বৃহদারণ্যক উপনিষদ, চতুর্থ অধ্যায়, প্রথম ব্রাহ্মণ।(ব্রহ্মের আয়তন এবং প্রতিষ্ঠা।) (Brihadaranyaka Upanishad Fourth Chapter, First Brahmin in Bengali Language.)
বৃহদারণ্যক উপনিষদ, চতুর্থ অধ্যায়, প্রথম ব্রাহ্মণ।
ভূমিকা।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায় প্রথম ব্রাহ্মণের মূল অংশ সহ বঙ্গানুবাদ এবং বিশেষ অর্থ (নিরুক্ত) প্রকাশ করা হলো।
ব্রহ্ম খণ্ড বা সারাংশ নামক নিম্নলিখিত অংশে এই উপনিষদের মূল ব্যক্তব্যটি যথাসাধ্য প্রাঞ্জল করা হয়েছে।
মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৪৫) এবং তাঁর প্রধান শিষ্য মহর্ষি ত্রিদিবনাথ বন্দোপাধ্যায়ের (১৯২৩-১৯৯৪) উপদেশ অনুসরণ করে এই উপনিষদের অর্থ লেখা হলো।
দেবকুমার লাহিড়ী।
ব্রহ্ম খণ্ড (সারাংশ)।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই অংশে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য, মহারাজ জনককে ব্রহ্মের ছয়টি আয়তনের বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। যিনি ব্রহ্ম, তিনি অবাধ চেতনা, তিনি ‘বৃংহণ' করছেন বা সবাইকে অতিক্রম করে বর্দ্ধিত হচ্ছেন। আমরা সবাই সেই ব্রহ্মেরই আয়তন, তাঁরই নামরূপময় প্রকাশ। এই নামরূপময় প্রকাশ বা আয়তনবান্ বিশ্বকে প্রকাশিত করতে গিয়ে স্বয়ংপ্রকাশ চেতনা, যিনি ব্রহ্ম, তিনি প্রথমে নিজের ছয়টি আয়তন প্রকাশ করেছেন। সেই ছয়টি আয়তন বা তাঁর বিস্তার হলো , (১) বাক্, (২) প্রাণ, (৩) চক্ষু, (৪) শ্রোত্র, (৫) মন, (৬) হৃদয়।
স্বয়ংপ্রকাশ চেতনা এই আয়তন সকলের দ্বারা যে ভাবে আমাদের ধারণ করেছেন এবং আমাদের সাথে ব্যবহারময় হয়েছেন তা এই প্রকার :
(১) বাক্ এবং প্রজ্ঞা। (ব্রহ্মের প্রথম আয়তন।
যে ব্যক্তিত্ব (শক্তিত্ব) বা নিয়ন্ত্রণের দ্বারা আত্মস্বরূপ ব্রহ্ম আমাদের প্রজ্ঞাবান্ বা বোধময় করেছেন তাঁর নাম বাক্। আমাদের অনুভূতিগুলি শব্দ বা বাক্যের আকারে আমাদের মধ্যে থাকে এবং প্রতিটি বোধ বা অনুভূতির চেহারা বা আয়তন একটি শব্দ বা বাক্য; যেমন, ফুল,ফল, আঃ, উঃ ইত্যাদি। আমরা আমাদের বোধ বা প্রজ্ঞার জগতে বেঁচে আছি। আবার তাঁর এই বাক্ শক্তি থেকে বা তাঁর কথা থেকেই এই বিশ্ব ভূবন রচিত হয়েছে; অর্থাৎ যিনি সবার আত্মা এবং সব হয়েছেন, তাঁর প্রজ্ঞা থেকে আমাদের প্রজ্ঞা জাত হচ্ছে। আমরা আমাদের প্রজ্ঞা বা অনুভূতির জগতে বেঁচে আছি। তাই বলা হয়েছে, 'প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ ((ঐতরেয় উপনিষদ)।
ঐ স্বয়ং প্রকাশ চেতনার ‘ফুল’ বলে যে বাক্য বা কথাটি, তাই মূর্ত্ত হয়ে ফুল হয়েছে। সেই ফুল বা বাক্য থেকে আমাদের মধ্যে ফুলের অনুভূতি জন্মাচ্ছে। এই যে বহিঃ বা বহির্বিশ্ব, তার নাম ‘ সম্ভূতি’ এবং সেই ‘সম্ভূতি' অনুসারে আমাদের মধ্যে যে বোধ বা প্রজ্ঞা প্রকাশ পাচ্ছে, তার নাম ‘অনুভূতি'। যেহেতু আমাদের ‘বোধ’ বা ‘অনুভূতি’ ক্ষণস্থায়ী এবং আমরাও মরণশীল, তাই উপনিষদে (ঈশোপনিষদ্) ‘অনুভূতিকে' বিনাশ বলা হয়েছে। (ঈশোপনিষদ্ চতুর্দশ মন্ত্র।)
যেখান থেকে বাক্, বাক্য হয়ে, মূর্ত্ত বা শব্দিত হচ্ছেন, বিরাটে তার নাম ‘জনলোক', এবং আমাদের শরীরে তার স্থান (ললাটের নীচে) কণ্ঠে। বৈদেহী বাক্ বা আত্ম শক্তি (আত্মারামের শক্তি), যিনি বিদেহ বা দেহবিহীন, তিনিই এই মূর্ত্ত বিশ্ব হয়েছেন, শরীরী হয়েছেন। জনক এই শক্তির বা জ্ঞানের উপাসক বলে, তাঁকে বৈদেহ জনক বলা হত।
(২) প্রাণ এবং প্রিয়তা (প্রিয়ত্ব)। (ব্রহ্মের দ্বিতীয় আয়তন)।
যিনি প্রজ্ঞা, তিনি মাত্র প্রজ্ঞা, বোধ, বা অনুভূতি নন, তিনি হৃদয়ময়, ব্যব্যহারময়, স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, যিনি এক হয়েও বহু হয়েছেন এবং সেই বহু বহু আত্মখণ্ডকে নিজেতে ধরে রেখেছেন। তাই এই প্রাণ হলেন তিনি, যিনি থাকলে আমরা থাকি এবং যিনি (শরীর থেকে) উৎক্রমণ করলে, আমরাও তাঁর সাথে চলে যাই। যেখানে আত্ম এবং অনাত্ম দুইই থাকে, তিনি প্রাণ। নিজেকে দ্বিতীয় করে, অনাত্ম করে, সেই অনাত্মকে বা জীবকে ইনি আত্মবোধেই দর্শন করছেন----এর নাম প্রিয়তা বা প্রিয়ত্ব।তাই সর্ব্বভূত বা যে কেউ সৃষ্ট হয়েছে, তারা সকলে এঁর প্রিয় এবং ইনি সবার প্রিয়।
প্রাণ = প্র (প্রথম) + অন (জ্ঞান বা চিৎ প্রকাশ / animation); সকল বোধ বা প্রজ্ঞা প্রকাশের অগ্রে যিনি থাকেন, তিনি প্রাণ। তাই প্রাণ দেখলে তবে আমরা দেখি, প্রাণ শুনলে তবে আমরা শুনি, ইত্যাদি। প্রাণ যখন দেখেন, তাতে দর্শন এবং দ্রষ্টা দুইই সৃষ্ট হয়, প্রাণ যখন শোনেন, তাতে শ্রুতি এবং শ্রোতা দুইই সৃষ্ট হয়; এই ভাবে সর্ব্ব বোধ বা প্রজ্ঞার প্রকাশ প্রাণ থেকে হচ্ছে। প্রাণের শক্তি হলেন বাক্ এবং তাঁদের মিলনে যা জাত হচ্ছে তা প্রজ্ঞা।
(যা বৈ প্রাণঃ সা প্রজ্ঞা, যা বা প্রজ্ঞা স প্রাণঃ—যিনিই প্রাণ তিনি প্রজ্ঞা, যিনি প্রজ্ঞা তিনি প্রাণ। কৌষীতকি উপনিষদ্ তৃতীয় অধ্যায়।)
(৩) চক্ষু এবং সত্য বোধ। (ব্রহ্মের তৃতীয় আয়তন)।
সমস্ত বোধ বা অনুভূতিগুলি প্রাণেতে যেখানে প্রদীপ্ত হয়েছে,চেতনা বা প্রাণের সেই কেন্দ্রের নাম ‘চক্ষু'। তাই সকল অনুভূতির প্রকাশ চোখে ধরা পড়ে । আমরা যা কিছু বোধ বা অনুভব করছি, তার দ্বারা আমাদের অস্তিত্ব বোধ বজায় থাকছে। তাই অস্তিত্ব বা সত্য বোধের মূলে রয়েছে ‘রূপ’ বা 'দর্শন'। আমাদের যে জাগ্রত অবস্থা, তার নাম জাগ্রতপাদ। এই যে জেগে থাকার অবস্থা, এই অবস্থায় বা স্থিতিতে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি পরিণত হয়ে উঠেছে। যেখানে আমরা স্বপ্ন দেখি, সেখানে ইন্দ্রিয় গুলি এখনো ‘শৈশব’ অবস্থায় রয়েছে; তাই স্বপ্ন থেকে জাগ্রত অবস্থায় ফিরে এলে আমাদের মনে হয় জাগ্রত অবস্থা স্বপ্নের থেকে অধিকতর সত্য।
এই যে জাগ্রত অবস্থায় আমরা ঘড় -সংসার করি, বেঁচে থাকি, সেই অবস্থার উপর স্বয়ংপ্রকাশ চেতনার যে নিয়ন্ত্রণময় স্বরূপ তার নাম ‘গৃহপতি অগ্নি’ এবং তাঁকে ‘আদিত্য’ বলা হয়েছে। উপনিষদে, ঋষি বলেছেন যে , ‘ঐ গৃহপতি অগ্নির মধ্যে যিনি দৃষ্ট হন, তাঁর নাম ‘আদিত্য’। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪। ১১। ১।)। যিনি সবাইকে নিয়ে মিলে মিশে বা একাত্ম বোধে ভোগ করছেন তাঁর নাম আদিত্য। এই একাত্মতাই আদিত্যের অদিতিত্ব এবং এই ভোগ করাই হলো আদিত্যের খাওয়া বা ‘অদন’ করা।
যেমন আমাদের মধ্যে ‘চক্ষু’ বা চোখ হলো সকল রূপের আলয় বা লোক, তেমনি ‘বিরাটে' এই লোকের নাম ‘আদিত্য', যিনি আমাদের বহিরাকাশে ‘সূর্য', এবং যাঁর থেকে ‘আলোক' বা ‘রূপ' বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
তাই ঋষিরা বলেছেন যে ঐ আদিত্যে যিনি আছেন তিনি আর এই অক্ষিগত পুরুষ একই। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ১। ৬। ৫, ১। ৬। ৬, ১। ৬। ৮, ১। ৭। ২, ১। ৭। ৪, ১। ৭। ৫ দ্রষ্টব্য। )
এই দেখা বা দৃষ্টির আর একটি নাম ‘ঈক্ষণ’। ঈক্ষণ মানে ‘দেখা' , আবার ‘ ঈক্ষণ’ মানে ‘ক্ষণ বা কালকে প্রকাশ করা’। যেমন সূর্যের থেকে রূপ, আলো এবং কাল বা ‘ অহো-রাত্রি, ঋতু সকল ’ ইত্যাদি প্রকাশ পাচ্ছে, সেই রকম ‘চক্ষু’ থেকেও রূপ এবং কাল বা অস্তিত্বের বোধ প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন সূর্যের থেকে অহো-রাত্র প্রকাশ পাচ্ছে, তেমনই আমাদের ‘জাগরণ এবং নিদ্রা’ আমাদের ‘চক্ষুর’ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।( https://www.sciencedaily.com/releases/2008/08/080815140250.htm;
তাই বৃহদারণ্যকে ঋষি বলেছেন, যে, “ রূপ সকল যাঁর আয়তন, চক্ষু যাঁর লোক, মন যাঁর জ্যোতি [মনের দ্বারা বা সঙ্কল্পের দ্বারা যিনি রূপময় হন], সবার যিনি পরম গতি [আশ্রয়], তিনি ঐ আদিত্যে যে পুরুষ; তাঁর যে দেবতা বা দেবময়তা (ব্যক্তিত্ব বা ব্যবহারময়তা) তা ‘সত্য'। (বৃহদারণ্যক ৩। ৯। ১২।)
বৃহদারণ্যকে ঋষি আরো বলেছেন যে, যা মূর্ত্ত, যা মর্ত্ত, যা স্থিতিশীল, যা সীমিত তার রস হলো (অধ্যাত্মে ) চক্ষু এবং (অধিদৈবে) যিনি আদিত্য (সূর্য)।(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্।২। ৩। ৪। )
এই আদিত্য বা চক্ষু আমাদের সত্য বোধ বা অস্তিত্ব বোধের উপর প্রত্যক্ষ ভাবে আধিপত্য করছেন এবং এই জন্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে চক্ষুই ‘প্রতিষ্ঠা'। সত্য বা অস্তিত্ব বোধের দ্বারাই আমরা প্রতিষ্ঠিত। সাধারণ বোধবৃত্তিতে দেখা যায় যে সত্য বোধের প্রগাঢ়তা শোনার থেকে দেখাতে বেশী। যা দেখি তাকে আমরা সহজেই ‘সত্য’ বলে স্বীকার করি।
তাই ইন্দ্রিয়রা যখন প্রাণকে বন্দনা করেছিলেন, তখন চক্ষু বলেছিলেন, "আমি যে প্রতিষ্ঠা, তুমি সেই প্রতিষ্ঠা! “ (....যদহং প্রতিষ্ঠাস্মি, ত্বং তৎ প্রতিষ্ঠাসীতি। ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৫। ১১। ১৩।)
এই জন্য জ্ঞানেন্দ্রিয় চক্ষুর, কর্ম্মেন্দ্রিয় হলো পা (পাদ) বা ‘প্রতিষ্ঠা’। এই পা দিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠিত এবং গতিশীল। গতি মানেই ‘কাল গতি’। তাই রূপ প্রকাশ আর কাল প্রকাশের যে কেন্দ্র তা চক্ষু বা আদিত্য এবং সেই কেন্দ্রের ক্রিয়ার নাম ‘ঈক্ষণ‘। ঈক্ষণ শব্দের অর্থ উপরে বলা হয়েছে। এই রূপ প্রকাশ আর কাল প্রকাশই, ঋক্ বেদোক্ত বিষ্ণুর ‘চক্ষু আর পরম পদ’। (ওং তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ, দিবীব চক্ষুরাততং—সেই বিষ্ণুর যে পরম পদ, যা দেবগণ সদা দর্শন করেন, যা দিবি বা দ্যুলোকের ন্যায়, আতত (বিস্তৃত) চক্ষু। [ঋক্ বেদ।])
৪। শ্রোত্র এবং আনন্ত্য (দিক্)। (ব্রহ্মের চতুর্থ আয়তন।
শ্রোত্র বা শ্রবণের সাথে দিকের যে প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ আছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানও জানে। ( https://ehomerecordingstudio.com/binaural-hearing/ )
বাক্ এবং প্রজ্ঞার কথা আগে উক্ত হয়েছে। প্রজ্ঞার অনুভূতি বা উপলব্ধি মানেই শ্রুতি বা শোনা। যে কোন প্রজ্ঞাই কথার আকারে আমাদের মধ্যে ফোটে এবং শ্রবণ বা শ্রুতির দ্বারাই আমরা সেই কথাটিকে শুনি বা সেই প্রজ্ঞা বা বোধ প্রকাশকে অনুভব করি। এই প্রজ্ঞা যে ‘দিক্' দিয়ে প্রথম আমাদের কাছে আসেন বা উপস্থিত হন, তা পূর্ব্ব দিক্। প্রজ্ঞা বা বোধ প্রকাশের সাথে সাথে তার অনুভূতি বা ভোগ হতে থাকে; যে দিকে এইটি হয়, তা পশ্চিম দিক্। যে প্রজ্ঞা পূব দিকে উদিত হন, তিনি অস্ত যান পশ্চিমে। এই উদয় থেকে যে অস্তে যে সংক্রমন, তাতে আমরা তাঁকে অনুভব করি, বোধ করি বা ভোগ করি। যখন প্রজ্ঞা উদিত হন, তখন তাঁর সেই বিশেষ রূপটি ফোটানর জন্য, অন্য সব কিছু আবৃত হয়ে থাকে পশ্চিম দিকে। প্রজ্ঞার উদয় (প্রকাশ) এবং অস্ত (ভোগ) যা, ‘কথা বলা’ এবং ‘কথা শোনাও’ তা। আমরা যা বলি, সেই কথাকেই শুনি বা অনুভব করি। এই জন্য বেদ বা বেদনের এক নাম শ্রুতি।
প্রজ্ঞার এই উদয় এবং অস্ত, এই যে দুই ব্যক্তিত্ব,এঁরা বেদোক্ত মিত্রাবরুণ বা মিত্র ও বরুণ। আমাদের ঈপ্সিত রূপ, রস, শব্দ ইত্যাদি হয়ে উদিত হচ্ছেন বলে ইনি মিত্র, আর ঐ পশ্চিম দিক্, যেদিকে সব ঢাকা পরছে, আবৃত হচ্ছে, এবং ভোগ হচ্ছে, তার অধিপতি বরুণ।
( প্রজ্ঞা বা প্রাণ, পূর্ব্ব দিকে উদিত হন এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যান; সেই জন্য সূর্যের গতি পূব থেকে পশ্চিমে বলা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে হিন্দুরা পৃথিবীর আহ্নিক গতির বিষয়ে জানতেন না। )
প্রতি অনুভূতি বা বোধ-ক্রিয়াতে আমরা পরিবর্ত্তিত হচ্ছি, আমাদের বিবর্ত্তন হচ্ছে, এবং অভ্যুদয়ের পথে চলেছি। স্বয়ংপ্রকাশ চেতনার ঈশিত্বের দ্বারা বা মহাপ্রাণের নিয়ন্ত্রণের দ্বারা এইটি হচ্ছে। প্রাণের যে দিক্ বা যে ধারাতে আমরা এই ভাবে পরিণত হচ্ছি, সেইটি দক্ষিণ দিক্। এই দিক্ দিয়ে প্রাণ ক্রিয়াশীল হয়ে আমাদেরকে অনুভূতি অনুসারে ভাঙছেন এবং গঠন করছেন। প্রাণের এই কর্ম্মময় দিক্টির নাম দক্ষিণ দিক্। তাই যে দিক্ দিয়ে বা যে হাত দিয়ে আমরা প্রধান কাযগুলি করি, সেইটি ডান বা দক্ষিণ হাত; বাম হাতে যদি কেউ কায করেন, তত্রাচ সেইটি ডান বা দক্ষিণ দিক্ই। প্রাণের এই নিয়ন্ত্রণময় স্বরূপকে ‘দক্ষিণাগ্নি’ বলা হয়। প্রাণ মানেই অগ্নি। অগ্নি মানে যিনি প্রকাশবান্, সবার অগ্রে, সবাইকে নিয়ে চলেছেন, নেতা। দক্ষিণাগ্নির অন্য নাম অন্বাহার্যপচনাগ্নি, অর্থাৎ যে অগ্নি সবাইকে পচন বা পাক করেন, রন্ধন করে গঠন করেন এবং যে অগ্নির দ্বারা আমরা হজম করি। আমরা যা খাই, অনুভব করি, তা যে ভাবে আমাদের সাথে মিশে যায় সেই ভাবেই আমাদের পরিণতি হয়।
আর অনুভূতি বা প্রতি বোধক্রিয়ার অন্তে, আমারা যেদিকে উঠে যাই বা উত্তরণ করি, সেইটি উত্তর দিক্। এই পরিণতি বা পরিণত আমাদের টুকরোগুলি, মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, প্রাণের যে দিকে বিধৃত থাকে তার নাম উত্তর। ঐ উত্তর দিকে যা প্রাণের বুকে ধরা তাকে, তাই ধরে বা তদনুসারে আবার আমরা পুনরায় জাত হই, বিবর্ত্তিত হই। এই ভাবে আমরা ক্রমশঃ উর্ধ্ব স্তরের জীবে পরিণত হই। এই ভাবে আমরা মহাপ্রাণে ফিরে চলেছি, তাঁতে হূত হচ্ছি, তাঁর আহ্বানে আবাহিত হয়ে তাঁতে ফিরে চলেছি। প্রাণের এই মহিমাকে লক্ষ করে তাঁকে 'আহবনীয়' অগ্নি বলা হয়।
গৃহপতি অগ্নি হলেন পিতার অগ্নি, দক্ষিণাগ্নি হলেন মাতার অগ্নি আর আহবনীয় হলেন গুরু বা আচার্যর অগ্নি। এই জন্য, এই উপনিষদে ঋষিদের পিতৃমান্, মাতৃমান্ এবং আচার্যবান্ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
মহাপ্রাণ যেদিকে সমস্ত বিশ্ব ভূবনকে নিজেতে বিধৃত করে রেখেছেন, সেই দিক্ হল ঊর্ধ্ব। ঐ মহাপ্রাণই আবার সবার আধার হয়ে নিজেকে অনন্তে বিস্তার করেছেন। এইটি অধঃ দিক্। প্রাণের এই আধার হয়ে বিস্তারকে, বৃহদারণ্যকে ঋষি, প্রাণের শক্তি বাকের বিস্তার বলে বর্ণনা করেছেন।(প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে অধোদিকের অধিপতি যে দেবতা তাঁর নাম ‘অনন্ত'। )
তস্যৈ বাচঃ পৃথিবী শরীরং জ্যোতী রূপময়মগ্নিস্তদ্যাবত্যেব বাক্ তাবতী পৃথিবী তাবানয়মগ্নিঃ-------সেই বাকের পৃথিবী হলো শরীর, জ্যোতীরূপ ঐ অগ্নি; তাই যত দূর পর্যন্ত বাক্ তত দূর পৃথিবী (যিনি সবাইকে পৃথক্ অস্তিত্ব দিয়ে ধারণ করেন), ততদূর এই (গৃহপতি) অগ্নি। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১। ৫। ১১) ।
প্রাণের প্রবনতাই দিক্। তাই দিক্ অন্ত বিহীন। এই জন্য একই বিশ্বকে প্রত্যেকে আলাদা ভাবে অনুভব করে। এই জন্য একই কর্ম্মের ফল একজনের থেকে অন্যজনের আলাদা হয়। এই জন্য দুটি ধূলি কণার মধ্যেও পার্থক্য থাকে। উপড়ে যে দক্ষিণাগ্নির (অন্বাহার্যপচনাগ্নির) কথা বলা হয়েছে, সেই অগ্নির একটি তনু হল দিক্ (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪। ১২। ১।)
যা কিছু আমরা দেখছি, অনুভব করছি, তা যে চেতনার, বোধের মূর্ত্তি বা প্রজ্ঞা, যিনি আমাদের প্রাণ এবং আত্মা, এবং আমরা নিজেরাও জ্ঞান স্বরূপ এই প্রজ্ঞার উন্মেষে, নিজের বিষয়ে এবং যে কোন বস্তুর বিষয়ে, মাত্র সীমাবদ্ধ বা আকার আয়তনের মধ্যেই মাত্র সীমিত, এই রূপ যে ধারণা বা ভাব, তা আর থাকেনা। মাত্র শরীর অব্দিই আমার বিস্তার নয়, আমি কোন সীমিত আয়তনের দ্বারা বদ্ধ নই। এর নাম দেশবদ্ধতা থেকে বা দেশ (সীমিত আয়তনময়তা) থেকে দিক্এ প্রবেশ করা। তখন দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি আর দেশ বদ্ধ থাকেনা। যে দিকে চোখ, মাত্র সেই দিক্ই দৃশ্য হয় না; দর্শন হয় সর্ব দিক্ময়। বহু দূরে যা কথিত হয়, তাও শ্রুত হয়; এই রকম সমস্ত ইন্দ্রিয় শক্তি, দেশ বদ্ধতা বা জাড্য থেকে মুক্ত হয়ে যায়। শ্রুতি, বেদ, বা জ্ঞান স্বরূপতার প্রকাশে এই রকম হয়।
শব্দের যে সীমাবদ্ধ অর্থ বা ‘শবত্ব' তা দূর হয়, তখন সেই শব্দ হয় অনন্ত বেদন, শ্রুতি এবং অর্থ প্রকাশময়। তখন শব্দ হয়ে যায় দেবতা বা অনন্ত।
তাই ঋষি বলেছেন ‘দিক্ই শ্রোত্র’। আমরা যা কিছু বোধ করছি, আমাদের বোধের, প্রজ্ঞার জগতে যা কিছু আছে, তা আমাদের অন্তরে শব্দ বা বাক্যের আকারে থাকে; আর এই কথার মানেই তা শ্রুতি বা শ্রবণের আকারে থাকে। এখানে, এই শব্দ বা শ্রুতির রাজ্যে দেশ বা আকার-আয়তন (dimensions) নেই, অথচ সবই আছে। তাই এই শ্রবণই ‘দিক্’ যা থেকে দেশ বা মূর্ত্তি (definitions and dimensions) রচিত হয়। এই শ্রবণে, শ্রুতিতে, সব কিছু অন্ত বিহীন হয়ে থাকে।
দুটো পদার্থের মধ্যে যে ফাঁক, যাকে আমরা শূন্য বা আকাশ বলে বর্ণনা করি, তা হলো এই দিক্, যার থেকে ‘দেশ' রচনা হয়েছে বা পদার্থ সকল আয়তনবান্ হয়েছে। সেই রকম আমরা যে আলাদা আলাদা, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নিয়ে সৃষ্টি হয়েছি, একজনের ব্যক্তিত্ব আর এক জনের সাথে যে মিশে যাচ্ছে না, তাও এই আকাশের জন্য। তাই উপনিষদে এই আকাশকে ‘বহুলা’ বলা হয়েছে। বহুলা মানে , যে শক্তি বহু হন। (ছান্দোগ্য ১৫.৫.১।)
উপনিষদে আরো বলা হয়েছে যে এই আকাশ স্ত্রী গণের (বাকের নানা স্বরূপের ) দ্বারা পূর্ণ। (বৃহদারণ্যক ১.৪.৩। )
আত্মশক্তি বাকের বা আত্ম-পুরুষ প্রাণের ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতা সকলই দিক্ সকল। ঐ আত্মশক্তি বাক্ কে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে যে এই আকাশ স্ত্রী গণের দ্বারা পূর্ণ। সর্ব্বদিক্ এই আকাশে সাম্যে থাকে বলেই, আমরা আকাশকে গোলাকার বলে অনুভব করি।
ঋষিরা বলেছেন যে ঐ বহিরাকাশ আর আমাদের অন্তরে যে আকাশ, তা একই। বহিরাকাশ ও অন্তরাকাশ এবং অন্তর ও বহিঃ এই দুইদিকের উপর যিনি আধিপত্য করছেন তিনি দহরাকাশ, দহর, অন্তরহৃদয়াকাশ এই সব নামে উপনিষদে অভিহিত। চিৎস্বরূপ, স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, যিনি বাক্, প্রাণ এবং মন, এই তিনের সমাসে সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন, এই তিন আকাশ তাঁর স্বরূপ এবং তাই তাঁর একটি নাম ত্র্যম্বক। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, তৃতীয় অধ্যায়, দ্বাদশ খণ্ড, সপ্তম, অষ্টম ,নবম মন্ত্র; ছান্দোগ্য উপনিষদ্, তৃতীয় অধ্যায়, চতুর্দ্দশ খণ্ড; ছান্দোগ্য উপনিষদ্, অষ্টম অধ্যায়, প্রথম খণ্ড। )
(অয়মাত্মা বাঙ্ময় মনোময়ঃ প্রাণময়ঃ—এই আত্মা বাঙ্ময় মনোম প্রাণময়------- বৃহদারণ্যক ১। ৫। ৩।)
৫। মন এবং আনন্দ।(ব্রহ্মের পঞ্চম আয়তন।
যে মিথুন বা আনন্দ থেকে সবাই জাত হয়েছে, উপনিষদে তাকে কখনো বাক্ এবং প্রাণের মিথুন আবার কখনো বাক্ এবং মনের মিথুন বলা হয়েছে। ঋষি বলেছেন মনকে আনন্দ রূপে উপাসনা করতে এবং মনই আনন্দ।
আনন অর্থে ‘মুখ', যেখান থেকে প্রাণ বা অন প্রকাশ পাচ্ছেন। আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয় গুলি তাই মুখেই প্রতিষ্ঠিত। ‘দ’ অর্থে ‘বাক্'। (উপনিষদে দৈবী বাকের প্রকাশ কে ‘দ, দ, দ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। [বৃহদারণ্যক উপনিষদ]। বাক্ বা ‘দ' যার দ্বারা, বা নিজের যে ‘করণের' দ্বারা,নিজেকে বা প্রাণকে মূর্ত্ত করেন, ‘বাক্য' করেন তা ‘দন্ত’। ‘দ' বা বাকের ‘অন্ত' যার দ্বারা সাধিত হয়, তা দন্ত। )
তাই স্বয়ংপ্রকাশ চেতনা বা মুখ্যপ্রাণের যে বাঙ্ময় প্রকাশ বা শব্দ বা বাক্য সকল তা ‘আনন্দ'। আনন্দ = আনন +দ(বাক্)। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তা এই বাক্ ও প্রাণের মিথুন জাত আনন্দের প্রকাশ। বাক্ ও প্রাণের মিথুনে প্রকাশ পায় ‘মন', এবং এই (দৈব) মন থেকে যা কিছু ‘মান্য' বা ‘মান সম্পন্ন’, যা কিছু অনুভূতিগ্রাহ্য তা, বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই বিশ্ব প্রকাশ পায়। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ্, তৃতীয় অধ্যায়, ভৃগু বল্লী, ষষ্ঠ অনুবাক্ দ্রষ্টব্য। )
তাই এই মনই আনন্দ,কেননা বাক্ ও প্রাণের মিলন সম্ভূত এই মন।
ছান্দোগ্যে বাক্ ও প্রাণের মিথুনের কথা একাধিক বার বলা হয়েছে। এই মিথুনকে ঋক্ (বাক্) ও সামের (প্রাণের) মিথুন ও বলা হয়েছে। নীচে উদ্ধৃত করা হলো।
বাগেব ঋক্ প্রাণঃ সাম
(বাক্ ই ঋক্, প্রাণই সাম।
ওম্ ইতি এতদ্ অক্ষরম্ উদ্গীথঃ।
(ওম্ এই অক্ষর উদ্গীথ।)
তদ্বা এতদ্ মিথুনং যদ্ বাক্ চ প্রাণশ্চঃ ঋক্ চ সাম চ।
(সেই এই মিথুন, যা বাক্ ও প্রাণ, এবং যা ঋক্ ও সাম।) (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ১। ১।৫)
অব্যক্ত থেকে ব্যক্ততার প্রকাশে, প্রথম যে মিথুন তা বাক্ ও প্রাণের মিথুন। সেই মিথুনে যা জাত হয় তা ‘মন' বা দৈব মন, যে মন সুখ ও দুঃখের দ্বারা অভিভূত হয় না, যে মনই খণ্ড খণ্ড হয়ে আমাদের মন হয়েছে। এই মনের দৈব নাম ব্রহ্মা এবং এঁর শক্তি হলো ব্যক্ত বাক্ বা শ্বেত সরস্বতী যিনি এই মনকে ব্যক্ত বিশ্বের আকারে মূর্ত্ত করছেন। এই যে মিথুন, যা মনের সাথে বাকের মিথুন তার কথা বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে। আবার, বৃহদারণ্যক উপনিষদে, বাক্ ও প্রাণের মিথুনের কথাও বলা হয়েছে। এই যে বাক্, যিনি প্রাণের শক্তি, তিনি অব্যক্ত বাক্ বা নীল সরস্বতী।
উপরোক্ত প্রথম এবং দ্বিতীয় মিথুনের কথা বৃহদারণ্যকে বলা হয়েছে। বৃহদারণ্যক পঞ্চম অধ্যায় , অষ্টম ব্রাহ্মণে (বৃহদারণ্যক ৫। ৮। ১। ) বলা হয়েছে, বাক্ হলেন ধেনু (গাভী), প্রাণ হলেন ঋষভ (বৃষ) এবং মন হলেন বৎস (বাছুর)। এই ভাবে বাক্ ও প্রাণের মিথুন এবং তার থেকে জাত মনের কথা উক্ত হয়েছে।
আবার বৃহদারণ্যকে মন ও বাকের মিথুনের কথা বলা হয়েছে। বৃহদারণ্যক প্রথম অধ্যায়, প্রথম ব্রাহ্মণ থেকে এই মিথুনের বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা নীচে উদ্ধৃত করা হলো।
তস্যৈ বাচঃ পৃথিবীং শরীরং জ্যোতীরূপময়মগ্নিস্তদ্যাবত্যেব বাক্ তাবতী পৃথিবী তাবানয়মগ্নিঃ। (বৃহদারণ্যক ১। ৫। ১১।) (সেই বাকের শরীর পৃথিবী, জ্যোতীরূপ এই অগ্নি; তাই যতদূর অব্দি বাক্ ততদূর পৃথিবী, সেইরকম এই অগ্নি।)
অথৈতস্য মনসো দ্যৌঃ শরীরম্ জ্যোতীরূপমসাবাদিত্যস্তদ্যাবত্যেব মনস্তাবতী দ্যৌস্তাবানসাবাদিত্যস্তৌ মিথুনং সমেতাং ততঃ প্রাণঃ অজায়ত। সঃ ইন্দ্রঃ স এষঃ অসপত্নো দ্বিতীয় বৈ সপত্নো নাস্য সপত্নো ভবতি য এবং বেদ। (বৃহদারণ্যক ১। ৫। ১২।) ( অনন্তর এই মনের দ্যুলোক হলো শরীর, জ্যোতীরূপ এই আদিত্য; তাই যতদূর অব্দি মন, ততদূর দ্যুলোক, সেইরকম ঐ আদিত্য। সেই দুই জন [বাক্ ও মন] মিথুনে সঙ্গত হলেন; তার থেকে [সেই মিথুন থেকে] প্রাণ জাত হলেন। সে [সেই প্রাণ] ইন্দ্র; সে অসপত্ন [ যাঁর সপত্নী হয় না; যাঁর বহু পত্নী থাকলেও, অদ্বৈত দর্শন হেতু , সেই বহু শক্তিকে, বহুরূপী বাক্ কে একজন বলে বা আত্ম শক্তি বলেই জানেন]; দ্বিতীয়তাই সপত্নী; এঁর সপত্নী হয় না, যিনি এই রকম জানেন বা এই ভাবে বেদনময় হন। )
অথৈতস্য প্রাণস্যাপঃ শরীরম্ জ্যোতীরূপমসৌ চন্দ্রস্তদ্যাবানেব প্রাণস্তাবত্য আপস্তাবানসৌ চন্দ্রঃ। ত এতে সর্ব্ব এব সমাঃ সর্ব্বেঃ অনন্তাঃ;স যো হৈতানন্তবত উপাস্তেঃ অন্তবন্তং স লোকং জয়ত্যথ যো হৈতাননন্তনুপাস্তেঃ অনন্তং স লোকং জয়তি। (বৃহদারণ্যক ১। ৫। ১৩।) (অনন্তর এই প্রাণের আপ্ [অপ্ / জল] হলো শরীর, জ্যোতীরূপ ঐ চন্দ্র; তাই যতদূর অব্দি প্রাণ ততদূর অব্দি অপ্, সেই রকম ঐ চন্দ্র। সেই এরা [বাক্, প্রাণ, মন এবং তাঁদের জ্যোতীরূপ এবং শরীর] সবাই সমান [স্বয়ংপকাশ আত্মস্বরূপই বা তাঁর মহিমা], সবাই অনন্ত; যারা এঁদেরকে 'অন্ত' বলে উপাসনা করে তারা 'অন্তবান্' লোকসকল জয় করে; আর যারা এঁদেরকে 'অনন্ত' বলে উপাসনা করে তারা 'অনন্তবান্' লোকসকল জয় করে।)
আত্মশক্তি বাকের শরীর হলো পৃথিবী; ইনি সেই পৃথিবী, সেই ধরিত্রী যিনি ঐ বাকের শরীর এবং সবার শরীর। যেখানে যা কিছু আয়তনময়, শরীরী, তা এই বাকেরই আয়তন, এই পৃথিবীরই বিস্তার। (পৃথিবী অর্থে যেখানে সবাই মুর্ত্ত, পৃথক পৃথক অস্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র নিয়ে বিদ্যমান।)
আর আত্মস্বরূপের সঙ্কল্পময়তা হলো মন এবং তা আনন্দ, যা বাক্ ও প্রাণের মিথুন থেকে জাত। এই মন যেমন যেমন সঙ্কল্প করেন, বাক্ তেমন তেমন ভাবে মনের সাথে সঙ্গত হয়ে তা প্রকাশ করেন।(মুণ্ডকোপনিষদ্ ৩। ১। ১০। দ্রষ্টব্য)। তাই ঋষি বললেন যে মনের শরীর হলো দ্যুলোক। দ্যু বা দিব্ হলো সেই লোক যার থেকে সবাই প্রকাশ পায়।
আর এই মন এবং বাকের মিথুন থেকে এই যে ব্যক্ত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য,মনের দ্বারা যাকে মাপা যায়, মান নির্ণয় করা যায়, এমন যে বিশ্ব প্রকাশ পেয়েছে তা সেই প্রাণই, যে প্রাণ আর বাকের মিলনে এই দৈব মন সৃষ্টি হয়েছে। এই মন এবং বাকের মিথুনে যে জাত হয়েছে, ঋষি তাকে ইন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা সবাই ইন্দ্র বা ইদং দ্রষ্টা। আমরা অনবরত, এটা (ইদং) মাটি, এটা (ইদং) আকাশ, এটা (ইদং) ফুল, এই ভাবে সকল কিছু দর্শন করছি। আমরা বহুদর্শী,বহুর মধ্যে যে এক তাকে বাদ দিয়ে, তাকে না দেখে, আমরা ‘ইদং দ্রষ্টা’ বা ইন্দ্র হয়েছি। এই রকম যে ইন্দ্র, তার নাম (ঋক্ বেদোক্ত) ‘পুরুরবা', যে বহু বা ‘পুরু' রবময় পুরুষ, বা বহু বা দ্বিতীয় দর্শনময়। আর যে ইন্দ্র স্বর্গের রাজা, তিনি দেখছেন যে ‘নিজ’ বা একই আত্মা সর্ব্বত্র দ্রষ্টা এবং সকল দৃশ্য আত্মারই রূপ। তাই ঋষি বলেছেন যে ইন্দ্র ‘অসপত্ন' এবং দ্বিতীয়তাই সপত্নী। আত্মা যে বহু হয়েছেন, এই বহুত্ব আত্মারই মহিমা, একেরই বহুত্ব। ইনি নিজেই নিজেকে বহু করেছেন বা বহু বলে জানছেন। ইনি নিজেই নিজের শক্তি। এই জানা বা জ্ঞানশক্তি ইনি নিজেই। তাই এই শক্তির বহুত্বর মধ্যে যিনি একত্ব দেখেন, তিনি অসপত্ন; তাঁর বহু পত্নী থাকলেও, তিনি ‘অসপত্ন’। এই ইন্দ্র সোমপায়ী; প্রাণ থেকে যে অবাধ বেদন, অনুভূতি রাশি প্রকাশ পাচ্ছে, তা পান করছেন। চন্দ্র বা সোমই এঁর জ্যোতী। যেখানে যা কিছু যে কেউ পেয়েছে, পাচ্ছে, সেই আপ্তি এঁরি আপ্তির অন্তর্গত। তাই অপ্ বা আপ্, যা আপ্তি, যা সর্ব্বতৃষ্ণা নিবারক, তা এই প্রাণের বা ইন্দ্রের শরীর। সবার মধ্যে ইনিই দ্রষ্টা, ইনিই ভোক্তা। তাই ইনি অসপত্ন।
(প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বৃহদারণ্যকে ঋষি বলেছেন------তস্মাৎ অয়ম্ আকাশঃ স্ত্রীয়া পূর্যত--------সেই হেতু এই আকাশ স্ত্রীর দ্বারা পূর্ণ। বৃহদারণ্যক --------১। ৪। ৩। )
৬। হৃদয়। (ব্রহ্মের ষষ্ঠ আয়তন)।
ব্রহ্মের যে ষষ্ঠ পাদ তা হৃদয়। ষষ্ঠ সংখ্যাটি মধুবাচক; যেমন মধুমক্ষিকারা ষট্পদা। হৃদয়েই মধুচক্র স্থিত এবং মন্ত্ররূপ মধু মক্ষিকারা হৃদয়েই আসক্ত। আমরা যে মন্ত্রময়, বাঙ্ময়, অনুভূতির বিশ্বে বেঁচে আছি, সেখানে সকল কিছুকে ‘আমি' বা ‘আমার' বলে ধরে রেখেছি; যেমন আমার সন্তান, আমার সম্পদ, এইভাবে সবকিছু আমরা হৃদয়ের দ্বারাই ধরে রেখেছি। সেইরকম স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, ব্রহ্মরূপে নিজেকে সর্ব্বাকারে প্রকাশ করে, তাঁর সেই প্রতিটি সত্বাকে হৃদয়ের দ্বারাই বা ‘আমার সৃষ্টি, আমার সন্তান’ বলে ধরে রেখেছেন। তাই উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘হৃদয়ম্ ব্রহ্ম’।
তাই মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন হৃদয়কে স্থিতি রূপে উপাসনা করতে। স্থিতি না হলে ভোগ হয় না; এই সৃষ্টির সার্থকতা হয় না। এই হৃদয়ই ভোগের ক্ষেত্র, আমাদের সমস্ত অনুভূতির কেন্দ্র, এবং অধিদৈবে বরুণ লোক। হৃদয়ের দ্বারাই এই বিশ্ব স্থিতি শীল হয়েছে এবং আমরা জীবনময় হয়েছি, আয়ুষ্মান হয়েছি।
হৃদয় মানে যেখানে আহরণ (হৃ) এবং দান (দ) এই দুই কর্ম্ম সম্পন্ন হয় এবং এই দুইয়ের নিয়ন্ত্রণ (যমন —য/য়) কেন্দ্র যা। আমরা এই বিশ্বকে গ্রহণ করছি হৃদয়ের দ্বারা, এবং নিজেদেরকে এই বিশ্বতে বিতরণ করছি, বিলিয়ে দিচ্ছি এই হৃদয়ের দ্বারাই। আর এই আত্মস্বরূপই হৃদয় গুহার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আমাদেরকে বা আমাদের হৃদয়কে দোল দিচ্ছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন।
হৃদয়রূপ গুহার প্রসঙ্গে, কঠোপনিষদের একটি মন্ত্র নীচে উদ্ধৃত করা হলো।
ঋতম্ পিবন্তৌ সুকৃতস্য লোকে গুহাম্ প্রবিষ্টৌ পরমে পরার্দ্ধে।ছায়াতপৌ ব্রহ্মবিদো বদন্তি পঞ্চাগ্নৌ যে চ ত্রিণাচিকেতাঃ।। ( কঠোপনিষদ্ ১.৩.১। )
(সেই দুইজন [অক্ষর এবং ক্ষর আত্মা] সুকৃতের লোকে [যেখানে সব কিছু সুখ বাআনন্দ থেকে কৃত বলে জ্ঞাত বা অনুভূত হয়, সেই লোকে], ঋত [যা সত্যের সার বা সত্যের রস, অমৃত] পান করছেন; এই পর বা শ্রেষ্ঠ অর্দ্ধ, গুহাতে প্রবিষ্ট।
ব্রহ্মবিদ্ , এবং, যাঁরা পঞ্চাগ্নিকে জানেন, যাঁরা নচিকেতা নামক তিন অগ্নিকে জানেন, তাঁরা বলেন যে (এঁরা দুই জন—অক্ষর এবং ক্ষর) ছায়া এবং আতপের ন্যায়।
(নচিকেতা, গৃহপতি, দক্ষিণ এবং আহবনীয়, এই তিন অগ্নিকে জেনেছিলেন বলে, এই তিন অগ্নি তাঁর নামে প্রসিদ্ধ। )
আকাশ এবং প্রতিষ্ঠা।
ব্রহ্মের ছয়টি আয়তন আকাশে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠা------প্রতি তিষ্ঠতি—এই আত্মস্বরূপ যেমন করে নিজেকে সৃষ্টি করে আয়তনময় হয়েছেন, সেই প্রতি আয়তনকে নিজেই আধার হয়ে ধারণ করেছেন।এর নাম প্রতিষ্ঠা। স্থিতি না হলে, তার ভোগ বা উপলবদ্ধি হয় না। এই পরম আত্মস্বরূপে যা ‘অতিষ্ঠা’, যেখানে স্থিতির বোধও আত্মবোধে মিলিয়ে গেছে, সেই আত্মস্বরূপই আবার ‘আকাশ' রূপ প্রতিষ্ঠা। আকাশ হলো চেতনের সেই ভূমি, যেখানে কিছু নেই আবার যেখান থেকে সব প্রকাশ পায়। আকাশ= আ (আত্মময়,আতত বা বিস্তৃত, কাশ্ বা প্রকাশবান্ যিনি। )
এই আকাশের ধর্ম্ম হলো বিধৃতি। এখানে সব বিধৃত, তাই এই আকাশই প্রতিষ্ঠা। আকাশ বা অবকাশ না হলে, সৃষ্টি স্থিতিশীল হয় না। অবকাশ বা ফাঁক মানে একটি সত্ত্বা থেকে আরেকটি সত্ত্বাকে আলাদা করে ধরে রাখা; এর দ্বারা পৃথক পৃথক অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় বা সম্ভব হয়।
বহিরাকাশ বা বাইরের আকাশে যেমন ভৌতিক বিশ্ব এবং আমাদের শরীর প্রত্যক্ষ হচ্ছে , সেইরকম যেখানে আমরা মনোময়, সঙ্কল্পময়, অনুভূতিময়, তা অন্তরাকাশ। আর এই দুই আকাশের উপর আধিপত্য করছেন দহরাকাশ বা অন্তর্হৃদয়াকাশ।
আমরা যেমন আমাদের শরীরে প্রতিষ্ঠিত, সেই রকম ব্রহ্মের এই ছয়টি আয়তন আকাশে প্রতিষ্ঠিত।
এই প্রসঙ্গে উপনিষদে ঋষি বলেছেন------যদা চর্ম্মবদাকাশং বেষ্টয়িষ্যন্তি মানবাঃ। তদা দেবম্ বিজ্ঞায় দুঃখস্যান্তো ভবিষ্যতি।। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্, ৬। ২০। )------চর্ম্ম যেমন (শরীরকে আবৃত বা বেষ্টন করে) , সেই ভাবে মানবরা যখন আকাশকে বেষ্টন বা আলিঙ্গন করে, সেই দেবতাকে জেনে তার দুঃখ দূর (অন্ত) হয়ে যায়।
আকাশকে জানা মানেই সুখের উপলবদ্ধি এবং দুঃখের অবসান। সুখ = সু + খ= সুলভ আকাশ। দুঃখ = দুঃ + খ = দুর্লভ আকাশ। অন্তরের যে আকাশ, তার নৈকট্য বা স্পর্শই সুখ আর তার অভাবই দুঃখ। এই স্পর্শ স্থূলে, চর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত। এই স্পর্শই বায়ু, যা আকাশকে আবৃত রেখেছে।
অন্তরাকাশের প্রথম প্রকাশের যে অভূতপূর্ব্ব সুখ এবং অন্তর্মুখী আকর্ষণ, তা সাধকদের বহির্মুখী কর্ম্ম চাঞ্চল্যকে স্তিমিত করে দেয়। দ্রষ্টা ঋষিরা বলেছেন যে অন্তরের এই আকাশ এবং বহিরাকাশ একই।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ, চতুর্থ অধ্যায়, প্রথম ব্রাহ্মণ।
১ম মন্ত্র।
ওঁ জনকোহ বৈদেহ আসাং চক্রেऽথ হ যাজ্ঞবল্ক্য আবব্রাজ। তং হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্য কিমর্থচারীঃ পশুনিচ্ছন্নণ্বন্তানিত্যুভয়মেব সম্রাড্ ইতি হোবাচ।।১।
অন্বয় এবং অর্থ।
ওঁ জনকঃ---ওম্ জনক
হ বৈদেহ ---এবং (যিনি) বৈদেহ
আসাং চক্রেঃ—আসীন ছিলেন;
অথ হ ----অনন্তর
যাজ্ঞবল্ক্য আবব্রাজ---- যাজ্ঞবল্ক্য আগমন করলেন।
তং হ উবাচ—তাঁকে বললেন
কিম্---কি
অর্থচারীঃ---অর্থের জন্য বিচরণ (আগমন) করেছেন ?
পশুন্ ইচ্ছন্--পশু ইচ্ছা করে
অণ্বন্তানিতি----অণু অন্তান্ ইতি---যা অণু (সূক্ষ) তার অন্তে যা ( তার ইচ্ছায় )? ইতি।
উভয়মেব ,সম্রাড্---উভয়ম্ এব সম্রাড্--- সম্রাট্! উভয়ের জন্যই।
ইতি হ ---ইহাই
উবাচ—বললেন।
অর্থ।
ওঁ। জনক এবং যিনি বৈদেহ, তিনি আসীন ছিলেন। অনন্তর যাজ্ঞবল্ক্য আগমন করলেন।
তাঁকে (জনক) বললেন ---কি অর্থে বিচরণ (আগমন) করেছেন ? পশু ইচ্ছা করে, না যা অণু (সূক্ষ) তার অন্তে যা (তার ইচ্ছায়)?
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)---সম্রাট্! উভয়ের জন্যই--- ইহাই বললেন।
নিরুক্ত। (এই অংশে বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং অনুচ্ছেদের অর্থ এবং তাৎপর্য লিখিত হলো। উপরে ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশে যে সব অর্থ এবং ব্যাখ্যা উক্ত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই নিরুক্ত অংশে করা হয় নি।)
১। বৈদেহ জনক ও বৈদেহী সীতা।
জনক---জন+ক--যেখান থেকে বা যাঁর থেকে ‘ক’ বা ব্যঞ্জন বর্ণ বা চেতনার বর্ণময় প্রকাশ বা জনন (জন) হচ্ছে তিনি জনক।
বিরাটে বা বিপুল চেতনায় এই ক্ষেত্রের নাম জনলোক। আমাদের শরীরে এই কেন্দ্র হল ‘কণ্ঠ’, যেখান থেকে চেতনা বা আমরা শব্দের আকারে ব্যক্ত হচ্ছি। এই স্থূল, মূর্ত্ত বিশ্ব, চেতনায় শব্দের আকারে বিধৃত; যেমন আমাদের মনে আমাদের অনুভূতিগুলি শব্দের আকারে রয়েছে। জ্ঞানস্বরূপ চেতনা, যিনি কোন সীমা বা আয়তনের দ্বারা বদ্ধ নন, তিনিই সসীম, মূর্ত্ত বিশ্বের আকারে নিজেকে প্রকাশ করেছেন, আয়তন বা দেহ ধারণ করেছেন। এই চিৎ শক্তির নাম বৈদেহী, যিনি অশরীরী বা বিদেহ হয়েও শরীর বা দেহ ধারণ করেন।
(যে ঐতিহসিক নারী, যাঁর নাম ছিল সীতা, তাঁর মধ্যে এই চিৎ শক্তির জ্ঞান স্বাভাবিক ভাবে ছিল, তাই তাঁকে বৈদেহী বলে সম্বোধন করা হতো এবং এই কারণে তাঁকে ‘অযোনিজা’ বলা হতো এবং এই কারণেই তাঁর পিতার নাম ছিল ‘জনক’।)
বৈদেহ জনক--যিনি উপরোক্ত বিদেহ জ্ঞানের উপাসক তাঁর নামও বৈদেহ জনক।
২। যাজ্ঞবল্ক্য।
যাজ্ঞবল্ক্য= যঃ জ্ঞঃ + যঃ বল্কঃ——যিনি জ্ঞ এবং যিনি বল্ক বা বল্কল। যিনি জ্ঞ, তিনি জানছেন; তিনি সবার মধ্যে জ্ঞানময় বা বোধময়, এবং তাঁর জ্ঞান বা বোধক্রিয়া থেকে সবাই জাত। সকল কিছু তাঁর জ্ঞান বা বোধক্রিয়ার মূর্ত্তি।
তাঁরই থেকে জাত এই বিশ্ব তাঁকে বল্কলের মতো বেষ্টন করে আছে। তিনি নিজেই এই বিশ্ব হয়ে, জ্ঞ স্বরূপ নিজেকে বল্কলের মতো বেষ্টন করেছেন। এই রকম জ্ঞানের যিনি দ্রষ্টা তাঁর নাম যাজ্ঞবল্ক্য।
৩। পশুন্ ইচ্ছন্--পশু ইচ্ছা করে; পশুবলি। পশু এবং যজ্ঞ।
যারা পাশ বদ্ধ, তারা পশু। আমরা দেবতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সুখ, দুঃখ ভোগ করছি এবং মৃত্যুর বশীভূত হয়ে আছি। এইটি পশুত্ব।
এই দেবতারা, জ্ঞানস্বরূপ যে বিশ্ব-চেতনা তাঁরই বিশেষ বিশেষ অভিব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ত্ব এবং নিজেদেরকে সেইভাবেই জানেন। । আবার ঐ দেবক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আমরা সৃষ্টি হয়েছি। আবার যারা আমাদের অধীন, বা যাদের জীবন আমাদের ভোগ্য তারা আমাদের পশু। শুধু ছাগল, গরু, ভেড়াই নয়, জ্ঞান চক্ষে দেখলে দেখা যাবে বহু জীব বা প্রাণী আছে যারা আমাদের উপর নির্ভর এবং আমাদের ভোগ্য।
শরীর অনুসারে, কণ্ঠ থেকে মস্তক পর্য্যন্ত নিয়ন্ত্রণময় আত্মা বা ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। কণ্ঠের নীচে, জীবাত্মা, যে পাশ বদ্ধ হয়ে সুখ দুখঃ ভোগ করছে তার বা পশুর অধিষ্ঠান। এই জন্য, বলিতে শিরচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ প্রকৃত বলি হলে জীব আর পশুত্ব বা মৃত্যুর বশীভূত থাকে না। কোন নিরীহ পশুকে হত্যা করে, দেবতা বা দেবীকে সন্তুষ্ট করা বলির উদ্দেশ্য নয়।
দেবতাদের মতো, দ্রষ্টা ঋষিদের বশে বা অধীনে যারা থাকে, তারাও তাঁদের পশু (বা শিষ্য) এবং এই পশুদের পশুত্ত্ব থেকে দেবত্ব এবং আত্মজ্ঞতায় ঋষিরা তাঁদের উপদেশের দ্বারা নিয়ে যান। এর নামও পশুবলি।
তাই ঋষিরা পশুকামী। এই পশুদের যে পশুত্ব দূর হয় তাই যজ্ঞ। যিনি ‘জ্ঞ’ বা জ্ঞান স্বরূপ চেতনা, তাঁতে ‘যুক্ত’ হওয়া যে কর্ম্মের দ্বারা বা যে জ্ঞান বা বোধক্রিয়ার দ্বারা, তার নাম যজ্ঞ।
৪। অণু অন্ত্যান্ ইতি। জ্ঞান, প্রাণ ও যজ্ঞ।
অণোরনিয়ান্মহতো মহীয়ানাত্মাস্য জন্তোর্নিহিতো গুহায়াং--------অণু থেকেও অণু, মহৎ থেকেও মহান (এই) আত্মা, জন্তুর (জীবের) গুহাতে (হৃদয়ের মধ্যে বা হৃদয় গুহাতে) নিহিত। (কঠোপনিষদ্ ১।২। ২০।])
অণু অন্ত্যান্ ইতি---যা অণু (সূক্ষ) তার অন্তে যা ( তাঁর ইচ্ছায় )---- যিনি অণু থেকেও অণু, তাঁর ইচ্ছায়।
অর্থাৎ যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, পশু এবং যজ্ঞ যাঁতে অস্তমিত হয়, যিনি অণুর ও অন্তে, এই দুইয়ের ইচ্ছায় তিনি এসেছেন।
যিনি ‘জ্ঞ’ বা যাঁর প্রকাশ বা কর্ম্মময়তার নাম জ্ঞান, সেই কর্ম্ম বা বোধপ্রকাশই ‘যজ্ঞ’। ‘জ্ঞ’ বা যিনি সবাইকে জানেন, সবাই যাঁর জ্ঞান বা বোধের মূর্তি, তাঁর বোধক্রিয়া বা বোধপ্রকাশের নাম ‘অন’ বা ‘প্রাণ’। ‘জ্ঞান’ শব্দের ইহাই তাৎপর্য্য। ‘জ্ঞ’ এবং ‘অন’ বলাও যা, ‘আত্মা’ এবং ‘প্রাণ’ বলাও তা। আত্মার ঈশিত্ব, নিয়ন্ত্রণ বা কর্ম্মময়তাই প্রাণ। এই নিয়ন্ত্রণের অন্য নাম ‘যমন’। তাই ‘যজ্ঞ’ অর্থে পরম আত্মস্বরূপের ‘যমন’ ---য +জ্ঞ।
তাই সকল কর্ম্ম, যজ্ঞ, আত্মাতেই অন্ত প্রাপ্ত হয়। এর নাম, ‘অণু অন্ত্যান্’ বা ‘যা অণু (সূক্ষ) তার অন্তে যা’।
(আবার, ‘যজ্ঞ’ = যঃ জ্ঞঃ----যিনি ‘জ্ঞ’, তাঁকে জানার জন্য যে কর্ম্ম তার নাম ‘যজ্ঞ’। )
২য় মন্ত্র
যত্তেকশ্চিদব্রবীত্ তচ্ছৃণবামেত্যব্রবীত্ মে জিত্বা শৈলনির্বাগ্বৈব্রহ্মেতি।
যথা মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ ব্রুয়াত্তথা তচ্ছৈলিনিরব্রবীত্ বাগ্বৈ ব্রহ্মেত্যবদতো হি কিং স্যাদিত্যব্রবীত্তু তে তস্যায়তনং প্রতিষ্ঠাং?
ন মেऽব্রবীদিত্যেকপাদ্বা এতত্ সম্রাড্ ইতি।
স বৈ নো ব্রুহি যাজ্ঞবল্ক্য।
বাগেবায়তনমাকাশঃ প্রতিষ্ঠা প্রজ্ঞেত্যেনদুপাসীত।
কা প্রজ্ঞতা যাজ্ঞবল্ক্য?
বাগেব সম্রাডিতি হোবাচ। বাচা বৈ সম্রাড্ বন্ধু: প্রজ্ঞায়তে ঋগবেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোऽথর্বাঙ্গিরস ইতিহাসঃ পুরাণং বিদ্যা উনিষদঃ শ্লোকাঃ সূত্রাণ্যনুব্যাখ্যানানি ব্যাখ্যানানি ইষ্টং হুতমাশিতং পায়িতং অয়ম্ চ লোকঃ, পরশ্চ লোকঃ
সর্ব্বাণি চ ভুতানি বাচৈব সম্রাট্ প্রজ্ঞায়ন্তে; বাগ্বৈ সম্রাট্ পরমম্ ব্রহ্ম; নৈনম্ বাক্ জহাতি, সর্ব্বাণ্যেনম্ ভূতান্যভিক্ষরন্তি, দেবো ভূত্বা দেবানপ্যেতি, য এবম্ বিদ্বানেতদুপাস্তে।
হস্ত্যৃষভং সহস্রম্ দদামীতি হোবাচ জনকো বৈদেহঃ।
স হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ, পিতা মেऽমন্যত নাননুশিষ্য হরেতেতি।
অন্বয় এবং অর্থ।
যৎ তে (যা কিছু) কশ্চিৎ (কেহ) অব্রবীত্ (বলেছেন) তৎ (তা) শৃণবাম (শুনব)। ইতি।
অব্রবীত্ (বলেছিলেন) মে (আমাকে) জিত্বা শৈলিনিঃ বাক্ বৈ (বাক্ ই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম)। ইতি।
যথা (যেমন) মাতৃমান্ (মাতৃমান্) পিতৃমান্ (পিতৃমান্) আচার্যবান্ (আচার্যবান্) ব্রুয়াৎ (বলে থাকেন) তথা (সেই প্রকার) তৎ (তাহা) শৈলিনিঃ (শৈলি) অব্রবীত্ (বলেছিলেন) --- বাগ্বৈ (বাক্ ই) ব্রহ্ম ( ব্রহ্ম )।ইতি। অবদতো (বাক্ শক্তি হীনের) হি কিং স্যাৎ (কিই বা থাকে!) । ইতি।
অব্রবীৎ (বলেছিলেন) তু (পরন্তু) তে (আপনাকে) ) তস্যা (বাক্ রূপ ব্রহ্মের) আয়তনং (আয়তন) (এবং) প্রতিষ্ঠাং (প্রতিষ্ঠা)?
ন (না) মে (আমাকে) অব্রবীৎ (বলেছিলেন)। ইতি।
এক (একটি) পাৎ (পদ) বা (ই), এতত্ (ইহা) সম্রাট্ (সম্রাট্ )! ইতি ।
স (তাহা) বৈ (অবশ্যই) নো (আমাকে) ব্রুহি(বলুন) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।
বাক্ (বাক্) এব (ই) আয়তনম্ (আয়তন) আকাশঃ (আকাশ) প্রতিষ্ঠাঃ (প্রতিষ্ঠা ), প্রজ্ঞা (প্রজ্ঞা) ইতি (ইনি), এনত্ ( এঁকে) (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)। কা (কি) প্রজ্ঞতা (প্রজ্ঞা) যাজ্ঞব্যলক্য (যাজ্ঞব্যলক্য )?
বাক্ এব (বাক্ ই——বাক্ ই প্রজ্ঞা সম্রাড্ (সম্রাট)-- ইতি হ (ইহাই) উবাচ (বললেন)।
বাচা বৈ (বাক্ ই) সম্রাড্ (সম্রাট) বন্ধু (বন্ধু), প্রজ্ঞায়তে (বিজ্ঞাপিত করেন) ঋগবেদঃ (ঋক বেদ) যজুর্বেদঃ (যজুর্বেদ) সামবেদঃ (সামবেদ) অথর্ব্ব আঙ্গিরস: (অথর্ব্ব আঙ্গিরস) ইতিহাসঃ (ইতিহাস) পুরাণং ( পুরাণ) বিদ্যা (বিদ্যা) উপনিষদঃ (উপনিষ) শ্লোকাঃ (শ্লোক সকল) সূত্রাণি (সূত্র সকল) অনুব্যাখ্যানানি (অনু ব্যাখ্যা সকল) ব্যাখ্যানানি (ব্যাখ্যা সকল) ইষ্টং (ইষ্ট) হুতম্ (যা কিছু হুত) আশিতং (যা কিছু খাদ্য) পায়িতং (যা কিছু পেয়) অয়ম্ চ লোকঃ (ইহ লোক) পরঃ চ লোকঃ (এবং পরলোক) সর্ব্বাণি চ ভুতানি (এবং সকল ভূতসমূহ) বাচ এব (বাক্ ই) সম্রাড্ (সম্রাট) প্রজ্ঞায়ন্তে (বিজ্ঞাপিত করেন) ; বাক্ বৈ (বাক্ ই) সম্রাট্ (সম্রাট) পরমম্ (পরম) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম) ; ন এনম্ (না এঁকে) বাক্ (বাক্) জহাতি (পরিত্যাগ করেন) , সর্ব্বাণি (সকল) এনম্ (এঁর জন্য) ভূতানি (ভূত সকল/ জীব সকল) অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন), দেব (দেব/ দেবতা) ভূত্বা (হয়ে) দেবান্(দেবগণকে) অপ্যেতি (আপ্ত বা প্রাপ্ত হন), য: (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (বিদিত হয়ে) এতৎ (এই) উপাস্তে (উপাসনা করেন)।
হস্তি (হস্তি) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো)—— ইতি হ (এই ই) উবাচ (বললেন) জনকো (জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ)।
স হ (তাহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ(যাজ্ঞবল্ক্য), পিতা (পিতা) মে (আমার) অমন্যত (মনে করতেন) অননুশিষ্য (অনুশাসন / উপদেশ না দিয়ে), ন (না) হরেৎ (হরণ) ইতি।
অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-- যা কিছু, কেহ (অন্য কোন ঋষি) (আপনাকে) বলেছেন তা শুনব। ইতি।
(জনক বললেন)-- আমাকে জিত্বা শৈলিনি বলেছিলেন, বাক্ই ব্রহ্ম।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-- যেমন মাতৃমান্, পিতৃমান্, আচার্যবান্ বলে থাকেন,সেই প্রকার, তাহা, শৈলিনি বলেছিলেন--- "বাক্ই ব্রহ্ম"। বাক্ শক্তি হীনের কিই বা থাকে!
পরন্তু আপনাকে তার (বাক্ রূপ ব্রহ্মের) আয়তন এবং প্রতিষ্ঠা কি, তা
বলেছিলেন ?
(জনক বললেন)---আমাকে বলেননি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-- সম্রাট্! ইহা (বাক্) একটি পাদই । (সম্রাট্! বাক্, ব্রহ্মের ছয়টি পাদের মধ্যে একটি পাদ।)
(জনক বললেন)---যাজ্ঞবল্ক্য, তাহা অবশ্যই আমাকে বলুন।(যাজ্ঞবল্ক্য, বাক্ নামক ব্রহ্মের এই পাদের বিষয়ে আমাকে অবশ্যই বলুন। )
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-- বাক্ই ( ব্রহ্মের) আয়তন, আকাশ প্রতিষ্ঠা (আকাশে এই বাক্ প্রতিষ্ঠিত); প্রজ্ঞা (প্রজ্ঞা) ইতি (ইনি), এনত্ ( এঁকে) (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)।
(জনক বললেন)— যাজ্ঞবল্ক্য, প্রজ্ঞা কি?
বাক্ ই----- সম্রাট, বাক্ ই প্রজ্ঞা। ইহাই (যাজ্ঞবল্ক্য) বললেন।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-------বাক্ ই, সম্রাট বন্ধু, (বাক্ ই ) বিজ্ঞাপিত করেন ঋক বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ব্ব আঙ্গিরস, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা, উপনিষদ্, শ্লোক সকল, সূত্র সকল, অনুব্যাখ্যা সকল, ব্যাখ্যা সকল, ইষ্ট, যা কিছু হুত, যা কিছু খাদ্য, যা কিছু পেয়, ইহ লোক এবং পরলোক, এবং সকল ভূতসমূহ; বাক্ ই সম্রাট বিজ্ঞাপিত করেন ; বাক্ ই সম্রাট পরম ব্রহ্ম ; এঁকে বাক্ পরিত্যাগ করেন না, এঁর জন্য ভূত সকল/ জীব সকল অভিক্ষরণ করেন; দেবতা হয়ে দেবগণকে আপ্ত বা প্রাপ্ত হন যিনি এই ভাবে বিদিত হয়ে এই প্রকার উপাসনা করেন।
(জনক বললেন)-----সহস্র হস্তি ঋষভ দান করছি; ইহাই বললেন জনক-বৈদেহ।
যাজ্ঞবল্ক্য তাহাই বললেন, “ আমার পিতা মনে করতেন অনুশাসন (উপদেশ) না দিয়ে (সম্পূর্ণ না করে) হরণ (দক্ষিণা গ্রহণ) না করতে। ইতি।
নিরুক্ত। (এই অংশে বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং অনুচ্ছেদের অর্থ এবং তাৎপর্য লিখিত হলো। উপরে ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশে যে সব অর্থ এবং ব্যাখ্যা উক্ত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই নিরুক্ত অংশে করা হয় নি। ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশের ১ম অংশ দ্রষ্টব্য।)
১। জিত্বা শৈলিনি—যিনি এই শৈল বা প্রস্তরময় কঠিন পৃথিবী বা ভৌতিকতাকে, বাক্ বা জ্ঞানস্বরূপ চেতনার শব্দাত্মক প্রকাশ বা বাক্যের মূর্ত্তি বা আয়তন বলে প্রত্যক্ষ করেন, বা এই ভাবে ভৌতিকতাকে যিনি জয় করেছেন, তিনি জিত্বা শৈলিনি। ঐ বাক্ থেকে জাত বাক্য দিয়ে, শিলা দিয়ে, সব মূর্ত্তি রচিত হয়েছে। বিশ্বের সবাই মূর্ত্ত হয়েছে, কত শৈল রচিত হয়েছে। তাই এঁর নাম ‘শৈলজা’, যিনি শিলার আকারে জাত হয়েছেন।
২। পাদ------ পা। পা বা চরণ হলো তা, যার চিহ্ন ধরে ব্রহ্মকে অনুসরন করা যায়। (পদেন অনুবিন্দেৎ——পা বা পদচিহ্ন দ্বারা অনুবেদন বা অনুসরণ কর্ত্তব্য। (বৃহদারণ্যক ১। ৪। ৭। )
৩। বন্ধু-------বন্ধু শব্দটি ‘বন্ধ্' ধাতুর থেকে হয়েছে। এই বাক্ ‘প্রজ্ঞা' রূপে সমস্ত বিশ্বকে আমাদের সাথে যুক্ত করে দিচ্ছেন বা বেঁধে দিচ্ছেন, তাই ইনি বন্ধু বা মিত্র।
৪। সর্ব্বাণি (সকল) এনম্ (এঁর জন্য) ভূতানি (ভূত সকল/ জীব সকল) অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন)------এই প্রকার যিনি জ্ঞানময়, ভূত সকল বা যে কেউ সৃষ্ট হয়েছে, তারা জেনে বা না জেনে এঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়, এঁর প্রতি তারা যা নিজেদের প্রিয় তা, বা নিজেদেরকে বিতরণ করে।
অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন)--------যেমন এই অক্ষর আত্মা, নিজের অক্ষয়ত্ব কে বজায় রেখেই, বিশ্বের আকারে বা আমাদের আকারে নিজেকে অভিক্ষরণ করেন, তেমনি এই অক্ষর ব্রহ্মকে বা তাঁর পাদপদ্মকে যাঁরা জানেন, তাঁর প্রতি সেই ভূত সকল বা ক্ষরাত্মারা নিজেদেরকে অভিক্ষরণ করেন।
৫। দেব (দেব/ দেবতা) ভূত্বা (হয়ে) দেবান্(দেবগণকে) অপ্যেতি (আপ্ত বা প্রাপ্ত হন)-------দেবতা হয়ে দেবগণকে প্রাপ্ত হন।
চেতনাতে কিছু পাওয়া বা কোন আপ্তি মানেই তাই হওয়া। চেতনার ধর্ম্মই এই। তাই বলা হলো, দেবতা হয়ে দেবগণকে প্রাপ্ত হন।
৬। হস্তি (হস্তি) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো) :
হস্তি--------হস্ত বা কর্ম্ম যাঁর প্রকাশ। (হস্তি বা হাতির যে শুণ্ড বা শূঁড় তা হস্তির হস্ত বা হাত। এই শূঁড়ের দ্বারা হাতিরা হাতের যাবতীয় কায, যেমন স্পর্শ করা, গ্রহণ করা বা ধরা, আদর করা ইত্যাদি করে থাকে। এই শূঁড় অত্যন্ত শক্তিশালী এবং কর্ম্মকুশলী হস্ত। এই জন্য যিনি সর্ব্বহস্তা বা সর্ব্বকর্ম্মা বা বিশ্বকর্ম্মা (তষ্টৃ), সেই দেবতার বাহন হলো হস্তি। যে দেব শক্তি যে তির্য্যক্ বা পশুভূমিতে বিশেষ ভাবে প্রকট সেই পশু সেই দেবতার বা দেবীর বাহন।
৭। সহস্র হস্তিঋষভ।
স্বরবর্ণ বা আত্মপ্রকাশ, যার নাম অর্চি (ঋ + অ + চি), তা যাতে দীপ্ত বা প্রকাশিত, তা ঋষভ। যাঁরা এই অর্চি, ঋচ্ বা ঋক্ দ্রষ্টা, তাঁরা ঋষি।
সহস্র শব্দের অর্থ, ‘সহ স্রবতি -------আত্মনা সহ স্রবতি-----আত্মস্বরূপের সাথে যা প্রকাশ পাচ্ছে, বা আত্মময় কর্ম্মপ্রকাশ।
সহস্র হস্তিঋষভ--------আত্মোজ্জ্বল কর্ম্ম প্রবাহ।
সুতরাং হস্তিঋষভ এই শব্দের অর্থ আত্মার্চি দীপ্ত যে কর্ম্মসকল। জনক, যাজ্ঞবল্ক্যের উপদেশের দ্বারা প্রদীপ্ত হয়ে, তাঁর জ্ঞানদীপ্ত কর্ম্ম সকল যাজ্ঞবল্ক্যকেই নিবেদন করলেন বা স্বীকার করলেন।
(এই প্রসঙ্গে ইহা উল্লেখ্য যে আমরা এখানে যাঁদের কথোপকথনের কথার অর্থ করছি, তাঁরা হস্তি বলতে ‘সর্ব্ব কর্ম্মময় হস্তের কথা স্বাভাবিক ভাবেই মনে করতেন, সেই রকম পক্ষী বলতে ‘শুক্ল' এবং ‘কৃষ্ণ' পক্ষের ডানা মেলে যে সোমময় কাল প্রবাহ, তাকেই উক্ত করতেন, গো বলতে সর্ব্ববিষয়ে বিচরণময় ইন্দ্রিয়দের জানতেন, আর এই যে কাল (প্রাণ) আমাদের বহন করছেন জন্ম থেকে মৃত্যুতে এবং মৃত্যু থেকে জন্মতে, লোক থেকে লোকান্তরে তাকে অশ্ব বলতেন। আর এই স্বর্গ বা দ্যুঃ, পশুভূমির মধ্যে বা তির্যক ক্ষেত্রে যে ভাবে প্রকটিত, তাকে দর্শন করে, ঐ সব জীবদের হস্তি, পক্ষী, গো, অশ্ব ইত্যাদি বলে নামকরণ করেছেন। সেই প্রকার সহস্র বলতে, আত্মারই বহু বহু প্রবাহ এবং শত বলতে পূর্ণতা বোঝায়। তাই একটি বা সহস্র হস্তি-ঋষভ, যাই দান করা হয়েছিল, তার প্রকৃত অর্থ যা উপরে উল্লিখিত হলো। )
৮। স হ (তাহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ(যাজ্ঞবল্ক্য), পিতা (পিতা) মে (আমার) অমন্যত (মনে করতেন) অননুশিষ্য (অনুশাসন / উপদেশ না দিয়ে) ন (না) হরেৎ (হরণ)। ইতি।
যাজ্ঞবল্ক্যের পিতা কে? এই প্রশ্নের উত্তর উপনিষদে দেওয়া আছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রথম অধ্যায়, পঞ্চম ব্রাহ্মণ, প্রথম মন্ত্রে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন— যৎ সপ্ত অন্নানি মেধয়া তপসা অজনয়ৎ পিতা......(বৃহদারণ্যক, ১.৫.১।)——পিতা যখন সপ্ত অন্ন মেধা এবং তপস্যার দ্বারা সৃষ্টি করেছিলেন…।
যাজ্ঞবল্ক্যের পিতা তিনি, যিনি এই আত্মস্বরূপ অক্ষর, যিনি সৃষ্টিকে পোষণ করার জন্য, জীবনী শক্তি দেবার জন্য,
প্রাণ রূপ অন্ন হয়ে নিজেকে সৃষ্টি করেছেন।
৩য় মন্ত্র।
যদেব তে কশ্চিদব্রবীত্তচ্ছৃণবামেতি
অব্রবীন্ম উদঙ্কঃ শৌল্বায়নঃ, প্রাণো বৈ ব্রহ্মেতি
যথা মাতৃমান্,পিতৃমান্, আচার্যবান্ ব্রুয়াৎ তথা তচ্ছৌল্বায়নোऽব্রবীৎ প্রাণো বৈ ব্রহ্মেতি, অপ্রাণতো হি কিং স্যাদিত্যব্রবীত্তু তে তস্যায়তনং প্রতিষ্ঠাং
ন মেऽব্রবীদিত্যেকপাদ্বা এতত্ সম্রাট্ ইতি
স বৈ নো ব্রুহি যাজ্ঞবল্ক্য
প্রাণ এবায়তনম্ আকাশঃ প্রতিষ্ঠাঃ, প্রিয়মিত্যেনদুপাসীত।
কা প্রিয়তা যাজ্ঞবল্ক্য
প্রাণ এব সম্রাডিতি হোবাচ প্রাণস্য বৈ সম্রাট্ কামায়াযাজ্যং যাযয়তি অপ্রতিগৃহ্যস্য প্রতিগৃহ্ণাতি অপি তত্র বধাশঙ্কং ভবতি যাং দিশমেতি প্রাণস্যৈব সম্রাট্ কামায় প্রাণো বৈ সম্রাট্ পরমং ব্রহ্ম নৈনং প্রাণো জহাতি, সর্ব্বাণ্যেনং ভূতান্যভিক্ষরন্তি দেবো ভূত্বা দেবানপ্যেতি য এবম্ বিদ্বানেতদুপাস্তে
হস্ত্যৃষভং সহস্রম্ দদামীতি হোবাচ জনকো বৈদেহঃ
স হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ, পিতা মেऽমন্যত নাননুশিষ্য হরেতেতি।
অন্বয় এবং অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যৎ এব তে (যা কিছু) কশ্চিৎ (কেহ) অব্রবীত্ (বলেছেন) তৎ (তা) শৃণবাম (শুনব)। ইতি।
(জনক বললেন)------অব্রবীৎ (বলেছিলেন) ম (আমাকে) উদঙ্কঃ শৌল্বায়নঃ (উদঙ্ক শৌল্বায়ন), প্রাণো বৈ (প্রাণ ই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------যথা (যেমন) মাতৃমান্ (মাতৃমান্) পিতৃমান্ (পিতৃমান্) আচার্যবান্ (আচার্যবান্) ব্রুয়াৎ (বলে থাকেন), তথা (সেই প্রকার) তৎ (তাহা) শৌল্বায়ন (শৌল্বায়ন) অব্রবীৎ (বলেছিলেন)----- প্রাণো বৈ (প্রাণ ই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি। অপ্রাণতো (প্রাণ বিহীন যে তার) হি কিং স্যাৎ (কিই বা থাকে!) । ইতি।
অব্রবীৎ (বলেছিলেন) তু (পরন্তু) তে (আপনাকে) ) তস্য (প্রাণ রূপ ব্রহ্মের) আয়তনং (আয়তন) (এবং) প্রতিষ্ঠাং (প্রতিষ্ঠা)?
(জনক বললেন)------ন (না) মে (আমাকে) অব্রবীত্ (বলেছিলেন)। ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------এক (একটি) পাৎ (পদ) বা (ই), এতৎ (ইহা) সম্রাট্ (সম্রাট্ )! ইতি ।
(জনক বললেন)------স (তাহা) বৈ (অবশ্যই) নো (আমাকে) ব্রুহি(বলুন) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------প্রাণ এব (প্রাণই) (ব্রহ্মের) আয়তনম্ (আয়তন) , আকাশঃ (আকাশ) প্রতিষ্ঠাঃ (প্রতিষ্ঠা); প্রিয়ম্ (প্রিয়), (ইতি) ইনি এনত্ ( এঁকে) (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)। কা (কি) প্রিয়তা (প্রিয়ত্ব / ভালবাসা) যাজ্ঞব্যল্ক্য (যাজ্ঞব্যল্ক্য)?
প্রাণ এব (প্রাণ ই) সম্রাট্ (সম্রাট্); ইতি হ (ইহাই) উবাচ (বললেন); প্রাণস্য বৈ (প্রাণের জন্যই) সম্রাট্ (সম্রাট্) কামায় (কামনা করে) অযাজ্যং (যাঁরা যজনার যোগ্য নন) (তাঁদের জন্য) যাযয়তি (যজনা করেন), অপ্রতিগৃহ্যস্য (যাঁর দান গ্রহণযোগ্য নয়) প্রতিগৃহ্ণাতি (তাঁর থেকেও গ্রহণ করেন), অপি(এমন কি)( যদি) তত্র (সেখানে) বধাশঙ্কং (বধ /মৃত্যুর আশঙ্কা) ভবতি (হয়) (তত্রাচ) যাং (যে) দিশম্ (দিকে) (সেই দিকে) এতি (যায়) প্রাণস্য (প্রাণের ) এব (জন্যই) সম্রাট্ (সম্রাট্ ) কামায় (কামনা করে), প্রাণো বৈ (প্রাণ) পরমং ( পরম ) ব্রহ্ম ( ব্রহ্ম ) ; ন (না) এনং (এঁকে) প্রাণো (প্রাণ) জহাতি (ত্যাগ করেন), সর্ব্বাণি (সকল) এনম্ (এঁর জন্য) ভূতানি (ভূত সকল/ জীব সকল) অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন), দেব (দেব/ দেবতা) ভূত্বা (হয়ে) দেবান্(দেবগণকে) অপ্যেতি (আপ্ত বা প্রাপ্ত হন), যঃ (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (বিদিত হয়ে) এতৎ (এই) উপাস্তে (উপাসনা করেন)।
হস্তি (হস্তি) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো)----- ইতি হ (এই ই) উবাচ (বললেন) জনকো (জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ)।
স হ (তাহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ(যাজ্ঞবল্ক্য), পিতা (পিতা) মে (আমার) অমন্যত (মনে করতেন) অননুশিষ্য (অনুশাসন / উপদেশ না দিয়ে), ন (না) হরেৎ (হরণ) ইতি।
অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যা কিছু, কেহ (অন্য কোন ঋষি) (আপনাকে) বলেছেন তা শুনব।
(জনক বললেন)-----আমাকে উদঙ্ক শৌল্বায়ন বলেছিলেন, প্রাণ ই ব্রহ্ম।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-------যেমন মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ বলে থাকেন, সেই প্রকার, তাহা শৌল্বায়ন বলেছিলেন----- প্রাণ ই ব্রহ্ম; প্রাণ বিহীন যে, তার কিই বা থাকে! পরন্তু আপনাকে কি তার (প্রাণ রূপ ব্রহ্মের ) আয়তন এবং প্রতিষ্ঠা কি, তা বলেছিলেন ?
(জনক বললেন)-----আমাকে বলেননি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ সম্রাট্! ইহা (প্রাণ) একটি পাদই । (সম্রাট্! প্রাণ, ব্রহ্মের ছয়টি পাদের মধ্যে একটি পাদ।)
(জনক বললেন)---যাজ্ঞব্যলক্য , তাহা অবশ্যই আমাকে বলুন। (যাজ্ঞবল্ক্য , প্রাণ নামক ব্রহ্মের এই পদের বিষয়ে আমাকে অবশ্যই বলুন।)
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-- প্রাণই (এই ব্রহ্মের একটি) আয়তন, আকাশ প্রতিষ্ঠা (আকাশে এই প্রাণ প্রতিষ্ঠিত); ইনি প্রিয়, (এঁকে) (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)।
(জনক বললেন)---প্রিয়ত্ব কি যাজ্ঞবল্ক্য?
প্রাণই সম্রাট্; ইহাই (যাজ্ঞবল্ক্য) বললেন; প্রাণের জন্যই সম্রাট্ কামনা করে, যিনি যজনার যোগ্য নন তাঁর জন্যও যজনা করেন, যাঁর দান গ্রহণযোগ্য নয়, তাঁর থেকেও গ্রহণ করেন; এমন কি যদি সেখানে (কোথাও) বধ (মৃত্যুর) আশঙ্কা হয় (তত্রাচ), যে দিকে (প্রাণের জন্য, প্রিয়ত্বের জন্য যেতে ইচ্ছা করে) (সেই দিকে) যায়; প্রাণের জন্যই সম্রাট্! (প্রাণ) পরম ব্রহ্ম; এঁকে (যিনি এই রকম জানেন), প্রাণ (তাঁকে) পরিত্যাগ করেন না, এঁর জন্য ভূত সকল (জীব সকল) অভিক্ষরণ করেন; দেবতা হয়ে দেবগণকে আপ্ত বা প্রাপ্ত হন যিনি এই ভাবে বিদিত হয়ে এই প্রকার উপাসনা করেন।
হস্তি (হস্তি) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো)---------ইতি হ (এই ই) উবাচ (বললেন) জনকো (জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ)।
যাজ্ঞবল্ক্য তাহাই বললেন, “আমার পিতা মনে করতেন অনুশাসন ( উপদেশ) না দিয়ে (সম্পূর্ণ না করে) হরণ (দক্ষিণা গ্রহণ) (অনুচিত) ইতি।
নিরুক্ত। (এই অংশে বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং অনুচ্ছেদের অর্থ এবং তাৎপর্য লিখিত হলো। উপরে ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশে যে সব অর্থ এবং ব্যাখ্যা উক্ত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই নিরুক্ত অংশে করা হয় নি।ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশের ২য় অংশ দ্রষ্টব্য।)
১। উদঙ্ক শৌল্বায়ন।
উদঙ্ক = উৎ + অঙ্ক। যিনি থাকলে সবাই থাকে এবং যিনি উঠে গেলে বা উৎক্রমণ করলে, তার সাথে সবাই উঠে যায় বা চলে যায়, তার নাম প্রাণ। আমাদের অঙ্কে করে ইনি উৎক্রমন করেন বলেন, এঁর নাম ‘উদঙ্ক' , এবং এই জন্য এই প্রাণকে অশ্বও বলা হয়।
শৌল্বায়ন শব্দটি শুল্ব এবং অয়ন থেকে হয়েছে। শুল্ব শব্দের একটি অর্থ ‘সূত্র'। বায়ু বা প্রাণই সূত্র।এই সূত্রের দ্বারাই আমাদের শরীরের অঙ্গ সকল পরস্পরের সাথে যুক্ত আছে, এই সূত্রই আমাদের স্নায়ু সকল, এই সূত্রের দ্বারাই বংশ বা পরম্পরা রচনা হয়, এই সূত্রের দ্বারাই বিশ্বের সবাই সবার সাথে যুক্ত, এই সূত্রের দ্বারাই জীব এক থেকে অন্যলোকে গতাগতি করে।
অয়ন অর্থে প্রাণের সংক্রমন বা গতি।
যিনি প্রাণের উৎক্রমণ, এবং প্রাণের অয়ন বা সংক্রমন থেকে যে সূত্র বা বায়ু জাত হয়ে সকল কিছুকে যুক্ত করে রেখেছেন তা জানেন তিনি উদঙ্ক শৌল্বায়ন।
২। প্রিয় বা প্রিয়তা।
কা (কি) প্রিয়তা (প্রিয়ত্ব / ভালবাসা) যাজ্ঞব্যল্ক্য (যাজ্ঞব্যল্ক্য)?
প্রাণ এব (প্রাণ ই) সম্রাট্ (সম্রাট্);
যিনি সবার আগে, সবার প্রথম, তিনি প্রাণ (প্র + অন)। যিনি দেখলে তবে আমরা দেখি, যিনি শুনলে তবে আমরা শুনি, যিনি জানলে তবে আমরা জানি, তিনি প্রাণ। যিনি এক হয়েও দ্বিতীয়, আবার যিনি নিজের দ্বিতীয়তাকে বা বিশ্বভূবনকে আত্মবোধে ধারণ করেছেন, তিনি প্রাণ। তাই ইনি প্রিয় এবং যা কিছু আমাদের ভাল লাগে বা প্রিয় বলে বোধ হয়, তাতে আমরা প্রাণের স্পর্শ পাই।
প্রিয় শব্দটি, প্রী ধাতু থেকে হয়েছে। প্রী ধাতুর অর্থ, প্রীত হওয়া, প্রীত করা, ইত্যাদি। প্রী = প্র + ঈ——যিনি প্র, প্রথম বা প্রাণ, তাঁর ‘ ঈ ‘ বা শক্তিত্ব বা কর্ম্মময়তা, ‘প্রী’ বা প্রিয়ত্বর দ্বারা মণ্ডিত। ঋষি এং দেবতারা এঁকে মুখ্যপ্রাণ বলে বন্দনা করেছেন। ইনি সবাইকে মৃত্যুর পরপারে নিয়ে যান।
৩। ন (না) এনং (এঁকে) প্রাণো (প্রাণ) জহাতি (ত্যাগ করেন):
এর অর্থ, এই যে এই প্রকার বিদ্বান, যিনি সকল কিছু যে প্রিয় তা প্রাণের জন্যই প্রিয় ইহা জানেন, প্রাণ তাঁকে পরিত্যাগ করেন না; অর্থাৎ প্রাণ যখন শরীর থেকে উৎক্রমণ করেন, ইনি সেই প্রাণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন এই রকম বোধ করেন না। এই প্রকার বিজ্ঞাতার অতি প্রিয়জনেরও যদি মৃত্যু হয়, তাহলে তিনি ব্যথিত হন না, কেননা ইনি জানেনে প্রাণের জন্যই সবাই প্রিয়।
৪তুর্থ মন্ত্র।
যদেব তে কশ্চিদব্রবীত্তচ্ছৃণবামেতি
অব্রবীন্মে বর্কুর্বার্ষ্ণঃ চক্ষুর্বৈ ব্রহ্মেতি
যথা মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ ব্রুয়াৎ তথা তদ্বাষ্ণোঃ অব্রবীচ্চক্ষুর্বৈ ব্রহ্মেতি অপশ্যতো হি কিং স্যাদিত্যব্রবীত্তু তে তস্যায়তনং প্রতিষ্ঠাং
ন মেऽব্রবীদিত্যেকপাদ্বা এতত্ সম্রাট্ ইতি
স বৈ নো ব্রুহি যাজ্ঞব্যলক্য
চক্ষুরেবায়তনম্ আকাশঃ প্রতিষ্ঠা সত্যমিত্যেতদুপাসীত
কা সত্যতা যাজ্ঞবল্ক্য
চক্ষুরেব সম্রাডিতি হোবাচ চক্ষুষা বৈ সম্রাট্ পশ্যন্তমাহুরদ্রাক্ষীরিতি স আহাদ্রাক্ষমিতি তৎ সত্যং ভবতি চক্ষুর্বৈ সম্রাট্ পরমং ব্রহ্ম নৈনং চক্ষুর্জহাতি সর্ব্বাণ্যেনং ভূতান্যভিক্ষরন্তি দেবো ভূত্বা দেবানপ্যেতি য এবম্ বিদ্বানেতদুপাস্তে
হস্ত্যৃষভং সহস্রম্ দদামীতি হোবাচ জনকো বৈদেহঃ
স হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্য পিতা মেऽমন্যত নাননুশিষ্য হরেতেতি।
অন্বয় এবং অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যৎ এব তে (যা কিছু) কশ্চিৎ (কেহ) অব্রবীত্ (বলেছেন) তৎ (তা) শৃণবাম (শুনব)। ইতি।
(জনক বললেন)------অব্রবীৎ (বলেছিলেন) মে (আমাকে) বর্কুর্বার্ষ্ণঃ (বর্কুর্বার্ষ্ণ), চক্ষুর্বৈ (চক্ষুই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যথা (যেমন) মাতৃমান্ (মাতৃমান্) পিতৃমান্ (পিতৃমান্) আচার্যবান্ (আচার্যবান্) ব্রুয়াৎ (বলে থাকেন), তথা (সেই প্রকার) তৎ (তাহা) বাষ্ণোঃ (বাষ্ণো) অব্রবীৎ (বলেছিলেন), চক্ষুঃ বৈ (চক্ষুই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি; অপশ্যতো (দৃষ্টিবিহীন যে তার) হি কিং স্যাৎ (কিই বা থাকে!) । ইতি। অব্রবীৎ (বলেছিলেন) তু (পরন্তু) তে (আপনাকে) ) তস্য (চক্ষু রূপ ব্রহ্মের) আয়তনং (আয়তন) (এবং) প্রতিষ্ঠাং (প্রতিষ্ঠা)?
(জনক বললেন)------ন (না) মে (আমাকে) অব্রবীৎ (বলেছিলেন)। ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ এক (একটি) পাৎ (পাদ) বা (ই), এতত্ (ইহা) সম্রাট্ (সম্রাট্ )। ইতি ।
স (তাহা) বৈ (অবশ্যই) নো (আমাকে) ব্রুহি(বলুন) যাজ্ঞবলক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ চক্ষুঃ এব (চক্ষুই) আয়তনম্ (আয়তন) , আকাশঃ (আকাশ) প্রতিষ্ঠাঃ (প্রতিষ্ঠা); সত্যম্ (সত্য), (ইতি) ইনি এনৎ ( এঁকে) (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)।
(জনক বললেন)------কা (কি) সত্যতা (সত্য) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)?
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ চক্ষুঃ এব (চক্ষুই) সম্রাট্ (সম্রাট্) ! ইতি হ (ইহাই) উবাচ (বললেন); চক্ষুষা বৈ (চক্ষুর দ্বারাই) সম্রাট্ ( সম্রাট্ ) পশ্যন্তম্ (যে দেখেছে) (তাকে) আহুঃ (বলা হয়) অদ্রাক্ষীঃ (দেখেছ কি?), ইতি (ইহা) ; স (সে) আহ (বলে) (হ্যাঁ) অদ্রাক্ষম্ (দেখেছি), ইতি (তাহলে) তৎ (তা) সত্যং (সত্য) ভবতি (হয়) (সত্য বলে গণ্য করা হয়)।
চক্ষুঃ বৈ (চক্ষুই) সম্রাট্ (সম্রাট্) পরমং (পরম) ব্রহ্ম ( ব্রহ্ম); ন (না) এনং(এঁকে) চক্ষুঃ (চক্ষু)/দর্শন শক্তি) জহাতি (ত্যাগ করেন); সর্ব্বাণি (সকল) এনম্ (এঁর জন্য) ভূতানি (ভূত সকল/ জীব সকল) অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন), দেব (দেব/ দেবতা) ভূত্বা (হয়ে) দেবান্(দেবগণকে) অপ্যেতি (আপ্ত বা প্রাপ্ত হন), যঃ (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (বিদিত হয়ে) এতৎ (এই) উপাস্তে (উপাসনা করেন)।
হস্তি (হস্তি) (এবং) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো)------- ইতি হ (এই ই) উবাচ (বললেন) জনকো (জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ স হ (তাহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ(যাজ্ঞবল্ক্য), পিতা (পিতা) মে (আমার) অমন্যত (মনে করতেন) অননুশিষ্য (অনুশাসন / উপদেশ না দিয়ে), ন (না) হরেৎ (হরণ) ইতি।
অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যা কিছু, কেহ (অন্য কোন ঋষি) (আপনাকে) বলেছেন তা শুনব।
(জনক বললেন)------আমাকে বর্কুর্বার্ষ্ণ বলেছিলেন, চক্ষুই ব্রহ্ম।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-------যেমন মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ বলে থাকেন, সেই প্রকার, তাহা বার্ষ্ণো বলেছিলেন----- চক্ষুই ব্রহ্ম; দৃষ্টিবিহীন যে, তার কিই বা থাকে! পরন্তু আপনাকে কি বলেছিলেন তার (চক্ষু রূপ ব্রহ্মের) আয়তন এবং প্রতিষ্ঠা কি?
(জনক বললেন)----------আমাকে বলেননি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------সম্রাট্, ইহা (চক্ষু) একটি পাদই । (সম্রাট্, চক্ষু, ব্রহ্মের অন্যান্য পাদের মধ্যে একটি পাদ।)
(জনক বললেন)---যাজ্ঞবল্ক্য , তাহা অবশ্যই আমাকে বলুন।(যাজ্ঞবল্ক্য,চক্ষু নামক ব্রহ্মের এই পাদের বিষয়ে আমাকে অবশ্যই বলুন। )
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ চক্ষুই আয়তন, আকাশ প্রতিষ্ঠা; ইনি সত্য, এঁকে (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)।
(জনক বললেন)------যাজ্ঞবল্ক্য, সত্য কি ?
চক্ষুই সম্রাট্ (সত্য) ! ইহাই (যাজ্ঞবল্ক্য)বললেন; চক্ষুর দ্বারাই সম্রাট্ যে দেখেছে তাকে বলা হয় 'দেখেছ কি?', সে (যদি) বলে 'হ্যাঁ দেখেছি', তাহলে তা সত্য হয় (সত্য বলে গণ্য করা হয়)।
চক্ষুই সম্রাট্ পরম ব্রহ্ম; এঁকে চক্ষু (দর্শন শক্তি) ত্যাগ করেন না; এঁর জন্য ভূত সকল (জীব সকল) অভিক্ষরণ করেন; দেবতা হয়ে দেবগণকে আপ্ত বা প্রাপ্ত হন যিনি এই ভাবে বিদিত হয়ে এই প্রকার উপাসনা করেন।
সহস্র হস্তি (এবং) ঋষভ দান করছি-------- ইহাই বললেন জনক-বৈদেহ।
যাজ্ঞবল্ক্য তাহাই বললেন, “ আমার পিতা মনে করতেন অনুশাসন (উপদেশ) না দিয়ে (সম্পূর্ণ না করে) হরণ (দক্ষিণা গ্রহণ) (অনুচিত) ইতি।
নিরুক্ত। (এই অংশে বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং অনুচ্ছেদের অর্থ এবং তাৎপর্য লিখিত হলো। উপরে ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশে যে সব অর্থ এবং ব্যাখ্যা উক্ত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই নিরুক্ত অংশে করা হয় নি। ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশের ৩য় অংশ দ্রষ্টব্য।)
১। চক্ষু এবং সত্য।
চক্ষু শব্দটি চক্ষ্ ধাতু থেকে হয়েছে। চক্ষ্ ধাতুর অর্থ ‘দৃশ্যমান হওয়া বা রূপ প্রকাশ করা’, আবার ‘দেখা বা দর্শন করা’।
রূপ প্রকাশ এবং সেই প্রকাশিত রূপকে দেখা বা ভোগ করার যে কেন্দ্র, তা চক্ষু। তাই উপনিষদে ঋষি বলেছেন যে যিনি অক্ষিগত পুরুষ, তিনি ‘ইন্ধ' বা প্রকাশময় এবং ‘ইন্দ্র’, অর্থাৎ যা কিছু ‘ইদং' পদবাচ্য তার দ্রষ্টা।(বৃহদারণ্যক ৪। ২। ২।) যা কিছু ইহ বা ইদং, যা কিছু আমরা ‘এটা মাটি, এটা জল ‘ ইত্যাদি বলে দেখছি বা অনুভব করছি তা সত্য; তা ঐ স্বয়ংপ্রকাশ যে পুরুষ, যিনি ইন্ধ, তিনিই, সেই প্রকাশ গুলিকে ইন্দ্র হয়ে দর্শন বা ভোগ করছেন।
প্রাণ থেকে যা প্রকাশ পায় তা সত্য। প্রাণের প্রকাশবান্ কেন্দ্রের নাম চক্ষু। প্রাণ বা প্রাণময় মানেই তাতে দেখা বা দর্শন আছে। (আমাদের বিবাহে যে শুভ দৃষ্টি হয়, তা এই প্রাণকেই দেখে প্রিয়ত্ব কে উদবুদ্ধ করার একটি পদ্ধতি।)
প্রাণের এই দৃষ্টি থেকে সত্যের প্রকাশকে লক্ষ করে ঋষি বৃহদারণ্যকে বলেছেন——
তৎ এতৎ অমৃতং সত্যেন ছন্নম্। (সেই এই অমৃত সত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন। )
প্রাণো বা অমৃতং নামরূপে সত্যং তাভ্যাময়ং প্রাণশ্ছন্নঃ। (প্রাণই অমৃত; নাম ও রূপ সত্য; তাদের [নাম ও রূপের] দ্বারা
প্রাণ আচ্ছাদিত। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১। ৬। ৩। )
এই যে প্রাণের দৃষ্টি থেকে নামরূপময় বিশ্ব প্রকাশ পেয়েছে, তা সত্য এবং এই নামরূপময় বিশ্ব অমৃতময় প্রাণকে আচ্ছাদন করে রেখেছে। (ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি আমার সত্যরূপ প্রথম করেছ সৃষ্টি—শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ) এই জন্য যা আমরা দেখি তাকে আমরা সত্য বলে স্বীকার করি।
২। বর্কুর্বার্ষ্ণ।
অর্ক বা আত্ম অর্চি, নিজের থেকে ব্যক্ত হয়ে, নিজেকে দ্বিতীয় করে যে রূপ সকল প্রকাশ করছেন, তা বর্ক। আর সেই বর্কের যে ঊষ্মা বা উষ্ণতা, তা প্রাণের রূপময় প্রকাশগুলির প্রাণময়তা এবং তা বার্ষ্ণ। এই প্রাণই চক্ষু, বিশ্বচক্ষু, এবং ইনি সবাইকে উষ্ণ করেছেন। ইনি আছেন বলেই আমরা উষ্ণ। এই চক্ষুকে যিনি জানেন, তিনি বর্কুর্বার্ষ্ণ বা বার্ষ্ণ বংশীয় বর্কু।
৫ম মন্ত্র।
যদেব তে কশ্চিদব্রবীত্তচ্ছৃণবামেতি
অব্রবীন্মে গর্দভীবিপীতো ভারদ্বাজঃ শ্রোত্রং বৈ ব্রহ্মেতি
যথা মাতৃমান্ পিতৃমান্, আচার্যবান্ ব্রুয়াৎ, তথা তদ্ভারদ্বাজোऽব্রবীচ্ছ্রোত্রং বৈ ব্রহ্মেতি অশৃণ্বতো হি কিং স্যাদিত্যব্রবীত্তু তে তস্যায়তনং প্রতিষ্ঠাং
ন মেऽব্রবীদিত্যেকপাদ্বা এতৎ সম্রাট্ ইতি
স বৈ নো ব্রুহি যাজ্ঞবল্ক্য
শ্রোত্রমেবায়তনম্ আকাশঃ প্রতিষ্ঠানন্ত ইত্যেনদুপাসীত
কানন্ততা যাজ্ঞবল্ক্য
দিশ এব সম্রাডিতি হোবাচ তস্মাদ্বৈ সম্রাডপি যাং কাং চ দিশং গচ্ছতি নৈবাস্যা অন্তং গচ্ছতি অনন্তা হি দিশো দিশো বৈ সম্রাট্ শ্রোত্রম্ শ্রোত্রং বৈ সম্রাট্ পরমং ব্রহ্ম নৈনং শ্রোত্রং জহাতি সর্ব্বাণ্যেনং ভূতান্যভিক্ষরন্তি, দেবো ভূত্বা দেবানপ্যেতি, য এবম্ বিদ্বানেতদুপাস্তে
হস্ত্যৃষভং সহস্রম্ দদামীতি হোবাচ জনকো বৈদেহঃ
স হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ, পিতা মেऽমন্যত নাননুশিষ্য হরেতেতি।
অন্বয় এবং অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যৎ এব তে (যা কিছু) কশ্চিৎ (কেহ) অব্রবীৎ (বলেছেন) তৎ (তা) শৃণবাম (শুনব)। ইতি।
(জনক বললেন)------অব্রবীৎ (বলেছিলেন) মে (আমাকে) গর্দভীবিপীতো ভারদ্বাজঃ (গর্দভীবিপীতো ভারদ্বাজ), শ্রোত্রং বৈ (শ্রোত্রই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যথা (যেমন) মাতৃমান্ (মাতৃমান্) পিতৃমান্ (পিতৃমান্) আচার্যবান্ (আচার্যবান্) ব্রুয়াৎ (বলে থাকেন), তথা (সেই প্রকার) তৎ (তাহা) ভারদ্বাজঃ (ভারদ্বাজ) অব্রবীৎ (বলেছিলেন) শ্রোত্রং বৈ (শ্রোত্রই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি; অশৃণ্বতো (শ্রুতিবিহীন যে, তার) হি কিং স্যাৎ (কিই বা থাকে!) । ইতি। অব্রবীৎ (বলেছিলেন) তু (পরন্তু) তে (আপনাকে) ) তস্য (তার/শ্রোত্রের) আয়তনং (আয়তন) (এবং) প্রতিষ্ঠাং (প্রতিষ্ঠা)?
(জনক বললেন)------ন (না) মে (আমাকে) অব্রবীৎ (বলেছিলেন)। ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ এক (একটি) পাৎ (পদ) বা (ই), এতৎ (ইহা) সম্রাট্ (সম্রাট্ )! ইতি ।
(জনক বললেন)------স (তাহা) বৈ (অবশ্যই) নো (আমাকে) ব্রুহি(বলুন) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ শ্রোত্রম্ এব (শ্রোত্রই) আয়তনম্ (আয়তন), আকাশঃ (আকাশ) প্রতিষ্ঠাঃ (প্রতিষ্ঠা); অনন্ত (অনন্ত), ইতি (ইনি) এনদ্ (এঁকে) (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)।
(জনক বললেন)------কা অনন্ততা (আনন্ত্য কি) যাজ্ঞবল্ক্য?
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)----দিশ এব (দিক্ ই) সম্রাট্ (সম্রাট্), ইতি হ (ইহাই) উবাচ (বললেন)।
তস্মাৎ বৈ (সেই জন্যই) সম্রাট্ (সম্রাট্) অপি (যদি) যাং কাং চ(যে কোনো) দিশং (দিকেই) গচ্ছতি (গমন করে) ন (না) এব (এই জন্য) অস্য ( এর/দিকের) অন্তং (অন্তে) গচ্ছতি (গমন করে); অনন্তা (অনন্ত) হি (অবশ্যই) দিশোঃ (দিক্ সকল);দিশো বৈ ( দিক্সকলই ) সম্রাট্ (সম্রাট্) শ্রোত্রম্ (শ্রোত্র), শ্রোত্রং বৈ (শ্রোত্রই) সম্রাট্ (সম্রাট্) পরমং (পরম) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ন (না) এনং (এনাকে) শ্রোত্রং (শ্রোত্র) জহাতি (ত্যাগ করেন); সর্ব্বাণি (সকল) এনম্ (এঁর জন্য) ভূতানি (ভূত সকল/ জীব সকল) অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন), দেব (দেব/ দেবতা) ভূত্বা (হয়ে) দেবান্(দেবগণকে) অপ্যেতি (আপ্ত বা প্রাপ্ত হন), যঃ (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (বিদিত হয়ে) এতৎ (এই) উপাস্তে (উপাসনা করেন)।
(জনক বললেন)------হস্তি (হস্তি) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো)--------- ইতি হ (এই ই) উবাচ (বললেন) জনকো (জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ স হ (তাহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ(যাজ্ঞবল্ক্য), পিতা (পিতা) মে (আমার) অমন্যত (মনে করতেন) অননুশিষ্য (অনুশাসন / উপদেশ না দিয়ে), ন (না) হরেৎ (হরণ) ইতি।
অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যা কিছু, কেহ (অন্য কোন ঋষি) (আপনাকে) বলেছেন তা শুনব।
(জনক বললেন)------আমাকে গর্দভীবিপীতো ভারদ্বাজ বলেছিলেন, শ্রোত্রই ব্রহ্ম।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যেমন মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ বলে থাকেন, সেই প্রকার তাহা ভারদ্বাজ বলেছিলেন শ্রোত্রই ব্রহ্ম; শ্রুতিবিহীন যে, তার কিই বা থাকে! পরন্তু আপনাকে বলেছিলেন যে কি, তার (শ্রোত্রের) আয়তন এবং প্রতিষ্ঠা কি?
(জনক বললেন)--------আমাকে বলেননি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------- সম্রাট্! শ্রোত্র একটি পাদই । (সম্রাট্! শ্রোত্র, ব্রহ্মের অন্যান্য পাদের মধ্যে একটি পাদ।)
(জনক বললেন)---যাজ্ঞবলক্য , তাহা অবশ্যই আমাকে বলুন।( যাজ্ঞবলক্য,শ্রোত্র নামক ব্রহ্মের এই পাদের বিষয়ে আমাকে অবশ্যই বলুন।)
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ শ্রোত্রই (ব্রহ্মের) আয়তন, আকাশ (শ্রোত্রের) প্রতিষ্ঠা; অনন্ত ইনি, এঁকে (এই ভাবে) উপাসনা করনীয়।
(জনক বললেন)------আনন্ত্য কি যাজ্ঞবল্ক্য?
দিক্ই সম্রাট্, (যাজ্ঞব্যল্ক্য) ইহাই বললেন।
সেই জন্যই সম্রাট্ যদি যে কোনো দিকেই (কেহ) গমন করে, এর(দিকের) অন্তে বা শেষে গমন করতে পারে না; দিক্ সকল অবশ্যই অনন্ত; দিক্ সকলই সম্রাট্ শ্রোত্র; শ্রোত্রই সম্রাট্ পরম ব্রহ্ম; এনাকে শ্রোত্র ত্যাগ করেন না; এঁর জন্য ভূত সকল/ জীব সকল অভিক্ষরণ করেন; দেবতা হয়ে দেবগণকে আপ্ত বা প্রাপ্ত হন যিনি এই ভাবে বিদিত হয়ে এই প্রকার উপাসনা করেন।
(জনক বললেন)-------সহস্র হস্তি ঋষভ দান করছি-------- ইহাই বললেন জনক-বৈদেহ।
যাজ্ঞবল্ক্য তাহাই বললেন, “ আমার পিতা মনে করতেন অনুশাসন (উপদেশ) না দিয়ে (সম্পূর্ণ না করে) হরণ (দক্ষিণা গ্রহণ) (অনুচিত) ইতি।
নিরুক্ত। (এই অংশে বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং অনুচ্ছেদের অর্থ এবং তাৎপর্য লিখিত হলো। উপরে ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশে যে সব অর্থ এবং ব্যাখ্যা উক্ত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই নিরুক্ত অংশে করা হয় নি। ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশের ৪র্থ অংশ দ্রষ্টব্য।)
১। গর্দভীবিপীতো ভারদ্বাজ।
যেমন নর্দ মানে আনন্দয় নাদ বা ধ্বনি। সেই রকম, গর্দ মানে সম্বেদন হীন, অর্থ-শূন্য ধ্বনি। গর্ত এবং গর্দ এই দুইটি সংস্কৃত শব্দ সম্বন্ধ যুক্ত। গর্দ অর্থে যে শব্দ আপাত ভাবে অর্থহীন, যা ‘গর্ত বা শূন্যতাময়। যে পশুকে গর্দভ বলা হয়, তার ব্যবহারও অনেক সময়ই ভাব-লেশ হীন। সে যে শব্দ করে, তার মধ্যে ‘হ' এই শব্দের প্রাধান্য আছে। ‘হ' অর্থে 'শূন্য বা আকাশ', যেখানে সব কিছুকে হনন বা নাস্তি করা হয়েছে। তাই গর্দভী অর্থে সেই বাক্শক্তি, বা বাকের সেই বৈশিষ্ট যার দ্বারা বাক্য স্থূল বা অচেতনতার দ্বারা মণ্ডিত। তাই বাকের এক নাম ‘বৈখরী’ এবং খর শব্দের একটি অর্থ ‘গর্দভ'।
বিপীতো শব্দটি বিপীত শব্দের রূপ। বিপীত = বি + পীত——সম্পূর্ণ ভাবে যার দ্বারা পীত হয়েছে বা যে পান করেছে। গর্দভীবিপীত শব্দের অর্থ, যিনি যে শব্দের অর্থ নেই তাকেও পান করতে পারেন বা শুনতে পারেন, সেই অর্থহীন শব্দের অন্তরে যে বেদ বা শ্রুতি রয়েছেন তাকে জানেন; সেই শব্দের মধ্যে যে অর্থ বা সোম প্রবাহিত হচ্ছে, সেই শব্দ আত্মস্বরূপ বাকের যে দেবময় প্রকাশ তাকে প্রত্যক্ষ করেন।
এই প্রসঙ্গে, বৃহদারণকের এই উক্তিটি উল্লিখিত হলো——যঃ কশ্চ শব্দো বাগেব সৈষা হি অন্বায়ত্তা এষা হি ন——যা কিছু শব্দ, তা অবশ্যই বাক্; এই (বাক্) অন্ত-আয়ত্তা (অর্থাৎ বাকের বা শব্দের যা অন্ত বা মূল তার প্রকাশক) (আবার) এই বাক্ তার অপ্রকাশক। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১। ৫। ৩।)। শব্দের অর্থ, শব্দের আনন্ত্য বা দেবময় প্রকাশ এবং শব্দের মূল যিনি আত্মা বা আত্মশক্তি (বাক্), তা বাক্ (কারোর কাছে) প্রকাশ করেন এবং (কারোর কাছে) (প্রকাশ) করেনও না।
ভারদ্বাজ।
ভারদ্বাজ শব্দটি ভরদ্বাজ শব্দ থেকে হয়েছে। ভারদ্বাজ অর্থে যিনি ভরদ্বাজের সাথে সম্বন্ধ যুক্ত বা যিনি ভরদ্বাজ বংশীয়।
ভরদ্বাজ------ভরৎ + বাজ; ভরৎ——যিনি ভরণ করছেন; বাজ——জায়মান বাক্।
ভরদ্বাজ——যিনি জায়মান বাক্ কে ভরণ করছেন অথবা যিনি দর্শন করছেন যে বাক্ই (শব্দাত্মিকা চিন্ময়ী) অন্তর ও বাহিরে সর্ব্বাকারে জাত হচ্ছেন।
৬ষ্ঠ মন্ত্র।
যদেব তে কশ্চিদব্রবীত্তচ্ছৃণবামেতি
অব্রবীন্মে সত্যকামো জাবালো মনো বৈ ব্রহ্মেতি
যথা মাতৃমান্,পিতৃমান্ আচার্যবান্ ব্রুয়াৎ তথা তজ্জাবালোऽব্রবীন্মনো বৈ ব্রহ্মেতি অমনসো হি কিং স্যাদিত্যব্রবীত্তু তে তস্যায়তনং প্রতিষ্ঠাং
ন মেऽব্রবীদিত্যেকপাদ্বা এতত্ৎ সম্রাট্ ইতি
স বৈ নো ব্রুহি যাজ্ঞব্যল্ক্য
মন এবায়তনম্ আকাশঃ প্রস্তিষ্ঠাঃ আনন্দ ইত্যেনদুপাসীত
কানন্দতা যাজ্ঞবল্ক্য?
মন এব সম্রাডিতি হোবাচ মনসা বৈ সম্রাট্ স্ত্রিয়মভিহার্যতে, তস্যাং প্রতিরূপঃ পুত্রো জায়তে,স আনন্দো মনো বৈ সম্রাট্ পরমং ব্রহ্ম নৈনং মনো জহাতি সর্ব্বাণ্যেনং ভূতান্যভিক্ষরন্তি দেবো ভূত্বা দেবানপ্যেতি যঃ এবম্ বিদ্বানেতদুপাস্তে
হস্ত্যৃষভং সহস্রম্ দদামীতি হোবাচ জনকো বৈদেহঃ
স হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ পিতা মেऽমন্যত নাননুশিষ্য হরেতেতি।
অন্বয় এবং অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যৎ এব তে (যা কিছু) কশ্চিৎ (কেহ) অব্রবীত্ (বলেছেন) তৎ (তা) শৃণবাম (শুনব)। ইতি।
(জনক বললেন)------অব্রবীৎ (বলেছিলেন) মে (আমাকে) সত্যকামো জাবালঃ (সত্যকাম জাবাল) মনো বৈ (মনই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম), ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যথা (যেমন) মাতৃমান্ (মাতৃমান্) পিতৃমান্ (পিতৃমান্) আচার্যবান্ (আচার্যবান্) ব্রুয়াৎ (বলে থাকেন) তথা (সেই প্রকার) তৎ (তাহা) জাবালঃ (ভারদ্বাজ) অব্রবীৎ (বলেছিলেন) মনো বৈ (মনই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি; অমনসো ( মন বা সঙ্কল্প বিহীন যে, তার) হি কিং স্যাৎ (কিই বা থাকে!) । ইতি। অব্রবীৎ (বলেছিলেন) তু (পরন্তু) তে (আপনাকে) তস্য (তার/মনের) আয়তনং (আয়তন) (এবং) প্রতিষ্ঠাং (প্রতিষ্ঠা)?
(জনক বললেন)------ন (না) মে (আমাকে) অব্রবীৎ (বলেছিলেন)। ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ এক (একটি) পাৎ (পাদ) বা (ই), এতত্ (ইহা) সম্রাট্ (সম্রাট্ )! ইতি ।
(জনক বললেন)------স (তাহা) বৈ (অবশ্যই) নো (আমাকে) ব্রুহি(বলুন) যাজ্ঞবলক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ মন এব (মনই) আয়তনম্ (আয়তন), আকাশঃ (আকাশ) প্রতিষ্ঠাঃ (প্রতিষ্ঠা); আনন্দ ইতি এনৎ (এঁকে এই ভাবে) উপাসীত (উপাসনা করণীয়)।
(জনক বললেন) ------কা (কি) আনন্দতা (আনন্দ) যাজ্ঞবল্ক্য? ( যাজ্ঞবল্ক্য আনন্দ কি?)
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ মন এব (মনই এই ) (আনন্দ) সম্রাট্ ( সম্রাট্ ), ইতি হ (ইহাই) উবাচ ((বললেন); মনসা বৈ (মনের দ্বারাই/সঙ্কল্পের দ্বারাই) সম্রাট্ (সম্রাট্) স্ত্রিয়ম্ (স্ত্রীকে,বা যে শক্তি কাম বা যা কাম্য তা প্রদান করেন তাঁকে) অভিহার্যতে (অভি-হরণ করেন); তস্যাং (তার) প্রতিরূপঃ (প্রতিরূপ) পুত্রো (পুত্র) জায়তে (জাত হয়); স (সে-- সেই পুত্রই আনন্দ); মনো বৈ (মনই) সম্রাট্ (সম্রাট) পরমং (পরম) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ন (না) এনং (এনাকে) মনো (মন) জহাতি (ত্যাগ করে); সর্ব্বাণি (সকল) এনম্ (এঁর জন্য) ভূতানি (ভূত সকল/ জীব সকল) অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন), দেব (দেব/ দেবতা) ভূত্বা (হয়ে) দেবান্(দেবগণকে) অপ্যেতি (আপ্ত বা প্রাপ্ত হন), যঃ (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (বিদিত হয়ে) এতৎ (এই) উপাস্তে (উপাসনা করেন)।
(জনক বললেন)------হস্তি (হস্তি) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো)—— ইতি হ (এই ই) উবাচ (বললেন) জনকো (জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ স হ (তাহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ(যাজ্ঞবল্ক্য), পিতা (পিতা) মে (আমার) অমন্যত (মনে করতেন) অননুশিষ্য (অনুশাসন / উপদেশ না দিয়ে), ন (না) হরেৎ (হরণ) ইতি।
অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যা কিছু, কেহ (অন্য কোন ঋষি) (আপনাকে) বলেছেন তা শুনব।
(জনক বললেন)-------আমাকে সত্যকাম জাবাল বলেছিলেন মনই ব্রহ্ম।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যেমন মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ বলে থাকেন, সেই প্রকার তাহা ভারদ্বাজ বলেছিলেন মনই ব্রহ্ম; মন বা সঙ্কল্প বিহীন যে, তার কিই বা থকে!। পরন্তু আপনাকে কি বলেছিলেন তার/মনের আয়তন (এবং) প্রতিষ্ঠা?
(জনক বললেন)———আমাকে বলেননি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)-- সম্রাট্! ইহা (মন) একটি পাদই । (সম্রাট্! মন, ব্রহ্মের অন্যান্য পাদের মধ্যে একটি পাদ।)
(জনক বললেন)---যাজ্ঞবল্ক্য , তাহা অবশ্যই আমাকে বলুন।( যাজ্ঞবল্ক্য,মন নামক ব্রহ্মের এই পাদের বিষয়ে আমাকে অবশ্যই বলুন।)
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ মনই আয়তন, আকাশ প্রতিষ্ঠা; ইনি আনন্দ এঁকে এই ভাবে উপাসনা করণীয়।
(জনক বললেন)--------- যাজ্ঞবল্ক্য আনন্দ কি?
মনই এই (আনন্দ) সম্রাট্; ইহাই (যাজ্ঞবল্ক্য)বললেন; মনের দ্বারাই (সঙ্কল্পের দ্বারাই) সম্রাট্ স্ত্রীকে [অর্থাৎ] যে শক্তি কাম বা যা কাম্য তা প্রদান করেন তাঁকে) অভি-হরণ করেন (নিজেতে আহৃত করেন) , তার প্রতিরূপ পুত্র জাত হয়; সে---- সেই পুত্রই আনন্দ।
মনই সম্রাট পরম ব্রহ্ম; এনাকে মন ত্যাগ করেন না; এঁর জন্য ভূত সকল (জীব) সকল অভিক্ষরণ করেন; দেবতা হয়ে দেবগণকে আপ্ত বা প্রাপ্ত হন, যিনি এই ভাবে বিদিত হয়ে এই প্রকার উপাসনা করেন।
সহস্র হস্তি ঋষভ দান করছি-------- ইহাই বললেন জনক-বৈদেহ।
যাজ্ঞবল্ক্য তাহাই বললেন, “ আমার পিতা মনে করতেন অনুশাসন ( উপদেশ) না দিয়ে (সম্পূর্ণ না করে) হরণ (দক্ষিণা গ্রহণ) (অনুচিত) ইতি।
নিরুক্ত। (এই অংশে বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং অনুচ্ছেদের অর্থ এবং তাৎপর্য লিখিত হলো। উপরে ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশে যে সব অর্থ এবং ব্যাখ্যা উক্ত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই নিরুক্ত অংশে করা হয় নি। ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশের ৫ম অংশ দ্রষ্টব্য।)
১। (জনক বললেন) ------ কা (কি) আনন্দতা (আনন্দ) যাজ্ঞবল্ক্য? ( যাজ্ঞবল্ক্য আনন্দ কি?)
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ মন এব (মনই এই ) (আনন্দ) সম্রাট্ ( সম্রাট্ ), ইতি হ (ইহাই) উবাচ ((বললেন); মনসা বৈ (মনের দ্বারাই/সঙ্কল্পের দ্বারাই) সম্রাট্ (সম্রাট্) স্ত্রিয়ম্ (স্ত্রীকে,বা যে শক্তি কাম বা যা কাম্য তা প্রদান করেন তাঁকে) অভিহার্যতে (অভি-হরণ করেন), তস্যাং (তার) প্রতিরূপঃ (প্রতিরূপ) পুত্রো (পুত্র) জায়তে (জাত হয়); স (সে-- সেই পুত্রই আনন্দ)….
উপড়ে ব্রহ্মখণ্ড বা সারাংশে বলা হয়েছে যে মন ও বাকের মিথুনে প্রাণ বা ইন্দ্র জাত হয়েছেন।এই দৈব মন যা কিছু সঙ্কল্প করেন, সেই ভাবেই আত্মশক্তি বাকের সাথে মিলিত হয়ে তাকে সৃষ্টি করেন। যা কিছু সৃষ্টি হয় তা এই সঙ্কল্পময় আত্মারই নূতন হয়ে, দ্বিতীয় হয়ে প্রকাশ, তাঁরই প্রাণময় অভিব্যক্তি বা প্রাণ, তাঁরই প্রতিরূপ।
বাকের সাথে মিথুন রত এই যে মন, ইনি আনন্দ। এই আনন্দ থেকে সবাই জাত।
আবার এই মন, বাক্ ও প্রাণের যে মিথুন, যে মিথুন সবার পূর্ব্বে, তার থেকে জাত। তাই মনই আনন্দ।
২। পুত্র (পুত্রী)---------পুনরাবর্ত্তন থেকে যে ‘ত্র’ বা ‘ত্রাণ' করে, অর্থাৎ বার বার বাধ্যতামূলক জন্ম থেকে মৃত্যুতে এবং মৃত্যু থেকে জন্মতে যে গতাগতি, তার থেকে যে অব্যহতি পাওয়া, তাই পুনরাবর্ত্তন থেকে ত্রাণ। যে কোন অনুভূতি বা বোধপ্রকাশ যে আত্মপ্রকাশ, আত্মারই প্রতিরূপ (পুত্র) বা আত্মশক্তি বাক্ (পুত্রী / কন্যা), এই প্রজ্ঞার উদয়ে, দ্বিতীয়তা বোধ দূর হয়। দ্বিতীয়তা বোধ দূর হলে, মৃত্যু আর মৃত্যু থাকে না, তা হয়ে যায় মৃত্যু দেবতা, আত্মারই অব্যক্ত স্বরূপ বা অব্যক্তময় ব্যবহার।
৩। স্ত্রী--------সঃ (তিনি) + ত্রী (তিন)। এই আত্মাই বাক্, প্রাণ এবং মনের সমাসে সবাইকে নির্মাণ করেছেন। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ষষ্ঠ অধ্যায় তৃতীয় খণ্ড। )। এখানে স্ত্রী অর্থে আত্মশক্তি বাক্কেই উলেখ করা হয়েছে।
৪। অব্রবীৎ (বলেছিলেন) মে (আমাকে) সত্যকামো জাবালোঃ (সত্যকাম জাবাল) মনো বৈ (মনই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম), ইতি।
সত্যকাম জাবাল।
সত্যকাম--------যিনি যা কিছু কামনা করেন তা সত্য হয় বা সেই সেই কাম্যকে লাভ করেন। এই প্রসঙ্গে মুণ্ডকোপনিষদের এই মন্ত্রটি উক্ত হলো :
যং যং লোকং মনসা সংবিভাতি
(যে যে লোক মনের দ্বারা সঙ্কল্প করেন বা উদ্ভাসিত করেন)
বিশুদ্ধসত্ত্বঃ কাময়তে যাংশ্চ কামান্।
(বিশুদ্ধ সত্তা [যিনি] যা কিছু কামনা করেন। )
তং তং লোকং জয়তে তাংশ্চ কামান্
(সেই সেই লোক এবং কাম্য সকল জয় [ অর্জ্জন] করেন)
স্তস্মাদ্ আতজ্ঞং হ্যর্চয়েৎ ভূতিকামঃ। (মুণ্ডকোপনিষদ্ ৩। ১। ১০। )
(সেই হেতু যাঁরা বিভূতি [সম্পদ] কামী [তাঁরা]আত্মজ্ঞের [যাঁর সত্তা বিশুদ্ধ তাঁর] অবশ্যই অর্চ্চনা করবেন। )(মুণ্ডকোপনিষদ্ ৩। ১। ১০। )
জাবাল।
জাবাল শব্দটি ‘জবাল' শব্দ থেকে হয়েছে। একটি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ছিলেন জবাল শাখার অন্তর্গত।এঁরা মাতৃপরিচয় দিতেন। নিজের পরিচয় দিতে হলে এঁরা মার নামই করতেন। ছান্দোগ্য উপনিষদে সত্যকাম জাবালের আখ্যানে এই প্রকার পরিচয় জ্ঞাপন দেখা যায়। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, চতুর্থ অধ্যায়, চতুর্থ খণ্ড।)
আত্মশক্তি আত্মাকে বহু করে আবার সেই বহু বহু আত্ম-খণ্ড গুলিকে ভোগ দিচ্ছেন, স্বাতন্ত্র দিয়ে আলিঙ্গন করছেন, তার নাম ‘জবালা'। এই জন্য জবালা সত্যকামকে বলেছিলেন যে ‘আমি বহু পুরুষের পরিচর্যা করে যৌবনে তোমাকে পেয়েছি'। আর এই কথা শুনে সত্যকামের গুরু সত্যকামকে বলেছিলেন যে ‘অব্রাহ্মণ কখনো এই রকম বলতে পারে না’। প্রতি বোধ প্রকাশেই আমরা এক দ্বিতীয় পুরুষ বা সত্তা হয়ে জাত হচ্ছি, এবং সেই প্রতি পুরুষকে এই আত্ম শক্তি জবালা দর্শন,শ্রবণ ইত্যাদির ভোগ দিচ্ছেন, প্রাণময় করছেন।
আবার আমরা যে বহু জীবনের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ হচ্ছি, নিজের জীবনকে, কাল গতিকে যে ব্রহ্মের অয়ন বলে জানতে সক্ষম হচ্ছি, সেই বহু জীবনের জাতকদের দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ ইত্যাদি শক্তি হয়ে এই আত্মশক্তিই তাকে (তাদেরকে) জীবন দান করছেন এবং অভ্যুদয়ের পথে নিয়ে চলেছেন।
তাই বলা হলো-------" মনসা বৈ (মনের দ্বারাই/সঙ্কল্পের দ্বারাই) সম্রাট্ (সম্রাট্) স্ত্রিয়ম্ (স্ত্রীকে,বা যে শক্তি কাম বা যা কাম্য তা প্রদান করেন তাঁকে) অভিহার্যতে (অভি-হরণ করেন), তস্যাং (তার) প্রতিরূপঃ (প্রতিরূপ) পুত্রো (পুত্র) জায়তে (জাত হয়)।
তাই এই পাদের প্রবক্তা ‘সত্যকাম জাবাল'।
জবালা শব্দের একটি অর্থ হলো যাঁর থেকে ‘বল’ বা শক্তি’ জাত হয়। আর একটি অর্থ, যিনি ‘জ' অর্থাৎ ‘জন্ম' দিয়েও
‘বালা' বা ‘কুমারী’ থাকেন। এই জন্য আত্মা বা আত্মশক্তিকে ‘ অসঙ্গ / অসঙ্গা ' বলা হয়।
৭ম মন্ত্র।
যদেব তে কশ্চিদব্রবীত্তচ্ছৃণবামেতি
অব্রবীন্মে বিদগ্ধঃ শাকল্যো হৃদয়ং বৈ ব্রহ্মেতি
যথা মাতৃমান্,পিতৃমান্, আচার্যবান্ ব্রুয়াৎ, তথা তচ্ছাকল্যোऽব্রবীৎ হৃদয়ং বৈ ব্রহ্মেতি অহৃদয়স্য হি কিং স্যাদিত্যব্রবীত্তু তে তস্যায়তনং প্রতিষ্ঠাং
ন মেऽব্রবীদিত্যেকপাদ্বা এতত্ৎ সম্রাট্ ইতি
স বৈ নো ব্রুহি যাজ্ঞব্যলক্য
হৃদয়মেবায়তনম্, আকাশঃ প্রতিষ্ঠা, স্থিতিরিত্যেনদুপাসীত
কা স্থিততা যাজ্ঞবল্ক্য
হৃদয়মেব সম্রাডিতি হোবাচ হৃদয়ং বৈ সম্রাট্ সর্বেষাং ভূতানাং প্রতিষ্ঠা হৃদয়ে হ্যেব সম্রাট্ সর্ব্বাণি ভূতানি প্রতিষ্ঠিতানি ভবন্তি হৃদয়ং বৈ সম্রাট্ পরমং ব্রহ্ম নৈনং হৃদয়ং জহাতি সর্ব্বাণ্যেনং ভূতান্যভিক্ষরন্তি দেবো ভূত্বা দেবানপ্যেতি য: এবম্ বিদ্বানেতদুপাস্তে
হস্ত্যৃষভং সহস্রম্ দদামীতি হোবাচ জনকো বৈদেহঃ।
স হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্য, পিতা মেऽমন্যত নাননুশিষ্য হরেতেতি।
অন্বয় এবং অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যৎ এব তে (যা কিছু) কশ্চিৎ (কেহ) অব্রবীৎ (বলেছেন) তৎ (তা) শৃণবাম (শুনব)। ইতি।
(জনক বললেন)------অব্রবীৎ (বলেছিলেন) মে (আমাকে) বিদগ্ধঃ শাকল্যোঃ (বিদগ্ধ শাকল্য) হৃদয়ং বৈ (হৃদয়ই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম), ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যথা (যেমন) মাতৃমান্ (মাতৃমান্) পিতৃমান্ (পিতৃমান্) আচার্যবান্ (আচার্যবান্) ব্রুয়াৎ (বলে থাকেন), তথা (সেই প্রকার) তৎ (তাহা) শাকল্যঃ (শাকল্য) অব্রবীৎ (বলেছিলেন) হৃদয়ং বৈ (হৃদয়ই) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম); ইতি; অহৃদয়স্য ( হৃদয়হীন যে, তার) হি কিং স্যাৎ (কিই বা থাকে!) । ইতি। অব্রবীৎ (বলেছিলেন) তু (পরন্তু) তে (আপনাকে) তস্য (তার/হৃদয়ের) আয়তনং (আয়তন) (এবং) প্রতিষ্ঠাং (প্রতিষ্ঠা)?
(জনক বললেন)------ন (না) মে (আমাকে) অব্রবীৎ (বলেছিলেন)। ইতি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ এক (একটি) পাৎ (পাদ) বা (ই), এতৎ (ইহা) সম্রাট্ (সম্রাট্ )। ইতি ।
(জনক বললেন)------স (তাহা) বৈ (অবশ্যই) নো (আমাকে) ব্রুহি(বলুন) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)----- হৃদয়ম্ এব (হৃদয়ই) আয়তনম্ (আয়তন), আকাশঃ (আকাশ) প্রতিষ্ঠাঃ (প্রতিষ্ঠা); স্থিতিঃ (স্থিতি) ইতি (ইনি) এনদ্ (এঁকে) (এই ভাবে) উপাসীত (উপাস্য)।
(জনক বললেন)------কা স্থিতিতা (স্থিতি কি) যাজ্ঞবল্ক্য?
হৃদয়ম্ এব (হৃদয়ই) সম্রাট্ (সম্রাট্), ইতি হ (ইহাই) উবাচ (যাজ্ঞবল্ক্য)বললেন)।
হৃদয়ম্ বৈ ( হৃদয় অবশ্যই) সম্রাট্ (সম্রাট্) সর্ব্বেষাং (সর্ব্ব) ভূতানাং (ভূতের) আয়তনম্ (আয়তন), হৃদয়ম্ বৈ ( হৃদয় অবশ্যই) সম্রাট্ (সম্রাট্) সর্ব্বেষাং (সর্ব্ব) ভূতানাং (ভূতের) প্রতিষ্ঠা (প্রতিষ্ঠা), হৃদয়ে হি (হৃদয়েই) এব (এই ভাবে) সম্রাট্ ( সম্রাট্ ) সর্ব্বাণি (সর্ব্ব) ভূতানি ( ভুত) প্রতিষ্ঠিতানি (প্রতিষ্ঠিত) ভবন্তি (হয়) , হৃদয়ং বৈ (হৃদয়ই) সম্রাট্ (সম্রাট) পরমং (পরম) ব্রহ্ম ( ব্রহ্ম); ন (না) এনং (এঁকে) হৃদয়ং (হৃদয়) জহাতি (ত্যাগ করেন);
সর্ব্বাণি (সকল) এনম্ (এঁর জন্য) ভূতানি (ভূত সকল/ জীব সকল) অভিক্ষরন্তি (অভিক্ষরণ করেন), দেব (দেব/ দেবতা) ভূত্বা (হয়ে) দেবান্(দেবগণকে) অপ্যেতি (আপ্ত বা প্রাপ্ত হন), য (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (বিদিত হয়ে) এতৎ (এই) উপাস্তে (উপাসনা করেন)।
(জনক বললেন)------হস্তি (হস্তি) (এবং) ঋষভং (ঋষভ) সহস্রম্ (সহস্র) দদামি (দান করবো)--------- ইতি হ (এই ই) উবাচ (বললেন) জনকো (জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ)।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ স হ (তাহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ(যাজ্ঞবল্ক্য), পিতা (পিতা) মে (আমার) অমন্যত (মনে করতেন) অননুশিষ্য (অনুশাসন / উপদেশ না দিয়ে), ন (না) হরেৎ (হরণ) ইতি।
অর্থ।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যা কিছু, কেহ (অন্য কোন ঋষি) (আপনাকে) বলেছেন তা শুনব।
(জনক বললেন)——আমাকে বিদগ্ধ শাকল্য বলেছিলেন হৃদয়ই ব্রহ্ম।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ যেমন মাতৃমান্ পিতৃমান্ আচার্যবান্ বলে থাকেন, সেই প্রকার তাহা শাকল্য বলেছিলেন হৃদয়ই ব্রহ্ম ইতি। হৃদয়হীন যে, তার কিই বা থাকে! ইতি। পরন্তু আপনাকে কি বলেছিলেন তার (হৃদয় রূপ ব্রহ্মের) আয়তন (এবং) প্রতিষ্ঠা?
(জনক বললেন)------আমাকে বলেননি।
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------ সম্রাট্! ইহা (হৃদয়) একটি পাদই । (সম্রাট্! হৃদয়, ব্রহ্মের অন্যান্য পাদের মধ্যে একটি পাদ।)
(জনক বললেন)---যাজ্ঞবলক্য, তাহা অবশ্যই আমাকে বলুন।( যাজ্ঞবলক্য,হৃদয় নামক ব্রহ্মের এই পাদের বিষয়ে আমাকে অবশ্যই বলুন।)
(যাজ্ঞবল্ক্য বললেন)------হৃদয়ই আয়তন, আকাশ প্রতিষ্ঠা; ইনি স্থিতি এঁকে এই ভাবে উপাসনা করণীয়।
(জনক বললেন)------- যাজ্ঞবল্ক্য স্থিতি কি?
হৃদয়ই (স্থিতি) সম্রাট, ইহাই (যাজ্ঞবল্ক্য) বললেন।
হৃদয় অবশ্যই সম্রাট সর্ব্ব ভূতের আয়তন, হৃদয় অবশ্যই সম্রাট সর্ব্ব ভূতের প্রতিষ্ঠা, হৃদয়েই এই ভাবে সম্রাট সর্ব্ব ভূত প্রতিষ্ঠিত হয়, হৃদয়ই সম্রাট পরম ব্রহ্ম; হৃদয় এঁকে ত্যাগ করেন না।
এঁর জন্য ভূত সকল (জীব) সকল অভিক্ষরণ করেন; দেবতা হয়ে দেবগণকে আপ্ত বা প্রাপ্ত হন, যিনি এই ভাবে বিদিত হয়ে এই প্রকার উপাসনা করেন।
সহস্র হস্তি ঋষভ দান করছি------- ইহাই বললেন জনক-বৈদেহ।
যাজ্ঞবল্ক্য তাহাই বললেন, “আমার পিতা মনে করতেন অনুশাসন (উপদেশ) না দিয়ে (সম্পূর্ণ না করে) হরণ (দক্ষিণা গ্রহণ) (অনুচিত) ইতি।
নিরুক্ত। (এই অংশে বিশেষ বিশেষ শব্দ এবং অনুচ্ছেদের অর্থ এবং তাৎপর্য লিখিত হলো। উপরে ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশে যে সব অর্থ এবং ব্যাখ্যা উক্ত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি এই নিরুক্ত অংশে করা হয় নি।ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশের ৬ষ্ঠ অংশ দ্রষ্টব্য।)
১। স্থিতি।
হৃদয় এবং স্থিতির ব্যাখ্যা ব্রহ্মখণ্ডে বা সারাংশের ৫ম অংশে উক্ত হয়েছে।
স্থিতি = স্থ + ইতি। চেতনা যখন নিজেকে দ্বিতীয় করে প্রকাশ করেন, সেই প্রকাশের ক্রমগুলি যেখানে এসে শেষ হয়, তার নাম ‘স্থ'। এই ‘স্থ' অব্দি হলে ‘সৃষ্টি সম্পূর্ণ’ হয় এবং স্থিতির অবস্থা হয়। স্থ হওয়া মানে ভূত বা ভৌতিক্তা সৃষ্টি হওয়া।
২। বিদগ্ধ শাকল্য।
বিদগ্ধ = বিশেষ ভাবে দগ্ধ। অগ্নি বা প্রাণের দ্বারাই সবাই দগ্ধ। যাকে যে ভাবে দগ্ধ করেন সে নিজেকে সেই ভাবেই জানছে। এই জন্য কেউ নিজেকে পাখী বলে জানছে বা পাখী হয়েছে, কেউ বা নিজেকে বৃক্ষ বলে জানছে বা বৃক্ষ হয়েছে। যখন দুঃখের দ্বারা দগ্ধ হই তখন আমরা দুঃখী, যখন সুখের দ্বারা দগ্ধ হই তখন আমরা সুখী। এই ভাবে কালের শাসনে সবাই দগ্ধ হয়েছে এবং হচ্ছে; এই জন্য যিনি এই ভাবে সৃষ্টিকে জানেন তিনি বিদগ্ধ শাকল্য।
শাকল্য = শা (শাসন) + কল্য ( যা কালক্রমে প্রকাশ পায়)।
যা কিছু নিয়ে আমরা বেঁচে আছি, যা কিছু আমাদের বোধে বা জ্ঞানে ফুটে আছে তা সব এই প্রাণের দ্বারা দগ্ধ,আঙ্গিরস প্রাণের থেকে ঝরে পরা অঙ্গার খণ্ড সকল। আর সেই সব অঙ্গার খণ্ডগুলিকে আমরা হৃদয় দিয়ে ধরে আছি। যা কিছু নিয়ে আমরা রয়েছি তাদেরকে আমার পুত্র, আমার কন্যা, আমার অর্থ এই ভাবে ধারণ করে আছি।এর নাম হৃদয় বা হৃদয়ের দ্বারা বিধৃত। এই ভাবে বিশ্ব ভূবনকে আত্মস্বরূপ, যিনি প্রাণ, তিনি হৃদয়ের দ্বারাই ধরে আছেন। হৃদয়ের দ্বারা বিধৃত হয়ে এই বিশ্ব স্থিতিশীল হয়েছে।
Comments
Post a Comment