ঈশোপনিষদ্‌ (ঈশ উপনিষদ্‌) --মূল মন্ত্র, অর্থ, নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা সহ। (Ishopanishad --Isha Upanishad in Bengali language with original texts, annotaions, meanings, etymolgies and explanation.)

ঈশোপনিষদ্‌।

ব্রহ্মখণ্ড (সারাংশ)।

যিনি ভিন্ন অন্য কেউ নেই, যাঁর থেকে আমাদের জন্ম, যাঁতে স্থিতি এবং যাঁতে আমরা লীন হই, যিনি আততম (আতত +ম), অর্থাৎ যিনি সব কিছুতে বিস্তৃত (আতত) এবং সকলকে অতিক্রম করে বিস্তৃত (*ম), তিনি সকলের মধ্যে  স্থিত আত্মা। (* 'ম' অর্থে 'চরম' বা 'আত্যন্তিক' বোঝায়।) 

এই আত্মা একদিকে অসঙ্গ, নির্লেপ, নিষ্কল, নিষ্ক্রিয় আবার ইনি প্রাণময়, কামময়, সকল কিছুর কর্ত্তা, সকল কিছুর বিজ্ঞাতা। 'কে আত্মা' , এই প্রশ্নের উত্তরে, ঋষি বলেছেন, ' যিনি আমাদের প্রাণ সকলের মধ্যে বিজ্ঞানময় এবং হৃদয়ে অন্তর্জ্যোতি'।(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৪।৩।৭ দ্রষ্টব্য। )

আত্মা জ্ঞানময়। ইনি একই সাথে বিশুদ্ধ নিজ বা আত্মবোধ স্বরূপ এবং প্রাণময়, বোধময়, চিৎ-চাঞ্চল্যময়। সমস্ত বিশ্ব এই আত্মার জ্ঞান বা বোধক্রিয়ার থেকে জাত। আমার নিজেরাও জ্ঞানময় বা অনুভূতিময়। আমরা যা কিছু জানি তা এই জ্ঞান বা বোধেরই মূর্ত্তি এবং এর নাম বেঁচে থাকা। এই আত্মা আছেন বলেই বা এঁর নিজত্ব নিয়েই আমরা আত্ম-পরিচয় দিই বা আমরা নিজবোধ-যুক্ত। আমি বা অহং বোধ এই নিজবোধের উপরই ফুটে আছে এবং নিদ্রা বা মৃত্যুর সময় এই নিজেতেই 'আমি' বিলীন হই। আমরা যে জ্ঞান বা বোধের বিশ্বে রয়েছি, এইটি দেখা অভ্যাস হতে থাকলে, প্রতি জ্ঞান বা বোধের মূলে এই অপরিণামী, চিরস্থির নিজ বা আত্মবোধের দিকে দৃষ্টি পড়ে যায়। আমাতে যত বোধ বা অনুভূতি ফুটছে, তার সাথে আমি বা যে 'অহং' অভিমানী সে জড়িয়ে থাকে বা সঙ্গত হয়ে থাকে।প্রতি মুহূর্ত্তে আমি নানা বোধময় হয়ে নিজের অন্তরে জ্ঞান বা বোধ ভূমিতে জাত হচ্ছি, নিরন্তর জাত হচ্ছি এই নিজ বা আত্মবোধ থেকে। এই আত্মাই নিরন্তর অহং এবং তৎ-সংশ্লিষ্ট সর্ব্ব বোধ বা অনুভূতির আকারে জাত হচ্ছেন, এবং তাকে আমরা আমাদের বোধ বা অনুভূতি বলে ধারণা করছি। নিরন্তর জাত হচ্ছেন, তাই এঁর নাম 'নিজ'। আবার এত কিছু হয়েও ইনি যেমন, তেমনই থাকেন, পরিবর্ত্তন হীন, স্থির, অব্যয়। সেই জন্য 'নিজ' শব্দের আর একটি অর্থ হলো 'নাস্তি জন্ম যস্য'----- যিনি জন্মান না, যিনি 'অজ'। প্রতি জীব বা প্রতি সত্তায় এঁকে যখন স্বতন্ত্র ভাবে দেখা হয় বা সম্বোধন করা হয়, তখন এঁর নাম ' ক্ষর আত্মা', 'প্রত্যক্‌ আত্মা', 'অণু-আত্মা'। ইনিই সর্ব্ব-ভূতের, সর্ব্ব জীবের আত্মা, এই দর্শন হলে এঁকে 'অক্ষর আত্মা, কূটস্থ আত্মা' ইত্যাদি বলা হয়। এঁর থেকেই ক্ষরিত হয়ে সবাই হয়েছে, এবং ইনি ক্ষরিত হয়েও ক্ষরিত হননি, তাই ইনি অক্ষর, আর প্রতি জীবে ইনি ক্ষর। আর ইনি ক্ষর এবং অক্ষর উভয়ই, তাই এঁকে পরমাত্মা বা পুরুষোত্তম বলা হয়। এই আত্মা স্বয়ংপ্রকাশ, অর্থাৎ ইনি নিজেই নিজেকে নিজের দ্বারা প্রকাশ করেন। এই জন্য ইনি স্বয়ংশক্তি, কেননা এই প্রকাশ শক্তি ইনি নিজেই। ইনি অসঙ্গ, অর্থাৎ সকল কিছু হয়েও কোন কিছুতে লিপ্ত বা সঙ্গবান হন না, আবার যেহেতু ইনি নিজেই সব, ইনি ভিন্ন আর কোথাও কেউ নেই তাই ইনি অসঙ্গ; কেননা নিজেই যখন সব, তখন কে কাতে সঙ্গত হবে, বা সঙ্গত হয়েও অসঙ্গই থাকেন।  এই যে আত্মশক্তি বা জ্ঞানশক্তি আর আত্মা, এঁরা একান্ত ভাবে অভেদ। ইনি দেখেন না তা নয়, ইনি দেখেও দেখেন না, কেননা ইনি দ্রষ্টা এবং দৃশ্য উভয়ই; ইনি শোনেন না তা নয়, ইনি শুনেও শোনেন না, কেননা ইনি  শ্রোতা এবং শব্দ  উভয়ই; ইনি আঘ্রাণ করেন না তা নয়, ইনি আঘ্রাণ করেও আঘ্রাণ করেন না, কেননা ইনি ঘ্রাতা এবং ঘ্রাণ উভয়ই; এই প্রকারই সব। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৪।৩।২৩ মন্ত্র এবং পরবর্ত্তী মন্ত্রগুলি দ্রষ্টব্য।)।  ইনি দর্শন করে চক্ষু হন (পশ্যন্‌ চক্ষুঃ ), শ্রবণ করে শ্রোত্র হন (শৃন্বন্‌ শ্রোত্রঃ), মনন করে মন হন (মন্বানো মন:), ইত্যাদি (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৪।৭ দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ ইনি যা হন, সেই হওয়াটাকে জানেন  বা অনুভব করেনইনি যে জানছেন বা বোধময় হচ্ছেন, তার দ্বারা আমাদের পরিবর্ত্তন হচ্ছে। এঁর জানা বা বোধ থেকে সব হচ্ছে, তাই এঁর জানা বা বোধক্রিয়ার  নাম 'সম্ভূতি'। আর সেই সম্ভূতিতে যা কিছু সৃষ্ট হয়েছে, তদনুসারে আমরা অনুভব করছি, অর্থাৎ বহির্বিশ্বে যা কিছু সৃষ্ট হয়েছে, তা আমাদের অন্তরে অনুভূতি ফোটাচ্ছে। এই অনুভূতি বা বোধের দ্বারা আমরা ক্রমশঃ পরিবর্ত্তিত হচ্ছি, ক্রমশঃ উন্নততর মানসিকতা সম্পন্ন হচ্ছি, নিজের অবিনশ্বরতা সম্বন্ধে, নিজের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছি।এর নাম অভ্যুদয় এবং বিবর্ত্তন। এই ভাবে ইনি যে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন, এই জন্য এঁকে নিয়ন্তা অথবা ঈশ্বর বলা হয়। নিজেকে বহু করে, অনন্ত অনন্ত জীব হয়েছেন এবং প্রতিটি সৃষ্ট জীবের অন্তরে ইনি ক্ষর আত্মা হয়ে বিরাজ করছেন। প্রতিটি জীবের মধ্যে, সৃষ্টির প্রতিটি কণাতে, ঈশ্বরত্বের দ্বারা তিনি তাঁর পরম আত্মস্বরূপতাকে, ব্রহ্মত্বকে জাগিয়ে তুলছেন। মৃত্যুর দ্বারা ছিন্ন, সীমিত, পুনঃ পুনঃ বাধ্যতা-মূলক যে জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত্তন তা চিরকালের জন্য আমাদের থেকে তিরোহিত হবে।মুক্ত দর্শন, মুক্ত শ্রবণ, মুক্ত মনন ইত্যাদি আমাদের  স্বভাবিক বৃত্তি হবে। একদিন প্রত্যেকে ' অহং ব্রহ্মাস্মি' (আমি ব্রহ্ম) এই আত্ম পরিচয় দিয়ে নিজের পরম স্বরূপেই নির্বাণ প্রাপ্ত হবে। 

এই উপনিষদে বিশেষ ভাবে আত্মার ঈশিত্ব, সেই ঈশিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে জীবন নির্ব্বাহ, সম্ভূতি এবং দেবময় বিশ্ব, অনুভূতিময় জীব ও জীবের অভ্যুদয়, এবং অন্তকালে এই নশ্বর শরীর পরিত্যাগ করে মহাপ্রাণে, অনিলে, প্রাণাগ্নিতে যে এই পার্থিব জীবনের সমাপ্তি, তা উক্ত হয়েছে।

মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৪৫) এবং তাঁর প্রধান শিষ্য মহর্ষি ত্রিদিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপদেশ অনুসরণ করে এই উপনিষদের অর্থ, নিরুক্ত এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা যথা সম্ভব প্রকাশ করা হলো।    

(debkumar.lahiri@gmail.com)    

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------                -                                                                                                                                                             

শান্তি পাঠ।

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্‌ পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।

ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ।।


অন্বয় -অর্থ।


ওঁ পূর্ণম্‌ অদঃ (উহা)—ওঁ, উহা পূর্ণ।

পূর্ণম্‌ ইদম্‌ (ইহা) —ইহা পূর্ণ।  

পূর্ণাৎ (পূর্ণ থেকে) পূর্ণম্ (পূর্ণ) উদচ্যতে (উদিত হন)

পূর্ণস্য (পূর্ণের) পূর্ণম্‌ (পূর্ণকে) আদায় (গ্রহণ করলে) পূর্ণম্‌ এব (পূর্ণই) অবশিষ্যতে (অবশিষ্ট থাকে)

ওঁ শান্তিঃ (ওঁ শান্তি) ওঁ শান্তিঃ (ওঁ শান্তি) ওঁ শান্তিঃ (ওঁ শান্তি)


অর্থ।

ওঁ, উহা পূর্ণ, ইহা পূর্ণ। পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদিত হন

পূর্ণের পূর্ণকে গ্রহণ করলে পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে। 

ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি। 


নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।


অদঃ' শব্দটিঅসৌশব্দের রূপ। বেদেঅসৌ' এই সর্ব্বনামটি আদিত্যের (আত্মাদিত্যের) সাথে অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়েছে। যা কিছুঅদনীয়' বা খাদ্য বা যা ভোগ্য, তা আদিত্যের বা কালের প্রকাশ।আদিত্যের (আত্মাদিত্যেরথেকেঅদ্য’ (কাল, বিশ্ব) প্রকাশ পাচ্ছে। তাই 'পূর্ণমদঃঅর্থে যাঁর থেকে সৃষ্টি প্রকাশ পাচ্ছে তিনি পূর্ণ। 

আবার যা কিছু ইদং-পদবাচ্য বাইহ', যা কিছুসৃষ্ট' হয়েছে , তাও পূর্ণ।পরম-আত্মস্বরূপ যিনি, তিনি পুর্ণ, এবং তিনিই নিজেকে বিশ্বের আকারে সৃষ্ট করেছেন, এবং তিনি নিজেই সৃষ্টি। তাই এই সৃষ্টির প্রতিটি সত্তা পূর্ণ। এই জন্য পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদিত হন।

এই আত্মা অক্ষর, ইনি ক্ষরিত হয়েও অক্ষয়ই থাকেন। তাই ইনি অনন্ত। এই জন্য পূর্ণের পূর্ণকে গ্রহণ করলে পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে।

শান্ত দ্যুলোক (যার অন্তরে আদিত্য)যে লোক থেকে সকল কিছু প্রকাশ পায়, কেননা এই লোক এই এক আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত।

শান্ত অন্তরীক্ষ, যে লোক দ্যু এবং পৃথিবী বা মূর্ত্ত বিশ্বকে যুক্ত করেছে, কেননা এই লোক এই এক আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত।

শান্ত পৃথিবী, যা এই মূর্ত্ত বিশ্ব, যেখানে আমরা সবাই পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে মূর্ত্ত হয়েছি, কেননা এই লোক এই এক আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত।

মন্ত্র, মন্ত্রার্থ এবং নিরুক্ত।

১ম মন্ত্র।

ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্‌।।

অন্বয়-অর্থ।

ঈশা ---ঈশ্বরের দ্বারা; বাস্যম্‌---আচ্ছাদিত; ইদম্‌---ইহা, এই; সর্ব্বং---সকল; যৎকিঞ্চ--যা কিছু; জগত্যাং---জগতে;

জগৎ---গতিশীল 

তেন---তার দ্বারা; ত্যক্তেন---ত্যাগের দ্বারা; ভূঞ্জীথা------ভোগ করবে; মা (না) গৃধঃ (কামনা করো)---কামনা করো না

কস্য (কারোর) স্বিৎ---কস্য স্বিৎ--- কদাপি কারোর; ধনম্‌---ধনকে

অর্থ। 

ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত এই সকল, যা কিছু এই জগতে গতিশীল। তার দ্বারা (এই জ্ঞানের অনুশীলনের দ্বারা) ত্যাগ করে ( যা বর্জ্জন করার তা বর্জ্জন করে) ভোগ করবে। কদাপি কারোর (অন্যের) ধনকে কামনা করো না। 

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

১-১। 'ঈশা'

ঈশা শব্দটি ঈশ শব্দ থেকে হয়েছে। ঈশা অর্থে ঈশ বা ঈশ্বরের দ্বারা।  ঈশ = ঈ+শ। 'ঈ' এই অক্ষরের অর্থ শক্তি বা চিৎশক্তি। শক্তি অর্থে যার দ্বারা কোন পরিবর্ত্তন সাধিত হয়। 'শ' অর্থে  শয় বা শয়ন। যিনি শায়িত থেকেও বা নিষ্ক্রিয় হয়েও সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সক্রিয় করে রেখেছেন, বা কালাবর্ত্তনময় করেছেন, তিনি ঈশ্বর বা ঈশ। যিনি সবার আত্মা, যাঁকে সবাই 'নিজ' বা 'আত্ম' বলে বোধ করে, তিনিই ঈশ বা ঈশ্বর। এই আত্মা যুগপৎ নিষ্ক্রিয় এবং সক্রিয়, নির্গুণ এবং সগুণ, অরূপ এবং রূপময়, অসঙ্গ এবং সঙ্গবান্‌। আত্মার এই উভয় স্বরূপ বা উভয়-লিঙ্গত্বের উল্লেখ উপনিষদে বারবার করা  হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কঠোপনিষদের একটি মন্ত্র উল্লেখ করা হলো। 

' আসীনো দূরং ব্রজতি শয়ানো *যাতি সর্ব্বতঃ।

কস্তং মদামদং দেবং মদন্যো জ্ঞাতুমর্হতি।।' ( কঠোপনিষদ মন্ত্র ১।২।২১।)

মন্ত্রার্থ। 

আসীন থেকেও যিনি দূরে গমন করেন, শায়িত থেকেও যিনি সর্ব্বত্র সংযমন বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেই হর্ষময় এবং হর্ষবিহীন দেবতাকে আমি ভিন্ন (আমার মতো জ্ঞাতা ভিন্ন) আর কে জানতে পারে। 

(* 'যাতি' শব্দটি 'যা' ধাতু থেকে হয়েছে। যা অর্থে 'যমন, সংযমন বা নিয়ন্ত্রণ করা। )  ( কঠোপনিষদ মন্ত্র ১।২।২১।)

১-২। 'ঈশা বাস্যম্‌ ইদম্‌ সর্ব্বম্‌  

  বাস্যম্‌---আচ্ছাদিত। 

'বাস্যম্‌'  শব্দটি 'বস্‌' অথবা 'বাস্‌' ধাতু থেকে হয়েছে। বস্‌ ধাতু থেকে বসন বা আচ্ছাদন শব্দটি হয়েছে।

সুতরাং ' ঈশা বাস্যম্‌ ইদম্‌ সর্ব্বম্‌ ' এই বাক্যের অর্থ  ঈশ্বর বা আত্মার ঈশ্বিত্বের দ্বারা সকল কিছু আচ্ছাদিত বা ঈশ্বর বা আত্মার ঈশ্বিত্বের দ্বারা সকল কিছু বসবাস করছে।

আত্মার ঈশিত্ব বা নিয়ত্রণ যে ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় তার নাম দেবক্ষেত্র বা দ্যুলোক। আর যে দেবতাদের (আত্ম স্বরূপের বিশেষ অভিব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বদের) মধ্য দিয়ে এই সত্য, বাস্তব বিশ্বকে পেয়ে আমরা বিশ্বের এবং নিজেদের অস্তিত্ব বোধ করছি, তাঁদের নাম বসু। বস্তু সকল বা বাস্তব বিশ্বের মূলে এঁরা আছেন, তাই এঁদের নাম বসু। স্থূল, বাস্তবিকতাময় আমরা শরীর রূপ বসনের দ্বারা আচ্ছাদিত বা আবৃত। বসু, বাস,বসন, বস্তু এই শব্দগুলি সম্বন্ধযুক্ত এবং একই রকম অর্থ বা ভাব প্রকাশক। 

পরম আত্মস্বরূপ, যাঁর থেকে আমরা জাত হয়েছি, তিনি তাঁর ঈশিত্বের দ্বারা আমাদেরকে নিজেতে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এই যে ফিরে যাওয়া বা প্রত্যাবর্ত্তন, এর থেকে আমাদের জন্মজন্মান্তর এবং বিবর্ত্তন হচ্ছে, আমাদের অভ্যুদয় হচ্ছে, আত্মজ্ঞতার পথে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। প্রতি মূহুর্তে আমার চেতনায় যা ফুটছে, আমার যে অনুভূতি হচ্ছে, সেইটি এই প্রত্যাবর্ত্তনের অংশ।এর নাম ' ঈশা বাস্যম্‌' বা ঈশিত্বের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে বসবাস করা বা জীবন যাপন করা।

১-৩। ভুবনস্য গোপ্তা। গোপাল, গোপ এবং  গোপী। 

এই যে প্রাণের দ্বারা বা ঈশিত্বের দ্বারা আমরা আচ্ছাদিত, এর একটি নাম 'গোপন' করা, এবং যিনি এইটি করেন , তাঁর নাম 'গোপ্তা'। বিপুল প্রাণের প্রকাশকে নিয়মিত করে,মাত্রা দিয়ে, আমাদের উপযোগী করে, তিনি এই ধরিত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। এই জন্য উপনিষদে এঁকে 'ভুবনস্য গোপ্তা' বলা হয়েছে। (মুণ্ডক উপনিষদ্‌, মন্ত্র ১।১।১ দ্রষ্টব্য।)

যিনি এইভাবে আমাদের আচ্ছাদন করে, বসনাবৃত করে পালন করেন, তাঁর নাম 'গোপাল' এবং 'গোপ'। যাদের দ্বারা আমরা সক্রিয় বা বিচরণ করি, এবং পুষ্ট হই, তাদের নাম 'গো'। 'গো' শব্দের অর্থ 'ইন্দ্রিয়'।  'গো' শব্দটি 'গম্' ধাতু থেকে হয়েছে, যার নাম 'গমন করা'। এই ইন্দ্রিয়গুলি কে যিনি পালন করে আমাদের সক্রিয় করেছেন, তিনি 'গোপাল'। যেটুকু আমরা নিতে পারি, শুধু সেই রকম মাত্রায়, শব্দ, স্পর্শ,রূপ,রস,গন্ধ কে পরিমিত করে দিচ্ছেন। এইটি বসন বা আচ্ছাদনের দ্বারা হচ্ছে। 'বাস্যম্‌' শব্দটির এই হলো তাৎপর্য। 

১-৪। 'যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ'---- যা কিছু এই জগতে গতিশীল।

যৎকিঞ্চ---যাহা কিছু, জগত্যাং---জগতে,  জগৎ---জগৎ বা গতিশীল।

এখানে 'জগতে যা কিছু জগৎ' এই বাক্যে দুইবার জগৎ শব্দ প্রয়োগ করার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। 

জগৎ অর্থে যা গতিময় বা গতিয়ুক্ত। যেকোন গতির মূলে আছে 'কাল'। কালের দ্বারা অবস্থান্তর হ্য় বা একটি অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় সংক্রমণ হয়। কোন বস্তু বা প্রাণী যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় তখন তা গতির দ্বারাই হয়; আবার কোন প্রাণী যখন এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্ত্তিত হয়, সেটিও একটি গতি। আর এই গতি, কাল গতি, বা কাল প্রসূত। 

আমাদের যে দিন রাত্রি হয়, তা পৃথিবী নিজের অক্ষকে অবলম্বন করে আবর্ত্তন করছে বলে। এই অহো-রাত্রোময় বা দিন-রাতময় যে জীবন আমরা যাপন করছি, তার নাম, বা এই কালের নাম 'বর্ত্তমানতা'। আবর্ত্তন থেকে বর্ত্তমানতা। এইটি এক ধরণের কাল বা চেতনার বা চিৎ স্বরূপ আত্মার নিয়ন্ত্রণ। এইটিকে ব্রহ্মার কালও বলে এবং  এইটি থেকে  বর্ত্তমানতা বা অস্তিত্ব বোধ হচ্ছে। সৃষ্টি, স্থিতি,এবং লয়, এই ত্রিভঙ্গিম বা ত্রিবিক্রম কাল যাঁর থেকে প্রকাশ পাচ্ছে, তিনি বিষ্ণু। ।এই কালের নাম বর্ষ বা বৎসর। দিন-রাত গুলি বর্ষিত হচ্ছে। এই জন্য কালের বাহককে বৃষ বলা হয়। তাহলে যা বর্ত্তমানতা (বা ব্রহ্মার কাল) তা এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ময় বিষ্ণুর কালের অন্তর্গত। আবার আমাদের প্রতি মুহূর্ত্তটাও সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ময়। কাল যাঁতে অক্রম, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যাঁতে একই সাথে,  তিনি মহাকাল বা মহেশ্বর। এই যে বর্ত্তমানতার মধ্যে সৃষ্টি-স্থিতি-লয় চলছে, এর নাম কালের মধ্যে কাল বা, গতির মধ্যে গতি বা  'জগত্যাং জগৎ'।

১-৫। ত্রিকাল।

কাল তিনটি। ব্রহ্মার কাল, যার বৈশিষ্ট্য হল বর্ত্তমানতা।  

বিষ্ণুর কাল, যার বৈশিষ্ট্য হলো 'অয়ন, সংক্রমণ---সৃষ্টি থেকে লয় এবং লয় থেকে সৃষ্টিতে আবর্ত্ততিত হওয়া এবং সেই আবর্ত্তনে নিজের প্রকাশ, বা ব্যাপ্তি (স্থিতি) রচনা করা। এই জন্য ঋক্‌ বেদে, বিষ্ণুর পদ (পরমম্‌ পদম্‌ ) বা কাল গতি এবং সর্ব্বব্যাপী প্রকাশবান্‌ চক্ষু (দিবীব চক্ষুরাততম্‌) বা কাল থেকে যা প্রকাশ পেয়ে ব্যাপ্তি বা স্থিতি রচনা করছে তার কথা বলা হয়েছে। (এই বিষ্ণুর তেজই, পৃথিবীর আকাশে সূর্য। সূর্যর থেকে কাল (বৎসর, মাস, দিন-রাত ইত্যাদি) প্রকাশ পাচ্ছে এবং রূপ, আলো বা দৃষ্টি প্রকাশ পাচ্ছে। চেতনার চক্ষু মানেই রূপ-প্রকাশ ও রূপ অনুভব করা, এবং কাল প্রকাশ বা গতিময় হওয়া বা চলা এবং সেই গতির ভোক্তা হওয়া। ( দেখা মানেই চলা, যা দেখছি তাতে উপনীত হওয়া।)

মহেশ্বরের কাল বা মহাকাল---- সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এই তিনটি ক্রম যেখানে একত্রে বা অক্রমে থাকে তার নাম মহাকাল। এই ক্ষেত্রে কাল বীজাকারে থাকে। এখানে একটি ক্ষণেই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় রয়েছে। 

১-৬। বাস্যম্‌--বাস--সুবাস--গন্ধ----পৃথিবী। আহ্নিক গতি এবং গন্ধতত্ত্ব।

আমরা আগে বলেছি যে আত্মার ঈশিত্বের দ্বারা সবাই বসবাস করছে, বসনের দ্বারা আবৃত হয়েছে, একটি আয়তন বা শরীর রূপ বসন পেয়ে তার মধ্যে বসবাস করছে। বস্তুময়, স্থূল বা ভৌতিক বিশ্বের সাধারণ নাম 'পৃথিবী', যার অন্য নাম 'বসুন্ধরা'। পৃথিবী হলেন সেই দেবী, যাঁতে সকলে পৃথক্‌ পৃথক্‌ আয়তনময় বা শরীরী হয়ে বাস করছে। আমাদের শরীর এই পৃথিবীরই অংশ। উপনিষদে পৃথিবী এবং শরীর সমার্থক। পৃথিবী শব্দের দ্বারা ধরিত্রীকে বোঝায়, যিনি সমগ্র বস্তুময় বিশ্বকে ধারণ করেছেন, এবং তা উপনিষদের নিম্নে উদ্ধৃত এই মন্ত্রটিতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতস্মাৎ জায়তে প্রাণো মনঃ সর্ব্বেন্দ্রিয়ঃ চ।

খং বায়ুঃ জ্যোতিরাপঃ পৃথিবী বিশ্বস্য ধারিণী।। (মুণ্ডক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।১।৩।)

অর্থ।

এতস্মাৎ (এঁর থেকে ) জায়তে ( জাত হয় ) প্রাণো (প্রাণ ) মনঃ ( মন ) সর্ব্বেন্দ্রিয়ঃ ( সর্ব্বেন্দ্রিয় ) চ (এবং )----এঁর (এই পরম আত্মস্বরূপ) থেকে প্রাণ, মন এবং সর্ব্বেন্দ্রিয় জাত হয়েছে।

খং (আকাশ) বায়ুঃ (বায়ু) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) আপঃ (আপ্‌/জল) পৃথিবী ( পৃথিবী ) বিশ্বস্য ( বিশ্বের ) ধারিণী (ধাত্রী)---আকাশ, বায়ু, জ্যোতি, আপ্‌ (জল), বিশ্বের ধাত্রী পৃথিবী।।

এঁর (এই পরম আত্মস্বরূপ) থেকে জাত হয় প্রাণ, মন এবং সর্ব্বেন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, জ্যোতি, আপ্‌ (জল), বিশ্বের ধাত্রী পৃথিবী । (মুণ্ডক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।১।৩।)

এই পৃথিবীর অন্য নাম ক্ষিতি, কেননা, এখানে সবাই ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, মরণশীল বা মর্ত্ত্য। ঋষিরা বলেছেন, যা ক্ষিতি তত্ত্ব, তার তন্মাত্রা হল গন্ধ। পৃথিবী যেমন নিজের অক্ষে আবর্তন করছে যার নাম আহ্নিক গতি (যার থেকে দিন ও রাত হচ্ছে), সেই রকমই আমাদের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস রূপে প্রাণ বায়ুর আবর্ত্তন চলছে। যা এই পৃথিবীর আহ্নিক গতি, নিজের চারিদিকে ঘূর্ণন, তাই আমাদের শরীরে শ্বাস-প্রশ্বাস রূপ বায়ুর বা প্রাণের আবর্ত্ত, এবং তার দ্বারা আমাদের  শারীরিক বা পার্থিব স্থিতি সম্ভব হয়েছে। নাসার দ্বারা যে গন্ধ আঘ্রাণ করা, আর শ্বাস-প্রশ্বাস, এই দুইটি বিচ্ছিন্ন ক্রিয়া নয়। এই জন্য উপনিষদে গন্ধকে 'প্রাণ' বলা হয়। গন্ধ মানেই গম্ (গতি) + ধ (ধৃত বা বিধৃত)----গতিকে আবর্ত্তের আকারে বিধৃত করে একটি স্থিতির রূপ নেওয়া। এই জন্য গন্ধকে 'বাস' বা 'সুবাস' বলা হয়' কেননা প্রাণের স্থিতি বা বাস করা মানেই গন্ধ বা সুবাস।সুতরাং 'বাস্যম্‌' শব্দের এইটি একটি তাৎপর্য। 

১-৭। ' তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা'--আত্মার ঈশিত্বকে স্বীকার করে লোকসকলকে মান্যতা। 

এই আত্মা থেকে সবাই জাত হয়েছে এবং এঁর দ্বারাই সবাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই জন্য বলা হয়েছে, 'ব্রহ্মা দেবানাং প্রথমম্‌ সংবভূব বিশ্বস্য কর্ত্তা ভুবনস্য গোপ্তা'----ব্রহ্মা দেবগণের মধ্যে প্রথমে সৃষ্ট হয়েছিলেন, যিনি বিশ্বের কর্ত্তা (স্রষ্টা) এবং ভুবনের পালয়িতা ( মুণ্ডক উপনিষদ্‌, মন্ত্র ১।১।১ দ্রষ্টব্য)। তাঁর এই সৃষ্টিকে স্বীকার করে, তাঁর দ্বারা যা কিছু বিধিত হয়েছে তাকে মান্যতা দিয়ে যদি চলতে হয়, তাহলে সকলের অধিকারকে মান্য করে, অন্যের অধিকারে যা আছে তার প্রতি লিপ্সা ত্যাগ করে, ঈশ্বরের দ্বারা যে ভোগ নিজের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে তার বাইরে না গিয়ে যে জীবন যাপন তা হলো ত্যাগের দ্বারা ভোগ করা।

১-৮।তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা----তার দ্বারা (এই জ্ঞানের অনুশীলনের দ্বারা) ত্যাগ করে ( যা বর্জ্জন করার তা বর্জ্জন করে ) ভোগ করবে। সেই যে ঈশিত্ব তাতে যে সবাই আচ্ছাদিত এইটি জানতে জানতে, বা স্বীকার করে, কাল যাপন করবে।

স্রষ্টা, ঈশিত্বের দ্বারা আমাদেরকে নিজেতে ফিরিরে নিচ্ছেন, এবং এইটি আমাদের প্রত্যাবর্ত্তন, বা মুক্তির পথে কালগতির দ্বারা বাহিত হয়ে চলা। এ কথা আগে বলা হয়েছে। এই ঈশিত্ব বা নিয়ন্ত্রণের দ্বারা আমরা প্রতি মুহূর্ত্তে পরিবর্ত্তিত হচ্ছি, পূর্ব্ব অবস্থা ত্যাগ করে নূতন অবস্থায় সংক্রমণ করছি। এর নাম 'ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা', এবং এই প্রজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কাল যাপন তার নাম ' তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা ' অর্থাৎ এই ঈশিত্ব দর্শন করতে করতে কর্ম্ম করা।

যিনি আমাদের মধ্যে জ্ঞান বা চেতনা, তিনি আমাদের এবং সর্ব্বভূতের আত্মা এবং ঈশ্বর। তিনি সব কিছুর জ্ঞাতা, তাই তিনি 'জ্ঞ' এবং তিনি নিজেকে সকল কিছুর আকারে জেনে সকল কিছু হয়েছেন। জানা মানেই, যা জানা হচ্ছে, তাই হওয়া। ইনি যে জানেন তার নাম 'অন' বা প্রাণ প্রকাশ। অন মানে অন্য বা দ্বিতীয় হওয়া, নিজেকে দ্বিতীয় করে সৃষ্টি করা। ইনি জেনেও বা প্রাণময় হয়েও, যেমন তেমনি থাকেন,  আর সেই অপরিনামী, স্থির, নিষ্ক্রিয় স্বরূপের নাম 'জ্ঞ', আবার অপরিনামী, স্থির, নিষ্ক্রিয় হয়েও সবাইকে বা সকল কিছুকে জানেন। এই জানাই প্রাণের প্রকাশ, যার বাইরের নাম 'কাল'। আর এই পরম আত্মস্বরূপের নাম 'জ্ঞান', এঁকে আত্মবোধ বা নিজবোধও বলা হয়। 

এই জ্ঞানকে দেখলে, নিজে যে জ্ঞান বা চেতনার বিশ্বে রয়েছি এবং ইনিই ঈশ্বর, এবং আমি এবং বিশ্ব এঁরই মূর্তি, এই প্রকার জ্ঞানের উন্মেষ হতে থাকলে, স্থূল, সীমিত, মরণশীল যে জীবন সেইটাকে পরিত্যাগ করে , চিন্ময়, অন্তহীন যে জীবন তার আবির্ভাব হতে থাকে। এই যে মর্ত্ত বা স্থূলত্ব বা মরণ কে ত্যাগ করে বাঁচা, এটিও 'ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা' বা ত্যাগের দ্বারা, মরণকে ত্যাগ করতে করতে ভোগ করা। 

এই প্রসঙ্গে উপনিষদের একটি মন্ত্র উদ্ধৃত করা হলো। (কেনোপনিষদ্‌ দ্বিতীয় খণ্ড, ৫ম মন্ত্র)। 

ইহ চেৎ অবেদীদথ সত্যমস্তি না চেদিহাভেদীনমহতী বিনষ্টিঃ।

ভূতেষু ভূতেষু বিচিত্য ধীরাঃ প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভাবন্তি। (কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।৫।)

অন্বয় ও শব্দার্থ।

ইহ (অত্র; ইহলোকে) চেৎ (যদি) অবেদীৎ (বিদিত হয়) অথ (তাহলে) সত্যম্‌ (সত্য) অস্তি (হয়)----যদি ইহলোকে (কেহ এই জ্ঞানস্বরূপ আত্মকে) বিদিত হয় তাহলে সত্য হয় (সত্য বা অবিনশ্বরতা লব্ধ হয়)

ন  চেৎ (যদি না) ইহ (অত্র; ইহলোকে) বেদীৎ (বিদিত হয়) মহতী (মহৎ) বিনষ্টিঃ (বিনাশ)---যদি না  ইহলোকে (কেহ এই জ্ঞানস্বরূপ আত্মকে) বিদিত হয় ( তাহলে ) মহৎ বিনাশ (হয়)

ভূতেষু (ভূতে বা প্রতি ভৌতিক বোধে) ভূতেষু (ভূতে বা প্রতি ভৌতিক বোধে) বিচিত্য (বিদিত হয়ে) ধীরাঃ (ধীর গণ) প্রেত্য (প্রস্থান করে) অস্মাৎ (এই) লোকাৎ (লোক থেকে) অমৃতাঃ (অমৃত) ভবন্তি (হন)-----ভূতে-ভূতে বা প্রতি বিষয় অনুভূতিতে বিদিত হয়ে ধীরগণ এই লোক থেকে প্রস্থান করে অমৃত হন।

অর্থ।

যদি ইহলোকে কেহ এই জ্ঞানস্বরূপ আত্মাকে বিদিত হয় তাহলে সত্য বা অবিনশ্বরতা লব্ধ হয়।যদি ইহলোকে (কেহ এই জ্ঞানস্বরূপ আত্মাকে) বিদিত না হয় তাহলে মহৎ বিনাশ হয় (মৃত্যু গ্রস্ত হয়)। ভূতে-ভূতে  (প্রতি বিষয় বোধে) (এই জ্ঞানস্বরূপ আত্মাকে বিদিত হয়ে ধীরগণ এই লোক থেকে (এই মরণশীল অবস্থা থেকে) প্রস্থান করে অমৃত হন। (কেনোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।৫।)

যিনি আমাদের মধ্যে জ্ঞান বা চেতনা, আমাদের প্রতি অনুভূতি বা বোধ তাঁরই প্রকাশ বা মূর্ত্তি, ঐ জ্ঞান স্বরূপই প্রতি মুহূর্ত্তে আমাদের এই ভাবে চেতায়িত এবং সক্রিয় করে রেখেছেন। এইটি ঈশিত্ব বা 'জ্ঞ'র অনময়তা বা প্রাণময়তা। প্রতি অনুভূতিতে এই দর্শনের দ্বারা ভৌতিক অবস্থাকে ত্যাগ করে জ্ঞানময় বা চিন্ময় স্বরূপে প্রবিষ্ট হয়ে, এই প্রকাবিজ্ঞাতা অমৃত লাভ করেন। এর নাম ' তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা'। 

১-৯। প্রবিবিক্তভুক্‌ আত্মা।

উপনিষদে উক্ত হয়েছে, যে আমরা যা কিছু খাই বা ভোগ করি, তার স্থূলাংশের দ্বারা স্থূলত্ব বা স্থূল শরীর বা ভৌতিক স্থিতি পুষ্ট হয়। আবার এই ভোগের যে সূক্ষ্মাংশ, তা চেতনার ভৌতিকতা বর্জ্জিত বা ভৌতিকতা ত্যক্ত যে স্বরূপ, যা বিশুদ্ধ জ্ঞানময়, তাতে নীত হয়।একথা উপনিষদে বর্ণনা করা হয়েছে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ৫।১৯।১ মন্ত্র এবং পরবর্ত্তী মন্ত্রগুলি দ্রষ্টব্য, ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৬।৬।১ থেকে ৬।৬।৫,  প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৫ দ্রষ্টব্য। )

যে ক্ষেত্রে এই সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম আত্মা নিজেকে স্থূল বলে বোধ করে বা জেনে, স্থূল বা ভৌতিক বিশ্ব হয়েছেন, সেখানে আত্মার নাম স্থূলভুক্‌। তাঁর যে স্থূলত্ব বা ভৌতিকতা তার দ্বারা আমরাও স্থূল বা ভৌতিক হয়ে ভৌতিক বিশ্বকে ভোগ করছি।

আর যেখানে, অন্তরীক্ষে, অন্তরে, এই স্থূলত্বকে বা ভৌতিকতাকে বর্জ্জন করে ভোগ করছেন সেখানে এঁর নাম প্রবিবিক্তভুক্‌ বা তৈজস আত্মা। ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৪।২।৩, মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌ ৪র্থ মন্ত্র  দ্রষ্টব্য।)

ভৌতিকতা বর্জ্জিত মানে যখন কোন কালগত বা দেশগত সীমার দ্বারা বদ্ধ নয়। যার কালগত সীমা নেই, সে কালের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না এবং সে ত্রিকালজ্ঞ। যার দেশগত সীমা নেই, সে সর্ব্বত্র স্থিতি নিতে পারে। তাই যে ভোগ ভৌতিক, তা কাল এবং দেশের (স্থানের) দ্বারা সীমিত, সুতরাং তা নানা ভাবে সীমিত এবং অস্থায়ী। যে ভোগ দেশ এবং কালের ঊর্দ্ধে, তার বৈচিত্র অনন্ত, কেননা সর্ব্ব দেশে সর্ব্ব কালে সেই ভোগের যে বৈচিত্র তাতে তা বিদ্যমান থাকে।

তাই আমরা যখন খাই বা কিছু বোধ করি, তার স্থূলাংশ যায় স্থূল শরীরে। তার সূক্ষ্মাংশ যায় শরীরের ঊর্দ্ধে যে জ্ঞানময় বা প্রাণময় সত্তা, তাঁতে। এই সূক্ষ্ম ভোগ যে ভাবে হয় তার বর্ণনা ছান্দোগ্য উপনিষদে ৫।১৯।১ মন্ত্র থেকে ৫।২৩।২ মন্ত্রে বিশদ ভাবে বলা হয়েছে। তা সংক্ষেপে নীচে বলা হলো।

এই যে অন্ন বা ভোগ যখন অন্তরে গৃহীত হয়, তার দ্বারা পঞ্চ প্রাণ (প্রাণ,ব্যান,অপান,সমান,উদান) তৃপ্ত হন।  প্রথমে প্রাণের যে চক্ষু বা দর্শনময়তা তা তৃপ্ত হয়। তার কারণ যা স্থূল বা ভৌতিক তার থেকে আমাদের সত্য বোধ হয়। যা দেখি, তাকে সত্য বলতে কোন অসুবিধা হয় না।তাই এই ভৌতিকতাকে যখন সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন যা প্রথম উপলব্ধি হয়, তা 'দর্শনময়তা' বা 'চক্ষু'। চক্ষু বা দৃষ্টি শক্তির আকারে যে প্রাণ আমাদের মধ্যে আছেন, তিনি যখন তৃপ্ত হন, তখন সূর্য  বা আদিত্য তৃপ্ত হন। তার কারণ, যা আমাদের মধ্যে চক্ষু বা দৃষ্টি শক্তি তা আমাদের যে বহিরাকাশ, তাতে আদিত্য রূপে বিরাজিত।আদিত্য তৃপ্ত হলে, দ্যু তৃপ্ত হন। দ্যু অর্থে মহাপ্রাণ যিনি নিজেকে দোহন করে বিশ্বভূবনকে প্রকাশ করেছেন, এবং তাঁর প্রকাশ কেন্দ্রের নাম আদিত্য। দ্যু তৃপ্ত হলে, যা কিছু  দ্যু এবং আদিত্য লোকে অধিষ্ঠিত তাঁরা তৃপ্ত হন, এবং এঁদের তৃপ্তির হেতু সেই ভোক্তাও তৃপ্ত হন, এবং প্রজা, পশু, ভোগ্য অন্ন, তেজ এবং ব্রহ্মবর্চ্চসের দ্বারা সেই ভোক্তা সমৃদ্ধ হন। একই ভাবে, ব্যান,অপান,সমান,উদান, এবং তাঁদের সাথে যুক্ত ইন্দ্রিয় শক্তিরা এবং দেবতারা তৃপ্ত হন।  আমরা দেখি বা না দেখি, অনবরত আমাদের প্রতি ভোগ বা অনুভূতি এইভাবে প্রাণ এবং তাঁর দেবময় যে মহিমা সকল, তাদের মধ্যে প্রসারিত হচ্ছে। আমরা যখন  খাই বা ভোগ করি, আমাদের সাথে পঞ্চপ্রাণ, দেবগণ এবং আমাদের অধ্যাত্মে এবং অধিদৈবে (দেবক্ষেত্রে) যাঁরা আছেন, তাঁরাও খান এবং ভোগ করেন। এই যে ভোগ বিতরিত হয়, এও ত্যাগ বা বিতরণ। (যাঁরা এইটি জানেন, তাঁরা বিতরণ হেতু বৈতরণী অনায়াসে পার হন।) আত্মার ঈশিত্ব দেখলে আমরা সজ্ঞানে এই দেবক্ষেত্রের সাথে এক হয়ে, আমাদের এই মরণশীল, সংকুচিত অবস্থাকে ত্যাগ করবো। এর নাম 'প্রবিবিক্তভুক্‌' হওয়া বা ত্যাগের দ্বারা ভোগ করা।

১-১০। মা গৃধঃ  কস্য স্বিৎ ধনম্‌---কদাপি কারোর ধনকে কামনা করো না।

অন্যের অধিকারে যা আছে তার প্রতি লিপ্সা ত্যাগ করে, ঈশ্বরের দ্বারা যে ভোগ নিজের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে তার বাইরে না গিয়ে যে জীবন যাপন তা হলো ত্যাগের দ্বারা ভোগ করা;  ত্যাগের দ্বারা যে ভোগ, এইটি তার একটি অর্থ । সুতরাং এই ব্রত বা এই ধর্ম্ম পালন করতে হলে পরের ধনের প্রতি ঈপ্সা পরিত্যাজ্য। 

কামনা করাই আমাদের স্বভাব। পরের ধনের প্রতি ঈপ্সা পরিত্যাজ্য হলেও, সেই ঈপ্সাকে সহজে পরিত্যাগ করা যায় না। যখন আমরা উপলবদ্ধি করি যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস,গন্ধ, নিজেরই বোধ বা অনুভূতির মূর্ত্তি, নিজের অন্তরেই তাদের বোধ করছি, তখন কামনার গতি বাইরে না গিয়ে ভিতরের দিকে চলে। যিনি জ্ঞান স্বরূপ, আমাদের মধ্যে প্রাণ বা চেতনা, যাঁর থেকে আমরা জন্মেছি, যাঁতে স্থিত, এবং যাঁতে লীন হই, তিনিই আমাতে বোধ বা অনুভূতির আকারে ফুটছেন, এইটি জানার দ্বারা 'পর' বা 'দ্বিতীয়তার' বোধযুক্ত বহির্মুখী যে ভোগ বা অনুভূতি তার থেকে মুক্ত হয়ে, ক্ষয়হীন, মৃত্যুহীন যে ভোগ তার সূচনা হয়। উপনিষদে অনুভুতিকে অবিদ্যা বলা হয়েছে, এবং এইভাবে অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়-----এই কথা এই ঈশোপনিষদে ঋষি পরে বলেছেন। ( দ্বিতীয়তার বোধ থেকে মৃত্যু হয় বা মৃত্যুকে নিজের অন্ত বলে বা নিজের বিলুপ্তি বলে মনে হয়।নিজেই নিজের অন্ত বা অন্তিম কাল হয়ে ফুটছি, এই জ্ঞান হলে আর মৃত্যুতেও মৃত্যুর দ্বারা সেই জ্ঞানী অভিভূত হন না।)

২য় মন্ত্র।

কুর্ব্বন্নেবেহ কর্ম্মাণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ।

এবং ত্বয়ি নান্যথেতো'স্তি ন কর্ম্ম লিপ্যতেনরে।।

অন্বয়-অর্থ। 

কুর্ব্বন্‌ ইব (কুর্ব্বন্ ----করে; কুর্ব্বন্‌ ইব--করেই) ইহ (ইহ লোকে) কর্ম্মাণি (কর্ম্মসকল; কর্ম্ম) জিজীবিষেৎ (জীবিত থাকতে ইচ্ছা  করবে) শতং (শত) সমাঃ (বৎসর; )---কর্ম্ম করেই বা কর্ম্মের দ্বারাই ইহলোকে শত বৎসর জীবিত থাকতে ইচ্ছা করবে

এবং (এই প্রকারই) ত্বয়ি (তোমাতে) না (না) অন্যথা (অন্যথা) ইতঃ (এখান থেকে) অস্তি (আছে) ন (না) কর্ম্ম (কর্ম্ম) লিপ্যতে (লিপ্ত হয়) নরে (নরতে) -----এবং (এই প্রকারই) অন্যথা (অন্যথা) ইতঃ (এর থেকে) ন অস্তি ( না আছে/ নেই) ত্বয়ি (তোমাতে), নরে (নরতে) ন (না) কর্ম্ম (কর্ম্ম) লিপ্যতে (লিপ্ত হয়) ----এই প্রকারই, এর থেকে অন্যথা নেই, যাতে  তোমাতে, নরতে (মনুষ্যতে) কর্ম্ম লিপ্ত না হয়।

অর্থ।

কর্ম্মের দ্বারাই (কর্ম্ম করেই) ইহলোকে শত বৎসর জীবিত থাকতে ইচ্ছা করবে---- এই প্রকারই, এর থেকে অন্যথা নেই, যাতে  তোমাতে, নরতে (মনুষ্যতে) কর্ম্ম লিপ্ত না হয়।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

২-১। কর্ম্ম। " ন কর্ম্ম লিপ্যতেনরে'"। 

আমরা সবাই কর্ম্মময়। 'যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ'---- যা কিছু এই জগতে গতিশীল, সেই সবই চাঞ্চল্যময়, অর্থাৎ কর্ম্মময়। সবাই কালের দ্বারা, প্রাণের দ্বারা চলেছে। এই মহাপ্রাণ আমাদের সবাইকে মৃত্যুর পরপারে নিয়ে চলেছেন। এ কথা উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে। মৃত্যুর থেকে দূরে নিয়ে চলেছেন, বা মৃত্যু এঁর থেকে দূরে থাকে, তাই মুখ্যপ্রাণ বা মহাপ্রাণের নাম দুর্গা। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ মন্ত্র ১।৩।৯ থেকে ১।৩।১১ দ্রষ্টব্য।)

কর্ম্ম মানেই বোধ বা অনুভূতিময় হওয়া। যে কর্ম্ম যে প্রকার বোধ বা অনুভূতিময় হয়ে আমরা করি, সেই কর্ম্মের ফল সেই প্রকার হয়, অর্থাৎ আমাদের পরিণতি সেইরকম হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ সেইভাবে নির্ম্মিত হয়। কর্ম্ম-কালীন অনুভূতি অনুসারে কর্ম্মের ফল হয়। অনুভূতি-হীন বা উপলব্ধি-হীন কর্ম্মের থেকে বিশেষ কিছু লাভ হয় না। 

প্রতি কর্ম্ম যে আমার জ্ঞানেই হচ্ছে, যিনি আমাতে জ্ঞ বা আত্মা, তিনিই 'অন', প্রাণ, চেতনা বা কর্ম্ম-চাঞ্চল্যর আকারে আমাতে সর্ব্বদা প্রকাশ পাচ্ছেন আমাকে চেতায়িত রাখতে, এবং ক্রমশঃ আত্মজ্ঞতার পথে আমাকে নিয়ে যেতে। এইটি আত্মার ঈশিত্ব বা নিয়ন্ত্রণ এবং এইজন্য কর্ম্মের কথা বলা হয়েছে।

কর্ম্ম== ক+ঋ+অ+ম। ঋ অর্থে গতি। সুতরাং কর্ম্ম অর্থে ক থেকে ম পর্যন্ত বর্ণ প্রবাহ বা প্রাণ প্রবাহ, বা ব্যঞ্জনময়, প্রকাশাত্মক চিৎগতি বা প্রাণগতি।

ক থেকে ম পর্যন্ত যে ব্যঞ্জন বর্ণ সকল, তাদের নাম স্পর্শ বর্ণ। জিহ্বা,তালু, দন্ত,এবং অধরোষ্ঠ এই সব অবয়বদের স্পর্শ থেকে এই স্পর্শবর্ণ সকল উচ্চারিত হয়। স্পর্শ অর্থে 'বায়ু' বা 'প্রাণ'। প্রাণ-প্রবাহই স্পর্শ। স্পর্শের দ্বারাই আমরা যা আমাদের থেকে ভিন্ন বা দ্বিতীয় তার সাথে যুক্ত হই। মৃত্যু দর্শন, দ্বৈতবোধ বা নানা অর্থাৎ ভিন্নতার বোধ  থেকে হয়। (মৃত্যোঃ স মৃত্যুম আপ্নোতি য ইহ.নানেব পশ্যতি.....মৃত্যুর থেকে সে মৃত্যুকে পায় যে এখানে নানা (দ্বিতীয়) দর্শন করে। কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।১।১০ থেকে উদ্ধৃত। )। স্পর্শের যে অনুভূতি তার জ্ঞানেন্দ্রিয় হল অধরোষ্ঠ এবং ত্বক, আর কর্ম্মেন্দ্রিয় হলো বাহু, যা আমাদের কর্ম্ম করার প্রধান অঙ্গ। কর্ম্ম করা মানেই দ্বিতীয় কিছুকে বা দ্বিতীয়তাকে স্পর্শ করা।

সুতরাং কর্ম্ম কে যত জ্ঞানময় বা আত্ম চেতনার প্রকাশ বলে অভ্যাস করা যায়, যে চেতনা এবং আত্মা সবার চেতনা এবং আত্মা, তখন সেই কর্ম্মের দ্বারা অমৃত লাভ হয়। দ্বিতীয় সঙ্গ না হয়ে আত্মসঙ্গ হয়।এর নাম " ন কর্ম্ম লিপ্যতেনরে'---কর্ম্ম বা দ্বিতীয় বোধের দ্বারা লিপ্ত বা অভিভূত হয়ো না।

২-২। জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ।

 জিজীবিষেৎ----জীবিত থাকতে ইচ্ছা করো। 

আমরা মরেই আছি। প্রতি মুহূর্ত্তে অস্তিত্ব রক্ষার তারনায় আমরা ত্রস্ত, এবং এর নাম বাঁচা নয়। তাই বলা হয়েছে, 'বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করো (জিজীবিষেৎ)', এবং যে বেঁচে থাকা 'অন্তে' নয়, পূর্ণতায় নিয়ে যাবে। এই পূর্ণতায় বাঁচার নাম 'শত বৎসর (শতং সমাঃ) ' বেঁচে থাকা। 

শত শব্দটি পূর্ণতাবাচক।'শ' বা 'শক্তি' যুক্ত হবার যে ক্রম বা ক্রমাঙ্ক তা শত। তাই কোনকিছু যদি 'শত' হয়, তাহলে তার উপর অধিকার এসে যায়। শত বৎসর আয়ু তখনি হয় যখন প্রাণ প্রবাহ বা আয়ু নিজেরই প্রবাহ বা বর্দ্ধন হয়ে যায়।নিজেকেই নিজের মধ্যে জন্ম থেকে মরণ অব্দি যত রূপ, সেই সর্ব্বরূপে পাচ্ছি, এতে পূর্ণতার উপলব্ধি হয়। 

'সমা' শব্দটির অর্থ 'বৎসর'। সমা অর্থে  'সম অয়ন'। কাল প্রকাশের সাথে সমতা রেখে যে চলা বা আবর্ত্তন, তা 'সমা' বা 'সমাবর্ত্তন'। 

২-৩। এবং ত্বয়ি নান্যথেতো'স্তি ন কর্ম্ম লিপ্যতেনরে-----এই প্রকারই, এর থেকে অন্যথা নেই, যাতে  তোমাতে, নরতে (মনুষ্যতে) কর্ম্ম লিপ্ত না হয়।

কর্ম্ম থেকে অন্যথা বা অন্য কোন স্থিতি বা অবস্থা সম্ভব নয়। আমরা নিচেষ্ট হতে প্রয়াসী হতে পারি, কিন্তু শারীরিক এবং মানসিক কর্ম্ম (অনুভূতি) চলতেই থাকবে।  

উপনিষদে বলা হয়েছে, পুরুষ মাত্রেই কামনা করছে, সেই কামনা থেকে সংকল্প বা ক্রতুময় হচ্ছে, এবং সংকল্প অনুযায়ী কর্ম্ম করছে, এবং যেমন কর্ম্ম করছে, সেইভাবেই তার পরিণতি বা বিবর্ত্তন হচ্ছে। যে কোন সত্তাই পুরুষ। যেহেতু সৃষ্টির আদিতে স্রষ্টা বহু হবার কামনা করেছিলেন এবং তাঁর থেকে সবাই সৃষ্ট হয়েছে, সেই রকম, প্রতি পুরুষ, বা যে কেউ সৃষ্ট হয়েছে, সেও কামময়, এবং সেইজন্য সে কর্ম্মময়। কর্ম্মের দ্বারাই আমরা বহু হই, নিজেদেরকে প্রসারিত করি।কামনার দ্বারাই, কর্ম্মের দ্বারাই আমরা অন্তরে বহু অনুভূতিময় হই বা বহু হই। তাই কর্মেন্দ্রিয়র নাম ' বাহু '। 

৩য় মন্ত্র।

অসুর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ। তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ।

অন্বয়-অর্থ।

অসুর্যা (অসুর্য ) নাম (নামক) তে (সেই) লোকাঃ (লোক সকল) অন্ধেন (অন্ধ) তমসা (তমসার দ্বারা) বৃতাঃ (আবৃত)-----অসুর্য নামক সেই লোক সকল, যা অন্ধ তমসার দ্বারা আবৃত

তান্‌ (তারা) তে (তথায়) প্রেত্য (প্রস্থান করে; মৃত্যুর পর প্রস্থান করে) অভিগচ্ছন্তি (গমন করে) যে কে চ (যারা যারাই) আত্মহনো (আত্মহননকারী) জনাঃ (লোকেরা, ব্যক্তিরা)----তারা মৃত্যুর পর প্রস্থান করে তথায় গমন করে, যারা যারাই আত্মহননকারী

অর্থ।

অসুর্য নামক সেই লোক সকল, যা অন্ধ তমসার দ্বারা আবৃত; যারা যারাই আত্মহননকারী, তারা মৃত্যুর পর প্রস্থান করে তথায় গমন করে।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

৩-১।অসুর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ---অসুর্য নামক সেই লোক সকল যা অন্ধ তমসার দ্বারা আবৃত। 

অসুর্য----অ (অল্প,নাস্তি) + সুঃ (সোম বা প্রাণ প্রবাহ) + য (যমন, নিয়ন্ত্রণ)। সু বা সোম বা প্রাণ প্রবাহ যেখানে নেই  বা অল্প বা  যমিত বা নিয়ন্ত্রিত, সেই রকম যা, তা অসুর্য। 

যেখানে প্রাণ চাঞ্চল্য স্তিমিত বা ক্ষীণ, সেই লোক অসুর্য।

সুর্য অর্থে সূর্যও হয়। সুতরাং অসুর্যা লোক অর্থে যেখানে সূর্য বা প্রাণের দীপ্তি প্রচ্ছন্ন। 

অসুর্য শব্দের আর একটি নিরুক্ত অনুচ্ছেদ ৩-৩ এ উল্লেখ করা হয়েছে।

৩-২।অন্ধেন তমসাবৃতাঃ----অন্ধ তমের দ্বারা আবৃত। 'তম' শব্দের একটি অর্থ  'আত্যন্তিক'। সুতরাং ' অন্ধ তমের দ্বারা আবৃত ' অর্থে, 'শুধুমাত্র অন্ধকার, তার বাইরে অন্য কিছু দৃষ্ট নয়'। 

৩-৩।তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ----যারা যারাই আত্মহননকারী, তারা মৃত্যুর পর প্রস্থান করে তথায় গমন করে।

'আত্মহনো জনাঃ' অর্থে যারা আত্মহননকারী। আত্মহনন অর্থে আত্মা, যিনি 'জ্ঞ' বা স্থির নিজবোধ স্বরূপ, যিনি আমাদের প্রতি অনুভূতি বা বোধক্রিয়ার মূলে রয়েছেন, তাঁকে না দেখা বা উপেক্ষা করার নাম আত্মহনন করা। নিজে বা নিজবোধ বা আত্মবোধ না থাকলে, কোন বোধ থাকে না। আমরা যখন ঘুমিয়ে পরি বা জ্ঞান হারাই, তখন এই  নিজেতেই ঘুমাই বা সংজ্ঞাহীন হই, আবার এই নিজেতেই জেগে উঠি। এই জন্য ঘুমের সময় 'অস্তি-নাস্তি' বোধ না থাকলেও, জাগ্রত হয়ে বা সংজ্ঞা লাভ করে, এই 'নিজবোধ' অবলম্বন করেই 'অহং বা আমি' বলে প্রকাশ পাই, এবং নিদ্রিত অবস্থায় যে ছিলাম, তাও ধারণা করতে পারি। অনাত্মজ্ঞতা হেতু, এই অন্ধকার আমরা কর্ম্মসাপেক্ষে সবাই মৃত্যুর পর  অল্পবিস্তর ভোগ করি। 

অসুর্যা শব্দের অর্থ পূর্ব্বে  ৩-১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। অসুর্যা শব্দের আর একটি অর্থ হলো, ' যা অসুরদের, বা যা আসুরিক ', এবং সেই হেতু অসুর্য বা আত্মজ্যোতি-হীন। অসু মানে প্রাণ এবং অসুর মানে যারা প্রাণের অসু বা রঞ্জনাতে আবিষ্ট হয়ে থাকে, কিন্তু যাঁর জ্যোতি বা প্রকাশ এই বিশ্ব হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে সেই প্রাণকে ( 'অন' কে) এবং প্রাণ যাঁর সক্রিয়তা সেই আত্মাকে ('জ্ঞ' কে) দেখে না। এই জন্য মৃত্যুর পর, অর্থাৎ যখন ভৌতিক-বিশ্ব তিরোহিত হয়, তখন তারা অন্ধকারই দেখে।

র্থ মন্ত্র।

অনেজদেকং মনসো জবীয়ো নৈনদ্দেবা আপ্নুবন্‌ পূর্ব্বমর্ষৎ।

তদ্ধাবতো'ন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি।।

অন্বয়-অর্থ।

অনেজৎ (ন এজৎ--কম্পিত হন না; স্থির) একং (এক) মনসঃ (মনের থেকে) জবীয়ঃ (বেগবান্‌ ) ন (না) এনৎ (এনাকে) দেবাঃ (দেবগণ) আপ্নুবন্‌ (আপ্ত হয়;  প্রাপ্ত হয়) পূর্ব্বম্‌ (পূর্ব্বেই) অর্ষৎ (ধাবমান্‌)-----অকম্পিত (স্থির), এক, মনের থেকেও গতিবান্‌, পূর্ব্বেই ধাবমান্‌ এনাকে দেবগণ প্রাপ্ত হন না।

তৎ (তিনি) ধাবতঃ (ধাবমান্‌ হয়ে; ধাবন করে) অন্যান্‌ (অন্যান্যদের) অতি এতি (অতিক্রম করেন) তিষ্ঠৎ (স্থির থেকেও) তস্মিন্‌ (তাঁতে) অপঃ (আপ্‌ কে, দিব্য জলকে) মাতরিশ্বা (বায়ু; প্রাণ) দধাতি (ধারণ করেন)----স্থির থেকেও, তিনি ধাবন করে অন্যান্যদের অতিক্রম করেন; তাঁতে মাতরিশ্বা (বায়ু; প্রাণ) অপ্‌ (দিব্য জলকে) কে ধারণ করেন।

অর্থ।

অকম্পিত (স্থির), এক, মনের থেকেও গতিবান্‌, পূর্ব্বেই ধাবমান্‌ এনাকে দেবগণ প্রাপ্ত হন না। স্থির থেকেও, তিনি ধাবন করে অন্যান্যদের অতিক্রম করেন; তাঁতে মাতরিশ্বা (বায়ু; প্রাণ) অপ্‌কে (দিব্য জলকে)  ধারণ করেন।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

৪-১। অনেজৎ --ন এজৎ--কম্পিত হন না। '

অনেজৎ' শব্দের আর একটি অর্থ, 'অন + এজৎ', অর্থাৎ 'অন' বা প্রাণ যাঁর 'এজন' বা কম্পন। এই জন্য উপনিষদে বলা হয়েছে, 'আত্মন এষ প্রাণো জায়তে'----আত্মা থেকেই এই প্রাণ জাত হন। (প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৩ দ্রষ্টব্য।) যিনি 'জ্ঞ' তাঁর থেকেই 'অন' বা প্রাণ জাত হন।

৪-২। অনেজদেকং---অনেজৎ একং।

এজন অর্থে কম্পন বা নিজের বাইরে না গিয়ে যে গতি, নিজেতেই নিজের গতি, এইটি এজন বা কম্পনের বৈশিষ্ট্য। এই জন্য 'এজন' শব্দের একটি অর্থ,  এ (এক) + জন (জায়মান্)---এক হয়েও জাত হওয়া বা দ্বিতীয় হওয়া। এই জন্য ' অনেজৎ একং' বলা হলো।

৪-৩। মনসঃ জবীয়ঃ --- মনের থেকে বেগবান্‌। মাতরিশ্বা। 

প্রথমে বলা হলো, এই আত্মা এজন বিহীন, বা অকম্পিত। তারপর বলা হলো,  ' মনসঃ জবীয়ঃ --- মনের থেকে বেগবান্‌'।  দ্বিতীয়তা না থাকলে গতি হয় না। দ্বিতীয়তায় গতি নেওয়ার অর্থ বহু হওয়া, বা সৃষ্টি করা।আত্মার সক্রিয়তাই প্রাণ, এবং প্রাণই বহু হন, নিজেকে বিশ্বের আকারে সৃষ্টি করেন। প্রাণের গতির বৈশিষ্ট্য হলো যে সেই গতিতে যা কিছু সৃষ্ট হয়েছে, তা প্রাণেই সংলগ্ন থাকে। প্রাণ দ্বিতীয় হয়েও, সেই দ্বিতীয় সত্তাগুলিকে নিজের বর্দ্ধন বা বৃদ্ধি বলে জানেন। এইজন্য প্রাণকে বা বায়ুকে উপনিষদে অধি-অর্দ্ধ বলা হয়েছে। অধি-অর্দ্ধ (অধ্যর্দ্ধ) অর্থে ১-১/২ বা দেড়। ১-১/২ অর্থে এক এবং একের থেকে যা দ্বিতীয় হয়েছে (খণ্ডিত হয়েছে) তা একেই সংযুক্ত। বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্ত হয়েছে, যেহেতু এই প্রাণেতে সবাই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তাই ইনি অধ্যর্দ্ধ (অধ্যর্দ্ধ)। ' যৎ অস্মিন্‌ ইদম্‌ সর্ব্বম্‌ অধি অর্ধ্নোৎ, তেন অধ্যর্দ্ধঃ----যেহেতু এঁতে (এই প্রাণেতে, এই বায়ুতে) এই সকল কিছু বর্দ্ধিত হয়, সেই কারণে ' অধ্যর্দ্ধ'। অর্দ্ধ শব্দটি ঋধ্‌ ধাতু থেকে হয়েছে, ঋধ্‌ অর্থে  বর্দ্ধিত হওয়া।(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৩।৯।৯ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।)

একই কারণে প্রাণকে অশ্ব বলা হয়। অশ্ব অর্থে যিনি শ্বাস-প্রশ্বাসের আবর্ত্তন হয়ে, প্রাণাবর্ত্তন হয়ে, কালাবর্ত্তন হয়ে ছুটে চলেছেন। অশ্ব শব্দের আর একটি অর্থ হলো যিনি স্ফীত হচ্ছেন, প্রসারিত হচ্ছেন। বায়ু বা প্রাণ প্রসারিত হন, স্ফীত হন। অশ্ব শব্দটি শ্বি ধাতু থেকে হয়েছে;  শ্বি অর্থে স্ফীত হওয়া। প্রাণ বা বায়ুকে মাতরিশ্বা বলা হয়। আমরা যেমন মাতৃগর্ভে বর্দ্ধিত হই, সেই রকম আমরা সবাই প্রাণেতেই বর্দ্ধিত হচ্ছি, কাল যাপন করছি, সৃষ্টি থেকে স্থিতি, স্থিতি থেকে লয়ে, এবং জন্ম থেকে জন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে বিবর্ত্তিত হয়ে আমাদের অভ্যুদয় হচ্ছে। প্রাণ নিজের মধ্যে মাত্রা দিয়ে, আমাদের বর্দ্ধন বা পরিবর্ত্তন করছেন বলে, এঁর নাম মাতরিশ্বা। মাতরি----মাতাতে, বা যিনি মাত্রার দ্বারা পরিবর্ত্তন করেন, তাঁতে শ্বন্‌ বা বর্দ্ধন হচ্ছে, তাই ' মাতরিশ্বা'। মাতরি+শ্বন্‌= মাতরিশ্বন্‌ > মাতরিশ্বা।

যেখানে দ্বিতীয় বোধ সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত, তার নাম মন। সুনির্দিষ্ট, আয়তনময়, বোধগম্য, ভৌতিক বিশ্ব আমরা যেখানে অনুভব করছি তার নাম 'মন'। মনের কোন আয়তন নেই, কিন্তু যা কছু মাপা যায়,  যা আয়তনময়, যা মান বা পরিমাপযোগ্য, তার মাপ বা মান নির্ণয় মনেতেই হয়। দ্বিতীয় বোধ যেখানে প্রকটিত, সেখানে আর কম্পন বা এজন নয়, সেখানে গতি, একটি থেকে অন্যতে গতি। 

৪-৪।তৎ ধাবতঃ অন্যান্‌ অতি এতি  তিষ্ঠৎ -----স্থির থেকেও, তিনি ধাবন করে অন্যান্যদের অতিক্রম করেন।

যেহেতু প্রাণের দ্বারাই সকলে প্রাণেতেই গতিময় বা পরিবর্ত্তনময়, তাই প্রাণ সবাইকে অতিক্রম (অতি এতি) করেই থাকেন। যেহেতু সকল গতি বা পরিণতি প্রাণেতেই হয়, তাই প্রাণ স্থির থেকেও ধাবন করেন এবং সকলকে অতিক্রম করেন। অতিক্রম করার অর্থ ক্রম বা ক্রমণের ঊর্দ্ধে।সুতরাং যা কিছুর আরম্ভ এবং শেষ আছে, সেই আরম্ভ এবং শেষ অব্দি যে ক্রমসকল তা যাঁতে, যে প্রাণেতে (অনেতে), সেই প্রাণ ক্রমণের ঊর্দ্ধে। তাই ইনি সবাইকে সর্ব্বদা অতিক্রম করছেন।

৪-৫।তস্মিন্‌  অপঃ মাতরিশ্বা দধাতি ------- তাঁতে মাতরিশ্বা (বায়ু; প্রাণ) অপ্‌ (দিব্য জলকে) কে ধারণ করেন।

অপ্‌ অর্থে  দিব্য জল বা দিব্য বারি, যাঁর থেকে মূর্ত্ত বা স্থূল বিশ্ব প্রকাশ পায় এবং যাঁতে মূর্তি বা ভৌতিকতা বিলীন হয়।এঁর দ্বারাই ভূত সমূহ আপ্যায়িত হচ্ছে। 

আগে বলা হয়েছে, যেখানে আমরা আয়তনময়, যেখানে ভৌতিক বিশ্বকে অনুভব করছি তা হলো মন। আত্মা বা প্রাণের যে বহির্মুখী তেজ, তা থেকে মান-সম্পন্ন, পরিমাপ-যোগ্য বিশ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। আর আমাদের মনেও সেই মান-সম্পন্ন, পরিমাপ-যোগ্য বিশ্ব অনুভূত হচ্ছে, যার নাম ভৌতিক বিশ্ব। ভৌতিক শব্দটি ভূত শব্দ থেকে হয়েছে। ভূত শব্দের একটি অর্থ 'অতীত'। সমস্ত সৃষ্টি করে, নিজেকে সর্ব্বরূপে পেয়ে যে আপ্তি , তাই 'অপ্‌' এবং  'আপ্‌' বা আপ্তি। এই ভৌতিক বিশ্ব, চেতনার আপ্তির পরাকাষ্ঠা। আর এই মন এবং ভৌতিক বিশ্ব আপ্যায়িত হচ্ছে অপের দ্বারা। অপ্‌ হল প্রাণের বসন, প্রাণের আবরণ, বা প্রাণের শরীর । (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৫।১৩ দ্রষ্টব্য।)

প্রাণের যে তৃপ্তি তাই স্থূল বিশ্ব হয়ে ফুটে উঠেছে। আর এই তৃপ্তি তাঁর বসন, আপ্তি, অপ্‌। এই 'অপ্‌' কে প্রাণ বা মাতরিশ্বা নিজেতে ধারণ করেছেন, যার থেকে আমাদের বিশ্ব প্রজাত হয়েছে। বসু দেবতা, যাঁদের কথা পূর্ব্বে আলোচিত হয়েছে, তাঁরা এই প্রাণের বসন-অভিমানী পুরুষ।

বসনের দ্বারা যেমন সকলে আচ্ছাদিত হয়, আবার এই যে বসন তা নির্ম্মিত হয় বয়নের দ্বারা। যিনি বয়ন করেন তিনি বায়ু বা মাতরিশ্বা। তাই বায়ুকে সূত্রাত্মাও বলা হয়। এই সূত্রের দ্বারা সবাই সবার সাথে যুক্ত।প্রাণ বা কাল বা বায়ু যখন প্রবাহিত হন, তখন আমরা একটি অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাই, যার নাম হল পরিবর্ত্তন। এই পরিণতিগুলি বায়ু বা প্রাণরূপ সূত্রের দ্বারা যুক্ত থাকে। তাতে যে একটি সামগ্রিক সূত্রজাল বা তন্তুজাল রচিত হয়, সেইটি তার বসন। এই ভৌতিক বিশ্ব সেই বসনেরই বহির্ভাগ আর এই ভৌতিকতার মূলে আছে অপ্‌। এই দিব্য অপ্‌, যাঁর থেকে ভৌতিক বিশ্বরূপ আবরণ রচিত হয়েছে, তাঁর নাম বরুণ। আবরণ করেন তাই বরুণ। এই বিশ্ব এই ভাবে , এই মাতরিশ্বার তন্তুজালে রচিত বা বিধৃত। 

৫ম মন্ত্র।

তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।

তদন্তরস্য সর্ব্বস্য তদু সর্ব্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।।

অন্বয়-অর্থ।

তৎ (তিনি) এজতি (এজন করেন) তৎ (তিনি) ন (না) এজতি (এজন করেন)----তিনি এজন করেন, তিনি এজন করেন না।

তৎ (তিনি) দূরে (দূরে) তৎ (তিনি) উ (আবার) অন্তিকে (সমীপে)-----তিনি দূরে তিনি আবার সমীপে।

তৎ (তিনি) অন্তরস্য  (অন্তরে) সর্ব্বস্য (সকলের) তৎ (তিনি) উ (আবার)  সর্ব্বস্য (সকলের) অস্য (এই) বাহ্যতঃ (বাহ্যে)------তিনি সকলের অন্তরে,  তিনি আবার এই সকলের বাহ্যে।

অর্থ।

তিনি এজন করেন, তিনি এজন করেন না। তিনি দূরে তিনি আবার সমীপে। তিনি সকলের অন্তরে, তিনি আবার এই সকলের বাহ্যে।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

৫-১। তৎ  এজতি ----তিনি এজন করেন।

এজন অর্থে  'এ +জন'---যিনি 'এক' তিনি যখন 'জাত' হন, 'জনক' হন, তখন সেই ক্রিয়ার নাম এজন। এজনকে কম্পনও বলা হয়।

'তেজ' শব্দটির অর্থই হলো, 'তৎ এজতি'----'তিনি অর্থাৎ আত্মস্বরূপ এজন করছেন'। তাই প্রাণ তেজোময়, কেননা আত্মার সক্রিয়তাই 'প্রাণ'। এই জন্য প্রাণকে প্রাণাগ্নি বলা হয়, কেননা প্রাণের তেজের দ্বারাই সকল কর্ম্ম সাধিত হচ্ছে। যিনি অগ্রবর্ত্তী ('অগ্‌', 'অগ্র') হয়ে সকল ঘটনা, সকল কিছুকে নিয়ে আসেন ( 'নি' /নী), নীত বা উপনীত করেন, তিনি অগ্নি। 

৫-২। তৎ ন এজতি -----তিনি এজন করেন না।

তিনি এজন করেন না-----অর্থাৎ তিনি এজন করেও, তেজোময় হয়েও তেজোময় হন না।এই আত্মা তেজোময় হয়েও যেমন শান্ত,নির্লেপ,অসঙ্গ তেমনই থাকেন। অসঙ্গ মানে সঙ্গবান্‌ না হওয়া, লিপ্ত না হওয়া। আবার যিনি এক, অদ্বিতীয়, যাঁর থেকে কেউ বা কিছু ভিন্ন বা অন্য নয়, তিনি সঙ্গবান্‌ হলেও অসঙ্গই থাকেন, কেননা দ্বিতীয়তা ছাড়া সঙ্গ হয় না। সুতরাং অদ্বিতীয়তাও অসঙ্গত্ব। ইনি নিজেই নিজের তেজ।

৫-৩।তদ্‌ দূরে তদ্বন্তিকে-----তিনি দূরে তিনি আবার সমীপে।

দূরত্ব এবং সামীপ্য এই দুইটি বোধই দ্বিতীয় বোধ থেকে হয়। যা নিজেতে, তা দূরেও নয়, নিকটেও ন, তা নিজেতেই, তা আত্মগত।

যিনি আত্মা, যিনি অদ্বিতীয়, তাঁর থেকেই দূর এবং নিকট এই দুই বোধ জন্মায়। সুতরাং, যিনি নিজবোধ স্বরূপ আত্মা, যিনি  দূরও নন এবং নিকটও নন, তিনিই দূর এবং নিকট এই দুই জ্ঞান বা এই দুই মেরু হয়ে প্রকাশ পান। এই জন্য ইনি দূরেও এবং নিকটেও।

কালের যে ক্রম, একটার পর একটা যে ক্ষণ বা কাল-ক্রিয়ার মাত্রা, তার দ্বারাই দূরত্ব বা সামীপ্যের জ্ঞান বা অনুভূতি হয়। দূরত্ব বা সামীপ্য, কালগত বা দেশগত দুইই হতে পারে। যিনি আত্মস্বরূপ, জ্ঞ, বা নিজবোধ, তাঁতে দেশ এবং কাল অক্রমে আছে। তিনি ক্রিয়াময় হলেই, আরম্ভ (সৃষ্টি), বর্ত্তমানতা (স্থিতি) এবং শেষ (লয়), এই তিনটি ক্রম প্রকাশ পায়। এতেই, দূর বা নিকট এই বোধ অনুভূত হয়। দূরত্ব বা সামীপ্য গুণগতও হয়। একজন আরেকজনের সদৃশ, এইটি গুণগত নৈকট্য, এবং একজন আরেকজনের বিসদৃশ, এইটি গুণগত দূরত্ব। যে কোন দূরত্ব, ব্যবধান মূলতঃ কালাত্মক, কেননা কাল মানে প্রাণের ক্রিয়া, যার দ্বারা সব কিছু সম্ভবিত হচ্ছে।

কাল, দেশ বা গুণগত দূরত্বের মূলে আছে 'ফাঁক' বা 'আকাশ'। চেতনার দূর বা পৃথক করে রাখার যে শক্তি, তার নাম আকাশ এবং এর দ্বারা সৃষ্টির বহুত্ব বজায় থাকে। এইজন্য ছান্দোগ্য উপনিষদে আকাশকে বহুল বলা হয়েছে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৫।১৫।২ দ্রষ্টব্য।)

৫-৪। দূর এবং অন্তিক এর একটি অর্থ।

প্রাণ যখন সৃষ্টি করেন, তখন নিজের থেকে বা আত্মার থেকে দ্বিতীয়তা বা দূরত্ব রচনা করেন। এইটিই 'দূর'।

প্রাণ বা কাল যখন সেই দ্বিতীয়তা কে বিলোপ করেন বা অন্তে নিয়ে যান, তার অর্থ  সেই দ্বিতীয়তাকে নিজেতেই ফিরিয়ে নেন, এইটি অন্ত, বা অন্তিক হওয়া। 

৫-৫। তদন্তরস্য সর্ব্বস্য তদু সর্ব্বস্যাস্য বাহ্যতঃ----তিনি সকলের অন্তরে,  তিনি আবার এই সকলের বাহ্যে।

আত্মা স্বয়ংপ্রকাশ। ইনি নিজেই নিজের শক্তি। এই স্বয়ংপ্রকাশ, স্বয়ংশক্তি  আত্মা যখন নিজেকে প্রকাশ করেন, সেই শক্তি প্রকাশে দুইটি মেরু প্রকাশ পায়। এই জন্য আত্মাকে উভয় লিঙ্গ সম্পন্ন বলা হয়, অর্থাৎ প্রতি শক্তি প্রকাশ দুইটি মেরুর দ্বারা চিহ্নিত হয়। মেরু মানেই 'মে রূপে' অর্থাৎ 'আমার দুই রূপ'। এই জন্য বলা হলো, ইনি এজন করেন এবং এজন করেন না, ইনি দূরে এবং নিকটেও, ইনি সকলের অন্তরে এবং আবার সকলের বাহিরে।

এই জন্য উপনিষদে বলা হয়েছে, 'দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে----ব্রহ্মের দুইটি রূপ ' (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ , মন্ত্র ২।৩।১)। 

৫-৬। সর্ব্বান্তর আত্মা।

এই আত্মা সর্ব্বান্তর। প্রাণের বা অনের সকল আলোড়নের অন্তরে ইনি স্থির নিজবোধস্বরূপ, বা জ্ঞানের অন্তরে ইনি 'জ্ঞ'। আমাদের প্রতিবোধ বা প্রতি অনুভূতির অন্তরে ইনি নিজবোধ, বা আত্মবোধ স্বরূপ, বা আত্মা। স্বয়ং, নিজ, বা আত্মবোধ না থাকলে কোন অনুভূতি বা বোধ হয় না, বা কোন উপলব্ধিই হয় না। এই বিষয়ে কেনোপনিষদের  একটি মন্ত্র উদ্ধৃত করা হলো।

মন্ত্র।

প্রতিবোধ বিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।

আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতে'অমৃতম্‌।। (কেনোপনিষদ মন্ত্র  ২।৪)।

অর্থ।

প্রতিবোধ (প্রতিবোধে) বিদিতং (বিদিত) মতম্‌ (এই রকম মতি হলে; এই ভাবে জানলে) অমৃতত্বং ( অমৃতত্ব)  হি (অবশ্যই) বিন্দতে (লাভ করে)-----প্রতি বোধে বোধে বিদিত হচ্ছেন (বা এই আত্মা দৃষ্ট হচ্ছেন) এই ভাবে জানলে অবশ্যই অমৃতত্ব লাভ করে।

আত্মনা (আত্মার দ্বারা; আত্মজ্ঞানের দ্বারা) বিন্দতে (লাভ করে)  বীর্যং (বীর্য; শক্তি);  বিদ্যয়া (বিদ্যার দ্বারা; শক্তির দ্বারা)  বিন্দতেঃ (লাভ করে) অমৃতম্‌ (অমৃত) --------আত্মজ্ঞানের দ্বারা বীর্য (শক্তি ) লাভ করে; বিদ্যার দ্বারা (শক্তির দ্বারা)  অমৃত লাভ করে।

আত্মাকে দেখলেই শক্তি, বীর্য, বা বিদ্যা লাভ হয়। প্রতিবোধের অন্তরে বা মূলে ইনি সর্ব্বদা রয়েছেন। 

বিদ্যা বা বীর্য লাভ  অর্থে' আত্মার ঈশিত্ব বা নিয়ন্ত্রণ শক্তির দর্শন পাওয়া এবং নিজের মধ্যে ঈশিত্বের প্রকাশ ঘটা।

অন্তর্যামী ব্রাহ্মণ।

অন্তর শব্দের একটি অর্থ পৃথক বা আলাদা। আত্মা নিজেকে নিজের থেকে দ্বিতীয় করে বা নিজের থেকে নিজেকে পৃথক করে সৃষ্টি করেন। তাই যে সৃষ্ট হয়েছে, তার থেকে ইনি পৃথক বা অন্তর।  যে সৃষ্ট হয়েছে সে আত্মার বাহিরে স্থিতি পেয়েছে এবং তার অন্তরে আত্মা স্থিত। এইজন্য অন্তর মানে 'মধ্যে' এবং 'পৃথক'। 

বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায় সপ্তম ব্রাহ্মণের (অংশের) নাম ' অন্তর্যামী ব্রাহ্মণ'। এই অংশে, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য অন্তরাত্মার বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। এখানে বলা হয়েছে, যিনি সমস্ত কিছুতে রয়েছেন, সকলের অন্তর, যাঁকে কেউ জানেনা, সকলেই যাঁর শরীর ( সকলেই যাঁর বাহিরে এবং তাঁর আবরণ স্বরূপ ), যিনি সকলের অন্তরকে যমন (নিয়ন্ত্রণ) করছেন, ইনিই সেই আত্মা, অন্তর্যামী, অমৃত। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ মন্ত্র ৩।৭।৩ থেকে মন্ত্র ৩।৭।২৩ অব্দি দ্রষ্টব্য। )

বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩।৭।২৩ মন্ত্রে আরো বলা হয়েছে যে এই অন্তর্যামী অমৃত আত্মা, অদৃষ্ট বা দৃষ্টির গোচর হননা, কিন্তু ইনি দ্রষ্টা, এবং ইনি ভিন্ন অন্য কেউ দ্রষ্টা নয়; এই রকমই ইনি অশ্রুত, কিন্তু ইনি শ্রোতা, এবং ইনি ভিন্ন অন্য কেউ শ্রোতা নয়, এঁকে  মনের দ্বারা জানা যায় না, কিন্তু ইনি মনন করেন, এবং ইনি ভিন্ন অন্য কেউ মনন করে না, ইনি অবিজ্ঞাত, কিন্তু ইনি বিজ্ঞাতা, এবং ইনি ভিন্ন অন্য কেউ বিজ্ঞাতা নয়। 

ইনি সকলের অন্তরে, সকলে এঁর বাহিরে, এবং তাই প্রত্যেকে এঁর শরীর বা এঁর আবরণ।

এই সৃষ্টি বহির্মুখী, পরমাত্মা বহিঃ-প্রবণ হয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই আমরা স্বভাবতঃ বহির্মুখী।এই প্রসঙ্গে কঠ উপনিষদের ২।১।১ মন্ত্র দ্রষ্টব্য। ওখানে উক্ত হয়েছে যে স্বয়ম্ভূ (যিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেন) এই বিশ্বকে বহির্মুখী হয়ে তৃণবৎ (তৃণ যেমন স্বতঃই জন্মায়) সৃষ্টি করেছিলেন। সেই জন্য সকলে, যা পর (দ্বিতীয়) বা যা নিজের বাহিরে তাই দর্শন করে, অন্তরাত্মাকে দর্শন করেনা। 

৫-৭। তদু সর্ব্বস্যাস্য বাহ্যতঃ-----তিনি আবার এই সকলের বাহ্যে।

যা কিছু 'বাহির', যা বহির্বিশ্ব, তা আত্মপ্রকাশ, বা জ্ঞানস্বরূপ স্বয়ংপ্রকাশ আত্মারই রূপ।এই বহির্বিশ্ব হয়ে, এই চিন্ময় আত্মা আমাদের প্রত্যেককে বেষ্টন করেছেন। শব্দ,স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধের আকারে আমাদের মধ্যে এই চেতনা প্রবিষ্ট হচ্ছেন, বাহির থেকে অন্তরে প্রবাহিত হয়ে আমাদেরকে সচেতন করে রেখেছেন।প্রবাহিত হন যেখান থেকে, সেই ক্ষেত্রের নাম বহিঃ। দেবক্ষেত্র, দ্যুলোক, এবং বসু দেবতাদের প্রসঙ্গে এই কথা আগে বলা হয়েছে। আমরা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র ভাবে এই বহির্বিশ্ব বা চিৎ ক্ষেত্রের অন্তরে বিকশিত হচ্ছি, যেমন গর্ভস্থ শিশু মাতৃ গর্ভে বর্দ্ধিত হয়। এই ভাবে আমাদের জন্ম জন্মান্তর সংঘটিত হচ্ছে, এবং আমাদের অভ্যুদয় হচ্ছে, আমরা মুক্তির পথে চলেছি।নিজেকে দোহন করে প্রকাশ করেন বলে এঁর নাম দ্যু, এবং সেই এক একটি প্রকাশ-অভিমানী ব্যক্তিত্বের নাম দেবতা। এই প্রকাশ সত্তারা অন্তহীন, মৃত্যুহীন বা অনন্ত।এই রকমই সব, জল-দেবতা, বায়ুদেবতা, বৃক্ষ দেবতা' ইত্যাদি। সর্ব্ব দেশ এবং সর্ব্ব কাল প্রকাশের যে বিশিষ্টতা, তার ধারক এই দেবগণ। এই জন্য, আত্মার ঈশিত্ব দর্শনে আসতে থাকলে দেবক্ষেত্র প্রকাশ পায়। স্থূল, ভৌতিক বিশ্ব এই দেবক্ষেত্রের পৃষ্ঠ বা পিছেনর দিক্‌। 

৬ষ্ঠ মন্ত্র।

যস্তু সর্ব্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি।

সর্ব্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।

অন্বয়-অর্থ।

যঃ ( যখন) তু (কিন্তু) সর্ব্বাণি (সর্ব্ব ) ভূতানি (ভূতকে) আত্মনি (আত্মাতে) এব (ই) অনুপশ্যতি (অনুদর্শন করেন)--কিন্তু যখন সর্ব্ব ভূতকে আত্মাতেই অনুদর্শন করেন

সর্ব্ব (সর্ব্ব) ভূতেষু (ভূতে) চ (এবং) আত্মানং (আত্মাকে) ততঃ ( সেই হেতু) ন (না) বিজুগুপ্সতে (গোপন করেন))----এবং সর্ব্ব ভূতে আত্মাকে,  সেই হেতু গোপন করেন না-----এবং সর্ব্বভূতে আত্মাকে (অনুদর্শন করেন), সেই হেতু তিনি গোপন করেন না

অর্থ।

কিন্তু যখন সর্ব্বভূতকে আত্মাতেই অনুদর্শন (প্রতি অনুভূতিতে দর্শন করেন ) এবং সর্ব্বভূতে আত্মাকে (অনুদর্শন করেন), সেই হেতু তিনি গোপন করেন না (তাঁর গোপন করার কিছু থাকে না)।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

প্রতি অনুভূতিতে বা বোধে আত্মাকে, বা যিনি 'জ্ঞ' তাঁকে দর্শন করার কথা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতি অনুভূতিতে যে দর্শন, তা অনুদর্শন। ভূত অর্থে ' যা অতীত' বা ' যার সৃষ্টি হয়ে গেছে '। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, আত্মস্বরূপ মহা চেতনা যা কিছু নিজে হয়েছেন, তার নাম সম্ভূতি। আর তাঁর সেই হওয়া অনুসারে, সম্ভূতি অনুসারে, আমরা জগৎকে অনুভব করছি; আমাদের অনুভূতির বিশ্বে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধময় এই বিশ্ব কে আমি জানছি। সম্ভূতি অনুসারে জানছি বলে আমাদের জানার নাম অনুভূতি বা অনুদর্শন। এই জন্য 'অনুপশ্য' শব্দটি উপরের মন্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।

মন্ত্রের প্রথম চরণে সর্ব্বভূতকে আত্মাতেই দেখার কথা বলা হয়েছে। সর্ব্বভূত আত্মাতেই স্থিত, সমূহিত। এর নাম 'সপ্তমী তিথি'; সপ্ত অর্থে 'সহ আপ্ত, আত্মনা সহ আপ্তঃ', নিজেতেই সব বিধৃত। 

মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণে সর্ব্বভূতে আত্মাকে দেখার কথা বলা হয়েছে। এই আত্মা সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত। প্রথমে 'আপ্ত', তারপর 'ব্যাপ্ত'। আত্মার এইটি 'অষ্টমী তিথি'। অষ্ট শব্দটি অশ্ ধাতু থেকে হয়েছে। অশ্ ধাতুর অর্থ, ব্যাপ্ত হওয়া, ছড়িয়ে পরা।অষ্টম অর্থে  'অশ্‌-তম' বা ব্যাপ্তির চরমতা। 

আত্মার প্রাণময়, ভোগপ্রদায়ী প্রকাশের নাম সোম, যা আমাদের মধ্যে অনুভূতির আলোড়ন, সেই  সোমের প্রকাশ গুলিই তিথি, যার দ্বারা আমরা স্থিতি পেয়েছি। আর এই আত্মস্বরূপ 'অতিথি', অর্থাৎ যিনি 'তিথি বিহীন', যিনি 'অক্ষয়', যিনি সপ্তমী, অষ্টমী, ইত্যাদি তিথির আকারে খণ্ডিত হয়েও, অখণ্ড, সনাতন এবং অব্যয়। 

এই সোমের আলোড়নের মধ্যে যিনি রয়েছেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করে কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, 'অতিথি দুরোণসৎ---দুরোণ্‌ বা সোমের কলসের মধ্যে 'অতিথি' বিদ্যমান। (কঠোপনিষদ মন্ত্র ২।২।২ দ্রষ্টব্য।)

অতিথি শব্দের আর একটি অর্থ হলো, যার একটিই তিথি। এই তিথিকে ধ্রুবা কলা বা অমাকলা (অমাবস্যার চাঁদ) বলা হয়েছে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৪।৫ দ্রষ্টব্য।)

৭ম মন্ত্র।

যস্মিন্‌ সর্ব্বাণি ভূতান্যাত্মৈবাভূদ্‌  বিজানতঃ।

তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ।।

অন্বয়-অর্থ।

যস্মিন্‌ (যাঁতে ) সর্ব্বাণি (সর্ব্ব) ভূতানি (ভূত) আত্মা এব (আত্মাই) অভূদ্‌  (হয়ে গেল) বিজানতঃ (বিজ্ঞাতার) তত্র (তথায়) কো (কোথায়) মোহঃ (মোহ ) কঃ (কোথায় ) শোক (শোক) একত্বম্‌ (একত্ব) অনুপশ্যতঃ (অনুদর্শনকারীর)----------যাঁতে সর্ব্ব ভূত আত্মাই হয়ে গেল, (সেই) বিজ্ঞাতার কোথায় মোহ কোথায় শোক, (যিনি) একত্ব  অনুদর্শনকারীর। 

অর্থ। 

যাঁতে (যে আত্মায়) সর্ব্বভূত বিজ্ঞাতার (যিনি আত্মাকে জানছেন বা বিজ্ঞাত হচ্ছেন তাঁর) আত্মাই হয়ে গেল, তথায় (সেই আত্মায়) একত্ব অনুদর্শনকারীর কোথায় মোহ কোথায় শোক।  

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

যিনি 'আততম্‌' অর্থাৎ সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত, যিনি ভিন্ন আর কিছু নেই, তিনি 'আত্মা'। সকল কিছু নিজের জ্ঞান বা অনুভূতির মূর্ত্তি এবং প্রতি জ্ঞান, বোধ, বা অনুভূতির মূলে রয়েছেন স্বয়ং বা নিজবোধ বা আত্মা, এবং জ্ঞান বা অনুভূতির মূর্ত্তি গুলি তাঁরই প্রকাশ, এই ভাবে জানতে থাকলে সমস্ত কিছু আত্মময় হয়ে যায়, অর্থাৎ সর্ব্বভূত বা সমস্ত সৃষ্টি তাঁর আত্মাই হয়ে যায়, বা সর্ব্বভূত আত্মমূর্ত্তি রূপে দৃষ্ট হয়। আত্মবোধ বা 'নিজ' এই বোধ না থাকলে কোন বোধই থাকে না। 'থাকা' এবং 'না থাকার ' বোধও এই নিজবোধ কে আশ্রয় করে ফোটে। ইনি আত্মা। 

এই রকম যিনি অনুদর্শনকারী বা বিজ্ঞাতা তাঁর মোহ বা শোক থাকতে পারে না। দ্বিতীয় জ্ঞান থেকেই মোহ  এবং শোক হয়। যখন নিজেতেই সকল কিছু, তখন কোন কিছু হারাবার থাকে না, পাবার থাকে না, সুতরাং মোহ বা শোকের কোন কারণই থাকে না। মোহ শব্দটি মুহ্‌ ধাতু থেকে হয়েছে। মুহ্‌ অর্থে মুহ্যমান্‌ হওয়া, সংজ্ঞা হারানো। কোন বিষয়ে তীব্র আকাঙ্ক্ষা হলে, প্রাণগতি যখন তাতেই রুদ্ধ হয়, অন্য সকল বিষয়ে আর অবধান থাকে না, তার নাম 'মোহ'। আত্মজ্ঞ পুরুষ মোহগ্রস্ত যদি বা হন, আত্মজ্ঞতা হেতু, মুহ্যমান্‌ হয়েও, অসঙ্গই বা অমোহিতই থাকেন, এবং নিজের  মুহ্যমান্‌  অবস্থাকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন। ভগব্দগীতায়, একে 'নির্ম্মাণ মোহ' বা মোহকে নির্ম্মাণ করা বলা হয়েছে।

গীতার শ্লোকটি নীচে উদ্ধৃত করা হলো।

" নির্ম্মাণ-মোহ জিত-সঙ্গ-দোষ

অধ্যাত্ম-নিত্য বিনিবৃত্ত-কামাঃ দ্বংদ্বৈর

বিমুক্তঃ সুখ-দুঃখ-সংজ্ঞৈর গচ্ছন্তি

অমূঢ়াঃ পদম্‌ অব্যয়ঃ তৎ। "(গীতা শ্লোক ১৫।৫।)

অর্থ।

মোহকে নির্মাণ করেন (কিন্তু মোহের দ্বারা গ্রস্ত হন না ), সঙ্গদোষ-জয়ী, নিত্য-অধ্যাত্মময় (নিত্য আত্ম-সঙ্গ-ময়), কামনা-সকল থেকে নিবৃত্ত, দ্বংদ্ব এবং সুখ ও দুঃখ সংজ্ঞা (এটা সুখ, এটা দুঃখ এই প্রকার বিভেদ বোধ) থেকে বিমুক্ত হয়ে, সেই অমূঢ় ( যিনি মোহের উর্দ্ধে ), যে অব্যয় পদ, তাঁতে গমন করেন। (গীতা শ্লোক ১৫।৫।)

শোক শব্দটি শক্‌ ধাতু থেকে হয়েছে। শক্‌ বা শক্তি বা কাল-শক্তির বশ্যতায় যে ''শোচন' বা দুঃখ ভোগ, তাই শোক।

' এক ' শব্দটির অর্থ  এই রূপ ----এক = অ+ই+ক----'অ' বা অব্যয় আত্মাই, 'ই' বা গতি নিয়ে ক বা ব্যঞ্জনম্য বা রুপময় হচ্ছেন। সুতরাং সকল কিছু যা দৃষ্ট, শ্রুত ইত্যাদি হচ্ছে, তা 'এক' বা অদ্বিতীয় আত্মাই। 

৮ম মন্ত্র।

স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্‌।

কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতো'র্থান্ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।। 

অন্বয়-অর্থ।

সঃ (তিনি) পর্যগাৎ (পরি+অগাৎ---সর্ব্বত্র গত; পরিব্যাপ্ত) শুক্রম্‌ (শুক্র---শু বা কালক্রম প্রকাশক

হেতু উজ্জ্বল) অকায়ম্‌ (কায়া বিহীন) অব্রণম্‌ ( ব্রণহীন বা ক্ষত বিহীন) অস্নাবিরং (স্নায়ু বিহীন) শুদ্ধম্‌ (শুদ্ধ) অপাপবিদ্ধম্‌ (অপাপবিদ্ধ)----তিনি পরিব্যাপ্ত, শুক্র ( কালক্রম প্রকাশক হেতু উজ্জ্বল ), কায়া বিহীন (অশরীরী) ব্রণহীন (ক্ষত বিহীন), স্নায়ু বিহীন, শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ।

কবিঃ (কবি) মনীষী ( মনীষী ) পরিভূঃ (পরিভূ---জাত হয়ে তাকে বেষ্টন করেন) স্বয়ম্ভূঃ (স্বয়ম্‌ বা নিজেই নিজেকে জাত করেন) যাথাতথ্যতঃ (যথাযথ তথ্য অনুযায়ী) অর্থান্‌ (অর্থ  সকলকে) ব্যদধাৎ (ধারণ করেছেন) শাশ্বতীভ্যঃ (শাশ্বত) সমাভ্যঃ (বৎসর ব্যাপী)-----কবি, মনীষী, পরিভূ ( জাত হয়ে তাকে বেষ্টন করেন), স্বয়ম্‌ বা নিজেই নিজেকে জাত করেন, যথাযথ তথ্য অনুযায়ী অর্থ সকলকে ধারণ করেছেন শাশ্বত বৎসর-ব্যাপী।

অর্থ।

তিনি (এই আত্মা) পরিব্যাপ্ত, শুক্র ( কালক্রম প্রকাশক হেতু উজ্জ্বল ), কায়া বিহীন (অশরীরী), ব্রণহীন ( ক্ষত বিহীন), স্নায়ু বিহীন, শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, কবি, মনীষী, পরিভূ (জাত হয়ে তাকে বেষ্টন করেন), স্বয়ম্ভূ  (নিজেই নিজেকে জাত করেন), যথাযথ তথ্য অনুযায়ী অর্থ সকলকে ধারণ করেছেন শাশ্বত বৎসর-ব্যাপী।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

৮-১। পর্যগাৎ (পরি+অগাৎ)---সর্ব্বত্র গত; পরিব্যাপ্ত----যাঁকে কোন পরিধির দ্বারা সীমায়িত করা যায় না। 

৮-২। শুক্র----'শ' অর্থাৎ শক্তি বা কালের যে প্রকাশ-উন্মুখ স্বরূপ তাই 'শু'। 'শুক্র' অর্থে, স্ফুটন- উন্মুখ কাল, যিনি ক্রমান্বয়ে বা কাল-ধারায় (কাল- ক্রমে) প্রকাশ পাচ্ছেন, আর প্রকাশবান্‌ হেতু উজ্জ্বল। 

(যেমন কালের কল্যাণ-প্রকাশক ভাবকে লক্ষ করে 'শুভ' বলা হয়। শুভ = শু (কল্যাণ) + ভ (ভাতি)----কল্যাণময় ভা বা দীপ্তি দান করছে। কাল যা দেন তা কল্যাণের জন্য।)

৮-৩। অকায়ম্‌ (কায়া বিহীন)---কায়া=শরীর বা কায়। 'ক' বা প্রাণ বা কাল, যিনি সর্ব্ব ব্যঞ্জনার মূলে, তাঁর যে 'আয়' বা 'আয়তি' বা 'আয়তন' তার নাম 'কায়' বা কায়া'। 

৮-৪। অব্রণম্‌ --- ব্রণহীন বা ক্ষত বিহীন। 'ব' অর্থাৎ বায়ু বা প্রাণ গতির যে 'র' বা রুদ্ধ অবস্থা, তা 'ব্র' *। গতির অবরুদ্ধতার যারা যা অন্বিত, তা 'ব্রণ'। 

(* যেমন কোন গতিকে বা প্রাণকে একটি বিশেষ কোন কিছুতে 'রুদ্ধ' করার বা প্রতিষ্ঠা (ত) করার নাম সেই বিষয়ে 'ব্রত' ধারণ করা। আর মহাপ্রাণ কোনো কিছুতেই আবব্ধ নন বলে তাঁকে 'ব্রাত্য' বলা হয়। ব্রাত্য মানে যাঁর কোনো ব্রত নেই। ব্রাত্যঃ ত্বম্‌ প্রাণ----হে প্রাণ তুমি ব্রাত্য-----প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।১১ দ্রষ্টব্য।)

৮-৫। অস্নাবিরং ---স্নায়ু বিহীন। প্রাণ বা বায়ুকে সূত্র বলা হয়, একথা আগে বলা হয়েছে।(অনুচ্ছেদ ৪।৫ দ্রষ্টব্য।) এই সূত্রই স্নায়ু এবং এই সূত্রজালই স্নায়ু-জাল। আত্মত্বে, যেখানে নিজেই নিজের সূত্র, নিজেই নিজের স্নায়ু, সেখানে ইনি 'অস্নাবির'। 

৮-৬। শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্‌----শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ। ইনি শুদ্ধ, এবং সেই কারণেই অপাপবিদ্ধ। নিজে ভিন্ন আর কেউ নেই, আর কিছু নেই, এইটি শুদ্ধতা। যেখানে দ্বিতীয়তা বোধ নেই, সেখানে মৃত্যুও নেই। দ্বিতীয়তা বোধ, বা 'নানা' অর্থাৎ ' একটি থেকে অপরটি ভিন্ন বা আলাদা' এই রকম বোধ থেকে মৃত্যু দর্শন হয়। কঠোপনিষদে উক্ত হয়েছে যে যতক্ষণ দ্বিতীয়তার জ্ঞান আধিপত্য করে, সকল কিছুকে আত্মপ্রকাশ বলে যতক্ষণ না বিদিত হওয়া যায়, ততক্ষণ,জীব মৃত্যুর থেকে মৃত্যুকে পায়----অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর পুনঃ-পুনঃ আবর্ত্তনে, সে বারবার মৃত্যুকে অনুভব করে। " মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি---মৃত্যুর থেকে সে  মৃত্যুকে পায়, যে ইহলোকে "নানা' দর্শন করে।" (কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।২।১০ থেকে উদ্ধৃত।) বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, যে সকল কিছুকে আত্মার থেকে অন্য বলে জানে, সকল কিছু তাকে পরিত্যাগ করে। সর্ব্বম্‌ তম্‌ পরাদাৎ যঃ অন্যত্র আত্মনঃ সর্ব্বম্‌ বেদঃ-----সকল কিছু তাকে পরিত্যাগ করে, যে আত্মার থেকে অন্যত্র বলে সকল কিছুকে জানে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।৪।৬ থেকে উদ্ধৃত।)  সকল কিছু যখন পরিত্যাগ করে, সেই সর্ব্বহারা হবার যে চরম অনুভূতি তার নাম মৃত্যু। যিনি মৃত্যুকে আত্মারই রূপ বলে জানেন, তিনি সব হারিয়ে, সে সবকে নিজেতেই, আত্মাতেই অন্তহীন ভাবে পান, বা তিনি কিছুই হারান না। মৃত্যুর থেকে তিনি মৃত্যু বা বিনাশের অনুভূতি পান না, মৃত্যুর থেকে তিনি অমৃত লাভ করেন।সব কিছু যাঁতে বিশিষ্টতা হারিয়ে লুপ্ত হয় আবার তাঁর থেকে পুনরায় জাত হয়, তিনি অমৃত।

৮-৭। কবি। কবয়তি ইতি কবিঃ---যিনি কথা বলছেন, যাঁর কথা অর্থময় একটি চেহারা নিচ্ছে, যাঁর কথাএকটি সচেতন ব্যক্তি হয়ে বা ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে, তিনি কবি। চেতনার প্রকাশই কথা এবং তাই বিশ্ব ভুবন হয়েছে। এই কবির কবিত্বই বিশ্ব ভুবন। 

( এই প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার অংশ উদ্ধৃত করা হলো----

সেই সত্য যা রচিবে তুমি,

ঘটে যা তা সব সত্য নহে ।কবি, তব মনোভূমি, রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো ।'' )

দৈব পিতৃগণ যা ভোগ করেন, বা যা তাঁদেরকে আহুতি দেওয়া হয় তার নাম 'কব্য'। আমাদের জন্ম-জন্মান্তরে যত জন্ম হয়েছে, সে সব জন্ম এই পিতৃগণের মধ্য দিয়ে হয়। সেই সকল জন্মের যে 'ব্যক্তিত্ব' তা এই পিতৃগণের থেকে আমরা অর্জ্জন করি এবং সৃষ্ট জীব সকলের এই ব্যক্তিত্বই তাঁদের ভোগ্য বা কব্য।)

৮-৮। মনীষী -----মনীষি। মনীষী শব্দটি মনীষিন্‌ শব্দ থেকে হয়েছে। মনীষিন্‌ শব্দের কর্তৃবাচ্যের রূপ ' মনীষী '। 

মনীষিন্‌ অর্থে' মন+ঈষ্‌ (দেখা, দর্শন করা)----যিনি মনের দ্বারাই  দর্শন করেন, মনই যাঁর চক্ষু। উপনিষদে বলা হয়েছে, যে যিনি দিব্য মন, তাঁর জ্যোতিরূপ হলেন আদিত্য। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৫।১২। দ্রষ্টব্য।) পৃথিবীর আকাশে ঐ যে সূর্য, তা এই মহাপ্রাণের মানস চক্ষু, যা আমাদের বহিরাকাশে প্রকাশ পেয়েছে। 

৮-৯। পরিভূঃ -- পরিভূ---জাত হয়ে তাকে বেষ্টন করেন। ' ভূ ' অর্থে জাত হওয়া। ' পরি ' অর্থে  ' বেষ্টন ' বা ' পরিবেষ্টন ' । আত্মস্বরূপ নিজেই সৃষ্টি রূপে জাত হয়ে প্রতি সৃষ্টিকে বিশ্বরূপে আলিঙ্গন করেছেন। (একথা পূর্ব্বেও অনুচ্ছেদ ৫-৭ এ বলে হয়েছে।)

৮-১০। স্বয়ম্ভূঃ -- স্বয়ম্‌ বা নিজেই নিজেকে জাত করেন (ভূ)।  

 এই আত্মা স্বয়ংপ্রকাশ এবং স্বয়ংশক্তি। ইনি নিজেই নিজেকে নিজের দ্বারা প্রকাশ করেন আর সেই প্রকাশে ইনি নিজে এবং বিশ্ব-ভুবন প্রকাশিত হয়েছে।

 ৮-১১। যাথাতথ্যতঃ  অর্থান্‌  ব্যদধাৎ শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ --- যথাযথ তথ্য অনুযায়ী অর্থ  সকলকে ধারণ করেছেন শাশ্বত বৎসর ব্যাপী)। 

অর্থ --অ (আত্মা বা প্রাণ) + ঋ (ঋত বা সত্য প্রকাশক গতি) + থ (স্থিতি বা প্রতিষ্ঠা)-----যিনি 'অ' বা অক্ষর আত্মস্বরূপ, তিনি প্রাণময় হয়ে যে একটি স্থিতি নিয়েছেন, মূর্ত্ত হয়েছেন, তার যে তাৎপর্য তাই 'অর্থ'। একটি সৃষ্টির কেন্দ্র থেকে বা তন্মধ্যস্থ প্রাণ থেকে যে প্রাণের রশ্মিগুলি বিচ্ছুরিত হচ্ছে তা 'অরা'' যেমন রথ চক্রের ' অরা' হয়'। আর সেই অরাগুলি, রশ্মিগুলি যে সামগ্রিক একটি রূপ বা বর্ণনা প্রকাশ করছে, সেইটি সেই সৃষ্ট জীব বা পদার্থের 'অর্থ'। 

 যাথাতথ্যতঃ---যথা তথ্য। তৎ বা যিনি তৎ-পুরুষ, যাঁকে কোন একটি বিশেষ নামে বর্ণনা করা যায় না, তিনি যেখানে যে ভাবে স্থিত (থ), বা যে স্থিতিটি নিয়েছেন, তদ্বিষয়ক যে জ্ঞান বা প্রজ্ঞা সেইটি তার 'তথ্য'। জ্ঞান স্বরূপ চেতনাই, স্থিতি হয়ে, মূর্ত্ত হয়ে প্রকাশ হন, একথা আগে আলোচিত হয়েছে। 'যথা', অর্থাৎ, যেমন (য) ভাবে, স্থিতির (থ) আকার (আ) নেন, সেইরকমই তথ্য, আর সেই স্থিত বা প্রতিষ্ঠিত সৃষ্ট পদার্থ বা জীব সমূহ যা এই বিশ্ব, তার দ্বারা আমরা চেতায়িত হচ্ছি  বা আমাদের মধ্যে অনুভূতি সকল ফুটে উঠছে। তাই যা কিছু সৃষ্ট, সেই সব, যথাযথ যে তথ্য তারই অর্থ জ্ঞাপন করছে। এই ভাবেই 'ব্যদধাৎ', অর্থাৎ ধারণ করছেন প্রতি জীবকে, প্রতি পদার্থকে, অনাদি অনন্ত কাল ধরে ( শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ )।

৮-১২। শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ---শাশ্বত বৎসর ব্যাপী। 

শাশ্বতী শব্দটি শক্তি বাচক। যিনি 'শশ্বৎ' তাঁর শক্তি ' শাশ্বতী '। 'শ' শব্দটি শক্তি বা কালবাচক। শু+অ= শ্ব----শক্তি বা কাল প্রবাহ। শশ্বৎ অর্থে যিনি স্বয়ং-শক্তি এবং শ্ব বা কালের আকারে বা প্রাণ -প্রবাহ হয়ে নিজেকে  প্রকাশ করেন। কাল বা প্রাণ এঁতে শায়িত থাকে এবং এঁর থেকেই প্রবাহিত হয়। 'শী' ধাতুর অর্থ শয়ন করা এবং 'শ্বি' ধাতুর অর্থ স্ফীত হওয়া। ইনি শায়িত থেকেও বিশ্ব ভুবনের আকারে স্ফীত হচ্ছেন। কালের জনক বলে, ইনি কালের ঊর্দ্ধে এবং তাই ইনি শাশ্বত বা চিরন্তন। 

'সমাভ্যঃ' শব্দটি 'সমা' শব্দ থেকে হয়েছে। ' সমাভ্যঃ ' অর্থে ' সমা ' বা বৎসর ব্যাপী। কালের দ্বারা যা আমাদের মেধা হচ্ছে, আমাদের সত্তায় মিশে আমাদের গঠণ করছে, আমাদের সাথে সমত্ব পাচ্ছে, তা ' সমা '। বৎস বা সন্তান কে গড়ে তোলার জন্য কালের বা প্রাণের যে একটি পূর্ণ আবর্ত্তন, তার নাম সম্বৎসর (বা বৎসর)। 

৯ম মন্ত্র।

অন্ধন্তমঃ প্রবিশন্তি যে'বিদ্যামুপাসতে।

ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ।।

অন্বয়-অর্থ। 

অন্ধং (যা অন্ধ তাতে;  অন্ধকারে)  তমঃ (তমতে; তমসাতে) প্রবিশন্তি (প্রবেশ করে) যে (যারা) অবিদ্যাম্‌ (অবিদ্যাকে; অবিদ্যার) উপাসতে (উপাসনা করেন)------অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে যারা অবিদ্যাকে উপাসনা করে।

ততঃ (তার থেকেও) ভূয়ঃ (বেশী; অধিক) ইব (অবশ্যই) তে (তারা) তমঃ (তমতে; তমসাতে) য (যারা) উ (আবার) বিদ্যায়াং (বিদ্যাতে) রতাঃ (রত)----- (তার থেকেও অধিক) ততোধিক তমসাতে অবশ্যই (প্রবেশ করে) যারা আবার বিদ্যাতে রত ।

অর্থ। 

যারা অবিদ্যাকে উপাসনা করে, (তারা), অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে। ততোধিক তমসাতে অবশ্যই (প্রবেশ করে) যারা আবার বিদ্যাতে রত ।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

৯-১। অন্ধন্তমঃ প্রবিশন্তি ----অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে।

' তম ' শব্দটিতে কোন অবস্থার চরমতা বা কোন গুণের 'চরম' অবস্থাকে বোঝায়। সুতরাং ' অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে' এর একটি অর্থ হল, ' গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করে'। 

অন্ধ= অম (তেজ, প্রাণ) +ধ (বিধৃত)। আত্মার তেজ বা প্রাণ, যা সকল প্রকাশের মূলে, সেই তেজের নাম ' অন্ধ '। এই অন্ধ বা অন্ধকার আসলে আত্মজ্যোতির দ্বারা পূর্ণ, কিন্তু আমরা আত্ম-বিস্মিত বলে, অন্ধকার দর্শন করি। সেই জন্য গভীর নিদ্রায়, যখন আমরা স্বপ্নও আর দেখি না, তখন আমরা আত্মস্বরূপে বা আত্মাতেই একীভূত হই, কিন্তু যখন জেগে উঠি তখন মনে হয় যেন অন্ধকারে গিয়েছিলাম; শুধু নিদ্রাজনিত একটি সুখ বা বিশ্রাম উপলব্ধি করি।

৯-২।অন্ধং প্রবিশন্তি অবিদ্যাম্‌ উপাসতে------অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে যারা অবিদ্যাকে উপাসনা করে।

অবিদ্যা শব্দের অর্থ ' অ (অল্প )+ বিদ্যা'। অবিদ্যা অর্থে  বিদ্যার সম্পূর্ণ লুপ্তি নয়। বিদ্যা শব্দের অর্থ  'শক্তি' বা 'জ্ঞান -শক্তি', অর্থাৎ যাঁর দ্বারা 'বিদিত হওয়া যায়' বা জানা যায়। আমরা যে চেতনাময়, সজীব, তার কারণ আমরা সর্ব্বদা 'বোধ' বা অনুভূতিময়, অর্থাৎ সর্ব্বদা জানছি বা অনুভব করছি। তাই 'বিদ্যমানতা' মানে 'অস্তিত্ব' বা 'স্থিতি'।

এই বিদ্যা বা জ্ঞানশক্তি যাঁর দ্বারা আমরা জানছি এবং যাঁর জ্ঞানের বা বোধের মূর্ত্তি এই বিশ্ব-ভুবন, তাঁর আরেকটি নাম 'সম্ভূতি', বা সম্যক্‌ ভূতি, কেননা ইনি যা জানেন তাই হয়ে যান, তাই হয়ে ভূত বা মূর্ত্ত হন। ইনি নিজেকে নিজে বিশ্বভুবনের আকারে জেনে বিশ্ব-ভুবন হয়েছেন। ইনি নিজেকে বৃক্ষ বলে জেনে বৃক্ষ হয়েছেন, এইটি বিদ্যা বা সম্ভূতি শক্তি। আর সেই বৃক্ষ রূপ যে 'হওয়া' বা সম্ভূতি, তদনুসারে আমাদের মধ্যে যে বৃক্ষের জ্ঞান বা অনুভূতি হচ্ছে তার নাম অনুভূতি বা অল্পবিদ্যা বা অবিদ্যা। এই বিষয়ে আমার পূর্ব্বে  যা বলেছি, তার একটি অংশ উদ্ধৃত করলাম---- "যা সৃষ্টি হয়ে গেছে, আত্মস্বরূপ মহা-চেতনা যা কিছু নিজে হয়েছেন, তার নাম সম্ভূতি। আর তাঁর সেই হওয়া অনুসারে, সম্ভূতি অনুসারে, আমরা জগতকে অনুভব করছি; আমাদের অনুভূতির বিশ্বে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধময় এই বিশ্ব কে আমি জানছি। সম্ভূতি অনুসারে জানছি বলে আমাদের জানার নাম অনুভূতি বা অনুদর্শন।"

প্রতি অনুভূতির মূলে যে নিজবোধ স্বরূপ, অব্যয়, অপরিণামী আত্মা আছেন, তাঁকে দেখে মৃত্যুকে অতিক্রম করতে হয়, আর তাঁকে না দেখে পূজা, ধ্যান, ভক্তি ইত্যাদি যে ক্রিয়া বা অনুভূতিময় হওয়া, তা অবিদ্যার দ্বারা অনুসন্ধান করা এবং তাতে, আত্ম-দর্শন না হওয়ায়, মৃত্যু-দর্শন হয়। তাই বলা হলো যে, যারা অবিদ্যাকে উপাসনা করে, তারা অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে। (এই প্রসঙ্গে অনুচ্ছেদ ৫-৬ দ্রষ্টব্য।)

৯-৩। ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ------ততোধিক তমসাতে অবশ্যই (প্রবেশ করে) যারা আবার বিদ্যাতে রত।

বিদ্যা অর্থে সম্ভূতি, এ কথা আগের অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। যারা মাত্র এই সম্ভূতি (বিদ্যা), বা সম্ভূত বিশ্ব, বা সৃষ্ট বিশ্বকে নিয়েই অধ্যয়ন করছে, বা উপাসনা করছে, যে আত্মস্বরপ চেতনা এই বিশ্ব মূর্ত্তি --যাঁর চেতনায় বা জ্ঞানে সবাই সৃষ্ট হয়েছে, তাঁর বিষয়ে যারা অনুভূতিহীন বা জ্ঞানহীন, তারা আরও অধিক অন্ধকারে বা তমে প্রবেশ করে, কেননা চেতনাকে না দেখা হেতু তারা এই জড় বা ভৌতিক বিশ্বকে নিয়েই থাকে বা তার উপাসনা বা চর্চা করে। যারা অবিদ্যা বা মাত্র-অনুভূতি নিয়ে থাকে, তারা প্রাণময়তা বা অনুভূতিকে অবলম্বন করে বলে, ততটা অন্ধকারে প্রবিষ্ট হয় না; আত্মজ্ঞান না থাকায়, অনুভূতির মূলে যে নিজবোধ রয়েছেন, যিনি অবিনশ্বর, তাঁকে না জানায়, তারাও মৃত্যুতে অন্ধকার বা অজ্ঞানতা বোধ করে'*।  কিন্তু  যারা মাত্র ভৌতিকতার চর্চা করে, মাত্র বিদ্যা বা সম্ভূতি, বা সম্ভূত বিশ্ব নিয়েই থাকে, তারা অধিকতর ভৌতিক-সঙ্গের জন্য মৃত্যুর পর অধিকতর অন্ধকার অনুভব করে।

(*এই জন্য এই উপনিষদের ১৪শ মন্ত্রে  অনুভূতি বা অবিদ্যাকে 'বিনাশ' বলা হয়েছে।)

১০ম মন্ত্র।

অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়া'ন্যদাহুরবিদ্যয়া।

ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে।।

অন্বয়-অর্থ।

অন্যৎ এব (অন্যই) আহুঃ (বলেছেন) বিদ্যয়াঃ (বিদ্যার দ্বারা)------ 'বিদ্যার দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন ।

অন্যৎ (অন্য থেকে) আহুঃ (বলেছেন) অবিদ্যয়াঃ (অবিদ্যার দ্বারা)---- 'অবিদ্যার দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন ।

ইতি (ইহাই) শুশ্রুম (শুনেছিলাম) ধীরাণাং (ধীরগণের থেকে) যে ( যাঁরা) নঃ (আমাদের) তৎ (তাঁকে) বিচচক্ষিরে (বি+ চচক্ষিরে---বিশেষ ভাবে দেখিয়েছিলেন)----ইহাই শুনেছিলাম ধীরগণের থেকে যাঁরা আমাদের বিশেষ ভাবে তাঁকে দেখিয়েছিলেন।

অর্থ।

'বিদ্যার দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন। 'অবিদ্যার দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন। ইহাই শুনেছিলাম ধীরগণের থেকে যাঁরা আমাদের বিশেষ ভাবে তাঁকে দেখিয়েছিলেন।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

বিদ্যা অর্থে বেদন বা জ্ঞান-শক্তি। এই জ্ঞানশক্তির দ্বারা বা জানার দ্বারা সকল কিছু সৃষ্ট হয়েছে, মূর্ত্ত বা ভূত হয়েছে বলে এঁর নাম 'সম্ভূতি'। ( ৯ম মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বিদ্যা এবং অবিদ্যা,  সম্ভূতি এবং অনুভূতির কথা বলা হয়েছে।)

১০-১। 'অবিদ্যার দ্বারা অন্যই'।

আমরা অল্পবিদ্যা বা অনুভূতিময়। এই অনুভূতির দ্বারাই আমরা গঠিত হচ্ছি বা আমাদের পরিবর্ত্তন এবং বিবর্ত্তন হচ্ছে। জন্ম-জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে সংঘটিত এই বিবর্ত্তনে, আমরা পশু থেকে মানুষ এবং মানুষ থেকে উন্নত-তর জীবে পরিণত হচ্ছি। এই বিবর্ত্তন বৃহৎ, জটিল এবং বিপুল কালের মধ্যে বিস্তৃত। পরিবর্ত্তিত হতে হতে, ক্রমশঃ আমরা   আমাদের মধ্যে যে অপরিণামী, স্থির আত্মস্বরূপ বা নিজবোধ রয়েছেন, তাঁর বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছি। প্রতি অনুভূতির মূলে, নিজবোধ বা স্বয়ং বোধ রয়েছেন, এবং এই নিজ, স্বয়ং বা আত্মবোধ, আমাদের অনুভূতিময় বা অনুভূতিতে গড়া বিশ্বের মূলে রয়েছেন। অবিদ্যার দ্বারা বা, অবিদ্যা, অনুভূতির অবলম্বনে এই আত্মস্বরপ দৃষ্ট হন, যিনি অপরিণামী, যিনি সর্ব্ব অনুভূতির মূলে। মৃত্যু এবং নিদ্রাও আমরা এই নিজবোধে বা এই আত্মবোধেই ভোগ করি। সুতরাং অবিদ্যার দ্বারা নিজের অবিনশ্বরতার বিষয়ে জ্ঞান লাভ হয় এবং মৃত্যু বা মৃত্যুভয় দূর হয়।

১০-২।' বিদ্যার দ্বারা অন্যই ' ।

বিদ্যার দ্বারা এই নিজবোধ বা আত্মাই যে সবার আত্মা বা বিশ্বাত্মা, এবং ঈশ্বর বা সকলের নিয়ন্তা, এইটি জানা হয়, বা নিজের অর্থাৎ আত্মার ঈশিত্ব দর্শন হয়। চিৎস্বরূপ আত্মার একটি নাম 'জাতবেদা'। যিনি জানতে জানতে বা বেদন করতে করতে জাত হন, এবং জাত হতে হতে জানেন বা বেদন করেন, তিনি 'জাতবেদা'। প্রাণ বা অগ্নিকে বেদ 'জাতবেদা'  বলে সম্বোধন করেছেন। জাতবেদা তিনি, যাঁর জানাটাই হওয়া, এবং যা হন, তাকেও জানেন। 

জানার দ্বারা হওয়ার যে শক্তি তাঁর নাম বিদ্যা। সেই শক্তি বেদনময় এবং তাঁর দ্বারাই সকলকিছু বিদিত হয়। ইনি কোন কিছু বিদিত হন বা কোনকিছুকে জানেন মানেই তদাকার গ্রহণ করেন বা তাই হন। আবার হয়েও যেমন তেমনি থাকেন, তাই ইনি বিশুদ্ধ আত্মস্বরূপ। 

আমরাও অন্তরে যখন যা কিছু জানছি বা অনুভব করছি, তখনই আমাদের জ্ঞান বা অনুভূতি ক্ষেত্রে তাই হচ্ছি। এইটি চেতনার ধর্ম্ম। তাই কর্ম্ম বা আমাদের অনুভূতি অনুসারে আমাদের পরিবর্ত্তন হয় এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কিরকম হবে তাও নির্দ্ধারিত হয়। কর্ম্ম  করা মানেই অনুভূতিময় হওয়া। যে, যে রকম অনুভূতিময় হয়ে কর্ম্ম করে, সে সেই প্রকার কর্ম্মফলের ভোক্তা কালক্রমে হয়। যেমন, কেউ যদি মন্ত্রের অর্থ না জেনে মন্ত্রোচ্চারণ করে, তো তাতে, সেই মন্ত্রের অন্তরে যে ভাব, এবং বিজ্ঞান আছে তা অজ্ঞাতই থাকে এবং সেই মন্ত্রের যে দেবতা বা চিন্ময় ব্যক্তিত্ব, তার দর্শনও হয় না, এবং এই কারণে সেই মন্ত্রোচ্চারণ মাত্র শব্দোচ্চারণে পরিণত হয়। আর যিনি এই সব বিষয়ে জানেন , তাঁর মন্ত্রোচ্চারণে দেবতার আবির্ভাবের জন্য দিব্যফল লাভ হয়, জাগতিক বিষয়েও সমৃদ্ধি হয়।কিন্তু অর্থ না জেনে যে মন্ত্রোচ্চারণ করে তার সেই কর্ম্মও নিষ্ফল হয় না, কেননা কর্ম্মের ফল অবশ্যম্ভাবী। তাই যে অর্থহীন মন্ত্রোচ্চারণ করে, তার সেই কর্ম্ম তাকে ক্রমশঃ সেই পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়, যাতে সে মন্ত্রের অর্থ এবং রহস্য বিদিত হতে পারে। তার আগ্রহ অনুসারে, এবং পূর্ব্ব-কৃত কর্ম্মের যে সব প্রভাব তদনুসারে, কাল-ক্রমে সে মন্ত্রার্থ এবং মন্ত্র-রহস্য বিদিত হ্য়। এই ভাবে পরমাত্মার ঈশিত্ব কালের মধ্য দিয়ে ক্রিয়াশীল। যাকে 'বিদ্যা', এবং 'সম্ভূতি' নামে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এই ঈশিত্বেরই প্রকাশ।

১০-৩। ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে-----ইহাই শুনেছিলাম ধীরগণের থেকে যাঁরা আমাদের বিশেষ ভাবে তাঁকে দেখিয়েছিলেন।

ধীরাণাং-----ধীরগণের। ধীর--স্থির, অপরিণামী, আত্মস্বরপকে বিদিত হওয়ার জন্য, যাঁদের কর্ম্ম  উপশমাত্মক  হয়ে গেছে, যাঁদের সকল কর্ম্ম  আত্মমুখী, তাঁরা ধীর পদবাচ্য। 

ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে------ইতি (ইহাই) শুশ্রুম (শুনেছিলাম) ধীরাণাং (ধীরগণের থেকে) যে ( যাঁরা) নঃ (আমাদের) তৎ (তাঁকে) বিচচক্ষিরে (বি+ চচক্ষিরে---বিশেষ ভাবে দেখিয়েছিলেন)-----যিনি ' তৎ ' পদবাচ্য, যাঁকে কোন বিশেষ নামের দ্বারা, বা সংজ্ঞার দ্বারা নির্দিষ্ট করা যায় না, তিনি সেই ধীরগণের বাক্যের আকারে নিজেকে বিজ্ঞাপিত, দর্শনীয়  করেছিলেন। সেই বাক্য সকলই শ্রুত হয়ে শ্রুতি হয়েছিল, বেদ মন্ত্র বা বেদ বাক্য হয়েছিল। 

১১শ মন্ত্র।

বিদ্যাঞ্চাবিদ্যাঞ্চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ। 

অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়া'মৃতমশ্নুতে।।

অন্বয়-অর্থ।

বিদ্যাং (বিদ্যাকে) চ (এবং) অবিদ্যাং (অবিদ্যাকে) চ (এবং), যঃ (যিনি) তদ্‌ (তাঁকে) বেদঃ (জানেন) উভয়ং (উভয়কে) সহ (একসাথে)------ বিদ্যাকে এবং অবিদ্যাকে, যিনি তাঁকে জানেন, উভয়কে একসাথে------ বিদ্যা এবং অবিদ্যা, এই উভয়কে একসাথে নিয়ে যিনি তাঁকে জানেন

অবিদ্যয়া (অবিদ্যার দ্বারা) মৃত্যুং (মৃত্যুকে) তীর্ত্বা (অতিক্রম করে)  বিদ্যয়াঃ (বিদ্যার দ্বারা) অমৃতম্‌ (অমৃতকে) অশ্নুতে (লাভ করেন)------অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে বিদ্যার দ্বারা অমৃতকে লাভ করেন।

অর্থ।

বিদ্যা এবং অবিদ্যা, এই উভয়কে একসাথে নিয়ে যিনি তাঁকে জানেন, অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে বিদ্যার দ্বারা অমৃতকে লাভ করেন।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

অবিদ্যার দ্বারা বা, অবিদ্যা, অনুভূতির অবলম্বনে এই আত্মস্বরপ দৃষ্ট হন, যিনি অপরিণামী, যিনি সর্ব্ব অনুভূতির মূলে, এবং তার ফল স্বরূপ, পরিবর্ত্তনের উর্দ্ধে নিজের অপরিণামী, অব্যয় স্বরূপকে বা আত্মার অবিনশ্বরতাকে অনুভব করে সেই বিজ্ঞাতাকে আর মৃত্যু দর্শন করতে হয় না। বিদ্যার দ্বারা বা সম্ভূতির দ্বারা  আত্মার ঈশিত্ব বিদিত হয়। এ সব কথা ৯ম মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে।

কেউ যদি একটি ফুল আমাকে এনে দেয়, সেটি দেখলে, সেই ফুলের বর্ণ, গন্ধ, এবং আনুসঙ্গিক বৈচিত্র আমার অনুভূতিতে আসে। কিন্তু সেই ফুলটি কোথাকার কোন কাননে কবে ফুটেছিল, সেই ফুলের মধু কি রকম, তার কত রকম প্রজাতি আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি যে বৈশিষ্ট্য সকল, সে সব আর আমার জ্ঞানে ফুলটি দেখামাত্র অনুভূত হয় না।আমার চেতনাই, চিৎ স্বরূপ আত্মাই, ঐ ফুল হয়ে এবং আমাতে ফুলের অনুভূতি হয়ে ফুটে ফুলের ভোগ দেন। যে আত্মা, বহিরাকাশে বা বাহিরে ফুল হয়ে, ফুল রূপে সম্ভূত হয়েছেন, তিনিই সবার অন্তরে ফুলের বোধ ফোটাচ্ছেন, বা ফুল রূপে অনুভূত হচ্ছেন। সুতরাং একই আত্মা বিদ্যার দ্বারা, সম্ভূতির দ্বারা ফুল হয়েছেন এবং অনুভূতি বা অবিদ্যার দ্বারা সেই ফুলকে অনুভব করছেন*। অনুভূতির বিশ্ব, বা যে জ্ঞানময় ক্ষেত্রে আমরা আছি, সেই দিকে দৃষ্টিপাত হলে, ক্রমশঃ ভৌতিকতার উপরে যে জ্ঞানক্ষেত্র আধিপত্য করছেন এবং যে  পরিবর্ত্তন-হীন নিজবোধ সর্ব্ব জ্ঞানক্রিয়ার উৎস তার ধারণা গভীরতর হয় এবং একই নিজ বা আত্মা যে সবার মধ্যে নিজ বা আত্মবোধ স্বরূপ এবং তাঁর দ্বারাই জ্ঞানময় বিশ্ব এবং সেই জ্ঞান-প্রসূত ভৌতিক বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, এই জ্ঞানের অভ্যুদয় হয়।এর নাম অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে বিদ্যার দ্বারা অমৃতকে লাভ করা।

(* যে ফুল বা ফুল নামক একটি জীব বা সত্তা, সেও নিজেকে ফুল বলে অনুভব করছে, আর সেই ফুলের থেকে পৃথক যে সত্তারা, তারাও সেই ফুল দেখে ফুলের অনুভূতিময় হচ্ছে, বা নিজের অন্তরে ফুল হচ্ছে। আবার প্রত্যেকের অনুভূতি প্রত্যেকের থেকে আলাদা, এবং সেই অনুভূতি সেই জীবের বা সেই সত্তার সংস্কার অনুযায়ী হয়, বা সে চেতনায় যেভাবে গৃহীত হয়েছে তদনুসারে হয়। )

১১-১। বিদ্যাঞ্চাবিদ্যাঞ্চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ-----বিদ্যা এবং অবিদ্যা, এই উভয়কে একসাথে নিয়ে যিনি তাঁকে জানেন

যিনি আমার মধ্যে 'নিজ', বা নিজ-বোধ স্বরূপ আত্মা, তিনিই যে সবার মধ্যে নিজ বা  নিজ-বোধ স্বরূপ আত্মা, এবং আমার, বা আমার অনুভূতি বা বোধ ক্ষেত্রের মূলে যে 'নিজ', সবার বা সবার অনুভূতি বা বোধ ক্ষেত্রের  মূলে  সেই একই ' নিজ ' বা নিজবোধ, এই প্রজ্ঞাকে অনুধাবন করা বা এই প্রজ্ঞার উপাসনা করাই, বিদ্যা এবং আবিদ্যা, এই উভয়কে নিয়ে বা এই উভয়-সহ আত্মোপসনা করা। এই জন্য বিদ্যা এবং অবিদ্যা, এই উভয়কে একসাথে নিয়ে তাঁকে (যিনি জ্ঞান এবং আত্মস্বরূপ) জানার কথা বলা হয়েছে।  

১২শ মন্ত্র।

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে'সম্ভূতিমুপাসতে।

ততো ভূয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ।। (১২।)

অন্বয়-অর্থ। 

অন্ধং (যা অন্ধ তাতে;  অন্ধকারে) তমঃ (তমতে; তমসাতে) প্রবিশন্তি (প্রবেশ করে) যে (যারা) অসম্ভূতিম্‌ (অসম্ভূতিকে; অসম্ভূতির) উপাসতে (উপাসনা করেন)------অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে যারা অসম্ভূতিকে উপাসনা করে।

ততঃ (তার থেকেও) ভূয়ঃ (বেশী; অধিক)  ইব (অবশ্যই)  তে  (তারা) তমঃ (তমতে; তমসাতে) য (যারা)  উ (আবার) সম্ভূত্যাং (সম্ভূতিতে) রতাঃ (রত)----- ( তার থেকেও অধিক) ততোধিক তমসাতে অবশ্যই (প্রবেশ করে) যারা আবার সম্ভূতিতে রত ।

অর্থ। 

যারা অসম্ভূতিকে উপাসনা করে, (তারা), অন্ধ তমসাতে প্রবেশ করে। ততোধিক তমসাতে অবশ্যই (প্রবেশ করে) যারা আবার সম্ভূতিতে রত ।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা ৯ম মন্ত্রে করা হয়েছে। ৯ম মন্ত্রে যা 'অবিদ্যা', এই মন্ত্রে তাই ' অসম্ভূতি ', এবং ৯ম মন্ত্রে যা 'বিদ্যা', এই মন্ত্রে তাই ' সম্ভূতি '। 

যখন বেদন বা বোধক্রিয়ার উপর লক্ষ করে বলা হয়ছে, তখন 'বিদ্যা' এবং 'অবিদ্যা' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। যখন শক্তি বা নিজের থেকে নিজের দ্বিতীয়তা বা নিজের 'বাহ্য' রচনা লক্ষ করে বলা হয়ছে, তখন সম্ভূতি এবং অনুভূতি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে।

১৩শ মন্ত্র।

 অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ।

ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে।। 

অন্বয়-অর্থ।

অন্যৎ এব (অন্যই) আহুঃ (বলেছেন) সম্ভবাৎ (সম্ভূতির দ্বারা)------ ' সম্ভূতির  দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন ।

অন্যৎ (অন্য থেকে) আহুঃ (বলেছেন) অসম্ভবাৎ (অসম্ভূতির দ্বারা)---- 'অসম্ভূতির দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন ।

ইতি (ইহাই) শুশ্রুম (শুনেছিলাম) ধীরাণাং (ধীরগণের থেকে) যে ( যাঁরা) নঃ (আমাদের) তৎ (তাঁকে) বিচচক্ষিরে (বি+ চচক্ষিরে---বিশেষ ভাবে দেখিয়েছিলেন)----ইহাই শুনেছিলাম ধীরগণের থেকে যাঁরা আমাদের বিশেষ ভাবে তাঁকে দেখিয়েছিলেন।

অর্থ।

'সম্ভূতির দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন। 'অসম্ভূতির দ্বারা অন্যই', বলেছিলেন। ইহাই শুনেছিলাম ধীরগণের থেকে যাঁরা আমাদের বিশেষ ভাবে তাঁকে দেখিয়েছিলেন।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা ১০ম মন্ত্রে করা হয়েছে। ১০ম মন্ত্রে যা 'অবিদ্যা', এই মন্ত্রে তাই ' অসম্ভূতি ', এবং  ১০ম মন্ত্রে যা 'বিদ্যা', এই মন্ত্রে তাই ' সম্ভূতি '। 

যখন বেদন বা বোধক্রিয়ার উপর লক্ষ করে বলা হয়ছে, তখন 'বিদ্যা' এবং 'অবিদ্যা' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। যখন শক্তি বা নিজের থেকে নিজের দ্বিতীয়তা বা নিজের 'বাহ্য' রচনা লক্ষ করে বলা হয়ছে, তখন সম্ভূতি এবং অসম্ভূতি  শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। অসম্ভূতি অর্থে  'সীমিত সম্ভূতি' বা অনুভূতি। যিনি আমাদের আত্মা, তাঁর মনই বা তাঁর মনের কথাগুলি ভৌতিক বিশ্ব হয়ে, প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনের কথা যা আমাদের হৃদয়ের ভাব থেকে ফুটছে, তা আমাদের মনের মধ্যেই থাকে। যেমন আমি যদি মনের মধ্যে একটি ফুলের কথা ভাবি, সেই ভাবনাটিকে একটি ভৌতিক ফুলের আকারে বাইরে বা বহিরাকশে প্রকাশ করতে পারি না। 

১৪শ মন্ত্র।

সম্ভূতিঞ্চ বিনাশঞ্চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ। 

বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা সম্ভূত্যা'মৃতমশ্নুতে।। (১৪।)

অন্বয়-অর্থ।

সম্ভূতিং (সম্ভূতিকে) চ (এবং) বিনাশং (বিনাশকে) চ (এবং), যঃ (যিনি) তদ্‌ (তাঁকে) বেদঃ (জানেন) উভয়ং (উভয়কে) সহ (একসাথে)------ সম্ভূতিকে এবং বিনাশকে, যিনি তাঁকে জানেন, উভয়কে একসাথে------ সম্ভূতি এবং বিনাশ, এই উভয়কে একসাথে নিয়ে যিনি তাঁকে জানেন

বিনাশেন (বিনাশেের দ্বারা) মৃত্যুং (মৃত্যুকে) তীর্ত্বা (অতিক্রম করে) সম্ভূত্যাঃ (সম্ভূতির দ্বারা) অমৃতম্‌ (অমৃতকে) অশ্নুতে (লাভ করেন)------বিনাশেের দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে সম্ভূতির দ্বারা অমৃতকে লাভ করেন।

অর্থ।

সম্ভূতি এবং বিনাশ, এই উভয়কে একসাথে নিয়ে যিনি তাঁকে জানেন, বিনাশেের দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে সম্ভূতির দ্বারা অমৃতকে লাভ করেন।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা ১১শ মন্ত্রে করা হয়েছে। ১১শ মন্ত্রে যা 'অবিদ্যা', এই মন্ত্রে তাই ' বিনাশ ', এবং  ১১শ মন্ত্রে যা 'বিদ্যা', এই মন্ত্রে তাই ' সম্ভূতি '। 

যখন বেদন বা বোধক্রিয়ার উপর লক্ষ করে বলা হয়ছে, তখন 'বিদ্যা' এবং 'অবিদ্যা' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। যখন শক্তি বা নিজের থেকে নিজের দ্বিতীয়তা বা নিজের 'বাহ্য' রচনা  লক্ষ করে বলা হয়ছে, তখন সম্ভূতি এবং বিনাশ (অনুভূতি) শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। বিনাশ অর্থে অনুভূতি, কেননা আমাদের অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী, অন্তবান্‌।

সুতরাং, ' বিনাশ ', ' অনুভূতি ' এবং ' অসম্ভূতি ', এই তিনটি শব্দ একই অর্থ জ্ঞাপন করে।

সম্ভূতি, অনুভূতি (বিনাশ, অসম্ভূতি) এবং বিশ্বের দেবতারা।

পূর্ব্বে ৫-৭ অনুচ্ছেদে 'দেবতা' এবং আত্মার ঈশিত্বের যে সম্বন্ধ, তদ্বিষয়ে বলা হয়েছে। বিদ্যা, বেদ, বেদন এই শব্দগুলি বিদ্‌ ধাতু থেকে উৎপন্ন। বিদ্‌ অর্থে 'জানা' বা 'বিদিত হওয়া'। চেতনা মানেই তা বেদনময়, হৃদয়ময়, অনুভূতিময়, চক্ষুমান্ এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। এই অন্তহীন চেতনার যে বিশেষ বিশেষ  প্রকাশবান্‌ সত্তা, তাঁরা ব্যবহারময়, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, এবং তাঁদের নাম দেবতা। প্রকাশময়তা এবং আনন্ত্য হল এই দেবক্ষত্রের ধর্ম্ম। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধের অন্তহীন, অনন্ত বৈচিত্র্যময় প্রকাশ এই দেবক্ষেত্রে উপলব্ধি হয়। যা অন্তরে 'বেদ', তাঁর ব্যবহারময় রূপ হল 'দেব' বা 'দেবতা'। পরমাত্মস্বরূপের বা ঈশ্বরের এই  দেবময়তা কে লক্ষ করে 'বিদ্যা' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে, এবং 'বিদ্যার ঈষৎ প্রকাশ বা বিদ্যার অনুগত যে চিৎ প্রকাশ তাকে অবিদ্যা, অনুভূতি বলে হয়েছে। আমরা মাত্র অনুভূতিময় হয়ে, আত্মজ্ঞান-হীন অবস্থায় যে উপাসনা করি বা সত্যকে জানার যে চেষ্টা করি, তাতে মৃত্যুর থেকে অব্যহতি পাই না, এবং সেই জন্য অনুভূতিকে 'বিনাশ' বলা হয়েছে। আমাদের অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী, চিরকাল থাকে না। আত্মা স্বয়ংশক্তি, স্বয়ংপ্রকাশ। আত্মার ঈশিত্ব এবং তার অন্তর্গত দেবতারা এই স্বয়ংপ্রকাশেরই প্রকাশ। যখন এই স্বয়ংশক্তি, স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার দিকে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, তখন সম্ভূতি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। 

১৫শ মন্ত্র।

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্‌।

তৎ ত্বং পুষন্নপাবৃণু সত্যধর্ম্মায় দৃষ্টয়ে।।

অন্বয়-অর্থ।

হিরণ্ময়েন (হিরণ্ময়) পাত্রেণ (পাত্রের দ্বারা) সত্যস্য (সত্যের) অপিহিতং (আবৃত) মুখম্‌ (মুখ)------হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখ আবৃত

তৎ (তাহা) ত্বং (তুমি) পূষন্‌ (হে পূষা) অপাবৃণু (অপাবৃত কর; অনাবৃত কর) সত্যধর্ম্মায় (সত্য ধর্ম্মের জন্য) দৃষ্টয়ে (দর্শনের জন্য-------তাহা তুমি, হে পূষা, অনাবৃত কর সত্যধর্ম্মের জন্য, (সত্য) দর্শনের জন্য।

অর্থ।

হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখ আবৃত, তাহা তুমি, হে পূষা, অনাবৃত কর সত্যধর্ম্মের জন্য, (সত্য) দর্শনের জন্য।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

১৫-১।হিরণ্ময় পাত্র।

যা প্রাণের নিশ্চয়াত্মক বেদন তার নাম হিংকার। প্রাণের প্রথম বেদনই নিশ্চয়াত্মক, যার নাম হিংকার।  এই হিংকারই আমাদেরকে অস্তিত্ব বোধময় করে রেখেছে। প্রাণ আছেন, তাই আমরা আছি। যিনি থাকলে যাঁর সাথে সবাই থাকে, এবং যিনি উঠলে যাঁর সাথে সবাই উঠে যায়, তাঁর নাম প্রাণ। প্রাণের এই উঠে যাওয়াকে উপনিষৎ 'উৎক্রমন' বলে বর্ণনা করেছেন। যা হিংকারময়, যার থেকে নিশ্চয়াত্মক বোধ ফুটছে, তা হিরণ্ময়।

এই প্রাণের যে চক্ষু বা দৃষ্টি, যার থেকে রূপময়, আয়তনময় বিশ্ব সৃজিত হয়েছে, তার নাম আদিত্য বা সূর্য। সেই আদিত্য বা সূর্যই আমাদের বহিরাকাশে, আমাদের সূর্য হয়ে আমাদেরকে প্রাণময় করেছেন, এবং পৃথিবী বা ধরিত্রীরূপে আমাদেরকে ধারণ করেছেন। (এই পৃথিবী বসু দেবতাদের অন্তর্গত; অনুচ্ছেদ ১-২ দ্রষ্টব্য।) 

যিনি সত্যস্বরূপ, তাঁকে আবৃত করে রেখেছে এই মূর্ত্ত বিশ্ব। সত্য বোধ মানেই অস্তিত্ব বোধ; যিনি সত্য তাঁর প্রকাশে আমরা অস্তিত্ব বোধময়। এই মূর্ত্ত বিশ্বই হিরণ্ময় পাত্র, যা আমাদেরকে অস্তিত্ব বোধময় করে রেখেছে। এই মূর্ত্তের আবরণে যিনি রয়েছেন, তিনি সেই চক্ষু বা দ্রষ্টা যাঁর দর্শনই দৃশ্য হয়েছে, আর আমরা সেই দৃশ্যের অনুদ্রষ্টা হয়েছি।ঐ রূপ সৃজনকারী চক্ষুই বহিরাকাশে সূর্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছেন।

সূর্যের আকর্ষণ সঞ্জাত যে বার্ষিক এবং আহ্নিক আবর্ত্তনে পৃথিবী গতিশীল হয়েছেন, তাতে যে বাৎসল্য প্রদায়ী বৎসর, ঋতু, মাস, অহোরাত্র (দিন-রাত) প্রকাশ পাচ্ছে, তার দ্বারা বা এই সকল কালের দ্বারা আমরা পুষ্ট হচ্ছি, এই সত্যস্বরূপ ভৌতিক বিশ্বে আমাদের প্রতিষ্ঠা স্থায়িত্ব পাচ্ছে। এই যে অহো-রাত্র, যা পৃথিবীর আহ্নিক গতির থেকে উৎপন্ন হচ্ছে তাই প্রাণ বা প্রাণবায়ু হয়ে, অপান* হয়ে আমাদের নাসা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয় অবলম্বনে, আমাদের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের আবর্ত্ত রচনা করে, প্রতি মুহূর্ত্তে আমাদের পার্থিব স্থিতিকে সুনিশ্চিত করছে। এই জন্য ঘ্রাণকে বৈদিক ভাষায় 'প্রাণ' বলা হয়। নিশ্বাস নেওয়া যে আঘ্রাণ তা আমরা বুঝতে পারি না। এই ভাবে আমরা পুষ্ট হচ্ছি। এই জন্য গন্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রে অনেক সময়ে 'পুষ্টি' শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়; যেমন 'ওঁ ত্র্যম্বকম্‌ যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্দ্ধনম্‌...', 'ওঁ গন্ধদ্বারাং দূরাধর্ষাং নিত্যপুষ্টাং করীষিণীম্‌....'। (*অপান এবং পৃথিবীর বিষয়ে, প্রশ্নোপনিষদের মন্ত্র ৩.৮ দ্রষ্টব্য।) 

এই পোষণ যে দেবতা সম্ভবিত করছেন, যাঁর অধিকারে আমরা পুষ্ট হচ্ছি তিনি 'পূষা' দেবতা। এই জন্য পরবর্ত্তী মন্ত্রে পূষা এবং সূর্যের নাম একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৫-২।সত্যের মুখ। 

চেতনার, প্রাণের জ্যোতির্ম্ময় প্রকাশ হলো চক্ষু। প্রাণের দেখা থেকে দৃশ্য বা দর্শনময়, আয়তনময়, সত্যবোধ জাগরণকারী এই বিশ্ব সৃষ্ট হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। এই প্রাণের ভাব এবং সেই ভাবের অর্থ-সকলই পৃথিবীরূপে, বা ভৌতিক বিশ্ব হয়ে, স্থূল হয়ে, মূর্ত্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সম্ভূত হয়েছে। ইংরাজি ভাষায় পৃথিবীকে যে Earth (আর্থ) বলা হয়, তা সংস্কৃত 'অর্থ' শব্দ থেকে হয়েছে।

এই যে ভাবময়, অর্থময় প্রাণপ্রকাশ হয়ে প্রাণ বা চেতনা, পৃথিবী বা ভৌতিক বিশ্ব হয়ে প্রতিভাত হচ্ছেন, তাকে লক্ষ করে সত্যের মুখ বলা হয়েছে। মুখ হল তা, যার থেকে প্রাণ বা প্রাণাগ্নি, ভাষা এবং অর্থ হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। 'মুখাৎ বাক্‌, বাচঃ অগ্নিঃ'----মুখ থেকে বাক্‌ এবং বাক্‌ থেকে অগ্নি জাত হলেন।( ঐতরেয় উপনিষদ্‌. মন্ত্র ১।১।৪।) অগ্নি মানে প্রাণ, যিনি স্বয়ংপ্রকাশ এবং সবাইকে চেতনা  দিয়ে, প্রাণ দিয়ে অভিতপ্ত করছেন। অগ্নি মানে অগ্‌ (অগ্র) + নী (নয়তি) -----যিনি সবার অগ্রে চলেন, যিনি সবাইকে নিয়ে অগ্রবর্ত্তী হন। প্রাণ না করলে কোন কিছু হয় না, সম্ভবিত হয় না। এই জন্য প্রাণকে 'প্রাণাগ্নি' বলা হয়।পৃথিবীর মধ্যে যেমন অগ্নি আছে, আমাদের শরীরের মধ্যে প্রাণাগ্নি জ্বলছেন, যার নাম বেঁচে থাকা। এই প্রাণই শব্দ বা বাক্য হয়ে মুখ থেকে অনবরত উচ্চারিত হচ্ছেন, আর শব্দ সকল প্রাণের অর্থকে বহন করছে। তাই যা কিছু বিশ্বরূপে প্রতিভাত তা এই প্রাণেরই শব্দ বা কথা, আর তা যে মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে, সে মুখ হলেন প্রাণ বা আত্মা স্বয়ং। আর আত্মস্বরূপ এই যে নিজেকে প্রাণময় করছেন, তাঁর সেই সামর্থ্য বা শক্তির নাম বাক্‌। 

তাই বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি বলেছেন যে, নাম এবং রূপময় এই বিশ্ব সত্য, এবং প্রাণ অমৃত;  আর এই নাম (সংজ্ঞা) রূপময় (আয়তনময়, দৃশ্যমান্‌) বিশ্বের দ্বারা প্রাণ আচ্ছাদিত হয়ে আছেন---- '  প্রাণো বা অমৃতম্‌, নাম রূপে সত্যং, তাভ্যাময়ং  প্রাণশ্ছন্নঃ ' । (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৬।৩।)

১৫-৩। তৎ ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্ম্মায় দৃষ্টয়ে-------তাহা তুমি, হে পূষা, অনাবৃত কর সত্য ধর্ম্মকে দর্শনের জন্য।

পূষা শব্দের অর্থ বা পূষাদেবের বিষয় পূর্ব্বে ১৫-১ অনুচ্ছেদে উক্ত হয়েছে।মহাপ্রাণ, যিনি পূষা, যিনি নাম-রূপময় বিশ্ব হয়ে আমাদের কে পুষ্ট করছেন, সেই পূষাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, 'এই যে বিশ্বরূপ ঢাকনা বা আবরণ তাকে  তুমি সরিয়ে দাও, সত্যধর্ম্মের জন্য, (সত্য) দর্শনের জন্য। প্রাণই সত্য।

১৬শ মন্ত্র।

পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য ব্যূহ রশ্মীন্সমূহ তেজো।

যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি

যো'সাবসৌ পুরুষঃ সো'হমস্মি।।

অন্বয়-অর্থ।

পূষন্  ( হে পূষা) এক-ঋষে (হে এক ঋষি) যম ( হে যম) সূর্য (হে সূর্য) প্রাজাপত্য (হে প্রজাপতি-ব্রত যুক্ত) ব্যূহ (ব্যূহিত 

করো) রশ্মীন্‌ (রশ্মি সকলকে) সমূহ (সমূহিত করো) তেজঃ (তেজকে) ------- হে পূষা, হে এক ঋষি, হে যম, হে সূর্য, হে প্রজাপতি-ব্রত যুক্ত,  ব্যূহিত করো রশ্মি সকলকে, সমূহিত করো) তেজঃ (তেজকে) 

যৎ (যে) তে (তোমার) রূপং (রূপ) কল্যাণতমং (কল্যাণতম) তৎ (সেই) তে (তোমার) পশ্যামি (দর্শন করছি)-----তোমার যে কল্যাণতম রূপ, সেই তোমার (রূপ) দর্শন করছি

যঃ (যিনি) অসৌ (ঐ) অসৌ (ঐ)  পুরুষঃ (পুরুষ) সঃ (তিনি) অহম্‌ (আমি) অস্মি (হই)------যিনি ঐ,ঐ (যে) পুরুষ, তিনি আমিই।

অর্থ।

হে পূষা, হে এক ঋষি, হে যম, হে সূর্য, হে প্রজাপতি-ব্রত যুক্ত, ব্যূহিত করো রশ্মি সকলকে, সমূহিত করো তেজকে;  তোমার যে কল্যাণতম রূপ, সেই তোমার (রূপ) দর্শন করছি। যিনি ঐ,ঐ (যে) পুরুষ, তিনি আমিই।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

 ১৬-১।পূষা শব্দের অর্থ এবং ব্যাখ্যা ১৫-১ অনুচ্ছেদে উক্ত হয়েছে।

১৬-২।একর্ষে ---হে এক ঋষি। ঋষি শব্দটি ঋষ্‌ ধাতু  থেকে হয়েছে। ঋষ্ ধাতুর অর্থ  'দ্রুত চলা বা দ্রুত প্রবাহিত হওয়া'। ঋষ্ ধাতুর আর একটি অর্থ দৃশ্‌ বা দেখা। দেখা মানেই চলা, একথা আমরা পূর্ব্বে ১-৫ অনুচ্ছেদে বলেছি। এক-ঋষি বা একর্ষি অর্থে, যিনি এক বা সর্ব্বাত্মা, সর্ব্ব-প্রাণ, বিষ্ণু, যাঁর দর্শন সর্ব্ব-প্রকাশকারী এবং যাঁর দর্শন থেকে কাল-গতি বা সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের আবর্ত্তন সঞ্জাত হচ্ছে।  

১৬-৩।যম।

যম অর্থে যিনি যমন বা সংযমন করছেন। চিন্ময় আত্মস্বরূপ যে অভিব্যক্তির দ্বারা যমন বা সংযমন করেন, তাঁর সেই অভিব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বই যম-দেবতা। 'ম' অক্ষরের একটি অর্থ 'অব্যক্ত'। সংস্কৃত ভাষায় 'মা' অর্থে 'না' বোঝায়। 'য' অর্থে অন্তর থেকে বা যিনি অন্তস্থ, তাঁর যমন বা নিয়ন্ত্রণ বোঝায়। যে কারণে 'য' অক্ষরটিকে অন্তস্থ 'য' বলা হয়। 'জ' বা যা কিছু জাত বা ব্যক্ত হয়েছে, তার অন্তরে যে মৃত্যু-হীন অবিনশ্বর আত্মা রয়েছেন, যাঁর থেকে সকল কিছু ব্যক্ত হয়েছে, সেই অবিনশ্বর আত্মার দিকে যিনি অখিল জীব-বর্গকে নিয়ে চলেছেন, তিনি যম-দেবতা। এই যমন, আত্মার ঈশিত্বের অন্তর্গত। আত্মজ্ঞান না থাকার জন্য, আমরা অন্তে, অর্থাৎ জীবনের শেষে, মৃত্যু বা নিজের নশ্বরতাকে উপলব্ধি করি। এই নশ্বরতার এবং নিজকে যেন হারিয়ে ফেলছি এই অনুভূতিই মৃত্যু দর্শন। এই মৃত্যুর অনুভূতিই আমাদের কে চালিত করে নিজের অবিনশ্বর, অমৃতময় স্বরূপকে খুঁজে পেতে।

নিজের যেকোনো বৃত্তিকে যদি অন্তরে জ্ঞান বা বোধের মূর্ত্তি বা আত্মার জ্ঞানপ্রকাশ বলে দেখা হয়, তো সেই বৃত্তির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ এসে যায়, সেই বিষয়ে সংযম বা সংযত ভাব স্বাভাবিক ভাবে উৎপন্ন হয়। সংযত - যা সম্যক্‌ (সং) ভাবে অন্তরে (য) প্রতিষ্ঠিত (ত) হয়েছে।

এই যম অমৃতের বা অব্যয় আত্মার আবরণ দেবতা। এই মৃত্যুর দ্বারাই অমৃত আবৃত।তাই এই অমৃত আত্মার একজন শ্রেষ্ঠ উপদেষ্টা হলেন যম এবং তাঁর উপদেশ কঠোপনিষদে বিবৃত হয়েছে।

১৬-৪। সূর্য----- সূ---- সূচ্‌----সূচনা;  সূ> সু---সুত হওয়া + ঋ (গতি) + য (যমন বা নিয়ন্ত্রণ)। 

যাঁর থেকে সমস্ত কিছু সূচিত হচ্ছে, এবং তাঁর দ্বারা 'গতিশীল হয়ে যমিত বা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তিনি সূর্য, বা প্রাণের সেই স্বরূপের নাম সূর্য। ত্রি-সবন (প্রাতঃ-মধ্যাহ্ন-সায়ং, বা জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি, বা সৃষ্টি-স্থিতি-লয়) যাঁর থেকে প্রকাশ পাচ্ছে, তিনি সূর্য এবং তাই তাঁর নাম 'সবিতা'। 

১৬-৫।প্রাজাপত্য---যিনি প্রজাপতি-ব্রত ধারণ করেছেন, বা প্রজা-পালনই যাঁর ব্রত। 

যা কিছু সৃষ্ট, তা প্রাণ থেকে জাত হয়েছে এবং তাই তাদের নাম প্রজা।যা যেখানে জাত হচ্ছে, যা কিছু জাত হচ্ছে, তা প্রাণই। তাই ইনি প্রথম জাত বা প্রজা। প্রশ্নোপনিষদে বলা হয়েছে, 'প্রজাপতিশ্চরসি গর্ভে ত্বমেব প্রতিজায়সে----হে প্রাণ প্রজাপতি রূপে তুমি গর্ভের মধ্যে বিচরণ কর, এবং তুমিই প্রতিজাত হও (গর্ভ থেকে)। ইনিই প্রতিজাত হন, তাই ইনি প্রজা।(প্রশ্নোপনিষদ্‌----মন্ত্র ২।৭ দ্রষ্টব্য।)ইনিই প্রজাদের পালন করেন, তাই ইনি প্রজাপতি। 'সংবৎসরো  বৈ প্রজাপতিঃ-----সংবৎসরই প্রজাপতি----কাল হয়ে, ষড়্‌-ঋতু যুক্ত হয়ে ইনি প্রজাদের পালন করছেন; কাল হয়ে কল্যাণ প্রদান করছেন।সংবৎসর = বাৎসল্যময় কাল। (প্রশ্নোপনিষদ্‌----মন্ত্র ১।৯ দ্রষ্টব্য।)

১৬-৬। ব্যূহ রশ্মীন্‌----- ব্যূহিত করো রশ্মি সকলকে।

রশ্মি।

আত্মা প্রাণ হয়ে বহু হয়েছেন। নিজেকে চূর্ণ করে প্রচুর হয়েছেন। স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার বহু বহু আত্মখণ্ডে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়াকে লক্ষ করে বলা হয়েছে, 'সহস্র রশ্মিঃ শতধা বর্ত্তমানাঃ প্রাণঃ প্রজানাম উদয়তি এষঃ সূর্যঃ' ------সহস্র সহস্র রশ্মি শত-শত ভাগে বিভক্ত হয়ে বর্ত্তমান; প্রজাগণের প্রাণ এই সূর্য উদিত হয়েছেন'। (প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৮ দ্রষ্টব্য।)। রাশি রাশি আত্ম-খণ্ডকে নিজের থেকে জাত করে  প্রকাশময় এবং পৃথক পৃথক বর্ত্মে বা সংক্রমণ মার্গে  প্রাণ চালনা করছেন, এবং সূত্র হয়ে প্রতি আত্ম-খণ্ডকে নিজেতে যুক্ত করে রেখেছেন। এই জ্যোতির্ম্ময় সূত্রগুলি বা আত্মপ্রসারণই রশ্মি। 

ব্যূহ।

রশ্মিগুলিকে তাদের বৈশিষ্ট্য বা গুণ অনুযায়ী সংগৃহীত করে বিভিন্ন শ্রেণী বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত করার নাম 'ব্যূহ রচনা' করা এবং ঐ শ্রেণীগুলিই ব্যূহগুণগত বিভাগের দ্বারা আত্ম-খণ্ডগুলিকে এই ভাবে সংগ্রহ করতে থাকলে, শেষ পর্য্যন্ত দ্বাদশ (১২)টি রাশি বা গোষ্ঠী হয়। এই দ্বাদশ রাশি, আদিত্যের দ্বাদশ স্বরূপকে জ্ঞাপন করে। আদিত্যের এই দ্বাদশ স্বরূপের একটির নাম 'পূষা'। 

হে আদিত্য, অদিতির সন্তান, অদ্বিতীয়তা-ময়, তোমার যে সহস্র সহস্র রশ্মি শত-শত ভাগে বিভক্ত হয়ে বর্ত্তমান, যা তোমারই খণ্ড, বা যা বিশ্ব রূপে প্রতীয়মান, সেই অনন্ত রশ্মিগুলিকে ব্যূহিত করো, যাতে সবার মধ্যে যে তুমি এক, অদ্বিতীয়, তোমার সেই অদিতিত্ব আমরা দেখতে পাই।

ব্যূহ= বি (বিশেষ) + উহ (উক্ত,নির্দিষ্ট)----বিশেষ বিশেষ ভাবে উক্ত বা নির্দিষ্ট করা; বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী,বর্গ, বা রাশিতে সন্নিবেশ করা। 

১৬-৭। সমূহ তেজো----- সমূহিত করো তেজকে।

পূর্বে উক্ত হয়েছে যে রশ্মি সকল ব্যূহিত হয় দ্বাদশ রাশিতে বা দ্বাদশ আদিত্যে। এই যে আদিত্যের দ্বাদশ রূপ যা দ্বাদশ রাশির উৎস, সেই দ্বাদশ আদিত্য, এক, অদ্বিতীয় অদিতিরই স্পন্দন বা তেজ থেকে জাত, অদিতির তনয়। তেজ মানে 'তৎ এজতি'------তৎ (সে) এজতি (এজন করছেন বা কম্পিত হচ্ছেন)। এই অদ্বয়, আদিত্য-রাগ রঞ্জিত আত্মশক্তি অদিতিতে, অদ্বয়-আত্মস্বরূপে, সমস্ত তেজ সমূহিত হয়েছে। সব তেজ, স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার তেজোময়তা, প্রকাশ উন্মুখতা, এবং তাঁতেই সমূহিত হয়। 

রশ্মিগুলি ব্যূহিত হয় তেজে এবং তেজ সমূহিত হয় অদিতিতে, অদ্বয় আত্মত্বে। বিশেষ বিশেষ ভাবে, এক-একটি করে বর্গ বা রাশিতে যে সংগ্রহ করা সেইটি হল ব্যূহ রচনা, এবং ব্যূহগুলিকে 'সম' ( 'স', সবন, সৃষ্টি বা যা ব্যক্ত; 'ম' বা মৃত্যু বা যা  অব্যক্ত), বা যিনি ব্যক্ত এবং অব্যক্ত দুইই, যিনি সবার সাথে 'সমান',তাঁতে একীভূত করার নাম সমূহিত করা।

এই জন্য ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে প্রয়াণ কালে, বাক্য মনে, মন প্রাণে, প্রাণ তেজে এবং তেজ পরমদেবতায় একীভূত হয়। (বাঙ্‌ মনসি সম্পদ্যতে, মনঃ প্রাণে, প্রাণঃ তেজসি, তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম্‌------- ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৬।১৫।১ এবং ৬।১৫।২  দ্রষ্টব্য।)

১৬-৮। যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি-----তোমার যে কল্যাণতম রূপ, সেই তোমার (রূপ) দর্শন করছি। 

কল্যাণ----কালং দদাতি কল্যাণম্‌---কাল যা দান করেন, যা কাল-বাহিত, তার দ্বারা কল্যাণ হয়। যে অদ্বয় আত্মা কালের উৎস, তিনি কল্যাণতম।  রূপ প্রকাশ মানেই কাল প্রকাশ----সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় এই তিনটি ক্রম হয়ে কাল বা প্রাণ প্রকাশিত হচ্ছেন। ইনি ত্রিবিক্রম বিষ্ণু, যিনি চলছেন এবং প্রকাশ করছেন, কাল-ক্রমময় হচ্ছেন এবং রূপ প্রকাশ করছেন। তাই ঋক্‌ বেদে ঋষি বলেছেন, বিষ্ণুর যে পরম পদ (অর্থাৎ 'পা' যার থেকে গতি বা কাল সৃষ্ট হয়, তা সূরগণ (সুর্য বা আদিত্য মণ্ডলস্থ দেবগণ) সদা দর্শন করেন, যা কিনা দিবির বা দ্যুলোকের মতো যে চক্ষু (প্রকাশ) সর্ব্ব ব্যাপী (আততম্‌)। আত্যন্তিক ভাবে আতত (বিস্তৃত)।মন্ত্রটি নীচে উক্ত হলো।

মন্ত্র।

তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাততম্‌ ।।( ঋক্‌ বেদ, মন্ত্র ১.২২.২০।)

অর্থ।

তৎ (সেই) বিষ্ণোঃ (বিষ্ণুর) পরমং (পরম) পদং (পদকে) সদা (সদা) পশ্যন্তি (দর্শন করেন) সূরয়ঃ (সুরগণ /দেবতারা)। দিবি ইব (দিবি/দ্যুলোকের মতো) চক্ষুঃ (চক্ষু) আততম্‌ (বিস্তৃত)------সেই বিষ্ণুর পরম পদকে সদা দর্শন করেন সুরগণ (দেবতারা)। দ্যুলোকের মতো বিস্তৃত চক্ষু (সেই পরম-পদ দ্যুলোকের মতো বিস্তৃত চক্ষু (প্রকাশবান্‌)।

সূর্য থেকে যে কাল এবং রূপ (আলোক) বিকীর্ণ  হচ্ছে, তা এই বিষ্ণুর পরমপদ থেকে উৎসরিত। এই পদই জগচ্চক্ষু, সর্ব্বব্যাপী আত্ম-সম্প্রসারণময় আত্মা। 

১৬-৯। যো'সাবসৌ পুরুষঃ সো'হমস্মি----যিনি ঐ,ঐ (যে) পুরুষ, তিনি আমিই।

যিনি পূষা, যিনি এক ঋষি, যিনি যম, যিনি সূর্য, যিনি প্রজাপতি,যিনি কল্যাণতম, তিনি যে পুরুষ তিনিই আমি। সূর্যের থেকে বিচ্ছুরিত প্রতি আলোর কণা যেমন সূর্যই, তেমনই ঐ এক, অদ্বিতীয় আত্মা বা অক্ষর-আত্মা, যিনি  নিজেকে  খণ্ডিত করে বহু হয়েছেন। সেই প্রতি খণ্ডিত আত্মা, বা ক্ষর-আত্মা ( অক্ষর-আত্মা থেকে ক্ষরিত আত্মারা) সেই অক্ষরই, সেই পরম-আত্মস্বরূপই। 

১৭শ মন্ত্র।

বায়ুরনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম্‌।

ওঁ। ক্রতো স্মর কৃতং স্মর ক্রতো স্মর কৃতং স্মর।।

অন্বয়-অর্থ।

বায়ুঃ (বায়ু প্রবাহিত হোক ) অনিলম্‌ (অনিলে) অমৃতম্‌ (অমৃতে) অথ (অনন্তর) ইদং (এই) ভস্মান্তং (ভস্মীভূত)----বায়ু (প্রাণবায়ু) প্রবাহিত হোক অনিলে, অনন্তর এই (শরীর) ভস্মীভূত

ওঁ । ক্রতো (হে ক্রতু) স্মর (স্মরণ কর)  কৃতং (কৃতকে; কৃত কর্ম্মকে) স্মর (স্মরণ কর)  ক্রতো (হে ক্রতু) স্মর (স্মরণ কর)  কৃতং (কৃতকে; কৃত কর্ম্মকে) স্মর (স্মরণ কর)----হে ক্রতু (হে সংকল্প> হে সংকল্পময় পুরুষ) স্মরণ কর---- কৃত কর্ম্মকে স্মরণ কর, হে ক্রতু (হে সংকল্প> হে সংকল্পময় পুরুষ) স্মরণ কর---- কৃত কর্ম্মকে স্মরণ কর।

অর্থ।

বায়ু (প্রাণবায়ু) প্রবাহিত হোক অনিলে অমৃতেঅনন্তর এই শরীর ভস্মীভূত। হে ক্রতু (হে সংকল্পময় পুরুষ) স্মরণ কর--- কৃত কর্ম্মকে স্মরণ কর;  হে ক্রতু (হে সংকল্পময় পুরুষ) স্মরণ কর--- কৃত কর্ম্মকে স্মরণ কর।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

ঈশিত্ব হেতু যে কাল প্রকাশ হচ্ছে, তাতে সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় এই তিনটি ক্রম আমরা অনুভব করছি। এই উপনিষদের প্রথম মন্ত্রে ত্যাগের দ্বারা ভোগের কথা ঋষি বলেছেন। এই মন্ত্রে ভোগের অন্তে, জন্ম থেকে মৃত্যুর যে একটি কালাবর্ত্তন, সেই আবর্ত্তনের যে শেষ পর্যায়, তদ্বিষয়ে বলা হয়েছে।

১৭-১।বায়ুরনিলমমৃতম-----বায়ু (প্রাণবায়ু) প্রবাহিত হোক অনিলে অমৃতে।

আমরা যখন দেহত্যাগ করি, তখন প্রাণের যে উদান নামক মহিমা বা স্বরূপ, সেই উদানের দ্বারাই আমরা শরীর থেকে উৎক্রমণ করি। 

অনিল শব্দের অর্থ, অন+ইল।ইল শব্দটি ইল্‌ ধাতু থেকে হয়েছে, যার অর্থ 'এলিয়ে পড়া, ঘুমিয়ে পড়া, শান্ত হয়ে যাওয়া '। সুতরাং অনিল শব্দের একটি অর্থ হলো যে মহাপ্রাণে, অন, বা জৈব-প্রাণ, বা সীমিত প্রাণচাঞ্চল্য এলিয়ে পড়ে, শান্ত হয়ে যায়।

এই অনিল অমৃত, অর্থাৎ অ (না) + মৃত। ইনি সদা জাগ্রত, অন্তহীন মহাপ্রাণ।

এই যে জীব-প্রাণ বা জীব, উদানের দ্বারা উৎক্রমণ করেন, বা দেহ থেকে দেহান্তরে, বা লোক থেকে লোকান্তরে গমন করেন।এই বিষয়ে প্রশ্নোপনিষদ্‌ থেকে উদ্ধৃত করা হলো। 

প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩.৭।

অথ (অনন্তর) একয়া (একটির দ্বারা) ঊর্দ্ধ (যা ঊর্দ্ধমুখী) উদানঃ (উদান) পুণ্যেন (পুণ্যের দ্বারা) পুণ্য্যং (পুণ্য) লোকং (লোকে) নয়তি (নিয়ে যান) পাপেন(পাপের দ্বারা) পাপম (পাপে) উভাভ্যামেব (উভয়ের দ্বারা) এব (এই প্রকারে)  মনুষ্যলোকম্‌ (মনুষ্যলোকে)। (প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩.৭।)

অর্থ। 

অনন্তর একটির দ্বারা, যা ঊর্দ্ধমুখী উদান, পুণ্যের দ্বারা পুণ্য লোকে নিয়ে যান, পাপের দ্বারা পাপে (অধ লোকে নিয়ে যান), এই প্রকারে উভয়ের দ্বারা (পুণ্য এবং পাপ যখন সমতায় থাকে, তখন তাদের দ্বারা) মনুষ্যলোকে (নিয়ে যান)। (প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩.৭।)

প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩.৮।

তেজো হ বা (তেজ অবশ্যই) উদানঃ (উদান)।  তস্মাৎ (সেই জন্য) উপশান্ততেজাঃ (যে উপশান্ততেজ--যার তেজ শান্ত বা ক্ষীণ হয়েছে) পুনঃ (পুনরায়) ভবতি (হয়) ইন্দ্রিয়ৈঃ (ইন্দিয়ের সাথে) মনসি (মনেতে) সম্পদ্যমানৈঃ ( সম্যক্‌ ভাবে গৃহীত)। (প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩.৮।)

অর্থ। 

তেজ অবশ্যই উদান।সেই জন্য যে উপশান্ত-তেজ--যার তেজ শান্ত বা ক্ষীণ হয়েছে, সে পুনরায় হয় (জন্মায়/ এক  লোক থেকে অন্য লোকে জন্ম নেয়) মনেতে সম্যক্‌ ভাবে গৃহীত ইন্দ্রিয়দের সাথে। (প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩.৮।)

১৭-২। ভস্মান্তং শরীরম্‌-----ভস্মীভূত শরীর। 

ভস্ম---ভ = ভাস= দীপ্তি, তেজ;  স্ম = নিশ্চয়। ভস্ম = যা অবশ্যই তেজ, স্বয়ংপ্রকাশ অগ্নি বা প্রাণ বা আত্মা। 

শরীর। শরীর শব্দটি 'শর' শব্দ থেকে হয়েছে। জলময়, অপোময়, আপ্তিময় বা রসময় যে আত্মা বা প্রাণ, তাঁর যে কঠিন, ভৌতিক অবস্থা, তা 'শরীর'। দুধের উপর যেমন 'শর' পড়ে, জল যেমন জমে বরফ হয়, সেইরকম চেতনার রসময়তা বা তারল্য থেকে  ভৌতিকতা উদ্ভূত হয়। যেমন মাতৃ গর্ভে আমরা জল বা তরলের মধ্যে থাকি, এবং তারপর পৃথিবীতে শরীর নিয়ে ভূমিষ্ঠ হই। 

বৃহদারণ্যক উপনিষদের  ১।২।২ মন্ত্রে বলা হয়েছে, অপ্‌ বা জলের বা প্রাণের রসময়তার যে শরবৎ অংশ ছিল, তা কঠিন হয়ে পৃথিবী হয়েছিল। উপনিষদে, পৃথিবী এবং শরীর বা দেহ শব্দটি একই অর্থে  প্রয়োগ করা হয়েছে।

এই স্থূলত্ব প্রাণেরই প্রকাশ, প্রাণ বা অগ্নিরই স্থূল প্রকাশ। কিন্তু শরীর বহির্বিশ্বের অংশ, তাই শরীরস্থ প্রাণ শরীর থেকে  উৎক্রমণ করলে, হিন্দুরা মৃতের শরীরের সংস্কার অগ্নিতে বা প্রাণাগ্নিতে করেন। ' ভস্মান্তং শরীরম্‌' বাক্যের এই হলো তাৎপর্য। 

১৭-৩। ওঁ। আত্মা বা চেতনার শব্দাত্মিকা স্বরূপকে লক্ষ করে 'ওঁ' উচ্চারণ করা হয়। এই ওঁকারকে প্রণব বলা হয়, কেননা প্রতি শব্দ বা বাক্‌ প্রকাশে ইনি নবীন হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। উপনিষদে প্রণবকে ধনু বলা হয়েছে। (মুণ্ডক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।২।৪।)। যাঁর দ্বারা শব্দ বা ধ্বনি উৎক্ষিপ্ত হয় তা ধনু। আত্মা বা প্রাণের দ্বারাই প্রয়াত আত্মা, তাঁর জন্য নির্ধারিত যে লোক সেই লোকেই উৎক্ষিপ্ত হন, বা উৎক্রমণ করেন, তাই 'ওঁ' এই মন্ত্রোচ্চারণ করা হলো। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে ' ওঁ'  হলেন অনুজ্ঞা-অক্ষর বা যে অক্ষরের দ্বারা 'আজ্ঞা' বা অনুমতি দেওয়া হয়। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৮ দ্রষ্টব্য।) 

১৭-৪। ক্রতো স্মর কৃতং স্মর ক্রতো স্মর কৃতং স্মর-----হে ক্রতু, হে সংকল্পময়  পুরুষ স্মরণ কর---- কৃত কর্ম্মকে স্মরণ কর, হে ক্রতু, হে সংকল্পময়  পুরুষ স্মরণ কর---- কৃত কর্ম্মকে স্মরণ কর।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্ত হয়েছে, যে 'এই পুরুষ কামময়; সে যেমন ভাবে কামময় হয়, তদনুযায়ী ক্রতুময় (সংকল্পময়) হয়,  ক্রতু বা সংকল্প অনুযায়ী কর্ম্ম করে, যে প্রকার কর্ম্ম করে সেই রকমই পরিণতি হয়' । (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৪।৪।৫ থেকে উদ্ধৃত।)

পুরুষ মানে যিনি পরম আত্মস্বরূপ। তিনি কামময়, সত্য সংকল্পময়, এবং তাঁর সেই সত্য সংকল্প থেকে আমরা সবাই সত্যরূপে জাত হয়েছি। আমরা এই আত্মার কর্ম্ম-সঞ্জাত। আবার আমরাও পুরুষ। নিজেকে খণ্ডিত করে (ষ) ইনি এক-একটি পুর বা আয়তন রচনা করে, তার মধ্যে বিরাজ করছেন, তাই ইনি পুরুষ এবং সৃষ্টির প্রতিটি সত্তাই একটি পুরুষ। যেহেতু পরম আত্মস্বরূপ কামময়, সংকল্পময়, কর্ম্মময়, সেই হেতু আমরাও কামময়, সংকল্পময়, কর্ম্মময়। এই পরম আত্মস্বরূপ কর্ম্ম করেও, পরিবর্ত্তিত হয়েও যেমন তেমনই থাকেন, সেইরকম আমাদের অন্তরে এই আত্মস্বরূপ সদা অপরিণামী, সনাতন অবস্থায় দৃষ্ট হচ্ছেন'। সকল কর্ম্ম, কালের সকল আবর্ত্তনের মধ্যে আমরা বা আমাদের যিনি আত্মা, তিনি সদা স্থির, অব্যয়, অপরিণামী। আমরা অনাত্মজ্ঞ বলে নিজেদের পরিবর্ত্তনময় অবস্থাই সর্ব্বদা ভোগ করি। এই পরম আত্মস্বরূপ, তাঁর ঈশিত্বের দ্বারা কামময় হয়ে, সংকল্পময় হয়ে, কর্ম্মময় হয়ে, আমাদেরকে অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে, লোক থেকে লোকান্তরে নিয়ে চলেছেন,আর এই বিবর্ত্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মার অবিনশ্বরতা এবং ঈশিত্বের উপলব্ধি ফুটে উঠছে, আমরা 'নিজেতে' ফিরে চলেছি। এই আত্মস্বরূপ ঈশিত্বের দ্বারা আমাদেরকে নিজেতে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

১৮শ মন্ত্র।

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্‌।

যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো ভূয়িষ্ঠাং তে নম উক্তিং বিধেম।।

অন্বয়-অর্থ।

অগ্নে (হে অগ্নি) নয় (নিয়ে চল) সুপথা (সুগম পথে) রায়ে (রয়ির জন্য) অস্মান্‌ (আমাদেরকে) বিশ্বানি (বিশ্বের সকল) দেব (হে দেব) বয়ুনানি (মার্গ; বায়ু রূপ সূত্রের দ্বারা রচিত মার্গ সকল ) বিদ্বান্‌ (বিদিত)------হে অগ্নি আমাদেরকে নিয়ে চল সুপথে, রয়ির জন্য;   হে দেব বিশ্বের সকল মার্গ (বায়ু রূপ সূত্রের দ্বারা রচিত মার্গ সকল তুমি বিদিত।

যুযোধি (যু-যুক্ত করো----যুক্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন করো;বিযুক্ত করো) অস্মৎ (আমাদের থেকে) জুহুরাণম (ভ্রষ্ট) এনঃ (পাপ; পাপগতি) ভূয়িষ্ঠাং (ভূয়তম; বহুতম) তে (তোমাকে) নম (নম) উক্তিং (উক্তি) বিধেম (আমরা বিধান করছি)-----বিযুক্ত করো আমাদের থেকে ভ্রষ্টকারী পাপগতি;  ভূয়তম/বহুতম নম উক্তি তোমার উদ্দেশ্যে আমরা বিধান করছি।

অর্থ।

হে অগ্নি আমাদেরকে নিয়ে চল সুপথে, রয়ির জন্য; হে দেব বিশ্বের সকল মার্গ (বায়ু রূপ সূত্রের দ্বারা রচিত মার্গ সকল) তুমি বিদিত। বিযুক্ত করো আমাদের থেকে ভ্রষ্টকারী পাপগতিকে;  ভূয়তম/বহুতম) নম উক্তি তোমার উদ্দেশ্যে আমরা বিধান করছি।

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

১৮-১। অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্‌-----হে অগ্নি আমাদের নিয়ে চল সুপথে, রয়ির জন্য।

অগ্নি।

অগ্নি---অগ (অগ্র--অগ্রে) + নি (নী---নয়তি---নিয়ে চলেন)-----যিনি অগ্রে বা পুরোভাগে থেকে সবাইকে নিয়ে চলেন। তাই ঋক্‌ বেদে অগ্নিকে বলা হয়েছে 'পুরোহিত' বা যিনি পুরোভাগে স্থিত। সমস্ত কর্ম্ম যাঁর থেকে সূচিত হয় এবং যাঁর দ্বারা সূচিত হয় তিনি প্রাণ এবং তাই প্রাণকে অগ্নি বলা হয়। অগ্নি অর্থে প্রাণাগ্নি।

রয়ি। 

'রায়ে' শব্দটি 'রয়ি' শব্দ থেকে হয়েছে। বাইরে যা রূপময়, আয়তন-যুক্ত, অন্তরীক্ষে তাই অনায়তন। যেমন জ্যোতি বা রূপ বহিরাকাশে আয়তন, এবং চক্ষু বা দৃষ্টির দ্বারা অনুভূত হয়, সেই রকমই, অন্তরে, অন্তরীক্ষে, শব্দই আয়তন এবং শ্রোত্র বা শ্রুতির দ্বারা অনুভূত হয়। বাইরের শরীর ভস্মীভূত হলেও, আমরা শব্দাত্মক হয়ে এই বিদেহ অবস্থায় থাকি।

রয়ি শব্দের একটি অর্থ 'সম্পদ' বা 'ধন'। শ্রোত্রকে উপনিষদে সম্পদ বলা হয়েছে। এই অন্তরীক্ষে, প্রাণ-রূপ চন্দ্রমার নিয়ন্ত্রণে লোকসকলে গতাগতি আমরা করি এবং ভোগ করি। তাই সুপথ-গামীদের প্রাপ্য যে রয়ি তার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। 

প্রশ্নোপনিষদের  প্রথম অধ্যায়ে, রয়ির বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানে বলা আছে, পরম আত্মস্বরূপ, যিনি প্রজাপতি, তিনি প্রজাকামী হয়ে প্রাণ ও রয়ির মিথুনকে সৃষ্টি করেছিলেন। সেই মিথুন থেকে সবাই জাত হয়েছে। তাই রয়ি, প্রাণের বা আত্মার শক্তি। একই ভাবে ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, প্রাণ এবং বাক্‌ এর মিথুনে সবাই জাত হয়েছে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।১।৫ দ্রষ্টব্য।) তাই এই রয়ি উপনিষদোক্ত বাক্‌ই। আত্মা বা প্রাণের প্রকাশই বিশ্ব, যা প্রাণ বা চেতনার বাক্য, বা চেতনার বাঙ্‌ময় মূর্ত্তি। আর সেই একই আত্মাকে, প্রাণকে রয়ি বা বাক্‌ বহু করছেন।আত্মা স্বয়ংশক্তি, বা নিজেই নিজের শক্তি। তাই এই প্রাণ এবং রয়ি, বা প্রাণ এবং বাক্‌ আত্মারই মিথুন, এবং আত্মাই। প্রকাশটি হলো কথা বা বাক্য, যা রূপময়, আয়তনময়। সবাইকে নিয়ে অদ্বিতীয় বোধে আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেছেন, তাই প্রাণ কে আদিত্য বলা হয়। আর সেই প্রকাশকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, সংযমিত করেন, এবং সেই প্রকাশের ভোগ যাঁতে হয়, তিনি বাক্‌ বা রয়ি। বাক্য বা শব্দকে আমরা জানি বা ভোগ করি শ্রবণের দ্বারা। বহির্মুখী যে আলো বা প্রকাশ তা আদিত্য-জ্যোতি, যার দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে সব। আর সেই প্রকাশিত ক্ষেত্রের যে অনুভূতিময়, বেদনময় জগৎ, তা অন্তরীক্ষ, যেখানকার আলো চন্দ্রজ্যোতি। তাই প্রশ্নোপনিষদে রয়িকে চন্দ্রমাও বলা হয়েছে। চেতনা এই  জ্যোতির্ময় চন্দ্রমা হয়ে আমাদের বিদেহ অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, এবং অমূর্ত্ত থেকে মূর্ত্ত এবং মূর্ত্ত থেকে অমূর্ত্ত হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাই প্রশ্নোপনিষদে বলা হয়েছে যে, যা কিছু অমূর্ত্ত এবং যা কিছু মূর্ত্ত তা রয়ি।(প্রশ্নোপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৫ দ্রষ্টব্য।) এইজন্য প্রয়াণ কালে 'সুপথা রায়ে' এই বাক্যের দ্বারা প্রাণাগ্নির উদেশ্যে প্রার্থনা করা হয়েছে। 

১৮-২। বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্‌-----হে দেব বিশ্বের সকল মার্গ (বায়ু রূপ সূত্রের দ্বারা রচিত মার্গ সকল) তুমি বিদিত।

দেব। দেব শব্দটি দিব্ বা দ্যু শব্দ থেকে হয়েছে। দেব অর্থে যিনি প্রকাশবান্‌। আত্মার স্বয়ংপ্রকাশত্বই অগ্নি বা প্রাণের প্রকাশময়তা। 

বয়ুনানি বিদ্বান্‌-----বায়ু রূপ সূত্রের দ্বারা রচিত মার্গ সকল) তুমি বিদিত।

বয়ুনানি শব্দটি বয়ুন শব্দের বহুবচন। বয়ুন শব্দটি ' বী ' ধাতু থেকে হয়েছে এবং বয়ুন শব্দের একটি অর্থ হলো 'পথ' বা 'মার্গ'। বী ধাতুর অর্থ  'বয়ন করা'। বায়ু শব্দটি ' বা ' এবং ' বী ' এই উভয় ধাতু সম্পন্ন। বায়ু মানে যিনি 'বয়ন' করছেন, যিনি আত্মজাল বিস্তার করে সবাইকে আত্মসূত্রে যুক্ত করে রেখছেন। তাই বায়ু যজুর্বেদের মুখ্য দেবতা। 

বয়ুন অর্থে প্রাণের বায়ুরূপ সূত্রের দ্বারা রচিত মার্গ সকল। এই অনন্ত দিকে প্রবাহিত এবং বিস্তৃত যে প্রাণ বায়ু, তার দ্বারাই লোক থেকে লোকান্তরে আমারা গতি নিই এবং আমাদের লোক-প্রাপ্তি হয়। এই প্রকাশবান্‌ প্রাণাগ্নি দেবতার দ্বারা  বিশ্বের সকল বয়ুন তাঁতে বিধৃত এবং তাঁর দ্বারা বিদিত।

১৮-৩। 

যুযোধি অস্মৎ জুহুরাণম এনঃ ভূয়িষ্ঠাং তে নম উক্তিং বিধেম----- বিযুক্ত করো আমাদের থেকে ভ্রষ্টকারী পাপগতিকে;  ভূয়তম/বহুতম নম উক্তি তোমার উদ্দেশ্যে আমরা বিধান করছি।

যুযোধি শব্দটি যু ধাতুর রূপ। যু অর্থে বিযুক্ত করা, বিচ্ছিন্ন করা। 

জুহুরাণম শব্দটি হ্বৃ ধাতু থেকে হয়েছে। হ্বৃ ধাতুর অর্থ ভ্রষ্ট হয়ে চলা; যে গতি লক্ষ থেকে 'হরণ' করে, সেই গতিতে চলা। সুতরাং 'জুহুরাণম' অর্থে  'ভ্রষ্টকারী পাপগতিকে'। 

ভূয়িষ্ঠাং তে নম উক্তিং বিধেম-----যে 'নম' বা 'নমন' ভূয়তম, যে নমনের দ্বারা 'বাঙ্‌ মনসি', অর্থাৎ মনের মধ্যে স্থিত বাক্যগুলি মনেতে নমিত হয়, লীন হয়, এবং 'মনঃ প্রাণে' অর্থাৎ বহির্মুখী সংকল্পময় মন, হৃদয়ময় অনুভূতিময় প্রাণে লীন হয়, এবং  ' প্রাণ তেজসি', অর্থাৎ হৃদয়ময় অনুভূতিময় প্রাণ, তেজোময় প্রাণাগ্নিতে বা বাক্‌এ বা তেজে লীন হয় এবং 'তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম্‌' অর্থাৎ তেজ সেই স্বয়ংপ্রকাশ পরম দেবতায় বা পরমআত্মস্বরূপ, যিনি নিজে ভিন্ন আর কেউ নেই, তাঁতে লীন হয়। সেই নম উক্তি আমরা বিধি-বদ্ধ করছি। (বাঙ্‌ মনসি সম্পদ্যতে, মনঃ প্রাণে, প্রাণঃ তেজসি, তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম্‌------- ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৬।১৫।১ এবং ৬।১৫।২  দ্রষ্টব্য।)

পরিশিষ্ট।

ঈশ্বরের বিষয়ে ভগব্দগীতার একটি মন্ত্র এবং তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা নীচে উক্ত হলো। 

ঈশ্বরঃ সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশে'র্জ্জুন তিষ্ঠতি।

ভ্রাময়ন্সর্ব্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।। (গীতা ১৮.৬১)

অন্বয়-অর্থ।

ঈশ্বরঃ (ঈশ্বর) সর্ব্বভূতানাং (সর্ব্বভূতের) হৃৎ (হৃদয়) দেশে (দেশে) অর্জ্জুন (অর্জ্জুন) তিষ্ঠতি (থাকেন; বিরাজ করেন)--হে অর্জ্জুন, ঈশ্বর সর্ব্বভূতের হৃদয়-দেশে বিরাজ করেন

ভ্রাময়ন্‌ (ভ্রমণ করাচ্ছেন) সর্ব্ব (সর্ব্ব) ভূতানি (ভূত সকলকে) যন্ত্র আরূঢ়ানি (যন্ত্রে আরূঢ়) মায়য়া (মায়ার দ্বারা) ------সর্ব্বভূত সকলকে ভ্রমণ করাচ্ছেন যন্ত্রে আরূঢ় হয়ে মায়ার দ্বারা।

অর্থ।

হে অর্জ্জুন, ঈশ্বর সর্ব্বভূতের হৃদয় দেশে বিরাজ করেন। যন্ত্রে আরূঢ় হয়ে মায়ার দ্বারা সর্ব্বভূত সকলকে ভ্রমণ করাচ্ছেন 

নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা।

স্থূল শরীর হিসাবে ঊর্দ্ধ-হৃদয় হলো মস্তিষ্ক, এবং নিম্ন হৃদয় হলো শরীরের মধ্যদেশ বা যার সাধারণ নাম হৃদয়। চিৎ-ক্ষেত্রের যেখান থেকে অনুশাসন বা নিয়ন্ত্রণ চলছে, তার নাম  ঊর্দ্ধ-হৃদয়। ওখান থেকে আমাদের প্রতি মুহূর্ত্তের ভোগ বা প্রতি মুহূর্ত্তের ঘটনা, এই চিন্ময় আত্মা আমাদেরকে প্রেরণ করছেন, বা নিম্ন হৃদয়ে প্রেরণ করছেন। ঊর্দ্ধ-হৃদয় হলো নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্র, ওখানে আত্মা অভোক্তা। ওখানকার ধর্ম্মই হলো প্রকাশ করা, নিয়ন্ত্রণ করা।নিম্ন হৃদয় হলো ভোগ-ক্ষেত্র, ওখানে আমরা বা আত্মা সঙ্গময়, ভোগে লিপ্ত।এই জন্য গীতায় ঈশ্বর সর্ব্বভূতের হৃদয় দেশে বিরাজ করছেন বলা হয়েছে।  

উপরে ১৬-৩ অনুচ্ছেদে আত্মার ঈশিত্ব এবং যমনের কথা বলা হয়েছে।বিশিষ্ট বিশিষ্ট যে নিয়ন্ত্রণ, বা যমনের যে সকল বিশিষ্টতার দ্বারা আমরা ত্রাণ পাই, তার নাম যন্ত্র।

'মায়া' শব্দটি 'মা' ধাতু থেকে হয়েছে। 'মা' অর্থে মাপা, মাত্রা দান করা বা পরিমিত করা, গঠণ করা ইত্যাদি।'য়' অর্থে  অন্তর এবং যমন, বা অন্তর থেকে যমন করা। মায়া শব্দের অর্থ, অন্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ বা সংযমন।হৃদয়ের দ্বারা বা ঈশিত্বের দ্বারা ইনি সবাইকে নিজেতে আকৃষ্ট করে রেখেছেন, তাই মায়া অর্থে আকর্ষণও হয়।

সর্ব্বভূতের অন্তরে বিরাজিত ঈশ্বর যন্ত্রারূঢ় হয়ে মায়ার দ্বারা সর্ব্বভূতকে ভ্রমণ করাচ্ছেন। এই ঈশিত্বকে উপলব্ধি না করে যে আমরা চলেছি বা কাল দ্বারা বাহিত হচ্ছি, এইটি ভ্রম বা ভুল করা, বা আত্মার ঈশিত্বকে না জেনে চলা বা ভ্রমণ। কিন্তু এই ভাবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে ভ্রম-গ্রস্ত হয়ে ভ্রমণ করতে করতে আমাদের ভ্রান্তি দূর হতে থাকে এবং ঐ ঈশিত্বের দ্বারাই আমাদের আত্ম-স্মৃতি ফিরে আসতে থাকে। 


   

















































































Comments

Popular posts from this blog

শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা । আচার্য শ্রী বিজয়কৃষ্ণ কৃত শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা। মূর্ত্তি পূজা রহস্য এবং বেদ। ( ১৯৪১ সাল/ সন ১৩৪৮ এর শারদীয়া দুর্গাপূজা, শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরাণী সঙ্কলিত।) (Durga Puja of 1941 in Bengali language--Performed by Rishi Bijoykrishna Chattopadhaya and recorded by Sarala Devi Chowdhurani.)

বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, চতুর্থ অধ্যায়, তৃতীয় ব্রাহ্মণ, মূল অংশ এবং বঙ্গানুবাদ । জাগ্রত, স্বপ্ন এবং নিদ্রার বিজ্ঞান।(Bengali translation of Fourth chapter, Third part of Brihadaranyaka Upanishad with original texts and meanings---science of the state of awakeness, dream and sleep.)