উপনিষদের বায়ু , আকাশ, এবং সোম ------ দেবী বর্গভীমা ও পাণ্ডব ভীম।(An article in Bengali language on the Goddess Vargabhiimaa and her foundation in Upanishads.)

উপনিষদের বায়ু, আকাশ, এবং সোম ------দেবী বর্গভীমা ও পাণ্ডব ভীম। 

সূচীপত্র

১।ভূমিকা

২। দেবী বর্গভীমা মন্দির--সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। 

৩। দেবী বর্গভীমা----বায়ু এবং আকাশ। 

৪। বায়ু এবং প্রাণ। 

৫। বায়ু এবং সংবর্গ।

৬। বর্গ, বায়ু, এবং বায়ুর সংখ্যা।

৭। বায়ু এবং আত্মস্ফীতি----বিশ্বের প্রসারণ। 

৮। দেবী দুর্গা এবং অশ্বমেধ।মেধা ও মেদিনীপূর।  

৯। দিক্‌ ও স্পর্শ, দিক্‌ ও আকাশ।

১০। উগ্রতারা।

১১। ভীমা আকাশ ।

১২।বলি।

১৩। বহুল আকাশ। 

১৪। মৃত্যুকালীন অবস্থান্তর এবং উদান বায়ুর দ্বারা উৎক্রমণ। 

১৫। আকাশ ত্রয়।  

১৬। দেবীর ত্রিনয়ন। 

১৭।শব্দ ও আকাশ। স্মৃতি ও শ্রুতি। 

১৮।সুলভ আকাশ এবং দুর্লভ আকাশ।

১৯।সাম এবং সংবর্গ। 

২০।ভীমা, ভ্রামরী, ভ্রূ।

২১।মূর্ত্ত এবং অমূর্ত্ত, সত্যবোধ এবং সংবর্গ।  

২২। কাল, দিক্‌ এবং দেশ।দিগ্বাসিনী দেবী।

২৩।আকাশ এবং অক্ষর আত্মা।

২৪। শ্রুতি, প্রতিশ্রুতি এবং দিক্‌। 

২৫।সতীপীঠ-বর্গভীমা। দক্ষিণাচার ও  বামাচার। দক্ষিণ ও উত্তর দিক্‌। যম এবং সোম। 

২৬।সত্যভামা।

২৭।বামন মন্ত্র।

২৮।সব্য, সব, সবন এবং সাবিত্রী। 

২৯।বিভাস শক্তি পীঠ।

৩০।কুন্তী পুত্র ভীম।

৩১।সত্য।

৩২। মন্তব্য

........................................................................................................................................................................

১।ভূমিকা
দ্যু এবং ভূ, স্বর্গ এবং মর্ত্ত্য যাঁদের কাছে এক হয়ে গিয়েছিল, এক সময় সমাজ তাঁদের অনুশাসনে চালিত হয়েছিল। অমৃত কি ভাবে মূর্ত্ত হয়েছেন, মর্ত্ত্য হয়েছেন, সেই দর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সত্য দ্রষ্টা ঋষিরা সমাজকে প্রভাবিত করেছিলেন। তাই আমাদের তীর্থে, দেব মন্দিরে, পৌরাণিক কাহিনী এবং প্রাচীন ইতিহাসে সেই প্রভবের প্রভা, যাঁরা সুধী, শ্রদ্ধাবান্‌ তাঁদের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। সব কিছু যদি চিন্ময় ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত, যদি তাঁরই প্রকাশ, তাহলে সকল কিছুতেই সেই চিন্ময়ের মহিমা এবং বিজ্ঞান বিদ্যমান থাকতে বাধ্য, তা কোন দৈব বা পৌরাণিক চরিত্রই হোক, কোন মন্দিরের স্থাপত্যই হোক, বা ইতিহাসের কোন ঘটনাই হোক।
মূর্ত্ত বা আয়তনময়তা যখন অমূর্ত বা অনায়তন হয়, তা আকাশ (শব্দ) এবং বায়ু (স্পর্শ) নামক দুই তত্ত্বের অন্তর্ভূক্ত।চিন্ময় ব্রহ্মের আকাশ (ভীমা) এবং বায়ু (বর্গ) এই দুই মহিমা বর্গভীমাক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্য।
এই প্রবন্ধে বায়ু এবং আকাশের যে বিজ্ঞান উপনিষদে উক্ত হয়েছে তার ব্যাখ্যা, এবং সংশ্লিষ্ট উপনিষদের মন্ত্র সকল অর্থ সহ উদ্ধৃত করা হয়েছে; এই বিজ্ঞানের পটভূমিকায় দেবী বর্গভীমার রহস্য বর্ণনা করা হয়েছে। বামাচার, যম, সোম, মধ্যম পাণ্ডব ভীম এবং শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামার যে ঔপনিষদ্‌ তাৎপর্য তার উল্লেখ করা. হয়েছে।
মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৪৫) এবং তাঁর প্রধান শিষ্য মহর্ষি ত্রিদিবনাথ বন্দ্যোপাধায়ের (১৯২৩-১৯৯৪) উপদেশ অবলম্বন করে এই প্রবন্ধটি পরিবেশিত হলো। 
<debkumar.lahiri@gmail.com>

২। দেবী বর্গভীমা মন্দির--সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। 

মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরের প্রাচীন নাম তাম্রলিপ্ত। এই শহর পৃথিবীর একটি অতি- প্রাচীন বন্দর-নগর এবং এই স্থানের উল্লেখ মহাভারতে আছে। কথিত আছে যে এই নগর এক সময় দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের অধীনে ছিল।  বহু ইতিহাস সমৃদ্ধ এই শহরে, রূপনারায়ণ নদীর তীরে, দেবী বর্গভীমার মন্দির অবস্থিত।  মোগল সেনাধ্যক্ষ কালাপাহাড় এই মন্দির ধ্বংস করতে সক্ষম হননি; শোনা যায় যে দেবীকে স্বপ্নে এক অতিসুন্দরী নারী রূপে দেখে তিনি ধ্বংস কার্য থেকে নিবৃত্ত হন। এই স্থান একটি শক্তি পীঠ। এইস্থানে দেবীর (সতীর) বাম গুল্‌ফ (গোড়ালি) পতিত হয়েছিল। মন্দিরের গর্ভ-গৃহ এবং তৎসংলগ্ন এলাকা রাস্তার থেকে অনেকটা উপরে;  দীর্ঘকায় সোপান শ্রেণী রয়েছে মন্দিরে পৌছানোর জন্য। গর্ভ-গৃহের কাছে একটি গাছ এবং পাশে একটি পুষ্করিণী আছে। 

এই সব ইতিহাসের বিষয়ে Internet এ অনেক তথ্য আছে। Internet এর কয়েকটি link নীচে উল্লেখ করা হলো। 

https://inscript.me/satipith-bargabhima-midnapore-mythology-and-history

https://www.aajbangla.in/know-about-maa-bargavima-and-temple-history-at-tamluk

৩। দেবী বর্গভীমা----বায়ু এবং আকাশ। 

বর্গ অর্থে বায়ু এবং ভীমা অর্থে আকাশ। চিন্ময় ব্রহ্মের আকাশ এবং বায়ুরূপ যে মহিমা বা শক্তি, তিনি দেবী বর্গভীমা। ছান্দোগ্য উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ে বায়ুকে সংবর্গ বলা হয়েছে---বায়ুর্বাব সংবর্গো----বায়ুই সংবর্গ, অর্থাৎ বায়ুই প্রকৃত বর্গ। (ছান্দোগ্য উপনিষদ মন্ত্র ৪।৩।২ দ্রষ্টব্য।) বায়ু বা প্রাণ থেকে সকল বর্গ বা প্রজাতিরা সৃষ্ট হয়েছে। তাই বায়ুই সংবর্গ।

আকাশ হল ভীম, যিনি ভীষণতার দ্বারা মণ্ডিত। দেবীর অন্য নাম উগ্রতারা। শিবকে  উগ্র-রূপ বায়ু এবং ভীম-রূপ আকাশ বলে উপাসনা করা হয়।শিবের মন্ত্রে বলা হয়েছে, 'ওঁ উগ্রায় বায়ু মূর্ত্তয়ে শিবায় নমঃ, ওঁ ভীমায় আকাশ মূর্ত্তয়ে শিবায় নমঃ। দেবী বর্গভীমা, বায়ু এবং আকাশরূপী শিবশক্তি।  

৪। বায়ু এবং প্রাণ। 

যিনি সবাইকে স্পর্শ করে আছেন, অর্থাৎ সবাইকে নিজেতে সংলগ্ন বা সংযুক্ত করে রেখেছেন এবং তা জানছেন বা তাতে বেদনময় হয়েছেন তাঁর নাম বায়ু। প্রাণের বা চিন্ময় আত্মস্বরূপের যে সর্ব্ব সংযোগময় স্বরূপ, যার দ্বারা এই বিশ্ব ভুবনকে আত্ম-তন্তুর দ্বারা বয়ন করেছেন, তাঁর নাম বায়ু। বায়ুর একনাম সূত্রাত্মা (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৭।২ দ্রষ্টব্য।) এই সূত্রের দ্বারা বিশ্ব ভুবনের সবাই সবার সাথে যুক্ত। বায়ু = বা +য়ু;  ' বা ' ধাতুর  অর্থ 'চলা, বয়ন করা' ।' য়ু ' অর্থে 'যু' বা ' যুজ্‌ ' বা যুক্ত করা। 

যে প্রাণ বাহিরে বায়ু , অন্তরে তাঁর নাম আয়ু, প্রাণ বায়ু, বা প্রাণ। ইনি সূত্র বা সূত্রাত্মা, অর্থাৎ একের সাথে আর এককে যুক্ত করে রাখেন। যুক্ততা, যোজ্যতা, জুড়ে রাখাই এঁর ধর্ম্ম, তাই ইনি যজুর্ব্বেদের মুখ্য দেবতা এবং যজুর্ব্বেদের প্রথম মন্ত্রে বায়ু শব্দ উক্ত হয়েছে। ইন্দ্রিয়রা এই যজুর্ব্বেদ বা আত্মার যজুঃ বা আত্মযোগের যে বেদন তার অন্তর্গত। এই ইন্দ্রিয়দের দ্বারাই আমরা বহির্বিশ্বের সাথে যুক্ত। 

অন্তর এবং বহিঃ এই দুইয়ের ইনিই যোজক, তাই অন্তস্থ 'য' এবং বর্গীয় ' জ '; এই দুইটি অক্ষর নিয়ে হয়েছে যজ্‌ বা যজুঃ বা যজন শব্দগুলি।  যজন= যজ্‌ + অন; অন অর্থে প্রাণ। এই চেতনা বায়ু বা প্রাণ হয়ে সবাইকে নিজের সাথে এবং সবার সাথে যুক্ত করে রেখেছেন, এবং এই কর্ম্মের নাম যজনা।  আবার আমরা যে এঁতে যুক্ত এইটি দেখার নামও যজনা।

আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সকল যে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে এবং সেই যুক্ততার মাধ্যমে যে শারীর কার্য্য নির্বাহ হয়, তা প্রাণের এই সূত্র রূপ মহিমার দ্বারা হয়। তাই এই প্রাণের সাথে যখন আমরা শরীর থেকে নিষ্ক্রান্ত হই, তখন প্রথমে অঙ্গসকল শিথিল হয়ে যায় (primary flaccidity), কেননা এই সূত্রের বন্ধন আর থাকে না। এই প্রসঙ্গে বৃহদারণকের এই উক্তিটি অর্থ সহ উদ্ধৃত করা হলো : 

বায়ুর্বৈ গৌতম তৎ সূত্রম্‌; বায়ুনা বৈ গৌতম সূত্রেণ অয়ং চ লোকঃ পরশ্চ লোকঃ সর্ব্বাণি চ ভুতানি সংদৃব্ধানি ভবন্তি; তস্মাদ্বৈ গৌতম পুরুষং প্রেতম্‌ আহুঃ বিস্রংসিত অস্য অঙ্গানি ইতি; বায়ুনা বৈ গৌতম সূত্রেণ সংদৃব্ধানি ভবন্তি। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ , মন্ত্র ৩।৭।২ থেকে উদ্ধৃত।)-------' হে গৌতম, বায়ুই সেই সূত্র; বায়ু-রূপ সূত্রের দ্বারা ইহ লোক, পরলোক, সকল ভূত সমূহ  (যা কিছু সৃষ্ট হয়েছে) সম্যক ভাবে দৃঢ় হয়েছে; সেই জন্য গৌতম, প্রয়াত পুরুষকে (প্রয়াত পুরুষের সম্বন্ধে) বলে, ''এর অঙ্গ সকল বিস্রস্ত (শিথিল) হয়েছে '' ; বায়ু-রূপ সূত্রের দ্বারা সম্যক রূপে দৃঢ় হয় ' । 

৫। বায়ু এবং সংবর্গ।

 উপনিষদে বায়ুকে সংবর্গ বলা হয়েছে ----বায়ুর্বাব সংবর্গো----বায়ুই সংবর্গ, অর্থাৎ বায়ুই প্রকৃত বর্গ। ( ছান্দোগ্য উপনিষদ মন্ত্র ৪।৩।২ দ্রষ্টব্য।) বর্গ  অর্থে  শ্রেণী, গোষ্ঠী, সমূহ , জাতি, ইত্যাদি। সৃষ্টিতে এই সমূহতা বা বর্গ সর্ব্বত্র দেখা যায়। একই জাতীয় জীব, একই জাতীয় বস্তু, সম বা সদৃশ ধর্ম্ম , এই সবের দ্বারা শ্রেণী, জাতি বা গোষ্ঠী নির্ব্বাচিত হয়। সমগ্র সৃষ্টি, প্রাণ বা বায়ু থেকে জাত হয়েছে, তাই আমরা সবাই প্রাণের বা বায়ুর সদৃশ, বা এই প্রাণের সন্তান, বা প্রজাপতির প্রজা, এবং এইজন্য সমগ্র সৃষ্টি প্রাণরূপ বা বায়ুরূপ মহাবর্গ বা সংবর্গের অন্তর্ভূক্ত। উপনিষদে বলা হয়েছে যে বায়ু বা প্রাণ এই কারণে সংবর্গ, যেহেতু ' সংবৃঙ্‌ক্ত/সংবৃঙ্‌ক্তে  ' , অর্থাৎ সকল কিছুকে নিজের মধ্যে সংহরণ করেন। এই সংবৃঙ্‌ক্ত শব্দটি বৃজ্‌/বৃ~ঞ্জ ধাতু এবং বৃণ্‌ ধাতু সম্পন্ন। 

বৃজ্‌/বৃ~ঞ্জ ধাতুর অর্থ, বর্জন করা, বক্র করা। বৃণ্‌ ধাতুর অর্থ গ্রাস করা, সংহরণ করা। বক্র অর্থে দিক্‌। দিক্‌ পরিবর্ত্তন হলে বক্রতা প্রকাশ পায়। স্থূল যে চেহারা, যা চাক্ষুষ, তা বর্জ্জিত হয় এবং তখন আমরা অশরীরী হয়ে বায়ুকে আশ্রয় করি।  বায়ুর এক নাম মরুৎ, যিনি মর, মর্ত্ত বা স্থূলের ঊর্ধ্বে। উপনিষদে বায়ুকে এবং আকাশকে অশরীরী বলা হয়েছে এবং বায়ু আকাশ থেকে উৎপন্ন, তাও উক্ত হয়েছে।(ছান্দোগ্য উপনিষদ মন্ত্র ৮।১২।২। দ্রষ্টব্য।) 

সীমাময় যে আয়তন, দেহ বা আকার, তা যেখানে থাকে না, অর্থাৎ যখন সীমাবদ্ধ 'দেশ' আর থাকে না, তখন আমরা হই দিক্‌-অভিমানী।  তখন বায়ু বা প্রাণই আমাদের অবলম্বন হয়; এই প্রকৃত অশরীরী অবস্থা। দিক্‌ অর্থে, প্রাণের প্রবণতা। প্রাণের প্রবণতাগুলিই দিক্‌। তাই উপনিষদে বলা হয়েছে, ' সর্ব্বা দিশঃ সর্ব্বে প্রাণাঃ ' (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪।২।৪।)

বৃহদারণ্যক উপনিষদে বায়ুকে ব্যষ্টি এবং সমষ্টি বলা হয়েছে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৩।৩।২)। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা, কিন্তু প্রত্যেকেই বায়ু বা প্রাণ থেকে জাত, বায়ু বা প্রাণের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র প্রকাশ। এই জন্য বলা হলো বায়ুই ব্যষ্টি। আবার আমরা সবাই প্রাণ বা বায়ু থেকে মূর্ত্ত হয়ে, প্রাণ বা বায়ুর দ্বারাই একে অপরে সংযুক্ত, আমরা সবাই বায়ুর অন্তর্ভূক্ত, তাই বায়ুই সমষ্টি বা সংবর্গ। 

৬। বর্গ, বায়ু, এবং বায়ুর সংখ্যা।

বর্গ শব্দের একটি অর্থ হলো নিজেকে নিজের দ্বারা গুণ করা। যেমন, ২*২=৪। নিজেকে নিজের দ্বারা ইনি বহু করেন, এই ক্রিয়ার নামও বর্গ। এই ক্রিয়ার যে ফল তার নাম বর্গফল এবং এই ক্রিয়ার দ্বারা যে দেশ, ক্ষেত্র বা আয়তন রচিত হয়, তার নাম বর্গক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রের আকার যেমনই হোক, যদি তাকে প্রাণের থেকে সঞ্জাত বলে জানা যায়, তবে তা বর্গ ক্ষেত্র বলেই উপলব্ধ হবে। যা অখণ্ড সংখ্যা (natural number), যেমন ১,২,৩, ৪, ...৪৫...১১০... ইত্যাদি, তার মধ্যে প্রথম যে সংখ্যার বর্গ হয়, তা হল ২ (২*২=৪)। কেননা একের বর্গ একই (১*১=১)। তাই বর্গ ক্ষেত্র হলো চতুর্ভূজ।  বিষ্ণু, যিনি প্রাণের দৈব প্রকাশ, তিনিও চতুর্ভূজ।

চার সংখ্যাটি বায়ুর সংখ্যা, কেননা প্রথম বর্গফল  হলো চার (২*২=৪)। ২ সংখ্যার অর্থ 'দ্বিতীয়তা'। যিনি ১ , যিনি নিজে ছাড়া আর কিছু নেই, তিনি নিজেকে নিজের দ্বারা দ্বিতীয় করেন, গুণ করেন এবং বহু হন, এবং এর নাম বর্গ।  আর সেই বহু বহু নিজের টুকরাগুলি কে, বা আত্মখণ্ডগুলিকে নিজেতেই ধরে রাখেন আত্ম-সম্বন্ধে, এবং প্রতিটি খণ্ড প্রতিটি খণ্ডের সাথেও যুক্ত, কেননা তারা একই প্রাণ বা আত্মার থেকে জাত। 

আত্মার ক্রিয়াময়তাই প্রাণ।  নিজেতে নিজের দ্বিতীয় স্বরূপ সৃষ্টি করে সেই খণ্ডগুলিকে নিজেতেই যুক্ত রেখে প্রাণ বা বায়ু বহু হচ্ছেন বা স্ফীত হচ্ছেন এবং সেই জন্য বৃহদারণ্যকে বলা হয়েছে এই যে দেবতা যিনি প্রবাহিত হচ্ছেন, তিনি 'অধিঅর্দ্ধ' অর্থাৎ 'অধি-ঋধ্‌' বা বর্দ্ধনময়। ঋধ্‌ অর্থে বর্দ্ধিত হওয়া। অধিঅর্দ্ধ শব্দের আর একটি অর্থ 'দেড়' বা ১-১/২ (এক এবং অর্দ্ধ)। দেড় অর্থে এক থেকে নিজেকে খণ্ডিত করা বা দ্বিধা করা, এবং সেই খণ্ডটি একেই যুক্ত রাখা; এর নাম দেড় বা অধি অর্দ্ধ।  এই প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩।৯।৮ এবং ৩।৯।৯ মন্ত্র দুইটি   উল্লেখ করা হলো।

কতমে তে ত্রয়ো দেবা ইতি ----সেই তিন দেবতা কে কে ?  

ইম এব ত্রয়ো লোকাঃ---এই তিন লোক; এষু হি ইমে সর্ব্বে দেবা ইতি----এতেই (এই  তিন লোকেই) এই সকল দেবতারা (প্রতিষ্ঠিত)।

কতমৌ তৌ দ্বৌ দেবা ইতি---সেই দুই দেবতা কে কে ?

অন্নং চৈব প্রাণশ্চেতি ----অন্ন এবং প্রাণ 

কতমো'ধ্যর্দ্ধ ইতি (কতমঃ অধিঃ অর্দ্ধ ইতি)----কে অধিঅর্দ্ধ (দেড়--১ ১/২) ?

যো'য়ং পবত ইতি--- এই যে প্রবাহিত হয়। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৯।৮।)

তৎ আহুঃ ---তখন বলা হয়

যৎ অয়ম্‌ এক ইব এব পবতে-----যখন একজনই (এক বায়ুই) প্রবাহিত হয়

অথ কথম্‌ অধি অর্দ্ধ ইতি----তাহলে কিভাবে অধি অধি অর্দ্ধ (বা দেড়---১ ১/২) ?

যৎ অস্মিন্‌ --যেহেতু ইহাঁতে (এই বায়ুতে)

ইদম্‌ সর্ব্বম্‌ অধি অর্ধ্নোৎ---এই সকল কিছু বর্দ্ধিত হয়

তেন অধি অর্ধঃ----সেই জন্য অধি অর্ধ।

কতম একঃ দেব ইতি----এক দেবতা কে?

প্রাণঃ ইতি-----প্রাণই

সঃ ব্রহ্ম--তিনি ব্রহ্ম

ত্যৎ ইতি আচক্ষতে---ত্যৎ বা 'তাহা' এই ভাবে আচরিত হন। (বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩।৯।৯।)

প্রাণই বর্দ্ধিত হচ্ছেন। যেখানে যা কিছু আছে, তা প্রাণেরই রূপ, তা প্রাণেরই বর্দ্ধন। আমারও বর্দ্ধিত হচ্ছি প্রতি মুহূর্তে, প্রতি কর্ম্মে, প্রতি অনুভূতিতে।আমাদের থেকে আমাদের সন্তানরা সৃষ্টি হচ্ছে। এই ভাবে প্রাণ সর্ব্বদা শাখা প্রশাখা বিস্তার করছেন। শুধু  তাই নয়, এই প্রাণের প্রসারণ, বিশ্বের প্রসারণরূপে দৃষ্ট হচ্ছে, যাকে আধুনিক বিজ্ঞান Expanding Universe (এক্সপাণ্ডিং ইউনিভার্স) বা প্রসারণময় বিশ্ব বলে অভিহিত করে।

৭। বায়ু এবং আত্মস্ফীতি----বিশ্বের প্রসারণ। 

ইংরাজি ভাষায় বায়ুমণ্ডলকে এটমোস্ফেয়ার (atmosphere) বলা হয়। এটমোস্ফেয়ার (atmosphere) এই শব্দটি      ' আত্মস্ফুর বা আত্মস্ফুরণ' থেকে হয়েছে। এই আত্মস্ফুরণ বা যিনি নিজবোধ বা আত্মস্বরূপ তাঁর স্ফুরণ।  যাঁকে সবাই নিজে বলে বোধ করে, তিনি প্রাণ বা বায়ু হয়ে সর্ব্বদা বিশ্বভুবনের আকারে বর্দ্ধিত হচ্ছেন।আধুনিক বিজ্ঞান যে প্রসারিত বিশ্বের (Expanding Universe) কথা বলে, তা এই আত্মস্ফুরণেরই স্থূল প্রকাশ। 

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি বলেছেন যে সৃষ্টির আদিতে এই আত্মা স্ফীত হয়েছিলেন। স্ফীত হওয়াকে 'অশ্বৎ' বলা হয়েছে; অশ্বৎ শব্দটি শ্বি ধাতু থেকে হয়েছে। শ্বি  ধাতুর অর্থ ' স্ফীত হওয়া' । যেহেতু ইনি স্ফীত বা অশ্বৎ হয়েছিলেন, তাই এঁর নাম 'অশ্ব'। উপনিষদে প্রাণ বা বায়ুকেই অশ্ব বলা হয়েছে। উপনিষদে উক্ত হয়েছে যে মুখ্যপ্রাণ বা মৃত্যুহীন যে প্রাণ তিনি অশ্ব নাম ধারণ করে মনুষ্যদের, হয় নাম ধারণ করে দেবতাদের, বাজী নাম ধারণ করে গন্ধর্ব্বদের এবং অর্ব্বা নাম ধারণ করে অসুরদের মৃত্যুর পরপারে নিয়ে যান। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌,মন্ত্র ১।১।২, ১।২।৬, ১।২।৭ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) শ্ব শব্দের দ্বারা প্রাণ বা কালের গতি বোঝায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস (শ্ব+ অস্‌) অর্থে প্রাণের গতাগতি বা ক্ষেপণ এবং প্রতিক্ষেপণ বোঝায়। 

৮। দেবী দুর্গা এবং অশ্বমেধ।মেধা ও মেদিনীপূর।  

 যে মুখ্যপ্রাণের কথা উপরে বলা হল, তাঁর অন্য নাম দুর্গা। উপনিষদে বলা হয়েছে,  " সেই এই দেবতার নাম দূর কেননা মৃত্যু এঁর থেকে দূরে থাকে-------- " সা বা এষা দেবতা দূর্নাম, দূরং হি অস্যাঃ মৃত্যুঃ......" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌,মন্ত্র ১।৩।১২ থেকে উদ্ধৃত। )। আবার এই স্ফুরণময়, প্রসারণময় প্রাণ বা বায়ুকে অশ্ব এবং অশ্বমেধ এই দুইও বলা হয়েছে। ইনি স্ফুরিত বা স্ফীত হচ্ছেন বলে এঁর নাম অশ্ব, এঁর এই স্ফুরণে যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড রচিত হচ্ছে, তা মেধ্য। এই সৃষ্টির দ্বারা আমরা পুষ্ট হচ্ছি। শব্দ, স্পর্শ,রূপ, রস, গন্ধ আমাদের সাথে মিশে, মিশ্রিত হয়ে, আমাদের মেধা হচ্ছে। মেধা অর্থে ' মে ধাত্রী বা আমার ধাত্রী'। আর এই মেধার দ্বারা যে পুষ্টি বাইরে হয়, তার নাম স্থূলতা বা মেদ যার থেকে পৃথিবী, মেদিনী, ভৌতিকতা বা শরীর উদ্ভূত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে দেবী বর্গভীমার অধিষ্ঠান যে তাম্রলিপ্ত শহরে, তা মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। 

৯। দিক্‌ ও স্পর্শ, দিক্‌ ও আকাশ।

পূর্ব্বে উল্লেখ করা হয়েছে প্রাণই দিক্‌।সর্ব্ব দিক্‌ই প্রাণ, প্রাণের প্রবণতা;  ' সর্ব্বা দিশঃ সর্ব্বে প্রাণাঃ ' (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪।২।৪।)। 

দিক্‌ সকল যখন সক্রিয় হয়, তখন তা থেকে যা জাত হয় তার নাম হয় স্পর্শ। আমরা নিজেকে যতই ভুলে থাকি, আত্মস্বরূপ থেকে যতই দূরে যাই সৃষ্টির প্রসারণতা হেতু, এই আত্ম স্পর্শ, বা প্রাণের স্পর্শ থেকেই যায়। তাই দুর্গার ধ্যানে বলা হয়েছে, ' মৃণালায়ত সংস্পর্শ দশবাহু সমন্বিতাম্‌', অর্থৎ মৃণাল বা পদ্মের নালের মতো আয়ত যাঁর  সংস্পর্শ----পদ্মের নালকে টানলে তা যেমন দীর্ঘ হয়ে যায়, ছিন্ন হয় না, তেমনি এই দুর্গা বা মহাপ্রাণ সর্বদাই আমাদের স্পর্শ করে আছেন, সেই স্পর্শ কখন যায় না।দেবী দুর্গা দশটি বাহুর দ্বারা সমন্বিত। বাহু অর্থে স্পর্শেন্দ্রিয়। বায়ুর তন্মাত্রা হল স্পর্শ। দশবাহু অর্থে যিনি সর্ব্ব দিক্‌ময়, বা প্রাণ/মুখ্যপ্রাণ। আত্মার প্রথম সক্রিয় প্রকাশই প্রাণ। এই প্রাণের প্রকাশের যে প্রথম স্তর তা আকাশ। আকাশ হল শব্দাত্মিকা; শববৎ নিষ্ক্রিয় আত্মা 'দ' বা বাঙ্‌ময় হয়েছেন; যত শব্দ নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে, তাদের শবত্বকে বিদারিত করে জাগ্রত করেন, সঞ্জীবিত করেন। মৃত্যুর ঘড়ে যত শব্দ রয়েছে, যা কিছু অব্যক্ত, তাদেরকে এই প্রাণ জাগিয়ে তোলেন। এই বিশ্ব ভুবন চেতনারই মূর্ত্তি, চেতনার প্রকাশ মানেই শব্দ বা কথা। এই স্থূল বিশ্ব শব্দাত্মক চেতনারই মূর্ত্ত প্রকাশ। আমরা যা কিছু শুনি, অনুভব করি, তা আমাদের চেতনায় শব্দের আকারেই থাকে। 

সুতরাং, প্রথমে আকাশ বা ব্যোম, তারপর মরুৎ বা বায়ু, তার পর তেজ বা আলো বা রূপ বা আয়তন, তারপর রস (অর্থাৎ যা বিশেষ একটি আয়তনের সার বা রস, বা সেই আয়তনের প্রাপ্তি বা আপ্তির আনন্দ), এবং সর্ব্ব শেষে গন্ধ বা প্রাণের সৌরভময় পুষ্টি বা স্থূলত্ব, এই ভাবে এই মহাপ্রাণ নিজেকে প্রকাশ করেছেন। 

প্রাণের প্রবণতাগুলি বা দিক্‌ সকল এই আকাশে বা তাঁর আকাশরূপ মহিমাতে সমতায় থাকে। প্রাণের এই মহিমার আর এক নাম ' সমান '----- সম+অন।তাই উপনিষদে বলা হয়েছে, " অন্তরা যদাকাশঃ স সমানো ----অন্তরে যে আকাশ সে সমান" । (প্রশ্নোপনিষদ্‌, মন্ত্র ৩।৮ দ্রষ্টব্য।)

আমরা আগে উল্লেখ করেছি, দুর্গার বাহুর কথা, যা আয়ত, পদ্মের নালের মতো; অর্থাৎ আমরা জন্মমৃত্যুর আবর্ত্তনে যে অবস্থাতেই থাকি, তার মধ্যেও এই মহাপ্রাণ বা মুখ্যপ্রাণ দুর্গার সংস্পর্শ সর্ব্বদা থাকে এবং এই জন্য সকল পরিণতির মধ্য দিয়ে আমাদের অভ্যুদয় হয়, আমরা ক্রমশঃ আত্মজ্ঞ হয়ে উঠি। এই প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদে প্রাণ বা দিক্‌কে ' অনপগ'  বলা হয়েছে।  অনপগ শব্দের অর্থ ' যে ছেড়ে চলে যায় না '। অনপগ = অন্ (না)  + অপগ (অন্য দিকে যায়)। আরো বলা হয়েছে যে, এইজন্য, যিনি এই প্রাণ বা দিক্‌ সকলের মধ্যে স্থিত পুরুষকে জানেন, তাঁকে কেউ পরিত্যাগ করেন না। বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই মন্ত্রটি উল্লেখ করা হলো : 

মন্ত্র

স হোবাচ গার্গ্যঃ য এবায়ং দিক্ষু পুরুষ এতমেবাহং ব্রহ্মোপাস ইতি। স হোবাচাজাতশত্রুঃর্মা মৈতস্মিন্‌ সংবদিষ্ঠাঃ দ্বিতীয়ো'নপগ ইতি বা অহমৈতমুপাস ইতি। স য এতমেবমুপাস্তে দ্বিতীয়বান্‌ হ ভবতি নাস্মাদ্গণশিচ্ছদ্যতে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ,মন্ত্র ২।১।১১।) 

অন্বয় অর্থ।

সঃ হ উবাচ গার্গ্য-------সেই গার্গ্য বললেন 

যঃ এব অয়ম্‌ দিক্ষু (যিনি এই যে দিক্‌ সকলে) পুরুষঃ (পুরুষ) এতম্‌ এব (এনাকেই) অহং (আমি) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম রূপে) উপাস (উপাসনা করি), ইতি-----যিনি এই যে দিক্‌ সকলের মধ্যে পুরুষ, এনাকেই আমি ব্রহ্ম রূপে উপাসনা করি।

সঃ হ (সেই) উবাচ (বললেন)  অজাতশত্রুঃ------ সেই অজাতশত্রু বললেন 

মা (আমাকে) মা (না) এতস্মিন্‌ (এইবিষয়ে) সংবদিষ্ঠাঃ ( উপদেশ দিও ) ----আমাকে এই বিষয়ে উপদেশ দিও না

দ্বিতীয়ঃ অনপগ ইতি বা অহম্‌ এতম্‌ উপাস ইতি----- দ্বিতীয়, অনপগ ইহা, আমি এই ভাবে উপাসনা করি।

দ্বিতীয়ঃ অনপগ----দ্বিতীয় এবং অনপগ-----ইনি দ্বিতীয় বা ইনিই দ্বিতীয় হন, এবং অনপগ বা যাঁর থেকে ছেড়ে কিছু যায় না; অনপগ---অন্ (না ) + অপগ (অপ +গ----অন্যত্র যায়)। দ্বিতীয় বা ভিন্ন ভিন্ন সত্তা বা আত্ম-খণ্ড গুলি এই পরমাত্মস্বরূপে বা এই মহাপ্রাণে যুক্তই থাকে, এঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। 

সঃ যঃ এতম্‌ এব উপাস্তে---- সে, যিনি, এই ভাবে উপাসনা করেন

দ্বিতীয়বান্‌ হ ভবতি---- দ্বিতীয়বান্‌ হন ----দ্বিতীয়তাকে নিজের বিস্তার বা প্রকাশ বলে জানেন

ন (না) অস্মাৎ (এঁর থেকে) গণঃ (গণ--জনগণ,স্বজনগণ, যা কিছু এঁর থেকে দ্বিতীয়) ছিদ্যতে (ছিন্ন হয়) ---- এঁর থেকে কেহ বিছিন্ন হন না ।

অর্থ।

(সেই গার্গ্য বললেলন) "যিনি এই যে দিক্‌ সকলের মধ্যে স্থিত পুরুষ, এনাকেই আমি ব্রহ্ম রূপে উপাসনা করি।"

সেই অজাতশত্রু বললেন, "আমাকে এই বিষয়ে উপদেশ দিও না;  দ্বিতীয়, অনপগ ইহা, আমি এই ভাবে উপাসনা করি"।( দ্বিতীয় বা ভিন্ন ভিন্ন সত্তা বা আত্ম-খণ্ড গুলি এই পরমআত্ম স্বরূপে বা এই মহাপ্রাণে যুক্তই থাকে, এঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না।)  সেই যিনি, এই ভাবে উপাসনা করেন, তিনি দ্বিতীয়বান্‌ হন (দ্বিতীয়তাকে নিজের বিস্তার বা প্রকাশ বলে জানেন)।এঁর থেকে কেহই (গণ সকল) বিছিন্ন হন না ।"

১০। উগ্রতারা।

দেবী বর্গভীমা উগ্র তারা বলেও উপাসিত হন। পূর্বে উক্ত হয়েছে যে শিব স্বরূপ চেতনার বায়ু হলো উগ্র মূর্ত্তি ( ওঁ উগ্রায় বায়ু মূর্ত্তয়ে শিবায় নমঃ)। 

উগ্র অর্থে সেই সামর্থ্য যার দ্বারা তৎক্ষণাৎ বা ক্ষণিকের মধ্যে কোন কার্য সম্পন্ন করা যায়। ঋক্‌ বেদে উক্ত দেবী বাগাম্ভৃণীর এই উক্তিটি উদ্ধৃত করা হলো----যং যং কাময়ে তং তং উগ্রং কৃণোমি-----যার যার উদ্দেশ্যে কামনা করি তাকে তাকে তৎক্ষণাৎ তাই করি। উগ্র শব্দটি, তুর্‌ (ত+ উর্‌ ) এবং গ্রস্‌ এই দুইটি শব্দ থেকে হয়েছে। তুর্‌ অর্থে 'শীঘ্র" এবং গ্রস্‌ ধাতুর থেকে গ্রস্ত অর্থাৎ অধিকৃত শব্দটি হয়েছে। উগ্রতার দ্বারা যিনি গ্রস্ত বা যিনি দ্রুততার দ্বারা সম্পন্ন করেন তিনি উগ্র, অথবা অগ্রেই যিনি করেন, তিনি উগ্র। 

( ঋক্‌ বেদে তুগ্র বলে একজনের কথা আছে যিনি ভুজ্যুর পিতা। তুগ্র শব্দটি তুর্‌ (শীঘ্র) এবং গ্র (গ্রস্ত) থেকে হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়, তৃতীয় ব্রাহ্মণে মহর্ষি ভুজ্যুর সাথে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যের এই বায়ুর বিষয়ে প্রশ্নোত্তর উক্ত হয়েছে। অবশ্য  বৃহদারণ্যক উপনিষদে ভুজ্যুকে, ভুজ্যু লাহ্যায়নি অর্থাৎ লাহ্যের পুত্র ভুজ্যু এই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।বৈদিক যুগে, অনেক সময় একই বিদ্যায় পারদর্শী ঋষিদের নাম এক বা সদৃশ হতো। )

বায়ু যিনি সূত্রাত্মা, যাঁর মাধ্যমে এবং যাঁর দ্বারা সূত্র বা যুক্ততা সংক্রান্ত সমস্ত কর্ম্ম সাধিত হচ্ছে, তা অক্রমে হয়,  কালের ক্রমধারায় বিলম্বিত হয় না। আমরা ক্রমদর্শী বলে, আমরা এই তাৎক্ষণিক ফল ভোগ করতে পারি না। কাল অতিবাহিত হলে, বা সময় হলে তবেই আমাদের যা কাম্য তার প্রাপ্তি হয়; কামনা মাত্রই আমরা ফল ভোগ করি না বা কাম্যকে পাই না, একটা ক্রমধারার মধ্য দিয়ে কাম্যকে আমরা পেয়ে থাকি। 

প্রাণ বা বায়ুর এই স্বরূপ যিনি জানেন, তিনি যা কামনা করেন, তৎক্ষনাৎ সেই কাম্যকে প্রাপ্ত হন। এই ভাবে যিনি আমাদের তৎক্ষনাৎ বা উগ্রভাবে ত্রাণ করেন, তিনি উগ্রতারা।  কামনা মুক্তির জন্যই হোক বা ভুক্তির জন্যই হোক, এই দেবী তাঁর উপাসককে তৎক্ষনাৎ তা দেন।  আকাশে কাল এবং দেশগত ব্যবধান নেই, তাই ঐ ক্ষেত্রে যে কোন ক্রিয়ার ফল তাৎক্ষনিক।

১১। ভীমা আকাশ ।

আকাশে যে অন্তহীন ব্যাপ্তি অনুভূত হয় তা ভয় বা ভীষণতার বোধকে জাগ্রত করে, যদি না এই আকাশকে চিৎ প্রকাশ বলে জানা যায়। দেশ এবং কাল এখানে লয় হয়ে যায়, আবার এই আকাশ থেকেই দেশ ও কাল প্রকাশ পায় এবং এই আকাশেই বিধৃত হয়ে থাকে। ভীষণতার দ্বারা মণ্ডিত তাই ভীম বা ভীমা। ভীম = ভী + ইম (ইদম্‌)---ইহা ভয় উদ্রেককারী। এই ভীষণতাকে লক্ষ করে কঠোপনিষদে ঋষি যা বলেছেন, তা দুইটি মন্ত্র উল্লিখিত করলাম :

কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।৩।২।

যদিদং কিং চ জগৎ সর্ব্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতম্‌।

মহদ্ভয়ং বজ্রমুদ্যতং য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।। 

অন্বয় অর্থ।

যৎ ইদং কিং চ ---- এই যা কিছু;  জগৎ----যা গতিশীল (বা যা কালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ) সর্ব্বং--সর্ব্ব (সেই সব)

প্রাণ এজতি  ----প্রাণেই স্পন্দিত; নিসৃতম্‌ --- (প্রাণ থেকে) নিসৃত হয়ে।

মহৎ ভয়ং ---মহৎ ভয়; বজ্রম্‌ উদ্যতং----উদ্যত বজ্র; য এতৎ বিদুঃ----যাঁরা এঁকে জানেন; অমৃতাঃ --অমৃত; তে---তাঁরা; ভবন্তি----হন। 

অর্থ।

এই যা কিছু গতিশীল ( কালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ), সে সব ( মহা প্রাণ থেকে ) নিসৃত হয়ে প্রাণেই স্পন্দিত হচ্ছে। ইনি মহৎ ভয় এবং উদ্যত বজ্র (সদৃশ)। যাঁরা এঁকে জানেন, তাঁরা অমৃত হন। ( কঠোপনিষদ্‌ ২।৩।২।)

কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।৩।৩।

ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্যঃ।

ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ।।

অন্বয় অর্থ।

ভয়াৎ অস্য---- এঁর ভয় থেকে; অগ্নিঃ তপতি---অগ্নি তাপ দেন; ভয়াৎ তপতি সূর্যঃ------ভয় থেকে সূর্য তাপ দেন; ভয়াৎ ইন্দ্রঃ চ বায়ু চ মৃত্যু ধাবতি পঞ্চমঃ----ভয় থেকে ইন্দ্র এবং বায়ু এবং মৃত্যু যিনি পঞ্চম, তিনি ধাবন করছেন।

অর্থ।

এঁর ভয়ে অগ্নি তাপ দেন,  ভয় থেকে সূর্য তাপ দেন, ভয় থেকে ইন্দ্র, এবং বায়ু, এবং মৃত্যু যিনি পঞ্চম, তিনি ধাবন করছেন (স্ব স্ব কর্ম্মে প্রবৃত্ত রয়েছেন)।( কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।৩।৩।) প্রাণ প্রকাশ এবং প্রাণ সংহরণ এই দুইই আকাশে হচ্ছে। হনন এবং সবন (সোম বা প্রাণের প্রকাশ) এই দুইই এই মহাচৈতন্য থেকে হচ্ছে বলে এঁকে হংস বলা হয়। আকাশের বীজমন্ত্র হলো হং। হং অর্থে যেখানে সকল আয়তন কে হনন করা হয়েছে, যেখানে সবাই অশরীরী।এই আকাশের থেকেই জ্ঞান বা চিৎ শক্তি বলের আকারে প্রকাশ পাচ্ছেন। যা অন্তরে জ্ঞান বা বোধক্রিয়া, তাই বাহিরে বল ক্রিয়া, যা ভৌতিক শক্তির আকারে পরিচিত। এই বিষয়ে উপনিষদের একটি শ্লোক উল্লেখযোগ্য----

ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে

ন তৎ সমশ্চাভ্যাধিকশ্চ দৃশ্যতে।

পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রুয়তে

স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ।।(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌ ৬.৮।)

ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে-----তাঁর কার্য এবং করণ নেই।

ন তৎ সমশ্চাভ্যাধিকশ্চ দৃশ্যতে------তাঁর সমান এবং তার থেকে অধিক কিছু দৃষ্ট হয় না।

পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রুয়তে----এঁর পরা শক্তি নানাবিধ ভাবে শ্রুত বা অনুভূত হয়।

স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ---এই যে জ্ঞান এবং বল শক্তি তা স্বাভাবিকী অর্থাৎ কোন আলাদা শক্তির দ্বারা পরিচালিত নয় (স্বয়ংচালিত বা স্বয়ংপ্রকাশ)। 

এই চেতনার কোন কার্য এবং করণ নেই, অর্থাৎ ইনি কোন কারণ সম্ভূত নন এবং কোন ক্রিয়া থেকেও উৎপন্ন হন নি।  এঁর সমান এবং এঁর থেকে অধিক কিছুও দৃষ্ট হয় না। ইনি পরাশক্তি, অর্থাৎ যে শক্তি দ্বারা ইনি নিজেকে পর বা পৃথক্‌ করেন বা বহু হন। (পৃ+অ = পর। )। এই পরাশক্তি এবং তাঁর থেকে জাত বিশ্বকে আমরা নানাভাবে শুনি বা অনুভব করি। শোনা বা শ্রুতি মানেই নিজের ভিতরে জানা বা অনুভব করা। এই পরাশক্তি স্বাভাবিকী, বা স্বয়ং বা আত্মপ্রকাশ সম্পন্ন এবং প্রচেষ্টা বিহীন। এই শক্তিই অন্তরে অনুভূতি, জ্ঞান বা বেদন এবং বাহিরে কাল দ্বারা পরিচালিত ক্রিয়া বা বিশ্ব-ক্রিয়া বা বল ক্রিয়ার আকারে দৃশ্য হচ্ছেন।

১২।বলি।

বলায় বলিরুচ্যতে-----বল প্রাপ্তির জন্যই ' বলি ' বলা হয়। উপরে উক্ত এই জ্ঞান এবং বল কে দেখে, এবং কারোর মধ্যে এই প্রজ্ঞাকে জাগ্রত করে যদি তার স্থূলত্বকে হনন করা হয়, তবে তার নাম বলি।এতে সেই জীবের পশু বৃত্তি দূর হয়, তার ঊর্ধ্বগতি হয়।তা না হলে জীব হত্যা হয়, এবং যারা সেই কর্ম্মের সাথে সংশ্লিষ্ট হয় তারা জীব হত্যা জনিত কর্ম্মের ফল ভোগ করে।কথিত আছে যে দেবতাদের যজ্ঞে পশুরা স্বেচ্ছায় বলি হতে চাইত।  দ্রষ্টা ঋষিদের বলির অধিকার আছে। বলির উদ্দেশ্য পশু বৃত্তিকে হত্যা করা, প্রাণনাশ নয় এবং বিশেষ কারণ না থাকলে আর্ষকৃত পূজায় বা যজ্ঞে কোন পশুকে বলি দেওয়া হতো না। যে সময় এই ব্রহ্ম বিদ্যা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই সময়ে, ক্ষত্রিয় রাজাদের যজ্ঞে, ঋষিদের পৌরোহিত্যে পশু বলি দেওয়া হতো। ব্রহ্মবিৎ ঋষিরা কখনো হিংসাকে সমর্থন করেন নি। যাকে বলি দেওয়া হয়, ঘাতকের প্রভাবে যদি তার মৃত্যুভয় দূর না হয়, তবে তা পাপকর্ম্ম। এই জন্য বলে হয়েছে-----

যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্টাঃ

যজ্ঞার্থে পশু ঘাতনম্‌

অতস্ত্বাং ঘাতয়িষ্যামি

তস্মাদযজ্ঞে বধো'বধঃ"

যজ্ঞার্থেই পশুরা সৃষ্ট হয়েছে, যজ্ঞার্থেই পশুদের বধ করা হয়, অতএব তোমাকে (পশুকে) আমি বধ করব এই জন্য যে যজ্ঞে বধ অবধ (অর্থাৎ বধের দ্বারা বধ হয় না)। 

আমরা মৃত্যুভয়গ্রস্ত এবং পুনঃ পুনঃ  জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে আমাদের  বিবর্ত্তন হচ্ছে তাও জানিনা, সুতরাং বলির যে বিজ্ঞান তা আমাদের বোধগম্য হওয়া অনেক সময় দুরূহ। তাই ঋষিদের দ্বারা অনুষ্ঠিত পূজা বা যজ্ঞে, সাধারণতঃ, ঋষিদের বিধানেই কুষ্মাণ্ড বলি দেওয়া হয়।

বলিদানের  মন্ত্রে পশুর উদ্দেশ্যে যা বলা হয়েছে, তার একটি অংশ উদ্ধৃত করা হলো।

  অগ্নিঃ পশুরাসীৎ ----অগ্নি পশু ছিলেন।

তেন অযজন্ত----সেই পশুত্বের দ্বারাই তিনি যজ্ঞ বা যজনা করেছিলেন। 

স এতম্‌ লোকম্‌ অযয়ৎ----তিনি এই ( অগ্নি ) লোককে জয় করেছিলেন।

যস্মিন্‌ অগ্নিঃ স তে লোকো ভবিষ্যতি----অগ্নি যে লোকে তা তোমারও লোক হবে।

তম্‌ জেষ্যসি-----তুমি জয় লাভ করবে।

পিবৈতাপঃ ---এই অপ্‌ বা জল পান করো।

হে পশু! অগ্নি পশু ছিলেন এবং সেই পশুত্বের দ্বারাই তিনি যজ্ঞ বা যজনা করেছিলেন (সেই পশুত্বকে অবলম্বন করেই তিনি আত্মস্বরূপে যুক্ত হয়েছিলেন )। তিনি এই অগ্নি লোককে জয় করেছিলেন।অগ্নি যে লোকে তা তোমারও লোক হবে।তুমি জয় লাভ করবে। এই অপ্‌ বা জল (সোম) পান কর।

বায়ুঃ পশুরাসীৎ ----বায়ু পশু ছিলেন।

তেন অযজন্ত----সেই পশুত্বের দ্বারাই তিনি যজ্ঞ বা যজনা করেছিলেন। 

স এতম্‌ লোকম্‌ অযয়ৎ----তিনি এই ( বায়ু ) লোককে জয় করেছিলেন।

যস্মিন্‌ বায়ুঃ স তে লোকো ভবিষ্যতি----বায়ু যে লোকে তা তোমারও লোক হবে।

তম্‌ জেষ্যসি-----তুমি জয় লাভ করবে।

পিবৈতাপঃ ---এই অপ্‌ বা জল পান করো।

হে পশু! বায়ু পশু ছিলেন এবং সেই পশুত্বের দ্বারাই তিনি যজ্ঞ বা যজনা করেছিলেন (সেই পশুত্বকে অবলম্বন করেই তিনি আত্মস্বরূপে যুক্ত হয়েছিলেন)। তিনি এই বায়ু লোককে জয় করেছিলেন।বায়ু যে লোকে তা তোমারও লোক হবে।তুমি জয় লাভ করবে। এই অপ্‌ বা জল (সোম) পান কর।

সূর্যঃ পশুরাসীৎ ----সূর্য পশু ছিলেন।

তেন অযজন্ত----সেই পশুত্বের দ্বারাই তিনি যজ্ঞ বা যজনা করেছিলেন। 

স এতম্‌ লোকম্‌ অযয়ৎ----তিনি এই ( সূর্য ) লোককে জয় করেছিলেন।

যস্মিন্‌ সূর্যঃ স তে লোকো ভবিষ্যতি----সূর্য যে লোকে তা তোমারও লোক হবে।

তম্‌ জেষ্যসি-----তুমি জয় লাভ করবে।

পিবৈতাপঃ ---এই অপ্‌ বা জল পান করো।

হে পশু! সূর্য পশু ছিলেন এবং সেই পশুত্বের দ্বারাই তিনি যজ্ঞ বা যজনা করেছিলেন (সেই পশুত্বকে অবলম্বন করেই তিনি আত্মস্বরূপে যুক্ত হয়েছিলেন )। তিনি এই সূর্য  লোককে জয় করেছিলেন।সূর্য যে লোকে তা তোমারও লোক হবে।তুমি জয় লাভ করবে। এই অপ্‌ বা জল (সোম) পান কর।

অগ্নি অর্থে বাক্‌, বায়ু অর্থে প্রাণ এবং সূর্য অর্থে মন। বলির দ্বারা পশুত্ব দূর হয়। আমরা বাক্‌, প্রাণ এবং মন এই তিন 'দেবতার সমাস। আত্মস্বরূপ এই তিন  হয়ে, এই তিনের সমাসে যে আমাদের সৃষ্টি করেছেন সেই প্রজ্ঞার উদয় হয়। বাক্‌, প্রাণ এবং মন, এই তিন প্রধান দেবতা। অন্যান্য দেবগণ এঁদের অন্তর্গত। এই ভাবে পশুত্ব থেকে দেবত্ব লাভ হয়।

১৩। বহুল আকাশ। 

এই যে আত্মশক্তি, যাঁর প্রকাশক্ষেত্রের নাম আকাশ, ছান্দোগ্য উপনিষদে এঁকে বহুল বলা হয়েছে। বহুল মানে যিনি বহু হন বা বহু হওয়াই যাঁর স্বভাব।  ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি কথোপকথন নীচে উদ্ধৃত করা হলো :

অথ হোবাচ জনংশার্করাক্ষ্য কং ত্বমাত্মানমুপাস্‌স  ইত্যাকাশমেব ভগবো রাজন্নিতি হোবাচৈষ বৈ বহুল আত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বমাত্মানমুপাস্‌সে তস্মাত্ত্বং বহুলো'সি প্রজয়া চ ধনেন চ।। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ৫।১৫।১।)
অথ হ উবাচ জনংশার্করাক্ষ্য----অনন্তর (রাজা অশ্বপতি) 'জন'কে  বললেন,
 "শার্করাক্ষ্য কং ত্বম্‌ আত্মানমম্‌ উপাস্‌স"  ইতি-------"শার্করাক্ষ্য কাকে তুমি আত্মা বলে উপাসনা করো?"

 আকাশম্‌ এব ভগবো রাজন্ ইতি হোবাচ-----"হে ভগবন্‌, রাজন্‌, আকাশকেই", এই কথা ( জন শার্করাক্ষ্য ) বললেন।  
(রাজা অশ্বপতির মন্তব্য) "এষঃ বৈ বহুল আত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বম্‌ আত্মানম্‌ উপাস্‌সে ----"ইনিই বহুল, বৈশ্বানর আত্মা, যাকে তুমি আত্মারূপে (বা আত্মজ্ঞানে) উপাসনা করো"
"তস্মাৎ ত্বং বহুলঃ অসি প্রজয়া চ ধনেন চ"---- "সেই হেতু তুমি  প্রজা এবং ধনের দ্বারা বহুল হয়েছ।" 

অনন্তর জনকে (রাজা অশ্বপতি) বললেন, "শার্করাক্ষ্য কাকে তুমি আত্মা বলে উপাসনা করো?"
 "হে ভগবন্‌, রাজন্‌, আকাশকেই", এই কথা ( জন শার্করাক্ষ্য ) বললেন।  
(রাজা অশ্বপতির মন্তব্য)। "ইনিই বহুল, বৈশ্বানর আত্মা, যাকে তুমি আত্মারূপে (বা আত্মজ্ঞানে) উপাসনা করো; সেই হেতু তুমি  প্রজা এবং ধনের দ্বারা বহুল হয়েছ (সেই হেতু তুমি বহু প্রজা এবং ধন সম্পন্ন হয়েছ। )

এই যে সবাই সবার থেকে আলাদা, তা এই বৈশ্বানর আত্মার বহুল নামক স্বরূপের দ্বারা সম্ভব হয়েছে। এই যে দুটি বস্তুর মধ্যে ব্যবধান, দুইটি মনের মধ্যে ব্যবধান তা এই বহুল বা বহুলা শক্তির প্রভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই মহাশক্তির দ্বারা ব্যবধান রচিত হয়েছে, আবার এই মহাশক্তির দ্বারাই সবাই, বা সেই পৃথক সত্তাগুলি এই আকাশে বিধৃত রয়েছে। প্রাণই বহু হয়েছেন, এবং সেই প্রাণ থেকে জাত প্রতিটি সত্তা প্রাণেরই পৃথক্‌ পৃথক্‌ রূপ। তাই প্রাণকে ' ব্যষ্টি ' বলা হয়েছে।আবার প্রাণই এই সব বা সর্ব্ব, তাই প্রাণকে ' সমষ্টি ' বলা হয়েছে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩।৩।২। মন্ত্রে  মহর্ষি ভুজ্যু লাহ্যায়নি এবং মহর্ষি যাজ্ঞব্যল্কের কথোপকথন দ্রষ্টব্য।)
বৈশ্বানর অর্থে যিনি বিশ্বভুবনের সবার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে সবাইকে নর করেছেন বা নরাচ্ছেন (নর্ত্তন) , প্রাণ চাঞ্চল্যময় করেছেন। 

পৃথকবর্ত্মা বায়ু।
সর্ব্বব্যাপী এই যে বায়ু বা প্রাণ,ইনি সর্ব্বত্র প্রবাহমান, সবাইকে ইনি স্পর্শ করছেন, ইনি সূত্র হয়ে সর্ব্ব যোগাযোগ যথার্থ ভাবে সাধন করছেন। এই সূত্র অবলম্বন করেই আমরা মৃত্যুর সময় শরীর থেকে নিষ্ক্রান্ত হই, লোক থেকে লোকান্তরে যাই এবং পুনরায় শরীরী হই। বায়ু বা প্রাণের দ্বারা আমরা শরীর থেকে উৎক্রান্ত হই, এবং এই জন্য এঁর নাম উদান (উৎ+অন)। আমরা যে জন্ম থেকে মৃত্যু এবং মৃত্যু থেকে জন্মে আবর্ত্তন করি, সেই আবর্তনের পথের নাম বর্ত্ম। এই পথ প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের আলাদা, এবং এক শ্রেণীর জীব থেকে অন্য শ্রেণীর জীবের আবর্ত্তনের পথ আলাদা। তাই ইনি পৃথকবর্ত্মা, পৃথক্‌ পৃথক্‌ পথে জীবদের নিয়ে যাতায়াত করেন। ( ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৫।১৪।১।, দ্রষ্টব্য।) 

১৪। মৃত্যুকালীন অবস্থান্তর এবং উদান বায়ুর দ্বারা উৎক্রমণ। 

বায়ু বা উদান-রূপ প্রাণের দ্বারা আমরা যে শরীর থেকে মৃত্যুর সময় উৎক্রান্ত হই তা আগে বলা হয়েছে। কিন্তু শরীর থেকে উৎক্রমণের আগে, পার্থিব শরীরের উর্দ্ধ্বে একটি সূক্ষ্ম বায়বীয় শরীর নির্মিত হয়। একটি বায়বীয় সূত্রের দ্বারা  দ্বারা সমস্ত প্রাণ বা ইন্দ্রিয় শক্তি সহ জীবাত্মা পার্থিব শরীর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ঐ সূক্ষ্ম শরীরকে আশ্রয় করেন।
এই বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে এবং তা নিম্নে উল্লিখিত হলো। 

যাজ্ঞবল্ক্যেতি হোবাচ, যত্রায়ং পুরুষো মৃয়ত উদস্মাৎ প্রাণাঃ ক্রামন্ত্যাহো নেতি নেতি হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যো'ত্রব সমবনীয়ন্তে স উচ্ছয়ত্যাধ্মায়ত্যাধ্মাতো মৃতঃ শেতে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৩।২।১১।)

অর্থ। 
যাজ্ঞবল্ক্য -----যাজ্ঞবল্ক্য!
ইতি হ উবাচ---ইহাই বললেন (আর্ত্তভাগ  যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করলেন।)

যত্র অয়ং পুরুষো মৃয়ত-------যখন এই পুরুষ মারা যায়, 
উৎ অস্মাৎ প্রাণাঃ ক্রামন্তি অহো ন ইতি----এর (এই শরীর থেকে) প্রাণ সকল উৎক্রমণ করেন না করেন না?

ন ইতি হ উবাচ যাজ্ঞবল্ক্যঃ  -----যাজ্ঞবল্ক্য বললেন " না ";
অত্র এব সম্‌ অবনীয়ন্তে-----এই খানেই (প্রাণ সকল) সমতায় (বা সম্মিলিত অবস্থায়) নীত হয় (বা এক হয়)
স উৎ শ্বয়তি---- সে (সেই মুমূর্ষু বা প্রয়াণোদ্যত জীবাত্মা) ঊর্দ্ধ্বে (পার্থিব শরীরের ঊর্দ্ধ্বে) স্ফীত হয়। 
আধ্মায়তি -----বায়ু (বা প্রাণ শক্তির দ্বারা) স্ফীত হয়
আধ্মাতো মৃতঃ শেতে---বায়ুর দ্বারা স্ফীত হয়ে মৃত শায়িত থাকে। 

(মহর্ষি আর্ত্তভাগ বললেন)---- "যাজ্ঞবল্ক্য! যখন এই পুরুষ মারা যায়, এর (এই শরীর থেকে) প্রাণ সকল উৎক্রমণ করেন না করেন না?"
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন ---- " না " । এই খানেই (এই সূক্ষ্ম আধারে) (প্রাণ সকল) সমতায় (বা সম্মিলিত অবস্থায়) নীত হয় (বা এক হয়); বায়ু (বা প্রাণ শক্তির দ্বারা) স্ফীত হয়, বায়ুর দ্বারা স্ফীত হয়ে মৃত শায়িত থাকে।" 

এই প্রসঙ্গে মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, তাঁর লিখিত গীতার যৌগিক ব্যাখায়, দেহান্তরের বিষয়ে যা প্রকাশ করেছেন, তার থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ এখানে উদ্ধৃত করলাম-----" সাধারণতঃ জীব ইন্দ্রিয়পথে নিষ্ক্রান্ত হয়েন। চক্ষু,কর্ণ,নাসা,মুখ আদি দিয়া দেহত্যাগ করেন। যে মনুষ্য জীবিত অবস্থায় যে প্রকার বৃত্তির সমধিক চালনা করে, মৃত্যুকালে তৎকার্যকারী ইন্দ্রিয়পথ অবলম্বন করিয়া তাহার প্রয়াণ সংসাধিত হয়। 

মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে যখন প্রাণের সমস্ত ভাব মন হইতে মিলাইয়া যাইতে থাকে, কেবলমাত্র জীবিতাবস্থার প্রবল ভাবগুলি উজ্জীবিত থাকে,তখন পূর্ব্বোক্ত সেই সেই ভাব যে ইন্দ্রিয়ের উপর কার্যকারী, সেই ইন্দ্রিয়পথে প্রাণশক্তিকে চালিত করে। সুতরাং জীবাত্মাও সেই ইন্দ্রিয়ে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সমস্ত শক্তি বা তেজ সংগৃহীত হইলে সেই ইন্দ্রিয় পথেই তিনি নির্গত হইয়া যান। 

যাহা হউক, মৃত্যুকালে আপন সংস্কারানুযায়ী আত্মা আপনার নির্গমনোপযোগী দ্বারে উপস্থিত হইলে তখন ধীরে ধীরে তাঁহার প্রাণশক্তি গুটাইয়া আসিয়া তাঁহাতে লিপ্ত হইতে থাকে; এবং দেহের বাহিরে আসিয়া ব্যোমপরমাণুতে*  গঠিত একটি মূর্তি নির্মাণ করে। দেহ হইতে অল্প ঊর্দ্ধ্বে এই মূর্তি সংসাধিত হয়; এবং দেহাভ্যন্তর হইতে প্রাণশক্তি আসিয়া ঐ দেহে আশ্রয় লাভ করে। স্রোতের জলে যেমন মরাল ভাসিতে ভাসিতে আসিতে  থাকে, তেমনই ভাবে আত্মা দেহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ঐ প্রাণময় দেহে আশ্রয় লাভ করেন। এই স্রোতটি শুভ্র সূত্রের আকারে বহির্গত হয়। আত্মা বহির্গত হইবার পরও এই সূত্রটি কিছুক্ষণ দেহে সংযুক্ত থাকে।  যতক্ষণ না সমস্ত শক্তিটুকু নিঃশেষিত হইয়া বহির্গত হইয়া আসে, ততক্ষণ এই সূত্র পরিদৃষ্ট হয়, এবং ততক্ষণ জীবাত্মা এই পরিত্যক্ত জীর্ণ দেহের নিকট অবস্থান করিতে থাকেন।" (মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ কৃত গীতার যৌগিক ব্যাখ্যার সাংখ্যযোগ থেকে উদ্ধৃত। )
এরপর সেই জীবাত্মা পৃথিবী বা ভূ-লোক থেকে প্রেতলোক বা ভুর্বলোক এবং অন্যান্য লোকে কর্ম্মানুসারে গমন করেন।
উদান রূপ প্রাণ বা উদান বায়ুর দ্বারা এইভাবে আমরা উৎক্রমণ করে লোকান্তরে গমন করি।  মর্ত্ত্য /মূর্ত্ত বা একটি বদ্ধ অবস্থার থেকে উঠিয়ে (উৎ) নিয়ে অন্য অবস্থায় যাবার যে সামর্থ্যময় প্রাণ বা বায়ু, তাঁর তার নাম উদান। 

(* ব্যোম বা আকাশের যে প্রবহণময় এবং সংযোগ সাধনকারী রূপ তা বায়ু বা স্পর্শ। আকাশ বা ব্যোমের প্রবণতাই দিক্‌ এবং তার থেকে সৃষ্টি হয় স্পর্শ বা যুক্ততা। )
উপনিষদের নানা অংশে মৃত্যু কালীন এবং মৃত্যুর পরবর্ত্তী বায়ুর, প্রাণবায়ুর বা প্রাণাগ্নির ক্রিয়ার কথা বলে হয়েছে এবং সুগতির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। ঈশোপনিষদে প্রাণাগ্নির উদ্দেশ্যে এই শ্লোকটি আছে-------
" অগ্নে নয় সুপথা রয়ে অস্মান্‌
  বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্‌।
  যুযুধ্যোস্মযুহুরাণমেনো ভূয়িষ্ঠাং তে নমউক্তিং বিধেম।।" (ঈশোপনিষদ্‌, ১৮শ শ্লোক।)

অর্থ। 
অগ্নে নয়----হে অগ্নি (প্রাণাগ্নি)!, নিয়ে চলো
সুপথা  --সুপথ দিয়ে
রয়ে---প্রাপ্তির জন্য
অস্মান্‌----আমাদেরকে
বিশ্বানি--সকল বা সমস্ত বিশ্বের 
দেব--হে দেব! 
বয়ুনানি --যা বয়ুন; বয়ুন =  প্রাণ বা বায়ুর দ্বারা রচিত যত মার্গ বা প্রাণের যুক্ততা; বয়ুন------প্রাণ বা বায়ুর বয়ন থেকে সৃষ্ট মার্গ
বিদ্বান্‌--- তা তোমার বিদিত বা তা তোমার জ্ঞান বা বোধক্রিয়ায় বিধৃত
যুযোধি---বিযুক্ত করো
অস্মাৎ---আমাদের থেকে
জুহুরানম্----যা বিপথে গেছে
এনম্‌---পাপকে
ভূয়িষ্ঠাং ----বহু বহু
তে --তোমার জন্য
নমউক্তিং----নম উক্তি
বিধেম----আমরা যেন বিধান করি। 

হে অগ্নি (প্রাণাগ্নি)! আমাদেরকে নিয়ে চলো সুপথ দিয়ে প্রাপ্তির জন্য। 
হে দেব! বিশ্বের যত বয়ুন ( প্রাণ বা বায়ুর বয়ন থেকে রচিত যত মার্গ বা প্রাণের যুক্ততা ) তা তুমি জান। 
যে পাপ বিপথে গেছে তাকে (আমাদের থেকে) বিযুক্ত করো। তোমার জন্য বহু বহু নম উক্তি আমরা যেন বিধান করি। (ঈশোপনিষদ্‌, ১৮শ শ্লোক।)

১৫। আকাশ ত্রয়।  
সর্ব্ব দিক্‌ যাঁতে সমতায় থাকে বা একীভূত হয়ে থাকে, আত্মার বা প্রাণের সেই স্বরূপের নাম আকাশ। দিক্‌ সকল, প্রাণেতে যেখানে সমতায় থাকে সেখানে প্রাণের নাম সমান। উপনিষদে উক্ত হয়েছে, 'অন্তরে যে আকাশ তা সমান' ("অন্তরা যদাকাশ: স সমানো..." ...প্রশ্নোনোপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৮।)।   এই আকাশের মধ্যে যখন আমরা বহির্মুখী হয়ে থাকি, পূর্ব্বদিক্‌ অভিমানী হয়ে থাকি তার নাম জেগে থাকা এবং সেই অবস্থার নাম জাগ্রত পাদ। 
স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার যে স্বরূপ জাগ্রত অবস্থার উপর আধিপত্য করেন তাঁর নাম গৃহপতি অগ্নি, যে অগ্নি বা প্রাণাগ্নি নিয়ে আমরা আমাদের সংস্কার অনুসারে কর্ম্মময় হয়ে থাকি। এই অগ্নির যে লোক তার নাম আদিত্য এবং বহিরাকাশে আমরা তাঁকে সূর্য বলি। যে আকাশের বা অবকাশের মধ্যে আমরা এই ভাবে জেগে থাকি, তার নাম বহিরাকাশ। স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা , যিনি  প্রাণ বা প্রাণাগ্নি, তাঁর বহিঃপ্রভময় নাম গৃহপতি অগ্নি। এই যে আমরা ভৌতিক বিশ্বে এই ভাবে সচেতন থাকি, স্থূল বা ভৌতিকতাময় হয়েছি, তার কারণ মহাপ্রাণ বা চেতনা, নিজেই এই রকম হয়েছেন। এই প্রাণাগ্নি বা অগ্নিকে উপনিষদে স্থূলভুক্‌ বা স্থূলত্বের ভোক্তা বলা হয়েছে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ চতুর্থ অধ্যায় ১১শ, ১২শ এবং ১৩শ খণ্ড দ্রষ্টব্য, মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৩, ৪, ৫ দ্রষ্টব্য।)

যখন আমরা স্বপ্ন দেখি, তখন এই আকাশের মধ্যে আমরা অন্তর্মুখী হয়ে থাকি। অন্তরের আলোকে বা স্বয়ং জ্যোতিতে আমরা স্বপ্ন দেখি। ' স্বয়ং আপ্নোতি ' বা নিজেতেই আপ্তি, এর নাম স্বপ্ন। বহির্বিশ্ব ছাড়াই আমরা স্বপ্নে শব্দ,স্পর্শ, রূপ ইত্যাদি সবই অনুভব করি। যাঁকে আমরা নিজ ( স্ব ) বলে অনুভব করি, যাঁর উপর ভর দিয়ে আমরা 'আমি' বা ' অহম্‌'  বলে জেগে থাকি বা অহঙ্কারময় হই, তিনি আত্মা। এই স্বপ্ন যেখানে দেখি, বিরাটে তার নাম 'অন্তরীক্ষ'। 
ভৌতিকতাকে বর্জ্জন করে, বিবিক্ত করে, এখানে স্বয়ংজ্যোতিতে সব কিছু পাওয়া যায় বা ভোগ হয় বলে, এইখানে আত্মা বা প্রাণাগ্নির নাম প্রবিবিক্তভুক্‌। এই  প্রবিবিক্তভুক্‌ অগ্নির যে লোক তার নাম অন্তরীক্ষ, এবং অন্তরীক্ষের অধিষ্ঠাতা এই অগ্নির অন্য নাম চন্দ্র বা চন্দ্রমা। এই স্বপ্নের রাজ্যে আমাদের সংস্কারগুলি পরিশোধিত হয়, স্থূল বা মর্ত্ত্য ভাব বিসর্জ্জিত হয়ে, দিব্য সংস্কার, জ্ঞান বা বিশুদ্ধ চিন্ময়তার বিকাশ হতে থাকে। এই অন্তরেই আমরা সুখ,দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতি ভোগ করি এবংএকে মর্ম্ম বলে ব্যক্ত করি।  এই প্রবিবিক্তভুক্‌ প্রাণাগ্নির একটি নাম দক্ষিণাগ্নি, এবং অন্য নাম অন্ব-আহার্য-পচন-অগ্নি। ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ চতুর্থ অধ্যায় দ্বাদশ খণ্ড দ্রষ্টব্য, এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌,চতুর্থ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।)
আমরা যা কিছু খাই, তার সূক্ষ্মাংশ, এই অন্তরের আকাশে যায় জ্যোতির্ম্ময় হয়ে, এই  প্রবিবিক্তভুক্‌ অগ্নির আহুতি হয়ে প্রজ্বলিত হয়। একই ভাবে, আমাদের বহির্মুখী কর্ম্ম থেকে যে অনুভূতি সকল হয়, তাও এই অন্তরাকাশে গতি পায়। 
প্রশ্নোপনিষদে ঋষি বলেছেন, সমান নামক প্রাণ, হূত বা ভুক্ত অন্নকে সমতায় নিয়ে আসেন এবং তখন সপ্ত অর্চ্চি প্রকাশ পায়। (প্রশ্নোপনিষদ মন্ত্র ৩।৫ দ্রষ্টব্য।)

আর যেখানে আমরা অন্তর্মুখীও নই এবং বহির্মুখীও নই, সেখানে আমরা নিদ্রিত হই এবং কোন স্বপ্নও দেখি না। এইখানে আমরা আমাদের মূল বা আত্মস্বরূপের সাথে এক হয়ে ভোগ করি। এখানে আত্মার নাম আনন্দভুক্‌। এখানে আর দ্বিতীয়তা নেই, নিজেই নিজেকে ভোগ করছেন। উপনিষদে উক্ত হয়েছে, যেমন পুরুষ তার প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা আলিঙ্গিত হয়ে অন্তর ও বাহ্যের বিষয়ে সচেতন থাকে না , সেইরকমই আমরা নিদ্রার সময় এই আত্মার আলিঙ্গনে অন্তর ও বহির্মুখী অবস্থার বাহিরে গিয়ে, সুখস্বরূপ আত্মায় একীভূত হয়ে বিহার করি। উপনিষদ্‌ এই অবস্থাকে আত্মরতি, আত্মক্রীড়া বলেছেন। অজ্ঞানতাবশতঃ, আমরা নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে মনে করি যে কোন অন্ধকারের মধ্যে গিয়েছিলাম এবং নিদ্রার সময় যে বিশ্রাম হয়েছিলো তা অনুভব করি। এই সুষুপ্তি বা নিদ্রার যে লোক সেখানে প্রাণাগ্নি বা আত্মাকে বিদ্যুতের মধ্যে অধিষ্ঠিত বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ অর্থে বিদ্যমানতার উৎকৃষ্ট রূপ। এই প্রকাশময়, বিদ্যুতে অধিষ্ঠিত আত্মা বা প্রাণাগ্নির নাম আহবনীয় অগ্নি। ইনি আত্ম-হবনময়, নিজেতেই নিজেকে আহুতি দিচ্ছেন; এখানে দ্বিতীয়তা নেই, সব আত্মময়। এই আহবনীয় অগ্নি সবাইকে ডাকছেন, আহ্বানময়, নিজেতে মিলিয়ে নেবেন বলে। এই ডাকে আমাদের বিবর্ত্তন হচ্ছে, আমারা পরমাত্মস্বরূপে ফিরে যাচ্ছি। 

এই নিদ্রাবস্থার বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদের মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যের উপদেশ নীচে উদ্ধৃত করা হলো। 
"তদ্বা অস্যৈৎতিচ্ছন্দা অপহতপাপ্‌মাভয়ং রূপম্‌। তদ্যথা প্রিয়য়া স্ত্রিয়া সংপরিষ্বক্তো ন বাহ্যং কিংচন বেদ নান্তরম্‌, এবমেবায়ং পুরুষঃ প্রাজ্ঞেনাত্মনা সংপরিষ্বক্তো ন বাহ্যং কিংচন বেদ নান্তরম্‌; তদ্বা অস্যৈতদাপ্তকামমং রূপম্‌, শোকান্তরম্‌।" বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৪।৩।২১।)----- সেই সকল এনার (এই পুরুষের) এই সকল অতি-ছন্দ ( ছন্দ বা আচ্ছাদনকে অতিক্রম করে বা ছন্দের ঊর্দ্ধ্বে) হতপাপ বা পাপবিহীন অভয়রূপ। তাহা (সেই অবস্থা), যে রকম প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা সম্যক্‌ রূপে আলিঙ্গিত হয়ে না বাহ্য না অন্য কিছু, না অন্তরকে জানেন, এই প্রকারই এই পুরুষ প্রাজ্ঞ আত্মার দ্বারা সম্যক্‌ রূপে আলিঙ্গিত হয়ে না বাহ্য, না অন্য কিছু, না অন্তরকে জানেন; তা এনার আপ্তকাম, অকাম ( কামনা বিহীন) রূপ, শোকের অতীত। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৪।৩।২১।)

 এই অন্তরাকাশ ও বহিরাকাশ যেখান থেকে প্রকাশ পেয়েছে তার নাম দহরাকাশ।  এই তিন আকাশই এক, একথা ঋষিরা বলেছেন। (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩।১২।৭, ৩।১২।৮, ৩।১২।৯ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে, যিনি সেই ব্রহ্ম, তিনিই পুরুষের বাহিরে যে আকাশ তাই, আর পুরুষের বাহিরে যে আকাশ তা পুরুষের অন্তরের আকাশ, আর যা পুরুষের অন্তরের আকাশ তা পুরুষের অন্তর্হৃদয়াকাশ। এই আকাশ পূর্ণ এবং পরিবর্ত্তন বিহীন। 
ই দহর আকাশকে  হৃদয়ের অভ্যন্তরের আকাশ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এইখানে আমরা নিদ্রিত হই। এই বিষয়ে উপনিষদের একটি উক্তি বঙ্গানুবাদ সহ উদ্ধৃত করা হলো------ (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌, মন্ত্র ২।১।১৭।)।
" স হোবাচ অজাতশত্রুঃ ---সেই অজাতশত্রু বললেন
যত্র এষঃ এতৎ সুপ্তঃ অভূৎ ----যথায় ইনি সুপ্ত হয়েছিলেন
এষঃ বিজ্ঞানময়ঃ পুরুষঃ----এই বিজ্ঞানময় পুরুষ
তৎ এষাং প্রাণানাং বিজ্ঞানেন বিজ্ঞানম্‌ আদায়---- তিনি এই প্রাণ সকলের বা ইন্দ্রিয় সকলের যে বিজ্ঞান বা জ্ঞানময়তা তাকে বিজ্ঞানের দ্বারা বা নিজের জ্ঞানক্রিয়া বা বোধক্রিয়ার দ্বারা (নিজেতে) গ্রহণ করে
যঃ এষঃ অন্তঃ হৃদয় আকাশম্‌ তস্মিন্‌ শেতেঃ---- যা এই অন্তর্হৃদয়-আকাশ (হৃদয়ের অন্তরের আকাশ) তাতে শয়ন করেন
তানি যদা গৃহ্ণাতি অথ হ এতৎ পুরুষঃ স্বপিতি নাম-----সেই সকলকে (সেই সকল জ্ঞানময়তাকে) যখন (নিজেতে) গ্রহণ করেন, তখন এই পুরুষের নাম হয় স্বপিতি (যিনি স্ব বা নিজেতে পান করেছেন---যিনি নিজেতে সকল জ্ঞানময়তাকে পান করে ফেলেছেন বা নিজেতে একীভূত করেছেন) 
" সেই অজাতশত্রু বললেন যথায় ইনি সুপ্ত হয়েছিলেন, এই বিজ্ঞানময় পুরুষ তিনি এই প্রাণ সকলের বা ইন্দ্রিয় সকলের যে বিজ্ঞান বা জ্ঞানময়তা, তাকে বিজ্ঞানের দ্বারা বা নিজের জ্ঞানক্রিয়া বা বোধক্রিয়ার দ্বারা (নিজেতে) গ্রহণ করে যা এই অন্তর্হৃদয়-আকাশ (হৃদয়ের অন্তরের আকাশ) তাতে শয়ন করেন। সেই সকলকে (সেই সকল জ্ঞানময়তাকে) যখন (নিজেতে) গ্রহণ করেন, তখন এই পুরুষের নাম হয় স্বপিতি (যিনি স্ব বা নিজেতে পান করেছেন---যিনি নিজেতে সকল জ্ঞানময়তাকে পান করে ফেলেছেন বা নিজেতে একীভূত করেছেন)। " (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌, মন্ত্র ২।১।১৭।)।
এই আকাশে, আমরা, আমাদের দর্শন, শ্রবণ, আস্বাদন ইত্যাদি সর্ব্ব বোধ বা জ্ঞানশক্তি সহ, আত্ম স্বরূপে একীভূত হই। এই আনন্দময় অবস্থা। এখানে ইনি দেখেন, তত্রাচ দেখেন না, কেননা, এখানে আত্মময়তা হেতু দ্বিতীয় কিছু নেই যা নিজের থেকে পৃথক্‌ , সুতরাং দর্শনযোগ্য। এখনে এইরকমই সব---শ্রবণ, আস্বাদন, আঘ্রাণ, মনন ইত্যাদি। ইনি আনন্দভুক্‌। 

১৬। দেবীর ত্রিনয়ন। 
এই যে অগ্নিত্রয়ের কথা বলা হলো, এই তিন অগ্নি বা তিন প্রাণাগ্নি (গৃহপতি, দক্ষিণ এবং আহবনীয় অগ্নি) হলেন দেবীর তিনটি চোখ, বা ত্রিনয়ন। প্রাণের সকল অনুভূতি একত্র' হয়ে যেখানে জ্বলে উঠেছে, তার নাম চোখ বা চক্ষু। 
কালীকার ধ্যানে উক্ত হয়েছে, " বালার্ক-মণ্ডলাকার-লোচনত্রিতয়ান্বিতাং"-----বালার্ক বা উদয়কালীন সূর্য মণ্ডলের  ন্যায় ত্রিলোচনের দ্বারা অন্বিত। 
এই তিন লোচন দিয়ে তিনটি কাল, বা নিয়ন্ত্রণের তিনটি ধারা প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে তিনটি অবস্থা যা সুষুপ্তি,স্বপ্ন এবং জাগরণ, তার ভোগ হচ্ছে।  
সবাই যেখানে তার বৈশিষ্ট্যগুলি হারিয়ে (অতিক্রম করে) আত্মস্বরূপে নিঃশেষে গতি (ইত) প্রাপ্ত হয় তা সুষুপ্তি বা নিদ্রার স্থান। এইটি অতীত কাল, অতি+ইত = অতীত। 
যেখানে আমরা জাগ্রত, সেখানে বর্ত্তমান কাল। অতীত আর বর্ত্তমানের যে সন্ধি তা ভবিষ্যৎ কাল এবং সুষুপ্তি আর জাগ্রত স্থানের যে সন্ধি তা স্বপ্নস্থান। তাই স্বপ্নের যে কাল তা ভবিষ্যৎ কাল। উপনিষদে স্বপ্নস্থানকে সন্ধিস্থান বলা হয়েছে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৪।৩।৯ দ্রষ্টব্য। )
বালার্ক অর্থে বাল বা বালক অর্ক বা সূর্য। সূর্য থেকে কাল এবং রূপ (আলো) প্রকাশ পাচ্ছে। এই দেবীতে কাল শিশু বা বীজাবস্থায় থাকে। মহাকাল এঁর ভৈরব। অর্ক অর্থে ঋক্‌ এর বিচ্ছুরণ। প্রাণ বা চেতনার ঋক্‌ বা মন্ত্রময় স্বরূপ যাঁর থেকে সৃষ্টি প্রকাশ পাচ্ছে, তা অর্ক। লোচন বা রোচন অর্থে, যেখান থেকে অর্চি বা ঋক্‌ প্রকাশ হচ্ছে। ইনি অর্চনাময়, আত্মস্তুতিময় হয়ে সৃষ্টি করছেন। ( স অর্চনন অচরৎ---তিনি অর্চনা করে বিচরণ করেছিলেন--বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌----১।১।২।)

১৭।শব্দ ও আকাশ। স্মৃতি ও শ্রুতি। 
প্রাণ, জ্ঞান বা চেতনা, নিজেকে শব্দের বা বাক্যের আকারে প্রকাশ করছেন। তাই আমাদের প্রতি অনুভূতি বা বোধ একটি শব্দাকারে মনে থাকে। আকাশ হলো তত্ত্ব এবং শব্দ হলো আকাশের তন্মাত্রা। 
আকাশ বা শব্দতত্ত্ব হলো চেতনার সেই স্বরূপ যাঁর থেকে সর্ব্ব শব্দ প্রকাশ পায়, যা শোনা যায় বা শ্রুতিযোগ্য।  
প্রাণ, যিনি আহবনীয় অগ্নি, যাঁর কথা উপরে উক্ত হয়েছে, তিনি যে ডেকে আমাদের আকর্ষণ করছেন, সেই ডাকটি, 'দ' এই অক্ষরের দ্বারা বোঝায়।উপনিষদে ' দ ' কে দৈবী বাক্‌ বলা হয়েছে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ পঞ্চম অধ্যায়, দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ দ্রষ্টব্য।) ' দ ' বা বাঙ্‌ময় চেতনা আমাদের জীবত্বকে হরণ করে শিবত্বে নিয়ে চলেছেন, তাই এই আকাশের নাম দহর (দ+ হর)। হৃদয়ের অভ্যন্তরে এই আকাশ এবং ' হৃদয়' শব্দটির অক্ষরগুলিকে বিপরীত ক্রমে সাজালে হয় 'দহর'; হৃদয়= হ+ঋ+দ+য় > দ+হ+ঋ+য়= দহর। এই যে অক্ষর বা বর্ণ সকল, এঁরাই প্রাণময়তার দ্বারা যুক্ত হয়ে, একটি অর্থময় বাক্য বা শব্দ রচনা করেন। এই বর্ণ সকল, অক্ষর আত্মার (যিনি আমাদের সকলের অবিনশ্বর, অক্ষয় আত্মা) বীজ বা শক্তিময় স্বরূপ, এবং সেইজন্য বর্ণদের নামও অক্ষর এবং এঁরা বর্ণমাতৃকা। যেমন আমাদের চেতনায়, মনে, এই বিশ্ব বাক্য বা শব্দের আকারে ধরা আছে, সেই রকমই, এই অনুভবযোগ্য বহির্বিশ্ব, মহাচৈতন্যের কথা বা বাক্যের প্রকাশ বা তাঁর মনেই বিধৃত। এই বিশ্ব তাঁর মানসপুত্র, তাঁরই প্রতিরূপ। তাই উপনিষদে ঋষি বলেছেন যে, 
" ঋচো অক্ষরে পরমে ব্যোমন্‌ যস্মিন্‌ দেবা অধি বিশ্বে নিষেদুঃ।
যস্তং ন বেদ কিমৃচা করিষ্যতি য ইত্তদ্বিদুস্ত ইমে সমাসতে------- ঋক্‌ মন্ত্র সকল এই অক্ষর আত্মায়, এই পরম ব্যোমে, যেখানে বিশ্বের দেবতারাও নিহিত; যে তা না জানে সে ঋক্‌ মন্ত্র সকল নিয়ে কি করবে! যাঁরা তাঁকে এই ভাবে  জানেন, তাঁরা সম্যক্‌ ভাবে (এঁতে) আসীন হন"। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৪।৮। )। এই মাতৃকাদের লক্ষ করে বলা হয়েছে,     " অয়মাকাশঃ স্ত্রীয়া পূর্যত " --এই আকাশ স্ত্রীগণের দ্বারা পূর্ণ। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌, মন্ত্র ১।৪।৩ দ্রষ্টব্য।) 

সকল শব্দ বা বাক্য যেখানে গৃহীত হয় তা শ্রোত্র। এই বাইরের বিশ্ব অনুভূতির আকারে আমাদের মধ্যে প্রতীত হচ্ছে। সকল অনুভূতি পরিণত হচ্ছে বাক্য বা শব্দে। এই অনুভূতিগুলি অনুভূত হবার পরে আমাদের অন্তরাকাশে শব্দের আকারে বিধৃত থাকে নিষ্ক্রিয় হয়ে, মৃতবৎ হয়ে; আবার পুনরায় স্মরণ হয়ে ফুটে ওঠে।মৃত হয়ে থাকে, এবং আবার স্মরণ হয়ে,  সোমময় হয়ে, পূর্ব্বানুভূতির রসে সিক্ত করে, তাই এর নাম স্মৃতি।  
যখন আমরা দেখতে পাই যে, যিনি আমাদের প্রাণ, যাঁর নিজত্ব নিয়ে আমরা অত্মবোধসম্পন্ন, তিনিই আমাদের মধ্যে সোম হয়ে, অনুভূতি হয়ে ফুটে উঠছেন, তখন সেই অনুভূতি হয়ে যায় শ্রুতি বা বেদ। প্রতি অনুভূতি হলো বোধ বা প্রাণেরই মূর্ত্তি বা আয়তন, ইনি সেই প্রাণ, যে প্রাণ মৃত্যুর ঊর্দ্ধে এবং আমরা যাঁর থেকে জাত হয়েছি, যিনি আমাদের উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ।  উপাদান কারণ অর্থে যিনি বা যা আমাদের উপাদান বা যা দিয়ে আমার সত্তা নির্ম্মিত।
নিমিত্ত কারণ অর্থে যাঁর জন্য এবং যাঁর দ্বারা আমরা সৃষ্ট হয়েছি। 
 
শব্দাত্মক চিৎ শক্তি, যেখানে প্রাণের সারা নেই, সেই শবত্বকে বিদীর্ণ করে, প্রাণময় আয়তন সকলকে প্রকাশ করেন। যা কিছু ছিল অব্যক্তে, তাকে ব্যক্ত করেন। শব্দের দ্বারা শবত্ব বিদীর্ণ হয়, তাই শব্দ। এই শব্দাত্মক, স্বয়ংপ্রকাশ চেতনার একটি নাম হল বিদ্যুৎ, কেননা ইনি মৃত্যুকে,অব্যক্ত অবস্থাকে বিদীর্ণ করে , চিন্ময়তাকে প্রকাশ করেন, অব্যক্তের অন্ধকার দূর করে নিজেকেই ব্যক্ত করেন। এই প্রসঙ্গে, বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি উক্তি উল্লেখ করা হলো ------

বিদ্যুত ব্রহ্মঃ ইতি আহুঃ----বিদ্যুৎ ব্রহ্ম এই বলা হয়
বিদানাৎ ইতি বিদ্যুৎ----বিদীর্ণ করেন তাই বিদ্যুৎ (বিদ্যুৎ শব্দটি বিদো বা দো ধাতু সম্পন্ন; ( দো অর্থে খণ্ড খণ্ড করা, বিদীর্ণ করা।) (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৫।৭।১ দ্রষ্টব্য।)

আত্মা নিজেই নিজের শক্তি বা স্বয়ং শক্তি। এই চিন্ময়ী বা যিনি চিতিশক্তি, তিনি যেমন শব্দের দ্বারা, বা শব্দিত হয়ে অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত হন, বা যা অব্যক্তে ছিল তাকে ব্যক্ততায় নিয়ে আসেন, সেই রকমই ইনি শব্দের দ্বারা যা ব্যক্ত তাকে অব্যক্ত করেন। তাই ' শব্দ ' এই শব্দটির যেমন একটি অর্থ হলো যা শবত্বকে বা অব্যক্তকে বিদীর্ণ করে, আর একটি অর্থ হলো যা শবত্ব দান করে। 
শব্দ= শবত্বং দাতি -----শবত্বকে বিদীর্ণ করে; শব্দ= শবত্বং দদাতি-----শবত্ব দান করে। ব্যক্ত থেকে অব্যক্ত এবং অব্যক্ত থেকে ব্যক্ততায় নিয়ে যাওয়াই মার কায। তাই ' মা ' অর্থে যিনি ' ম ' বা মৃত্যুকে যিনি আকার দেন বা প্রকাশ করেন; আবার যিনি ' ম ' বা মৃত্যুকে বা অব্যক্তকে আকার দিয়ে ব্যক্ত করেন, মূর্ত্ত করেন। 
শবের উপর আসীন বা আরুঢ়া এই শব্দাত্মিকা মা। তাই একটি ধ্যানে বলা হয়েছে, " ব্যাঘ্রচর্ম্ম পরিধানাং ভীমাদেবী শবাসনাম্‌ ", অপর একটি ধ্যানে উক্ত হয়েছে, " ওঁ শবারুঢ়াং মহাভীমাং ঘোরদংষ্ট্রাং বরপ্রদাম্‌ "।
যা মূর্ত্ত, আয়তনের মধ্যে বদ্ধ, তা শববৎ। সেই আয়তনের বহিরে যাবার অধিকার তার নেই। এই শববৎ অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়া, আয়তনের বদ্ধতার বাহিরে যাওয়ার অর্থ হলো শবত্বকে বিদীর্ণ করা। নিজের চিন্ময়তার উপলব্ধিতে এই জাড্যতা, আয়তনবদ্ধতা দূর হয়।আবার, শব্দের দ্বারাই এই চেতনা আয়তনময় হন বা নিজেকে আয়তনবদ্ধ করেন। মানব বলে যে শব্দ, তাই মানবের চেহারা নিয়েছে। স্বাধীন, স্বয়ংপ্রকাশ চিৎ শক্তি এই ভাবে, বাঙ্‌ময় হয়ে সর্ব্ব আয়তন সৃষ্টি করেছেন, এবং করেও অনায়তনই রয়েছেন।

১৮।সুলভ আকাশ এবং দুর্লভ আকাশ।
প্রাণের প্রথম সারা যখন সাধকরা উপলব্ধি করেন, তখন অন্তরাকাশ প্রকাশ পায়। এই আকাশের সান্নিধ্য বা অনুভূতি অতীব সুখকর, যা পার্থিব কোন সুখানুভূতির সাথে তুলনা করা যায় না। সুখ শব্দের অর্থ, ' সু (সুলভ) + খ  (আকাশ)'।  আর এই আকাশের সান্নিধ্য যদি অল্প বা লেশ হয়, তা দুঃখ। দুঃখ অর্থে,  ' দুঃ (দুর্লভ) + খ (আকাশ) '।     ' খ ' অর্থে ' আকাশ' , যেমন খগ অর্থে বিহঙ্গ, বা যারা ' খ ' বা আকাশে গমন করে। ' খর ' অর্থে যে রব, ' খ ' বা আকাশ বা শূন্যতার বোধ জাগায়, বা যে শব্দ ভাবলেশহীন। তাই গর্দভের নাম ' খর '। 
আকাশের এই সুখময়তার বিষয়ে উপনিষদের একটি মন্ত্র উল্লেখ করা হলো----- 
" যদা চর্ম্মবদাকাশং বেষ্টয়ন্তীং মানবাঃ। 
তদা দেবমবিজ্ঞায় দুঃখস্যান্ত ভবিষ্যতি।।(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৬।৩ দ্রষ্টব্য।)

অন্বয় অর্থ
যদা---যখন; চর্ম্মবৎ---চর্ম্মের ন্যায়;আকাশম্‌----আকাশকে; বেষ্টয়ন্তীং ----বেষ্টন করে; মানবাঃ----মানবরা;
তদা----তখন;  দেবম্‌---দেবতাকে;  অবিজ্ঞায়---অবিজ্ঞাত হবার জন্য (না জানার জন্য);  দুঃখস্য---দুঃখের; অন্ত---শেষ, অন্ত; ভবিষ্যতি---হয়।

অর্থ
যখন মানবরা চর্ম্মের ন্যায় (চর্ম্ম যেমন শরীরকে আবৃত করে থাকে) আকাশকে বেষ্টন করে,
তখন দেবতাকে না জানার জন্য যে দুঃখ তার অন্ত হয়। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৬।৩ দ্রষ্টব্য।)

১৯।সাম এবং সংবর্গ। 
আত্মা বা প্রাণের অশরীরীত্ব বা অরূপ মহিমা। আকাশ, বায়ু, অভ্র, বিদ্যুৎ এবং স্তনয়িত্নু ।

ছান্দোগ্য উপনিষদ সাম বেদের অন্তর্গত। যিনি সম, যিনি সবাইকে আত্মবোধে জানেন, সবাই যাঁকে আত্মা বা 'নিজ' বলে বোধ করে, যাঁর বেদনময়,ক্রিয়াময় স্বরূপের নাম প্রাণ,  তিনি সাম। বৃহ'দারণ্যক উপনিষদে প্রাণকে সাম বলা হয়েছে, কেননা ইনি সবার সাথে সম বা এক।( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৩।২২ দ্রষ্টব্য।) 
পরমাত্মস্বরূপই প্রাণ হয়ে সবাইকে সৃষ্টি করেছেন।এই প্রাণ বা বায়ুই সংবর্গ, এ কথা আগে উক্ত হয়েছে। যিনি সম তাঁর থেকেই বর্গ বা প্রাণি সমূহ সৃষ্ট হয়েছে, তাই বায়ু বা প্রাণই সংবর্গ, এবং এই সৃষ্টি প্রাণই।  
ছান্দোগ্য উপনিষদে, প্রাণ বা প্রজাপতি তাঁর উপদেশে বলেছেন যে, এই শরীর মর্ত্ত্য এবং মৃত্যুর দ্বারা গ্রস্ত; এই শরীর  অমৃত, অশরীরী আত্মার অধিষ্ঠান। সশরীরী হয়ে, প্রিয় এবং অপ্রিয় সকলের দ্বারা গ্রস্ত হন; সশরীরী যে সত্তা,তাঁর প্রিয় ও অপ্রিয়ের শেষ নেই। অশরীরী হবার জন্য প্রিয় এবং অপ্রিয় (এঁকে ) স্পর্শ করতে পারে না। ( ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৮।১২।১ দ্রষ্টব্য।) পরবর্ত্তী মন্ত্রে বলা হয়েছে, বায়ু, অভ্র, বিদ্যুৎ এবং স্তনয়িত্নু (মেঘ গর্জ্জন) এঁরা অশরীরী । মন্ত্রটি নীচে উদ্ধৃত করা হলো। 

অশরীরো বায়ুরভ্রং বিদ্যুস্তনয়িত্নুরশরীরাণ্যেতানি তদ্যথৈতান্যমুষ্মাদাশাৎ সমুত্থায় পরং জ্যোতিরূপসম্পদ্য স্বেন রূপেণভিনিষ্পদ্যন্তে।। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌,মন্ত্র ৮।১২।২।) 

অন্বয় অর্থ।
" অশরীরঃ বায়ুঃ -----বায়ু অশরীরী; অভ্রম্‌ বিদ্যুৎ স্তনয়িত্নুঃ অশরীরাণি এতানি----অভ্র, বিদ্যুৎ, স্তনয়িত্নু, এই সকলই অশরীরী; তৎ যথা ---তা যেমন; এতানি --এই সকল;  অমুষ্মাৎ আকাশাৎ সমুত্থায়-----ঐ আকাশ থেকে সমুত্থিত হয়ে; পরম্‌ জ্যোতিঃ উপসম্পদ্য----পরম জ্যোতিরূপ সম্পন্ন হয়;  স্বেন রূপেণ অভিনিষ্পদ্যন্তে----স্বীয়রূপে  প্রকাশিত হয়।" 

অর্থ।
বায়ু অশরীরী, অভ্র, বিদ্যুৎ, স্তনয়িত্নু, এই সকলই অশরীরী; তা যেমন  (তা এইরকম)----- এই সকল, ঐ আকাশ থেকে সমুত্থিত হয়ে পরম জ্যোতিরূপ সম্পন্ন হয়, স্বীয়রূপে প্রকাশিত হয়। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৮।১২।২।)। 

পরের মন্ত্রটিও উদ্ধৃত করা হলো (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৮।১২।৩।)।
এবমেবৈষ সম্প্রসাদো'স্মাচ্ছরীরাত্মমুত্থায় পরং জ্যোতিরূপসম্পদ্য স্বেন রূপেণাভিনিষ্পদ্যতে স উত্তমপুরুষঃ স তত্র পর্য়েতি জক্ষৎ ক্রীড়ন্রমমাণঃ স্ত্রীভির্বা যানৈর্বা জ্ঞাতিভির্বা নোপজনং স্মরন্তিদং স যদা প্রযোগ্য আচরণে যুক্ত এবমেবায়মস্মিঞ্ছরীরে প্রাণো যুক্তঃ। 

অন্বয় অর্থ।
" এবম্‌ এষঃ সম্প্রসাদঃ----এই রকমই, এই সম্প্রসাদ যুক্ত (আত্মা), অস্মাৎ শরীরাৎ সমুত্থায়---এই শরীর থেকে সমুত্থিত হয়ে;  পরম্‌ জ্যোতিরূপঃ সম্পদ্য--- পরম জ্যোতিরূপ সম্পন্ন হয়ে; স্বেন রূপেণ অভিনিষ্পদ্যন্তে----স্বীয়রূপে প্রকাশিত হয়; সঃ উত্তমঃ পুরুষঃ--তিনি উত্তম পুরুষ; সঃ তত্র পর্যেতি----তিনি তথায় পর্যটন করেন; জক্ষৎ (পরিহাস; jokes); ক্রীড়ন্‌---ক্রীড়া করেন; রমমাণঃ----রমণ (বা আনন্দ) করে; স্ত্রীভিঃ বা যানৈঃ বা জ্ঞাতিভিঃ বা----স্ত্রী গণের সাথে বা, যান সকলের (যান-বাহনের) সাথে জ্ঞাতিদের সাথে; ন উপজনং স্মরন্তি----উপজনকে ( যাকে উপায় করে বা অবলম্বন করে জন্ম হয়) স্মরণ করেন না; ইদম্‌ শরীরম্‌---( যা ) এই শরীর; সঃ যথা প্রযোগ্য আচরণে যুক্তঃ---তা যেমন প্রযোগ্য ( যা প্রয়োগ করা হয় ) আচরণে (যা বিচরণ করে বা চলমান ) যুক্ত (যুক্ত);  এবম্‌ এব অয়ম্‌ অস্মিন্‌ শরীরে------এইরকমই এই শরীরে;  প্রাণঃ যুক্তঃ---প্রাণ যুক্ত।" 

অর্থ।
"এই রকমই, এই সম্প্রসাদ যুক্ত (আত্মা), এই শরীর থেকে সমুত্থিত হয়ে পরম জ্যোতিরূপ সম্পন্ন হয়ে স্বীয়রূপে প্রকাশিত হন; তিনি উত্তম পুরুষ। তিনি তথায় পর্যটন করেন, পরিহাস করেন, ক্রীড়া করেন; স্ত্রী গণের সাথে, যান-বাহন নিয়ে, বা জ্ঞাতিদের সাথে আনন্দ করেন; উপজনকে ( যাকে উপায় করে বা অবলম্বন করে জন্ম হয় ) স্মরণ করেন না, যা এই শরীর; তা যেমন প্রযোগ্য (যা প্রয়োগ করা হয় ) আচরণে (যা বিচরণ করে বা চলমান বা শকট ) যুক্ত (যেমন অশ্ব রথে যুক্ত) এইরকমই এই শরীরে প্রাণ যুক্ত।" (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌, মন্ত্র ৮।১২।৩।)।

শরীর শব্দটি শ্রি ধাতু থেকে হয়েছে। শ্রি ধাতুটি আশ্রয় বোধক; শ্রি অর্থে আশ্রয় দেওয়া, আশ্রয় করা ইত্যাদি। যেমন প্রযোগ্য আচরণে যুক্ত, সেই রকমই এই শরীর, এ কথা উপরে উক্ত হয়েছে। এই শরীর প্রাণের দ্বারা পরিচালিত, প্রাণ শক্তি বা ইন্দ্রিয়রা এতে যুক্ত। 
যিনি স্বাধীন স্বয়ংপ্রকাশ চেতনা এবং তাঁকে যাঁরা জেনেছেন, তাঁরা নিজের থেকেই সব কিছু প্রকাশ করেন, নিজেতেই ভোগ করেন এবং নিজেতেই সংহরণ করেন। এই অবস্থাকে সম্প্রসাদ এবং স্বপিতি বলা হয়েছে। আমরা নিদ্রার সময়েও এই সম্প্রসাদ অবস্থায় নীত হই, কিন্তু অজ্ঞানতা বশতঃ, জেগে উঠে শুধু একটা বিশ্রামের সুখানুভূতি স্মরণে আসে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ চতুর্থ অধ্যায় তৃতীয় ব্রাহ্মণ দ্রষ্টব্য।) 

বায়ু, অভ্র, স্তনয়িত্নু, বিদ্যুৎ এই চারটি এই আকাশের বা অশরীরী আত্মার মহিমা বা প্রকাশ বৈশিষ্ট্য। বায়ু অর্থে প্রাণ বা আত্মার সক্রিয়তা, এবং যুজ্যতা। অভ্র অর্থে আত্মা যেটির জন্য কামময় তার বিষয়ে যে তেজোময়তা। ভ্র বা ভ্রমণ, বা কাল গতি প্রকাশের আগে, বর্ষণের আগে, যে তেজোময় হওয়া, তাই অভ্র। অভ্র থেকে মেঘ জাত হয়। মেঘ মানে যা থেকে সিঞ্চন বা বর্ষণ হয়। মেঘ শব্দটি মিহ্‌ ধাতু থেকে হয়েছে, মিহ্‌ ধাতুর অর্থ মেহন বা সিঞ্চন করা। অভ্র = অ (অগ্র, পূর্ব্ব) + ভ্র (ভ্রমণ)----ভ্রমণ বা কাল প্রকাশের পূর্ব্বাবস্থা। 
স্তনয়িত্নু অর্থে যিনি স্তনন বা আত্মস্তুতিতে রত বা সংলগ্ন। স্তনয়িত্নু শব্দের সাধারণ অর্থ, ' মেঘ গর্জ্জন '। আত্মস্তুতিময় প্রাণের অভিব্যক্তি হলো স্তনয়িত্নু এবং বিদ্যুৎ। উপনিষদে বলা হয়েছে ইন্দ্রই স্তনয়িত্নু । (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৯।৬ দ্রষ্টব্য।) যিনি ইদং দ্রষ্টা পুরুষ, তিনিই ইন্দ্র। যা কিছু ইদং পদবাচ্য, তা নিজের বা এই স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার প্রকাশ, এই ভাবে যিনি জানেন, অর্থাৎ এই রকম বেদনময় যে পুরুষ, তিনি ইন্দ্র। ইনি এই জ্ঞানেই সকল কিছু ভোগ করেন---এর নাম সোমপান করা। সোম চেতনার স্তনন থেকে, চিন্ময়ীর স্তন থেকে নিসৃত হচ্ছে। (চণ্ডীতে ঋষি বলেছেন যে চন্দ্রের/ সোমের তেজ থেকে দেবীর স্তনোদ্গম হয়েছিলো।)
যিনি সবার সাথে এক, বা সম, তিনি সাম; এ কথা উপনিষদে বলা হয়েছে। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৩।২২ দ্রষ্টব্য।)। ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ সাম বেদের অন্তর্গত। সামের নানা রকম নাম আছে। প্রাণের বা সামের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশের নাম গুলিও বিভিন্ন। এই যে অভ্র, স্তনয়িত্নু, ইন্দ্র, এঁরা বৈরূপ নামক সাম। বৈরূপ মানে বিগত রূপ বা অশরীরী। বায়ু যে অভ্র কে সমপ্লাবিত করে তাই হিংকার বা প্রাণের ' নিশ্চয়াত্মক ' বেদন বা সারা; মেঘ যে জাত হয় তাই ' প্রস্তাব '; বর্ষণই উদ্গীথ বা প্রাণের আকাঙ্ক্ষিত প্রকাশ, আর ঐ যে বিদ্যুৎ এর দ্যোতন এবং স্তনয়িত্নুর স্তনন তাই ' প্রতিহার ' বা প্রতিহরণ, অর্থাৎ যা প্রকাশ পেল, তা নিজেতেই ফিরে চললো;  প্রকাশ করে, সেই প্রকাশকে অনুভব করাই চেতনার ধর্ম্ম এবং এইটি প্রতিহার, এবং সমাপ্তিই ' নিধন '; অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ এই সবটাই প্রাণে নিহিত, এর নাম ' নিধন '। প্রাণের পাঁচটি রকম বা সমাপ্তির (সম্যক্‌ আপ্তির) পাঁচটি স্তর, সামের বা প্রাণের প্রতি প্রকাশে থাকে। বৈরূপ যে সাম, যে সাম রূপের অতীত, তার সমাপ্তির বর্ণনা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। ছান্দোগ্যের এই বৈরূপ সামের মন্ত্রটি উদ্ধৃত করা হলো।
 
" অভ্রাণি সমপ্লাবন্তে স হিংকারো 
  মেঘো জায়তে স প্রস্তাবো 
  বর্ষতি স উদ্গীথো
  বিদ্যোততে স্তনয়তি স প্রতিহার
  উদ্গৃহ্ণাতি তন্নিধনম্‌
  এতৎ বৈরূপম্‌ পর্জন্যে প্রোতম্‌।।" ( ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ২।১৫।১।)। 

২০।ভীমা, ভ্রামরী, ভ্রূ।
আত্মশক্তি বাক্‌, আত্ম-তেজকে নিজেতে ভরণ করেন, এবং নিজেকে বহু করেন বা নিজের থেকে দ্বিতীয় করে নিজেকে সৃষ্টি করেন। ভৃ অর্থে ভরণ করা, এবং অম্‌ অর্থে তেজ; এই জন্য এঁর নাম অম্ভৃণী বা বাগাম্ভৃণী। আর এই যে নিজের থেকে দ্বিতীয় বা ভিন্ন করেন এর থেকে যে দ্বিতীয় সত্তার সৃষ্টি হয়, সে কাল গতিতে ভ্রমণ করে। ভ্রমণের পূর্ব্বের যে অবস্থা, তা অভ্র। এই ভীম আকাশে সবাই ভ্রাম্যমাণ। ঋষি বলেছেন,  " ভীমা শক্তি ভ্রামরী বীজং " । যাঁর নিয়ন্ত্রণে আমরা ভ্রমণ করছি, তাঁকে না জানাই ভ্রম। প্রাণ বা আত্মশক্তি বাক্‌, নিজেকে দ্বিধা করে, দ্বিতীয়তা প্রকাশ করেন,  আর যা প্রকাশ হলো তাকে জানা বা অনুভব করা, এই দুই ক্রিয়াময় হন------ নিজেকে দ্বিতীয় করে প্রকাশ আর যা প্রকাশ পেল সেই প্রকাশিত সত্তা হয়ে নিজেকে তদাকারে জানা বা অনুভব করা। প্রকাশ হলো বহিঃ আর তার অনুভূতি হলো অন্তর, আবার এর নাম কথা বলা (চিৎ প্রকাশ) আর সেই কথাকে শোনা (শ্রুতি বা বেদ)। প্রকাশ মানেই দেখা বা দৃষ্টি এবং গতি; গতি অর্থে কাল ক্রিয়া, অর্থাৎ যা প্রকাশ পায় তাতে সৃষ্টি, স্থিতি,লয় এই তিন অবস্থা দৃষ্ট হয়। আমাতে যা দৃষ্টি বা দর্শন, বাইরের আকাশে তা সূর্য। সূর্যের থেকেও রূপ বা আলো এবং কাল (দিন, মাস, বৎসর) প্রকাশ পাচ্ছে। প্রাণ বা বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে ঋক্‌ বেদে যে মন্ত্র আছে তাতে বিষ্ণুর চোখের (চক্ষু, প্রকাশের উৎস) এবং পায়ের (পদ, গতি, কালগতি, প্রাণের সংক্রমণ) কথা একত্রে উল্লিখিত হয়েছে। এই জন্য চক্ষু হলো জ্ঞানেন্দ্রিয় আর পা হলো তার কর্ম্মেন্দ্রিয়। 
এই যে প্রাণের অন্তর ও বহির্গতি, এই দুইটি চক্ষুদ্বয়ের উপরে দুইটি ভ্রূতে অঙ্কিত রয়েছে। কালের বা প্রাণের আবর্ত্তময় গতি, দুইটি বক্র ভ্রূ হয়ে বিজ্ঞাপিত করছে। তাই আমাদের দুইটি ভ্রূর অব্যবহিত নীচেই দুইটি চোখ। ভ্রূ দুইটি যেখানে মিলিত হয়েছে, সেইটি মনের স্থান এবং এই মনকে দৈ চক্ষু বলা হয়। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৮।১২।৫ দ্রষ্টব্য।) প্রাণের সংকল্প বিকল্পময় স্বরূপই মন। মন থেকে ইন্দ্রিয়গুলি প্রসৃত হয়েছে। তাই আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি (চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, অধর এবং ওষ্ঠ) ভ্রূদ্বয়ের নীচে স্থিত। 
এই প্রসঙ্গে পরমারাধ্য গুরুদেব মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধায়ের লিখিত প্রসিদ্ধ পুস্তক গীতার যৌগিক ব্যাখ্যার একটি অংশ  উদ্ধৃত করা হলো----- " ঐ যে তোমার ললাট প্রান্তে চক্ষের উপরিভাগে নাসামূলভাব হইতে আকর্ণবিস্তৃত দুইটি কেশরেখা ভ্রুনামে খ্যাত, উহা কি জান ? কেন উহার নাম ভ্রু ? ভ্রু শব্দ ভ্রমণ বাচক।দৃষ্টির গতিনির্ণায়ক ঐ ভ্রু দুটি।শব্দ অনুসরণ করিয়া দৃষ্টি প্রবাহিত হয়।শব্দ বা নাম আন্তর প্রকাশ, রূপ বাহ্য প্রকাশ। ভিতরে শব্দ বা নাম অনুসরণে দৃষ্টি রূপান্বেষী হয়।রপ নামের সমবায়ী।দৃষ্টির গতি এইরূপ শব্দ বা নামাভিমুখী বলিয়া ভ্রু দুটি কর্ণাভিমুখে প্রবাহিত।এই জন্য ভ্রুমধ্য বলিতে অন্তর ও বাহ্য নামক প্রজ্ঞাদ্বয়ের মধ্য বা সন্ধি বুঝিতে হয়। অনন্তর অবাহ্য যে আত্মবোধ, উহাই অন্তর্ব্বাহ্যপ্রজ্ঞার সন্ধিস্থল। অন্তর্ব্বাহ্য প্রজ্ঞা ও অন্তর্ব্বাহ্যাচারী প্রাণ, ইহাও প্রায় একই কথা।শ্রুতি বলেন যাহা প্রজ্ঞা, তাহাপ্রাণ, যাহা প্রাণ তাহাই প্রজ্ঞা। সেই জন্য এই জ্ঞান ও প্রাণের অন্তর্ব্বাহ্য গতি ও তাহার সন্ধিক্ষেত্র ভ্রুমধ্যস্থলকে আত্মবোধের বাহ্য প্রতীকভূমিরূপে লক্ষ্য করা হয়। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুগুচ্ছের সন্ধি উহারই পশ্চাতে, সেই হিসাবেও উহা স্থূল অন্তর্বাহ্য সন্ধি।"
এই যে শব্দ যা প্রজ্বলিত হয়ে, রূপ হয়ে, দৃষ্টি হয়ে গতিময়, উপনিষদ্‌ এই প্রজ্বলিত শব্দকে ' অসু ' বলেছেন। অসু অর্থে প্রাণ এবং অস্‌ ধাতু থেকে অসু হয়েছে। অস্‌ অর্থে ' ক্ষেপণ করা '। উপনিষদের এই উক্তির কিয়দংশ উল্লেখ করা হলো। 
মন্ত্র।
স হোবাচ গার্গ্যঃ য এবায়ং যন্তং পশ্চাৎ শব্দো'নুদেত্যেতমেবাহং ব্রহ্মোপাস ইতি স হোবাচাজাতশত্রুঃ মা মৈতস্মিন্সংবদিষ্ঠাঃ অসুরিতি বা অহমেতমুপাস্তে সর্ব্ব  হৈবাস্মিংল্লোকে আয়ুরেতি নৈনং পুরা  কালাৎ প্রাণো জহাতি। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।১।১০।)

অন্বয় অর্থ।
সঃ হ উবাচ গার্গ্যঃ----সেই গার্গ্য বললেন
যঃ এব অয়ং যন্তং ------ এই যে এ চলেছে  
পশ্চাৎ শব্দোঃ অনু উদেতি ---- পশ্চাতে শব্দ এর প্রতি  উদিত হচ্ছে
এতম্‌ এব অহং ব্রহ্ম উপাস ইতি ----এঁকেই ব্রহ্ম রূপে উপাসনা করি

সঃ হ উবাচ অজাতশত্রুঃ----সেই অজাতশত্রু বললেন
মা মা এতস্মিন্‌ সংবদিষ্ঠাঃ ----না না এই বিষয়ে উপদেশ দিও না
অসুঃ ইতি বা অহম এতম্‌ উপাস্তে ----ইনি অসু, এই রূপে আমি এঁকে উপাসনা করি
সর্ব্ব  হ এব অস্মিন্‌ লোকে আয়ুঃ এতি ---এই লোকে সে সর্ব্ব আয়ু (প্রাণের সর্ব্ব ভোগ) প্রাপ্ত হয়
ন এনং পুরা  কালাৎ প্রাণঃ  জহাতি----- কাল পূর্ণ না হওয়ার পূর্ব্বে (কালের পূর্ণতা উপ্ল্বব্ধি না হবার পূর্ব্বে ) প্রাণ এঁকে ত্যাগ করেন না। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।১।১০।)
অর্থ।
সেই গার্গ্য বললেন, " এই যে এ চলেছে (তার) পশ্চাতে শব্দ তার প্রতি উদিত হচ্ছে, এঁকেই ব্রহ্ম রূপে উপাসনা করি"।
সেই অজাতশত্রু বললেন, "না না এই বিষয়ে উপদেশ দিও না। ইনি অসু, এই রূপে আমি এঁকে উপাসনা করি। এই লোকে  (যে এই অসুকে জানে) সে সর্ব্ব আয়ু (প্রাণের সর্ব্ব ভোগ) প্রাপ্ত হয়। কাল পূর্ণ না হওয়ার পূর্ব্বে (কালের পূর্ণতা উপ্ল্বব্ধি না হবার পূর্ব্বে ) প্রাণ একে ত্যাগ করেন না। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।১।১০।)
অসু অর্থে প্রাণ। অসু শব্দটি আস্য শব্দের সাথে সম্বন্ধ যুক্ত। আস্য মানে মুখ। প্রাণের একটি নাম আয়াস্য কেননা প্রাণ আস্য বা মুখ থেকে শব্দ (মুখ বা জিহ্বা দিয়ে), স্পর্শ (অধর-ওষ্ঠ দিয়ে), রূপ ( চোখ দিয়ে), রস (জিহ্বা দিয়ে), গন্ধ (নাক দিয়ে) হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন বা রূপময় হচ্ছেন। আর এই প্রাণ প্রকাশের বা রূপের যে অনুভূতি বা শ্রুতি তা হচ্ছে শ্রোত্রে, যা নাম বা শব্দ। তাই বলা হলো যা চলেছে, যা রূপ, তার পশ্চাতে যে শব্দ শ্রুত হচ্ছে, সে অসু। যা বাহিরে রূপ, তাই অন্তরে শব্দ বা শ্রুতি। কোন শব্দ শ্রুত হলে, আমরা সেই দিক্‌মুখী হয়ে, তার অন্বেষী হই, বা সেই দিকে গতি নিই, এবং এই গতির চিহ্ন ভ্রু হয়ে আমাদের কপালের নীচে অঙ্কিত রয়েছে। অন্তরে যত বোধ বা জ্ঞানের প্রকাশ হচ্ছে, তা শব্দাত্মক, তা শব্দ বা বাঙ্‌ময় আর তদনুযায়ী আমরা হৃদয়ে ভাবময়, মনে সংকল্পময়, এবং ইন্দ্রিয়তে কর্ম্মময় হচ্ছি।
২১।মূর্ত্ত এবং অমূর্ত্ত, সত্যবোধ এবং সংবর্গ।  
" নাম রূপে সত্যম্‌, প্রাণঃ বৈ অমৃতম্‌ তাভ্যাময়ম্‌ প্রাণশ্ছন্নঃ"-------নাম ও রূপ সত্য, প্রাণ অমৃত; তাদের দ্বারা ( নাম ও রূপের দ্বারা) প্রাণ আচ্ছন্ন বা আবৃত। এই বিশ্ব ভুবন, অর্থাৎ যা কিছু সত্য বলে প্রতীত হচ্ছে,  সেই সত্যতায় আমরা নিজেদের সত্য বা অস্তিত্বময় বলে বোধ করছি। যা কিছু সত্য, তার একটি নাম বা সংজ্ঞা আছে এবং একটি রূপ বা আয়তন আছে। তাই এই বিশ্ব নাম এবং রূপের আবরণে আবৃত মহাপ্রাণ, যিনি নিজেকে সত্যরূপে প্রকাশ করেছেন। এই সত্য বোধের যে কেন্দ্র তার নাম চক্ষু বা অক্ষি।কোন কিছু দেখতে পেলে, তদ্বিষয়ে সত্যতার বোধ সুদৃঢ় হয়। প্রজ্ঞা ক্ষেত্রে, চোখ আর পা, বা রূপ প্রকাশ এবং গতি যে এক, সে কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। আবার এই পা দিয়েই আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা বোধ সম্পন্ন হয়ে থাকি। এই জন্য উপনিষদে বলা হয়েছে,  ' চক্ষুই প্রতিষ্ঠা ' (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৫।১।৩ দ্রষ্টব্য।)। 
বৃহদারণ্যক উপনিষদে (দ্বিতীয় অধ্যায় তৃতীয় ব্রাহ্মণ) ঋষি বলেছেন, 
"এই প্রাণরূপ ব্রহ্মের দুইটি রূপ, যা  মূর্ত্ত এবং অমূর্ত্ত, যা মর্ত্ত্য এবং অমৃত, যা স্থির এবং গতিময়, যা সত্য বা ব্যক্ত (সৎ) এবং অব্যক্ত (তৎ)। 
তাই মূর্ত্ত, যা বায়ু এবং অন্তরীক্ষ থেকে অন্য; ইহা মর্ত্ত্য, ইহা স্থাবর, ইহা সৎ। সেই এই মূর্ত্তের, এই মর্ত্ত্যের, এই স্থাবরের, এই সতের ( যা সত্তা বা অস্তিত্ব সম্পন্ন বা অস্তিত্ব বোধময়, বা যা একটি নির্দিষ্ট অস্তিত্বের দ্বারা বিজ্ঞাপিত হয়) এই হলো রস এবং এই যিনি তাপ দিচ্ছেন তিনি এই সতের (সত্তাবানের) রস। 
অনন্তর অমূর্ত্ত---- বায়ু এবং অন্তরীক্ষ; এঁরা অমৃত, এঁরা তৎ, এঁরা যৎ; সেই এই অমূর্ত্তের, এই অমৃতের, এই যৎ এর, এই তৎ এর, এই হল রস যা এই (প্রাণ / আদিত্য) মণ্ডলে স্থিত পুরুষ;  এই তার রস। ইহাই অধিদৈব স্বরূপ।

অনন্তর অধ্যাত্ম (স্বরূপ)---- ইহাই মূর্ত্ত যা প্রাণের থেকে অন্য এবং যা এই অন্তরের আকাশ (থেকে অন্য); ইহা মর্ত্ত, ইহা স্থাবর, ইহা সৎ; সেই এই' মূর্ত্তের, এই মর্ত্তের, এই স্থাবরের, এই সতের এই হলো রস যা চক্ষু; ইহাই সতের (সত্তাবানের) রস"। ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌, মন্ত্র ২।৩।১, ২।৩।২, ২।৩।৩, ২।৩।৪ দ্রষ্টব্য।)

আত্মা যখন প্রাণ হন , বা নিজের ব্রহ্মত্বকে প্রকাশ করেন, বা বৃহৎ হন, তখন তাঁর প্রতি প্রকাশে দুইটি মেরু দৃষ্ট হয়। এই জন্য বলা হলো, যে ব্রহ্মের দুই রূপ, যা  মূর্ত্ত এবং অমূর্ত্ত, যা মর্ত্ত্য এবং অমৃত, যা স্থির এবং গতিময়, যা সত্য বা ব্যক্ত (সৎ) এবং অব্যক্ত (তৎ)। মেরু অর্থে ' মে রূপে ' ---আমার দুই রূপ।

প্রাণ বা আদিত্য যিনি আমাদের তাপ দেন, তিনি যা অমূর্ত্ত, যা অমৃত তার রস; অর্থাৎ এঁর উপল্বদ্ধি থেকে আমরা নিজের অমৃতত্ব এবং অমূর্ত্ত বা সীমাবদ্ধময়তার বাহিরে যে স্বরূপ তা অনুভব করি। এঁকে আদিত্য মণ্ডলে স্থিত পুরুষ বলা হয়েছে। যিনি প্রাণ, যাঁর দৈব প্রকাশ হলো আদিত্য, যিনি আমাদের তাপ দেন বা প্রাণময় করেন, এঁর থেকে কাল এবং রূপ বা রূপময় বা আয়তনময় বিশ্ব প্রকাশ পাচ্ছে; আবার এঁতে সব কিছু আয়তন হারিয়ে অনায়তন হয়ে বিধৃত থাকে, অর্থাৎ ইনি আকাশ।এই মহাপ্রাণ, যিনি অধিদৈবে আদিত্য, তিনিই আমাদের মধ্যে প্রাণ হয়ে আমাদের আকারে মূর্ত্ত হয়েছেন, এবং তাই এঁকে মধ্যম প্রাণ বলা হয়। আমাদের মধ্যে এঁর জ্যোতির্ম্ময়, রূপময় যে অবস্থান, তাই আমাদের দর্শন বোধ বা চক্ষু। তাই উপনিষদে বলা হয়েছে যে যিনি আদিত্যে স্থিত পুরুষ, তিনিই চাক্ষুষ পুরুষ। দেখা বা দর্শন বোধ আমাদের সত্যতার বোধকে প্রত্যক্ষ ভাবে জাগিয়ে দেয়। যা দৃষ্ট হয়, যা আয়তনের দ্বারা, আকারের দ্বারা, রূপের দ্বারা সহজেই প্রতীত হচ্ছে, তাকে সত্য বলে বোধ করতে কোন অসুবিধা হয় না। 
এই যা কিছু মূর্ত্ত, তাদের নিয়ে একটি বর্গ হয়, আবার এই যা কিছু অমূর্ত্ত তাদের নিয়েও অন্য একটি বর্গ হয়; এই রকমই আত্মস্বরূপ চেতনার প্রতি প্রকাশের বৈচিত্র নিয়ে একটি করে বর্গ হয়; যা কিছু মর্ত্ত্য তাদের একটি বর্গ এবং যা কিছু  অমৃত তাদের একটি বর্গ, যা কিছু স্থির বা স্থাবর তাদের একটি বর্গ, যা কিছু গতিময় বা চাঞ্চল্যময় তাদের একটি বর্গ, যা কিছু সৎ বা ব্যক্ত তাদের একটি বর্গ এবং যা কিছু তৎ বা অব্যক্ত তাদের একটি বর্গ। আত্মস্বরূপ যখন প্রাণময় হন, নিজের ব্রহ্মত্বকে প্রকাশ করেন, তাতে এই দুই বিপরীত মেরু প্রকাশ পায়।এর নাম নাম আত্মার উভয় লিঙ্গত্ব। এই এই সর্ব্ব  বৈপরীত্য, বা সকল বর্গ যে আত্মা বা মহাপ্রাণে সমত্বে থাকে, তিনি সংবর্গ। 
এই প্রাণকে উপনিষদ্‌ ইন্দ্র ( ইদং বা সর্ব্ব দ্রষ্টা পুরুষ), বৈকুণ্ঠ (সকল কুণ্ঠা বা দ্বিধা বিহীন), অপরাজিত সেনা বলে সম্বোধন করেছেন। সেনা অর্থে যে বা যারা ব্যূহ বা বর্গে অবস্থান করে। সেনা শব্দটি সেন্‌ ধাতু থেকে হয়েছে, যার আর একটি অর্থ ' অধিকার করা, জয় করা '। যা কিছু জাত (জ) হয়েছে, তাদের যিনি অন্তর (য় ), তিনি সবাইকে ' জয় ' করেছেন। যা কিছু দ্বিতীয় তাকে ইনি আত্মসম্বন্ধে জয় করেছেন। ইনি জিষ্ণু।  ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ২।১।৬ দ্রষ্টব্য। )

২২। কাল, দিক্‌ এবং দেশ।দিগ্বাসিনী দেবী।
আকাশ হল অনায়তন, এখানে সীমাবদ্ধতা বা দেশবদ্ধতা থাকে না।আবার আকাশ থেকেই আয়তন সম্পন্ন বিশ্ব জাত হচ্ছে এবং আকাশেই বিধৃত আছে, আকাশেই লীন হয়ে যায়। দেশ বা আয়তন, বা একটি সুনির্দ্দিষ্ট সত্তা, এবং তা একাত্মস্বরূপ থেকে দ্বিতীয় হয়ে জাত হচ্ছে। আত্মপ্রকাশের প্রথম ভূমি হলো আকাশ; দ্বিতীয়তা প্রকাশ করতে হলে যে অবকাশ রচিত হয় তাই আকাশ। আত্মাই দ্বিতীয় হন, তাই যা দ্বিতীয় তা আত্মাই, আবার দ্বিতীয় হয়েও দ্বিতীয়  নন, যেমন তেমনই, একাত্মস্বরূপ।এই যে আত্মা যিনি এক এবং দ্বিতীয় উভয়ই, ইনি প্রাণ। সুতরাং প্রাণ মানে কামময় আত্মা, কেননা দ্বিতীয় হবার মূলে আছে এক থেকে বহু হবার কামনা। ' কাম ' বা ' কাল ' একই কথা। আত্মার কামময়তাই কাল হয়ে প্রকাশ পায় এবং তাতে সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয় এই তিনটি ক্রম বা গতি সর্ব্বদা দৃষ্ট হয়।বেদে যা বাক্‌, তন্ত্রে তাই কাল। বাক্‌ হলেন প্রাণ বা আত্মার শক্তি বা স্বরূপ, যার দ্বারা তিনি বহু হন। এই যে প্রাণ বহু বা বিভিন্ন হন, সেই বিভিন্নতাগুলি বীজের আকারে প্রাণে নিহিত থাকে এবং তার নাম দিক্‌। তাই এই প্রকাশিত, প্রসারিত বিশ্বের  প্রতি সত্তাটি প্রাণে দিকের আকারে বিধৃত। প্রাণের ফুল বলে যে দিক্‌, তাতে ফুল বিষয়ক যতরকম অনুভূতি, বেদন বা জ্ঞানপ্রকাশ, তা বিধৃত রয়েছে; প্রাণের ফুল বলে যে প্রবণতা, তাই হলো, ফুল নামীয় দিক্‌। এই দিক্‌ সকলই একত্রে, একটি সমতায়, চিৎ ক্ষেত্রে যেখানে ধরা আছে, তার নাম আকাশ।এই জন্য আমরা আকাশকে গোলাকার অনুভব করি, অর্থাৎ সর্ব্বদিকের সমন্বয় হেতু। দিক্‌ সকলই প্রাণ, এ কথা উপনিষদে উক্ত হয়েছে, এবং আমরা এই বিষয়ের উল্লেখ করেছি  ' বায়ু এবং সংবর্গ' (অনুচ্ছেদ ৫) এবং " দিক্‌ ও স্পর্শ, দিক্‌ ও আকাশ" (অনুচ্ছেদ ৯), এই দুইটি অনুচ্ছেদে। 
যে চিন্ময়ী বিশ্বমাতা অনায়তন হয়েও  আয়তনময়, তিনি দিগ্বাসিনী।সেই বিশ্বমাতার আবির্ভাবে, পরমাধ্য গুরুদেব   শ্রী বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় যে স্তুতি করেছিলেন, সেই স্তবের একটি পঙ্‌তি হলো-----
" পূত-প্রণব-রাগ-রচিত চমৎকৃত বিকশিত-বিন্দু দিগ্বাসিনীং।
   প্রপূজিতাং অভয়াং বরদাং স্নেহ-করুণা-ভার- নম্রাং"।।

২৩।আকাশ এবং অক্ষর আত্মা।
পরমাত্মা , যিনি সবার আত্মা, বা যাঁকে নিয়ে আমরা আত্মপরিচয় দিই, তিনি যখন বহু হন, তাঁর সেই খণ্ড খণ্ড সত্তাগুলির নাম ক্ষর আত্মা। আর যিনি পরমাত্মস্বরূপ, তিনি বহু হয়েও যেমন তেমনি থাকেন, তাই তাঁর নাম অক্ষর, অর্থাৎ যিনি ক্ষয়হীন। এই বিশ্ব অক্ষর আত্মার জ্ঞান প্রকাশ। বিশ্ব বলে আত্মস্বরূপের যে জ্ঞান তাই বিশ্ব।আর প্রতিটি সত্তায় ইনি নিজেই রয়েছেন। ইনি নিজেই নিজেকে বিশ্বের আকারে জেনে বিশ্ব হয়েছেন, আবার স্থির, অসঙ্গ, অক্ষর আত্মা রূপে বিরাজ করছেন।চেতনার ধর্ম্মই হলো যে, যা জানেন তাই হন, এবং যা হন, সেই হওয়াটাকে জানেন।এই যে বিশ্বের আকারে জ্ঞান প্রকাশ, এর নাম সম্ভূতি, বা সম্যক রূপে ভূত হওয়া, মূর্ত্ত হওয়া।আর এই সম্ভূতি তে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তারা প্রত্যেকে জানছে বা অনুভূতিময়।বাইরে যে একটি বৃক্ষ, তা এই জ্ঞানস্বরূপ অক্ষর আত্মার বৃক্ষ জ্ঞান এবং তার থেকে আমাদের মধ্যে বৃক্ষের অনুভূতি ফুটছে।এই অক্ষর আত্মা যা হয়েছেন তদনুসারে, বা সম্ভূতি অনুসারে আমাদের মধ্যে বোধ ফোটে বলে, তার নাম অনুভূতি। আমরা আমাদের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র  অনুভূতির জগতে বেঁচে আছি। এই বোধ বা অনুভূতিকে সাধারণতঃ জ্ঞান বলা হয়।  এই জ্ঞান বা বোধ সর্ব্বদা নিজ বা আত্মবোধ যুক্ত। নিজে নেই , অথচ বোধ হচ্ছে, এ রকম হয় না। নিজ বলে যে বোধ, তা সর্ব্ব বোধের তলায় বা সর্ব্ব অনুভূতির মূলে আছেন। 'আমি' বা 'অহং' এই নিজবোধ স্বরূপ আত্মারই 'আমি' নামক জ্ঞান প্রকাশ। এই অক্ষর আত্মাকেই আমরা নিজ বলে অনুভব করছি। কিন্তু যাঁকে আমি নিজ বলে জানছি, তিন যে সবার মধ্যেই ' নিজ ' এই দর্শন না থাকায়, আমার এই অক্ষর আত্মাকে জানিনা।  আমাদের আমি বা অহং বোধ, নিদ্রার সময় বা মৃত্যুকালে এই আত্মবোধ বা নিজবোধেই মিলিয়ে যায় এবং নিদ্রা বা মৃত্যুর অন্তে আবার অহং বা আমি জেগে ওঠে। স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ভাবে এঁকে যখন দেখা হয়, তখন এঁকে অণু আত্মা, প্রত্যক্‌ আত্মা, ক্ষর আত্মা ইত্যাদি বলা হয়। 
( ঈশোপনিষদে অনুভূতিকে ' বিনাশ' বলা হয়েছে, কেননা আমদের অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী, এবং আমরাও ক্ষণস্থায়ী। ঈশোপনিষদের মন্ত্র ১২,১৩এবং ১৪ দ্রষ্টব্য।)

এই আত্মা স্বয়ংশক্তি, স্বয়ংপ্রকাশ এবং বিশ্ব নিয়ন্তা। ইনি নিষ্ক্রিয় অথচ সক্রিয়। এঁর ক্রিয়াময় স্বরূপের নাম প্রাণ, এবং নিজেই নিজেকে যে সক্রিয় করেন, বহু করেন, সেই সামর্থ্য বা শক্তির নাম বাক্‌, বা এই সক্ষমতা (স্বক্ষমতা) কে বাক্‌ বলা হয়। এই বাকেরই বিভিন্ন বিভিন্ন প্রকাশ-উন্মুখ স্ফুট্‌গুলি কে বর্ণ বলা হয়। এই বর্ণদের সমাসে সুনির্দিষ্ট অর্থময় যে শব্দরাজি এই মহাচৈতন্যে বা জ্ঞানস্বরূপে প্রকাশ পেয়েছে, তাই এই বিশ্ব ভুবন। এই জন্য বর্ণ কে অক্ষরও বলা হয় কেননা বাক্‌ স্বয়ং অক্ষর আত্মস্বরূপ বা অক্ষর আত্মস্বরূপ স্বয়ংশক্তি। এঁর বপু বা আয়তন বা প্রকাশ ক্ষেত্র হলো আকাশবৃহদারণ্যক উপনিষদে (তৃতীয় অধ্যায়, অষ্টম ব্রাহ্মণ), দ্রষ্টী ঋষি গার্গির প্রশ্নের উত্তরে,  ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এই আকাশ এবং অক্ষর আত্মার বিষয়ে যা বলেছিলেন, তার একটু অংশ নীচে উল্লেখ করা হলো :

যাজ্ঞবল্ক্য ) -----" যা দ্যুলোকের ঊর্ধ্বে, যা পৃথিবীর অধে, যা এই দ্যু এবং পৃথিবীর অন্তরে, যা অতীত,বর্ত্তমান এবং ভবিষ্যৎ, এই ভাবে যাকে দেখা যায়, তা আকাশে ওতপ্রোত ভাবে রয়েছে"।
 
(গার্গি)-----" আকাশ কোথায় ওতপ্রোত ভাবে রয়েছে?"

যাজ্ঞবল্ক্য ) -----" ইনিই সেই অক্ষর গার্গি, যাঁর কথা ব্রাহ্মণরা বলেন। (ইনি) অস্থূল (স্থূল নন, কিন্তু স্থূলত্বের আভাস যাঁতে আছে বা যিনি স্থূল হয়ে প্রকাশ হন) , অনণু (অণু নন, কিন্তু অণিমার আভাস যাঁতে আছে বা যিনি অণু হয়ে প্রকাশ হন) , অহ্রস্ব ( হ্রস্ব নন, কিন্তু হ্রস্বের আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি হ্রস্ব হয়ে প্রকাশ হন), অদীর্ঘ (দীর্ঘ নন, কিন্তু দৈর্ঘের আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি দীর্ঘ হয়ে প্রকাশ হন), অলোহিত (লোহিত, নন কিন্তু লোহিতের আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি লোহিত হয়ে প্রকাশ হন), অচ্ছায়া (ছায়া নন, কিন্তু ছায়ার আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি ছায়া হয়ে প্রকাশ হন), অতম ( তম নন, কিন্তু তমের আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি তম হয়ে প্রকাশ হন), অবায়ু ( যিনি বায়ু নন, কিন্তু বায়ুর আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি বায়ু হয়ে প্রকাশ হন), অনাকাশ ( যিনি আকাশ নন, কিন্তু আকাশের আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি আকাশ হয়ে প্রকাশ হন), অসঙ্গ (যিনি অসঙ্গ কিন্তু সঙ্গত্বর আভাস যাঁতে আছে বা যিনি সঙ্গবান্‌ হয়ে প্রকাশ হন), অরস (যিনি রস নন, কিন্তু রসের আভাস যাঁতে আছে বা যিনি রস হয়ে প্রকাশ হন), অগন্ধ (যিনি গন্ধ নন, কিন্তু গন্ধর আভাস যাঁতে আছে বা বা যিনি গন্ধ হয়ে প্রকাশ হন), অচক্ষু (চক্ষু বিহীন, কিন্তু চক্ষুর আভাস যাঁতে আছে বা যিনি দ্রষ্টা হয়ে প্রকাশ হন),  অশ্রোত্র (শ্রোত্র বিহীন, কিন্তু শ্রোত্র আভাস যাঁতে আছে বা যিনি শ্রোতা হয়ে প্রকাশ হন), অবাক্‌ (বাক্‌ শূন্য, কিন্তু বক্তার আভাস যাঁতে আছে বা যিনি বক্তা হয়ে প্রকাশ হন),  অমন (মন বিহীন, কিন্তু মনে আভাস যাঁতে আছে বা যিনি মন্তা হয়ে প্রকাশ হন), অতেজস্ক (তৈজস নন, কিন্তু তেজে আভাস যাঁতে আছে বা  যিনি তেজোময় হয়ে প্রকাশ হন), অপ্রাণ (প্রাণচাঞ্চল্য বিহীন, বা মাত্র আত্মস্বরূপ, কিন্তু যিনি প্রাণময় হন), অমুখ (মুখ বা উৎস বিহীন, কিন্তু সকল কিছুর উৎস), অমাত্র (মাত্রার দ্বার যাঁকে মাপা যায় না, কিন্তু যিনি মাত্রার যোগ্য হয়ে প্রকাশ পান), অনন্তর (অন্তরবিহীন বা যাঁতে অন্তর বোধ নেই, কিন্তু যাঁর থেকে অন্তর বোধ জাত হয়) ,অবাহ্য ( যাঁর বাহির বলে কিছু নেই বা যাঁর বাহিরে কিছু নেই, কিন্তু যাঁর থেকে বহির্বোধ জাত হয়)। সেই অক্ষর কাউকে খান না (ভোগ করেন না), এবং তাঁকেও কেহ ভোগ করেন না।" (যেহেতু এঁর থেকে দ্বিতীয় কিছু নেই , তাই ইনি অসঙ্গ বা ইনি কাউকে ভোগ করেন না এবং অন্য কেহ এঁকে ভোগ করেন না।) (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৮।৭ এবং ৩।৮।৮ ।)
 " এই অক্ষরের প্রশাসনেই, গার্গি, ঐ সূর্য এবং চন্দ্র বিধৃত হয়ে অবস্থান করছে, এই অক্ষরের প্রশাসনেই, গার্গি, দ্যুলোক এবং পৃথিবী বিধৃত হয়ে অবস্থান করছে, এই অক্ষরের প্রশাসনেই, গার্গি, নিমেষ সকল, মুহূর্ত্ত সমূহ, অহো-রাত্র সমূহ, অর্ধমাস সকল, মাস সকল, ঋতুসকল, সম্বৎসর সকল বিধৃত হয়ে অবস্থান করছে; এই অক্ষরের প্রশাসনেই, গার্গি, কোন কোন নদী শ্বেত পর্ব্বত সমূহ থেকে পূর্ব্ব দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, কোন কোন নদী  পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, যে যে দিকের, তদনুসারে; এই অক্ষরের প্রশাসনেই, গার্গি, মনুষ্যরা দাতার প্রসংশা করে, দেবগণ যজমানের এবং পিতৃগণ দর্ব্বীর অনুগত হন"।  (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৮।৯।)
" যে এই অক্ষরকে না বিদিত হয়ে, এই লোকে হবন করে, যজন করে, বহু সহস্র বর্ষব্যাপী তপস্যা করে, তার তা  অন্তবান্‌ হয় (চীরস্থায়ী হয় না)। যে এই অক্ষরকে না বিদিত হয়ে, এই লোক থেকে প্রস্থান করে (ইহলোক ত্যাগ করে) সে কৃপণ (কৃপার পাত্র)। আর যিনি এই অক্ষরকে বিদিত হয়ে, গার্গি, এই লোক থেকে প্রস্থান করেন, তিনি ব্রাহ্মণ।" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৮।১০।)

২৪। শ্রুতি, প্রতিশ্রুতি এবং দিক্‌। 
 যা কিছু আমরা অনুভব করছি, জানছি, তাই শ্রুতি বা বেদ। এই বাহিরের বিশ্ব, আমাদের মধ্যে যা কিছু অনুভূতি ফুটিয়ে দিচ্ছে, তা একটি শব্দের আকারে আমাদের মনে গৃহীত হচ্ছে, এবং এর নাম 'শোনা'। যা শুনছি সেটি একটি শব্দ বা ' নাম'। সেই নামের একটি চেহারা আছে, আয়তন আছে, যার নাম 'রূপ'। আমরা যতক্ষণ সচেতন থাকি, জাগ্রত বা স্বপ্নাবস্থায় থাকি, ততক্ষণ কথা বলি আর সেই কথা শুনি। বলা আর শোনা, প্রকাশ আর সেই প্রকাশকে কে অনুভব করা, ইহাই চেতনার ধর্ম্ম, এবং এই জন্যই সবাই কথা বলছে আর শুনছে। এই বিশ্ব আমাদের মধ্যে শব্দাত্মক রূপে বর্ত্তমান। তবে আমরা চেতনা বা প্রাণকে দেখি না বলে, বা নিজের চিন্ময়তা কে ভুলে থাকি বলে, আমাদের জানা বা অনুভূতি, বেদ বা শ্রুতি পদবাচ্য নয়; আমাদের যে অনুভূতি, তা প্রাণের যে বেদন বা শ্রুতি, তার বাইরের স্তর মাত্র, এবং এই কারণে আমরা ভৌতিকতার দ্বারা অভিভূত হয়ে থাকি। এই না জানা (স্বল্প জানা ) বা আত্মজ্ঞানহীনতা থেকে শ্রুতিমল জাত হয়। কথিত আছে যে বিষ্ণু বা প্রাণের শ্রুতিমল থেকে মধু এবং কৈটভ নামক দুই অসুরের জন্ম  হয়েছিলো। কীট ভাব বা ক্ষুদ্রতা এবং তাতে আসক্তি বা মধুময়তা,  এই নিয়ে, মধু ও কৈটভের অধীনে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু এই অসুররা যখন প্রাণ বা বিষ্ণুর দ্বারা হত হয়, তখন সীমাবদ্ধতার ঊর্দ্বে যে প্রাণ, তাঁর প্রকাশে শ্রুতি বা বেদের দ্বারা বা প্রাণের বেদনের দ্বারা আমরা আপ্লুত হই। সীমার বাইরে মানেই দিক্‌, যেখানে কোন আয়তন নেই।  
বৃহাদারণ্যক উপনিষদে ঋষি বলেছেন যে দিক্‌ সকলের মধ্যে যে তেজোময় এবং অমৃতময় পুরুষ বিদ্যমান, তিনিই অধ্যাত্মে বা আমাদের মধ্যে সেই পুরুষ যিনি ' শ্রোত্র/শ্রৌত্র ' এবং ' প্রাতিশ্রুৎক '। সর্ব্ব শ্রুতি যাঁর কৃতি বা কর্ম্ম,  সমস্ত বেদ বা বেদন যাঁর প্রকাশ, সেই বেদময় পুরুষ বা প্রাণই শ্রোত্র বা শ্রৌত্র পুরুষ। উৎক অর্থে কামময়। শ্রুৎক অর্থে যাঁর কামময়তা থেকে শ্রুতি বা বেদন প্রকাশ পাচ্ছে। প্রাতিশ্রুৎক অর্থে, শ্রুতি থেকে যারা জাত, তারাও শ্রুতি বা অনুভূতিময়, বা প্রতি-শ্রুতিময়। অক্ষর আত্মা নিজেকে প্রাণময় করে বা শ্রৌত্র হয়ে, শ্রুতিময় হয়ে সব হয়েছেন, আর সেই সৃষ্ট সত্তারা বা ক্ষর আত্মারা আবার নিজেকে তদাকারে জানছে বা অনুভব করছে, এবং অক্ষর আত্মার শ্রুতি থেকে যে বিশ্ব জাত হয়েছে, ক্ষর আত্মারা বা আমরা, তাকেও অনুভব করছে, তাই আমরা প্রাতিশ্রুৎকময় পুরুষ; অর্থাৎ আমরা যা হয়ে সৃষ্ট হয়েছি, নিজেকে তদাকারে জানছি এবং অন্যদের বা সৃষ্ট বিশ্বকেও জানছি।  সুতরাং এই প্রাণকে শ্রোত্র এবং প্রাতিশ্রুৎক বলা হয়েছে।  
আমরা সর্ব্বদাই উৎকর্ণ, সর্ব্বদাই শব্দ,স্পর্শ,রূপ,রস,গন্ধের আকারে অক্ষর আত্মার থেকে যে শ্রুতি বা বেদ বলে যা আসছে, যার অন্য নাম ' সোম ' তা পেতে উদগ্রীব এবং উৎকর্ণ। এই অক্ষর আত্মা থেকে যে প্রকাশ হচ্ছে, তা আকাশ এবং তার পর দ্যুলোক এবং অন্যান্য লোক সকল, যার নাম বিশ্ব। আমরা গ্রীবা ঘুরিয়ে, কাণ ঘুরিয়ে, এই বেদ বা শ্রুতি কে গ্রহণ করছি। বাইরে থেকে, ফল, ফুল, বৃক্ষ, ইত্যাদি কোন অনুভূতি বা বোধ এলে, বা কোন শব্দ বা বাক্য ফুটে উঠলে আমরা অন্তরে সেই দিকে অনুপ্রাণিত হই বা সেই দিঙমুখ হই।
প্রাতিশ্রুৎক শব্দের আর একটি অর্থ নীচে উল্লেখ করা হলো।
প্রাতিশ্রুৎক
প্রাতি শব্দের একটি অর্থ হলো হাতের অঙ্গুষ্ঠ এবং তর্জনীর মধ্যে যে ফাঁক বা অবকাশ বা আকাশ। অঙ্গুষ্ঠ অর্থে, উপনিষদোক্ত অবিনশ্বর আত্মা, যাঁকে ' অঙ্গুষ্ঠ মাত্র পুরুষ ' বলে ঋষিরা বন্দনা করেছেন। সুতরাং অঙ্গুষ্ঠ এবং প্রাতি বা ঐ ফাঁক হলো  আকাশ বা শব্দ, তর্জনী হলো স্পর্শ, মধ্যমা হলো রূপ, অনামিকা হলো রস এবং কনিষ্ঠা হল গন্ধ। আমরা যে কর্ম্ম করি, তা প্রাণেরই সক্রিয়তা, এবং অঙ্গুলিগুলি তারই প্রতীক। তর্জনীর দ্বারা স্পর্শ এবং দিক্‌ দুইই বোঝায়। কোন দিক্‌ দেখাতে হলে আমরা তর্জনীর দ্বারাই দেখাই। 
এই প্রাণ বা সর্ব্বশ্রুতিময় পুরুষকে শ্রৌত্র পুরুষ বা শ্রোত্রসম্বন্ধী পুরুষ বলে উপনিষদে বলা হয়েছে। প্রতি শ্রুতির যে বৈষিষ্ট্য, বা তদ্‌-অভিমানী যে পুরুষ বা ব্যক্তিত্ব, সেই প্রতি পুরুষই এক একটি দিক্‌ বা প্রাতিশ্রুৎক পুরুষ। প্রাণের এক একটি প্রবণতা, বা এক একটি বেদন বা এক এক প্রকার শ্রুতিই এক একটি দিক্‌। এক একটি দিকে প্রাণের এক এক বেদনের অনন্ত মহিমা নিহিত আছে। ফুল একটি দিক্‌, সেই দিকে ফুলের অনন্ত বৈচিত্র নিহিত, বৃক্ষ একটি দিক্‌, বিহঙ্গ একটি দিক্‌...... এই রকমই সব। এই দিক্‌ সকলই ব্যবহারময়, প্রকাশশক্তি সম্পন্ন দেবগণ, যাঁরা দিব্‌ বা দ্যুলোকবাসী।এই প্রসঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি মন্ত্র উল্লেখ করা হলো। 
মন্ত্র।
 আকাশ এব যস্যায়তনম্‌ শ্রোত্রং লোকো মনোজ্যোতির্যো বৈ তং পুরুষং বিদ্যাৎ সর্ব্বস্যাত্মনঃ পরায়ণং স বৈ বেদিতা স্যাদ্যাজ্ঞবল্ক্য বেদ বা অহং পুরুষং সর্ব্বস্যাত্মনঃ পরায়ণং যমাত্থ য এবায়ং শ্রোত্রঃ প্রাতিশ্রুৎকঃ পুরুষঃ স এষ বদৈব শাকল্য তস্য কা দেবতেতি দিশ ইতি হোবাচ। ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৩।৯।১৩।)
অন্বয় অর্থ।
আকাশ এব যস্য আয়তনম্‌ ------আকাশই যাঁর আয়তন, শ্রোত্রং লোকঃ-----শ্রোত্র যাঁর লোক, মনঃ জ্যোতিঃ ----মন যাঁর জ্যোতি, যঃ বৈ তং পুরুষং বিদ্যাৎ------ যিনি সেই পুরুষকে বিদিত হন ( জানেন ), সর্ব্বস্য আত্মনঃ পরায়ণং ----সকল আত্মার পরমগতি, সঃ বৈ বেদিতা স্যাৎ যাজ্ঞবল্ক্য---- হে যাজ্ঞবল্ক্য! তিনিই বেদিতা;
বেদ বা অহং পুরুষং সর্ব্বস্য আত্মনঃ পরায়ণং ----- আমি সকল আত্মার পরমগতি এই পুরুষকে জানি,  যম্‌ আত্থ----যার কথা বলছ,  য এব অয়ং শ্রোত্রঃ প্রাতিশ্রুৎকঃ পুরুষঃ -------যিনি এই শ্রোত্র প্রাতিশ্রুৎক পুরুষ, সঃ এষঃ---তিনি ইনি; 
বদ এব শাকল্য----শাকল্য এবার বলো;
তস্য কা দেবতা ইতি---তাঁর দেবতা কে?
দিশঃ ইতি হ উবাচ--- দিক্‌, ইহাই বললেন।

অর্থ
( শাকল্যের উক্তি।)
" আকাশই যাঁর আয়তন, শ্রোত্র যাঁর লোক, মন যাঁর জ্যোতি, যিনি সেই পুরুষকে বিদিত হন ( জানেন ), (যে পুরুষ) সকল আত্মার পরমগতি, হে যাজ্ঞবল্ক্য! তিনিই বেদিতা।"

(যাজ্ঞবল্ক্যের উক্তি।)
" আমি সকল আত্মার পরমগতি এই পুরুষকে জানি, যার কথা বলছ;  যিনি এই শ্রোত্র-সম্বন্ধী এবং প্রাতিশ্রুৎক পুরুষ,তিনি ইনি। শাকল্য এবার বলো।"
(শাকল্যের উক্তি।)
" তাঁর দেবতা কে? "
(যাজ্ঞবল্ক্যের উক্তি।)
 " দিক্‌। " 
ইহাই বললেন।বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৩।৯।১৩।)

" আকাশই যাঁর আয়তন ", এর অর্থ,যিনি আকাশের অন্তরে স্থিত। 
শ্রোত্র যাঁর লোক,", এর অর্থ, যিনি শ্রবণময় পুরুষ বা যাঁর ধর্ম্মই ' শ্রুতি '। 

" মন যাঁর জ্যোতি ", এর অর্থ, যিনি মন বা সংকল্পের দ্বারাই জ্যোতির্ময় হন বা নিজেকে প্রকাশ করেন, বা শব্দ সকলকে প্রকাশ করেন,কেননা শব্দ সকলই শ্রুত হয়।

সকল আত্মার পরমগতি ", এর অর্থ, যে যেখানে যা কিছু শুনছে তা যাঁর শ্রবণের অন্তর্গত, সেই এক এবং অদ্বিতীয় শ্রোতা।  
"  ' তাঁর দেবতা কে?'  দিক্‌, ইহাই বললেন।"-------অর্থাৎ শাকল্য যখন জিজ্ঞাসা করলেন যে শ্রোত্র - প্রাতিশ্রুৎক পুরুষের দেবতা কে বা তাঁর দৈব স্বরূপ বা যে স্বরূপে তিনি সকলের মধ্যে শ্রুতি প্রকাশ করছেন, সকলকে শ্রুতির ভোক্তা করছেন, কে সেই দেবতা, তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলনে যে সেই দেবতা হলেন 'দিক্‌'। শ্রোত্র - প্রাতিশ্রুৎক পুরুষের তাৎপর্য্য আগেই বলা হয়েছে।শ্রোত্র শব্দে কর্ণ বা কান বোঝায়। কর্ণ শব্দটি কোণ বা দিক্‌ এর সাথে সম্বন্ধ যুক্ত। ইংরাজি ভাষায় কর্ণার ( corner ) শব্দটিও কর্ণ থেকে হয়েছে। কর্ণার ( corner ) মানেও কোণ।
শ্রোত্র শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো, যে শ্রুতির দ্বারা ত্রাণ করে। যা কিছু আয়তনময়, রূপময়, তার অনুভূতি শব্দের আকারে আমাতে গৃহীত হচ্ছে, অনায়তন হয়ে আমাতে শব্দের আকারে রয়েছে। শ্রবণের এই বিজ্ঞান যাঁদের অধিগত হয়েছে, বৈদিক যুগে তাঁদের 'শ্রোত্রিয়' বলা হতো।

২৫।সতীপীঠ-বর্গভীমা। দক্ষিণাচার ও  বামাচার। দক্ষিণ ও উত্তর দিক্‌। যম এবং সোম। 
বর্গভীমার মন্দির একটি পীঠস্থান, যেখানে সতীর বাম গুল্‌ফ ( গোড়ালি ) পড়েছিল। সতী হলেন সৎ-শক্তি।আত্মস্বরূপ চেতনাই সত্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছেন। চেতন ,অচেতন সকল কিছুই পরমাত্মস্বরূপের সত্যপ্রকাশ।যে চেতনা অনায়তন,একান্ত স্বাধীন এবং সীমাহীন, অনন্ত, সেই চেতনাই সসীম, আয়তনময় হয়েছেন, মূর্ত্ত বা মর্ত্ত্য হয়েছেন, যা কিছু অচিৎ, যেখানে প্রাণের সারা-শব্দ নেই, তাও তাঁর মূর্ত্ত প্রকাশ। আমরা আগে অক্ষি বা চক্ষুর কথা বলেছি, যে চোখ থেকে রূপ বা দর্শন এবং কালগতি বা কালচক্র প্রকাশ পাচ্ছে। তাই প্রাণ বা বিষ্ণুর যে সু-দর্শন-চক্র, তা এই অক্ষিই বা অক্ষিগত পুরুষেরই ক্রিয়া, যার দ্বারা ইনি নিজেকে বা সতীদেহকে বহু খণ্ডে খণ্ডিত করেছেন। ঈক্ষণ কথাটি কাল বাচক; চিৎ শক্তি থেকে ক্ষণ বা কাল জন্মায়। আবার ঈক্ষণ মানে দেখা এবং কামনা করা। উপনিষদে ঋষি বলেছেন যে আত্মস্বরূপ ঈক্ষণ করে বহু হয়েছেন।  আর, সত্য বোধ বা  অনুভূতির যে কেন্দ্র তা চক্ষু, এই বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে। (এই প্রসঙ্গে কবিগুরুর একটি গান উল্লেখযোগ্য, সেই গানের প্রথম চরণ দুটি হলো------                                " ওগো, তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি
   আমার সত্যরূপ প্রথম করেছ সৃষ্টি ।।" ( https://www.geetabitan.com/lyrics/O/ogo-tomar-chokkhu-diye-lyric.html)

আমাদের বাম পায়ের পাতার যে সঞ্চালন তা সাধিত হয় বাম গুল্‌ফের দ্বারা। এই বামদিকের গতির উপর যিনি আধিপত্য করেন, সেই অক্ষিগত পুরুষের নাম বা আত্মস্বরূপের সেই মহিমার নাম সংযদ্বাম। বাম অর্থে যিনি শোভন, সুন্দর।  বাম অর্থে ' বা +ম '------' ম ' বা মর্ত্ত বা মৃত্যু যেখানে 'বা' অর্থাৎ ' বাদ ' বা ' ব্যতীত '। 
যে দিক্‌ দিয়ে আমরা দাক্ষিণ্যময় হচ্ছি, নিজেদেরকে কর্ম্মের দ্বারা প্রসারিত বা বিস্তার করছি, সেইটি দক্ষিণ দিক্‌। সেই দিকের উপর আত্মস্বরূপ চেতনার যে ব্যক্তিত্ব আধিপত্য করছেন তাঁর নাম যম, আর এই নিয়ন্তা কে সাক্ষাৎ চিন্ময় আত্মার প্রকাশ বলে দেখলে এঁকে  দক্ষিণাগ্নি বলা হয়। এই জন্য দক্ষিণ দিকের অধিপতি দেবতার নাম যম, ইনি মৃত্যু-দেবতা এবং অমৃতের আবরণ দেবতা। জন্ম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, এই দেবতার নিয়ন্ত্রণে, কর্ম্ম ফলের ভোক্তা হয়ে আমরা অমৃত লাভের পথে চলেছি। 
বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩।৯।২১ মন্ত্রে বলা হয়েছে যে দক্ষিণ দিকের দেবতা যম, যম প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞে, যজ্ঞ প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাতে এবং দক্ষিণা প্রতিষ্ঠিত শ্রদ্ধাতে, আর শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত হৃদয়ে। 
জ্ঞান মানে ' জ্ঞ + অন '। অন বা প্রাণময়তার মধ্যে যিনি স্থির, অপরিণামী আত্মস্বরূপ বা নিজবোধ স্বরূপ, তাঁর জানা বা বেদনই অন বা প্রাণ।নিজে নেই অথচ জানছি, এ সম্ভব নয়। নিজেই নিজেকে জানছেন নিজরূপে এবং সর্ব্ব রূপে, এবং জেনেও, 'জ্ঞ' বা নিজবোধ রূপে যেমন তেমনই আছেন। যিনি 'জ্ঞ', এই জ্ঞানময় বা প্রাণময় বিশ্ব তাঁরই কর্ম্ম বা প্রাণ-চাঞ্চল্য, তাঁরই যমন বা নিয়ন্ত্রণ। তাই কর্ম্ম মাত্রেই যজ্ঞ, এবং বিশেষতঃ যে সকল কর্ম্ম ঋষিরা অভ্যুদয়ের জন্য বিধান করেছিলেন, সেই সকল কর্ম্ম সমাজে যজ্ঞ বলে পরিচিত। যে ' দ ' বা আত্মশক্তি বাকের কথা আমরা আগে বলেছি, তিনি নিজেকে বা নিজের অক্ষর আত্মস্বরূপ থেকে ক্ষরিত হয়ে, প্রতিটি ক্ষণ, কালের প্রতিটি অবয়ব, বা অস্তি এবং নাস্তিময় যা কিছু এই আকারে প্রকাশ পাচ্ছেন, এইটি দক্ষিণ। (দক্ষ= দ+ক্ষ)। এই 'দ' বা আত্মশক্তির দ্বারাই আমরা ' দক্ষ ' হয়েছি এবং হচ্ছি----আমরা দক্ষতার সাথে দেখছি, শুনছি, কর্ম্ম করছি। এই যে প্রাণ কর্ম্ম হয়ে, দাক্ষিণ্যময় হয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন, এইটি দক্ষিণা বা প্রাণের এই প্রবণতাই দক্ষিণ দিক্‌।এর স্বীকৃতিতে যজ্ঞে দক্ষিণা দেওয়া হয়। এই  দক্ষিণা প্রতিষ্ঠিত শ্রদ্ধাতে। যাঁর দ্বারা আমরা দাক্ষিণ্যময় হচ্ছি, যাঁর দ্বারা আমাদের দর্শন, শ্রবণ, মনন ইত্যাদি সমৃদ্ধ হচ্ছে, তিনি আমাদের আশ্রয় এবং তাঁতে আমরা শ্রদ্ধাময়। আর এই সকল প্রতিষ্ঠিত হৃদয়ে, যিনি হৃদয়ময় আত্মা বা প্রাণ, তিনি আহরণ (হৃ) করছেন,  দান (দ)  করছেন, এবং এই প্রাণ-দান এবং প্রাণ-আহরণ উভয়কেই সংযমন (য়) করছেন। এই হলো প্রাণরূপ দক্ষিণাগ্নির অনুশাসনে যে যজ্ঞ চলছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩।৯।২৩ মন্ত্রে বলা হয়েছে যে উত্তর (উদীচী) দিকে যে দেবতা তিনি হলেন সোম। সোম অর্থে  ' সঃ মোদয়তি ' --সে উল্লাস বা করছে, বা সে মেতে উঠেছে'। এই আত্মস্বরূপ প্রাণই আপন আনন্দে আত্মহারা।নিজেকে নিজের ভিতর যত রকমে পাওয়া যায়, তার নাম বেদ বা শ্রুতি, এবং তাতে এই পরম আত্মস্বরূপ একদিকে অপরিণামী, অবিনশ্বর  অক্ষর-আত্মা এবং অন্যদিকে নিজেকে চূর্ণ চূর্ণ  করে বহু বহু ক্ষরাত্মা রূপে ( বা প্রত্যক্‌ আত্মা বা অণু আত্মা রূপে) নিজেকে প্রকাশ করেছেন। অক্ষর আত্মত্ব থেকে প্রথমে প্রকাশ পেয়েছে দিব্, দ্যু, দ্যুলোক বা দেবক্ষেত্র। নিজেকে দোহন করেন বলে এই লোকের নাম দ্যু। এই লোকের যে বিশেষ দ্যুতি তার নাম বিদ্যুত। প্রকাশময়তাই এই ক্ষেত্রের ধর্ম্ম। আমরা যেমন গ্রহণ করে আনন্দ পাই, তেমনই এঁরা আত্ম মহিমাকে প্রকাশ করেই আনন্দ পান। যেমন ফুল বা পুষ্প দেবতার মধ্যে, সমগ্র কাল এবং দেশের অন্তগর্ত ফুলের যত বৈচিত্র প্রকাশ পেয়েছে, পাবে এবং পেয়েছিল, সে সবই আছে, আর সেই ফুলকে বা ফুলের বৈচিত্রগুলিকে প্রকাশ করে অপরকে তার ভোক্তা করাই পুষ্প দেবতার ধর্ম্ম।
এই দ্যুলোকের যে আনন্দ বা অনুভূতি, তাই সোম। এই আনন্দ অনুভূতিতে মৃত্যুর মলিনতা নেই, হারিয়ে যাবে,ফুরিয়ে যাবে, এই আশঙ্কা নেই। বিদ্যমানতার যে উৎকৃষ্ট অবস্থা তা বিদ্যুৎ, যা দ্যুলোকের অগ্নি বা যে প্রকার প্রাণময়তা দ্যুলোকের উপর আধিপত্য করছেন তার নাম বিদ্যুৎ (এবং এই অগ্নিকে আহবনীয় অগ্নিও বলা হয়);  এই দ্যু লোক মৃত্যুর উর্দ্ধে (উৎ) বা অমৃতময়। এই আত্মশক্তি বাকের দ্বারাই উৎ ক্ষেত্রের আনন্দের মাত্রা নির্দ্ধারণ হয়, তাই এঁর নাম উমা।(আনন্দের মাত্রার বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদ, মন্ত্র  ৪।৩।৩৩ দ্রষ্টব্য।) সোম মানে 'সহ উমা' বা 'উময়া সহ'।  আত্মা (বা প্রাণ) এবং আত্মশক্তি (বাক্‌) পরস্পরে সম্পৃক্ত, যেমন বাক্য ও অর্থ পরস্পরে সম্পৃক্ত;  ইহাই একত্ব, সামত্ব, সাম, এবং বাক্‌ ও প্রাণের মিথুন আর এই মিথুনের যে আনন্দ সবাই সেই আনন্দের অংশ নিয়ে আনন্দের ভোক্তা হয়েছে।এই বাক্‌ ও প্রাণ এক-আত্ম-স্বরূপেরই প্রকাশ, যাঁকে ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ওম্‌ (ওঁ) এই অক্ষরের দ্বারা নির্দিষ্ট করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে, যে এই বাক্‌ ও প্রাণের মিথুন, ওম্‌ এই অক্ষরে বা অক্ষর আত্মায় যুক্ত। তাই সোম শব্দের একটি নিরুক্তি হলো ' সহ ওম্‌ '। ' সহ ওম্‌ ' এবং ' উময়া সহ ' এই দুইয়ের একই তাৎপর্য। ইহাই সোমের সোমত্ব।এই মিথুনের আনন্দের অংশ নিয়েই সবাই বেঁচে আছে, তাই সবাই সোমপায়ী বা সোমের ভোক্তা।  আমাদের মধ্যে যত অনুভূতির আলোড়ন চলেছে, তা এই সোমই, এই সোমই মৃত্তিকার অন্তরে প্রবাহিত হয়ে ধরিত্রীকে শস্য-শ্যামলা করেছে, এই সোমের দীপ্তিই  অন্তরীক্ষের জ্যোৎস্না, চন্দ্রমা বা প্রাণের কান্তি।(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৫।১৩ দ্রষ্টব্য।)
এই সোমদেব যে দিকে তার নাম উদীচী। উপনিষদে উত্তর না বলে উদীচী বলা হয়েছে। উদীচী শব্দটি  উৎ এবং  অচ্‌, এই শব্দদ্বয় থেকে হয়েছে। অচ্‌ অর্থে  ' বক্র হওয়া বা কোনো দিক্‌ অভিমুখী হওয়া '। উৎ অভিমুখী যে প্রাণ, তিনি উদীচী। মৃ বা মৃত্যুর উর্ধ্বে, তাই ইনি মরুৎ। তাই ঐ দিকে অমৃত। সোম ঐ দিক্‌ থেকেই আসছেন।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৩।৯।২৩ মন্ত্র থেকে শাকল্যের কয়েকটি প্রশ্ন এবং তার উত্তরে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য যা বলেছিলেন  তার একটি অংশ উদ্ধৃত করা হলো।
(শাকল্য।) " স সোমঃ কস্মিন্‌ প্রতিষ্ঠিত ইতি------ সেই সোম কোথায় প্রতিষ্ঠিত?"
(যাজ্ঞবল্ক্য।) " দীক্ষায়াম্‌ ইতি-----দীক্ষাতে।"
(শাকল্য।) " কস্মিন্‌ নু দীক্ষা প্রতিষ্ঠিত ইতি---- কোথায় দীক্ষা প্রতি'ষ্ঠিত?"
(যাজ্ঞবল্ক্য।) " সত্য ইতি--- সত্যে।" 
(শাকল্য।) " কস্মিন্‌ নু সত্যম্‌ প্রতিষ্ঠিত ইতি---- কোথায় সত্য প্রতি'ষ্ঠিত?"
(যাজ্ঞবল্ক্য।) " হৃদয় ইতি--- হৃদয়ে।"  ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ৩।৯।২৩ মন্ত্র থেকে উদ্ধৃত।)

সোম প্রতিষ্ঠিত দীক্ষাতে। দীক্ষা অর্থে দিব্য ঈক্ষা বা দিব্য ঈক্ষণ, দিব্য দর্শন। ঈক্ষণ অর্থে কামনা, আবার ঈক্ষণ অর্থে দর্শন বা প্রকাশ। আত্মস্বরূপের উল্লাসই সোম, আর সেই উল্লাসের মূলে আছে কাম বা ঈক্ষণ, এবং এই কাম বা ঈক্ষণ থেকে দ্যুলোক এবং অন্যান্য লোক সকল প্রকাশ পেয়েছে। তাই সোম প্রতিষ্ঠিত দীক্ষায়, দীক্ষা প্রতিষ্ঠিত সত্যে। যিনি দ্যুলোকের মধ্য দিয়ে সত্য হয়ে ফুটছেন, যাঁর সত্যতায় সবাই সত্য, তিনি সত্য। সত্য প্রতিষ্ঠিত হৃদয়ে।  হৃদয়ের দ্বারাই সত্যকে জানা যায়; যে কোন জ্ঞান বা বোধক্রিয়া হৃদয়ময় বা প্রাণময়। 
এই সোম উত্তরদিকে এবং দ্যু লোক এঁর অনুগত। (ঋক্‌ বেদে, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলে হয়েছে, ' উত্তরা হ বৈ সোমো রাজা' ---সোম রাজা উত্তরে '। ) 
যে দিক্‌ দিয়ে বা প্রাণের যে ধারাতে আমরা কর্ম্ম করি, যা কার্য্য-কারণের নিয়ম মেনে চলে, অথবা কর্ম্ম এবং ফলের যে বিধান, তদনুযায়ী সম্পন্ন হয়, সেই দিক্‌ হলো দক্ষিণ দিক্‌। এখানে আমরা প্রচেষ্টাময়, বিনা প্রচেষ্টায়, বিনা কর্ম্মে অভীষ্ট লব্ধ হয় না।
এই ধারাতে বা এই পথে বা এই দক্ষিণায়নে যেতে যেতে বা এই ভাবে জন্ম মৃত্যুর আবর্ত্তনে কর্ম্ম করতে করতে আমাদের জৈব সংস্কার ক্রমশঃ দৈব সংস্কারে পরিণত হয়। গ্রহণধর্ম্মী আমরা প্রকাশধর্ম্মী হতে থাকি। এখন কর্ম্ম করে তবে ফল প্রাপ্তি হয়, আর এই দেবময়তার আবির্ভাবে, ফল বা মহিমা নিজের অন্তর থেকে প্রকাশ করতে আমরা সক্ষম হই, কামনা বা ইচ্ছার দ্বারা। কর্ম্ম থেকে ফলের যে ক্রম, তা অবলুপ্ত হয়ে যায়, অর্থাৎ কর্ম্ম প্রচেষ্টা বিহীন হয়ে যায়। আমরা আপ্তকাম হই, সকল কামনার আপ্তি হয়; যা কাম্য তা নিজেতেই এই প্রজ্ঞার উদয় হয় এবং তার সার্থকতার প্রাপ্তি হয়।
এই যে পরিবর্ত্তন, কর্ম্ম এবং তদনুযায়ী ফল প্রাপ্তির যে বিধান তাকে অতিক্রম করা, এর নাম দক্ষিণাচার থেকে বামাচারে সংক্রমণ। দক্ষিণের বিপরীত উত্তর বা বাম। যা ছিল সাধ্য বা কর্ম্ম সাপেক্ষ, তা হয়ে যায় সিদ্ধ।
উপরে উক্ত হয়েছে যে দীক্ষা প্রতিষ্ঠিত সত্যে, তাই এই দীক্ষার চরম পরিণতি হলো নৈষ্কর্ম্য বা সন্ন্যাস বা সৎ স্বরূপে ন্যাস। নৈষ্কর্ম্য অর্থে প্রচেষ্টাহীন কর্ম্ম, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। মাত্র সংসার বা কর্ম্ম ত্যাগের দ্বারা সন্ন্যাস বা নৈষ্কর্ম্য লাভ করা যায় না।
এই মার বাম গুল্‌ফের সঞ্চালনে এই বামাচার সক্রিয়। ইনি বামনী এবং এঁর ভৈরবের নাম সংযদ্বাম। ভৈরবের তান্ত্রিক নাম সর্ব্বানন্দ। আমার আগে সোম, উল্লাস, আনন্দ, এবং আনন্দের মাত্রার কথা উল্লেখ করেছি। এই বামনী এবং বামদেবের প্রসঙ্গে উপনিষদের কয়েকটি মন্ত্র অর্থ সহ উল্লেখ করা হলো।
মন্ত্র।
য এষো'ক্ষিণি পুরুষো দৃশ্যত এষ আত্মেতি হোবাচৈতদমৃতমভয়মেতৎ ব্রহ্মেতি তদ্যদ্যপ্যস্মিন্সর্পির্বোদকং বা সিঞ্চতি বর্ত্মনী এব গচ্ছতি। ( ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪।১৫।১।)
অন্বয় অর্থ
যঃ এষঃ অক্ষিণি পুরুষঃ  দৃশ্যত এষঃ  আত্মা ---যে পুরুষকে এই অক্ষিতে দেখা যায়, ইনি আত্মা।
ইতি হ উবাচ---ইহাই (ঋষি) বলিলেন।
এতদ্‌ অমৃতম্‌, অভয়ম্‌, এতদ্‌ ব্রহ্ম ইতি----- ইনি অমৃত, অভয়, ইনি ব্রহ্ম।
তৎ যৎ অপি অস্মিন্‌ সর্পি বা উদকং বা সিঞ্চতি বর্ত্মনী এব গচ্ছতি----তাই যখন এঁতে (এই অক্ষি বা অক্ষিগত পুরুষে) সর্পি (ঘৃত) বা উদক সিঞ্চন করা হয়, তা বর্ত্মনীতেই যায় (অর্থাৎ প্রাণ বা অক্ষিগত পুরুষ থেকে জাত যে অক্ষ গতি তার অনুসরণ করে বা সেই প্রাণরূপ ব্রহ্মের নির্ধারিত অক্ষপথেই তার গতি হয়)।
অর্থ।
যে পুরুষকে এই অক্ষিতে দেখা যায়, ইনি আত্মা। ইহাই (ঋষি) বলিলেন। ইনি অমৃত, অভয়, ইনি ব্রহ্ম।
তাই যখন এঁতে (এই অক্ষি বা অক্ষিগত পুরুষে) সর্পি (ঘৃত; সর্পিল এবং মর্ত্ত সংলগ্ন গতি, সর্পের মতো গতি) বা উদক সিঞ্চন করা হয়, তা বর্ত্মনীতেই যায় (অর্থাৎ প্রাণ বা অক্ষিগত পুরুষ থেকে জাত যে অক্ষ গতি তার অনুসরণ করে বা সেই প্রাণ রূপ ব্রহ্মের নির্ধারিত অক্ষপথেই তার গতি হয়)।
( সর্পি= ঘৃত--যা ঘ্রাণ দায়ক; সর্পি--- যা সর্প গতি থেকে জাত; সুতরাং সর্পরা যেমন পৃথিবী সংলগ্ন হয়ে চলে, সেই রকম সকল পার্থিব কর্ম্ম বা গতি থেকে  যে প্রাণ বা চেতনাকে দেখা যায় তার আসল প্রকৃতি হলো ঘ্রাণ বা গন্ধ। যে প্রাণ পৃথিবীর অন্তর্গত হয়েছেন, সেই প্রাণ পার্থিব বায়ু হয়ে নাসিকা বা ঘ্রাণেন্দ্রিয় মধ্যদিয়ে আমাদের প্রাণবন্ত করছে। পৃথিবী বা ক্ষিতিতত্ত্বের তন্মাত্রা হলো গন্ধ; সর্পদের ঘ্রাণ শক্তি সাধারণতঃ প্রবল হয়। সুতরাং যা কিছু মর্ত্ত্য কর্ম্ম তা এই আত্মাতেই, অক্ষিগত পুরুষেই সর্পি বা ঘৃতের আকারে সিঞ্চিত হচ্ছে বা গৃহীত হচ্ছে এবং উদক (যা ' উৎ +অক্‌ ' অর্থাৎ যে জল/ অপ্‌ বা আপ্তি উর্ধ্বগামী-----উর্ধ্বগামী অপ্‌) যা কিছু কর্ম্ম আমাদের উর্ধ্বগামী বা আত্মমুখী করে তাও এই অক্ষিগত পুরুষে গৃহীত হয়।) ( ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪।১৫।১।)

মন্ত্র।
এতং সংযদ্বাম ইত্যাচক্ষত এতং হি সর্ব্বাণি বামান্যভিসংযন্তি সর্ব্বাণ্যেনং বামান্যভিসংযন্তি য এবং বেদ। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪।১৫।২।)

অন্বয় অর্থ।
এতং সংযদ্বাম ইতি আচক্ষতে-----এনাকে সংযদ্বাম এই ভাবে আচরণ করা হয় (দেখা হয়)
এতং হি সর্ব্বাণি বামানি অভিসংযন্তি --- এনাকেই (এনাতেই) সকল বাম অভিগমন করে (আশ্রয় করে)
সর্ব্বাণি এনং বামানি অভিসংযন্তি য এবং বেদ----- সকল বাম এঁকেই (এঁতেই) অভিগমন করে (আশ্রয় করে) যিনি এই রকম জানেন।
অর্থ।
এনাকে সংযদ্বাম, এই ভাবে আচরণ করা হয় (দেখা হয়)।এঁতেই সকল বাম অভিগমন করে (আশ্রয় করে)।
যিনি এই রকম জানেন সকল বাম এঁতেই (সেই প্রকার বিজ্ঞাতাকেও) অভিগমন করে (আশ্রয় করে)। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪।১৫।২।)

মন্ত্র।
এষ উ এব বামনীরেষ হি সর্ব্বাণি বামানি নয়তি সর্ব্বাণি বামানি নয়তি য এবং বেদ। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪।১৫।৩।)

অন্বয় অর্থ।
এষঃ উ এব বামনীঃ----ইনিই (এই সংযদ্বাম বা অক্ষিগত পুরুষই ) বামনী
এষঃ হি সর্ব্বানি বামানি নয়তি---- ইনিই সকল বামকে নিয়ে আসেন
সর্ব্বাণি বামানি নয়তি য এবং বেদ----- ( য এবং বেদ ) যিনি এই রকম জানেন, ( সর্ব্বাণি বামানি নয়তি ) সকল বামকে ( তাঁর কাছে ) নিয়ে আসেন

অর্থ।
ইনিই ( এই সংযদ্বাম বা অক্ষিগত পুরুষই ) বামনী।ইনিই সকল বামকে নিয়ে আসেন। যিনি এই রকম জানেন,  সকল বামকে (তাঁর কাছে) নিয়ে আসেন।(ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪।১৫।৩।)
ইনি স্বয়ংশক্তি বা নিজেই নিজের শক্তি, তাই এই সংযদ্বাম বা অক্ষিগত পুরুষই বামনী বা বামা শক্তি।যা কিছু বাম, যা কিছু দিব্য বা অমর্ত্ত, তা এই বিজ্ঞাতার অনুগত হয় এই বামনীর দ্বারা।

( প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে ------
১।বামদেবরূপী শিবকে ঘৃত দ্বারা স্নান করানো হয়; 
২। কীর্ত্তি, লক্ষ্মী,ধৃতি,মেধা,পুষ্টি,শ্রদ্ধা,ক্ষমা,মতি,বুদ্ধি,লজ্জা,বপু,শান্তি,তুষ্টি,কান্তি এঁদেরকে মাতৃকা, ধর্ম্মপালিকা এবং সুসংযতা, অর্থাৎ সংযদ্বামের শক্তি বলে দুর্গার স্নানের মন্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রটি হলো
 " ওঁ কীর্ত্তিঃ লক্ষ্মীঃ ধৃতিঃ মেধাঃ পুষ্টিঃ,শ্রদ্ধা ক্ষমা মতিঃ।
বুদ্ধিঃ লজ্জা বপুঃ শান্তিঃ তুষ্টিঃ কান্তিশ্চ মাতরঃ।
এতাস্তাং অভিষিঞ্চতু ধর্ম্মপালাঃ সুসংযতাঃ।।")

মন্ত্র।
এষ উ এব ভামনীরেষ হি সর্ব্বেষু লোকেষু ভাতি সর্ব্বেষু লোকেষু ভাতি য এবং বেদ। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৪।১৫।৪।)

অন্বয় অর্থ।
এষঃ উ এব ভামনীঃ----ইনিই (এই সংযদ্বাম বা অক্ষিগত পুরুষই ) ভামনী (যা কিছু ভাম অর্থাৎ যা কিছু দীপ্ত ( ভা ) এবং মনোময় (ম), তাদেরকে যিনি নিয়ে আসেন বা যে শক্তির দ্বারা ভাস্বর মনোময় সত্তারা নীত বা উপনীত হন)
এষঃ হি সর্ব্বেষু লোকেষু ভাতি ----ইনিই সর্ব্ব লোকেতে দীপ্ত (ভা) হচ্ছেন। 

অর্থ।
ইনিই (এই সংযদ্বাম বা অক্ষিগত পুরুষই ) ভামনী (যা কিছু ভাম অর্থাৎ যা কিছু দীপ্ত ( ভা ) এবং মনোময় (ম), তাদেরকে যিনি নিয়ে আসেন (বা যে শক্তির দ্বারা ভাস্বর মনোময় সত্তারা নীত বা উপনীত হন)।  ইনিই সর্ব্ব লোকেতে দীপ্ত ( ভা ) হচ্ছেন।
ভ্রুদ্বয়ের সন্ধি স্থলে দৈব চক্ষু, তৃতীয় চক্ষু বা মনের অবস্থান। এই ব্রহ্ম, যিনি অক্ষিগত পুরুষ, যিনি বামন, বামনী এবং ভামনী যাঁর শক্তি, তাঁকে উপনিষদ্‌  ' ভা রূপঃ সত্য সঙ্কল্প মনোময় ' বলে অভিহিত করেছেন। মনের ধর্ম্মই হলো সঙ্কল্পময়তা। ছান্দোগ্য উপনিষদের মন্ত্রটি উদ্ধৃত করা হলো।
মন্ত্র।
মনোময় প্রাণশরীরো ভারূপঃ সত্যসঙ্কল্প আকাশাত্মা সর্ব্বকর্ম্মা সর্ব্বকামঃ সর্ব্বগন্ধঃ সর্ব্বরসঃ সর্ব্বমিদমভ্যাত্তো'বাক্যনাদরঃ। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ৩।১৪।২।)

অন্বয় অর্থ।
মনোময়ঃ---মনোময়  
প্রাণশরীরঃ----প্রাণ-শরীর 
ভারূপঃ----ভারূপ (ভাস্বর) 
সত্যসঙ্কল্পঃ -----সত্য সঙ্কল্পময় (যাঁর সঙ্কল্প সকল সত্য হয়)
আকাশাত্মাঃ----আকাশ (আ---আতত বা সর্ব্বব্যাপী + কাশ্‌ /কাশ (উজ্বল, প্রকাশবান্‌) আত্মা
সর্ব্বকর্ম্মা----সকল কর্ম্মের কর্ত্তা এবং সকল কর্ম্ম
সর্ব্বকামঃ ------সকল কামের উৎস এবং সকল কামনা
সর্ব্বগন্ধঃ----- সকল গন্ধের উৎস এবং সকল গন্ধ (সকল স্থিতিকে যিনি প্রাণ বা গন্ধের দ্বারা পুষ্ট করেন)
সর্ব্বরসঃ ----সকল রসের উৎস এবং সকল রস ( সকল স্থিতির অন্তরে যিনি রস বা সত্ত্বার যে আধারশক্তি )
সর্ব্বম্‌ ইদম্‌ অভ্যাত্তঃ (অভি আত্তঃ----পরিব্যাপ্ত) -----সর্ব্ব 'ইদং' অর্থাৎ ইদং বা ইহা বলতে যা কিছু, সেই সকলকে পরিব্যাপ্ত করে রয়েছেন 
অবাকী ---- বাক্‌ বা শব্দের দ্বারা যাঁকে সম্বোধনকরা যায় না
অনাদরঃ----অনাদর (অন্‌+ আ + দৃ----দৃশ্যের বাহিরে, অগোচর)
অর্থ।
(এই আত্মা, ব্রহ্ম) মনোময়, প্রাণ-শরীর (প্রাণ যাঁর রূপ), ভারূপ (ভাস্বর), সত্য সঙ্কল্পময় (যাঁর সঙ্কল্প সকল সত্য হয়), আকাশ (আ---আতত বা সর্ব্বব্যাপী + কাশ্‌ /কাশ (উজ্বল, প্রকাশবান্‌) আত্মা, সকল কর্ম্মের কর্ত্তা এবং সকল কর্ম্ম, সকল কামের উৎস এবং সকল কামনা, সকল গন্ধের উৎস এবং সকল গন্ধ (সকল স্থিতিকে যিনি প্রাণ বা গন্ধের দ্বারা পুষ্ট করেন), সকল রসের উৎস এবং সকল রস ( সকল স্থিতি বা সত্তার অন্তরে যিনি রস বা আধারশক্তি), সর্ব্ব 'ইদং' অর্থাৎ ইদং বা ইহা বলতে যা কিছু, সেই সকলকে পরিব্যাপ্ত করে রয়েছেন, বাক্‌ বা শব্দের দ্বারা যাঁকে সম্বোধন করা যায় না, অনাদর বা সকলের অগোচর।(ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ৩।১৪।২।)

২৬।সত্যভামা।
পরম আকর্ষণময় পুরুষ যিনি কৃষ্ণ, যিনি আমাদের আত্মা, যিনি অক্ষিগত পুরুষ, যাঁর শক্তি হলো বামনী এবং ভামনী,  তিনিই বামন অবতার হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং অবতীর্ণ হন। তাঁরই ভারূপ, সত্যসংকল্পময় শক্তি, যিনি ভামনী, সেই ভামনীই ইতিহাস এবং পুরাণপ্রসিদ্ধ শ্রী কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা রূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।

২৭।বামন মন্ত্র।
এই বামদেব বা বামনের একটি উপনিষদোক্ত মন্ত্র নীচে উদ্ধৃত করা হলো।
মন্ত্র।
ঊর্ধ্ব প্রাণমুন্নয়ত্যপানং প্রত্যগস্যতি।
মধ্যে বামনমাসীনং বিশ্বে দেবা উপাসতে।।

অন্বয় অর্থ।
উর্ধ্ব প্রাণম্‌ উন্নয়তি ----উর্ধ্ব দিকে প্রাণকে নিয়ে চলেছেন
অপানং প্রত্যক্‌ অস্যতি----অপান প্রত্যক্‌ (অধঃ দিক্‌, যে দিকে আধারশক্তি রচিত হচ্ছে; উর্ধ্বের প্রত্যক্‌ অধঃ ) অস্যতি ( অস্যতি শব্দটি অস্‌ ধাতু থেকে হয়েছে, যার অর্থ ' থাকা, বা অস্তিত্বময় হওয়া; অস্যতি ----অস্তিত্ব প্রদায়িনী যে আধারশক্তি তাই হওয়া)
মধ্যে বামনম্‌ আসীনং---মধ্যে বামন আসীন
বিশ্বে দেবা উপাসতে----বিশ্বের দেবতারা উপাসনা করছেন।

অর্থ।
(এই আত্মা) উর্ধ্ব দিকে প্রাণকে নিয়ে চলেছেন, অপানকে প্রত্যক্‌ (অধঃ) দিকে আধারশক্তি রূপে চালিত করছেন; মধ্যে ইনি বামন রূপে আসীন এবং বিশ্বের দেবতারা এঁর উপাসনারত। (কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র২।২।৩।)

২৮।সব্য, সব, সবন এবং সাবিত্রী। 
সব্য অর্থে বাম হাত। সব অর্থে যেখানে বা যাতে সোম অপ্রকাশ, তাকে পেষণ করে করে সোমকে নিয়ে আসা। যাদেরকে পেষণ করে সোমকে নিষ্কাশিত করা হয়, তাদের নাম ওষধি। প্রাণের ঊষ্মাকে যারা ধারণ করেছে তাদের নাম ওষধি।যা কিছু আমরা জানি বা অনুভব করি, গাছপালা, ফুলফল, গিরি-কানন, স্ত্রী-সন্তান, যা কিছু আমাদের প্রজ্ঞা বা বোধ ক্ষেত্রে স্থিত, সেই সবই এই মহাচৈতন্যে ওষধি। ঐ ওষধি সকল থেকে, সোমলতা থেকে, যে প্রাণরূপ ঊষ্মা  সুত হচ্ছে, নিসৃত হচ্ছে, তার নাম সোম। সেই সোম, আপ্তি হয়ে, আপ হয়ে, জল বা রস হয়ে আমাদের মাতোয়ারা বা আত্মহারা করছে। 
তাই ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, এই ভূত বা বস্তু সকলের রস হলো পৃথিবী (চেতনার যে পৃথক্‌ স্থিতিদায়িনী স্বরূপ), এই পৃথিবীর রস হলো আপ, অপ্‌ (যা চেতনার আপ্তিময়তা বা জল), অপের রস হলো ওষধি যার থেকে প্রাণরূপ ঊষ্মা সোম হয়ে নিসৃত হচ্ছে, আর এই ওষধির রস হলো পুরুষ, যে কিনা আত্মখণ্ড। এই আয়তন বা পুরে যে পরমাত্মস্বরূপ খণ্ডিত ( ষ ) হয়ে, খণ্ড আত্মা হয়ে রয়েছেন বা অনুপ্রবিষ্ট হয়েছেন, তিনি পুরুষ। এই সোম ঐ সোমেশ্বরের জন্য নিসৃত হচ্ছে। '' ইন্দো ইন্দ্রায় পরিস্রব " ----হে ইন্দু (সোম), তুমি ইন্দ্রের (ইদং দ্রষ্টা বা অক্ষিগত পুরুষের) জন্য স্রাবিত হও! (যজুর্বেদ থেকে উদ্ধৃত।)
এই যে সব্য, বা বাম হস্ত থেকে বা চিন্ময়ীর বামাচার থেকে যে সোম প্রবাহিত হচ্ছে, তাই আমাদের জীবনপ্রবাহ, আর সেই জীবনপ্রবাহকে তিনটি সবনে বিভক্ত করে দেখা হয়----প্রাতঃ সবন, মধ্যাহ্ন সবন এবং তৃতীয় সবন (সায়ং সবন)। এই সবনের যিনি নিয়ন্ত্রিণী, তিনি সাবিত্রী। তিন সবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আমাদের মধ্যে যে সোম আসছে, তা ঐ দক্ষিণাগ্নির বা দক্ষিণদিকে যে পুরুষ সংযমন করছেন, সেই যমের দ্বারা সংযমিত হয়ে। চন্দ্রমা, নক্ষত্র, দিক্‌ সমূহ আর অপ বা জল হলো দক্ষিণাগ্নির তনু। যতক্ষণ আমরা দক্ষিণামুখী, কর্ম্মাধীন, ততক্ষণ, কর্ম অনুসারেই সোম আমাদের জন্য আংশিক হয়ে যাচ্ছে, পুরো যে ভোগ, যা উৎ বা দেবক্ষেত্রের ভোগ, যা মৃত্যুর দ্বারা মলিন না, তা এখনো হচ্ছে না, ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে, বা ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে চন্দ্রমা, নক্ষত্র, দিক্‌ সমূহ আর আপ/অপ্‌ বা জল রূপ যে দক্ষিণাগ্নির তনু সকল বা বিস্তার, তাঁদের দ্বারা। ঐ দেবক্ষত্রের যে ভোগ, তাকে প্রার্থনা করা হয়েছে এই সাবিত্রী মন্ত্রে :
তৎ সবিতুঃ বৃণীমহে
বয়ম্‌ দেবস্য ভোজনম্‌
শ্রেষ্ঠম্‌ সর্ব্বধাতমম্‌
তুরং ভগস্য ধীমহি (ঋক্‌ বেদ ৫।৮২।১।)
অন্বয় অর্থ
তৎ সবিতুঃ বৃণীমহে---তা সবিতার থেকে বরণ করতে চাই
বয়ম্‌--আমরা
দেবস্য ভোজনম্----দেবগণের ভোগ্য
শ্রেষ্ঠম্‌ সর্ব্বধাতমম্‌---(যা) শ্রেষ্ঠ এবং সকলকিছু কে ধারণ করে (সর্ব্ব ধৃতিশক্তি সম্পন্ন)
তুরং----শীঘ্র
ভগস্য---ভগ বা সমৃদ্ধির থেকে বা যিনি ভগ বা সমৃদ্ধি দান করেন তাঁর থেকে
ধীমহি --ধ্যান করছি।

অর্থ।
আমরা সবিতার থেকে তা বরণ করতে চাই যা দেবগণের ভোগ্য, (যা) শ্রেষ্ঠ এবং সকলকিছু কে ধারণ করে ( সর্ব্ব ধৃতিশক্তি সম্পন্ন); যিনি ভগ বা সমৃদ্ধি দান করেন তাঁর থেকে তা শীঘ্র (আসুক); আমার এরই ধ্যান করছি।(ঋক্‌ বেদ ৫।৮২।১।)

২৯।বিভাস শক্তি পীঠ।

সোম রাজার পুরীর নাম বিভা। সোমেশ্বর ক্ষেত্রের নাম প্রভাস। বর্গভীমাক্ষেত্রের একটি নাম বিভাস। এই দেবী স্বয়ংজ্যোতি। এই অক্ষিগত পুরুষের অক্ষি থেকে আত্মজ্যোতিই বিকীর্ণ হচ্ছে। সোম এই আত্মজ্যোতিতেই উজ্জ্বল, বিভাস এই আত্মজ্যোতিতেই উজ্জ্বল। এই প্রভাদেবীর একটি মন্ত্র উপনিষদ্‌ থেকে উদ্ধৃত করা হলো।
" ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতো'য়মগনিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্ব্ব তস্য ভাসা সর্ব্বমিদং বিভাতি।।" (কঠোপনিষদ্‌ ২।২।১৫।)

সেখানে সূর্য ভা বা আলোক দেয় না, চন্দ্র তারকারাও নয়, এই বিদ্যুতরাও ভা বা আলোক দেয় না, আর এই অগ্নিই বা কি ভাবে দেবে!
তাঁর ভা বা আলো সকলের ভা বা আলো হয়েছে, তাঁর ভা বা আলোতেই এই সব প্রতিভাত। (কঠোপনিষদ্‌ ২।২।১৫।)
(প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মুম্বাই শহরে প্রভাদেবীর একটি মন্দির আছে।)

৩০।কুন্তী পুত্র ভীম।
ভীম, যিনি মধ্যম পাণ্ডব বলে পরিচিত, তিনি বায়ু এবং কুন্তীর পুত্র। ভীমের অনেক কর্ম্ম ছিল ভীষণতার দ্বারা মণ্ডিত। এই মধ্যম পাণ্ডব, যিনি সকল কিছুর মাধ্যম, সেই বায়ুর পুত্র এবং ভীম বা আকাশের ন্যায় ভীষণ এবং বলশালী ছিলেন।এঁর অস্ত্র ছিল গদা। গদ্ ধাতু থেকে গদা শব্দটি হয়েছে। ' গ ' অক্ষরটি গতিবাচক এবং ' দ' অক্ষরটি 'বাক্‌',     ' বদ ' বা ' শব্দ ' বাচক। গদ বা গদা অর্থে বাক্য প্রবাহ  বোঝায়, যাকে গদ্য বলা হয়।আর, সেই বাক্য প্রবাহকে যদি একটি বা একাধিক ছাঁদে বা ছন্দে চিহ্নিত করা যায় বা বাঁধা যায়, তবে তা হয় পদ বা পদ্য। ( কবি গুরুর কথায় "অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে"। ) আকাশ থেকে এই মহাশক্তি যিনি শব্দাত্মিকা, সেই শক্তিই এই গদায় নিহিত। এই গদার দ্বারা যা স্থূল বা জড় তাকে চূর্ণ করে দেওয়া যায় বা তার শব্দাত্মক বা আকাশ রূপকে প্রকাশ করা যায়। এই গদাঘাতেই, ভীম দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করেছিলেন।  উরু অর্থে কামগতি। যে আকাশে সর্ব্বকাম, সকল কিছু নিহিত, তার শক্তি প্রয়োগে দুর্যয় কামগতি যা আমাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, যা অমৃতের প্রতিরোধী, সেই  দুর্যয় কামগতি সম্পন্ন পুরুষকে ভীম নিরস্ত করেছিলেন। 
ভীমকে পবন পুত্র হনুমানের অনুজ বলা হয়। হনুমানেরও অস্ত্র ছিল গদা। আমাদের যা অধরা হনু, অর্থাৎ, যা নীচের চোয়াল, তারই নীচে আমাদের গলা। মাথা থেকে গলা অব্দি যে আকৃতি তা এই গদারই মতো।আবার গলা হলো শরীরের সেই অংশ, যেখানে অন্তরের আকাশ থেকে ভাব বা শব্দরাজি এসে শব্দিত হচ্ছে বা বহিরাকাশে প্রকাশ পাচ্ছে। এই গলার যে অংশ বা যন্ত্র, যার দ্বারা কম্পন এবং অদনুযায়ী আওয়াজ বা শব্দ হয়, তার নাম ' স্বরযন্ত্র ' বা ল্যারিংক্‌স (Larynx). এই স্বরযন্ত্রের আকৃতিও অনেকটা গদার মতো। ইন্টারনেট (Internet) থেকে সংগৃহীত স্বরযন্ত্র বা Larynx এর একটি ছবি নীচে দেওয়া হলো।

৩১।সত্য।
মার এই আলখ্যের সমাপ্তি করছি সত্যের উদ্দেশ্যে উক্ত উপনিষদের একটি মন্ত্র উদ্ধৃত করে। 
মন্ত্র।
স যথোর্ণাভিস্তন্তুনোচ্চরেৎ যথাগ্নেঃ ক্ষুদ্রা বিস্ফুলিঙ্গা ব্যুচ্চরন্তি এবমেবাস্মাদাত্মনঃ সর্ব্বে প্রাণাঃ সর্ব্বে লোকাঃ সর্ব্বে দেবাঃ সর্ব্বানি ভূতানি ব্যুচ্চরন্তি  তস্যোপনিষৎ সত্যস্য সত্যমিতি প্রাণা বৈ সত্যম্‌ তেষামেষ সত্যম্‌। ( বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ২।১।২০।)

অন্বয় অর্থ
সঃ যথা উর্ণনাভিঃ তন্তুনা উচ্চরেৎ ----- সে (এই আত্মা), যেমন উর্ণনাভি (মাকড়শা) তন্তুর দ্বারা উৎ-চরণ (নিজের অবস্থান থেকে উত্থিত হয়ে বিচরণ করে)
যথা অগ্নেঃ ক্ষুদ্রা বিস্ফুলিঙ্গাঃ বি-উচ্চরন্তি ----যেমন অগ্নির থেকে ক্ষুদ্র বিস্ফুলিঙ্গ সকল বিভিন্ন দিকে উৎ-চরণ ( ঊর্ধে বিচরণ করে)
এবম এব অস্মাৎ আত্মনঃ ------এই রকমই এই আত্মা থেকে
সর্ব্বে প্রাণাঃ সর্ব্বে লোকাঃ সর্ব্বে দেবাঃ সর্ব্বানি ভূতানি বি-উচ্চরন্তি---- প্রাণ সমূহ, সর্ব্ব লোক, সকল দেবতারা, সর্ব্ব ভূত বিভিন্ন দিকে উত্থিত হয় বিচরণ করে
তস্য উপনিষৎ সত্যস্য সত্যম্‌ ইতি----তার উপনিষৎ ' সত্যের সত্য ' 
প্রাণাঃ বৈ সত্যম্‌ তেষাম্‌ এষঃ সত্যম্‌-----প্রাণ সকল সত্য, তাদের (এই প্রাণ সকলের) এষঃ(ইনি; এই আত্মা) সত্য।
অর্থ
সে (এই আত্মা), যেমন উর্ণনাভি (মাকড়শা) তন্তুর দ্বারা উৎ-চরণ ( নিজের অবস্থান থেকে উত্থিত হয়ে বিচরণ করে )
যেমন অগ্নির থেকে ক্ষুদ্র বিস্ফুলিঙ্গ সকল বিভিন্ন দিকে উৎ-চরণ ( ঊর্ধে বিচরণ করে), এই রকমই এই আত্মা থেকে
 প্রাণ সমূহ, সর্ব্ব লোক, সকল দেবতারা, সর্ব্ব ভূত বিভিন্ন দিকে উত্থিত হয়ে বিচরণ করে। তার উপনিষৎ ' সত্যের সত্য ' 
প্রাণ সকল সত্য, তাদের (এই প্রাণ সকলের) ইনি (এই আত্মা) সত্য।
' সত্যের সত্য ', ইহাই উপনিষৎ, অর্থাৎ এঁতে, এই আত্মাতে উপনীত হলে যে বেদন, যে অনুভূতি হয়, তা হলো যা কিছু সত্য তাদের সত্যতা এই আত্মায়, এঁর সত্যতায় সবাই সত্য।

৩২। মন্তব্য
এই মলিন ভারতবর্ষ আবার এই ভামিনীর ভা-তে যেন ভাস্বর হয়। আমাদের বহু তীর্থ লুপ্ত হয়ে গেছে। লুপ্ত মানে, শুধু যে তার স্থাপত্য হারিয়ে গেছে তা নয়, যে প্রজ্ঞা, যে আত্মবেদনকে রূপায়িত করার জন্য সেই তীর্থের প্রতিষ্ঠা সত্য-দ্রষ্টারা করেছিলেন, সেই জ্ঞান বা বেদ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। ঋষিদের আশীর্ব্বাদে আবার যেন সেই বেদোদ্ধার হয়।
" উজ্জ্বয়তাং`পরশু জ্যোতিষা সহ ভূয়া।
ঋতস্য সুদুঘা পুরাণবৎ।।" -----পর বা দ্বিতীয়তার জ্ঞানকে দূর করে, বিপুল (আত্ম)জ্যোতিতে উজ্বল করো, হে ঋতের (সত্যের) সু-দোগ্ধৃ ( সু-দোহনকারিণী ) পুরাকালে যেমন করেছিলে !




































 



 





Comments

Popular posts from this blog

ঈশোপনিষদ্‌ (ঈশ উপনিষদ্‌) --মূল মন্ত্র, অর্থ, নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা সহ। (Ishopanishad --Isha Upanishad in Bengali language with original texts, annotaions, meanings, etymolgies and explanation.)

শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা । আচার্য শ্রী বিজয়কৃষ্ণ কৃত শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা। মূর্ত্তি পূজা রহস্য এবং বেদ। ( ১৯৪১ সাল/ সন ১৩৪৮ এর শারদীয়া দুর্গাপূজা, শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরাণী সঙ্কলিত।) (Durga Puja of 1941 in Bengali language--Performed by Rishi Bijoykrishna Chattopadhaya and recorded by Sarala Devi Chowdhurani.)

বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, চতুর্থ অধ্যায়, তৃতীয় ব্রাহ্মণ, মূল অংশ এবং বঙ্গানুবাদ । জাগ্রত, স্বপ্ন এবং নিদ্রার বিজ্ঞান।(Bengali translation of Fourth chapter, Third part of Brihadaranyaka Upanishad with original texts and meanings---science of the state of awakeness, dream and sleep.)