দোল পূর্ণিমা।(মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের উপদেশাবলী থেকে সংগৃহীত।) (Dol Purnima- Festival of colours--as told by the Sage BijoyKrishna Chattopadyaya, in Bengali language).
দোল পূর্ণিমা।
এটা হল ব্রহ্মর্ষির দেশ। ঋষিরা এদেশকে একেবারে ব্রহ্মবাদে সমাপ্লুত করে গেছেন। এদেশে কতনা আনন্দ উৎসব ও পূজাপার্ব্বণ ব্যবস্থিত! সেগুলিকে ব্রহ্মজ্ঞের চোখ নিয়ে দেখলে ধরা যায় যে এই সব ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়ে গেছে একটি না একটি পরমতত্ত্বের আভাস। ছোটখাট কর্ম্মানুষ্ঠান বা প্রচলিত কাহিনী বা উপাখ্যানগুলি ব্রহ্মতত্ত্বের কোন কোন জটিল সূক্ষ্মতত্ত্বের প্রতীকস্বরূপ গৃহীত হতে পারে, যেমন ধর দোলে রং খেলা বা জবালার গোত্রহীন পুত্র সত্যকামের উপাখ্যান।
রং খেলার মানে কি? তোমাদের যত রং, তোমাদের মন প্রাণ যাতে পড়ে আছে সব আত্মদেবতায় সমর্পণ কর। তুমি স্ত্রী-পুত্র রসে, পিতামাতা রসে, বিষয় সম্পদ রসে মত্ত, সে সব ওঁকে দাও। বল--- ত্বমেব পিতা চ মাতা ত্বমেব, ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব, ত্বমেব বিদ্যা চ দ্রবিণং ত্বমেব, ত্বমেব সর্ব্বং মম দেবদেব। যে যা বলে বলুক, দ্বিধা কর না। কে জানে উৎকৃষ্ট, কে জানে নিকৃষ্ট, সব এই আত্মদেবতায় সমর্পণ কর। যার চেয়ে আর ক্ষুদ্র কিছু হতে পারে না, তাও তাঁকে উৎসর্গ কর। যাঁকে একদিকে বলছ ভগবতী, অপরদিকে দেখলে সব রসই সেই। শত্রু মিত্র হক, সুখ দুঃখ হক, সব তাঁতেই। কি সর্ব্বগ্রাসী ওঁর শক্তি। যেমন করে তাঁকে বরণ করনা, কোনটাতেই যেন তাঁর কুণ্ঠা আসছে না। তাঁর ভাবটা যেন--যা খুশী কর আমাকে নিয়ে। কিন্তু যতক্ষণ না পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান হয় ততক্ষণ কি করতে পারা যায় ? একটা awefulness এসে যায়,----নিজের জীবনের পঙ্কিলতা যেন পিছনে জড়িয়ে ধরে।
ধন্য আদর্শ ঋষিদের। ধন্য তাঁদের চোখ। আমরা তাঁদের অনুধাবন করতে ভুলে যাচ্ছি। কেন এই ফল্গু উৎসবটা তাঁরা করে গেছেন, তার খেঁই হারিয়ে ফেলছি। যদি এই জ্ঞানটি বুকে সমুজ্বল থাকে যে আমি পিতা বলি, ভ্রাতা বলি, বন্ধু বলি, এ আর কাকেও বলছি না, তাঁকেই বলছি, তাহলে কি আর মানুষের চেতনার গতি কোথাও অব্যাহত না থাকে। যতই এইরকম ব্যবহার করতে পারবে, ততই অভয় আসবে। তখন এইরূপ যা কিছু ব্যবহার সম্ভব হবে। বলে দিয়েছি, ওঁর সঙ্গে যদি সত্য হার্দ্য ব্যবহার করতে চাও, ওঁর দিকে খালি চেয়ে থাক, এই আলোর দিকে চেয়ে থাক। শুধু এইটুকু নয়। তোমার রং তুমি ওঁর গায়ে দিতে থাক, তখন ওঁর যা কিছু ধর্ম্ম---যেমন নিয়ন্তৃত্ব, স্বাধীনতা, প্রভৃতি সব রং তোমার গায়ে ঢেলে দেবেন।একটা একটা ফল্গু পরিয়ে দেখ না ? মা বল , ভাই বল, শত্রু বল, মিত্র বল, আর দেখ কেমন উনি সাজেন, তখন সত্যি ধন্য হয়ে যাবে, বুঝবে কাকে নিয়ে নরাচরা করছ। এ খালি ভাবের কথা নয়। হৃদয় বা প্রাণের যে বাহ্যাভিমুখী গতি তার নাম ইন্দ্রিয় বা ইদংদ্রষ্টা। ওদের কায হল একদিকে বাহির থেকে জিনিষ ধরে আনা ও ভিতরে দেওয়া, আবার ভিতর থেকে বাহিরে চালিয়ে দেওয়া। এই উভয়মুখী গতির নাম দোলা। এ দোলায় গোবিন্দকে দর্শন কর---অর্থাৎ যিনি তোমার ইন্দ্রিয়গুলো চরান, তাঁকে দর্শন কর। দোলায়াম্ গোবিন্দং দৃষ্ট্বা মালঞ্চে মধুসূদনম্। রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।। দোলা বা গোবিন্দ বলেছি, এখন মালঞ্চ মানে শুন। মালঞ্চ অর্থে শোভাময় এবং শ্রীময় এই বিপুল বিশ্ব। মধুসূদন অর্থে যিনি মধুকৈটভ রূপ দুটা জীবভাবকে বিনাশ করেন। এই ভাব দুটা হল, (১) অন্বেষণ বা অণুএষণা, অর্থাৎ বাহির থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকে পাবার জন্য এষণা করছে, বা ইচ্ছার গতি চলেছে। এইটার নাম মধু। (২) সংগ্রহ বা সঞ্চয় করছে। এষণা করছে, এবং যা পাচ্ছে তাকে কামড়ে ধরেছে ----একে কীট বলে। যা পায় তাই ভিতরে কৌটায় ভরে রেখে দেয়, এই হল কৈটভ। এই শোভাময় স্থূল বিশ্বে ----এই মালঞ্চে একটা কিছু দেখতে পেয়েছ কি তার দিকে চোখ বারাচ্ছ। এই মধুকে বিনাশ করতে হলে মালঞ্চে মধুসূদনকে দেখতে হবে।রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা--রথে বামনকে দেখলে। বামন মানে বামদেব সিদ্ধিদাতা। ইনি তোমার হৃদয়রথে বা অন্তরাকাশে অবস্থান করে তোমার রথ বা হৃদয়ের গতি পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন কোথায় রথ নিয়ে যাব বল--- আমি তোমার হৃদয়রথের সংস্কারাকাশে অবস্থান করছি। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনে যেমন গোবিন্দ অর্জ্জুনের রথে বসে অশ্ববল্গা ধারণ করে রথ পরিচালনা করেছিলেন, তেমন আমি এখানে তোমার হৃদয়রথে অর্থাৎ সংস্কারাত্মক আকাশে থেকে তোমায় সিদ্ধিসকল ঢেলে দিই। এই হল বামনকে রথে দেখা।
তা হলে প্রথমে দোলায় গোবিন্দকে দেখতে হবে। সেখানে তিনি গোবিন্দরূপে তোমার জীবভাবীয় উভয়মুখী প্রাণাত্মক গতি পরিচালনা করছেন বা গোসকল চরাচ্ছেন। আবার তোমারই মালঞ্চে বা তোমার স্থূলাত্মক দেহবিশ্বে তিনিই মধুসূদনরূপে তোমার জীবভাব বিনাশ করছেন। আবার তোমার সংস্কারময় গ্রন্থি পাকিয়ে ধরে বামনস্বরূপে তোমার হৃদয়রথ পরিচালনা করছেন--কি অদ্ভুত !
বামন হলেন নিজবোধ স্বরূপতা, ইনি নিজেই হাত, নিজেই চোখ। তোমরা বলে থাক নিজের হাত, নিজের পা। একবার শুধু বল যে নিজেই হাত, পা, চোখ, কান। তাহলেই ব্রহ্মগ্রন্থি ফেটে যাবে। অয়মাত্মা সর্ব্বকর্ম্মা সর্ব্বকামঃ সর্ব্বশব্দময়ঃ সর্ব্বস্পর্শময়ঃ সর্ব্বরসময়ঃ ভারূপঃ সত্যসঙ্কল্পঃ। নিজে সর্ব্বধর্ম্ম সম্পন্ন---নিজেই সর্ব্বরূপময়, সর্ব্বরসময় ইত্যাদি। সব রূপ আছে এখানে। কি রূপ দেখতে চাও ? যা কখন দেখনি, সেই মোহিনীরূপও এখানে আছে। আমার ছেলেটার কোন গুণই নাই----কালো, রোগা, পেট জোড়া পিলে, তবুও সে তোমার চোখে কত সুন্দর---কেননা সে তোমার ছেলে।এইরূপে সর্ব্বরূপে সর্ব্বরসে সমন্বিতা মা। এমন যে মা এতে নিজে গলে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি ! এই মাকে বরণ করায় কি উল্লাস---কি আনন্দ ! শুধু রূপরসই যে আছে তা নয়, এতে সর্ব্বশক্তি, অণিমা, লঘিমা, ঈশিত্ব, আপ্তকামত্ব অবধি আছে। এই মানুষটার পক্ষে এত সব লাভ সম্ভব ! খালি হিসাবটাই একবার দেখ না !
বাহির থেকে দেখতে কোথায় ভগবান আর কোথায় বা আমি ! উনি কী মহান্ আর আমি কত নগন্য।এর সঙ্গে আমার যে পরিচয় আছে এই সাড়াটি পর্যন্ত নাই। আমি যে বিশ্বনাথের সাথে related এ ক্ষুদ্র জীবনে এর response মোটেই নাই। ওঁর সঙ্গে সম্বন্ধ পাতাতে অন্তর সাড়া পায় না। কিন্তু এখন কি দেখছি ? এই চেতন দেবতার সকল সিদ্ধি, সকল ঐশ্বর্য্যে এমন কি ঈশিত্বে পর্যন্ত আমার access রয়েছে। এঁকে চেন। সত্যই উনি যা, সেই চোখে একবার ওঁকে দেখ ত। একবার বল দেখি----- হে আমার চেতন দেবতা তুমি আলোস্বরূপ, সত্যই তুমি আমার জগৎ। যাকে ভাই বলি, ভগ্নী বলি, স্ত্রী বলি, পুত্র বলি, এ সব সত্যি তুমি। আজ আমি যে শক্তিত্ব, ঈশিত্ব পর্যন্ত বলি, এসবও সত্যই তুমি। এমনকি আমি যে আমার নিজত্ব নিজত্ব বলি, সেও তুমি। এঁকে ডিঙ্গিয়ে supersede করে কোথায় পদক্ষেপ করব ?
তিনি বলেন ---তুমি এমন কুণ্ঠাময় জীব কেন ? তুমি ভাত খেতে যাবে, যাও না ভয় কি ? তুমি কবে ভাত খেতে বসেছ আর আমি তোমাকে বারণ করেছি ? আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে খাচ্ছি, তুমি আমাকে নিয়ে খাও না, আমাকে বাদ দিচ্ছ কেন ? তুমি স্ত্রী পুত্র নিয়ে, বিষয় আশয় নিয়ে আদর আহ্লাদ করতে চলেছ, সে তো বেশ, কিন্তু আমাকে ফেলে ছলেছ কেন ? তুমি দেখছ as if আমি নেই। তুমি যে সকল রসের প্রত্যাশী সে সব যে আমিই পরিবেশন করি। আমি না ঢুকলে তোমার স্ত্রী আর স্ত্রী থাকে না, আমি না ঢুকলে তোমার পুত্র আর পুত্র থাকে না। আমি না থাকলে তোমার স্ত্রী-পুত্র বোধ কি থাকে ? তবে আমায় ছেড়ে যেতে চাও কেন ? আমাকে নিয়ে নিয়ে চল, তাহলে এখন তুমি যে রস পাও তা ঢের বাড়িয়ে তোমাকে ভোগ করতে দেব। এখানে তুমি কতটুকু রস পাও। তোমার স্ত্রীর যে বাঁধা limited রূপ আছে, এখন তুমি সেইটুকু মাত্র ভোগ কর। হতে পারে সে সুন্দরী ---কিন্তু সে মাত্র একটি। কিন্তু আমাকে তার সঙ্গে জুড়ে দাও, দেখবে ও অনন্ত। যে দেবতা এইরূপে বিরাজ করে সব কুণ্ঠা দূর করে দেন, তাঁর নাম বৈকুণ্ঠপতি। কোন কুণ্ঠা নাই, চলে এস----এই তাঁর ধ্বনি।কিন্তু আমি কি পাপিষ্ঠ---এসব আমি দেখছি না। তুমি যখন এইরূপ আমার হতে পার, তখন তুমি এসে এমন ভাবে দাঁড়াও যে আমি আর তোমাকে ছাড়ব না। হে গুরু আমার দেবতা আমার, তুমি আমার সংস্কারগুলি আলো করে স্বয়ংজ্যোতি হয়ে দাঁড়াও যতক্ষণ না আমি তোমায় বরণ করে উঠতে পারি। আজ আমার অনুরাগ এসেছে, তোমার পরিচয়ের আভাস পেয়ে তোমাকে চাইছি, কিন্তু শক্তিতে কুলাচ্ছে না। কিন্তু আমার চাইই তোমাকে।
তোমার বুকের ভিতর একবার দেখ তো। কতবার বলেছ তুমিই আমার প্রাণ ---তুমি আত্মা, তুমি আত্মার আত্মা, কিন্তু বন্যার জল যখন সরে যায় তখন যে মাটি সেই মাটি। তখন ভগবান যে তলায়, সেই তলায় পড়ে রইলেন। তিনি যতক্ষণ না রুদ্রগ্রন্থিতে দাঁড়ান, ততক্ষণ এ হয় না। তখনই তুমি বলে উঠবে--তুমি না দিলে কে আমায় দেবে ! সুতরাং এখন যদি না নাও, সে দোষ তোমার। কেন ? আমি তোমাদের বরাবর বলে আসছি, আমি তোমাদের ক্ষণিক সাধনায় সিদ্ধ করে দিতে চাইছি। তার ফল হবে এই যে আমার মহাপ্রয়াণের সময় তুমি এসে দাঁড়াবে, তবেই আমি এ শরীর ছাড়ব। আমি যখন মরিনি ---বেঁচে রয়েছি, সেই সময় তুমি এস। এই হল ক্ষণিক সাধনা। এ কি করে সম্ভব হয় দেখ। মনে কর তুমি খেতে বসেছ, তখন একটি মাছি তোমার নাকে এসে বসল। তুমি তখন খাওয়া ফেলে -----তোমার এত বড় একটা ভোগ ছেড়ে----তুমি মাছিকে তাড়াবার জন্য হাত ওঠালে। ক্ষণিক সাধনা ঠিক এইরকম। তুমি যত জাগতিক ব্যাপারে ডুবে যাও না কেন, আমি তোমাকে এমন সুড়সুড়ানি দেব যার ঠেলায় তুমি আমার দিকে চলে আসবে।এতে বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন নাই। আমি কল্পনা করে কিছু বলি না; যাচাই করে তবে বলি। আমার বাল্যকাল থেকে এই ধারা। এমন কোন মানুষ আছে, যার বুকে মরবার সময় ত্রাহি ত্রাহি ভাব জাগবে না, যে বাবাগো বলে কেঁদে উঠবে না। যাঁকে দেখিয়ে দিচ্ছি, ওই আত্মদবতাকে দেখলে আর কি তোমার অমন ত্রাহি ভাব বেরুবে। তখন কি তুমি বলে উঠবে না ---ওগো আত্মদেবতা তুমি থাকতে আমি কি আর মরব ! সম্মুখে দেখছি আমার আত্মদেবতা---আমি আর যাব কোথায় !
এই আত্মদেবতায় ব্যবহারশীল হতে পাচ্ছ ? তবে নমস্তে বহুরূপায় বিষ্ণবে পরমাত্মনে বলে দেবতাকে রং দাও। কিন্তু এত রং যে ভগবানের গাময় মাখালে তা ছাড়াবে কি করে ? এই জন্য দোল খেলার পর, ঠাকুরকে অভিষেক করে তাঁর নিরঞ্জন দেখতে হয়। আমিই সব রং, তাই আমার গায়ে কোন বিশেষ রং লাগেনি। সব মেখেও আমি কিছু মাখি নি। যেমন একটা আয়নার কাঁচে রং লাগালে সেটা আয়নাতে লাগে না, এ ঠিক তেমনি। ভগবান সত্যিই রং মাখেন, কিন্তু ব্যাপারটি হল তিনি নিজে রং হয়ে রং মাখেন। তাই মেখেও যেমন তেমনই থাকেন----as if মাখেন নাই। এ কি অপূর্ব্ব তত্ত্ব ! তা যদি না হত, তিনি রং মেখেই যদি বসে থাকতেন, তা হলে 'কিছুই চাই না' জ্ঞানে যে সম্বুদ্ধ, তার কি তিনি আরাধ্য দেবতা হতে পারতেন ? তাঁকে আর এক এমন দেবতাকে ডাকতে হত। দেবতা এত রং মেখেও বলতে পারেন আমি যেমন তেমনি আছি। তাই যে বলে আমি কিছু চাই না, তাকেও উনি বলতে পারেন---- বেশ, তুমি কিছু চাও না, তবে এস আমার কাছে । সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম বলে যিনি ফুটে উঠছিলেন, তিনিই কি এই ! এ একেবারে পাগল করে ছেড়ে দেয় ! সব ইন্দ্রিয় ধর্ম্ম ওঁতেই। উনি সব---- একথা যেমন সত্য, উনি কিছু নন একথাও তেমন সত্য ! এ কী ভগবান ! এটা কি অদ্ভুত ! শুনতে অদ্ভুত লাগে, কিন্তু জগতে সব জিনিষই এইরূপ। জলে তরঙ্গ আছে, জলই তরঙ্গ হয়ে ছোটাছুটি করছে। কিন্তু জলজ্ঞান ও তরঙ্গজ্ঞান ----এ দুটা জ্ঞানে কি ঠেকাঠেকি আছে ? অলঙ্কার জ্ঞান ও সুবর্ণ জ্ঞান----- এ দুটাতে কি কোন মেশামেশি আছে ? তরঙ্গ হয়েও জলের জলত্ব অটুট, গহনা হয়েও সোনা অবিকৃতই থাকে। সোনাকে ফের যত আকারে নিতে চাও, ততরকমে তাকে গঠিত করতে পার। সেইরূপ, এই দেবতা সর্ব্ব রসে ভরা, তোমায় সব দিতে পারেন, আবার তাঁর আত্মদেবতা স্বরূপে কোন রস দেখতে পাবে না, অথচ সব রসই সেখান থেকে ঠেলে উঠতে পারে। ভগবানকে ডাকতে গিয়ে কেবল ডাইনে দেখলাম, বাঁয়ে দেখলাম না --- এ হবার জো নাই। এ দিকেও যেমন, ও দিকেও তেমনই রয়েছেন। ইনিই ব্রহ্ম, আত্মস্বরূপ, আবার ইনিই সত্যং, জ্ঞানং, অনন্তং। এ কি অদ্ভুত কৌশল! ইনি খালি সৌন্দর্য্যের দিকে নয়, ইনিই আবার অসুন্দর। জগৎ প্রকাশ মানে ক্রিয়া প্রকাশ। কিন্তু বিপরীত মেরু না থাকলে কোন ক্রিয়াই হয় না। এটা symbolised হয়েছে আমার জোরা জোরা ইন্দ্রিয়ে---দুটা চোখ, দুটা কান, দুটা হাত, দুটা পা, দুটা মস্তিষ্ক ( লঘু মস্তিষ্ক ও গুরু মস্তিষ্ক)। ডান চোখ ও বাম চোখ মানে উভয়মুখী গতি---একটা বহিরাভিমুখে আর একটা অন্তরাভিমুখে। যখন ফুটেছে তখন উভয়দিকের প্রাধান্য নিয়ে জন্মেছে। কিন্তু এদের জন্ম ওই আত্মদেবতা থেকে। যে ভাবেই ইনি খেলা করতে যান, ইনি এই double aspect নিয়ে যান। এই ওঁর লীলা। যেখানে ক্রিয়া প্রকাশ হয়, সেখানেই দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে দেখবে। তুমি বলবে ---এত সব কথা নাই বা জানলাম। আমি খালি ঐ রসে মেতে থাকব। তা হবে না। এ তোমাকে জানতে হবে, নচেৎ অবাধ ভগবান নেওয়া হবে না। যখন কিছু চাইছি বলছি তখন যে দেবতা ফুটছেন আর যখন কিছু চাই না বলছি তখনও সেই আত্মদেবতাই ফুটছেন। যখন কিছু চাই না বলছি তখন 'কিছু চাই না' স্বরূপ ঐ নিরঞ্জন দেবতার মূর্তি ফুটল, তুমি একেবারে ন্যাংটা শিব হয়ে গেলে, আর যখন কিছু চাইছি, তখন 'কিছু চাইছি' স্বরূপে সেই দেবতাই ফুটে উঠলেন। চোখ যেন না একবারও ঠকে, সেইজন্য এসব জানা দরকার।
জীবের সাংঘাতিক অবস্থা হল এই মধ্য অবস্থা। যখন জীব অজ্ঞান অবস্থায় থাকে তখন সে বেপরোয়া, আবার যখন সে প্রকৃত জ্ঞানী হয় তখনও সে বেপরোয়া। কিন্তু যখন তুমি এই মধ্য অবস্থায় জগৎ ভোগ করছ তখন সেই ভোগ তোমার মিষ্ট লাগে; তবুও বলছ--এই সব বৃথা আমার ভগবানকে ডাকা হল না। সব ভোগটা তিক্ত মনে হয়। এ কি দুর্দ্দশা ! যেটা পরম ভোগক্ষেত্র, যেখানে রাশি রাশি ভোগ ফুটছে, যেখানে কোন বন্ধন নাই, সেখানে তুমি যা পাচ্ছ তাও limited ! তার তলায় আছে বন্ধন। যা খেলাম তা পেটের ভিতর গিয়ে কর্ম্মফলরূপ বিষ হয়ে গেল ও তা থেকে নানারূপ germ তৈরি হয়ে শরীরটাকে নিপাত করে। আমরা বলি--- অনিত্য সংসার, জীবন অন্ধকার, বৃথা কাযে সময় গেল, ইত্যাদি। এ কি দৈন্য দুর্দ্দশা ! কিন্তু যখন ঐ ভোগ ওঁকে নিয়েই করবে, তখন বেপরোয়া হবে। এই শোচনীয় অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবে তখনই, যখন গুরু দেখিয়ে দিবেন, যে একটা কায, একটা চাঞ্চল্যও তোমাকে মারবার জন্য হয় নি---এ তোমার কাছে একেবারে ভগবতীকে এনে দিচ্ছেন। এই জ্ঞানদেবতাই তোমাকে উভয় দিকে ভগবতীর অবস্থান দেখিয়ে দিবেন। এই জ্ঞানে ঠেকতে পার বা না পার সেটা কথা নয়, তোমায় জানতে হবে এই ব্যাপারটি সত্য। ব্রহ্মগ্রন্থিতে intellect দিয়ে দেখে নাও, আর থাকতে পারা না পারা হল রুদ্রগ্রন্থির ব্যাপার। থাকতে পার আর না পার, জপ তপ কর বা করার সময়ও পাও না, তবু দেখ যে গুরু বলছেন তুমি ঠিক আছ। তোমার চোখ থাকলে তুমিও বলতে, সব ঠিক আছে---আমি রকমারি মূর্ত্তি ধরছি বটে কিন্তু মূলে ঠিক আছি । No discouragement, no despondency. এতে নৈরাশ্যের স্থান কোথায় ?
-------------------------------------------------------------
পরিশিষ্ট।
এই উপদেশটি বেদবাণী সম্পূরিকা, তৃতীয় খণ্ডের অন্তর্গত।দোল উৎসবের এই বিজ্ঞান ১৯৪১ সালের দোল পূর্ণিমার দিন, মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের দ্বারা উক্ত হয়। দোলোৎসবের অন্যান্য বৎসরের যে সকল উপদেশ, তা বেদবাণীর অন্যান্য খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।এই সকল উপদেশগুলি, তাঁর শিষ্যা স্বর্গীয়া সরলাদেবী চৌধুরানী, এবং অন্যান্য শিষ্যগণের দ্বারা শ্রুতিলিখনের দ্বারা লিপিবদ্ধ এবং সম্পাদিত হয়।
দেবকুমার লাহিড়ী। debkumar.lahiri@gmail.com
Comments
Post a Comment