বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, চতুর্থ অধ্যায়, তৃতীয় ব্রাহ্মণ, মূল অংশ এবং বঙ্গানুবাদ । জাগ্রত, স্বপ্ন এবং নিদ্রার বিজ্ঞান।(Bengali translation of Fourth chapter, Third part of Brihadaranyaka Upanishad with original texts and meanings---science of the state of awakeness, dream and sleep.)
বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, চতুর্থ অধ্যায়, তৃতীয় ব্রাহ্মণ, মূল অংশ এবং বঙ্গানুবাদ । জাগ্রত, স্বপ্ন এবং নিদ্রার বিজ্ঞান।
ভূমিকা
জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি বা নিদ্রা এই তিন অবস্থার যে বিজ্ঞান বা চেতনার তিনটি স্বরূপের কথা, উপনিষদের নানা অংশে বিবৃত করা হয়েছে। এই লেখাটি বৃহদারণ্যক উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায় তৃতীয় ব্রাহ্মণের মূল অংশ সহ বঙ্গানুবাদ, অন্বয় এবং অর্থ সহ। প্রতিটি সংস্কৃত শব্দের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে। নিরুক্ত অংশে উপনিষদের উক্তির তাৎপর্য উল্লেখ করা হয়েছে।উপনিষদের অর্থ উপনিষদের মধ্যেই উক্ত হয়েছে; এই জন্য অন্যান্য উপনিষদের মন্ত্র বা শ্লোক, প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল সংস্কৃত অংশে যে ভাবে বলা হয়েছে, বঙ্গানুবাদ ঠিক সেই ভাবেই করা হয়েছে যাতে মূল সংস্কৃত অংশ কোনভাবেই অনুবাদের প্রভাবে ভিন্ন না হয়ে যায়; সেই জন্য, নিরুক্ত অংশে, প্রয়োজন বোধে, মন্ত্রের অর্থকে প্রাঞ্জল করা হয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞান, নিদ্রা এবং স্বপ্নের যে গুরুত্ব তা উল্লেখ করে, এবং নানা গবেষণাও হচ্ছে। তবে এই চিৎ বিজ্ঞান যা এই আলখ্যে, গুরু এবং ঋষিদের উপদেশ অনুধাবন করে প্রকাশ করার প্রয়াস করেছি, তা আধুনিক বিজ্ঞানের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৪৫) এবং তাঁর প্রধান শিষ্য মহর্ষি ত্রিদিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯২৩-১৯৯৪) উপদেশ যথাসাধ্য অনুধাবন করে, এই উপনিষদের অর্থ লিখিত হলো।
প্রথমে, সারাংশ বা ব্রহ্ম খণ্ডটি পড়লে, মূল উপনিষদের মন্ত্রগুলি বুঝতে সুবিধা হবে।
সারাংশ (ব্রহ্ম খণ্ড)।
১। জীবের তিন অবস্থা এবং আদিত্য জ্যোতি।
আমরা তিনটি অবস্থার মধ্যে বেঁচে থাকি----জাগ্রত অবস্থা, স্বপ্ন এবং নিদ্রা বা সুষুপ্তি।এই তিনটি অবস্থাকে এই উপনিষদে জাগ্রতদেশ, স্বপ্ন এবং সম্প্রসাদ ( নিদ্রা / সুষুপ্তি ) বলে বলা হয়েছে। জাগ্রত অবস্থা এবং সুষুপ্তির যে সন্ধি বা সন্ধিস্থল, তাকে স্বপ্ন বলা হয়েছে। আমরা জাগ্রত অবস্থায়, বহির্মুখী হয়ে, সূর্য বা আদিত্যের আলোয় সকল কিছু দেখি। এই আদিত্যের থেকে দিন-রাত বা অহোরাত্রময় যে কালধারা বা নিয়ন্ত্রণ তা প্রকাশ পাচ্ছে, এবং তদনুসারে আমরা জাগ্রত অবস্থায় জ্ঞানময়, কর্ম্মময় হই। তাই জাগ্রত অবস্থায় আমাদের বা পুরুষের যে জ্যোতি হয় তাই 'আদিত্য জ্যোতি'। এই জ্যোতিতেই বা এই জ্যোতির দ্বারাই আমরা উঠি, বসি, কর্ম্ম করি। সবটা এক করে, তাল পাকিয়ে, একসা হয়ে যে ভোগের কেন্দ্র তাঁর নাম 'আদিত্য'। অদিতি, অর্থাৎ 'দিতি' বা দ্বিতীয়তা নেই, অদ্বিতীয়তাময়, তাই আদিত্য; আবার যিনি 'অদন' করছেন বা 'খাচ্ছেন, ভোগ করছেন', তিনি আদিত্য। যিনি মহাপ্রাণ বা মহান অগ্নি, তাঁকে বৈশ্বানর অগ্নি বলে বেদ অভিহিত করেছেন। তিনি বিশ্বের সবার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে, বিশ্ব ভোক্তা হয়েছেন, তাই তিনি 'বিশ্বনর' বা 'বৈশ্বানর'। সবাইকে এক জ্ঞানে বা আত্মজ্ঞানে দর্শন করছেন এবং নিজের সমগ্রত্বকে ভোগ করছেন, তাই তিনি আদিত্য। আবার, তাঁর প্রতি খণ্ড সত্তা বা প্রতি জীব, যদিও প্রতি মুহূর্ত্তে , প্রতি ক্ষণে, এক এক আলাদা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বা আলাদা পুরুষ, সেই ক্ষণে সে যা অনুভব করছে তদনুযায়ী সে এক পুরুষ বা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, তত্রাচ প্রতি জীব একটি অখণ্ড ব্যক্তিত্ব বোধেই জগৎকে ভোগ করছে। এইটি হলো আদিত্য জ্যোতিতে সক্রিয় হওয়া---- বহির্মুখী হয়ে, আদিত্য থেকে যে কালের অনুশাসন চলেছে, তার অধীনে সক্রিয় থাকা।এর নাম জাগ্রত অবস্থা।
২। স্বপ্ন।
বহিঃ বা বাইরের বিশ্ব কে বর্জ্জন করে, অন্তরে নিজের আলোয় বা আত্মজ্যোতির দ্বারা সকল কিছু সৃষ্টি করে ভোগ করার নাম স্বপ্ন দর্শন। যা কিছু জাগ্রত অবস্থায় আমরা ভোগ করি, দেখি, অনুভব করি, সেই সবই আবার স্বপ্নে দেখি, অনুভব করি। তাই স্বপ্ন মানেই, 'স্বয়ং আপ্নোতি', নিজেতে আপ্তি বা প্রাপ্তি। বাইরের বিশ্বকে বর্জ্জন করে, স্বয়ংজ্যোতি বা প্রাণের জ্যোতিতে আমরা স্বপ্ন দেখি। যা কিছু বাহিরে ছিল, সে সব আত্মা স্বয়ং অন্তরে সৃষ্টি করেন।
৩। চন্দ্র জ্যোতি।
নিষ্কল, নিষ্ক্রিয় আত্মার যে স্বাধীন সক্রিয়, নিয়ন্ত্রণময় ব্যক্তিত্ব বা অভিব্যক্তি, তাই প্রাণ বা প্রাণাগ্নি। সেই স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, যিনি প্রাণ হয়ে আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন এবং নিজেতে ধারণ করেছেন, তাঁর যে অন্তর বোধময় প্রকাশ বা জ্যোতি তার নাম চন্দ্র জ্যোতি। (প্রাণের জ্যোতিরূপ চন্দ্রমা----বৃহদারাণ্যক উপনিষৎ মন্ত্র ১।৫।১৩ দ্রষ্টব্য) এই অন্তর বোধময় লোক বা অন্তরীক্ষের যে একটু স্থূল প্রকাশ বাইরের আকাশে আমাদের জ্ঞানে ধরা পরেছে, যেটুকু আমাদের উপলব্ধিতে আসে, তাকে আমরা চন্দ্র বলে অনুভব করি। বাইরের জগৎকে আমরা আসলে অন্তরেই অনুভূতির আকারে বোধ করি। তাই এই উপনিষদে বলা হয়েছে যে, যখন আদিত্য অস্তমিত হন, তখন পুরুষের যে জ্যোতি তা চন্দ্র-জ্যোতি। সেই জ্যোতিতেই পুরুষ জ্ঞানময় হন, কর্ম্ম করেন।
৪। জাগ্রতস্থান, গৃহপতি অগ্নি, স্থূলভুক্ (sthuula-bhuk), বহিঃ প্রজ্ঞ।
অগ্নি, বা প্রাণের যে নিয়ন্ত্রণের দ্বারা আমরা বহির্মুখী হয়ে বা বহিঃ প্রজ্ঞ হয়ে এই ভৌতিক বিশ্বকে ভোগ করছি, তার নাম 'গৃহপতি অগ্নি' এবং এঁকে বৈশ্বানর অগ্নিও বলা হয়।এই জন্য মাণ্ডূক্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে জাগরিত স্থানে এই অগ্নি বৈশ্বানর, বহিঃ প্রজ্ঞ বা বহির্মুখী এবং 'স্থূলভুক্' বা স্থূলভোক্তা (ভৌতিকতার ভোক্তা) । এঁর আধিপত্যে আমরা গৃহস্থ হয়েছি, ঘড় সংসার করি। এই যে সংস্কার বদ্ধ হয়ে আমরা জীবন যাপন করছি, এইটি গৃহপতি অগ্নির অধীনে। বাবা অথবা পিতৃলোক থেকে আমরা সংস্কার প্রাপ্ত হই। তাই এই গৃহপতি অগ্নিকে পিতার অগ্নি বলা হয়। (মাণ্ডূক্য উপনিষৎ, তৃতীয় মন্ত্র। )
স্বপ্নস্থান, দক্ষিণাগ্নি, প্রবিবিক্তভুক্, অন্তঃ প্রজ্ঞ।
আর স্থূলকে (ভৌতিকতাকে) বর্জ্জন করে, এই যে অগ্নি বা প্রাণ স্বপ্নময় হন, এই জন্য এঁর নাম প্রবিবিক্তভুক্। প্রবিবিক্তভুক্ অর্থে, যিনি প্রকৃষ্ট ভাবে আলাদা করে, স্থূলত্ব থেকে আলাদা হয়ে ভোগ করেন। (মাণ্ডূক্য উপনিষৎ, চতুর্থ মন্ত্র।) এই স্বপ্নাবস্থায় আমরা অন্তর্মুখী হই এবং ইহা আত্মস্বরূপের অন্তঃ প্রজ্ঞ অবস্থা।
এই অগ্নির বা প্রাণের এই স্বরূপের অন্য নাম 'অন্বআহার্য পচন অগ্নি' কেননা যা কিছু আমরা খাই বা আহার করি, অনুভব করি, এবং পচন/ হজম করি তা এঁর অনুগত হয়। এর অর্থ, এই অগ্নিরদ্বারা আমাদের গঠণ হয়, কর্ম্ম বা অনুভূতি অনুসারে পরিণতি বা অভ্যুদয় হয়। তাই এই অগ্নি 'মায়ের অগ্নি'। যেহেতু ইনি আমাদের গঠণ বা নিয়ন্ত্রণ করছেন, যমন করছেন, তাই এঁর অন্য নাম দক্ষিণাগ্নি। যম বা যমন বা নিয়ত্রণের দ্বারা যে দেবতা, বা প্রাণের যে ব্যক্তিত্ব আমাদের আত্মজ্ঞানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি 'যম' বা দক্ষিণ দিক্ (যে দিকে আমাদের দাক্ষিণ্য বা প্রসারণ হচ্ছে) অভিমানী দেবতা। এই যে আত্মা বা যিনি প্রাণ, আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে অভ্যুদয় বা মুক্তির দিকে নিয়ে চলেছেন, তিনি স্বপ্নকালে আমাদের কে নিরীক্ষণ করেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, আমাদের পর্যালোচনা করেন। এই জন্য এই উপনিষদে উক্ত হয়েছে, স্বপ্নের দ্বারা শরীরকে নিচেষ্ট করে, এই অসুপ্ত বা চিরজাগ্রত আত্মা, যে সুপ্ত তাকে নিরীক্ষণ করেন।
উপনিষদে বলা হয়েছে যে, চন্দ্রে যে পুরুষ দৃষ্ট হন, তিনিই অন্বআহার্য পচন অগ্নি বা দক্ষিণাগ্নি। তাই যে স্বয়ং জ্যোতিতে (বা প্রাণের জ্যোতিতে) আমরা স্বপ্ন দেখি তা ঐ চন্দ্রমার জ্যোতি।
সন্ধি বা তৃতীয় স্থান। সুষুপ্তি বা নিদ্রা এবং জাগ্রত অবস্থার যে সন্ধি, তা স্বপ্ন। তাই স্বপ্নকে তৃতীয় স্থান বলা হয়েছে। সুপ্ত অবস্থাকে 'পরলোক' এবং জাগ্রত অবস্থাকে 'ইদং' বা ' ইহলোক' বলা হয়েছে। এই অমৃত আত্মা, স্বপ্ন বা সন্ধি স্থানে স্থিত হয়ে উভয়, অর্থাৎ নিজের সুষুপ্ত এবং জাগ্রত অবস্থাকে দর্শন করেন বা তুলনা করেন।
সম্প্রসাদ বা সুষুপ্তি।
সুষুপ্তিকে 'সম্প্রসাদ' বলা হয়েছে।সুপ্ত শব্দটি সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রা এবং স্বপ্ন, এই দুই অর্থেই প্রয়োগ করা হয়েছে। সুষুপ্তি কালে আমরা 'আরাম' বা 'প্রসাদ' অনুভব করি, কিন্তু তাঁকে (আত্মাকে, যাঁতে আমরা সুপ্ত হই,বা যাঁতে একীভূত হই) কেউই দেখতে পায় না। আমরা বলি, 'বেশ ঘুমিয়েছি'। নিদ্রাকালে 'আছি বা নেই' এই জ্ঞান আমাদের থাকে না, অথচ জেগে উঠে আমরা যে ঘুমিয়ে ছিলাম তা অনুভব করি। এর কারণ আমরা 'না থেকেও, ঐ অবিনশ্বর আত্মায় থাকি' বা তাঁতে একসা হয়ে থাকি। তাই বলা হয়েছে, সুপ্তিতে, আত্মা যদিও দেখেন, তত্রাচ দেখেন না, যদিও শোনেন, তত্রাচ শোনেন না, যদিও জানেন, তত্রাচ জানেন না এবং এর কারণ হলো এই যে, যিনি সুষুপ্ত বা সম্প্রসাদ সম্পন্ন, তাঁতে পৃথক বা বিভক্ত হয়ে কিছু থাকে না যে একজন আর একজনকে দেখবে, যে একজন আর একজনকে শুনবে, যে একজন আর একজনকে জানবে। ঋষি আরো বলেছেন যে অবিনশ্বরতা হেতু, দ্রষ্টার দৃষ্টি, শ্রোতার শ্রুতি, জ্ঞাতার জ্ঞানময়তা কখন বিলুপ্ত হয় না; নিত্য বিদ্যমান থাকে।
এই অমৃত আত্মা, যাঁতে সব একীভূত হয় সম্প্রসাদে, তিনি একান্ত স্বাধীন। তিনি প্রাণের দ্বারা শরীরকে রক্ষা করে, যথেচ্ছ বিচরণ করেন অন্তর এবং বাহিরে, তিনি আত্ম ক্রীড়াময়, আত্মরতিময়।আমাদের যে ভোগ, তা এই এক অমৃত আত্মার দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ ইত্যাদিরই অংশ।
আহবনীয় অগ্নি, বাক্ এবং আত্মজ্যোতি। আনন্দভুক্।
এই যে সুষুপ্তি বা সম্প্রসাদ, এইখানে আমরা একীভূত হই। ঘুমের সময় এই আত্মাই আমাদের ডাকেন, আহ্বান করেন। সেই ডাকেই আমরা তাঁতে ঘুমিয়ে পড়ি। তাই এই আত্মার এই আহ্বানময় ব্যক্তিত্বের নাম বা প্রাণময়তার নাম 'আহবনীয় অগ্নি'। আহবনীয় শব্দটি 'হবন' বা 'হু' শব্দ থেকে হয়েছে। যেখানে নিজেতেই নিজে আহুত হচ্ছেন, তা আহবনীয়। তাই এই উপনিষদে বলা হয়েছে যে যখন আদিত্য অস্তমিত হন, চদ্রমাও অস্তমিত হন, তখন পুরুষের জ্যোতি হলো অগ্নি (আহবনীয় অগ্নি)। উপনিষদে, এই অগ্নিকে আনন্দভুক্ বলা হয়েছে, কেননা এখানে নিজেই নিজের দ্রষ্টা, নিজেই নিজের শ্রোতা, ইত্যাদি। ((মাণ্ডূক্য উপনিষৎ, পঞ্চম মন্ত্র। )
এই যে তিন অগ্নি (প্রাণাগ্নি), গৃহপতি, দক্ষিণ এবং আহবনীয় অগ্নি, এঁরা আত্মা বা আত্মশক্তির প্রকাশ।আত্মা নিজেই নিজের শক্তি, বা স্বয়ং শক্তি। আত্মশক্তির নাম বাক্। নিজের দ্বারা বা বাকের দ্বারা ইনি নিজেকে সক্রিয় বা কামময় করেন এবং এই সক্রিয় আত্মার নাম প্রাণ বা প্রাণাগ্নি।
তাই ঋষি বলেছেন যে যখন আদিত্য অস্তমিত হন, চদ্রমাও অস্তমিত হন, অগ্নি শান্ত হন, বাক্ শান্ত হন, তখন আত্মাই পুরুষের জ্যোতি।
আত্মার অসঙ্গত্ব, ঈশ্বরত্ব এবং অবিনশ্বরত্ব।
এই উপনিষদে, আত্মার অসঙ্গত্ব এবং ঈশ্বরত্ব এই দুই স্বরূপের কথা বলা হয়েছে।অসঙ্গ অর্থে আত্মা ( যাঁকে আমরা সবাই 'নিজ' বলে বোধ করি) সঙ্গবান্ বা লিপ্ত হন না। তাই ঋষি বলেছেন যে জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সম্প্রসাদ অবস্থায় এই আত্মা যা কিছু ভোগ করেন, ইনি তার দ্বারা অনুগত নন বা অভিভূত হন না। আমরা যে ভোগ করি তা এঁর ভোগেরই অন্তর্গত, কিন্তু আমরা ভোগের দ্বারা লিপ্ত বা অভিভূত হই, সঙ্গত হই। ভোগ করেও আমরা যে অসঙ্গ, বিশুদ্ধ, অপরিণামী আত্মস্বরূপ তা আমরা জানিনা; যিনি আত্মজ্ঞ তিনি জানেন। অসঙ্গ শব্দের আর একটি অর্থ হলো, যেখানে দ্বিতীয়তা নেই, সেখানে কে কার সাথে সঙ্গত বা লিপ্ত হবে! তাই ঋষি বলেছেন যে সম্প্রসাদ বা সুপ্তি অবস্থায়, সেই সুপ্ত পুরুষ কিছুই কামনা করেন না, কোন স্বপ্নও দর্শন করেন না; কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি দেখেন না, তিনি দেখেও দেখেন না; কেননা তাঁর থেকে বিভক্ত বা দ্বিতীয় কিছু নেই যে তিনি দেখবেন; অথচ তিনি না দেখেও দেখেন, কেননা দ্রষ্টার দৃষ্টি শক্তি লোপ পায় না কেননা তা অবিনাশী। এই ভাবে তিনি শুনেও শোনেন না বা না শুনেও শোনেন, আঘ্রাণ করেও করেন না বা না আঘ্রাণ করেও আঘ্রাণ করেন, শ্রবণ করেও করেন না বা না শ্রবণ করেও শ্রবণ করেন, আস্বাদন করেও করেন না বা না আস্বাদন করেও আস্বাদন করেন, স্পর্শ করেও করেন না বা না স্পর্শ করেও স্পর্শ করেন, মনন করেও করেন না বা না মনন করেও মনন করেন, জেনেও জানেন না বা না জেনেও জানেন।
এই অমৃত আত্মাই ঈশ্বর। ইনিই আমাদের জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুপ্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে মুক্তির দিকে, পরম অভ্যুদয়ের দিকে নিয়ে চলেছেন। এর নাম উদ্গান করা,ঊর্ধ্বশ্বাসী হওয়া। উপনিষদে বলা হয়েছে যে মুখ্য প্রাণ উদ্গান করেছিলেন, আর তার ফলে দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি শক্তিরা, যারা মৃত্যুর দ্বারা ক্ষীণ হয়ে যেত, তারা আর ক্ষীণ হয় না ; সেই দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি শক্তি মৃত্যুর পরপারে উত্তীর্ণ হয়। যে, মৃত্যুর দ্বারা তাড়িত হয়ে দর্শন, শ্রবণ, আঘ্রাণ ইত্যাদি করতো, সে মৃত্যুকে অতিক্রম করে এবং দর্শন, শ্রবণ,স্পর্শ, আঘ্রাণ, আস্বাদন ইত্যাদি শক্তি অন্তহীন হয়ে যায়।
তিনটি স্বপ্ন----ত্রয়ঃ স্বপ্নাঃ।
ঐতরেয় উপনিষদে আত্মার তিনটি স্বপ্ন এবং তিনটি আবাসের কথা বলা হয়েছে। এই যে জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি অবস্থা তা আত্মারই তিনটি অবস্থা, তাঁরই তিনটি আপ্তি, স্বয়ং স্বরূপে বা নিজেতে আপ্তি। সুতরাং এই উপনিষদে 'স্বপ্ন' কে যে তৃতীয় স্থান বলা হয়েছে, তার দ্বারা ঐতরেয় উপনিষদের তিনটি স্বপ্নের কথাও বলা হয়েছে। (ঐতরেয় উপনিষৎ, মন্ত্র ১।৩।১২ দ্রষ্টব্য।)
১ম মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।১।)
জনকং হ বৈদেহং যাজ্ঞবল্ক্যো জগাম; স মেনে ন বদিষ্য ইতি; অথ হ যজ্জনকশ্চ বৈদেহো যাজ্ঞবল্ক্যশ্চাগ্নিহোত্রে সমূদাতে, তস্মৈ হ যাজ্ঞবল্ক্যো বরং দদৌ; স হ কামপ্রশ্নমেব বব্রে, তং হাস্মৈ দদৌ; তং হ সম্রাডেব পূর্ব্ব পপ্রচ্ছ।।৪।৩।১।
অন্বয় এবং অর্থ।
জনকম্ হ বৈদেহম্ (জনক যিনি বৈদেহ) যাজ্ঞবল্ক্যঃ জগাম (যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে গিয়েছিলেন) ; স (তিনি-- যাজ্ঞবল্ক্য) মেনে ( মনে করলেন) ন বদিষ্য (বলব না) ইতি;
অথ হ (অনন্তর) যৎ জ্নকঃ (যখন জনক) বৈদেহঃ (বৈদেহ) যাজ্ঞবল্ক্যঃ চ (এবং যাজ্ঞবল্ক্য) অগ্নিহোত্রে ( অগ্নিহোত্র কর্ম্মে) সমূদাতে (সম্যক রূপে উদাত্ত হয়েছিলেন বা ঊর্ধ্ব জ্ঞান বা বেদনে স্থিত হয়েছিলেন), তস্মৈ হ (তাঁহাকে) যাজ্ঞবল্ক্যো ( যাজ্ঞবল্ক্য ) বরং দদৌ (বর দান করেছিলেন) ; স হ (সে/তিনি) কাম প্রশ্নম্ ( কাম বা ইচ্ছা অনুযায়ী প্রশ্ন ) এব বব্রে (বলতে পারবেন; জিজ্ঞাসা করতে পারবেন ), তং হ (তাঁকে) অস্মৈ(এই/এই বর) দদৌ (বর দান করেছিলেন); তং হ (তাঁকে) সম্রাড্ এব (সম্রাটই) পূর্ব্ব (আগে) পপ্রচ্ছ(প্রশ্ন করেছিলেন)। ৪।৩।১
অর্থ।
বৈদেহ জনকের নিকট যাজ্ঞবল্ক্য গিয়েছিলেন। তিনি (যাজ্ঞবল্ক্য) মনস্থির করেলন, ' আমি কিছুই বলব না '। কিন্তু যখন বৈদেহ জনক এবং যাজ্ঞবল্ক্য অগ্নিহোত্র কর্ম্ম বিষয়ে সম্যক রূপে উদাত্ত হয়েছিলেন বা ঊর্ধ্ব জ্ঞান বা বেদনে স্থিত হয়েছিলেন, তাঁকে যাজ্ঞবল্ক্য বর দান করেছিলেন যে তিনি কামপ্রশ্ন বা ইচ্ছা অনুযায়ী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন। (তাই) তাঁকে (যাজ্ঞবল্ক্যকে) সম্রাটই (জনক) আগে প্রশ্ন করেছিলেন। ৪।৩।১
নিরুক্ত।
বৈদেহ জনক---- যিনি দেহ বা কোন আয়তনের দ্বারা নির্দিষ্ট হন না, তিনি বা সেই বৈদেহী বাক্ বা আত্মশক্তি সবার জনক হয়ে নিজেকে বিশ্বভুবনের আকারে জাত করছেন। এতে চেতনার সকল প্রকাশ, দেবক্ষেত্র থেকে ভৌতিক বিশ্ব অব্দি সকল কিছু সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে। এই যে চিৎশক্তি বা বৈদেহী জানকীর যিনি উপাসক তিনি 'বৈদেহ জনক'। এই বিদ্যা বা চিৎশক্তি বিরাটে বা অধিদৈবে যেখানে প্রতিষ্ঠিত তার নাম 'জনলোক' এবং অধ্যাত্মে এই লোকই 'বিশুদ্ধ চক্র বা কণ্ঠ'।
যাজ্ঞবল্ক্য--যঃ জ্ঞঃ, যঃ বল্কঃ--- গাছের ছাল হলো বল্ক। এই বিপুল বিশ্বই গাছ বা 'বৃক্ষ'। যা নিরন্তর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে আবার ক্ষয় প্রাপ্তও হচ্ছে, তা বৃক্ষ বা সৃষ্ট বিশ্ব।যিনি জ্ঞ বা জ্ঞানস্বরূপ তাঁর জ্ঞান বা বোধক্রিয়া থেকে সব কিছু জন্মাচ্ছে। বাইরে যে 'গাছটি', তা এই চেতনা বা জ্ঞানস্বরূপেরই 'গাছ বা বৃক্ষ' নামক 'জ্ঞান' বা 'বোধ'। আর এই বিশ্বচেতনার বোধে বা জ্ঞানে বিধৃত এই বৃক্ষবোধ থেকে আমার চেতনায় যে বৃক্ষ বোধ আমার সংস্কার অনুযায়ী ফুটছে, তার নাম 'আমার বৃক্ষ দেখা বা অনুভব করা'।আমার মধ্যেও ঐ একই চেতনা, একই আত্মস্বরূপ বৃক্ষ বোধ হয়ে ফুটছেন। এই আত্মস্বরূপ বা যিনি 'জ্ঞ', তিনি আমাদের সবার মধ্যে 'আত্মা' বা 'নিজবোধ' স্বরূপ এবং তিনি নিজেই বিশ্বভুবন হয়ে নিজেকে ছালের মতো বা গাছের বল্কলের মতো নিজেকে বেষ্টন করে আছেন। যিনি বিশ্বভুবনকে এই ভাবে জানেন বা দর্শন করছেন, সেই দ্রষ্ট্রা পুরুষের নাম 'যাজ্ঞবল্ক্য'।
অগ্নিহোত্র--অগ্নি +হু + ত্র। আমরা যা কিছু করি তা প্রাণ বা অগ্নির তৃপ্তির জন্যই করি। পরম আত্মস্বরূপ নিজেকে দ্বিতীয় বা বহুরূপে সৃষ্টি করতে গিয়ে, প্রথমে যা হন, তার নাম প্রাণ। আত্মা থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে সমস্ত বিশ্ব জাত হয়। এই প্রাণকে অগ্নি বলা হয়, কেননা এঁর থেকে সবাই প্রকাশ পেয়েছে এবং এঁর দ্বারা সবাই পরিচালিত হচ্ছে বা সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ময় হচ্ছে। সবার অগ্রে (অগ্) সবাইকে নিয়ে চলেছেন (নি/ নী) তাই এঁকে অগ্নি বলা হয়।
এই প্রাণ বা অগ্নির তৃপ্তির থেকেই আমরা তৃপ্ত হই, তাই প্রাণ যা চান আমরা তাই করি। আমরা যে খাবার খেয়ে তৃপ্ত হই, তা প্রাণ তৃপ্ত হন বলেই আমরা তৃপ্ত হই। (ছান্দোগ্য উপনিষৎ ৫ম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।) এই যে আমরা অনবরত প্রাণ বা অগ্নির তৃপ্তার্থে কর্ম্মময় এর নাম প্রাণগ্নিহোত্র বা প্রাণাগ্নিতে আহুতি দেওয়া।। তবে প্রকৃত অর্থ হলো, প্রাণকে দেখে কর্ম্মময় হওয়া বা আহুতি দেওয়া। এই প্রাণ বা অগ্নিতে আমরা তিনটি অবস্থায় আহুতি দিচ্ছি। সেই অবস্থা তিনটি হলো জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুপ্তি বা সম্প্রসাদ, আর সেই তিন অব'স্থায় প্রাণ বা অগ্নির যে মহিমা দৃষ্ট হয়, তার নাম গৃহপতি অগ্নি, দক্ষিণাগ্নি এবং আহবনীয় অগ্নি। ( সারাংশ /ব্রহ্ম খণ্ড দ্রষ্টব্য।)। এই তিন অগ্নিতে আমরা জেনে বা না জেনে আহুতি দিচ্ছি এবং এই তিন অগ্নির মধ্য দিয়ে মহাপ্রাণে ক্রমশঃ মেধ্য হচ্ছি বা তাঁর সাথে একসা হচ্ছি। এর নাম অগ্নিহোত্র এবং এর অন্য নাম অশ্বমেধ যজ্ঞ, প্রাণ বা অশ্বে মেধ্য হওয়া বা একসা হওয়া।
কামপ্রশ্ন--- (১) ইচ্ছামতো প্রশ্ন করা। (২) যে প্রশ্ন করা হবে, তার উত্তর নিশ্চিত ভাবে প্রাপ্তির যোগ্যতা যে প্রশ্ন কর্ত্তার হয়েছে, তাঁর প্রশ্ন কে 'কাম প্রশ্ন' বলা যায়।
প্রশ্ন--প্র + শ্ন > প্র + শ্ম = 'শম' (শ্ম) বা শক্তির (শ) নিষ্ক্রিয় অবস্থা (ম), অপ্রকাশ অবস্থা। প্র = প্রকাশ। যা অপ্রকাশ বা অজ্ঞাত, তদ্বিষয়ে যে বাক্য বা জিজ্ঞাসা তা ' প্রশ্ন '।
আদিত্য জ্যোতি----উপড়ে ' সারাংশ (ব্রহ্ম খণ্ড), জীবের তিন অবস্থা এবং আদিত্য জ্যোতি ' দ্রষ্টব্য।
২য় মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।২।)
যাজ্ঞবল্ক্য কিংজ্যোতিরয়ং পুরুষ ইতি; আদিত্যজ্যোতিঃ সম্রাডিতি হোবাচ, আদিত্যেনৈবায়ং জ্যোতিষাস্তে পল্যয়তে কর্ম্ম কুরুতে বিপল্যেতীতি; এবমেবৈতদ্যাজ্ঞবল্ক্য।।৪।৩।২।
অন্বয় এবং অর্থ।
যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) অয়ম্ (এই) পুরুষঃ (পুরুষের) ইতি;
আদিত্য জ্যোতিঃ (আদিত্য জ্যোতি) সম্রাড্ (সম্রাট্) ইতি হ (ইহাই) উবাচ (বললেন), আদিত্যেন এব (আদিত্যের দ্বারাই) অয়ং (এই পুরুষ) জ্যোতিষাঃ (জ্যোতির দ্বারাই) আস্তে (আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হয়), পল্যয়তে (পলায়ন করা/ অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে যাওয়া) কর্ম্মকুরুতে (কর্ম্ম করে) বিপল্যেতি (পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে) ইতি; এবম্ এব (এই প্রকার ই ) এতৎ (ইহা) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)। ৪।৩।২।
অর্থ।
যাজ্ঞবল্ক্য এই পুরুষের জ্যোতি কি?
যাজ্ঞবল্ক্য ইহাই বললেন, "সম্রাট্ আদিত্যই জ্যোতি"। আদিত্যের জ্যোতির দ্বারাই এই পুরুষ আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হয়, অবস্থান্তরে যায়, কর্ম্ম করে, পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে।
(জনক বললেন) এই প্রকারই ইহা যাজ্ঞবল্ক্য।৪।৩।২।
নিরুক্ত।
জ্যোতি/ জ্যোতিস্----আলোক, অগ্নি। জ্যোতি শব্দের তাৎপর্য হলো 'আয়তন বা প্রসার'। (জি ধাতুর অর্থ বর্ধিত হওয়া। ) যে যেরকম আয়তন নিয়েছে,তনুময় হয়েছে, সেইটি তার 'জ্যোতি'। আমরা যা কিছু দেখি, আকার বা আয়তন, তা আলোকেরই রূপ, তা আলো বা জ্যোতিই। তাই উপনিষদে উক্ত হয়েছে 'চক্ষুই সত্য, এবং যা মূর্ত্ত তার রস'।(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ২।৩।১ মন্ত্র এবং ৪।১।৪ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) চক্ষু মানে, যে কেন্দ্র থেকে দৃষ্টি, দৃশ্য বা আলো প্রকাশ পাচ্ছে।
পল্যয়তে -----এই শব্দটি 'পল্' ধাতু এবং 'পল' শব্দ থেকে হয়েছে। পল অর্থে 'ক্ষণস্থায়ী কাল'। তাই 'পল্যয়তে' অর্থে অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে যাওয়া বা একটি মুহূর্ত্ত থেকে পরবর্ত্তী মুহূর্ত্তে যাওয়া।
৩য় মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।৩।)
অস্তমিত আদিত্যে যাজ্ঞবল্ক্য কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষ ইতি; চন্দ্রমা এবাস্য জ্যোতির্ভবতীতি, চন্দ্রমসৈবায়ং জ্যোতিষাস্তে পল্যয়তে কর্ম্মকুরুতে বিপল্যেতীতি এবমেবৈতদ্যাজ্ঞবল্ক্য।।৪।৩।৩।
অন্বয় এবং অর্থ।
অস্তমিতে আদিত্যে (আদিত্য অস্তমিত হলে) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) এব (এবার/তখন) অয়ম্ (এই) পুরুষ (পুরুষের) ইতি; চন্দ্রমা এব (চন্দ্রই) অস্য (এঁর) জ্যোতিঃ ভবতি (জ্যোতি হয়) ইতি; চন্দ্রমসা এব (চন্দ্রমারই) অয়ম্ (এই পুরুষ) জ্যোতিষাঃ (জ্যোতির দ্বারা) আস্তে (আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হ্য়), পল্যয়তে (পলায়ন করে/ অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে যায়) কর্ম্মকুরুতে (কর্ম্ম করে) বিপল্যেতি (পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে) ইতি; এবম্ এব (এই প্রকারই ) এতৎ (ইহা) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।৪।৩।৩।
অর্থ।
যাজ্ঞবল্ক্য, আদিত্য অস্তমিত হলে তখন এই পুরুষের কি জ্যোতি ? চন্দ্রই এঁর জ্যোতি হয়।চন্দ্রমারই এই জ্যোতির দ্বারা পুরুষ আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হয়, অবস্থান্তরে যায়, কর্ম্ম করে, পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে।
(জনক বললেন) এই প্রকারই ইহা যাজ্ঞবল্ক্য । ৪।৩।৩।
নিরুক্ত।
অস্তমিতে আদিত্যে (আদিত্য অস্তমিত হলে) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) এব (এবার/তখন) অয়ম্ (এই) পুরুষঃ (পুরুষের) ইতি; চন্দ্রমা এব (চন্দ্রই) অস্য (এঁর) জ্যোতিঃ ভবতি (জ্যোতি হয়)---যাজ্ঞবল্ক্য, আদিত্য অস্তমিত হলে তখন এই পুরুষের কি জ্যোতি ? চন্দ্রই এঁর জ্যোতি হয়
উপড়ে ' সারাংশ (ব্রহ্ম খণ্ড), চন্দ্র জ্যোতি ' দ্রষ্টব্য।
চন্দ্র---চম্ (চমন বা পান করা, চুমুক দেওয়া) + দ্র (দ্রষ্টা). স্বয়ংপ্রকাশ চেতনা, যিনি দ্রষ্টা (দ্র), তাঁর দর্শন থেকে দৃশ্য রচনা হচ্ছে।তাঁর দৃষ্টি বা ঈক্ষণ থেকে সবাই সৃষ্টি হয়েছে। সবাইকে, সৃষ্টিকে, নিজের অন্তরে ধারণ করে তিনি যে সাম্যতা, সমতার যে রস, আত্মময় যে রস বা সোম তা পান করছেন। এতে স্থূল বিশ্বের অন্তরে সোম বা প্রাণের আলোড়ন চলেছে। আমরা যা কিছু খাচ্ছি, যা কিছু অনুভব করছি, তা যে রসময় হয়ে আমাদের গঠণ করছে, তা এই নিয়ন্ত্রণময় প্রাণের দ্বারাই হচ্ছে। আমাদের খাওয়া, ভোগ করা, তাঁরই খাওয়া বা সোমপানের অন্তর্গত। টক, ঝাল, দুঃখ, সুখ এই সব ভোগের দ্বারা আমাদের অভ্যুদয় হচ্ছে মুক্তির দিকে। তাই এই বহির্বিশ্বের বা আদিত্য জ্যোতির অন্তরে রয়েছেন, চন্দ্রমা বা সোম। বাইরের যা কিছু, তা আমার অন্তরে জ্ঞান বা বোধের আয়তন বা জ্যোতি। তাই বলা হলো, ' আদিত্য অস্তমিত হলে তখন চন্দ্রই এই পুরুষের জ্যোতি হয়।চন্দ্রমারই এই জ্যোতির দ্বারা পুরুষ আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হ্য়, অবস্থান্তরে যায়, কর্ম্ম করে, পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে '।
৪র্থ মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।৪।)
অস্তমিত আদিত্যে যাজ্ঞবল্ক্য চন্দ্রমস্যস্তমিতে কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষ ইতি; অগ্নিরেবাস্য জ্যোতির্ভবতীতি; অগ্নিনৈবায়ং জ্যোতিষাস্তে পল্যয়তে কর্ম্ম কুরুতে বিপল্যেতীতি; এবমেবৈতদ্যাজ্ঞবল্ক্য।। ৪।৩।৪।।
অন্বয় এবং অর্থ।
অস্তমিতে আদিত্যে (আদিত্য অস্তমিত হলে) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) চন্দ্রমসি অস্তমিতে (চন্দ্রমা অস্তমিত হলে) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) এব (এবার/তখন) অয়ম্ (এই) পুরুষঃ (পুরুষের) ইতি; অগ্নিঃ এব (অগ্নিই) অস্য (এঁর) জ্যোতিঃ ভবতি (জ্যোতি হয়) ; অগ্নিনা এব ( অগ্নির দ্বারাই) অয়ম্ (এই পুরুষ) জ্যোতিষাঃ (জ্যোতির দ্বারা) আস্তে (আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হ্য়), পল্যয়তে (পলায়ন করে/ অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে যায়) কর্ম্মকুরুতে (কর্ম্ম করে) বিপল্যেতি (পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে) ইতি; এবম্ এব (এই প্রকারই ) এতৎ (ইহা) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) ।৪।৩।৪।
অর্থ।
যাজ্ঞবল্ক্য, আদিত্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রমা অস্তমিত হলে, তখন এই পুরুষের জ্যোতি কি? অগ্নিই এঁর জ্যোতি হয়। অগ্নির এই জ্যোতির দ্বারাই পুরুষ আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হয়, অবস্থান্তরে যায়, কর্ম্ম করে, পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে । (জনক বললেন) এই প্রকারই ইহা যাজ্ঞবল্ক্য ।৪।৩।৪।
নিরুক্ত।
অস্তমিতে আদিত্যে (আদিত্য অস্তমিত হলে) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) চন্দ্রমসি অস্তমিতে (চন্দ্রমা অস্তমিত হলে) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) এব (এবার/তখন) অয়ম্ (এই) পুরুষ (পুরুষের) ইতি; অগ্নিঃ এব (অগ্নিই) অস্য (এঁর) জ্যোতিঃ ভবতি (জ্যোতি হয়)---- আদিত্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রমা অস্তমিত হলে, তখন এই পুরুষের জ্যোতি কি? অগ্নিই এঁর জ্যোতি হয়
উপড়ে ' সারাংশ (ব্রহ্ম খণ্ড),আহবনীয় অগ্নি, বাক্ এবং আত্মজ্যোতি এবং আনন্দভুক্ ' দ্রষ্টব্য।
দর্শনের যত ভোগ বা অনুভূতি তা দর্শন বা দৃষ্টি বলে যে চেতনা বা জ্ঞান শক্তি তাঁতে বিধৃত আছে এবং এইটি দর্শন নামক সংস্কার। সেইরকম শ্রবণ, আস্বাদন ইত্যাদির অনুভূতি শ্রবণ, আস্বাদন ইত্যাদির যে সংস্কার তাতে বিধৃত আছে। সুতরাং চন্দ্রমা অস্তমিত হলেও, রসাত্মক প্রাণের অলোড়ন না থাকলেও, দর্শন, শ্রবণ, আস্বাদন ইত্যাদি এই চেতনায় সংস্কার বা তেজের আকারে থাকে।এই তেজই অগ্নি। চেতনা বা প্রাণের যে তেজ, তার মানে তাঁর কামময়তা বা 'কাম'। কাম মানেই বহু হবার প্রবণতা বা তেজ। চেতনার এই তেজের দ্বারাই আমার অন্তর এবং বহিঃ, এই দুই দিকে অভিব্যক্ত হয়ছি।
অন্তরে যেখানে আমরা সুখ, দুঃখময়, যেখানে তৃপ্তি, রাগ-বৈরাগ্য, ঈর্ষা ইত্যাদির বোধ ফুটছে তা হৃদয় বা অন্তঃকরণ। এইখানে চেতনা বা প্রাণকে প্রাণ বলা হয়। এঁর নিয়ন্ত্রণময় স্বরূপের নাম দক্ষিণাগ্নি, আর জ্যোতির্ম্ময় প্রকাশ হচ্ছে চন্দ্র, যাঁর কথা উপড়ে উক্ত হয়েছে।
যেখানে আমরা সঙ্কল্পময়-বিকল্পময়, ইন্দ্রিয়াদি সহ কর্ম্মময়, সেখানে চেতনা বা প্রাণকে মন বলা হয়।এখানে আমরা বহির্মুখী। এঁর নিয়ন্ত্রণময় স্বরূপের নাম গৃহপতি অগ্নি আর জ্যোতির্ম্ময় প্রকাশ হচ্ছে আদিত্য বা সূর্য, যাঁর কথা উপড়ে উক্ত হয়েছে।
আর চেতনা বা প্রাণের যে তেজোময় স্বরূপ, যার দ্বারা চেতনা অন্তর বহিঃ বা, প্রাণ/হৃদয় এবং মন হয়েছেন, তার নাম তেজ। এঁর নিয়ন্ত্রণময় স্বরূপের নাম আহবনীয় অগ্নি, যাঁর কথা উপড়ে উক্ত হয়েছে। প্রকাশময় আমরা আবার এই তেজেই মিলে যাই, তাই এঁর নাম 'আহবনীয়'। ইনি আহ্বান করছেন, আর সেই আহ্বান শুনে, শ্রুত হয়ে, সেই আহ্বানের আকর্ষণে আমরা এঁতে হুত হচ্ছি।
তাই উপনিষদে বলা হয়েছে যে প্রয়াণ কালে মনের অনুভূতি বা মনের মধ্যে ফুটে থাকা কথাগুলি মনে গিয়ে একীভূত হয়, তারপর মন প্রাণে একীভূত হয়, তারপর প্রাণ তেজে একীভূত হয় এবং শেষে, তেজ পরমদেবতা বা আত্মস্বরূপে একীভূত হয়। ( বাঙ্ মনসি সম্পদ্যতে, মনঃ প্রাণে, প্রাণস্তেজসি, তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াং।ছান্দোগ্য উপনিষৎ, ৬।১৫।১।)
তাই বলা হলো আদিত্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রমা অস্তমিত হলে, তখন অগ্নিই এই পুরুষের জ্যোতি হন।৪।
৫ম মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।৫।)
অস্তমিত আদিত্যে যাজ্ঞবল্ক্য চন্দ্রমস্যস্তমিতে শান্তেऽগ্নৌ কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষ ইতি; বাগেবাস্য জ্যোতির্ভবতীতি; বাচৈবায়ং জ্যোতিষাস্তে পল্যয়তে কর্ম্ম কুরুতে বিপল্যেতীতি, তস্মাদ্বৈ সম্রাডপি যত্র স্বঃ পাণির্ন বিনির্জ্ঞায়তেऽথ যত্র বাগুচ্চরত্যুপৈব তত্র ন্যেতীতেবমেবৈতদ্যাজ্ঞবল্ক্য।। ৪। ৩।৫
অন্বয় এবং অর্থ।
অস্তমিতে আদিত্যে (আদিত্য অস্তমিত হলে) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) চন্দ্রমসি অস্তমিতে (চন্দ্রমা অস্তমিত হলে) শান্তেঃ অগ্নৌ (অগ্নি শান্ত হলে) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) এব (এবার/ তখন) অয়ম্ (এই) পুরুষ (পুরুষের) ইতি; বাক্ এব (বাক্ ই) অস্য (এঁর) জ্যোতিঃ ভবতি (জ্যোতি হয়) ;বাক্ এব (বাক্ ই) অয়ম্ (এই পুরুষ) জ্যোতিষাঃ (জ্যোতির দ্বারা) আস্তে (আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হ্য়), পল্যয়তে (পলায়ন করে/ অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে যায়) কর্ম্মকুরুতে (কর্ম্ম করে) বিপল্যেতি (পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে) ইতি; তস্মাৎ বৈ (সেই জন্য) সম্রাড্ (সম্রাট) অপি (এমনকি) যত্র (যেখানে) স্বঃ (নিজের) পাণিঃ (পাণি--হস্ত, ইন্দ্রিয় সকল) ন (না) বিনির্জ্ঞায়তেঃ (জানা যায়) অথ (তখন) যত্র (যেখানে/যে দিকে) বাক্ উচ্চরতি (বাক্ উচ্চারিত হয়) উপ এব তত্র ন্যেতি (উপ ন্যেতি---উপনীত হয়; এব তত্র--সেখানে)। ইতি। এবম্ এব (এই প্রকারই ) এতৎ (ইহা) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য)।৪।৩।৫।
যাজ্ঞবল্ক্য, আদিত্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রমা অস্তমিত হলে, অগ্নি শান্ত হলে, তখন এই পুরুষের জ্যোতি কি? বাক্ই এঁর জ্যোতি হন; বাক্ এই জ্যোতির দ্বারা অবস্থান্তরে যায়, কর্ম্ম করে, পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে । (জনক বললেন) এই প্রকারই ইহা যাজ্ঞবল্ক্য ।
সেই জন্য সম্রাট, এমনকি যেখানে নিজের ইন্দ্রিয় সকল দ্বারাও জানা যায় না, তখন যেখানে/যে দিকে বাক্ উচ্চারিত হয় সেখানে উপনীত হয়।ইতি।
(জনক বললেন) এই প্রকারই ইহা যাজ্ঞবল্ক্য । ৪।৩।৫।
নিরুক্ত।
১। যাজ্ঞবল্ক্য, আদিত্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রমা অস্তমিত হলে, অগ্নি শান্ত হলে, তখন এই পুরুষের জ্যোতি কি? বাক্ই এঁর জ্যোতি হন
যা অধ্যাত্মে (বা আমাদের মধ্যে) মন, তা অধিদৈবে বা বিপুল দেবশক্তি রূপে গৃহপতি অগ্নি বা আদিত্য। যা অধ্যাত্মে (বা আমাদের মধ্যে ) প্রাণ/অন্তঃকরণ /মর্ম্ম, তা অধিদৈবে বা বিপুল দেবশক্তি রূপে দক্ষিণাগ্নি বা চন্দ্রমা। যা অধ্যাত্মে (বা আমাদের মধ্যে) তেজ, তা অধিদৈবে বা বিপুল দেবশক্তি রূপে আহবনীয় অগ্নি বা অগ্নি এবং এই তেজে আমাদের সংস্কার সকল বিধৃত থাকে।
উপনিষদে এই মন্ত্রটি উক্ত হয়েছে----বাঙ্ মনসি, মনঃ প্রাণে, প্রাণ তেজসি, তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াং; ----বাক্য, অর্থাৎ মনের মধ্যে প্রকাশিত বাক্য বা অর্থ গুলি মনেই বিলুপ্ত হয়, মন প্রাণে এবং প্রাণ তেজে এবং তেজ পরম দেবতায় বিলীন হয়। (ছান্দোগ্য উপনিষৎ, ৬।১৫।১।)
তা হলে গৃহপতি অগ্নি বা আদিত্য (দৈব মন) অস্তমিত হয় দক্ষিণাগ্নিতে (দৈব প্রাণে) বা চন্দ্রমাতে, দক্ষিণাগ্নি (দৈব প্রাণ) বা চন্দ্রমা অস্তমিত হয় আহবনীয় অগ্নিতে (দৈব তেজে/ দৈব অগ্নিতে)। অর্থাৎ আদিত্য অস্তমিত হলে পুরুষের জ্যোতি হয় চন্দ্রমা এবং চন্দ্র অস্তমিত হলে পুরুষের জ্যোতি হয় অগ্নি।
যিনি আমাদের সকলের আত্মা, যাঁর আত্মত্ব নিয়ে আমার নিজের পরিচয় দিই, যিনি আমাদের মধ্যে 'নিজ' এই বোধরূপে নিরন্তর বিদ্যমান, এই তিন অগ্নিই এই পরম আত্মস্বরূপের শক্তি এবং এই আত্মা স্বয়ং শক্তি (বা নিজেই নিজের শক্তি)। এই শক্তির নাম 'বাক্', যিনি আমাদের মুখের থেকে 'বাক্য' বা কথার আকারে অনবরত প্রকাশিত হচ্ছেন। ইনি মুখ্য প্রাণ এবং আয়াস্য প্রাণ অর্থাৎ যে প্রাণ 'আস্য' বা মুখ থেকে নির্গত হচ্ছেন। (ছান্দোগ্য উপনিষৎ, প্রথম অধ্যায়, ১।২।১২ দ্রষ্টব্য।) এঁকে 'অশ্ব' বলা হয়েছে, যিনি সবাইকে নিয়ে চলেছেন মৃত্যুর পরপারে বা অমৃতে। ইনি, 'অশ্বৎ' অর্থাৎ 'স্ফীত' হচ্ছেন, বা বিশ্ব ভূবনের আকারে বর্দ্ধিত হচ্ছেন।(বৃহদ্রারণ্যক উপনিষৎ ১।২।৭ এবং১।২।৬ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।)
তাই বলা হলো, অগ্নিও যখন শান্ত হন, তখন পুরুষের জ্যোতি হন 'বাক্'।
২। তস্মাৎ বৈ (সেই জন্য) সম্রাড্ (সম্রাট) অপি (এমনকি) যত্র (যেখানে) স্বঃ (নিজের) পাণিঃ (পাণি--হস্ত, ইন্দ্রিয় সকল) ন (না) বিনির্জ্ঞায়তেঃ (জানা যায়) অথ (তখন) যত্র (যেখানে/যে দিকে) বাক্ উচ্চরতি (বাক্ উচ্চারিত হয়) উপ এব তত্র ন্যেতি (উপ ন্যেতি---উপনীত হয়;----- সেই জন্য সম্রাট, এমনকি যেখানে নিজের ইন্দ্রিয় সকল দ্বারাও জানা যায় না, তখন যেখানে/যে দিকে বাক্ উচ্চারিত হয় সেখানে উপনীত হয়
পাণি---পাণি শব্দের অর্থ 'হস্ত বা হাত, কর্ম্মেন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয় । পাণি শব্দটি পণ্ ধাতু থেকে হয়েছে। পণ্ ধাতুর একটি অর্থ পণ্য বিনিময় করা; হাত দিয়ে যেমন আমরা দেওয়া-নেওয়া (দান ও গ্রহণ) করি, সেই রকম সকল ইন্দিয় দ্বারা আমরা অন্তর ও বহিঃ, এই উভয় দিকেই গতিময়। শব্দ,স্পর্শ ইত্যাদি বাহির থেকে অন্তরে আসছে, আবার আমরা ইন্দ্রিয়দের দ্বারা কর্ম্মময় হয়ে অন্তর থেকে বাহিরে যাচ্ছি। এই বাক্ বা আত্মশক্তির দ্বারাই ইন্দ্রিয় সকল পরিচালিত হয়।(৪।৩।৭ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।)। তাই যিনি এই 'বাক্'কে বা স্বয়ংশক্তি আত্মাকে জানেন, তাঁর কাছে যা কিছু জ্ঞাতব্য তা বাকের দ্বারাই প্রকাশিত হয় বা উচ্চারিত হয়; ইন্দ্রিয়ের উপর আর নির্ভর করতে হয় না।
৬ষ্ঠ মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।৬।)
অস্তমিত আদিত্যে যাজ্ঞবল্ক্য চন্দ্রমস্যস্তমিতে শান্তেऽগ্নৌ শান্তায়াং বাচি কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষ ইতি; আত্মৈবাস্য জ্যোতির্ভবতীতি আত্মৈবায়ং জ্যোতিষাস্তে পল্যয়তে কর্ম্ম কুরুতে বিপল্যেতীতি।। ৪।৩।৬
অন্বয় এবং অর্থ।
অস্তমিতে আদিত্যে (আদিত্য অস্তমিত হলে) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) চন্দ্রমসি অস্তমিতে (চন্দ্রমা অস্তমিত হলে) শান্তে অগ্নৌ (অগ্নি শান্ত হলে) শান্তায়াং বাচি (বাক্ শান্ত হলে) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) এব (এবার/ তখন) অয়ম্ (এই) পুরুষ (পুরুষের) ইতি; আত্মা এব (আত্মাই) অস্য (এঁর) জ্যোতিঃ ভবতি (জ্যোতি হন) ইতি; আত্মা এব অয়ং (আত্মাই এই) জ্যোতিষাঃ (জ্যোতির দ্বারা) আস্তে (আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হ্য়),পল্যয়তে (পলায়ন করা/ অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে যাওয়া), কর্ম্মকুরুতে (কর্ম্ম করে) বিপল্যেতীতি (পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে) ইতি। ৪।৩।৬
অর্থ।
যাজ্ঞবল্ক্য, আদিত্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রমা অস্তমিত হলে, অগ্নি শান্ত হলে, বাক্ শান্ত হলে, তখন এই পুরুষের জ্যোতি কি?
আত্মাই এঁর জ্যোতি হন; এই আত্মজ্যোতির দ্বারা আসীন হয়/অস্তিত্ববান্ হয়, অবস্থান্তরে যায়, কর্ম্ম করে, পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থায় ফিরে আসে।৪।৩।৬
নিরুক্ত।
অস্তমিতে আদিত্যে (আদিত্য অস্তমিত হলে) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য) চন্দ্রমসি অস্তমিতে (চন্দ্রমা অস্তমিত হলে) শান্তে অগ্নৌ (অগ্নি শান্ত হলে) শান্তায়াং বাচি (বাক্ শান্ত হলে) কিম্ (কোন/কি) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) এব (এবার/ তখন) অয়ম্ (এই) পুরুষ (পুরুষের) ইতি; আত্মাএব (আত্মাই) অস্য (এঁর) জ্যোতিঃ ভবতি (জ্যোতি হন)----যাজ্ঞবল্ক্য, আদিত্য অস্তমিত হলে, চন্দ্রমা অস্তমিত হলে, অগ্নি শান্ত হলে, বাক্ শান্ত হলে, তখন এই পুরুষের জ্যোতি কি?
এই অংশের নিরুক্ত আগের মন্ত্রের (৫ম মন্ত্র) নিরুক্তে উক্ত হয়েছে।
বাক্ আত্মারই শক্তি এবং আত্মা নিজেই নিজের শক্তি। তাই বলা হলো, বাক্ও যখন শান্ত হন, তখন পুরুষের জ্যোতি হলো 'স্বয়ং জ্যোতি'। তিন অগ্নি এবং বাক্ সেই আত্মত্বে এক হয়ে আছে।
৭ম মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।৭।)
কতম আত্মা ইতি; যোऽয়ং বিজ্ঞানময়ঃ প্রাণেষু হৃদ্যন্তর্জ্যোতিঃ পুরুষঃ ; স সমানঃ সন্নুভৌ লোকাবনুসংচরতি, ধ্যায়তীব লেলায়তীব; স হি স্বপ্নো ভূত্বেমং লোকমতিক্রামতি মৃত্যো রূপাণি। ৪।৩।৭
অন্বয় এবং অর্থ।
কতমঃ আত্মা (কোনটি আত্মা) ইতি; যঃ (যিনি) অয়ং (এই) বিজ্ঞানময়ঃ (বিজ্ঞানময়) প্রাণেষু (প্রাণ সমূহে বা ইন্দ্রিয় সকলে). হৃদি (হৃদয়ের) অন্তঃ (অন্তরে) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) পুরুষঃ (পুরুষ) ; স (সে/ তিনি) সমানঃ সন্ (সমান হওয়াতে) উভৌ (উভয়) লোকৌ (দুই লোকে) অনুসংচরতি (অনুসঞ্চরণ / বিচরণ করেন) , ধ্যায়তি ইব (যেন ধ্যান করছেন বা ভাবছেন) লেলায়তি ইব (যেন আস্বাদন করছেন, লেহন করছেন); স হি (তিনিই) স্বপ্নো ভূত্বা (স্বপ্ন হয়ে/ বা স্বপ্নাবস্থা ধারণ করে) ইমং (এই) লোকম্ (লোককে) অতিক্রামতি (অতিক্রম করেন) মৃত্যো রূপাণি (মৃত্যু রূপ)। ৪।৩।৭।।
অর্থ।
কোনটি আত্মা ?
যিনি এই বিজ্ঞানময় প্রাণ সমূহে (ইন্দ্রিয় সকলে), (যিনি) হৃদয়ের অন্তরে জ্যোতি, (যিনি) পুরুষ; তিনি সমান হওয়াতে উভয় লোকে অনুসঞ্চরণ (বিচরণ) করেন , যেন ধ্যান করছেন বা ভাবছেন, যেন আস্বাদন এবং লেহন করছেন; তিনিই ( স্বপ্ন হয়ে /স্বপ্নাবস্থা ধারণ করে, এই লোককে অতিক্রম করেন (যা) মৃত্যুরই নানা রূপ। ৪।৩।৭।।
নিরুক্ত।
১। যঃ (যিনি) অয়ং (এই) বিজ্ঞানময়ঃ (বিজ্ঞানময়) প্রাণেষু (প্রাণ সমূহে বা ইন্দ্রিয় সকলে) হৃদি (হৃদয়ের) অন্তঃ (অন্তরে) জ্যোতিঃ (জ্যোতি) পুরুষঃ (পুরুষ)---যিনি এই বিজ্ঞানময় প্রাণ সমূহে (ইন্দ্রিয় সকলে), (যিনি) হৃদয়ের অন্তরে জ্যোতি, (যিনি) পুরুষ;
ইন্দ্র যে পথ দিয়ে চলাচল করেন, তাদের নাম 'ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়= ইন্দ্র ইয়তে---ইন্দ্র চলেছেন!
যিনি সবাইকে দর্শন করছেন এবং যিনি সবার মধ্যে দ্রষ্টা, যিনি ' ইদং দ্রষ্টা ', তিনি ইন্দ্র। ইন্দ্র = ইদং দ্রষ্টা।(ইদন্দ্র---ইদম্+দ্র----- ঐতরেয় উপনিৎ ১।৩।১৪)
এই যে আমরা, এইটি (ইদং) গাছ, এইটি (ইদং) ফুল , এই ভাবে সদা দর্শন করছি এবং যার দ্বারা সত্য বা অস্তিত্ব বোধময় হয়ে রয়েছি, এই দর্শন, যিনি স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা বা প্রাণ তাঁরই দর্শনের অংশ। স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা বা প্রাণ দেখছেন মানেই তাতে দর্শন, দ্রষ্টা এবং দৃশ্য যুগপৎ সৃষ্টি হচ্ছে। এই উপনিষদের দ্বাত্রিংশ (৩২) মন্ত্রে যে বলা হয়েছে, ' দ্রষ্টা অদ্বৈত', সেখানে এই ইন্দ্রের কথাই বলা হয়েছে। প্রজাপতি বা প্রাণের ভোগক্তৃত্বের নাম ইন্দ্র। এই জন্য বেদে, ইন্দ্র ও প্রজাপতিকে কখনো কখনো যুগ্ম ভাবে সম্বোধন করা হয়েছে।
এই জন্য প্রাণ বা ইন্দ্রের এই চলাচলের যে পথ সকল, তাদের নাম ইন্দ্রিয় এবং উপনিষদে ইন্দ্রিয় শব্দের জায়গায় অনেক সময় ' প্রাণ' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে।
যিনি আমাদের প্রাণসমূহ বা ইন্দ্রিয় সকলের মধ্যে বিজ্ঞাতা, বা যাঁর জ্ঞান বা বোধক্রিয়া আমাদের প্রজ্ঞা বা অনুভূতির আকারে প্রকাশ পাচ্ছে, তিনি আমাদের আত্মা।
এই বিজ্ঞানাত্মা বা যিনি প্রাণসকলের মধ্যে বিজ্ঞাতা তাঁর বিষয়ে প্রশ্নোপনিষদের এই উক্তিটি উদ্ধৃত করা হলো :
" এষ হি দ্রষ্টা স্প্রষ্টা শ্রোতা ঘ্রাতা রসয়িতা মন্তা বোদ্ধা কর্ত্তা বিজ্ঞানাত্মা পুরুষঃ। স পরেऽক্ষর আত্মনি সংপ্রতিষ্ঠতে।। (প্রশ্নোপনিষৎ, মন্ত্র ৪।৯।)----এই বিজ্ঞানাত্মা পুরুষই দ্রষ্টা, ইনিই স্পর্শ করেন, ইনিই শ্রোতা, ঘ্রাতা, ইনিই আস্বাদন করেন, ইনিই কর্ত্তা বা সকল কর্ম্মের সাধক।এই বিজ্ঞানাত্মাই , শ্রেষ্ঠতর অক্ষর আত্মায় সম্প্রতিষ্ঠিত "।
২। হৃদি (হৃদয়ের) অন্তঃ (অন্তরে) জ্যোতিঃ (জ্যোতি)----(যিনি) হৃদয়ের অন্তরে জ্যোতি
স্রষ্টা যেখানে সৃষ্টিকে, 'আমার সৃষ্টি' এই বোধে ধারণ করেছেন, তার নাম 'হৃদয়'। আমরাও হৃদয় দিয়েই 'আমার সন্তান, আমার জীবন, আমার সম্পদ' বলে সকল কিছু ধরে রেখেছি। উপনিষদের একাধিক অংশে হৃদয়ের কথা বলা হয়েছে।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম ব্রাহ্মণে, ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, যে হৃদয় হলো ব্রহ্মের ষষ্ঠ পাদ বা ষষ্ঠ অভিব্যক্তি। হৃদয়কে 'স্থিতি' এই বোধে উপাসনা করতে।
ষষ্ঠ সংখ্যাটি মধুবাচক; যেমন মধুমক্ষিকারা ষট্পদা। হৃদয়েই মধুচক্র স্থিত এবং মন্ত্ররূপ মধু মক্ষিকারা হৃদয়েই আসক্ত। আমরা যে মন্ত্রময়, বাঙ্ময়, অনুভূতির বিশ্বে বেঁচে আছি, সেখানে সকল কিছুকে ‘আমি' বা ‘আমার' বলে ধরে রেখেছি; যেমন আমার সন্তান, আমার সম্পদ, এইভাবে সবকিছু আমরা হৃদয়ের দ্বারাই ধরে রেখেছি।
সেইরকম স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, ব্রহ্মরূপে নিজেকে সর্ব্বাকারে প্রকাশ করে, তাঁর সেই প্রতিটি সত্তাকে হৃদয়ের দ্বারাই 'আমার সৃষ্টি, আমার সন্তান’ বলে ধরে রেখেছেন। তাই উপনিষদে বলা হয়েছে,‘হৃদয়ম্ ব্রহ্ম’। এই হৃদয়ই ভোগের ক্ষেত্র, আমাদের সমস্ত অনুভূতির কেন্দ্র।স্থিতি না হলে ভোগ হয় না; এই সৃষ্টির সার্থকতা হয় না।তাই হৃদয়কে 'স্থিতি' এই বোধে উপাসনা করতে ঋষি বলেছেন। হৃদয়ের দ্বারাই এই বিশ্ব স্থিতি শীল হয়েছে এবং আমরা জীবনময় হয়েছি, আয়ুষ্মান হয়েছি।
হৃদয় মানে যেখানে আহরণ (হৃ) এবং দান (দ) এই দুই কর্ম্ম সম্পন্ন হয় এবং যা এই দুইয়ের নিয়ন্ত্রণ (যমন —য/য়) কেন্দ্র। আমরা এই বিশ্বকে গ্রহণ করছি হৃদয়ের দ্বারা, এবং নিজেদেরকে এই বিশ্বতে বিতরণ করছি, বিলিয়ে দিচ্ছি এই হৃদয়ের দ্বারাই। আর এই আত্মস্বরূপই হৃদয় গুহার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আমাদেরকে বা আমাদের হৃদয়কে দোল দিচ্ছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন।( হৃদয়রূপ গুহার প্রসঙ্গে, কঠোপনিষদের মন্ত্র ১।৩।১ দ্রষ্টব্য। )
এই হৃদয়ে যা কিছু বিধৃত তা আত্মজ্যোতি, বা আত্মারই জ্যোতি, স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার উদ্ভাসন। তাই বলা হলো এই আত্মাই হৃদয়স্থ অন্তর্জ্যোতি।
৩। স (সে/ তিনি) সমানঃ সন্ (সমান হওয়াতে) উভৌ (উভয়) লোকৌ (দুই লোকে) অনুসংচরতি (অনুসঞ্চরণ / বিচরণ করেন) , ধ্যায়তি ইব (যেন ধ্যান করছেন বা ভাবছেন) লেলায়তি ইব (যেন কম্পিত হচ্ছেন, লেহন করছেন)------ তিনি সমান হওয়াতে উভয় লোকে অনুসঞ্চরণ (বিচরণ) করেন , যেন ধ্যান করছেন বা ভাবছেন, যেন আস্বাদন করছেন, লেহন করছেন
উভৌ (উভয়) লোকৌ (দুই লোকে) অনুসংচরতি (অনুসঞ্চরণ /বিচরণ করেন))----উভয় লোক অর্থে ইহলোক বা জাগ্রত অবস্থা/ জাগ্রতপাদ এবং পরলোক বা সুপ্তি বা সম্প্রসাদ (ঘুমের অবস্থা)।
স (সে/ তিনি) সমানঃ সন্ (সমান হওয়াতে)----এই বাক্যের তাৎপর্য হলো যে সেই আত্মা, সমান থেকেই বা সমান ভাবেই জাগ্রত এবং সুপ্ত অবস্থায় বিচরণ করেন বা বিদ্যমান থাকেন।
ধ্যায়তি ইব (যেন ধ্যান করছেন বা ভাবছেন) -----ধ্যায়তি ইব/যেন ধ্যান করছেন। ধ্যান= ধি +অ+অন = নিজেতে ধারণ করে প্রাণময় করা। এই স্রষ্টা সৃষ্টিকে নিজেতে ধারণ করেছেন এবং প্রাণময় করেছেন।
লেলায়তি ইব (যেন আস্বাদন এবং লেহন করছেন)----স্রষ্টা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সেই প্রতি সৃষ্টিকে আস্বাদন এবং লেহন করছেন। তাই জিভ বা জিহ্বা থেকে বাক্ বাক্যের আকারে উচ্চারিত হচ্ছেন, প্রজ্ঞা বা বোধ বাক্যের আকারে মূর্ত্ত হচ্ছেন, আর সেই প্রতি মূর্ত প্রকাশকে লেহন এবং আস্বাদন করছেন। শব্দোচ্চারণ এবং আস্বাদন এই দুইই জিহ্বার ধর্ম্ম--জায়তে চ হুয়তে চ----নিজেকে জাত (জি) করছেন এবং সেই জাতককে নিজেতেই আহুতি (হু) দিচ্ছেন----নিজেই নিজেকে দ্বিতীয় করে জাত করে তাকে আস্বাদন করছেন। তাই জিহ্বার নাম 'রসনা'। এই আস্বাদনের দ্বারা, আত্মরসের দ্বারা আমার এঁতে দ্রবীভূত হচ্ছি বা এক হয়ে যাচ্ছি। ( স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা , যিনি প্রাণাগ্নি, তাঁর লেলায়মান সপ্ত জিহ্বার নাম, মুণ্ডকোপনিষদের ১ম মুণ্ডক / ১ম অধ্যায়, দ্বিতীয়. খণ্ড, চতুর্থ মন্ত্রে উক্ত হয়েছে। )
৮ম মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক, ৪।৩।৮।)
স বা অয়ং পুরুষো জায়মানঃ, শরীরমভিসম্পদ্যমানঃ পাপ্মভিঃ সংসৃজ্যতে; স উৎক্রামন্ ম্রিয়মাণঃ পাপ্মনো বিজহাতি। ৪।৩।৮।
অন্বয় এবং অর্থ।
স বা অয়ং (সেই এই) পুরুষো (পুরুষ) জায়মানঃ ( জায়মান্ বা জাত হয়ে), শরীরম্ অভিসম্পদ্যমানঃ (শরীর অভিমানী হয়ে / শরীরকে প্রাপ্ত হয়ে) পাপ্মভিঃ (পাপ সকলের সাথে) সংসৃজ্যতে (সংসৃষ্ট হন বা সৃষ্ট হন) ; স (তিনি) উৎক্রামন্ (উৎক্রমন করে) ম্রিয়মাণঃ (মৃত হয়ে) পাপ্মনো (পাপ সকলকে) বিজহাতি (পরিত্যাগ করেন)। ৪।৩।৮।
অর্থ।
সেই এই পুরুষ জায়মান্ (জাত) হয়ে, শরীর অভিমানী হয়ে (শরীরকে প্রাপ্ত হয়ে), পাপ সকলের সাথে সংসৃষ্ট হন বা সৃষ্ট হন; তিনি উৎক্রমন করে, মৃত হয়ে (শরীর অভিমানকে হত্যা করে), পাপ সকলকে পরিত্যাগ করেন। ৪।৩।৮।
নিরুক্ত
১। স বা অয়ং (সেই এই) পুরুষো (পুরুষ) জায়মানঃ ( জায়মান্ বা জাত হয়ে) , শরীরম্ অভিসম্পদ্যমানঃ (শরীর অভিমানী হয়ে / শরীরকে প্রাপ্ত হয়ে) পাপ্মভিঃ (পাপ সকলের সাথে) সংসৃজ্যতে (সংসৃষ্ট হন বা সৃষ্ট হন) ----সেই এই পুরুষ জায়মান্ (জাত) হয়ে, শরীর অভিমানী হয়ে (শরীরকে প্রাপ্ত হয়ে), পাপ সকলের সাথে সংসৃষ্ট হন বা সৃষ্ট হন
নিদ্রিত অবস্থা বা সম্প্রসাদ থেকে অথবা স্বপ্ন থেকে পুরুষ যখন জাগ্রত অবস্থায় যান, তখন তাঁর শরীর বোধ পুনরায় প্রকাশ পায়। জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা দেখি, যা শুনি, যা কিছু অনুভব করি, তাদের দ্বারাই অভিভূত হয়ে থাকি। যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, আমরা যে সর্ব্বদা জ্ঞানময় এবং প্রতি জ্ঞান বা বোধের মূলে সর্ব্বদা 'নিজ' বা 'আত্মবোধ' রয়েছেন এই খেয়াল থাকে না। আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, যখন 'আছি বা নেই', এই বোধও থাকেনা, তখনও এই 'নিজবোধ বা যিনি অবিনশ্বর আত্মা তিনি থাকেন।যে কারণে ঘুমের পর, আমরা বুঝতে পারি যে ঘুমিয়ে ছিলাম; যে কারণে অনেক সাধারণ মানুষ বা শিশুদের পূর্ব্ব জীবনের স্মৃতি থাকে। এই নিজ বা আত্মবোধের উপর ভর করেই আমরা 'আমি' বা 'অহং' বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করি এবং সকল কিছু বোধ করি। এর নাম বেঁচে থাকা। তাহলে প্রকৃতপক্ষে, এই বিশ্ব আমার অন্তরে জ্ঞান বা বোধেরই মূর্ত্তি এবং এই নিজবোধ স্বরূপ আত্মাই 'আমিত্ব' এবং অন্যান্য বোধাকারে অনবরত জাত হচ্ছেন। নিরন্তর জাত হচ্ছেন বলে এঁর নাম 'নিজ' এবং জাত হয়ে যেমন তেমনি থাকেন বা জাত হয়েও জাত হননা তাই এঁর নাম নিজ (নি---নাস্তি জন্ম যস্য)। সবাই এঁকে 'নিজ' বলেই অনুভব করে এবং বিশ্ব ভূবন এঁরই আত্মপ্রকাশ। ইনি নিষ্কল, নিষ্ক্রিয়, শান্ত, অপরিণামী হয়েও সকল কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। আত্মজ্ঞান না থাকায়, বিশ্বকে আমরা 'দ্বিতীয়' বা নিজের থেকে আলাদা বলে দর্শন করি। দ্বিতীয় দর্শন থেকে মৃত্যু হয়। (মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য় ইহ নানেব পশ্যতি----মৃত্যুর পর মৃত্যু সে প্রাপ্ত হয়, যে ইহলোকে নানা (দ্বিতীয়) দর্শন করে।কঠোপনিষৎ মন্ত্র ২।১।১০।) পাপই মৃত্যু। (পাপ্মানং মৃত্যুম্----পাপ রূপ মৃত্যুকে----বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, মন্ত্র ১।৩।১১। ) যখন সবই নিজের প্রকাশ হয়ে যায়, তখন মৃত্যুও আত্মপ্রকাশ, তখন আর তথাকথিত মৃত্যু দর্শন হয় না, বাধ্যতামূলক, আবশ্যকতার দ্বারা পরিচালিত যে জীবন ধারা তার অবসান হয়।
তাই স্থূলবোধে, দ্বিতীয় জ্ঞানে, এই যে আমরা রয়েছি, এই স্থিতি মৃত্যু বা পাপের সাথে সৃষ্ট, মৃত্যু বা পাপের দ্বারা গ্রস্ত।
২। স (তিনি) উৎক্রামন্ (উৎক্রমন করে) ম্রিয়মাণঃ (মৃত হয়ে) পাপ্মনো (পাপ সকলকে) বিজহাতি (পরিত্যাগ করেন)---তিনি উৎক্রমন করে, মৃত হয়ে (শরীর অভিমানকে হত্যা করে), পাপ সকলকে পরিত্যাগ করেন।
প্রাণ থেকে তিনটি ক্রম সৃষ্টি হয়। এই তিনটি ক্রমকে আমরা সৃষ্টি, স্থিতি লয় বা ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান এবং অতীত বলে অনুভব করছি। প্রাণের এই ক্রমণ-ধর্ম্মী ব্যক্তিত্বকে বেদ ত্রিবিক্রম বিষ্ণু বলে অভিহিত করেছেন। প্রাণই আমাদের এক লোক থেকে অন্যলোকে বা এক প্রকার কাল ক্রম থেকে অন্য প্রকার কালক্রমে নিয়ে যান। মৃত্যু কালে প্রাণ উৎক্রমণ করেন,তাই আমরা শরীর বা পৃথিবী থেকে উৎক্রমণ করে অন্যলোকে বা অন্য প্রকার কালক্রমের মধ্যে প্রবেশ করি। উপনিষদের নানা অংশে প্রাণের উৎক্রমণের কথা বলা আছে। প্রাণ যখন উৎক্রমণ করেন তখন তাঁর সাথে অন্যান্য প্রাণ বা ইন্দ্রিয় শক্তিরাও উৎক্রমণ করতে বাধ্য হন। যিনি থাকলে সব থাকে, এবং যিনি উঠলে তাঁর সাথে আর সবাই উঠে পড়ে, তাঁর নাম প্রাণ।
এই প্রাণ যখন উৎক্রমণ করে আমাদের অমৃতে নিয়ে যান, তখন আর উৎক্রমণের বোধ হয় না। তখন মনে হয় না যে কোথায় যাচ্ছি, তখন আমরা উৎক্রমণের সময়ে দেখি যে প্রাণেতেই রয়েছি, অপ্রাণ হচ্ছি না। তাই উপনিষদে উক্ত হয়েছে যে, প্রাণ যখন উৎক্রমণ করতে গেলন ইন্দ্রিয়রা বা ইন্দ্রিয় দেবতারা বলেছিলেন , " মা উৎক্রমীঃ ----- উৎক্রমণ করো না" । (প্রশ্নোপনিষৎ মন্ত্র ২।১২ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষৎ মন্ত্র ৬।১।১৩ দ্রষ্টব্য।) " উৎক্রমণ করো না"এ কথার অর্থ , " তুমি যখন উৎক্রমণ করবে, আমরা যেন উৎক্রমণ কে অনুভব করি না-------আমরা যেন জানি যে আমরা তোমাতেই রয়েছি, আমার যেন বোধ করিনা যে আমরা 'অপ্রাণ' বা প্রাণহীন হচ্ছি"।এই রকম যে উৎক্রমণ, যাতে মৃত্যু দর্শন হয় না, তার নাম 'উদ্গান'। উপনিষদে উক্ত হয়েছে, মুখ্য প্রাণ ( মৃত্যুহীন বিশ্বপ্রাণ ) উদ্গান করেছিলেন আর সেই উদ্গানে, চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয় বা প্রাণের খণ্ড খণ্ড স্বরূপরা যারা ক্ষয়িষ্ণু বা মৃত্যুগ্রস্ত হয়েছিল, যারা ছিল সীমিত, তারা মৃত্যুর পরপারে গিয়ে দেবতা বা অনন্ত হয়েছিল। তখন যা কিছু অদৃষ্ট ছিল তাও দৃষ্ট হয়, যা কিছু অশ্রুত ছিল তাও শ্রুত হয়, যা কিছু অজ্ঞাত ছিল তাও জ্ঞাত হয়। তখন চক্ষু হয়ে যায় সূর্য, শ্রোত্র হয়ে যায় দিক্ সমূহ, ঘ্রাণ হয়ে যায় পৃথিবী, আস্বাদন হয়ে যায় অপ্, স্পর্শ হয়ে যায় বায়ু, কথা হয়ে যায় অগ্নি, এবং এই ভাবে সমস্ত কিছু দেবময় বা অন্তহীন, মৃত্যু হীন চেতনার অভিব্যক্তি হয়ে যায়। তাই বলা হলো যে তিনি উৎক্রমন করে, মৃত বা ম্রিয়মান হয়ে (শরীর অভিমানকে হত্যা করে), পাপ সকলকে পরিত্যাগ করেন।
ঘোড়া যেমন সবলে খুঁট কে উৎপাটিত করে খুঁট এবং রজ্জু সহ বন্ধন মুক্ত হয়, সেই রকমই প্রাণ ইন্দ্রিয়দের নিয়ে উৎক্রমণ করেন। ( বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, মন্ত্র ৬।১।১৩ দ্রষ্টব্য) তাই ঘোড়ার নাম 'অশ্ব'। শ্ব মানে কাল বা প্রাণ গতি। নিজের ক্ষুদ্রতাকে, সীমাময় অবস্থাকে, বর্ধন করে দেবত্ব বা অন্তহীন অবস্থায় নিয়ে যান ,এর নাম 'অশ্বৎ' অর্থাৎ স্ফীত হওয়া।(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ. ১।২।৭ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) 'অশ্বৎ' স্বব্দটি শ্বি ধাতু থেকে হয়েছে; শ্বি অর্থে স্ফীত হওয়া। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ. ১।২।৭ মন্ত্র দ্রষ্টব্য.।) আবার ইনিই ব্রহ্ম কেননা ইনি নিরন্তর বহু হচ্ছেন, বর্ধিত হচ্ছেন। ( এই ব্রহ্মাণ্ড স্ফীত হচ্ছে, এ কথা আধুনিক বিজ্ঞানও জানে।)
ইনি 'অশ্ব' হয়ে মনুষ্যদের, 'হয়' হয়ে দেবতাদের, 'বাজী' হয়ে গন্ধর্ব্বদের এবং 'অর্ব্বা' হয়ে অসুরদের মৃত্যুর পরপারে নিয়ে যান। এই অশ্ব অবিনশ্বর এবং শ্ব বা কাল হয়ে, নিশ্বাস এবং প্রশ্বাস হয়ে সবাইকে শাসন করছেন, নিজেতে আকর্ষণ করছেন। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, মন্ত্র ১।১।২ দ্রষ্টব্য।)
আবার এই প্রাণ, এই আত্মস্বরূপ যিনি নিয়ন্তা, তিনি যখন আমাদের জাগ্রত অবস্থা থেকে সুপ্তিতে নিয়ে যান, তখনো আমরা শরীর বোধ, দ্বিতীয়তার দ্বারা অভিভূত স্থূলত্বকে বর্জ্জন করে সুপ্ত হই। ।
৯ম মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক, ৪।৩।৯।)
তস্য বা এতস্য পুরুষস্য দ্বে এব স্থানে ভবত, ইদং চ পরলোক স্থানং চ; সংধ্যং তৃতীয়ং স্বপ্নস্থানং; তস্মিন্ সন্ধ্যে স্থানে তিষ্ঠন্নেতে উভে স্থানে পশ্যতি -----ইদং চ পরলোকস্থানং চ । অথ যথাক্রমোऽয়ং পরলোকস্থানে ভবতি তমাক্রমমাক্রম্যোভয়ান্পাপ্মন আনন্দাংশ্চ পশ্যতি; স যত্র প্রস্বপিতি, অস্য লোকস্য সর্ব্বাবতো মাত্রামপাদায় স্বয়ং বিহত্য, স্বয়ং নির্ম্মায়, স্বেন ভাসা, স্বেন জ্যোতিষা প্রস্বপিতি, অত্রায়ং পুরুষঃ স্বয়ং জ্যোতির্ভবতি।। ৯।।
অন্বয় এবং অর্থ।
তস্য বা এতস্য (সেই এই) পুরুষস্য (পুরুষের) দ্বে এব (দুইটি) স্থানে ভবতঃ (স্থান হয়)----ইদং (ইহ) চ পরলোকস্থানং চ (এবং পরলোকস্থান); সন্ধ্যং (সন্ধ্যা / সন্ধি) তৃতীয়ং (তৃতীয়) স্বপ্নস্থানং (স্বপ্নস্থান); তস্মিন্ (সেই) সন্ধ্যে স্থানে (সন্ধ্যা স্থানে) তিষ্ঠন্নেতে (স্থিত হয়ে) উভে স্থানে (উভয় স্থান) পশ্যতি (দর্শন করে)---ইদং চ পরলোকস্থানং চ (ইহ এবং পরলোক স্থান)। অথ (এখন) যথা (যে) ক্রমঃ ( ক্রম বা গতির ধারাবাহিকতা ) অয়ং (এই ) পরলোকস্থানে ভবতি (পরলোকস্থানে হয় / পরলোকস্থানে গমন করেন) তম্ আক্রমম্ (সেই ক্রম বা গতিধারা অনুসারেই) আক্রম্য (ক্রমণ করে) উভয়ান্ (উভয় কে) পাপ্মন্ আনন্দান্ চ (পাপ সকল এবং আনন্দ সকলকে) পশ্যতি (দেখেন) ; সঃ (সে/ তিনি) যত্র (যেখানে) প্রস্বপিতি (স্বপ্নময় হন), অস্য (এই) লোকস্য (লোকের) সর্ব্বাবতো (সর্ব্বতো ভাবে) মাত্রাম্ (মাত্রাকে) অপ আদায় (আদায় করে/ অপহরণ করে) স্বয়ং (স্বয়ং) বিহত্য (হত্যা করে বা বিলুপ্ত করে), স্বয়ং নির্ম্মায় (,স্বয়ং নির্ম্মাণ করে), স্বেন (নিজের) ভাসা (ভা বা আভার দ্বারা), স্বেন (নিজের) জ্যোতিষা (জ্যোতির দ্বারা) প্রস্বপিতি (স্বপ্নময় হন), অত্র(এই স্থানে) অয়ং (এই) পুরুষঃ(পুরুষ) স্বয়ং জ্যোতিঃ (স্বয়ং জ্যোতি) ভবতি (হন)।। ৪।৩।৯।
অর্থ।
সেই এই পুরুষের দুইটি স্থান হয়----ইহ এবং পরলোকস্থান; সন্ধ্যা (সন্ধি) তৃতীয়, স্বপ্নস্থান; সেই সন্ধ্যা স্থানে স্থিত হয়ে উভয় স্থান দর্শন করেন---ইহ এবং পরলোক স্থান। এখন যে ক্রম (গতির ধারাবাহিকতায়) এই পরলোকস্থানে গমন করেন, সেই ক্রম অনুসারেই ক্রমণ করে, উভয় কে--- পাপ সকল এবং আনন্দ সকলকে দেখেন; তিনি যেখানে স্বপ্নময় হন, এই (ইহ) লোকের মাত্রাকে সর্ব্বতোভাবে আদায় করে (অপহরণ করে), স্বয়ং (দেহাত্মবোধকে) হত্যা করে (বিলুপ্ত করে), স্বয়ং (সকল কিছু) নির্ম্মাণ করে, নিজের ভা বা আভার দ্বারা , নিজের জ্যোতির দ্বারা স্বপ্নময় হন। এই স্থানে এই) পুরুষ স্বয়ং জ্যোতি হন।। ৯।।
নিরুক্ত।
১। তস্য বা এতস্য (সেই এই) পুরুষস্য (পুরুষের) দ্বে এব (দুইটি) স্থানে ভবতঃ (স্থান হয়)----ইদং (ইহ) চ পরলোকস্থানং চ (এবং পরলোকস্থান); সংধ্যং (সন্ধ্যা / সন্ধি) তৃতীয়ং (তৃতীয়) স্বপ্নস্থানং (স্বপ্নস্থান); তস্মিন্ (সেই) সন্ধ্যে স্থানে (সন্ধ্যা স্থানে) তিষ্ঠন্নেতে (স্থিত হয়ে) উভে স্থানে (উভয় স্থান) পশ্যতি (দর্শন করে)---ইদং চ পরলোকস্থানং চ (ইহ এবং পরলোক স্থান)।------সেই এই পুরুষের দুইটি স্থান হয়----ইহ এবং পরলোকস্থান; সন্ধ্যা (সন্ধি) তৃতীয়, স্বপ্নস্থান; সেই সন্ধ্যা স্থানে স্থিত হয়ে উভয় স্থান দর্শন করেন---ইহ এবং পরলোক স্থান
সন্ধি স্থান------ মূল মন্ত্রে 'সংধ্য' শব্দটি 'সন্ধি' অর্থে উক্ত হয়েছে। সংধ্য শব্দের একটি অর্থ 'সন্ধি স্থান' এবং আর একটি অর্থ, 'সম্+ধ্য' অর্থাৎ 'সম্যক্ ধ্যান'। স্বপ্নকে সন্ধি স্থান বলা হয়েছে। এই স্বপ্নস্থানে, এই আত্মা আমাদেরকে দেখেন,আমাদের সম্যক্ পর্যালোচনা করেন। এই স্বপ্নাবস্থায় আমাদের সংস্কার সংস্কৃত হয় বা উন্নত হয়, যাতে আমাদের মুক্তি বা আত্মোপল্বদ্ধি সুগম হয়। এই উপনিষদের একাদশ মন্ত্রে বলা হয়েছে, স্বপ্নের দ্বারা শরীর বোধকে দূর করে, এই অসুপ্ত বা চির জাগ্রত আত্মা, যে সুপ্ত তাকে দর্শন করেন।
এই স্বপ্ন স্থানে, ইনি, এই অমৃত আত্মা, তাঁর মৃত্যুর ঊর্ধে অমৃতময় যে স্বরূপ তা এবং মৃত্যুর অধীন যে রূপ, এই দুইই দর্শন করেন। তাই বলা হলো, যে স্থান তৃতীয়, যা স্বপ্ন বা সংধ্য /সন্ধি স্থান, সেইখানে স্থিত হয়ে ইহ এবং পরলোক, এই উভয় স্থানই দর্শন করেন। পরলোক অর্থে যা 'পর' বা শ্রেষ্ঠতর লোক। ইহ অর্থে ' তাৎক্ষণিক '----কোথা থেকে উৎপন্ন তা অজ্ঞাত এবং কোথায় অন্ত তাও অজ্ঞাত---- কালের এইরকম অনুশাসন যে লোকে চলছে তার নাম 'ইহলোক'।
২। অথ (এখন) যথা (যে) ক্রমঃ (ক্রম বা গতির ধারাবাহিকতা) অয়ং (এই )পরলোকস্থানে ভবতি (পরলোকস্থানে হয় / পরলোকস্থানে গমন করেন) তম্ আক্রমম্ (সেই ক্রম বা গতিধারা অনুসারেই) আক্রম্য (ক্রমণ করে) উভয়ান্ (উভয় কে) পাপ্মন্ আনন্দান্ চ (পাপ সকল এবং আনন্দ সকলকে) পশ্যতি (দেখেন-----এখন যে ক্রম বা গতির ধারাবাহিকতায় এই পরলোকস্থানে গমন করেন, সেই ক্রম অনুসারেই ক্রমণ করে, উভয় কে--- পাপ সকল এবং আনন্দ সকলকে দেখেন
যে ধারায় বা ধারাবাহিকতায় এই অমৃত আত্মা আমাদের জাগ্রত অবস্থা থেকে সুপ্তিতে নিয়ে যান, তারই বিপরীত ক্রমে ইনি আমাদের সুপ্তি থেকে জাগ্রত অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সেই রকমই, যে ধারাবাহিকতায় আমরা দেহত্যাগের পর নানা অবস্থান্তরের মধ্য দিয়ে বা নানা লোকে জন্ম নিই, তারই বিপরীত ক্রমে পুনরায় সেই লোকসকলের মধ্য দিয়ে বা সেই পথেই প্রত্যাবর্ত্তন করি শরীর ধারণ করতে বা মর্ত্তে মূর্ত্ত হতে।উপনিষদে এই মৃত্যুর পর বিদেহ আত্মার লোক থেকে লোকান্তরে গতি এবং পুনর্জন্মে প্রত্যাবর্ত্তনের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নানা অংশে বলা হয়েছে। ( ছান্দোগ্য উপনিষদ, পঞ্চম অধ্যায়, দশম খণ্ড, বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ৬।২।১৬ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) যেমন বেঁচে থাকাকালীন এবং মৃত্যুর পরবর্ত্তী অবস্থায় আমরা সুখ ও দুঃখ দুইই অনুভব করি, সেই রকমই জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুপ্ত অবস্থায় আমরা সুখ ও দুঃখ উভয়ই অনুভব করি। সুপ্ত অবস্থার যে ভোগ, তা আত্মময়, সেখানে দ্বিতীয়তা থাকে না। এই উপনিষদের পরবর্ত্তী অংশে সুপ্তির যে ভোগ বা সম্প্রসাদ, তার কথা বলা হয়েছে।
৩। সঃ (সে/ তিনি) যত্র (যেখানে) প্রস্বপিতি (স্বপ্নময় হন), অস্য (এই) লোকস্য (লোকের) সর্ব্বাবতো (সর্ব্বোতো bhabe) মাত্রাম্ (মাত্রাকে) অপ আদায় (আদায় করে/ অপহরণ করে) স্বয়ং (স্বয়ং) বিহত্য (হত্যা করে বা বিলুপ্ত করে) , স্বয়ং নির্ম্মায় (স্বয়ং নির্ম্মাণ করে), স্বেন (নিজের) ভাসা (ভা বা আভার দ্বারা) , স্বেন (নিজের) জ্যোতিষা (জ্যোতির দ্বারা) প্রস্বপিতি (স্বপ্নময় হন), অত্র (এই স্থানে) অয়ং (এই) পুরুষঃ(পুরুষ) স্বয়ং জ্যোতিঃ (স্বয়ং জ্যোতি) ভবতি (হন)----তিনি যেখানে স্বপ্নময় হন, এই (ইহ) লোকের মাত্রাকে সর্ব্বতোভাবে আদায় করে (অপহরণ করে), স্বয়ং (দেহাত্মবোধকে) হত্যা করে (বিলুপ্ত করে), স্বয়ং (সকল কিছু) নির্ম্মাণ করে, নিজের ভা বা আভার দ্বারা , নিজের জ্যোতির দ্বারা স্বপ্নময় হন। এই স্থানে এই) পুরুষ স্বয়ং জ্যোতি হন
প্রস্বপিতি বা স্বপিতি শব্দটি 'স্বপ্' ধাতু থেকে হয়েছে। স্বপ্ অর্থে, স্ব + আপ/ আপ্তি বা নিজেতে বা আত্মাতে আপ্তি রূপ ক্রিয়া, অথবা স্বপ্ অর্থে, সু বা সুখ স্বরূপ আত্মায় আপ্তি রূপ ক্রিয়া (সু + আপ্/আপ), এই দুই অর্থই হয়।
সুতরাং ' প্রস্বপিতি ' অর্থে প্রকৃষ্ট রূপে সুপ্ত হন, অথবা প্রকৃষ্ট রূপে স্বপ্নময় হন, এই দুইটি অর্থই হতে পারে ।
মাত্রা অর্থে, এই অমৃত আত্মার মাপ বা পরিমাপ সকল, যাদের দ্বারা ইনি সৃষ্টিকে বা জীবকে নির্ম্মাণ করেন। পরিমাপের যে 'নির্দিষ্টতা', যার তারতম্যে প্রত্যেকে স্বতন্ত্র, এক জন আর এক জন থেকে আলাদা, তার নাম 'মাত্রা'। মাত্রার দ্বারাই ভেদ বা সীমা সৃষ্টি হয়। সুতরাং, জাগ্রতপাদে বা জাগ্রত অবস্থায় যে বিশ্বকে আমরা জানি বা যেখানে আমরা বেঁচে থাকি, সেই বিশ্বের বা লোকের সকল মাত্রাকে গ্রহণ করে, এই একান্ত স্বাধীন অমৃত আত্মা স্বপ্নে সকল কিছু নির্ম্মাণ করেন।
শব্দ,স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চ তন্মাত্রা, এই আত্মস্বরূপের বা চেতনার মাত্রা বা স্পন্দন থেকে সৃষ্ট। নিজেকে নিজে স্পর্শ করবেন বলে চেতনার যে নন্দ বা আনন্দ-ক্ষুব্ধ অবস্থা তার নাম 'স্পন্দন'।
স্বয়ং বিহত্য----জাগ্রত অবস্থায় যে বিশ্ব আমাদের জ্ঞান বা অনুভূতিতে বিদ্যমান থাকে, স্বপ্নে বা সুপ্তিতে তাকে 'বিহত্য' অর্থাৎ বিশেষ ভাবে ইনি হত্যা করেন; এর অর্থ,স্বপ্ন বা সুপ্তি কালে আমাদের শরীর বোধ এবং শরীরী হয়ে যে ভৌতিক জগৎ আমরা উপল্বদ্ধি করি বা তার অনুভূতি, তাকে ইনি বিনাশ করেন।
স্বয়ং নির্ম্মায়----স্বপ্ন বা সুপ্তিতে ইনি নিজেই সকল কিছু নির্মাণ করেন। আত্মস্বরূপে দ্বিতীয়তা নেই। এই আত্মা
সকল কিছুর নিমিত্ত এবং উপাদান কারণ----এঁর দ্বারা বা একমাত্র এঁর নিয়ন্ত্রণেই সকল কিছু নির্ম্মিত হয় এবং যা কিছু নির্ম্মিত হয় তার উপাদানও ইনি। জ্ঞান বা চেতনাই সব এবং সকলের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের নিয়ন্তা বা ঈশ্বর।
নির্মাণ--নিঃ + মান----নিজেকে মাত্রার দ্বারা মান বা আকার-আয়তনময় করা।
স্বেন (নিজের) ভাসা (ভা বা আভার দ্বারা)---নিজের ভা বা আভার দ্বারা
ভাসা শব্দটি ভাস্ ধাতু এবং ভা ধাতু থেকে হয়েছে। এই আত্মশক্তি সৃষ্টিকে নিজের গর্ভে ধারণ বা ভরণ করেন এবং নিজেকেই সৃষ্টির আকারে প্রসব করেন। ভাসা---ভা + অস্ (ক্ষেপণ বা প্রকাশ)---গর্ভ থেকে জ্যোতির্ময় প্রকাশ। এই জন্য গায়ত্রী বা সাবিত্রীর ভর্গকে উপাসনা করা হয়। তাই আত্মশক্তি বাক্কে বাগাম্ভৃণী বা বাক্ অম্ভৃণী বলা হয়, কেননা এই আত্মশক্তি বাক্, আত্মার বীর্য, তেজ বা 'অম্' কে স্বীয় গর্ভে ভরণ করেন। অম্ভৃণ শব্দের অর্থ যা তেজ বা অম্কে ভরণ করে। অম্ভৃণ শব্দের আর একটি অর্থ 'সোমের কলস'।
স্বেন (নিজের) জ্যোতিষা (জ্যোতির দ্বারা) প্রস্বপিতি (স্বপ্নময় হন)----নিজের জ্যোতির দ্বারা ।
জ্যোতি শব্দের অর্থ, উপরে দ্বিতীয় মন্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। নিজের জ্যোতির দ্বারা নির্ম্মাণ করার অর্থ নিজেই নিজের আয়তন বা আকার হন।
উপনিষদে ' স্বপিতি' শব্দটি সুষুপ্তি বা নিদ্রা এবং স্বপ্ন অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে যে 'স্বপিতি' এই অবস্থায় ঘ্রাণ, বাক্য সকল, দর্শন, শ্রুতি, এসব 'স্ব' বা নিজেতে গৃহীত হয়। ( বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, ২।১।১৭।)
প্রস্বপিতি শব্দটির অর্থ, স্ব বা নিজেতে, আত্মত্বে আপ্তি ক্রিয়া বা নিজেতে পাওয়া। স্বপ্নকালে যা কিছু আমরা বাইরের জগতে অনুভব করি, সেই সব এই আত্মা নিজেই নিজেতে নিজের দ্বারা নির্ম্মাণ করেন এবং আমরা স্বপ্নে সে সকল ভোগ করি বা অনুভব করি। ছান্দোগ্য উপনিষদে (ছান্দোগ্য উপনিষৎ ৬।৮।১) বলা হয়েছে যে 'স্বপিতি' অর্থে 'স্বম্ হি অপীতো ভবতি' , অর্থাৎ স্বম্ বা স্বয়ংকে বা নিজেকেই প্রাপ্ত হওয়া। স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি, এই দুই অবস্থার উদ্দেশেই স্বপিতি শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।
১০ম মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক, ৪।৩।১০।)
ন তত্র রথা ন রথযোগা ন পন্থানো ভবন্তি, অথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে; ন তত্রানন্দা মুদঃ প্রমুদো ভবন্তি, অথানন্দান্ মুদঃ প্রমুদঃ সৃজতে; ন তত্র বেশান্তাঃ পুষ্করিণ্যঃ স্রবন্ত্যো ভবন্তি, অথ বেশান্তান্ পুষ্করিণীঃ স্রবন্তীঃ সৃজতে; স হি কর্ত্তা। ৪।৩।১০।
অন্বয় এবং অর্থ।
অর্থ।
১১শ মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক ৪।৩।১১।)
তদেতে শ্লোকা ভবন্তি।
স্বপ্নেন শারীরমভিপ্রহত্যাসুপ্তঃ সুপ্তানভিচাকশীতি।
শুক্রমাদায় পুনরৈতি স্থানং হিরণ্ময়ঃ পুরুষ একহংসঃ।।১১।।
অন্বয় এবং অর্থ।
তৎ (তাতে/ সেই বিষয়ে) এতে শ্লোকাঃ (এই সকল শ্লোক) ভবন্তি (হয়)।
স্বপ্নেন (স্বপ্নের দ্বারা) শারীরম্ (শরীরীকে বা দেহাত্মবোধ কে) অভিপ্রহত্য (হত্যা করে বা লুপ্ত করে) অসুপ্তঃ (অসুপ্ত) সুপ্তান্ (সুপ্তকে) অভিচাকশীতি (দর্শন করে)।
শুক্রম্ (শুক্রকে) আদায় (গ্রহণ করে) পুনঃ (পুনরায়) এতি (আসেন / গমন করেন) স্থানং (স্থানে) হিরণ্ময়ঃ (হিরণ্ময়) পুরুষঃ (পুরুষ ) একঃ (এক/ অদ্বিতীয়) হংসঃ (হংস)।।৪।৩।১১।
অর্থ।
সেই বিষয়ে এই সকল শ্লোক হয়।
" স্বপ্নের দ্বারা শরীরীকে ( বা শরীর অভিমানকে /দেহাত্মবোধকে) হত্যা করে (বা অবশ করে) অসুপ্ত সুপ্তকে দর্শন করেন।
শুক্রকে গ্রহণ করে পুনরায় আসেন (জাগ্রত) স্থানে।(ইনি) হিরণ্ময় পুরুষ এক (অদ্বিতীয়) হংস "।।৪।৩।১১।
নিরুক্ত।
১। স্বপ্নেন (স্বপ্নের দ্বারা) শারীরম্ (শরীরীকে বা দেহাত্মবোধ কে) অভিপ্রহত্য (হত্যা করে বা লুপ্ত করে) অসুপ্তঃ (অসুপ্ত) সুপ্তান্ (সুপ্তকে) অভিচাকশীতি (দর্শন করে)----স্বপ্নের দ্বারা শরীরীকে ( বা শরীর অভিমানকে/দেহাত্মবোধ কে) হত্যা করে (বা অবশ করে) অসুপ্ত সুপ্তকে দর্শন করেন
স্বপ্নে আমরা বিচরণ করি,কর্ম্ম করি, কিন্তু স্বপ্নকালে আমাদের শরীর অবশ হয়ে থাকে। এই সময়ে এই অমৃত আত্মা আমাদের দর্শন করেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতে আমরা বিশুদ্ধ হই, আমাদের সংস্কার গুলো আরো মার্জিত হয় এবং আমরা ক্রমশঃ আত্মজ্ঞতা এবং আত্মার ব্রহ্মত্ব বিষয়ে অবগত হতে থাকি।
আমরা ক্রম দর্শী। জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি আমরা আলাদা আলাদা ভাবে ভোগ করি। যখন জেগে থাকি তখন স্বপ্ন দেখিনা, যখন আমরা ঘুমাই (যাকে গভীর ঘুম, সুষুপ্তি বা deep sleep বলা হয়) তখন স্বপ্ন দেখিনা। জেগে থাকার সময় ঘুমের যে বিশ্রাম তা হয় না। এর নাম ক্রমধারায় ভোগ করা।
এই আত্মত্বে জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি অক্রমে ভোগ হচ্ছে। ' অভিচাকশীতি ' শব্দের তাৎপর্য হলো, 'সদা তাকিয়ে রয়েছেন'। এই অমৃত আত্মা চিরজাগ্রত। এই অসুপ্ত আত্মা , সুপ্ত, আত্মবিস্মৃতিময় আমাদের সর্ব্বদা দেখছেন। এই দৃষ্টি আকর্ষণময়, সদা এই আকর্ষণে আমরা ক্রমশঃ এই আত্মস্বরূপের নিকটস্থ হচ্ছি, ক্রমশঃ মৃত্যুময়, মর্ত্ত সংস্কার ক্ষীণ হচ্ছে। স্বয়ংপ্রকাশ, স্বয়ংজ্যোতি আত্মা মানেই, ইনি দর্শন করছেন।
স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, যিনি অগ্নি বা প্রাণ, তিনি চিরজাগ্রত। আর এই দর্শন বা লক্ষ শক্তির নাম লক্ষ্মী; এনাকে কোজাগরী লক্ষীও বলা হয়। কোজাগরী----কো জাগর্তি----কে জেগে আছ? ঋক্ বেদে বলা হয়েছে, আগ্নি বা প্রাণই চির জাগ্রত। স্বয়ংপ্রকাশ আত্মাই অগ্নি। এই বিষয়ে ঋক্ বেদ, পঞ্চম মণ্ডল, ৪৪শ সূক্তের দুইটি মন্ত্র নীচে উদ্ধৃত করা হলো।
যো জাগার তমৃচঃ কাময়ন্তে যো জাগার তমু সামানি যন্তি। যো জাগার তময়ং সোম আহ তবাহমস্মি সখ্যে ন্যোকাঃ ----- যে জেগে থাকে তাকে ঋক্ সকল বা আত্মার ঋক্ রূপ বেদন থেকে জাত দেবতারা কামনা করছে; যে জেগে থাকে তাতে সাম সকল বা আত্মার সাম রূপ বেদন থেকে জাত দেবতারা গমন করছে; যে জেগে থাকে তাকে এই সোম বলেন যে 'আমি তোমার সখ্যতায় বদ্ধ'। (ঋক্ বেদ, ৫।৪৪।১৪)।
অগ্নিজাগার তমৃচঃ কাময়ন্তেऽগ্নিজাগার তমু সামানি যন্তি। অগ্নিজাগার তময়ং সোম আহ তবাহমস্মি সখ্যে ন্যোকাঃ।।------অগ্নিই জেগে আছেন, তাঁকে ঋক্ সকল বা আত্মার ঋক্ রূপ বেদন থেকে জাত দেবতারা কামনা করছেন; অগ্নিই জেগে আছেন,তাঁতে সাম সকল বা আত্মার সাম রূপ বেদন থেকে জাত দেবতারা গমন করছেন; অগ্নিই জেগে আছেন, তাকে এই সোম বলেন যে 'আমি তোমার সখ্যতায় বদ্ধ'। (ঋক্ বেদ, ৫।৪৪।১৫)।
২। শুক্রম্ (শুক্রকে) আদায় (গ্রহণ করে) পুনঃ (পুনরায়) এতি (আসেন / গমন করেন) স্থানং (স্থানে) হিরণ্ময়ঃ (হিরণ্ময়) পুরুষঃ (পুরুষ ) একঃ (এক/ অদ্বিতীয়) হংসঃ (হংস)-----শুক্রকে গ্রহণ করে পুনরায় আসেন (জাগ্রত) স্থানে।(ইনি) হিরণ্ময় পুরুষ এক/অদ্বিতীয় হংস
শুক্র = শু (চলা, গতি সম্পন্ন হওয়া) +ক্র (ক্রম)।
শুক্র--কোন প্রকাশের মূলে প্রাণ শুক্র রূপে সেই প্রকাশের বীজ হয়ে উজ্জ্বলতার সাথে বিদ্যমান থাকেন এবং একটি ক্রমধারায় সেই বীজ থেকে প্রকাশটি সম্পন্ন হয়। সেই প্রকাশ কেন্দ্র বা উৎস কে শুক্র বলে। তাই শুক্র অর্থে যা উজ্জ্বল এবং যার থেকে ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পায়। সুতরাং শুক্র অর্থে কোনকিছুর বীজ বোঝায়।
স্বপ্নের পর বা সুষুপ্তির পর, সেই অমৃত আত্মা আমাদেরকে পুনরায় জাগ্রত স্থানে বা জাগ্রত অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। জাগ্রত অবস্থায় যে যে বীজ বা যে যে শুক্রগুলি আমাদের কে ফুটিয়ে, মূর্ত্ত করে, কর্ম্মময় করে রাখে, সেইগুলিকে পুনরায় গ্রহণ করে আমাদেরকে জাগ্রতপাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং সেই শুক্রদের দ্বারাই আমরা আবার জাগ্রতপাদে কর্ম্মময় হই। এই জন্য আমরা ঘুমের আগে যে সব সঙ্কল্প, কামনা ইত্যাদি নিয়ে জাগ্রত থাকি, ঘুমের পর যখন পুনরায় জেগে উঠি, তখন সেই আগের সঙ্কল্প, কামনা ইত্যাদি নিয়েই জাগ্রত অবস্থায় ফিরে আসি; যদিও ঘুমের সময়, 'আমি' বা আমিত্বের বোধ বা অহং বোধ এবং আমার সঙ্কল্প, কামনা সকল সবকিছুই বিলুপ্ত হয়।
হিরণ্ময় = হিংকারময়। প্রাণের যে প্রথম উপল্বব্ধি তার নাম 'হিংকার'। হিং অর্থে 'নিশ্চয়াত্মক' বোধ। মহাপ্রাণের প্রথম উপল্বব্ধি বা মহাপ্রাণের আবির্ভাবের যে প্রথম পর্যায়, তাতে সমস্ত 'অনিশ্চয়তা' বোধ জীবন থেকে দূর হয়ে যায়।এই জন্য, সাম বেদে বা ছান্দোগ্য উপনিষদে, সামের (প্রাণের) প্রথম প্রকাশকে 'হিংকার' বলা হয়েছে।
এই স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, যিনি সবার প্রাণ, যে প্রাণ মৃত্যুর ঊর্ধে, তিনি হিরণ্ময়।
পুরুষ----ইনি পুরুষ কেননা, এঁতে মৃত্যুরূপ পাপ থকে না। পুরুষ = পূর্ব্বম্ ঔষৎ----পূর্বেই যিনি পাপসকলকে (দ্বিতীয় বোধকে বা মৃত্যুকে) ভস্ম করেছিলেন। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ. ১।৪।১।)
পুরুষ---পুর + উষ্ (প্রজ্বলিত হচ্ছেন)----যিনি পুরের মধ্যে প্রদীপ্ত। প্রতি কথা, বা প্রতি বোধ প্রকাশের মধ্যে এই স্বয়ংপ্রকাশ আত্মস্বরূপ নিহিত।
হংস----মহাপ্রাণ, যে কেন্দ্র থেকে সকলকে নিজেতে সংহরণ করছেন (হং) এবং সকলকে প্রকাশ (সবন/ সৃষ্টি) করছেন, তার নাম ' হংস ' ।
হংস = হং (হনন, সংহরণ) + স (সবন--প্রাণ বা সোম প্রকাশ; প্রাতঃ /প্রভাত, মাধ্যংদিন / মধ্যাহ্ন, সায়ম্ / সন্ধ্যা--- এই তিন কালক্রমে প্রাণ প্রকাশ পান এবং আমাদের ভোগ হয়।)----সর্ব্বত্র সঞ্চারী এই মহাপ্রাণই হংস।
একহংসঃ----এই মহাপ্রাণ এক, অদ্বিতীয়, ইনি সর্ব্বত্র প্রাণ সংহরণময় এবং প্রাণ বিতরণময়।
১২শ মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক ৪।৩।১২।)
প্রাণেন রক্ষন্নবরং কুলায়ং বহিষ্কুলায়াদমৃতশ্চরিত্বা।
স ঈয়তেऽমৃতো যত্র কামং হিরণ্ময়ঃ পুরুষ একহংসঃ।।৪।৩।১২।
অন্বয় এবং অর্থ।
প্রাণেন (প্রাণের দ্বারা) রক্ষন্ (রক্ষা করে) অবরং (অবর--যা শ্রেষ্ট থেকে ভিন্ন) কুলায়ং (কুলায় /নীড়/ বাসা---বাসস্থান), বহিঃ কুলায়াৎ (কুলায়ের বাহিরে) অমৃতঃ (অমৃত---যিনি অমৃত) চরিত্বা (বিচরণ করে) সঃ (তিনি) ঈয়তেঃ (যান/গমন করেন) অমৃতঃ (যিনি অমৃত) যত্র (যেখানে) কামং (কাম বা কাম্য সকল বিদ্যমান); হিরণ্ময়ঃ (হিরণ্ময়) পুরুষ (পুরুষ ) একঃ (এক/ অদ্বিতীয়) হংসঃ (হংস)।।৪।৩।১২।
অর্থ।
প্রাণের দ্বারা যা অবর বা শ্রেষ্ট থেকে ভিন্ন যে কুলায় (বা স্থৃৃূূল শরীর), তাকে রক্ষা করে, সেই কুলায়ের বাহিরে যিনি অমৃত তিনি বিচরণ করেন এবং সেই অমৃত (পুরুষ) গমন করেন যেখানে কাম বা কাম্য সকল বিদ্যমান; (ইনি) হিরণ্ময় পুরুষ এক/ অদ্বিতীয় হংস।।৪।৩।১২।
নিরুক্ত।
সুষুপ্তি এবং স্বপ্নের সময় আমরা ভৌতিক শরীরকে ব্যবহার করি না, কিন্তু ঐ সময়ে আমাদের ভৌতিক শরীর প্রাণবন্তই থাকে। এই স্বাধীন অমৃত আত্মাই আমাদের স্থূল (ভৌতিক) শরীর বোধকে দূর করে, আমাদেরকে স্বপ্ন এবং সুষুপ্তির (সংপ্রসাদের) রাজ্যে নিয়ে যান এবং এঁরই নিয়ন্ত্রণে আমাদের শরীর সুষুপ্তি এবং স্বপ্নকালে প্রাণবন্ত থাকে এবং জাগ্রত অবস্থায় পুনরায় সক্রিয় হয়। এই ভাবে স্বপ্নে এবং সুষুপ্তিতে আমরা স্থূল (ভৌতিক) শরীরের বাইরে গিয়ে ভোগ করি।
যিনি আত্মজ্ঞ, যিনি এই স্বাধীন, সর্ব্বত্র বিচরণকারী আত্মাকে জানেন, তিনি শরীরী হয়েও যথেচ্ছ শরীরের বাহিরে বিচরণ করতে পারেন। এই আত্মা যা যা কামনা করেন, তাতেই গমন করেন, তাই প্রাপ্ত হন। ভোক্তা, ভোগ্য এবং ভোগ এই তিনই এই আত্মা এবং এই তিনকেই ইনি সৃষ্টি করেন। আমরা অভাবের তাড়নায় কাম্যের প্রতি ধাবন করি।ইনি নিজের থেকে, নিজের দ্বারাই কাম্যকে সৃষ্টি করে তার প্রতি ধাবন করেন। ইনি ভোক্তা হয়েও অভোক্তা, কর্ত্তা হয়েও নিষ্ক্রিয়। এই আত্মাকে জেনে আত্মজ্ঞও এই ভাবে বিহার করেন।
১৩শ মন্ত্র। (বৃহদারণ্যক ৪।৩।১৩।)
উতেব স্ত্রীভিঃ সহ মোদমানো জক্ষদুতেবাপি ভয়ানি পশ্যন্।।৪।৩।১৩।।
অন্বয় এবং অর্থ।
স্বপ্নান্তে ( স্বপ্ন অবস্থায়) উচ্চ (উচ্চ) (এবং) অবচম্ (নিম্ন) (অবস্থা) ঈয়মানঃ (প্রাপ্ত হয়ে), রূপাণি (রূপ সকল) দেবঃ (দেব/ স্বয়ং প্রকাশ পুরুষ) কুরুতে (করেন/ নির্মাণ করেন) বহূনি (বহু), উত (এবং) ইব (যেন) স্ত্রীভিঃ (স্ত্রীগণের) সহ (সাথে) মোদমানো (আমোদময় হন) জক্ষৎ ( হাস্য/পরিহাস করেন) উত ইব অপি (আবার যেন) ভয়ানি (ভয় সকল) পশ্যন্ (দর্শন করেন)।।৪।৩।১৩।
(জক্ষৎ শব্দটি জক্ষ্ ধাতু থেকে হয়েছে। জক্ষ্ = iocus (Latin) / joke, jest (English) )
অর্থ।
স্বপ্ন অবস্থায় উচ্চ এবং নিম্ন অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে, দেব (স্বয়ং প্রকাশ পুরুষ) বহু রূপ নির্মাণ করেন, এবং যেন স্ত্রীগণের সাথে আমোদময় হন, পরিহাস করেন, আবার যেন ভয় সকল দর্শন করেন।।৪।৩।১৩।
নিরুক্ত।
স্বপ্নাবস্থায় এই স্বয়ং প্রকাশ আত্মা, স্বয়ং জ্যোতির দ্বারাই উচ্চ এবং নিম্ন অবস্থা সকল সৃষ্টি করেন। নিজেতেই ইনি ভীত হন, নিজেই নিজের ভীতি হন, নিজেই স্ত্রীগণ হয়ে নিজেই তাদের সাথে আমোদময়, পরিহাসময় হন। এইটি স্বাধীন আপ্তকাম অবস্থা। আত্মজ্ঞ পুরুষও এইভাবে আপ্তকাম হয়ে বিহার করেন। ৪।৩।১৩।
১৪শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।১৪।)
অন্বয় এবং অর্থ।
আরামম্ (আরাম/সুখ) অস্য (এই আত্মার উপল্বদ্ধি জনিত সুখ; আত্ম সান্নিধ্যে যে সুখ বোধ হয়) পশ্যন্তি (দেখে/অনুভব করে), ন তং (না তাঁকে) পশ্যতি কঃ চন (কেহ)।ইতি।
তং ন (না তাকে/ যে নিদ্রিত তাকে না ) আয়তং (সহসা) বোধয়েৎ (বোধময় করো/জাগিও) ইতি (ইহা) আহুঃ (বলেন)। দুর্ভিষজ্যং (দুরারোগ্য) ভবতি (হয়) যম্ (যে) এষঃ (ইহাকে / এই জাগ্রত স্থানকে) ন প্রতিপদ্যতে (না পায়/ না যথাযথ ভাবে পায়) । অথঃ (অনন্তর) খলু (অবশ্যই) আহুঃ (বলা হয়), জাগরিতদেশঃ (জাগরিতদেশ----জাগ্রত স্থান) এব (ই) অস্যঃ (এঁর) এষঃ (এই---অর্থা'ৎ স্বপ্ন স্থান) ইতি; যানি হি এব (যা কিছুই) জাগ্রৎ (জাগ্রত অবস্থায়) পশ্যতি (দর্শন করেন) তানি (সেই সবই) সুপ্তঃ (সুপ্ত হয়ে ---- স্বপ্ন অবস্থায় দর্শন করেন) ইতি; অত্র (এখানে) অয়ং (এই) পুরুষঃ (পুরুষ) স্বয়ং জ্যোতিঃ (স্বয়ং জ্যোতি) ভবতি (হয়) ; সঃ (তিনি---তিনি বললেন), "অহং (আমি) ভগবতে (ভগবানকে) সহস্রং (সহস্র) দদামি (দান করছি), অত (এখন) ঊর্ধ্বং (যা ঊর্ধ্ব) বিমোক্ষায় (মোক্ষের জন্য) ব্রুহি ইতি (তা বলুন) । ৪।৩।১৪।
অর্থ।
এই আত্মার থেকে আরাম/সুখ অনুভব করে;তাকে কেহই দেখতে পায় না।
যে নিদ্রিত তাকে সহসা জাগিও না----ইহাই বলেন। যে এই জাগ্রত স্থানকে যথাযথ ভাবে না পায়, তার দুরারোগ্য হয়। অনন্তর অবশ্যই বলা হয়, জাগ্রত স্থানই এঁর এই স্বপ্ন স্থান। যা কিছুই জাগ্রত অবস্থায় দর্শন করেন, সেই সবই স্বপ্ন অবস্থায় দর্শন করেন। এখানে এই পুরুষ স্বয়ংজ্যোতি হন ; তিনি বললেন, "আমি ভগবানকে সহস্র দান করছি, এখন যা ঊর্ধ্ব, মোক্ষের জন্য তা বলুন । ৪।৩।১৪।
নিরুক্ত।
সুষুপ্তি এবং স্বপ্নাবস্থা থেকে জাগ্রত অবস্থায় যে যে ক্রম ধারায় ফিরতে হ্য়, তা যদি ঠিকমত না হ্য়, তবে শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে বা অন্যকোন ব্যাধি হতে পারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে এই উপনিষদে, 'যথাক্রম', 'প্রতিযোনি', 'প্রতিন্যায়' ইত্যাদি যে শব্দ সকল ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে যাওয়ার সময় যথাযথ যে ক্রম অনুধাবন করা হয় তা বলা হয়েছে।
যা কিছু আমরা জাগ্রত অবস্থায় ভোগ করি, সেই সবই আমরা স্বপ্নেও ভোগ করি। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন এবং জাগ্রত অবস্থার ভোগের মধ্যে পার্থক্য থাকে। নিজের বা আত্মার স্বয়ংজ্যোতিত্ব যত উপল্বদ্ধিতে আসে, তত জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তিতে স্বাধীনতা এসে যায়, এই তিন অবস্থাই আত্মপ্রকাশের অন্তর্গত হয়ে যায়।
১৫শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।১৫।)
অন্বয় এবং অর্থ।
সঃ (সে/তিনি) বৈ এষঃ এতস্মিন্ (এই প্রকার) সংপ্রসাদে (সংপ্রসাদে) রত্বা (রত বা রতিময় হয়ে) চরিত্বা (বিচরণ করে), দৃষ্ট্বা (দর্শন করে) এব (এই প্রকারে) পুণ্যং চ পাপং চ (পুণ্য এবং পাপকে), পুনঃ (পুনরায়ে) প্রতিন্যায়ং (প্রতি -নি-----যে দিক থেকে নীত হয়েছিলেন বা যে দিক থেকে সম্প্রসাদ অবস্থায় গিয়েছিলেন) প্রতি যোনি (উৎপত্তি বা উৎস যেখান থেকে উত্থিত হয়ে সম্প্রসাদ অবস্থায় গিয়েছিলেন) আদ্রবতি (আ+ দ্রু----দ্রুত যান) স্বপ্নায় এব (যা স্বপ্নাবস্থা) ; স (তিনি) যৎ তত্র কিঞ্চিৎ (যৎ কিঞ্চিৎ তত্র---যা কিছু সেখানে) পশ্যতি (দর্শন করেন) অনন্বাগত (অন্+অনু+আগত--অনুগত হন না) তেন (তার দ্বারা) ভবতি (হন); অসঙ্গো (অসঙ্গ) হি (অবশ্যই) অয়ং (এই) পুরুষ (পুরুষ) ইতি; এবম্ এব (এই প্রকারই ) এতৎ (ইহা) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য); সঃ (তিনি---তিনি বললেন), " অহং (আমি) ভগবতে (ভগবানকে) সহস্রং (সহস্র) দদামি (দান করছি), অতঃ (এখন) ঊর্ধ্বং (যা ঊর্ধ্ব) বিমোক্ষায় এব (মোক্ষের জন্য) ব্রুহি ইতি (তা বলুন)।। ৪।৩।১৫।
অর্থ।
তিনি এই প্রকার সম্প্রসাদে রতিময় হয়ে, বিচরণ করে,দর্শন করে এই প্রকারে পুণ্য এবং পাপকে, পুনরায়ে যে দিক থেকে সম্প্রসাদ অবস্থায় গিয়েছিলেন সেই দিকে, উৎপত্তি বা উৎস, যেখান থেকে উত্থিত হয়ে সম্প্রসাদ অবস্থায় গিয়েছিলেন সেখানে দ্রুত যান যা স্বপ্নাবস্থা; তিনি যা কিছু সেখানে দর্শন করেন তার দ্বারা অনুগত হন না; অবশ্যই এই পুরুষ অসঙ্গ; এই প্রকারই ইহা যাজ্ঞবল্ক্য; তিনি (জনক) বললেন----- " আমি ভগবানকে সহস্র দান করছি, এখন যা ঊর্ধ্ব তা মোক্ষের জন্য বলুন " ।। ৪।৩।১৫।
নিরুক্ত
সম্প্রসাদ বা স্বপ্ন বিহীন নিদ্রার যে ভোগ তা অন্তর এবং বহিঃ প্রজ্ঞা বিহীন, সেখানে অন্তর এবং বহিঃ একসা হয়ে গেছে। স্বপ্নের যে ভোগ তা অন্তর প্রজ্ঞাময়।
১৬শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।১৬।)
অন্বয় এবং অর্থ।
সঃ (সে/তিনি) বা এষঃ এতস্মিন্ (এই প্রকার) স্বপ্নে (স্বপ্নে) রত্বা (রত বা রতিময় হয়ে) চরিত্বা (বিচরণ করে), দৃষ্ট্বা (দর্শন করে) এব (এই প্রকারে) পুণ্যং চ পাপং চ (পুণ্য এবং পাপকে), পুনঃ (পুনরায়ে) প্রতিন্যায়ং (প্রতি -নি------যে দিক থেকে নীত হয়েছিলেন বা যে দিক থেকে স্বপ্ন অবস্থায় গিয়েছিলেন) প্রতিযোনি (উৎপত্তি বা উৎস যেখান থেকে উত্থিত হয়ে স্বপ্ন অবস্থায় গিয়েছিলেন) (সেখানে) আদ্রবতি (আ+ দ্রু----দ্রুত যান) (যা) বুদ্ধান্তায় এব (বুদ্ধান্ত--- যেখানে বুদ্ধি মন এবং ইন্দ্রিয় সকল সক্রিয়); স (তিনি) যৎ তত্র কিঞ্চিৎ (যৎ কিঞ্চিৎ তত্র---যা কিছু সেখানে) পশ্যতি (দর্শন করেন) অনন্বাগত (অন্+অনু+আগত--অনুগত হন না) তেন (তার দ্বারা) ভবতি (হন); অসঙ্গো (অসঙ্গ) হি (অবশ্যই) অয়ং (এই) পুরুষ (পুরুষ) ইতি; এবম্ এব (এই প্রকারই ) এতৎ (ইহা) যাজ্ঞবল্ক্য (যাজ্ঞবল্ক্য); সঃ (তিনি---তিনি বললেন), "অহং (আমি) ভগবতে (ভগবানকে) সহস্রং (সহস্র) দদামি (দান করছি), অতঃ (এখন) ঊর্ধ্বং (যা ঊর্ধ্ব) বিমোক্ষায় (মোক্ষের জন্য) ব্রুহি ইতি (তা বলুন)।। ৪।৩।১৬।
অর্থ।
তিনি এই প্রকার স্বপ্নে রত বা রতিময় হয়ে, বিচরণ করে, দর্শন করে এই প্রকারে পুণ্য এবং পাপকে, পুনরায় যে দিক থেকে স্বপ্ন অবস্থায় গিয়েছিলেন, উৎপত্তি বা উৎস, যেখান থেকে উত্থিত হয়ে স্বপ্ন অবস্থায় গিয়েছিলেন, সেখানে দ্রুত যান যা বুদ্ধান্ত (জাগ্রত অবস্থা) বা যেখানে বুদ্ধি মন এবং ইন্দ্রিয় সকল সক্রিয়; তিনি যা কিছু সেখানে দর্শন করেন তার অনুগত হন না; এই পুরুষ অবশ্যই অসঙ্গ।
(জনক বললেন) এই প্রকারই ইহা যাজ্ঞবল্ক্য; তিনি (জনক) বললেন, "আমি ভগবানকে সহস্র দান করছি, এখন যা ঊর্ধ্ব, মোক্ষের জন্য তা বলুন "। ৪।৩।১৬।
নিরুক্ত।
১। অসঙ্গ
ইনি স্বপ্নে যা কিছু ভোগ করেন, তা ভোগ করেও অভোক্তাই থাকেন। কেননা ইনি অসঙ্গ। ইনি স্বয়ং জ্যোতিতে সকল কিছু নিজেই হন বা নির্ম্মাণ করেন, তত্রাচ যেমন তেমনি থাকেন। এর নাম অসঙ্গ।
২। সঃ (সে/তিনি) বা এষঃ এতস্মিন্ (এই প্রকার) স্বপ্নে (স্বপ্নে) রত্বা (রত বা রতিময় হয়ে) চরিত্বা (বিচরণ করে), দৃষ্ট্বা (দর্শন করে) এব (এই প্রকারে) পুণ্যং চ পাপং চ (পুণ্য এবং পাপকে), পুনঃ (পুনরায়ে) প্রতিন্যায়ং (প্রতি -নি------যে দিক থেকে নীত হয়েছিলেন বা যে দিক থেকে সম্প্রসাদ অবস্থায় গিয়েছিলেন) প্রতি যোনি (উৎপত্তি বা উৎস যেখান থেকে উত্থিত হয়ে সম্প্রসাদ অবস্থায় গিয়েছিলেন) আদ্রবতি (আ+ দ্রু----দ্রুত যান) বুদ্ধান্তায় এব (বুদ্ধান্ত--- যেখানে বুদ্ধি মন এবং ইন্দ্রিয় সকল সক্রিয়)----তিনি এই প্রকার স্বপ্নে রত বা রতিময় হয়ে, বিচরণ করে, দর্শন করে এই প্রকারে পুণ্য এবং পাপকে, পুনরায় যে দিক থেকে স্বপ্ন অবস্থায় গিয়েছিলেন, উৎপত্তি বা উৎস, যেখান থেকে উত্থিত হয়ে স্বপ্ন অবস্থায় গিয়েছিলেন, সেখানে দ্রুত যান যা বুদ্ধান্ত বা যেখানে বুদ্ধি মন এবং ইন্দ্রিয় সকল সক্রিয়
ইনি স্বপ্নাবস্থা থেকে বুদ্ধান্ত বা জাগ্রত অবস্থায় দ্রুত গমন করেন। দ্রুত শব্দটি দ্রু ধাতু থেকে হয়েছে। দ্রু ধাতুর একটি অর্থ 'তরল হয়ে যাওয়া'। সুতরাং কোন কিছুর জন্য দ্রুত ধাবন করার অর্থ সেইটি প্রাপ্ত হবার কোন কাঠিণ্য থাকলে তাকে তরল করে দেওয়া বা দ্রবীভূত করা; সুতরাং দ্রুত গমন করার অর্থ সুনিশ্চিত ভাবে গন্তব্য স্থলে পৌছন বা যার জন্য যাওয়া তাকে সুনিশ্চিত ভাবে পাওয়া।
৩। সঃ (তিনি---তিনি বললেন), "অহং (আমি) ভগবতে (ভগবানকে) সহস্রং (সহস্র) দদামি (দান করছি), অতঃ (এখন) ঊর্ধ্বং (যা ঊর্ধ্ব) বিমোক্ষায় (মোক্ষের জন্য) ব্রুহি ইতি (তা বলুন)----তিনি (জনক) বললেন, "আমি ভগবানকে সহস্র দান করছি, এখন যা ঊর্ধ্ব, মোক্ষের জন্য তা বলুন
সহস্র দান অথবা সহস্র গোদান অর্থে, নিজের সকল কিছু দান করা। যদিও এখানে 'সহস্র' দান করার কথা বলা হয়েছে, উপনিষদে সহস্র গোদানের কথাও বলা হয়েছে। গো মানে ইন্দ্রিয়, যাদের দ্বারা আমরা গতাগতিময় বা সক্রিয়। গো শব্দটি গম্ ধাতু থেকে হয়েছে যার অর্থ 'চলা'। এই ইন্দ্রিয় বা গরুরা বিচরণ করছে, সক্রিয় হয়েছে এবং তাদের মধ্য দিয়ে অনুভূতি বা জ্ঞান রূপ দুগ্ধ, (শব্দ, স্পর্শ, রূপ,রস, গন্ধ) আমরা পান করছি। আর এই আত্মশক্তি বাক্ই 'দোগ্ধৃ' বা 'গোয়ালার মেয়ে, যে দুধ দোয়', যার নিয়ন্ত্রণে এই ইন্দ্রিয়রা সক্রিয় এবং অনুভূতি বা সোমরূপ রস বিতরণ করছে।
সহস্র শব্দটির অর্থ 'আত্মনা সহ স্রবতি', 'আত্মার সাথে যা প্রবাহিত হচ্ছে'। এই যে আত্ম-নির্ঝর, প্রাণের ঝর্ণা, যা আমার মধ্যে রূপ, রস, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধের আলোড়ন তুলেছে, তা যেখান থেকে উৎসারিত হচ্ছে, তার নাম সহস্রার।
সুতরাং সহস্র দান করছি এর অর্থ, নিজেকে নিবেদন করছি; সহস্র গো-দান করছি এর অর্থ নিজেকে এবং নিজেতে অর্জিত সকল কিছু দান করছি। (এখানে অবশ্যই একহাজারটা গরুকে ধরে বেঁধে দান করার কথা বলা হয়নি।)
১৭শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।১৭।)
স বা এষ এতস্মিন্বুদ্ধান্তে রত্বা চরিত্বা, দৃষ্টৈব পুণ্যং চ পাপং চ, পুনঃ প্রতিন্যায়ং প্রতিযোন্যাদ্রবতি স্বপ্নান্তায়ৈব।। ১৭।।
অন্বয় এবং অর্থ।
সঃ (সে/তিনি) বা এষঃ এতস্মিন্ (এই প্রকার) বুদ্ধান্তে (বুদ্ধান্ত---বুধ্ +অন্ত---যে দিকে বোধ সম্পন্ন হয় বা জাগ্রত অবস্থায়) রত্বা (রত বা রতিময় হয়ে) চরিত্বা (বিচরণ করে), দৃষ্ট্বা (দর্শন করে) এব (এই প্রকারে) পুণ্যং চ পাপং চ (পুণ্য এবং পাপকে), পুনঃ (পুনরায়ে) প্রতিন্যায়ং (প্রতি -নি--যে দিক থেকে নীত হয়েছিলেন বা যে দিক থেকে বুদ্ধান্ত অবস্থায় গিয়েছিলেন) প্রতিযোনি (উৎপত্তি বা উৎস যেখান থেকে উত্থিত হয়ে বুদ্ধান্ত অবস্থায় গিয়েছিলেন) আদ্রবতি (আ+ দ্রু----দ্রুত যান) স্বপ্নান্তায় এব (স্বপ্নাবস্থায়)। ৪।৩।১৭।
অর্থ।
তিনি এই প্রকার বুদ্ধান্তে ----অর্থাৎ জাগ্রত বোধময় বা জাগ্রত অবস্থায় রত বা রতিময় হয়ে বিচরণ করেন, দর্শন করেন এই প্রকারে পুণ্য এবং পাপকে, পুনরায় যে দিক থেকে বুদ্ধান্তে বা জাগ্রত অবস্থায় গিয়েছিলেন, যে উৎপত্তি বা উৎস থেকে উত্থিত হয়ে জাগ্রত অবস্থায় গিয়েছিলেন সেই স্বপ্নাবস্থায় দ্রুত গমন করেন। ৪।৩।১৭।
নিরুক্ত।
ইনি যেমন স্বপ্ন থেকে জাগ্রত অবস্থায় গমন করেন, সেই রকমই জাগ্রত থেকে স্বপ্নাবস্থায় প্রত্যাবর্ত্তন করেন। এই ভাবে জাগ্রত থেকে স্বপ্ন, স্বপ্ন থেকে জাগ্রত এবং সুষুপ্তিতে এবং সুষুপ্তি থেকে স্বপ্ন এবং জাগ্রত অবস্থায় ইনি আমাদের বারবার চালিত করেন। এই ভাবে ক্রমশঃ স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার যে তিনটি প্রকাশ, অর্থাৎ আদিত্য (গৃহপতি অগ্নি), চন্দ্রমা (দক্ষিণাগ্নি) এবং অগ্নি (আহবনীয় অগ্নি) আর তাঁর যে স্বয়ংশক্তিত্ব বাক্, তদ্বিষয়ক প্রজ্ঞার উন্মেষ আমাদের মধ্যে হতে থাকে।
১৮শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।১৮।)
তদ্যথা মহামৎস্য উভে কূলে অনুসংচরতি পূর্ব্ব চাপরং চ, এবমেবায়ং পুরুষ এতাবুভাবন্তাবনুসংচরতি স্বপ্নান্তং চ বুদ্ধান্তং চ।। ৪।৩।১৮।।
অন্বয় এবং অর্থ।
তৎ যথা (যেমন) মহামৎস্যঃ (মহা মৎস্য) উভে (উভয়) কূলে (কূলে) অনুসংচরতি (সঞ্চরণ করেন) পূর্ব্ব (পূর্ব্ব কূল) চ অপরং চ (এবং যা অপর (পশ্চিম) কূল), এবম্ এব (এই প্রকারই) অয়ং (এই) পুরুষঃ (পুরুষ) এতৌ (এই) উভৌ (দুই) অন্তৌ (অন্তে) অনুসংচরতি ( সঞ্চরণ করেন) (যা) স্বপ্নান্তং (স্বপ্নান্ত--স্বপ্ন এবং সম্প্রসাদ অবস্থা) চ বুদ্ধান্তং চ (এবং বুদ্ধান্ত) ।। ৪।৩।১৮।
অর্থ।
যেমন মহামৎস্য উভয় কূলে সঞ্চরণ করে, (যা) পূর্ব্ব (পূর্ব্ব কূল) এবং যা অপর (পশ্চিম কূল) এই প্রকারই এই পুরুষ এই অন্তদ্বয়ে সঞ্চরণ করেন (যা) স্বপ্নান্ত (অর্থাৎ স্বপ্ন এবং সম্প্রসাদ অবস্থা ) এবং বুদ্ধান্ত (অর্থাৎ জাগ্রৎ অবস্থা)। ৪।৩।১৮।
নিরুক্ত।
অপ্ বা জল হলো প্রাণের শরীর। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ মন্ত্র ১।৫।১৩ দ্রষ্টব্য। ) অপ্ই আপ্তি। আপ্তি বা প্রাপ্তির যে তৃপ্তি তা প্রাণই। এই আপ্তিময়, প্রাণময় আমরা এই প্রাণেই জীবন ধারণ করে আছি এবং এই মহাপ্রাণরূপ মহামৎস্য, আমাদেরকে 'মৎ' বা 'মদ্' ভাবময় হয়ে, 'এরা আমারই' এই হার্দ বোধে সৃষ্টিকে বা আমাদেরকে নিজেতে বিধৃত করে, ইনি স্বপ্ন-সুষুপ্তি আর জাগ্রত অবস্থা, এই দুই কূলে বারবার সঞ্চরণ করছ্নে।
১৯শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।১৯।)
তদ্যথাস্মিন্নাকাশে শ্যেনো বা সুপর্ণো বা বিপরিপত্য শ্রান্তঃ সংহত্য পক্ষৌ সল্লয়ায়ৈব ধ্রিয়তে, এবমেবায়ং পুরুষ এতস্মা অন্তায় ধাবতি যত্র সুপ্তো ন কং চন কামং কাময়তে, ন কং চন স্বপ্নং পশ্যতি।। ৪।৩।১৯।।
অন্বয় এবং অর্থ।
তৎ যথা (এই যে) অস্মিন্ আকাশে (এই আকাশে) শ্যেনঃ (শ্যেন পক্ষী) বা সুপর্ণঃ (সুপর্ণ) বা (অথবা সুপর্ণ--যে সুন্দর পর্ণ যুক্ত) বিপরিপত্য (বি+পরি-পৎ; পৎ অর্থে 'ওড়া, পতিত হওয়া'; বিপরিপত্য---যার ওড়া শেষ হয়ে আসছে বা যে গন্তব্য স্থানের দিকে উড়তে উড়তে নমিত হচ্ছে বা নিকটবর্ত্তী হচ্ছে); শ্রান্তঃ (শ্রান্ত হয়ে বা শ্রমহেতু ক্লান্ত হয়ে) সংহত্য (সম্যক্ ভাবে হত্যা করে অর্থাৎ সম্যক্ ভাবে নিষ্ক্রিয় হতে হতে) পক্ষৌ (পক্ষ বা পাখা দুইটিকে) সল্লয়ায় এব (যে দিকে বা যাহাতে লীন হয়, সে দিকে বা তার প্রতি) ধ্রিয়তে (ধারণ করে বা পাখা দুটিকে সেই দিকে চালনা করে), এবম্ এব (এই ভাবেই) অয়ং (এই) পুরুষঃ (পুরুষ) এতস্মৈ অন্তায় (এই অন্তের দিকে) ধাবতি (ধাবন করেন), যত্র (যেখানে) সুপ্তো (সুপ্ত/যে নিদ্রিত) ন কম্ চন কামম্ কাময়তে (কোন প্রকার কাম বা কাম্যকে কামনা করে না), ন কম্ চন স্বপ্নম্ পশ্যতি (কোন প্রকার স্বপ্ন দর্শন করেনা)।। ৪।৩।১৯।।
অর্থ।
এই যে এই আকাশে শ্যেন পক্ষী বা সুপর্ণ (যে সুন্দর পর্ণ যুক্ত), (যে) উড়তে উড়তে গন্তব্য স্থানের দিকে নমিত হচ্ছে বা নিকটবর্ত্তী হচ্ছে, (যে) শ্রান্ত হয়ে, সম্যক্ ভাবে নিষ্ক্রিয় হতে হতে পাখা দুইটিকে যে দিকে বা যাহাতে লীন (সুপ্ত) হয় তার দিকে ধারণ করে (চালনা করে); সেই ভাবেই এই পুরুষ এই অন্তের দিকে ধাবন করেন, যেখানে সুপ্ত কোন প্রকার কাম্যকে কামনা করেন না, কোন প্রকার স্বপ্ন দর্শন করেন না।। ৪।৩।১৯।।
নিরুক্ত।
সুষুপ্তিতে, যে সুপ্ত সে কোন কিছু কামনা করেনা, কোন স্বপ্নো দেখেনা। সুষুপ্তির অবস্থা ২১শ,২২শ,২৩শ ইত্যাদি মন্ত্র সকলে উক্ত হয়েছে।
নিদ্রার সময় আমরা অন্তের দিকে ধাবিত হই, যেখানে সকল কিছু এক অমৃত আত্মাতে বিলীন হয়ে যায়। যেমন দিনের শেষে, পাখী আকাশে উড়তে উড়তে তার কুলায়ের দিকে ধাবিত হয়, সেই রকম সুষুপ্তির সময় আমরা এই অন্তরাকাশের মধ্য দিয়ে জাগ্রতপাদ থেকে সুষুপ্তিতে গমন করি। এই যে আমরা অন্তে ধাবন করি বা জাগরন থেকে নিদ্রার দিকে যাই , তা এই অমৃত আত্মারই জাগ্রত অবস্থা থেকে নিদ্রার রাজ্যে প্রত্যাবর্ত্তন। এই অমৃত আত্মার সুষুপ্তিতে ফিরে যাবার যে দৃশ্য, তা অন্তরাকাশে দর্শন করে, তারই বর্ণনা ঋষি এই ভাবে করেছেন--- একটি শ্রান্ত শ্যেন পক্ষী, যে সুন্দর পক্ষদ্বয় দ্বারা ভূষিত, তাই সুপর্ণ, সে তার সমস্ত কর্ম্মকে সংহত করতে করতে, নিজেতে গুটিয়ে নিতে নিতে বা নিজেতে সংগ্রহ করতে করতে, ক্রমশঃ শান্ত হয়ে আসা পক্ষদুটিকে চালনা করতে করতে সেই অন্তের দিকে ধাবিত হয়, যেখানে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি,যেখানে আমরা কোনকিছু আর চাই না, কোন স্বপ্ন আর দেখিনা!
শ্যেন= শ্য+ইন। ইন, ইন্, ইন্ব, এই শব্দগুলি, 'অন্তরস্থ, অন্তরে স্থিত', উজ্জ্বল (ইন্ধ), দর্শনময় (ইন্দ্র---ইদং দ্রষ্টা) এই সব অর্থ বোধক। শ্য অক্ষরটি কালের শাসন বা অধ্যক্ষতা বাচক। শ্ব মানে কাল, স্ব বা আত্মস্বরূপের নিয়ন্ত্রণময়তা।
অন্তরীক্ষ বা অন্তরের যে আকাশ, তা ঈক্ষণ বা দর্শনময়, প্রাণের ঈক্ষণ বা দৃষ্টিতে উজ্বল। (ঋক্ বেদে একে বিষ্ণুর চক্ষু বলা হয়েছে যা আকাশের ন্যায় বা দ্যুলোকের ন্যায় আতত বা বিস্তৃত । )
আত্মচক্ষুমান্ পুরুষ বা ইন্দ্রকে ( ইদং দ্রষ্টাকে) বেদে 'শ্যেন' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ইনি খেচর, আকাশচারী। যেখানে, আয়তন বা দেশগত দূরত্ব লোপ পায়, তার নাম আকাশ এবং আকাশ হলো 'কাশ' বা প্রকাশময়, দৃষ্টিময়। এঁর দুটি সুন্দর পক্ষ আছে, তাই ইনি 'সুপর্ণ'। শুক্ল এবং কৃষ্ণ পক্ষ, এই দুইটি পাখা মেলে, ইনি উড়ছেন---- অন্তরীক্ষে সোম বা প্রাণের দ্বারা সবাইকে আপ্লুত করছেন তাঁর শুক্লপক্ষের সঞ্চালনে এবং সেই প্রাণের প্লাবনকে আবার নিজেতে আকর্ষণ করে সংযমন করছেন কৃষ্ণপক্ষের সঞ্চালনে।
এই মহাপক্ষীর যে সঞ্চরণ বা গতাগতি, তাতেই আমার জাগ্রত থেকে সুপ্তিতে বা সুপ্তি থেকে জাগরনে প্রবেশ করি।
আমরা সর্ব্বদাই অন্তের দিকে ধাবিত হচ্ছি। প্রতি কর্ম্মে, প্রতি অনুভূতিতে, চেতনার প্রতি প্রকাশে আমরা যেমন নিত্য নূতন হয়ে অভিব্যক্ত হচ্ছি আবার সাথে সাথে অন্তরের ঐ চিৎক্ষেত্রে, যেখান থেকে অভিব্যক্ত হচ্ছি, সেখানেই ফিরে যাচ্ছি।
২০শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২০।)
তা বা অস্যৈতা হিতা নাম নাড্যো যথা কেশঃ সহস্রধা ভিন্নস্তাবতাऽণিম্না তিষ্ঠন্তি, শুক্লস্য নীলস্য পিঙ্গলস্য হরিতস্য লোহিতস্য পূর্ণা; অথ যত্রৈনং ঘ্নন্তীব জিনন্তীব, হস্তীব বিচ্ছায়য়তি, গর্তমিব পততি, যদেব জাগ্রদ্ভয়ং পশ্যতি তদত্রাবিদ্যয়া মন্যতে; অথ যত্র দেব ইব রাজেব, অহমেবেদং সর্ব্বোऽস্মীতি মন্যতে, সোऽস্য পরমো লোকঃ।। ৪।৩।২০।।
অন্বয় এবং অর্থ।
তাঃ বৈ (সেই সকল) অস্য (এনার--এই পুরুষের) এতাঃ হিতা (এই হিতা) নাম (নামক) নাড্যঃ (নাড়ী সকল) যথা (যেমন) কেশঃ (কেশকে) সহস্রধা (সহস্র ধারায় বা ভাগে) ভিন্নঃ (ভিন্ন/ভাগ হলে হ্য়) তাবতা (তার মতোই) অণিম্না (অণুর মতো) তিষ্ঠন্তি (আছে), শুক্লস্য (শুক্ল বর্ণের দ্বারা) নীলস্য (নীল বর্ণের দ্বারা) পিঙ্গলস্য (পিঙ্গল বর্ণের দ্বারা) হরিতস্য (হরিত বর্ণের দ্বারা) লোহিতস্য (লোহিত বর্ণের দ্বারা) পূর্ণা (পূর্ণ); অথ (আর) যত্র (যেখানে) এনং (এনাকে) ঘ্নন্তি ইব (যেন নিহত হচ্ছেন), জিনন্তি ইব (যেন পরাজিত হচ্ছেন), হস্তি ইব বিচ্ছায়য়তি ( হস্তির দ্বারা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন) , গর্তম্ ইব পততি (যেন গর্ত্তে পতিত হচ্ছেন), যৎ এব (যাহা কিছু) জাগ্রদ ভয়ং (জাগ্রত অবস্থায় ভয়) পশ্যতি (দর্শন করে) তৎ (তাহাই) অত্র (এই খানে / এই স্বপ্নাবস্থায়) অবিদ্যয়া (অবিদ্যার দ্বারা) মন্যতে (মনন করেন) ; অথ (আর) যত্র (যেখানে) দেবঃ ইব (দেবতার ন্যায়) রাজা ইব (রাজার ন্যায়), অহম্ এব (আমিই) ইদং (এই) সর্ব্বঃ (সব) অস্মি (হই) ইতি মন্যতে (এই রকম মনে করেন বা বিজ্ঞাত হন) , সঃ (সেই লোক/স্থান) অস্য (এনার) পরমঃ (পরম) লোকঃ (লোক)।। ৪।৩।২০।।
অর্থ।
সেই সকল এনার (এই পুরুষের) এই হিতা নামক নাড়ী সকল; যেমন কেশ সহস্র ধারায় বা ভাগে ভিন্ন (ভাগ) হলে হ্য়, তার মতোই, অণুর মতো (সূক্ষ্ম ভাবে) আছে; শুক্ল বর্ণের দ্বারা, নীল বর্ণের দ্বারা, পিঙ্গল বর্ণের দ্বারা, হরিত বর্ণের দ্বারা, লোহিত বর্ণের দ্বারা পূর্ণ; আর যেখানে এনাকে যেন নিহত হচ্ছেন, যেন পরাজিত হচ্ছেন, যেন হস্তির দ্বারা ছিন্ন বিছিন্ন হচ্ছেন, যেন গর্ত্তে পতিত হচ্ছেন, যাহা কিছু জাগ্রত অবস্থায় ভয় দর্শন করেন, তাহাই এইখানে / এই স্বপ্নাবস্থায় অবিদ্যার দ্বারা মনন করেন (অনুভব করেন); আর যেখানে দেবতার ন্যায়, রাজার ন্যায়, 'আমিই এই সব হই' এই রকম মনে করেন বা বিজ্ঞাত হন, সেই লোক/স্থান এনার পরম লোক সকল।। ৪।৩।২০।
নিরুক্ত।
১। হিতা নাম নাড্যো----হিতা নামক নাড়ী সকল
হ = আকাশ বা হৃদয়াকাশ। ইত = পথ।
হিতা নাড়ী-- হৃদয় থেকে প্রসৃত বর্ণময় এবং রসময় প্রাণের ধারা।
এই উপনিষদের ৭ম মন্ত্রে (মন্ত্র-৪.৩.৭), 'কে আত্মা' এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে যে, ' যিনি আত্মা, তিনি প্রাণসমূহের মধ্যে বিজ্ঞাতা, তিনি হৃদয়ের অন্তরে জ্যোতি'। সুতরাং ঐ যে সূক্ষাতিসূক্ষ হিতা নাড়ী সকল, যারা শুক্ল, নীল, পিঙ্গল, হরিত, লোহিত ইত্যাদি বর্ণময় এবং রসময়, বিদ্রবণময়, তারা এই অন্তর্জ্যোতিরই বর্ণ বিচ্ছুরণ। এই জ্যোতি প্রকাশ আত্মস্তুতিময়। সেই স্তুতির যে অর্চনা বা অর্চি তাই হিতার বর্ণ আর তার যে তৃপ্তি বা আপ্তি, তাই নাড়ীতে নিহিত রস।ঈড্ ধাতুর অর্থ 'স্তুতি করা'। 'ন' বা আনন্দময় এবং ঈড্ বা স্তুতিময় এই আত্মশক্তির প্রবাহ সকলই হিতা নাড়ী। প্রাণময়, তাই সর্ব্ব হিতকর। এই প্রাণ আমাদের মধ্যে রয়েছেন, তাই এঁর নাম পুরোহিত--পুরে হিত বা নিহিত। আবার সবার অগ্রে বা পুরোভাগে এই অগ্নি বা প্রাণ থাকেন বলে ইনি 'পুরোহিত'। উল্লেখযোগ্য যে ঋক্ বেদের প্রথম মন্ত্রে অগ্নি বা প্রাণের উদ্দেশ্যে 'ঈলে বা ঈডে' এবং 'পুরোহিত' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে।
২। যথা (যেমন) কেশঃ (কেশকে) সহস্রধা (সহস্র ধারায় বা ভাগে) ভিন্নঃ (ভিন্ন/ভাগ হলে হ্য়) তাবতা (তার মতোই) অণিম্না (অণুর মতো) তিষ্ঠন্তি (আছে)---যেমন কেশ সহস্র ধারায় বা ভাগে ভিন্ন (ভাগ) হলে হ্য়, তার মতোই, অণুর মতো (সূক্ষ্ম ভাবে) আছে
মনই অণু। মনের কোন 'মান' বা 'আকার, আয়তন, নেই। আমরা বিশ্বকে যেখানে আয়তনময়, স্থূল বা ভৌতিক বলে বোধ করি, তা মন। অথচ, মন আয়তন বিহীন। এই' হিতারা 'আণবিক' এবং মানস দৃষ্টিতেই প্রতিভাত হয়। উপনিষদে মনকে দৈব চক্ষু বলা হয়েছে।
৩। শুক্লস্য (শুক্ল বর্ণের দ্বারা) নীলস্য (নীল বর্ণের দ্বারা) পিঙ্গলস্য (পিঙ্গল বর্ণের দ্বারা) হরিতস্য (হরিত বর্ণের দ্বারা) লোহিতস্য (লোহিত বর্ণের দ্বারা) পূর্ণা (পূর্ণ)----শুক্ল বর্ণের দ্বারা, নীল বর্ণের দ্বারা, পিঙ্গল বর্ণের দ্বারা, হরিত বর্ণের দ্বারা, লোহিত বর্ণের দ্বারা পূর্ণ
অগ্নির যে রোহিত বর্ণ তা তেজের, যে শুক্ল বর্ণ তা অপের, আর যে কৃষ্ণ বর্ণ তা অন্নের। (ছান্দোগ্য উপনিষৎ মন্ত্র ৬।৪।১ দ্রষ্টব্য।)
রোহিত শব্দটি রুহ্ ধতু থেকে হয়েছে। রুহ্ অর্থে ' বর্ধিত হওয়া'। তেজোময় হয়ে প্রাণাগ্নি যে নিজেকে বিস্তার করেন, বহু করেন, তা 'রোহিত'। যা রোহিত বা তেজোময় তাই তরল হয়ে লোহিত হয়েছে। লোহিত= লো (লোক) + হিত (নিহিত)----যিনি 'লোক' , 'আলোক' বা অগ্নি, তিনিই নিহিত; যেমন রক্তের মধ্যে অক্সিজেন থাকে।
অপ বা আপ্তি জনিত যে তৃপ্তি, তার বর্ণ শুক্ল। আর প্রাণের যে অন্ন বা বহু বহু অন মূর্ত্তি (অন--অন--অন-----অন্ন) যার দ্বারা প্রাণ আমাদের প্রাণময় করেন, অন্নময় করেন, তাই পরম আকর্ষণময় কৃষ্ণ বর্ণ।
নীল= নী + ল। যে বর্ণের দ্বারা প্রাণগ্নি আমাদের নিয়ে যান (নী) লয়ে(ল) বা যার দ্বারা আমরা প্রশমিত হই, শান্ত হই, তা নীল বর্ণ।
পিঙ্গল এবং পিঙ্গ শব্দ দুটির অর্থ প্রায় এক, এবং পিঞ্জ্ ধতুর থেকে হয়েছে যার অর্থ হলো ইংরাজী শব্দ tinge, অর্থাৎ একটি বর্ণের সাথে অন্যান্য বর্ণের স্বল্প মিশ্রণ। সুতরাং পিঙ্গল বর্ণ অর্থে মিশ্র বর্ণ।
হরিত হল সেই বর্ণ যা সহজেই আমাদের দৃষ্টি হরণ করে, যা আমাদের মনকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় হরণ করে নিয়ে যায়।
আত্মার যে দর্শনময়, ভোগময় এবং দৃশ্য রচনাময় স্বরূপ তাঁর নাম ইন্দ্র। সব কিছুই দর্শন করছেন, সবার মধ্যেও ইনিই দ্রষ্টা, তাই ইনি ইদং দ্রষ্টা বা ইন্দ্র, সহস্রলোচন পুরুষ। আবার ইনিই স্বয়ংপ্রকাশ এবং স্বয়ং জ্যোতির্ম্ময় হয়ে সকল দর্শন, সকল দৃশ্য রচনা করেন বলে এঁকে ইন্ধ বলা হয়। ইন্ধন ধর্ম্মী তাই ইনি ইন্ধ। ইন্ধ সন্ত ইন্দ্র ইতি আচক্ষতে----ইন্ধ হলেও, ইনি ইন্দ্র রূপেই আচরিত হন। (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, ৪।২।২ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) এই ইন্দ্র রূপ আর প্রতিরূপময় (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, ২।৫।১১ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।)। নিজেই রূপ হয়ে, নিজেই সেই রূপকে অনুভব করেন, তাই প্রতিরূপময়। এই ইন্দ্রের রথে যে অশ্বরা যুক্ত থাকে তাদের নাম 'হরি'। একটি রূপ থেকে আর একটিতে অনবরত চলেছেন, হরণ এবং বিচ্ছুরণময় পুরুষ। যে যেখানে যা কিছু দেখছে, যা কিছু ভোগ করছে, তা ইন্দ্রই দেখছেন, তা ইন্দ্রেরই ভোগ্য। সব দর্শন এঁতেই আহৃত হচ্ছে, ইনিই হরণ করছেন।
( মন্তব্য। হিতা নাড়ী এবং সুষুপ্ত স্বরূপের বিষয়ে উপনিষদের নানা অংশে আর্ষোক্তি আছে। আগ্রহী পাঠকরা উপনিষদের এই অংশ গুলি পড়তে পারেন : বৃহদারণ্যক উপনিষৎ মন্ত্র ২।১।১৭, ২।১।১৮,২।১।১৯,২।১।২০, প্রশ্নোপনিষৎ মন্ত্র ৩।৬, ৩।৭ ।)
২১শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২১।)
তদ্বা অস্যৈতদতিচ্ছন্দা অপহতপাপ্মাভয়ং রূপম্। তদ্যথা প্রিয়য়া স্ত্রিয়া সংপরিষ্বক্তো ন বাহ্যং কিংচন বেদ নান্তরম্, এবমেবায়ং পুরুষঃ প্রাজ্ঞেনাত্মনা সংপরিষ্বক্তো ন বাহ্যং কিংচন বেদ নান্তরম্; তদ্বা অস্যৈতদাপ্তকামমকামং রূপম্ শোকান্তরম্।। ৪।৩।২১।
অন্বয় এবং অর্থ।
তাৎ বৈ (সেই সকল) অস্য (এনার--এই পুরুষের) এতৎ (এই সকল) অতি ছন্দাঃ (ছন্দকে অতিক্রম করে বা ছন্দের ঊর্দ্ধে) অপহতঃ পাপ্মা (হতপাপ বা পাপবিহীন) অভয়ং (অভয়) রূপম্ (রূপ) । তৎ (তা--সেই অবস্থা), যথা প্রিয়য়া (যে রকম প্রিয়) স্ত্রিয়াঃ (স্ত্রীর দ্বারা) সংপরিষ্বক্তঃ (সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে) ন বাহ্যং (না বাহ্য) কিংচন (না কিছু) বেদ (জানেন) ন আন্তরম্ (না অন্তর), এবম্ এব (এই প্রকারই) অয়ং (এই) পুরুষঃ (পুরুষ) প্রাজ্ঞেন (প্রাজ্ঞ) আত্মনা (আত্মার দ্বারা) সংপরিষ্বক্তো (সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে) ন বাহ্যং (না বাহ্য) কিংচন (না কিছু) বেদ (জানেন) ন অন্তরম্ (না অন্তর); তৎ বৈ (তা) অস্য (এনার) এতৎ (এই) আপ্তকামম্ (আপ্তকাম) অকামং (অকাম) রূপম্ (রূপ) শোকান্তরম্ (শোকের অতীত)।। ৪।৩।২১।
অর্থ।
সেই সকল এনার (এই পুরুষের) এই সকল অতি-ছন্দ (ছন্দকে অতিক্রম করে বা ছন্দের ঊর্দ্ধে) হতপাপ বা পাপবিহীন অভয় রূপ। তাহা (সেই অবস্থা), যে রকম প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে না বাহ্য, না অন্য কিছু, না অন্তরকে জানেন, এই প্রকারই এই পুরুষ প্রাজ্ঞ আত্মার দ্বারা সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে না বাহ্য, না অন্য কিছু, না অন্তরকে জানেন; তা এনার এই আপ্তকাম অকাম (কামনা বিহীন) রূপ, শোকের অতীত।। ৪।৩।২১।
নিরুক্ত।
১। অতি ছন্দাঃ (ছন্দকে অতিক্রম করে বা ছন্দের ঊর্দ্ধে) অপহতঃ পাপ্মা (হতপাপ বা পাপবিহীন) অভয়ং (অভয়) রূপম্ (রূপ)----অতি-ছন্দ (ছন্দকে অতিক্রম করে বা ছন্দের ঊর্দ্ধে) হতপাপ বা পাপবিহীন অভয় রূপ
যিনি অদ্বৈত, সেই আত্মস্বরূপ থেকে ছিন্ন হয়ে, ছেদ হয়ে, আমরা স্বতন্ত্র হয়েছি। ছেদন সঞ্জাত যে আনন্দ, তা ছন্দ; বা নিজেকে আচ্ছাদন করে দ্বিতীয় হবার যে আনন্দ, তা ছন্দ। এক এক রকম ছেদন থেকে, এক এক প্রকার আনন্দ এবং সেই অনুযায়ী এক এক প্রকার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই সৃষ্ট জীবসমূহ এক এক প্রকার আনন্দের ভোক্তা হয়েছে। এই উপনিষদের ৩৩শ মন্ত্রে, আনন্দের মাত্রার কথা বলা হয়েছে---- যেমন মনুষ্যদের শত আনন্দ (মনুষ্যের পরম আনন্দের যা শতগুণ) তা জিতলোক-পিতৃগণের একটি আনন্দ, আর যা জিতলোক-পিতৃগণের শত আনন্দ তা একটি গন্ধর্ব্বলোকের আনন্দ, আর যা গন্ধর্ব্বলোকের শত আনন্দ তাএকটি কর্ম্মদেবগণের আনন্দ, ইত্যাদি। আবার এক এক লোকের যে আনন্দ, তার থেকে সেই লোকের ছন্দ, বা স্বাতন্ত্র, সেই লোকের তন্ত্রী রচিত হয়েছে।
কিন্তু যেহেতু ছন্দের মধ্যে দ্বিতীয়তা বোধ থাকে, তাই যতক্ষণ ছন্দকে অতিক্রম করে অতিচ্ছন্দ অবস্থায় না যাওয়া যায়, ততক্ষণ মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায় না। তাই ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে দেবতারা মৃত্যুর থেকে বাঁচবার জন্য ছন্দের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন, বা ছন্দের দ্বারা নিজেদের আচ্ছাদিত করেছিলেন, কিন্তু তাতেও অব্যহতি পাননি। জলের অভ্যন্তরে যেমন মাছকে দেখা যায়, সেই রকম মৃত্যু তাঁদের কে দেখে আক্রমণ করে ছিলেন। (ছান্দোগ্য উপনিষৎ ১।৪।২।)
২। অপহতঃ পাপ্মা (হতপাপ বা পাপবিহীন) অভয়ং (অভয়) রূপম্ (রূপ)----হতপাপ বা পাপবিহীন অভয় রূপ
পাপ---পা + অপ্----যার দ্বারা অপ্, জল বা প্রাণ পীত (পা) হয় বা নিঃশেষিত হয়।
অপহতঃ পাপ্মা (হতপাপ বা পাপবিহীন)----মৃত্যুই পাপ। আমরা জ্ঞান বা বোধের জগতে বেঁচে আছি। প্রতি মূহুর্ত্তে আমরা যা কিছু বোধ করছি তা আমারই অন্তরে যিনি জ্ঞান বা বোধস্বরূপ, তাঁরই মূর্ত্তি। যিনি আত্মস্বরূপ বা 'নিজ' এই বোধ, তিনি সর্ব্ব বোধের মূলে, সর্ব্ব বোধের জনক। নিজ, এই বোধ না থাকলে কোন বোধ থাকে না। আমরা দেখি বা না দেখি, এই নিজ বোধস্বরূপ আত্মা সর্ব্বদা রয়েছেন, ইনি অবিনশ্বর এবং চিরজাগ্রত। 'অহং' বা 'আমি' বলে যে বোধ,তা এই নিজবোধ বা আত্মারই একটি রঞ্জনা। ' অ ' থেকে ' হ ' পর্যন্ত প্রাণ বা তেজের যত বর্ণ হয় তার রঞ্জনায় রঞ্জিত হয়ে, এই আত্মবোধ অহং হন। যা বাহিরে অহঃ বা দিন, সেই আত্মপ্রকাশই আমাতে অহং (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ,৫।৫।৩।এবং ৫।৫।৪।মন্ত্র দ্রষ্টব্য।)
আত্মজ্ঞানের উদয়ে, মৃত্যু অথবা দেহ থেকে বিদেহ অবস্থায় যাওয়াকে, নিজের বোধ বা চেতনারই ক্রিয়া বা প্রকাশ বলে উপল্বদ্ধি হয়, মূলে অবিচল নিজবোধ অবিচলই থাকেন। এতে মৃত্যুতে মৃত্যুঞ্জয়কে দর্শন হয়।
অভয়---ভয় বিহীন। ' ভ ' অক্ষরটি ভীষণতা সূচক। ভীষণতার দ্বারা যিনি মণ্ডিত তিনি ভীম। আকাশকে শিবস্বরূপ আত্মার ভীম মূর্ত্তি বলা হয়েছে (ভীমায় আকাশ মূর্ত্তয়ে শিবায় নমঃ। )। আকাশকে মাত্র শূন্য বলে বোধ হলে তা হয় ভীম। আকাশ হলো পরমআত্মস্বরূপের সেই প্রকাশভূমি, যেখান থেকে সকল আয়তন বা আকৃতি প্রকাশ পায়, কিন্তু যেখানে কোন আয়তন বা আকার নেই। তাই বৃহদারণ্যক উপনিষদে, যাজ্ঞবল্ক্য, গার্গীকে বলেছিলেন যে, এই আকাশ যাঁতে ওতপ্রোত ভাবে প্রতিষ্ঠিত, তিনি অক্ষর, তিনি অক্ষয়, সর্ব্ব ভূতের আত্মা এবং নিয়ন্তা। এই হল অভয় মূর্ত্তি। মৃত্যু দূর হলে আর মনে হয় না যে শূন্যের মধ্যে গতি হচ্ছে।
দ্বিতীয় বোধের দ্বারা আচ্ছন্ন বলে আমরা মৃত্যু অনুভব করি এবং এই মৃত্যুই পাপ। (পাপ্মানং মৃত্যুম্----পাপরূপ মৃত্যু......বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ১।৩।১০)
৩। তৎ (তা--সেই অবস্থা), যথা প্রিয়য়া (যে রকম প্রিয়) স্ত্রিয়াঃ (স্ত্রীর দ্বারা) সংপরিষ্বক্তঃ (সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে) ন বাহ্যং (না বাহ্য) কিংচন (না কিছু) বেদ (জানেন) ন আন্তরম্ (না অন্তর), এবম্ এব (এই প্রকারই) অয়ং (এই) পুরুষঃ (পুরুষ) প্রাজ্ঞেন (প্রাজ্ঞ) আত্মনা (আত্মার দ্বারা) সংপরিষ্বক্তো (সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে) ন বাহ্যং (না বাহ্য) কিংচন (না কিছু) বেদ (জানেন) ন অন্তরম্ (না অন্তর)------যে রকম প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে না বাহ্য, না অন্য কিছু না অন্তরকে জানেন,), এই প্রকারই এই পুরুষ প্রাজ্ঞ আত্মার দ্বারা সম্যক রূপে আলিঙ্গিত হয়ে না বাহ্য, না অন্য কিছু, না অন্তরকে জানেন
প্রাজ্ঞ আত্মা----- প্রাজ্ঞ = প্রা+ জ্ঞ; প্রা=পূরিত; প্রা+ জ্ঞ = যিনি 'জ্ঞ' দ্বারা পূরিত। আমরা যা কিছু জানি, বোধ করি, বিশ্বভূবনে যা কিছু জ্ঞাতব্য তা যাঁর জ্ঞান বা বোধের মূর্ত্তি, তিনি প্রাজ্ঞ। আগে যে বিজ্ঞানময় পুরুষের কথা উক্ত হয়েছে, যিনি আমাদের আত্মা, আমাদের সকল অনুভূতি, সকল বোধপ্রকাশ যাঁর জ্ঞান বা বোধের ক্রিয়ার অন্তর্গত বা যাঁর জ্ঞান বা বোধ ক্রিয়ার প্রকাশ তিনি বা সেই জ্ঞান স্বরূপ চেতনাই প্রাজ্ঞ। জ্ঞান= জ্ঞ+অন। অন=প্রাণ বা বোধ প্রবাহ; জ্ঞ= যাঁর বোধ প্রবাহ বা যিনি জানছেন, যিনি বোধময় হচ্ছেন। নিজেই সকল কিছু বোধ করেন বা জানেন। আত্মজ্ঞান-হীন বা নিজ এই বোধ নেই অথচ জ্ঞান বা বোধ ক্রিয়া হচ্ছে, এরকম হয় না। তাই সমস্ত বোধ বা অনুভূতির মূলে, এই 'জ্ঞ' বা বিজ্ঞাতা আছেন, এই এক আত্মস্বরূপ আছেন, যাঁকে সবাই 'নিজ' বলে অনুভব করে; ইনি প্রাজ্ঞ।
অন্তর ও বাহ্য---- প্রাজ্ঞ বা যিনি স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, তিনি যখন জ্ঞানক্রিয়াময় হন, সেই প্রতি প্রকাশে অন্তর ও বাহ্য এই দুই দিক্ বা দুই বোধ সৃষ্টি হয়। প্রকাশের দিক্টি বহিঃ এবং সেই প্রকাশটি যে দিকে অনুভূত হয় সেইটি অন্তর।
নিদ্রা বা সুষুপ্তি কালে আমরা এই প্রাজ্ঞের দ্বারা আলিঙ্গিত হয়ে, ওঁর সাথে এক হয়ে যাই, তাই অন্তর ও বাহ্য এই দুই বোধও থাকে না।
৪। তৎ বৈ (তা) অস্য (এনার) এতৎ (এই) আপ্তকামম্ (আপ্তকাম) অকামং (অকাম) রূপম্ (রূপ) শোকান্তরম্ (শোকের অতীত)-----তা এনার এই আপ্তকাম অকাম (কামনা বিহীন) রূপ, শোকের অতীত
আপ্তকাম---- যাঁতে সমস্ত কামনা আপ্ত হয়ে গেছে। সবকিছুর প্রাপ্তি বা সমাপ্তি (সম্যক্ আপ্তি) যাঁতে হয়েছে। এই প্রাজ্ঞ আত্মায় সবকিছুই বিদিত, সব কিছুই প্রাপ্ত এবং সব কিছুই এঁর থেকে জাত হয়, তাই ইনি আপ্তকাম এবং যিনি এনাকে জানেন তিনিও আপ্তকাম।
অকাম---যিনি নিজেই সর্ব্ব কাম, সর্ব্ব কামনা এবং সর্ব্ব কাম্য, তিনি অকাম---- যেখানে বা যাঁতে কোন কাম বা কাম্য নেই এবং যাঁর থেকে সর্ব্ব কাম এবং সর্ব্ব কাম্য জাত হয়। আমরা যা নেই তার জন্য কামনা করি, আর যিনি অকাম এবং আপ্তকাম, তিনি পূর্ণতার থেকে কামময় হন, অভাব থেকে নয়।
শোক---শোক শব্দটি শুচ্ ধাতু থেকে হয়েছে। শুচ্ অর্থে দগ্ধ করা, দীপ্ত হওয়া ইত্যাদি।অনবরত অভাব, অনিশ্চয়তা, ব্যাধি ইত্যাদির দ্বারা আমরা যে দগ্ধ হচ্ছি তা এই আত্মজ্ঞানের উদয়ে দূর হয়; নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়----মুক্তির আর অন্য কোন পথ নেই।
২২শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২২।)
অত্র পিতাऽপিতা ভবতি, মাতাऽমাতা, লোকা অলোকা, দেবা অদেবা বেদা অবেদা । অত্র স্তেনোऽস্তেনো ভবতি, ভ্রূণহাऽভ্রূণহা; চাণ্ডালোऽচণ্ডালঃ, পৌল্কসোऽপৌল্কসঃ, শ্রমণোऽশ্রমণঃ, তাপসোऽতাপসোऽনন্বাগতং পুণ্যেনানন্বাগতং পাপেন, তীর্ণো হি তদা সর্ব্বাঞ্ছোকান্ হৃদয়স্য ভবতি।। ৪।৩।২২।।
অন্বয় এবং অর্থ।
অত্র (এখানে) পিতা (পিতা) অপিতা (অপিতা) ভবতি (হন), মাতা (মাতা) অমাতা (অমাতা), লোকাঃ (লোক সকল) অলোকাঃ (অলোক), দেবাঃ (দেবতারা) অদেবাঃ (অদেব) বেদাঃ( বেদসকল) অবেদাঃ (অবেদ) হয়। অত্র (এখানে) স্তেনঃ (চোর) অস্তেনো(চৌর্য স্বভাব বিহীন) ভবতি (হয়), ভ্রূণহাঃ (ভ্রূণহা---ভ্রূণ হত্যাকারী) অভ্রূণহাঃ (ভ্রূণ হত্যার প্রবণতা বিহীন হয়); চাণ্ডালঃ (চণ্ডাল) অচণ্ডাল (অচণ্ডাল), পৌল্কসঃ (পৌল্কস) অপৌল্কসঃ (অপৌল্কস), শ্রমণঃ (শ্রমণ) অশ্রমণঃ (অশ্রমণ), তাপসঃ (তাপস) অতাপসঃ(অতাপস) (হয়)। অনন্বাগতং পুণ্যেন (অন্+অন্বাগতং--অনুগত নন; অনন্বাগতং পুণ্যেন----পুণ্যের অনুগত নন) অনন্বাগতং পাপেন (পাপের অনুগত নন), তীর্ণঃ হ তদা সর্ব্বান্ শোকান্ হৃদয়স্য ভবতি (তীর্ণো হ ভবতি তদা----উত্তীর্ণ হন তখন; হৃদয়স্য সর্ব্বান্ শোকান্-----হৃদয়ের সর্ব্ব শোক থেকে)।।৪।৩।২২
অর্থ।
এখানে পিতা অপিতা হন, মাতা অমাতা হন, লোক সকল অলোক হয় (কোন বিশেষ লোকের বৈশিষ্ট থাকে না), দেবতারা অদেব (কোন বিশেষ দৈব মহিমার প্রকাশ থাকে না) হয়। এখানে চোর চৌর্য স্বভাব বিহীন হয়, যারা ভ্রূণহা তারা অভ্রূণহা (ভ্রূণ হত্যার প্রবণতা বিহীন) হয়; চণ্ডাল অচণ্ডাল, পৌল্কস অপৌল্কস হয়, শ্রমণ অশ্রমণ হয়, তাপস অতাপস হয়; (ইনি) পুণ্যের অনুগত নন, পাপের অনুগত নন; তখন হৃদয়ের সর্ব্ব শোক থেকে উত্তীর্ণ হন।৪।৩।২২
নিরুক্ত।
১। অত্র (এখানে) পিতা (পিতা) অপিতা (অপিতা) ভবতি (হন), মাতা (মাতা) অমাতা (অমাতা), লোকাঃ (লোক সকল) অলোকাঃ (অলোক) দেবাঃ (দেবতারা) অদেবাঃ (অদেব) বেদাঃ( বেদসকল) অবেদাঃ (অবেদ) হয়------এখানে পিতা অপিতা হন, মাতা অমাতা হন, লোক সকল অলোক হয় (কোন বিশেষ লোকের বৈশিষ্ট থাকে না), দেবতারা অদেব (কোন বিশেষ দৈব মহিমার প্রকাশ থাকে না) হয়
পিতা - অপিতা, মাতা- অমাতা, ইত্যাদি শব্দ গুলি লক্ষণীয়। অপিতা শব্দটির অর্থ পিতৃত্ব নেই যেখানে বা যে সত্তাতে। কিন্তু অপিতা শব্দটিতে পিতৃত্বের আভাস আছে। সেই রকম, অমাতা, অলোক ইত্যাদি শব্দগুলিতে যথাক্রমে মাতৃত্বের, লোকত্বের আভাস রয়েছে।
সুতরাং, যাঁতে, যে প্রাজ্ঞ আত্মায় পিতা অপিতা হন , মাতা অমাতা হন, লোক সকল অলোক হয়, দেবতারা অদেব হন, তাঁর থেকেই পিতৃগণ, মাতৃগণ, লোক সকল, দেবগণ ইত্যাদি সকলে জাত হন। সর্ব্ব গুণ যাঁতে নির্গুণ হয়, তিনি সর্ব্ব গুনের দ্বারা আভাসিত।
যিনি প্রাজ্ঞ, এক আত্মস্বরূপ, তাঁতে সর্ব্ব গুণ, সর্ব্ব বৈশিষ্ট, নির্গুণ, নির্বিশেষ হয়ে এক আত্মত্বে একীভূত হয়।আবার এঁর থেকেই পিতৃত্ব এবং পিতৃগণ, মাতৃত্ব এবং মাতৃগণ, লোক সকল, দেবগণ ইত্যাদি সবাই জাত হন।
২। পৌলক্স শব্দটি পুল এবং কস এই দুইটি শব্দ থেকে হয়েছে। দুইটি শব্দই স্পর্শ সংক্রান্ত। পুল অর্থে পুলক বা রোমহর্ষ। কস শব্দটির একটি অর্থ কষ্টি পাথর, যার সাথে সোনাকে ঘর্ষণ করে, সোনার বিশুদ্ধতাকে নিরূপণ করা যায়। ইংরাজী ভাষায় pocs /pox (চর্ম্ম রোগ) এই শব্দগুলি খুব সম্ভবতঃ পৌলক্স, পুলক্স, পুক্কশ ইত্যাদি শব্দের সাথে সম্বন্ধ যুক্ত। সুতরাং পৌলক্স শব্দটি স্পর্শ সংক্রান্ত বিকৃতি বা ব্যাধিযুক্ত পুরুষকে বোঝাতে পারে।
৩। অনন্বাগতং পুণ্যেন (অন্+অন্বাগতং--অনুগত নন; অনন্বাগতং পুণ্যেন----পুণ্যের অনুগত নন) অনন্বাগতং পাপেন (পাপের দ্বারা অনুগত নন), তীর্ণঃ হ তদা সর্ব্বান্ শোকান্ হৃদয়স্য ভবতি (তীর্ণো হ ভবতি তদা----উত্তীর্ণ হন তখন; হৃদয়স্য সর্ব্বান্ শোকান্-----হৃদয়ের সর্ব্ব শোক থেকে)------(ইনি) পুণ্যের দ্বারা অনুগত নন, পাপের দ্বারা অনুগত নন; তখন হৃদয়ের সর্ব্ব শোক থেকে উত্তীর্ণ হন
এই আত্মা একান্ত স্বাধীন। ইনি অবাধ, পুণ্য বা পাপ কোন কিছুকে অনুসরণ করতে ইনি বাধ্য নন, এঁর কোন আবশ্যকতা নেই।
এঁকে বিদিত হলে আর কোন কিছু হারাতে হয় না, কেননা ইনিই সকল কিছু এবং এঁতেই সকল কিছু বিধৃত। হৃদয় গ্রন্থি ছিন্ন হয়, রাগ-অনুরাগের ঊর্ধে যে তেজোময় আত্মা, তাঁর দর্শনে সেই আত্মজ্ঞ আপ্তকাম, অকাম এবং সর্ব্ব শোকের থেকে উত্তীর্ণ হন।
এই প্রসঙ্গে উপনিষদের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করা হলো।
" যদা সর্ব্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেऽস্য হৃদিঃ শ্রিতাঃ।অথ মর্ত্ত্যোऽমৃতো ভবতি অত্র ব্রহ্ম সমুশ্নতে।।" ( কঠোপনিষৎ, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় বল্লী চতুর্দশ মন্ত্র।)---যখন (আপ্তকামত্ব হেতু) হৃদয়ে স্থিত কামনা সকল আর থাকে না, তখন (এই) মর্ত্ত (মর্ত্ত) অমৃত হয়ে যায়, এইখানেই (এই মর্ত্তেই) সম্যক্ ভাবে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়।
২৩শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২৩।)
যদ্বৈ তন্ন পশ্যতি পশ্যন্বৈ তন্ন পশ্যতি, ন হি দ্রষ্টুর্দৃষ্টের্বিপরিলোপো বিদ্যতেऽবিনাশিত্বান্ন তু তদ্দ্বিতীয়মস্তি ততোऽন্যদ্বিভক্তং যৎ পশ্যেৎ। ৪।৩।২৩।
অন্বয় এবং অর্থ।
যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন পশ্যতি (দেখেন না) পশ্যন্ বৈ (দেখেও) তৎ (তখন) ন পশ্যতি (দেখেন না); ন হি (অবশ্যই না) দ্রষ্টুঃ (দ্রষ্টার) দৃষ্টেঃ (দৃষ্টি) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু) ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যাকে) পশ্যেৎ (দ্যর্শন করবেন। ৪।৩।২৩।
অর্থ।
এই যে তথায় দেখেন না, দেখেও তখন দেখেন না; অবশ্যই দ্রষ্টার দৃষ্টি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু; তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত যে তাকে তিনি দেখবেন।
নিরুক্ত।
১। যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন পশ্যতি (দেখেন না) পশ্যন্ বৈ (দেখেও) তৎ (তখন) ন পশ্যতি (দেখেন না)----এই যে তথায় দেখেন না, দেখেও তখন দেখেন না
ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যাকে) পশ্যেৎ (দ্যর্শন করবেন----তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত যে তাকে তিনি দেখবেন
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে দেখেন না তা নয়; তিনি দেখেন, এবং দেখলেও যে দ্রষ্টা হন তা নয়। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি দেখলেও দৃশ্যের সাথে সঙ্গ করেন না, কেননা ইনি নিজেই দৃশ্য, নিজেই দ্রষ্টা।এখানে নিজেই নিজেকে দর্শন করেন এবং তাতে সর্ব্ব দৃশ্য বিদ্যমান থাকে।
অসঙ্গ মানে 'আত্মসঙ্গ'।
২। ন হি (অবশ্যই না) দ্রষ্টুঃ (দ্রষ্টার) দৃষ্টেঃ (দৃষ্টি) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু)----অবশ্যই দ্রষ্টার দৃষ্টি বিলুপ্ত হ্য় না; বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু
তিনি যে দেখেন না, তার অর্থ এই নয় যে দৃষ্টি বা দর্শন শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত। যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে তা সুষুপ্তি।এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সুষুপ্তিতে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি, তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া।
২৪শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২৪।)
যৎ বৈ তৎ ন জিঘ্রতি জিঘ্রন্ বৈ তৎ ন জিঘ্রতি ন হি ঘ্রাতুঃ ঘ্রাতেঃ বিপরিলোপো বিদ্যতেঃ অবিনাশিত্বাৎ ন তু তৎ দ্বিতীয়ম্ অস্তি ততঃ অন্যৎ বিভক্তং যৎ জ্জিঘ্রেৎ।। ৪।৩।২৪।
অন্বয় এবং অর্থ।
যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন জিঘ্রতি (আঘ্রাণ করেন না) জিঘ্রন্ বৈ (আঘ্রাণ করেও) তৎ (তখন) ন জিঘ্রতি (আঘ্রাণ করেন না); ন হি (অবশ্যই না) ঘ্রাতুঃ (ঘ্রাতার) ঘ্রাতেঃ (ঘ্রাণ শক্তি) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু) ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা) জ্জিঘ্রেৎ (আঘ্রাণ করবেন)। ৪।৩। ২৪।
অর্থ।
এই যে তথায় আঘ্রাণ করেন না, আঘ্রাণ করেও তখন আঘ্রাণ করেন না, অবশ্যই ঘ্রাতার ঘ্রাণ শক্তি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু; তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত যে তাকে তিনি আঘ্রাণ করবেন। ৪।৩।২৪।
নিরুক্ত।
১। যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন জিঘ্রতি (আঘ্রাণ করেন না) জিঘ্রন্ বৈ (আঘ্রাণ করেও) তৎ (তখন) ন জিঘ্রতি (আঘ্রাণ করেন না)না)----এই যে তথায় আঘ্রাণ করেন না, আঘ্রাণ করেও তখন আঘ্রাণ করেন না
ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা) জ্জিঘ্রেৎ (আঘ্রাণ করবেন)
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে আঘ্রাণ করেন না তা নয়; তিনি আঘ্রাণ করেন, এবং আঘ্রাণ করেও যে ঘ্রাতা হন তা নয়। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি আঘ্রাণ করলেও গন্ধের সাথে সঙ্গ করেন না, কেননা ইনি নিজেই গন্ধ, নিজেই ঘ্রাতা।এখানে নিজেই নিজেকে আঘ্রাণ করেন এবং তাতে সর্ব্ব গন্ধ বিদ্যমান থাকে।
অসঙ্গ মানে 'আত্মসঙ্গ'।
২। ন হি (অবশ্যই না) ঘ্রাতুঃ (ঘ্রাতার) ঘ্রাতেঃ (ঘ্রাণ) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু)---অবশ্যই দ্রষ্টার দৃষ্টি বিলুপ্ত হ্য় না; বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু
তিনি যে আঘ্রাণ করেন না, তার অর্থ এই নয় যে ঘ্রাণ শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ, ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত।
যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে তা সুষুপ্তি।এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সুষুপ্তিতে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি, তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া।
২৫শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২৫।)
যদ্বৈ তন্ন রসয়তে রসয়ন্বৈ তন্ন রসয়তে, ন হি রসয়িতু রসয়তের্বিপরিলোপো বিদ্যতেऽবিনাশিত্বান্ন তু তদ্দ্বিতীয়মস্তি ততোऽন্যদ্বিভক্তং যদ্রসয়েৎ।। ৪। ৩। ২৫।।
অন্বয় এবং অর্থ।
যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন রসয়তে (আস্বাদন করেন না) রসয়ন্ বৈ (আস্বাদন করেও) তৎ (তখন) ন রসয়তে (আস্বাদন করেন না); ন হি (অবশ্যই না) রসয়িতু (আস্বাদনকারীর) রসয়তেঃ (রসনার জ্ঞান ) বিপরিলোপঃ (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু) ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যাকে) রসয়েৎ (আস্বাদন করবেন)।। ৪।৩। ২৫।
অর্থ।
এই যে তথায় আস্বাদন করেন না, আস্বাদন করেও তখন আস্বাদন করেন না; অবশ্যই আস্বাদনকারীর রসনার জ্ঞান বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু; তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই , যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, যে তা আস্বাদন করা যায়।। ৪।৩। ২৫।
নিরুক্ত।
১। যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন রসয়তে (আস্বাদন করেন না) রসয়ন্ বৈ (আস্বাদন করেও) তৎ (তখন) ন রসয়তে (আস্বাদন করেন না)----এই যে তথায় আস্বাদন করেন না, আস্বাদন করেও তখন আস্বাদন করেন না
ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যাকে) রসয়েৎ (আস্বাদন করবেন)
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে আস্বাদন করেন না তা নয়; তিনি আস্বাদন করেন, এবং আস্বাদন করেও আস্বাদন করেন না। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি আস্বাদন করলেও স্বাদের সাথে সঙ্গ করেন না, কেননা ইনি নিজেই স্বাদ, নিজেই আস্বাদকারী। যেখানে একজন অন্য কিছুকে আস্বাদন করে, এখানে এই প্রাজ্ঞে সেরকম নয়। এখানে নিজেই নিজেকে আস্বাদন করেন এবং তাতে সর্ব্ব স্বাদ বিদ্যমান থাকে।
অসঙ্গ মানে 'আত্মসঙ্গ'।
২। ন হি (অবশ্যই না) রসয়িতু (আস্বাদনকারীর) রসয়তেঃ (রসনার জ্ঞান ) বিপরিলোপঃ (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু)----অবশ্যই আস্বাদনকারীর রসনার জ্ঞান বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু
তিনি যে আস্বাদন করেন না, তার অর্থ এই নয় যে আস্বাদন শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ,আস্বাদন, ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত।
যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে তা সুষুপ্তি।এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সুষুপ্তিতে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি, তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া।
২৬ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২৬।)
যদ্বৈ তন্ন বদতি বদন্বৈ তন্ন বদতি, ন হি বক্তুর্বক্তের্বিপরিলোপো বিদ্যতেऽবিনাশিত্বান্ন তু তদ্দ্বিতীয়মস্তি ততোऽন্যদ্বিভক্তং যদ্বদেৎ।।৪।৩।২৬
অন্বয় এবং অর্থ।
যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন বদতি (কথা বলেন না) বদন্ বৈ (বলেও) তৎ (তখন) ন বদতি (বলেন না) ; ন হি (অবশ্যই না) বক্তুঃ (বক্তার) বক্তেঃ (কথা বলার ক্ষমতা) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু) ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা/যাকে) ব্যদেৎ (বলবেন)।। ৪।৩।২৬।
অর্থ।
এই যে তথায় কথা বলেন না, বলেও তখন বলেন না; অবশ্যই বক্তার কথা বলার ক্ষমতা বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু; তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই, যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত যাকে তিনি বলবেন। ৪।৩।২৬ ।
নিরুক্ত।
১। যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন বদতি (কথা বলেন না) বদন্ বৈ (বলেও) তৎ (তখন) ন বদতি (বলেন না)
ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা/যাকে) ব্যদেৎ (বলবেন)
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে কথা বলেন না তা নয়; তিনি কথা বলেন , এবং কথা বলেও যে বক্তা, তা নয়। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি কথা বলেও বক্তা হন না; কেননা ইনি নিজেই বক্তা, নিজেই বাক্য, নিজেই শ্রোতা। যেখানে একজন অন্যজনের উদ্দেশ্যে কথা বলে, এখানে এই প্রাজ্ঞে সেরকম নয়। এখানে নিজেই নিজেকে বলেন এবং তাতে সর্ব্ব বাক্য বিদ্যমান থাকে।
অসঙ্গ মানে 'আত্মসঙ্গ'।
২। ন হি (অবশ্যই না) বক্তুঃ (বক্তার) বক্তেঃ (কথা বলার ক্ষমতা) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু)-----অবশ্যই বক্তার কথা বলার ক্ষমতা বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু
তিনি যে কথা বলেন না, তার অর্থ এই নয় যে বাক্ শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ,আস্বাদন, বাক্ ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত।
যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে তা সুষুপ্তি।এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সুষুপ্তিতে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি, তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া।
২৭ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২৭।)
যদ্বৈ তন্ন শৃণোতি শৃণ্বন্বৈ তন্ন শৃণোতি , ন হি শ্রোতুঃ শ্রুতের্বিপরিলোপো বিদ্যতেऽবিনাশিত্বান্ন তু তদ্দ্বিতীয়মস্তি ততোऽন্যদ্বিভক্তং যচ্ছৃণুয়াৎ।। ৪।৩।২৭।
অন্বয় এবং অর্থ।
যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন শৃণোতি (শ্রবণ করেন না) শৃণ্বন্ বৈ (শ্রবণ করেও) তৎ (তখন) ন শৃণোতি (শ্রবণ করেন না) ; ন হি (অবশ্যই না) শ্রোতুঃ (শ্রোতার) শ্রুতেঃ (শ্রবণ শক্তি) বিপরিলোপঃ (বিলুপ্ত হ্য়), বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু) ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা/যে) শৃণুয়াৎ ( শ্রবণ করবেন )। ৪।৩।২৭।
অর্থ।
এই যে তথায় শ্রবণ করেন না শ্রবণ করেও তখন শ্রবণ করেন না; অবশ্যই শ্রোতার শ্রবণ শক্তি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু; তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই, যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, যে তিনি শ্রবণ করবেন। ৪।৩।২৭।
নিরুক্ত।
১। যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন শৃণোতি (শ্রবণ করেন না) শৃণ্বন্ বৈ (শ্রবণ করেও) তৎ (তখন) ন শৃণোতি (শ্রবণ করেন না)
ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা/যে) শৃণুয়াৎ ( শ্রবণ করবেন )
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে শ্রবণ করেন না তা নয়; তিনি শ্রবণ করেন , এবং শ্রবণ করেও যে শ্রোতা, তা নয়। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি শ্রবণ করেও শ্রোতা হন না; কেননা ইনি নিজেই শব্দ, নিজেই শ্রোতা, নিজেই বক্তা। যেখানে একজন অন্যজনের কথা শোনে বা অন্য কিছুকে শ্রবণ করে, এখানে এই প্রাজ্ঞে সেরকম নয়। এখানে নিজেই নিজেকে শ্রবণ করেন এবং তাতে সর্ব্ব শ্রুতি বিদ্যমান থাকে।
অসঙ্গ মানে 'আত্মসঙ্গ'।
২। ন হি (অবশ্যই না) শ্রোতুঃ (শ্রোতার) শ্রুতেঃ (শ্রবণ শক্তি) বিপরিলোপঃ (বিলুপ্ত হ্য়), বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু)-----অবশ্যই শ্রোতার শ্রবণ শক্তি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু
তিনি যে শ্রবণ করেন না, তার অর্থ এই নয় যে শ্রবণ শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ,আস্বাদন,বাক্ ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত।
যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে তা সুষুপ্তি।এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সুষুপ্তিতে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি, তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া।
২৮শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২৮।)
যদ্বৈ তন্ন মনুতে মন্বানো বৈ তন্ন মনুতে ন হি মন্তুর্মতের্বিপরিলোপো বিদ্যতেऽবিনাশিত্বান্ন তু তদ্দ্বিতীয়মস্তি ততোऽন্যদ্বিভক্তং যন্মন্বীত ।।৪।৩।২৮।
অন্বয় এবং অর্থ।
যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন মনুতে (মনন করেন না) মন্বানো বৈ (মনন করেও) তৎ (তখন) ন মনুতে (মনন করেন না) ; ন হি (অবশ্যই না) মম্তুঃ (মননকারীর) মতেঃ (মনন শক্তি) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়) বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু) ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা/যে) মন্বীত ( মনন করবেন )।। ৪।৩।২৮।
অর্থ।
এই যে তথায় মনন করেন না, মনন করেও তখন মনন করেন না ; অবশ্যই মননকারীর মনন শক্তি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু; তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত (পৃথক) যাকে তিনি মনন করবেন )।৪।৩।২৮।
নিরুক্ত।
১। যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন মনুতে (মনন করেন না) মন্বানো বৈ (মনন করেও) তৎ (তখন) ন মনুতে (মনন করেন না) -----এই যে তথায় মনন করেন না, মনন করেও তখন মনন করেন না
ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যা/যে) মন্বীত ( মনন করবেন )----তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত (পৃথক) যাকে তিনি মনন করবেন
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে মনন করেন না তা নয়; তিনি মনন করেন , এবং মনন করেও যে মন্তা, তা নয়। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি মনন করেও মন্তা হন না; কেননা ইনি নিজেই মন, নিজেই মন্তা, নিজেই মনের সকল কথা,সকল আয়তন । যেখানে একজন অন্যজনকে বা অন্য কিছুকে মনে করে, এখানে এই প্রাজ্ঞে সেরকম নয়। এখানে নিজেই নিজেকে মনন করেন এবং তাতে মানস ক্ষেত্রে যা কিছু প্রকাশ পেয়েছিলো, যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে, যা কিছু প্রকাশ পাবে, তা বিদ্যমান থাকে।
তিনি যে মনন করেন না, তার অর্থ এই নয় যে মনন শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ,আস্বাদন,বাক্, মনন ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত।
যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে তা সুষুপ্তি।এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সুষুপ্তিতে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি। তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া।
২৯ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।২৯।) যদ্বৈ তন্ন স্পৃশতি স্পৃশন্বৈ তন্ন স্পৃশতি ন হি স্প্রষ্টুঃ স্পৃষ্টের্বিপরিলোপো বিদ্যতেऽবিনাশিত্বান্ন তু তদ্দ্বিতীয়মস্তি ততোऽন্যদ্বিভক্তং যৎ স্পৃশেৎ ।।৪।৩।২৯।
অর্থ।
এই যে তথায় স্পর্শ করেন না, স্পর্শ করেও তখন স্পর্শ করেন না; অবশ্যই স্পর্শকারীর স্পর্শ শক্তি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু; তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত (পৃথক) যাকে তিনি স্পর্শ করবেন।৪।৩।২৯।
নিরুক্ত।
১। যৎ বৈ তৎ (এই যে তথায়/ সেখানে) ন স্পৃশতি (স্পর্শ করেন না) স্পৃশন্বৈ (স্পর্শ করেও) তৎ (তখন) ন স্পৃশতি (স্পর্শ করেন না);----এই যে তথায় স্পর্শ করেন না, স্পর্শ করেও তখন স্পর্শ করেন না
ন তু তৎ (না তাঁর থেকে) দ্বিতীয়ম্ (দ্বিতীয়) অস্তি (আছে--কিছু আছে), ততঃ (তাঁর থেকে) অন্যৎ বিভক্তং (বিভক্ত/পৃথক আছে) যৎ (যাকে)স্পৃশেৎ (স্পর্শ করবেন)-----তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত (পৃথক) যাকে তিনি স্পর্শ করবেন
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে স্পর্শ করেন না তা নয়; তিনি স্পর্শ করেন, এবং স্পর্শ করেও যে স্পর্শকারী হন, তা নয়। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি স্পর্শ করেও স্পর্শকারী হন না এবং স্পৃষ্টও হন না; কেননা ইনি নিজেই স্পর্শ, নিজেই স্পর্শকারী, নিজেই স্পৃষ্ট। যেখানে একজন অন্যজনকে স্পর্শ করে বা অন্য কিছুকে স্পর্শ করে, এই প্রাজ্ঞে সেরকম নয়। এখানে নিজেই নিজেকে স্পর্শ করেন এবং তাতে সর্ব্ব স্পর্শ বিদ্যমান থাকে।
অসঙ্গ মানে 'আত্মসঙ্গ'।
২। ন হি (অবশ্যই না) স্প্রষ্টুঃ (স্পর্শকারীর) স্পৃষ্টেঃ (স্পর্শ শক্তি) বিপরিলোপঃ (বিলুপ্ত হ্য়), বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু)-----অবশ্যই স্পর্শকারীর স্পর্শ শক্তি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু
তিনি যে স্পর্শ করেন না, তার অর্থ এই নয় যে স্পর্শ করার শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ,আস্বাদন,বাক্,স্পর্শ ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত।
যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে, সেই যে সুষুপ্তি, তা এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সেখানে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি, তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া।
৩০ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩০।)
যদ্বৈ তন্ন বিজানাতি বিজানন্বৈ তন্ন বিজানাতি ন হি বিজ্ঞাতুর্বিজ্ঞাতের্বিপরিলোপো বিদ্যতেऽবিনাশিত্বান্ন তু তদ্দ্বিতীয়মস্তি ততোऽন্যদ্বিভক্তং যদ্বিজানীয়াৎ ।।৪। ৩। ৩০।
এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা (যাঁতে আমরা একীভূত হই সুষুপ্তি বা নিদ্রা কালে), তিনি যে জানেন না তা নয়; তিনি জানেন বা বোধ করেন , এবং তৎ সত্বেও যে জ্ঞাতা, তা নয়। এই প্রাজ্ঞ আত্মাকে উপনিষৎ অসঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। অসঙ্গ শব্দের দুইটি অর্থ হয়, (১) যিনি সঙ্গ করেন না, নির্লিপ্ত; (২) যিনি সঙ্গ করেও অসঙ্গই থাকেন। তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত, তাই তিনি জেনেও বিজ্ঞাতা হন না; কেননা ইনি নিজেই জ্ঞান, নিজেই জ্ঞাতা, নিজেই জ্ঞাতব্য, বোধ বা অনুভূতি সকল । যেখানে একজন অন্যজনকে বা অন্য কিছুকে জানে বা অনুভব করে, এই প্রাজ্ঞে সেরকম নয়। এখানে নিজেই নিজেকে জানেন এবং তাতে জ্ঞান ক্ষেত্রে যা কিছু প্রকাশ পেয়েছিলো, যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে, যা কিছু প্রকাশ পাবে, তা বিদ্যমান থাকে।
অসঙ্গ মানে 'আত্মসঙ্গ'।
২। ন হি (অবশ্যই না) বিজ্ঞাতুঃ (বিজ্ঞাতার) বিজ্ঞাতেঃ (জ্ঞান বা বোধ শক্তি) বিপরিলোপো (বিলুপ্ত হ্য়), বিদ্যতেঃ (বিদ্যমান থাকে) অবিনাশিত্বাৎ (অবিনাশিত্ব হেতু)------ অবশ্যই বিজ্ঞাতার জ্ঞান বা বোধ শক্তি বিলুপ্ত হ্য় না, বিদ্যমান থাকে অবিনাশিত্ব হেতু
তিনি যে বোধ করেন না, তার অর্থ এই নয় যে বোধ বা জ্ঞান শক্তি লুপ্ত হয়েছে; এই আত্মা অবিনাশী, শাশ্বত, আর তাই দর্শন, শ্রবণ, ঘাণ,আস্বাদন,বাক্, বোধ ইত্যাদি শক্তিরা অবিনাশী; এদের বিলোপ হয় না। এই জন্য সবাই শাশ্বত, সবাই অবিনাশী, সবাই অমৃত।
যেখানে সব কিছু আত্মত্বে বিলীন হয়েছে তা সুষুপ্তি।এই প্রাণ বা আত্মার যে প্রবাহ বা ধারা, যার নাম সুষুম্না, তার দ্বারা আমরা সুষুপ্তিতে নীত হই, ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে; তা পরম সুখময় আপ্তি বা সুপ্তি, তা নিদ্রা, নিজেতে বা আত্মায় দ্রবীভূত হওয়া। ( বৃহদারণ্যক উপনিষৎ মন্ত্র ৪।৫।১৫ দ্রষ্টব্য। )
যত্র বা অন্যদিবস্যাৎ,তত্রান্যোऽন্যৎ পশ্যেৎ, অন্যোऽন্যজ্জিঘ্রেৎ, অন্যোऽন্যদ্রসয়েৎ, অন্যোऽন্যদ্বদেৎ, অন্যোऽন্যচ্ছৃণুয়াৎ, অন্যোऽন্যন্মন্বীত, অন্যোऽন্যৎ স্পৃশেৎ, অন্যোऽন্যদ্বিজানীয়াৎ।। ৪।৩।৩১
অন্বয় এবং অর্থ।
যত্র বৈ (আর যেখানে) অন্যৎ ইব (অন্যের মতো/ দ্বিতীয় বোধ ) স্যাৎ (হয়) ,তত্র (সেখানে) অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) পশ্যেৎ (দর্শন করে), অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) জ্জিঘ্রেৎ (আঘ্রাণ করে), অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) রসয়েৎ (আস্বাদন করে), অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) বদেৎ (কথা বলে), অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) শৃণুয়াৎ (শ্রবণ করে), অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) মন্বীত ( মনে করে ), অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) স্পৃশেৎ (স্পর্শ করে), অন্যঃ (অন্য) অন্যৎ (অন্যকে) বিজানীয়াৎ (বিজ্ঞাত হয়)।। ৪।৩।৩১।
অর্থ।
আর যেখানে 'অন্য' (বা দ্বিতীয়) বোধ হয়, সেখানে অন্য অন্যকে দর্শন করে, অন্য অন্যকে আঘ্রাণ করে, অন্য অন্যকে আস্বাদন করে, অন্য অন্যকে কথা বলে, অন্য অন্যকে শ্রবণ করে, অন্য অন্যকে মনে করে, অন্য অন্যকে স্পর্শ করে, অন্য অন্যকে বিজ্ঞাত হয়। ৪।৩।৩১।
নিরুক্ত।
যত্র বৈ (আর যেখানে) অন্যৎ ইব (অন্যের মতো/ দ্বিতীয় বোধ ) স্যাৎ (হয়)----আর যেখানে 'অন্য' (বা দ্বিতীয়) বোধ হয়
অন্য----এই আত্মা যিনি নিষ্কল, নিষ্ক্রিয়, অসঙ্গ, তিনিই আবার শক্তিময়, প্রাণময়। যিনি একান্তই এক, তিনি যখন নিজেকে দ্বিতীয় করেন, তখন তাঁর প্রথম যে অভিব্যক্তি তার নাম প্রাণ। প্রাণ= প্র +অন/অন্; প্র= প্রথম; অন= জ্ঞান বা বোধ ক্রিয়া। নিজেকে দ্বিতীয় করেন, নিজেকে দ্বিতীয় বলে জেনে। তাই 'অন্য' শব্দের অর্থ , যা অন্ বা অন থেকে হয়েছে, যা অন বা প্রাণের থেকে জাত, যা প্রাণের দ্বারা যমিত বা নিয়ন্ত্রিত। যা কিছু অন্য, যা কিছু দ্বিতীয়, তা প্রাণেরই স্বরূপ, নিজেকে নিজের থেকে দ্বিতীয় করে জানা, নিজেকেই দ্বিতীয় করে সৃষ্টি করা সত্তা সকল।
আত্মবোধ যেখানে প্রচ্ছন্ন, যেখানে দ্বিতীয়তা বোধই প্রধান, সেখানে যে জ্ঞান বা বোধক্রিয়া তা হলো অন্য অন্যকে দর্শন করা, অন্য অন্যকে আঘ্রাণ করা, অন্য অন্যকে আস্বাদন করা, ইত্যাদি। আত্মজ্ঞান বিহীন কোন জ্ঞান প্রকাশ হয় না, নিজে নেই অথচ বোধ করছি, তা হয় না। 'অহং' বা 'আমি' এই বোধের দ্বারা, স্থির এই আত্মবোধ প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকেন।
৩২ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩২।)
সলিল একো দ্রষ্টাদ্বৈতো ভবতি, এষ ব্রহ্মলোকঃ সম্রাডিতি হৈনমনুশশাস যাজ্ঞবল্ক্যঃ, এষাস্য পরমা গতিঃ, এষাস্য পরমা সম্পদ, এষোऽস্য পরমো লোক এষোऽস্য পরম আনন্দ, এতস্যৈবানন্দস্যান্যানি ভূতানি মাত্রামুপজীবন্তি।। ৪।৩।৩২
অন্বয় এবং অর্থ।
সলিল (সলিল) একঃ (এক) দ্রষ্টা (দ্রষ্টা) অদ্বৈতো (অদ্বৈত) ভবতি (হন); এষ (এই) ব্রহ্মলোকঃ (ব্রহ্মলোক) সম্রাড্ (সম্রাট), ইতি হ এনম্ (এই রকমই) অনুশশাস (অনুশাসন করেছিলেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ (যাজ্ঞবল্ক্য), এষ (এই) অস্য(এঁর--এই জীবের) পরমা (পরম) গতিঃ (গতি), এষ (এই) অস্য(এঁর--এই জীবের) পরমা (পরম) সম্পদ (সম্পদ ), এষ (এই) অস্য(এঁর--এই জীবের) পরম (পরম) আনন্দ (আনন্দ), এতসা এব আনন্দস্য (এই আনন্দেরই) অন্যানি (অন্য) ভূতানি (ভূত সকল/সৃষ্ট জীব সকল) মাত্রাম্ (মাত্রাতে) উপজীবন্তি (জীবিত থাকে)।। ৪।৩।৩২।
অর্থ।
সলিল, এক, দ্রষ্টা, অদ্বৈত। সম্রাট! এই ব্রহ্মলোক। যাজ্ঞবল্ক্য এই রকমই অনুশাসন করেছিলেন--- এই এঁর (এই জীবের) পরম গতি, এই এঁর পরম সম্পদ, এই এঁর পরম লোক, এই এঁর পরম আনন্দ।এই আনন্দেরই মাত্রাতে অন্যান্য ভূত সকল (সৃষ্ট জীব সকল) জীবিত থাকে। ৪।৩।৩২।
নিরুক্ত।
সলিল--- সল +ইল। সল শব্দের অর্থ জল; এই অর্থে 'সল' অর্থে যা নিজের মধ্যে দ্রবীভূত করে। 'ল' অক্ষরটি লীণ বা দ্রবণার্থক। (খুব সম্ভবতঃ ইংরাজী ভাষায় Solution, Solvent, Dissolve শব্দগুলি উৎপত্তি এই 'সল' শব্দ থেকে।)
ইলা শব্দের অর্থ যিনি 'এলিয়ে পড়েছেন, শুয়ে পড়েছেন'; ইলা অর্থে পৃথিবী, যা এই চেতনার স্থির সত্তা বা ভৌতিকতার বিস্তার।এই কাঠিণ্য বা ভৌতিকতার মূলে আছে চেতনার, অপ্ বা জল রূপ মহিমা। জলের কোন বিশেষ আকার নেই, যেমন আধারের যা আকৃতি,জলের আকৃতিও তাই হয়।চেতনার এই অপ্ বা জল রূপ মহিমা থেকেই ভৌতিকতা সৃষ্টি হয় এবং এতেই ভৌতিকতা বিলীন হয়।
ইলা অর্থে বাক্ বা শব্দ হয়, কেননা এই আত্মশক্তি বাক্ই, শব্দাত্মিকা চেতনাই, শব বা ভৌতিক বিশ্ব হয়েছেন।
যিনি আত্মবোধে, আত্মরসে, সবাইকে নিজেতে লীণ করেন তিনি সলিল। এই সলিল স্বরূপ যিনি, তিনি এক, তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই, তিনি সকল কিছুর দ্রষ্টা, সকল প্রকাশ, সকল সৃষ্টি তাঁর দৃষ্টি প্রসূত। ইনি অদ্বৈত (অ + দ্বৈত), অর্থাৎ এঁতে দ্বিতীয় বলে কিছু নেই, অথচ ইনি দ্বিতীয়তার দ্বারা আভাসিত।
ব্রহ্ম---যিনি বর্ধিত হচ্ছেন। বৃহ্ বা বৃংহ ধাতু থেকে ব্রহ্ম শব্দটি হয়েছে। ইনি নিরন্তর নিজেকে বিস্তার করছেন বা বিশ্বভুবনের আকারে বর্ধিত হচ্ছেন। 'অশ্বৎ' শব্দটির অর্থ 'স্ফীত' হওয়া। ইনি, এই মহাপ্রাণ স্ফীত হচ্ছেন বলে এঁকে 'অশ্ব' বলা হয়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে যে সৃষ্টির শুরুতে ইনি স্ফীত হলেন। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, প্রথম অধ্যায়; Expanding Universe)।
এই ব্রহ্মই আমাদের পরম গতি, আমাদের পরম সম্পদ, আমাদের পরম লোক, আমাদের পরম আনন্দ।
এই ব্রহ্মানন্দেরই মাত্রা, অংশই, সবার মধ্যে আনন্দ; এই আনন্দের মাত্রাতে বা এই আনন্দের অংশ নিয়ে সবাই সৃষ্টি হয়েছে, এই আনন্দের মাত্রাতেই সবাই জীবন মৃত্যুর আবর্ত্তনে আবর্ত্ততিত, এই আনন্দের মাত্রাতেই সবাই অভ্যুদয়ের পথে বিবর্ত্তিত হচ্ছে।
৩৩ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩৩।)
স যো মনুষ্যাণাং রাদ্ধঃ সমৃদ্ধো ভবত্যন্যেষামধিপতিঃ, সর্বৈর্মানুষ্যকৈর্ভোগৈঃ সম্পন্নতমঃ, স মনুষ্যাণাং পরম আনন্দঃ;
অথ যে শতং মনুষ্যাণামানন্দাঃ স একঃ পিতৃণাং জিতলোকানামানন্দঃ; অথ যে শতং পিতৃণাং জিতলোকানামানন্দাঃ স একো গন্ধর্ব্বলোক আনন্দঃ; অথ যে শতং গন্ধর্ব্বলোক আনন্দাঃ স একঃ কর্ম্মদেবানামানন্দো----যে কর্ম্মণা দেবত্বমভিসম্পদ্যন্তেঃ; অথ যে শতং কর্ম্মদেবানামানন্দাঃ স এক আজানদেবানামানন্দো, যশ্চ শ্রোত্রিয়োऽবৃজিনোऽকামহতঃ; অথ যে শতমাজানদেবানামানন্দাঃ স একঃ প্রজাপতিলোক আনন্দো যশ্চ শ্রোত্রিয়োऽবৃজিনোऽকামহতো; অথ যে শতং প্রজাপতিলোক আনন্দাঃ স একো ব্রহ্মলোক আনন্দো; যশ্চ শ্রোত্রিয়োऽবৃজিনোऽকামহতঃ; অথৈষ এব পরম আনন্দ, এষ ব্রহ্মলোকঃ সম্রাডিতি হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ; সোऽহং ভগবতে সহস্রং দদামি, অত ঊর্ধ্বং বিমোক্ষায়ৈব ব্রুহীত্যত্র; অথ হ যাজ্ঞবল্ক্যো বিভয়াংচকার---- মেধাবী রাজা সর্ব্বেভ্যো মান্তেভ্য উদরৌৎসীদিতি।। ৪।৩।৩৩।
অন্বয় এবং অর্থ।
সঃ (সে) যঃ (যে) মনুষ্যাণাং (মনুষ্যদের মধ্যে) রাদ্ধঃ (সফল) সমৃদ্ধঃ (সমৃদ্ধ) ভবতি (হ্য়), অন্যোষাম্ (অন্য সকলের) অধিপতিঃ (অধিপতি), সর্বে (সমুদায়) মানুষ্যকৈঃ(মানুষের) ভোগৈঃ(ভোগ সকল) সম্পন্নতমঃ (উৎকৃষ্ট ভাবে সম্পন্ন), স (সে/ তা) মনুষ্যাণাং (মানুষের) পরমঃ আনন্দঃ (পরম আনন্দ)।
অথ যে (আর যে) শতং মনুষ্যাণাম্ (মনুষ্যদের শত) আনন্দাঃ (আনন্দা) স (সে/ তা) একঃ (একটি) পিতৃণাং (পিতৃগণ) জিতলোকানাম্ (যাঁরা পিতৃলোকে থাকার অধিকার জয় করেছেন বা অর্জ্জন করেছেন) আনন্দঃ (তাঁদের আনন্দ);
অথ যে (আর যে) শতং পিতৃণাং জিতলোকানাম্ আনন্দাঃ (জিতলোক পিতৃগণের শত আনন্দ) (সে/ তা) একঃ (একটি) গন্ধর্ব্বলোক আনন্দঃ (গন্ধর্ব্বলোকের আনন্দ);
অথ যে (আর যে) শতং গন্ধর্ব্বলোক আনন্দাঃ (গন্ধর্ব্বলোকের শত আনন্দ) স (সে/ তা) একঃ (একটি) কর্ম্মদেবানাম্ আনন্দঃ (কর্ম্মদেবগণের আনন্দ) ----যে কর্ম্মণা (যাঁরা কর্ম্মের দ্বারা) দেবত্বম্ (দেবত্বকে) অভিসম্পদ্যন্তে (লাভ করেন);
অথ যে (আর যে) শতং কর্ম্মদেবানাম্ আনন্দাঃ (কর্ম্মদেবগণের শত আনন্দ) স (সে/ তা) একঃ (একটি) আজান দেবানাম্ আনন্দঃ (আজান দেবগণের আনন্দ; আজান ---যাঁরা জন্মসূত্রেই দেবতা বা দেবযোনি সম্ভূত), যঃ (যা) চ (এবং) শ্রোত্রিয়ঃ (শ্রোত্রিয়---শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা) অবৃজিনঃ (যাঁরা বর্জ্জন করেন না) অকামহতঃ ( অ+কাম+ হত----যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না )।
অথ যে (আর যে) শতং আজান দেবানাম্ আনন্দাঃ (আজান দেবগণের শত আনন্দ) স (সে/ তা) একঃ (একটি) প্রজাপতিলোক আনন্দঃ (প্রজাপতিলোকের আনন্দ) যঃ (যা) চ (এবং) শ্রোত্রিয়ঃ (শ্রোত্রিয়---শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা) অবৃজিনঃ (যাঁরা বর্জ্জন করেন না) অকামহতঃ ( অ+কাম+ হত----যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না )।
অথ যে (আর যে) শতং প্রজাপতিলোক আনন্দাঃ (প্রজাপতিলোকের শত আনন্দ) স (সে/ তা) একঃ (একটি) ব্রহ্মলোক আনন্দ (ব্রহ্মলোকের আনন্দ); যঃ (যা) চ (এবং) শ্রোত্রিয়ঃ (শ্রোত্রিয়---শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা) অবৃজিনঃ (যাঁরা বর্জ্জন করেন না) অকামহতঃ ( অ+কাম+ হত----যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না )।
অথ এষঃ এব (আর এইই) পরমঃ আনন্দঃ (পরম আনন্দ), এষ ব্রহ্মলোকঃ (এই ব্রহ্মলোক) সম্রাড্ (সম্রাট) ইতি হ (ইহাই) উবাচ (বললেন) যাজ্ঞবল্ক্যঃ (যাজ্ঞবল্ক্য); সঃ (তিনি---তিনি বললেন), "অহং (আমি) ভগবতে (ভগবানকে) সহস্রং (সহস্র) দদামি (দান করছি), অত (এখন) ঊর্ধ্বং (যা ঊর্ধ্ব) বিমোক্ষায় এব (মোক্ষের জন্য) ব্রুহি ইতি (তা বলুন); অথ হ (অনন্তর) যাজ্ঞবল্ক্যো (যাজ্ঞবল্ক্য) বিভয়াংচকারঃ (ভয় পেলেন)---- মেধাবী রাজা সর্ব্বেভ্যো (সকল) মা (আমার) অন্তেভ্য (অন্তরকে---অন্তরস্থ জ্ঞানকে) উদরৌত্সীৎ (উৎ + অরৌৎসীৎ----যা অবরুদ্ধ তাকে 'উৎ বা উদ্ধার করবেন) ইতি।। ৪।৩।৩৩।।
(মন্তব্য----উদরৌত্সীৎ = উৎ + অরৌৎসীৎ; অরৌৎসীৎ শব্দটি 'রুধ্' ধাতুর একটি রূপ। 'রুধ্' অর্থে; অবরুদ্ধ করা'।
অর্থ।
সে, যে, মনুষ্যদের মধ্যে সফল, সমৃদ্ধ , অন্য সকলের অধিপতি, সমুদায় মানুষের ভোগ সকলে উৎকৃষ্ট ভাবে সম্পন্ন, (এই প্রকার মনুষ্যের যে আনন্দ) তা মনুষ্যের পরম আনন্দ।
মনুষ্যদের শত আনন্দ (মনুষ্যের পরম আনন্দের যা শতগুণ) তা একটি জিতলোক পিতৃগণের (যাঁরা পিতৃলোকে থাকার অধিকার জয় করেছেন বা অর্জ্জন করেছেন) তাঁদের আনন্দ।
আর যে জিতলোক পিতৃগণের শত আনন্দ তা একটি গন্ধর্ব্বলোকের আনন্দ।
আর যে গন্ধর্ব্বলোকের শত আনন্দ তা একটি কর্ম্মদেবগণের আনন্দ--------যাঁরা কর্ম্মের দ্বারা দেবত্বকে লাভ করেন।
আর যে কর্ম্মদেবগণের শত আনন্দ তা আজান দেবগণের একটি আনন্দ (আজান দেবগণ ---যাঁরা জন্মসূত্রেই দেবতা বা যাঁরা দেবযোনি সম্ভূত) যা আবার যে শ্রোত্রিয় (যাঁরা শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা), যাঁরা বর্জ্জন করেন না, যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না (তাঁদেরও আনন্দ)।
আর যে আজান দেবগণের শত আনন্দ তা একটি প্রজাপতিলোকের আনন্দ যা আবার যে শ্রোত্রিয় (যাঁরা শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা), যাঁরা বর্জ্জন করেন না, অকামহত ( যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না) তাঁদেরও আনন্দ।
আর যে প্রজাপতিলোকের শত আনন্দ তা একটি ব্রহ্মলোকের আনন্দ যা আবার যে শ্রোত্রিয়ঃ (শ্রোত্রিয়---শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা, যাঁরা বর্জ্জন করেন না, অকামহত ( অ+কাম+ হত----যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না) তাঁদেরও আনন্দ।
আর এইই পরম আনন্দ, এই ব্রহ্মলোক সম্রাট---- ইহাই বললেন যাজ্ঞবল্ক্য। তিনি (জনক) বললেন, "অহং (আমি) ভগবানকে সহস্র দান করছি, এখন যা ঊর্ধ্ব তার বিষয়ে মোক্ষের জন্য বলুন। অনন্তর যাজ্ঞবল্ক্য ভয় পেলেন (এই মনে করে)---- মেধাবী রাজা আমার অন্তরে অবরুদ্ধ সকলকে (সকল জ্ঞানকে) উদ্ধার করবেন (বিজ্ঞাত হবেন) ইতি।।৪।৩। ৩৩।
নিরুক্ত।
১। আনন্দ
আনন্দময় স্বরূপের বর্ণনা , উপড়ে ২১শ মন্ত্রে এবং পরবর্ত্তী মন্ত্রগুলিতে বলা হয়েছে। ঐ যে প্রাজ্ঞ আত্মা, যাঁকে অতিচ্ছন্দ এবং অপহতপাপ বলে ঋষি বর্ণনা করেছেন, যিনি আপ্তকাম, অকাম, যাঁতে অন্তর ও বাহ্য আত্মজ্ঞানে বিলীন হয়ে গেছে, যিনি নিজেই নিজেকে দেখছেন এবং তাতে সকল দর্শন আছে, যিনি নিজেই নিজেকে শুনছেন এবং তাতে সকল শ্রুতি আছে, যিনি নিজেই নিজেকে স্পর্শ করছেন এবং তাতে সকল স্পর্শানুভূতি আছে, যিনি নিজেই নিজেকে আস্বাদন করছেন এবং তাতে সকল রসময়তা আছে, ইনি নিজেই নিজেকে আঘ্রাণ করছেন এবং তাঁতে সকল সৌরভ আছে, ইনি নিজেই নিজেকে মনন করছেন এবং তাতে সকল মানসিকতা আছে, ইনি নিজেই নিজেকে জানছেন বা বোধ করছেন এবং তাতে চেতনায় বা বোধে যা কিছু প্রকাশ পেতে পারে, অনুভূত হতে পারে সেই সকল প্রজ্ঞা আছে।এঁতে সবাই তার বৈশিষ্ট হারিয়ে আত্মস্বরূপতায় এক হয়ে যায়। ইনিই আনন্দ এবং আত্মা। ছান্দোগ্য উপনিষদে (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৭ম অধ্যায়, ২৩শ এবং ২৪শ খণ্ড দ্রষ্টব্য।) এঁকে ভূমা এবং সুখস্বরূপ বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, যেখানে অন্য অন্যকে জানে, যেখানে অন্য অন্যকে দেখে, যেখানে অন্য অন্যকে শোনে, তা অল্প এবং এতে সুখ নেই; আর যা ভূমা তা অমৃত।ভূমা অর্থে, যাঁর মাত্রা (মা) থেকে সবাই জাত (ভূ) হয়েছে। তাই পুর্ব্ব মন্ত্রে (৩২শ) বলা হয়েছে, " এই আনন্দেরই মাত্রাতে অন্যান্য ভূত সকল (সৃষ্ট জীব সকল) জীবিত থাকে "।
ছান্দোগ্য উপনিষদে (ছান্দোগ্য,৭।২৪।২।) আরো বলা হয়েছে, যে বাড়ী-ঘড়, জমিজমা, গো অশ্ব, সম্পদ সকলকে লোকে যেমন কোন এক জনের 'মহিমা' বলে, এই আত্মা এবং আনন্দ সেরকম নয়। ইনি নিজেই নিজের মহিমা (শক্তি) বা আনন্দ। স্বে মহিন্মি যদি বা ন মহিন্মীতি (ছান্দোগ্য,৭।২৪।১।) ----এই আত্মা নিজের মহিমাতেই, (নিজের আনন্দতেই, নিজের শক্তিতেই), অথবা মহিমাতেও নয় -----অর্থাৎ মহিমা বা আত্মশক্তি এবং আত্মা এই প্রকার স্বগত ভেদও নেই।
'স্বে মহিন্মি যদি বা ন মহিন্মীতি', ছান্দোগ্য উপনিষদের এই উক্তিটিই 'নন্দ' শব্দের অর্থ।
ন= ন মহিন্মীতি, মহিমাতেও নয়, আত্মা এবং আত্মমহিমা বা আত্মশক্তি একই, একজন অন্যজনে প্রতিষ্ঠিত, এরকম নয়।
ন---- এই যে প্রাজ্ঞ আত্মা ইনি 'ন', এঁতে পিতা অপিতা হয়, মাতা অমাতা হয়, এঁতে সব নাস্তি হয়ে যায়, স্ব স্ব বৈশিষ্ট হারিয়ে , আত্মার সাথে এক হয়।
দ ---- বাক্ বা আত্মশক্তি। 'দ' কে বৃহদারণ্যক উপনিষদে 'দৈবী বাক্' বলা হয়েছে। ( বৃহদারণ্যক উপনিষৎ মন্ত্র ৫।২।৩।) এই স্বয়ংবরা বাক্, বাগদত্তা, ইনি নিজেকেই নিজেতে বা আত্মাতে দান করে আত্মাকে বা নিজেকে বহু করেন। । দান= দ + অন= বাক্+প্রাণ। এই সক্রিয় আত্মা বা প্রাণ এবং বাকের মিথুনে সমগ্র সৃষ্টি সৃজিত হয়েছে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ ১।১।৫ এবং ১।১।৬ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।)। এই জন্য বলে, দানের দ্বারাই বর্ধিত হয়। এই জন্য, এই বাক্ ও প্রাণের মিথুনে যা কিছু জাত, যা কিনা এই প্রাণের বা চেতনার রূপ বা আয়তন, যা এই বিশ্ব ভূবন, তার সাধারন নাম 'কথা' বা 'বাক্য', এবং তা যেখান থেকে প্রকাশ পায় বা মূর্ত্ত হয়ে জাত হয় তার নাম, 'বদন'। (এই বিশ্ব ভূবন চেতনারই বাক্য বা কথা দিয়ে নির্মিত বা চেতনারই বাক্ প্রকাশ; যেমন আমাদের মনের সকল চিন্তা, অনুভূতি বাক্য বা কথা দিয়েই নির্ম্মিত।)
ন্দ-----এই আত্মা বা 'ন ' এই 'দ' বা বাকে বা 'মহিমাতে'।
সুতরাং এই আত্মমিথুনই 'নন্দ' এবং যেহেতু এই মিথুন সমগ্র সৃষ্টির প্রতিটি সত্তার কারণ বা মূলে, তাই আনন্দ বলা হয়। ' আ ' অর্থে সর্ব্বব্যাপী (যেমন বলা হয় আ-সমুদ্র-হিমাচল।
২। শত-----যিনি শ বা শক্তি, যিনি 'শক্' বা সকল কিছু করতে সমর্থ। এই সামর্থ্য, কালের দ্বারা যে অনবরত পরিবর্ত্তন তাতে প্রকাশ পাচ্ছে। সেই কালের ক্রম ধারা যদি অন্তে বা শেষে পূর্ণতায় নিয়ে যায় ,তার নাম 'শত' বা 'শতায়ু'। আয়ু বা প্রাণের ধারা বা কালের ধারা যখন পূর্ণতায় নিয়ে যায় তার নাম ' শতায়ু '।
তাই কোন অবস্থার যখন পূর্ণতা হয়, তখন সেইটি হবার যে কাল তা শত বৎসর। এই জন্য বলা হয়েছে, মনুষ্যের যা পরম আনন্দ তার শতগুণ হল জিতলোক পিতৃগনের একটি আনন্দ। মনুষ্য লোকের থেকে শ্রেষ্ঠতর পিতৃলোক এবং মনুষ্যগণ কর্ম্মের দ্বারা এই লোক জয় করে। আত্মার যে নিয়ত্রণ, তাই কর্ম্ম বা আমাদের জীবনগতি আকারে প্রকাশ পাচ্ছে এবং তার দ্বারা আমরা উন্নত থেকে উন্নত সত্তায় পরিণত হচ্ছি।আমাদের কর্ম্ম সংস্কার বা পিতৃগণের উদ্ধার হচ্ছে। পিতার থেকেই আমরা সংস্কার প্রাপ্ত হই বা পিতৃলোকেই আমাদের সংস্কার বিধৃত থাকে। আমাদের স্বভাব বা সংস্কার এই পিতৃলোকে বিধৃত এবং পিতৃলোকের অন্ন; তাই বলা হয় যে পিতৃগণ স্বধা ভোক্তা।
৫। গন্ধর্ব্ব----প্রাণের যে বিধৃতি শক্তি, তার নাম গন্ধ। কালক্রমের দ্বারা আমরা দিন-রাতময় (অহোরাত্রময়) হয়ে কালচক্রে আবর্ত্তিত হতে হতে জীবনস্রোতে ভেসে চলেছি এই সমস্ত গতিটি, যে প্রাণের থেকে আমাদের উৎপত্তি, সেই প্রাণেতেই বিধৃত এবং এর নাম গন্ধ। গতি বা 'গম্' যে বিধৃত হয়েছে, ধৃত (ধ) হয়েছে, তাই তার গন্ধ। এই ভাবে যাঁরা নিজের বর্ত্তমানতা বা স্থিতিকে প্রাণে বিধৃত বলে জানেন, তাঁরা গন্ধর্ব্ব।
এই জন্য কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, ' যথা অপ্সু পরীব দদৃশে তথা গন্ধর্ব্বলোকে'-----যেমন জলের মধ্যে দৃষ্ট হয় , সেইরকমই গন্ধর্ব্বলোকে। জলের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্বকে অন্দোলিত হতে দেখা যায়, কিন্তু সেই প্রতিবিম্ব সকল যেমন জলেই থাকে, তেমনি আমাদের সকল চাঞ্চল্য এই 'অপ্' বা প্রাণেই ধরা থাকে।
নাকের মধ্য দিয়ে যে বায়ু বা প্রাণ অনবরত অন্তর ও বাহিরে সঞ্চালিত হয়ে আমাদের স্থিতি সম্পাদন করছে, সেই রকমই, পৃথিবীর যে আহ্নিক গতি, তার দ্বারাই আমরা অহোরাত্রময় হয়ে পৃথিবীতে স্থিতিশীল হয়েছি। এই হল ‘গন্ধের' গন্ধত্ব। যা ক্ষিতি (পৃথিবী) তত্ত্ব, তার তন্মাত্রা হলো গন্ধ।
পূজ্যপাদ গুরুদেব মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের কোন এক দিনের উপদেশের, গন্ধ বিষয়ক উক্তি নীচে উধৃত করা হলো:
“ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্দ্ধকং
উর্ব্বারুকমিব বন্ধনাৎ মৃত্যোর্মোক্ষীয় মা অমৃতাৎ। এই হলো প্রাণ প্রতিষ্ঠার মন্ত্র।
গন্ধ মানে কি? গাং ধত্তে——ইন্দ্রিয়দের ধরছে, অথবা গাঃ রশ্মীন্ ইন্দ্রিয়াণি ধারয়তি ইতি গন্ধ। ইন্দ্রিয়েরা কাতে গিয়ে ধরা পড়ে? এই স্থূল বিশ্ব না থাকলে আমার ইন্দ্রিয়েরা কায করে না। স্থূল বিশ্ব হল গন্ধতত্ত্ব। সুগন্ধি মানে ইন্দ্রিয়ের ধর্ত্তা বা পরিচালক। ত্র্যম্বকং মানে ঋক্, যজু,সাম, এই তিন বেদ, ত্রিবেদন, ত্রিদর্শন। স্থূল বিশ্বই আমাদের খাইয়ে পুষ্ট করে রেখেছে। উর্ব্বারুক—ফাটা ফুঁটি। ফাটা ফুঁটিকে যেমন করে শিকেয় বেঁধে রাখা হয়, তেমনি মৃত্যুর দ্বারা আমার যে বন্ধন, তা থেকে আমায় মুক্ত কর——অমৃত থেকে যেন আমাকে সরিয়ে দিও না। যেখানেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়, সেখানেই এই মন্ত্র। মন্ত্রচৈতন্যের দ্বারা প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়।"
গন্ধর্ব্বরা এই ভৌতিকতাকে প্রাণেরই আবর্ত্তন বলে জানেন। তাঁরা জানেন প্রাণই ভৌতিক বিশ্বেতে প্রতিষ্ঠিত।
৬। কর্ম্মদেবগণ-----যাঁরা কর্ম্মের দ্বারা দেবত্ব অর্জ্জন করেছেন। আমাদের কর্ম্ম বা ক্রিয়াময়তা আমাদের জ্ঞান বা বোধেই হচ্ছে। নিজের এই জ্ঞানময় স্বরূপের দিকে দেখতে অভ্যস্থ হতে থাকলে, যা অচেতন বা ভৌতিক বিশ্ব বলে এখন বোধ হচ্ছে, তাও যে জ্ঞানের বা চেতনারই ভৌতিকতা তা উপল্বদ্ধি হয়। শুধু তাই নয়, যে জ্ঞান বা চেতনা আমাতে ফুল এই জ্ঞানমূর্ত্তি আকারে ফুলের বোধ ফুটিয়ে দিচ্ছেন, তিনিই অন্য সকলেও ফুল এই জ্ঞান বা বোধের আকারে তাদেরকেও ফুলের ভোক্তা করছেন। জ্ঞান বা চেতনার এই যে স্বরূপ, যা কিনা সবার মধ্যে ফুলের বোধ বা অনুভূতি, তিনি 'ফুল' বা 'পুষ্প' দেবতা। তখন ফুল দেখলে,সেই ফুলের পিছনে অনন্ত ফুলের ঢেউ দেখা যায়। সর্ব্ব দেশে, সর্ব্ব কালে, ফুলের যে অনন্ত বৈচিত্র আছে তা প্রতিভাত হয়। কেউ যদি এইরকম বিজ্ঞাতার কাছে একটি ফুল নিয়ে আসে, তো সেই ফুল কোন গাছের, কার বাগানের, কোন মালীর প্রযত্নে ফোটা, সেই সবই এবং সেই ফুলের যে অন্তহীনতা, তা সেই বিজ্ঞাতার দৃষ্টিতে অনায়াসে প্রতিভাত হয়। জ্ঞান ও কর্ম্মের সমুচ্চয়ের দ্বারা ইন্দ্রিয়রা দেবত্ব বা আনন্ত্য লাভ করে; এই বিজ্ঞাতা অবাধ শ্রবণ, অবাধ দর্শন, অবাধ প্রজ্ঞা ইত্যাদির অধিকারী।
৭। আজান দেবগণ----যাঁরা সংস্কার বা জন্মসূত্রেই দেবতা। আমরা যা সৃষ্টি হয়েছে তাকে ভোগ করি। আমরা গ্রহণ ধর্ম্মী। দেবতারা, দিব্ বা প্রকাশ ধর্ম্মী। তাঁরা নিজের থেকে যা প্রকাশ করেন বা সৃষ্টি করেন, তাতেই তাঁদের ভোগ হয়। ফুলের যত রূপ, যত গন্ধ, যত প্রকার, তা এই পুষ্প দেবতার প্রকাশ, এই তাঁর আনন্দ। আর সেই প্রকাশকে বা তার মাত্রা কে গ্রহণ করে বা অনুভব করে আমার ফুল বোধ করি বা আনন্দ পাই।
৮। শ্রোত্রিয়ঃ (শ্রোত্রিয়---শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা) অবৃজিনঃ (যাঁরা বর্জ্জন করেন না) অকামহতঃ ( অ+কাম+ হত----যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না) -----শ্রোত্রিয় (যাঁরা শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা), যাঁরা বর্জ্জন করেন না, অকামহত ( যাঁরা কামের দ্বারা হত বা অভিভূত হন না)
শ্রোত্রিয়---শ্রোত্র/শ্রুতি বা বেদগতির দ্রষ্টা। আমরা যা কিছু বোধ বা অনুভব করি, তা আমাদের মধ্যে শব্দ বা শ্রুতির আকারেই অনুভূত হয়। প্রতি অনুভূতিই আমাদের মধ্যে কতকগুলি শব্দ বা ভাবের আকারে বিজ্ঞাত হয়। বাইরের বিশ্বের প্রতিটি পদার্থ আমাদের মনে একটি শব্দ আকারে গৃহীত হচ্ছে এবং সেই শব্দকে শোনার নামই 'অনুভব করা'। একটি ফুলের যা কিছু আকার, যা কিছু বর্ণ, যা কিছু গন্ধ, যা কিছু মাধুর্য তা আমাতে শব্দের আকারে গৃহীত হচ্ছে বা শ্রুত হচ্ছে। সেই ফুলের যে অনুভূতি বা বেদন আমাতে আসছে তা এই শ্রুতি। তাই বেদ মানেই শ্রুতি, কথা বলা মানে চেতনার প্রকাশ, আর কথা শোনা মানে যা প্রকাশ পাচ্ছে, তাকে অনুভব করা বা জানা।তাই কথা বলা এবং শোনা এইটি একসাথে হয়,আমরা যা বলি, সেই কথাটি যুগপৎ শুনি।
যিনি শ্রোত্রিয়, তাঁর কাছে এই বিশ্বভূবন চেতনার বাঙ্মূর্তি। ভৌতিকতার যে খোলস, বা জাড্যতার যে আবরণ, তা অপসৃত হয়ে, যা বেদ, যা প্রাণ, যা চেতনা তা, বা এই শব্দাত্মিকা আত্মশক্তি বাক্ প্রকাশিত হন। প্রতি শব্দ, চেতনার প্রতি স্ফূট, তাঁর কাছে মহাপ্রাণের প্রকাশ বা মহাপ্রাণের কথা হয়ে যায়।এর নাম শ্রুতি।
৯। অবৃজিনঃ (যাঁরা বর্জ্জন করেন না)--- যিনি আত্মজ্ঞ, যিনি সকল কিছুকে আত্মমূর্ত্তি বলে দর্শন করেন, তাঁর কাছে কেউ বা কিছুই বর্জ্জনীয় নয়। ইনি পুণ্য ও পাপ কোন কিছুর প্রতিই অনুগত নন। ইনি যদি কারোর প্রতি দুষ্কর্ম্মও করেন, তার দ্বারা সেই ব্যক্তির আত্মজ্ঞানেরই উদয় হয় বা আত্মজ্ঞতা লাভের পথে যে বাধা সকল তা দূর হয়।
১০। অকামহত----যাঁরা কাম বা কামনার দ্বারা অভিভূত নন বা যাঁদের কামনা অপ্রতিহত বা যাঁরা যা কামনা করেন তা ততক্ষণাৎ লাভ করেন। (মুণ্ডক উপনিষৎ, মন্ত্র ৩।১।১০।)
১১। প্রজাপতি।
আজান দেবগণের আনন্দের যে শতগুণ তা প্রজাপতির একটি আনন্দ। দেবগণের মধ্যে যিনি প্রথম, তিনি ব্রহ্মা এবং তাঁকে প্রজাপতিও বলা হয়। প্রাণ থেকে যা কিছু জাত হয়েছে, তা প্রজা। সেই প্রজাগণ, অর্থাৎ, সর্ব্বজীব এবং দেবগণের যিনি অধ্যক্ষ বা অধিকর্ত্তা, তিনি প্রজাপতি এবং ব্রহ্মা। এই প্রসঙ্গে, মুণ্ডক উপনিষদের নিম্নে উল্লিখিত শ্লোকটি দ্রষ্টব্য------ওঁ। ব্রহ্মা দেবানাং প্রথমঃ সংবভূব বিশ্বস্যকর্ত্তা ভুবনস্য গোপ্তা। স ব্রহ্মবিদ্যাং সর্ব্ববিদ্যাপ্রতিষ্ঠামথর্বায় জ্যেষ্ঠপুত্রায় প্রাহ। ব্রহ্মা দেবগণের মধ্যে প্রথম আবির্ভূত হয়েছেন, যিনি বিশ্বের কর্ত্তা এবং ভুবনের পালনকর্ত্তা। তিনি সর্ব্ব বিদ্যা যাঁতে প্রতিষ্ঠিত, সেই ব্রহ্মবিদ্যা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অথর্বকে বিবৃত করেছিলেন। (মুণ্ডক উপনিষদ ১।১।১।)
এই প্রজাপতির অন্য নাম সম্বৎসর।(প্রশ্নোপনিষৎ মন্ত্র ১।৯, বৃহদরাণ্যক উপনিষৎ মন্ত্র ১।৫।১৪ এবং ১।৫।১৫ দ্রষ্টব্য) কালাবর্ত্তন বা বৎসর সকলের মধ্য দিয়ে ইনি সম্যক্ রূপে সৃষ্ট জীব বা বৎস সকলকে বা প্রজাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। দেবক্ষেত্রের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ প্রকাশ পাচ্ছে। ইনি ব্রহ্মা বা ব্রহ্মের আকার বা প্রকাশ। এঁর দ্বারা ব্যক্ত বিশ্ব প্রকাশ পাচ্ছে। তাই ইনি রক্ত বর্ণ। এঁর শক্তি হলেন ব্যক্ত বাক্শক্তি বা সরস্বতী, যাঁর দ্বারা চেতনা সুনির্দিষ্ট শব্দের আকারে বা অনুভব যোগ্য বিশ্বের রূপে প্রকাশ পাচ্ছেন।
১২। ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মা। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ ৩২শ মন্ত্রে উক্ত হয়েছে। পরম আত্মস্বরূপ যিনি , তিনি নিজেকে বর্ধন বা স্ফীত করছেন সমগ্র সৃষ্টির আকারে তিনি ব্রহ্ম। আর এই ব্রহ্মের আকার হলো ব্রহ্মা। ব্যক্ত, পরিমাপ যোগ্য বিশ্ব, যার মান নির্ণয় করা যায়, তা এই ব্রহ্মের 'মন' বা মানসক্ষেত্রে বিধৃত, প্রকাশিত; যেমন আমাদের মনে ধারণা, ভাব ইত্যাদি সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত। ব্রহ্মের মনই ব্রহ্মা, যাঁকে দৈব মন বলা হয়েছে। বৃহদরাণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, এই যে দ্যুলোক (যা দিব্ বা চেতনার প্রকাশ ক্ষেত্র) তা এই মনের শরীর আর ঐ যে আদিত্য যিনি সর্ব্ব রূপের,সর্ব্ব দৃশ্যের, সর্ব্ব আকারের উৎস, তা এই মনেরই জ্যোতিরূপ। এই মন অনন্ত।(বৃহদরাণ্যক উপনিষৎ, মন্ত্র ১।৫।১৪ এবং ১।৫।১৫, দ্রষ্টব্য।)
৩৪ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩৪।)
স বা এষ এতস্মিন্ স্বপ্নান্তে রত্বা চরিত্বা, দৃষ্টৈব পুণ্যং চ পাপং চ, পুনঃ প্রতিন্যায়ং প্রতিযোন্যাদ্রবতি বুদ্ধান্তায়ৈব।। ৩৪।।
অন্বয় এবং অর্থ।
সঃ (সে/তিনি) বা এষঃ এতস্মিন্ (এই প্রকার) স্বপ্নান্তে (সুষুপ্তি বা সম্প্রসাদ এবং স্বপ্নাবস্থায়) রত্বা (রত বা রতিময় হয়ে) চরিত্বা (বিচরণ করে), দৃষ্ট্বা (দর্শন করে) এব (এই প্রকারে) পুণ্যং চ পাপং চ (পুণ্য এবং পাপকে), পুনঃ (পুনরায়ে) প্রতিন্যায়ং (প্রতি -নি--যে দিক থেকে নীত হয়েছিলেন বা যে দিক থেকে স্বপ্নান্ত অবস্থায় গিয়েছিলেন) প্রতি যোনি (উৎপত্তি বা উৎস যেখান থেকে উত্থিত হয়ে স্বপ্নান্ত অবস্থায় গিয়েছিলেন) আদ্রবতি (আ+ দ্রু----দ্রুত যান) বুদ্ধান্তায় এব (যে দিকে বুদ্ধি, মন এবং ভৌতিক বিশ্ব)। ৪।৩।৩৪।
অর্থ।
তিনি এই প্রকার স্বপ্নান্তে (সুষুপ্তি বা সম্প্রসাদ এবং স্বপ্নাবস্থায়), রতিময় হয়ে, বিচরণ করে, এই প্রকারে পুণ্য এবং পাপকে দর্শন করে, পুনরায়ে যে দিক থেকে নীত হয়েছিলেন (যে দিকে বুদ্ধান্ত বা জাগ্রত অবস্থা), উৎপত্তি বা উৎস, যেখান থেকে উত্থিত হয়ে স্বপ্নান্ত অবস্থায় গিয়েছিলেন, সেই (বুদ্ধান্ত বা জাগ্রত) অবস্থার দিকে দ্রুত যান (যে দিকে বুদ্ধি, মন এবং ভৌতিক বিশ্ব)। ৪।৩।৩৪।
৩৫ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩৫।)
তদ্যথানঃ সুসমাহিতমুৎসর্জদ্যায়াদেবমেবায়ং শারীর আত্মা প্রাজ্ঞেনাত্মনান্বারূঢ় উৎসর্জন্যাতি, যত্রৈতদূর্ধ্বোচ্ছ্বাসী ভবতি।। ।। ৪। ৩। ৩৫
অন্বয় এবং অর্থ।
তৎ (তখন) যথা (যেমন) অনঃ (শকট/বিমান) সুসমাহিতম্ (সুসমাহিত হয়ে) উৎসর্জৎ (উৎক্রমণে) যায়াৎ (যায়), এবম্ এব (এই ভাবেই) অয়ং (এই) শারীরঃ (শরীরস্থ) আত্মা (আত্মা) প্রাজ্ঞেন আত্মনা (প্রাজ্ঞ আত্মার দ্বারা) আরূঢ় (আরূঢ় হয়ে) উৎসর্জন্ (উৎক্রমণে) যাতি (যান), যত্র (যখন) এতৎ (ইনি --শারীর আত্মা) ঊর্ধ্ব (ঊর্ধ্বে) উৎ (উৎক্রমণের নিমিত্ত) শ্বাসী (শ্বাসময় বা প্রাণগতি যুক্ত) ভবতি (হন)।। ৪।৩।৩৫।
অর্থ।
তখন যেমন শকট/বিমান সুসমাহিত হয়ে উৎক্রমণে যায়, এই ভাবেই এই শরীরস্থ আত্মা প্রাজ্ঞ আত্মার দ্বারা আরূঢ় হয়ে উৎক্রমণে যান---- যখন (তখন) ইনি (শারীর আত্মা) ঊর্ধ্বে উৎক্রমণের নিমিত্ত শ্বাসময় বা প্রাণগতি যুক্ত হন। ৪।৩।৩৫।
নিরুক্ত।
১। তৎ (তখন) যথা (যেমন) অনঃ (শকট/বিমান) সুসমাহিতম্ (সুসমাহিত হয়ে) উৎসর্জৎ (উৎক্রমণে) যায়াৎ (যায়)-তখন যেমন শকট/বিমান সুসমাহিত হয়ে উৎক্রমণে যায়
' অনঃ' শব্দটি ' অনস্' শব্দ থেকে হয়েছে, যার অর্থ 'যান' বা ' শকট'। মূল শব্দ হলো ' অন্ ' ধাতু, যার অর্থ, অন্/প্রাণ বা শক্তির দ্বারা চলা বা গতিশীল হওয়া।
কোন যান, কোন বিমান বা শকট উৎক্রমণের সময়ে যেমন তার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সুসমাহিত বা সুসংগঠিত হয়ে তাকে পরিচালনা করে, সেই রকম এই শরীরী জীব প্রাজ্ঞ আত্মার দ্বারা পরিচালিত হয়ে শরীর থেকে উৎক্রমণ করেন এবং ঊর্ধ্বে উৎক্রমণের নিমিত্ত শ্বাসময় বা প্রাণগতি যুক্ত হন।
৩৬ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩৬।)
স যত্রায়মণিমানং ন্যেতি----জরয়া বোপতপতা বাণিমানং নিগচ্ছতি---তদ্যথাম্রং বোদুম্বরং বা পিপ্পলং বা বন্ধনাৎ প্রমুচ্যত, এবমেবায়ং পুরুষ এভ্যোऽঙ্গেভ্যঃ সংপ্রমুচ্য পুনঃ প্রতিন্যায়ং প্রতিযোন্যাদ্রবতি প্রাণায়ৈব।। ৪।৩।৩৬।।
অন্বয় এবং অর্থ।
স যত্র (সে যখন) অয়ম্ (এই) অণিমানং (অণু /সূক্ষ্ম অবস্থায়) নি এতি (নীত বা উপনীত হয়)----জরয়া (জরা হেতু) বা (অথবা) উপতপতা বা (তপ/তাপ বা তেজের দ্বারা 'উপ' বা উপনীত হয়), অণিমানং (অণু /সূক্ষ্ম অবস্থায়) নিগচ্ছতি (গমন করে)---তৎ (তখন) যথা (যেমন) আম্রং (আম্র) বা (বা) উদম্বরং (উদম্বর বা ডমরু ফল) বা পিপ্পলং (পিপ্পল ফল) বা বন্ধনাৎ (বদ্ধন থেকে, বৃন্ত থেকে) প্রমুচ্যত (বিচ্যুত হয়, পড়ে যায়), এবম্ এব (এই ভাবেই) অয়ং পুরুষঃ (এই পুরুষ), এভিঃ (এই সকল) অঙ্গেভ্যঃ (অঙ্গ সকল থেকে, শরীর থেকে) সংপ্রমুচ্য (সম্যক রূপে মুক্ত হয়ে) পুনঃ (পুনর্বার) প্রতিন্যায়ং (যে দিক দিয়ে এসেছিলেন বা যে দিক দিয়ে এসে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন) প্রতিযোনি (যে মূল বা যোনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন) আদ্রবতি (দ্রুত গমন করেন) প্রাণায় এব (প্রাণময় হবার জন্য)।। ৪।৩।৩৬।
অর্থ।
সে যখন এই অণু /সূক্ষ্ম অবস্থায় নীত বা উপনীত হয়), জরা হেতু অথবা তপ/তাপ বা তেজের দ্বারা 'উপ' বা উপনীত হয়ে, অণু /সূক্ষ্ম অবস্থায় গমন করে, তখন যেমন আম্র (আম) বা উদম্বর (ডমরু ফল) বা পিপ্পল ফল বদ্ধন থেকে (বৃন্ত থেকে) বিচ্যুত হয় (মুক্ত হয়), এই ভাবেই এই পুরুষ (শরীরস্থ পুরুষ), এই সকল অঙ্গ থেকে (শরীর থেকে) সম্যক্ রূপে মুক্ত হয়ে পুনর্বার যে দিক দিয়ে এসেছিলেন (বা যে দিক দিয়ে এসে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন), যে মূল বা যোনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন তথায় দ্রুত গমন করেন প্রাণময় হবার জন্য।। ৪।৩।৩৬।
নিরুক্ত।
জরা হেতু, ব্যাধি হেতু বা অন্য কারণে, দেহত্যাগের সময়ে, প্রাণ বা তেজের দ্বারা অণু বা সূক্ষ্ম অবস্থায় নীত হয়, তখন এই শরীর থেকে বা স্থূল স্থিতির থেকে সম্যক্ ভাবে জীব মুক্ত হয়।
এখানে যে তিনটি (আম্র, উদম্বর, পিপ্পল) ফলের বৃন্তচ্যুত হওয়ার বা বদ্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা তিনটি মুক্তি। আমরা মন, হৃদয় এবং সংস্কার ক্ষেত্র, এই তিনটি জায়গায় আটকে আছি বা জড়িয়ে গেছি বা জাড্যতার দ্বারা বদ্ধ হয়েছি।
ভৌতিক যে বিশ্ব তা আমার মনেই অনুভূত হচ্ছে। জ্ঞান বা বোধে, যেখানে আমরা আকার আয়তনময় বিশ্বকে উপল্বদ্ধি করি তার নাম মন। ভৌতিক বিশ্বকে জ্ঞানমূর্ত্তি বা মনোময় বলে জানলে, বার বার বাধ্যতামূলক যে জন্ম মৃত্যু তার থেকে অব্যহতি পাওয়া যায়, ভৌতিকতার প্রভাব চলে যায়, বিদেহ অবস্থায় থাকাই স্বাভাবিক হয়ে যায়।যোগ শাস্ত্রে এর নাম, ব্রহ্ম গ্রন্থি ভেদ বা জ্ঞান মুক্তি। এই মুক্তি কে বলা হয়েছে আম্রফলের বৃন্তচ্যুত হওয়া।
বিশ্বকে জ্ঞানমূর্ত্তি বলে জানলেও, হৃদয়ের যে কামনা, অনুরাগ, বিরাগ, এইগুলি থেকে যায়। যখন জানা যায় যে জ্ঞান মানে প্রাণ, অর্থাৎ নিজেই নিজেকে দ্বিতীয় বোধে বা জ্ঞানে জানছেন, নিজেই নিজেকে দ্বিতীয় করে ভোগ করছেন, তখন এই রাগ, অনুরাগের যে বশ্যতা, তা চলে যায়। সেই রকম বিজ্ঞাতা,প্রিয়জনকে বা প্রিয় বিষয়কে পেয়ে বা হারিয়ে কখনো বিচলিত হন না। এর নাম, বিষ্ণু গ্রন্থি ভেদ বা রাগ মুক্তি। এই মুক্তি কে বলা হয়েছে উদম্বর ফলের বৃন্তচ্যুত হওয়া।
উদম্বর----উৎ (ঊর্ধ্ব)+অম্বর (আকাশ) ------ঊর্ধ্ব হৃদয় আকাশ বা ঊর্ধ হৃদয়, যেখানে রাগ মুক্তি হয়।
জ্ঞান এবং রাগ মুক্তির পরও, সংস্কারের প্রভাব থেকে যায়। আমরা যে জন্ম জন্ম ধরে, দেখা, শোনা, চলা, বসা, খাওয়া ইত্যাদি কর্ম্ম করে এসেছি, তাদের প্রভাব বা বশ্যতা থেকে যায়। যখন জ্ঞানময়তা বা প্রাণময়তা, আত্মপ্রকাশ মাত্র বলে জানা যায়, তখন কর্ম্মসকল আত্মময় হয়। এই অবস্থার বর্ণনা আগেও করা হয়েছে। ( উপড়ে ৪।৩।২৩ মন্ত্র এবং পরবর্ত্তী মন্ত্রগুলি দ্রষ্টব্য।) এই রকম বিজ্ঞাতা পুরুষ যে দেখেন না তা নয়; তিনি দেখেও দেখেন না; অবশ্যই তাঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই যা তাঁর থেকে অন্য এবং বিভক্ত যে তাকে তিনি দেখবেন"। ( উপড়ে ৪।৩।২৩ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) এই রকমই তাঁর শ্রবণ, আস্বাদন,আঘ্রাণ,স্পর্শ, মনন ইত্যাদি কর্ম্ম।এর নাম নৈষ্কর্ম্ম বা সন্যাস (সংন্যাস), সৎ স্বরূপে ন্যস্ত হওয়া। আমরা যেমন প্রাণময়তা বা কর্ম্মের দ্বারা বেঁচে থাকি, যাঁর নৈষ্কর্ম্ম লাভ হয়েছে, তিনি স্বেচ্ছায় কর্ম্মকে নিজের থেকে প্রকাশ করেন। আমাদের কাছে দেখা, শোনা, খাওয়া ইত্যাদি আবশ্যকতা, কিন্তু এঁর কাছে নয়। (মহাভারতে এক সন্যাসীর কথা আছে, তাঁর নাম জৈগীষব্য। জৈগীষব্য এবং অসিত দেবলের কাহিনীতে প্রকৃত সন্যাসীর আচরণের বর্ণনা আছে। উপড়ে ৪।৩।১২ মন্ত্রে স্বাধীন আত্মার যথেচ্ছ বিচরণের যে বর্ণনা করা হয়েছে, তা প্রকৃত সন্যাসীর আচরণে দৃষ্ট হয়।
পিপ্পল= পি+প+পল; পি----পান করা; প---পা---পালন করা; পল----ক্ষণস্থায়ী কাল। (পল+অয়ন= পলায়ন বা অন্তর্হিত হওয়া।)
কালের অনুশাসনে আমরা যে নশ্বরতা বা ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্ব ভোগ করি, তার নাম পিপ্পল বা পিপুল ফল খাওয়া।(মুণ্ডকোপনিষৎ, ৩। ১। ১ দ্রষটব্য।)
এই কাল বা প্রাণ যাঁর থেকে উৎপন্ন হন, তিনি অবিনশ্বর আত্মা। এই নশ্বরতা বা ক্ষণস্থায়ী অবস্থাকে যিনি খেয়ে ফেলেন, গ্রাস করেন, তাঁর নাম পিপ্পলাদ----পিপ্পল (পিপুল ফল) অদতি (খাচ্ছেন)। উপনিষদের ঋষি পিপ্পলাদ, এই অবিনশ্বর আত্মা এবং প্রাণের বিষয়ে বিস্তৃত উপদেশ দিয়ছেন। এই প্রাণ এবং অবিনশ্বর আত্মার যিনি দ্রষ্টা তাঁর নাম পিপ্পলাদ ঋষি এবং তাঁর প্রণীত উপনিষদের নাম প্রশ্নোপনিষৎ।
শরীর থেকে মুক্ত হয়ে কর্ম্মানুসারে আমাদের ভোগ হয় এবং লোক লোকান্তরে গতি হয়। বিরাটে, দৈবক্ষেত্রে বা অধিদৈবে আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব লোক আছে, যা আমাদের যোনি, উৎস বা আশ্রয়। আমরা জ্ঞানতঃ বা স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় নানা লোকের মধ্য দিয়ে আমাদের যোনি বা আশ্রয়ে উপনীত হই এবং আমাদের এই গতিকেই বলা হয়েছে----" পুনঃ (পুনর্বার) প্রতিন্যায়ং (যে দিক দিয়ে এসেছিলেন বা যে দিক দিয়ে এসে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন) প্রতিযোনি (যে মূল বা যোনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন) আদ্রবতি (দ্রুত গমন করেন) প্রাণায় এব (প্রাণময় হবার জন্য) "।
' প্রাণায় এব ',এর একটি অর্থ ---- পুনরায় প্রাণময় হবার জন্য বা পুনর্জন্মের জন্য বা লোকান্তরে জন্মের জন্য । আর একটি অর্থ----- প্রাণের দ্বারা আহূত হয়ে।
৩৭ শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩৭।)
তদ্যথা রাজানমায়ন্তমুগ্রাঃ প্রত্যেনসঃ সূতগ্রামণ্যোऽন্নৈঃ পানৈরবসথৈঃ প্রতিকল্পন্তে, অয়মায়াতি, অয়মাগচ্ছতীতি, এবং হৈবংবিদং সর্ব্বাণি ভূতানি প্রতিকল্পন্ত, ইদং ব্রহ্মায়াতি, ইদমাগচ্ছতীতি। ৪।৩।৩৭।
অন্বয় এবং অর্থ।
তৎ (তখন) যথা (যেমন) রাজানম্ আয়ন্তম্ (আয়ন্তম্--আগমনকারী, রাজানম্----রাজার জন্য) উগ্রাঃ (যাঁরা উগ্র) প্রতি এনসঃ (এনসঃ প্রতি--পাপসকলের প্রতি) সূতগ্রামণ্যঃ (যাঁরা গ্রামসকল হতে সূত বা আগত) অন্নৈঃ (অন্ন সকলের সাথে) পানৈঃ (পানীয় সকলের সাথে) আবসথৈঃ (আবাস সমূহের সাথে বা বস্ত্রাদি সহ) প্রতিকল্পন্তে (প্রতীক্ষা করেন)--- অয়ম্ আয়াতি (ঐ আবির্ভূত হচ্ছেন), অয়ম্ আগচ্ছতি (ঐ আসছেন) ইতি। এবং হ (এই ভাবেই) এবং বিদং (এই রকম বিজ্ঞাতার জন্য) সর্ব্বাণি ভূতানি (সকল ভূত সকল, ভূতাধিপতি পুরুষ গণ) প্রতিকল্পন্ত (প্রতীক্ষা করেন)---- ইদং (এইতো) ব্রহ্ম আয়াতি (ব্রহ্ম আবির্ভূত হচ্ছেন), ইদম্ (এইতো) আগচ্ছতি (আসছেন) ইতি।। ৪।৩।৩৭।
অর্থ।
তখন যেমন আগমনকারী, রাজার জন্য, যাঁরা পাপসকলের প্রতি উগ্র (রাজার অধীনে যাঁরা পাপ কর্ম্ম সকলকে দমন করেন), যাঁরা গ্রামসকল হতে সূত বা আগত, (তাঁরা) অন্ন, পানীয় ও বস্ত্রাদি সহ প্রতীক্ষা করেন--- ঐ আবির্ভূত হচ্ছেন, ঐ আসছেন এই ভাবেই এই রকম বিজ্ঞাতার জন্য সকল ভূত সকল, (ভূতাধিপতি পুরুষগণ বা সত্তারা) প্রতিকল্পন্ত (প্রতীক্ষা করেন)---- এইতো ব্রহ্ম আবির্ভূত হচ্ছেন, এইতো আসছেন, (এই রকম হর্ষোক্তি করতে করতে)।। ৪।৩।৩৭।
নিরুক্ত।
১। ইদং (এইতো) ব্রহ্ম আয়াতি (ব্রহ্ম আবির্ভূত হচ্ছেন), ইদম্ (এইতো) আগচ্ছতি (আসছেন)----এইতো ব্রহ্ম আবির্ভূত হচ্ছেন, এইতো আসছেন
পূর্ব্বের মন্ত্রগুলিতে ব্রহ্মলোকের এবং ব্রহ্মানন্দের বিষয়ে বলা হয়েছে। এই মন্ত্রে ব্রহ্মবিদ্ পুরুষ যখন প্রয়াণ করেন,তখন সর্ব্বভূত সকল, বিরাট বিশ্বের যত সব চিন্ময় সত্তারা আছেন তাঁরা, সেই ব্রহ্মজ্ঞের আগমনের প্রতীক্ষায় অবস্থান করেন। "ঐ আবির্ভূত হচ্ছেন, ঐ আসছেন, এইতো ব্রহ্ম আবির্ভূত হচ্ছেন, এইতো আসছেন' এই রকম উক্তির দ্বারা তাঁরা ব্রহ্মজ্ঞের সান্নিধ্যের যে আনন্দ তা প্রকাশ করতে থাকেন।
' এইতো ব্রহ্ম আবির্ভূত হচ্ছেন ', এই উক্তিতে, ব্রহ্মজ্ঞকে ব্রহ্ম বলেই সম্বোধন করা হয়েছে, কারণ ব্রহ্মকে জেনে ব্রহ্মজ্ঞ ব্রহ্মই হন (ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি)। জানা মানেই হওয়া, বা যা আমরা জানি বা বোধ করি আমরা আমাদের চেতনায় তাই হয়ে যাই; শরীর বোধের দ্বারা বা ভৌতিকতার দ্বারা আমরা আচ্ছন্ন থাকি বলে, যা বোধ করি, মাত্র তাই প্রাধান্য পায়, চেতনায় আমরা কিভাবে পরিবর্ত্তিত হচ্ছি তা লক্ষে আসে না।
উল্লেখযোগ্য যে অধঃস্থ এবং ঊর্ধ্বস্থ সর্ব্ব জীবই নিজের অজান্তে অথবা সচেতনতার সাথে ব্রহ্ম সান্নিধ্য কামনা করে। ব্রহ্ম সান্নিধ্য মানে যিনি পরম আত্ম স্বরূপ, নিজের থেকেও নিজের, যিনি অন্তহীন আত্মস্বরূপ, সেই নিজের সান্নিধ্য।
২। তৎ (তখন) যথা (যেমন) রাজানম্ আয়ন্তম্ (আয়ন্তম্--আগমনকারী, রাজানম্----রাজার জন্য) উগ্রাঃ (যাঁরা উগ্র) প্রতি এনসঃ (এনসঃ প্রতি--পাপসকলের প্রতি) সূতগ্রামণ্যঃ (যাঁরা গ্রামসকল হতে সূত বা আগত) অন্নৈঃ (অন্ন সকলের সাথে) পানৈঃ (পানীয় সকলের সাথে) আবসথৈঃ (আবাস সমূহের সাথে/ বাস বা বস্ত্র সকলের সাথে) প্রতিকল্পন্তে (প্রতীক্ষা করেন)--- অয়ম্ আয়াতি (ঐ আবির্ভূত হচ্ছেন), অয়ম্ আগচ্ছতি (ঐ আসছেন)----তখন যেমন আগমনকারী, রাজার জন্য, যাঁরা পাপসকলের প্রতি উগ্র (রাজার অধীনে যাঁরা পাপ কর্ম্ম সকলকে দমন করেন), যাঁরা গ্রামসকল হতে সূত বা আগত, (তাঁরা) অন্ন, পানীয় ও বস্ত্রাদি সহ প্রতীক্ষা করেন--- ঐ আবির্ভূত হচ্ছেন, ঐ আসছেন এই ভাবেই এই রকম বিজ্ঞাতার জন্য সকল ভূত সকল, (ভূতাধিপতি পুরুষগণ বা সত্তারা) প্রতিকল্পন্ত (প্রতীক্ষা করেন)---- এইতো ব্রহ্ম আবির্ভূত হচ্ছেন, এইতো আসছেন, (এই রকম হর্ষোক্তি করতে করতে)
সেই ভূতবর্গ, বা চিন্ময় সত্তারা, সুরাসুর, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা, যক্ষ, রাক্ষস এবং দৈত্য গণ, নাগ, কিন্নর, নদী এবং বিদ্যাধরগণ, মাস, ঋতু ইত্যাদি কালপুরুষগণ. ঋষিগণ, অন্যান্য ভূতাধিপতিগণ, ইত্যাদি সকলে, 'ঐ আবির্ভূত হচ্ছেন, ঐ আসছেন' এই রকম হর্ষোক্তি করতে করতে, (দিব্য) অন্ন, (দিব্য) পানীয়, (দিব্য) বস্ত্রাদি নিয়ে, এই প্রকার যে বিজ্ঞাতা, যিনি ব্রহ্মবিদ্, তাঁর সঙ্গ লাভের জন্য প্রতীক্ষা করেন।
৩৮শ মন্ত্র।(বৃহদারণ্যক ৪।৩।৩৮।)
তৎ যথা রাজানং প্রয়িয়াসন্তমুগ্রাঃ প্রত্যেনসঃ সূতগ্রামণ্যোऽভিসমায়ন্তি, এবমেবেমমাত্মানমন্তকালে প্রাণা অভিসমায়ন্তি, যত্রৈতদুর্ধ্বোচ্ছ্বাসী ভবতি।।৪।৩।৩৮।
অন্বয় এবং অর্থ।
তৎ যথা (তখন যেমন) রাজানং প্রয়িয়াসন্তম্ (প্রয়িয়াসন্তম্---প্রত্যাগমনকারী; রাজানং--রাজার নিকটে) উগ্রাঃ (যাঁরা উগ্র) প্রতি এনসঃ (এনসঃ প্রতি--পাপসকলের প্রতি) সূতগ্রামণ্যঃ (যাঁরা গ্রামসকল হতে সূত বা আগত) অভিসাময়ন্তি (সমাগত হয়), এবম্ এব (এই রকমই) ইমম্ (এই) আত্মানম্ (আত্মার নিকটে) অন্ত কালে (অন্ত কালে---প্রয়াণ কালে) প্রাণাঃ (প্রাণ সকল) অভিসমায়ন্তি (সমাগত হয়), যত্র (যখন) এতৎ (এখান থেকে/শরীর বা মর্ত্ত থেকে) ঊর্ধ্বঃ (ঊর্ধ্বে) উৎ শ্বাসী (উৎক্রমণের যে শ্বাস বা প্রাণগতিময়) ভবতি (হয়)।। ৪। ৩। ৩৮
অর্থ।
যেমন প্রত্যাগমনকারী রাজার নিকটে, যাঁরা পাপসকলের প্রতি উগ্র (যাঁরা পাপসকলকে উগ্রতার সাথে ধ্বংস করেন), যাঁরা গ্রামসকল হতে সূত বা আগত, তাঁরা সমাগত হন, এই রকমই এই আত্মার নিকটে অন্ত কালে (প্রয়াণ কালে) প্রাণ সকল সমাগত হয়, যখন এখান থেকে (শরীর বা মর্ত্ত থেকে) (আত্মা/প্রাণ) ঊর্ধ্বে (ক্রমণ করার জন্য) উৎ শ্বাসী (উৎক্রমণের যে শ্বাস বা প্রাণগতিময়) হন।। ৪। ৩। ৩৮।
নিরুক্ত।
পূর্ব মন্ত্রে ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মের আগমনের বিষয়ে বলা হয়েছে এবং আয়ন্তম্ (আগমন করছেন) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই মন্ত্রে প্রয়িয়াসন্তম্ (প্রত্যাগমন) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এই কারণে যে প্রয়াণের পর, ব্রহ্মবিদ্ পুরুষ ব্রহ্মলোকেই গমন করেন। (ছান্দোগ্য উপনিষৎ, মন্ত্র ৪।১৫।৫ দ্রষ্টব্য এবং কৌষীতকি উপনিষৎ, মন্ত্র ১।৩ থেকে ১।৭ দ্রষ্টব্য।) ব্রহ্মই ব্রহ্ম থেকে বহির্গত হয়ে জীব হন, এবং জীবরূপ ব্রহ্মই ব্রহ্মে প্রত্যাগমন করে নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হন।
অন্ত কালে, প্রাণ সকল বা ইন্দিয়শক্তিরা, যাঁরা সর্ব্বাঙ্গে প্রসৃত হয়েছিলেন (অর্থাৎ গ্রাম সকল থেকে সূত হয়েছিলেন), তাঁরা আত্মায় সমাগত হন। প্রাণের যে তেজোময় স্বরূপ, তাঁর নাম 'উদান'। এই উদানের দ্বারাই জীব শরীর থেকে উত্থিত হয়ে অন্য , সূক্ষ্মতর শরীর বা লোকে গমন করেন। (এই প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়, চতুর্থ ব্রাহ্মণ দ্রষ্টব্য।)
Comments
Post a Comment