শ্রী শ্রী বিশ্বমাতা পূজা । আচার্য্য শ্রীমদ্ বিজয়কৃষ্ণ কৃত শ্রী শ্রী বিশ্বমাতা (অমা/অদিতি) পূজা। মূর্ত্তি পূজা রহস্য এবং বেদ। ( ১৯৪১ সাল/ সন ১৩৪৮, শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরাণী কর্ত্তৃক সঙ্কলিত।) (Worship of Aditi/Ama—Vishvamaataa/Universal Mother Goddess of the year 1941 in Bengali language--Performed by Rishi Bijoykrishna Chattopadhaya and recorded by Sarala Devi Chowdhurani.)


ভূমিকা।

মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫ -১৯৪৫), যিনি 'হাওড়ার ঠাকুর' বলে তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজে পরিচিত ছিলেন, তাঁর একজন প্রধান শিষ্যা ছিলেন স্বর্গীয়া সরলা দেবীচৌধুরাণী; তিনি প্রায় ১০ বৎসর গুরুসঙ্গ করেন, এবং ঐ সময়ে তিনি মহর্ষির বহু উপদেশ শ্রুতিলিখনের দ্বারা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই উপদেশাবলী 'বেদবাণী' নামে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতি বছর, মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ, শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং বিশ্বমাতা-পূজার অনুষ্ঠান সশিষ্য সম্পাদন করতেন। 
পূজাকালীন যে মন্ত্র সকলের দ্বারা মহর্ষি পূজা করেছিলেন, এবং তার সাথে যে চিৎ-বিজ্ঞান রহস্য প্রকাশ করেছিলেন, তা শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে 
সরলাদেবী লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পরে, এই  লেখাগুলিও, বেদবাণীর মত, পুস্তাকাকারে প্রকাশিত হয়। নিম্নলিখিত পূজার আলেখ্য, ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের বিশ্বমাতা পূজার বিবরণ—যা সরলাদেবী লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

বিশ্বমাতা-অমা।
বেদে যিনি অম/অমা এবং অদিতি বলে পূজিতা হয়েছেন, তিনিই বিশ্বমাতা। 'অমো নামাসি অমা হি তে সর্ব্বং ইদং'—তোমার নাম 'অম', কেননা তোমাতেই এই সব—যা কিছু 'ইদং' পদবাচ্য। (ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৫।২।৬ দ্রষ্টব্য।) তাই আমরা যারা, বিশ্বভুবন থেকে অনুভূতিরাশি নিয়ে বা 'সোমপান' করে বেঁচে আছি, আমরা যারা 'ইদং' অর্থাৎ যা কিছু 'ইদং' বা 'ইহ' বলে প্রতীত হচ্ছে, তার দ্রষ্টা, সেই আমরা সবাই সোমপায়ী ইন্দ্র। এই 'অম' কে জানিনা বলে, আমরা 'ক্ষয়শীল', 'মৃত্যু গ্রস্ত', আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি ক্ষয়িষ্ণু । এঁকে দেখলে আমরা অমর হই, প্রকৃত ইন্দ্র হই। ইন্দ্রিয়দের মৃত্যুর পরপারে যিনি নিয়ে যান, তাঁকে, ছান্দোগ্য এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মুখ্যপ্রাণ এবং আয়াস্য প্রাণ বলে বন্দনা করেছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে এঁকে 'দুর্‌' নামক (দেবতা /দেবী) বলা হয়েছে, কেননা মৃত্যু এঁর থেকে দূরে চলে যায়—'সা বা এষা দেবতা দূর্‌ নাম দূরং হ্যস্যা মৃত্যু'—সে এই দেবতার নাম 'দূর্‌', কেননা মৃত্যু এঁর থেকে দূরে থাকে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৩।৯) । মৃত্যু এঁর থেকে দূরে (দূর) যায় (গচ্ছতি) তাই এঁর নাম দূর্গা/দুর্গা । এই মৃত্যু দূর হলে যে ছিল দুর্গা, সেই হয় অমা/অদিতি এবং যে ছিল মহিষাসুর বা 'খণ্ডিত মহিমা', মৃত্যুর দ্বারা ণ্ডিত, সে হয়ে যায় 'ইন্দ্র'-—যিনি অন্তহীন দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি শক্তি সম্পন্ন, —সহস্রলোচন ইন্দ্র। 
যিনি সবাইকে নিয়ে উদিত হন, সবাইকে নিয়ে অস্তমিত হন, যিনি থাকলে সবাই থাকে, এবং যিনি গেলে সবাই তাঁর সাথে যায়, তিনি অদিতি, অম, প্রাণ।

বিশ্বমাতার পূজার বিষয়ে মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণের উপদেশাবলীর থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি । 

"বিশ্বমাতাপূজা কি ?" এই প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি বলতেন,—" তুমি মনুষ্য হয়েছ কেমন করে ? তোমার মনুষ্য-মূর্ত্তি ধরবার কারণ কি ? তোমাকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁর একটা ঢেউ তুমি । ঢেউরূপী শক্তিটির পিছনে অনন্ত মনুষ্যমূর্ত্তি রয়েছে । এই ঢেউটা ঠেলে এসে তোমাকে মানবত্ব দেবার জন্য চেপে ধরচে এবং তোমাকে মানবমূর্ত্তি দিয়েছে ।তা হ'লে এই নিয়ন্ত্রিণী মাকেই তুমি মনুষ্যত্বরূপে ভোগ করছ ? এইটে দেখাই বিশ্বমাতাপূজা। —অনন্ত যে মা, তুমি হলে তার একটা সান্ত টুকরো । পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে । তবে সান্ত বা বলি কেন ? অনন্ত যে তেজটা শব্দের আকারে বা ভাবের আকারে ফুটছে, তোমাতেও তেমন আকারে বেরুচ্ছে বা  ফুটছে ।"
বিশ্বমাতাপূজার তত্ত্ব ও বিধানের সম্বন্ধে মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ বলেছিলেন—"এ পূজায় রাখতে হবে দুর্গাপূজার খানিকটা । এ পূজার আরম্ভ হয় বেদ থেকে । বেদ, জাতবেদা, ইন্দ্র, সোম, অদিতি ও আদিত্য,— এ অংশ নিয়ে তোমাদের অমাপূজা সংঘটিত হবে । অমা পূজা মানেই বিশ্বমাতা পূজা । সন্ধি পূজার ব্যবস্থা অমাপূজায় নাই কেন ? দুর্গা হল সংযোজনী শক্তি, এপাশ থেকে ওপাশ সংযোজন করে এবং পূর্ণেন্দু; আর অমা হল পূর্ণা—অমাবস্যা । দুর্গাপূজার নবমী পূজায় পোক্ত না হলে অমার পূজা হয় না । " 

 দেবীমূর্ত্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

দেবী ত্রিনয়না, প্রকটিত জিহ্বা, অষ্টভুজা, অষ্ট অস্ত্র (অষ্ট বজ্র) ধারিণী, গভীর-নীল বর্ণা। ইনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর — এই তিন দেবতার দ্বারা (ত্রিবৃতের দ্বারা) বেষ্টিতা, এবং শিশু ইন্দ্র এঁর বক্ষে সংলগ্ন । 
দেবীর দক্ষিণ দিকে আসীন ব্রহ্মা, বাম দিকে বিষ্ণু, এবং দেবীর দক্ষিণ পদের নিকটে আসীন মহেশ্বর। তাঁর দক্ষিণ পদপ্রান্ত মহেশ্বরের কর-পল্লবদ্বয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত; দেবীর বাম-পদপ্রান্ত সর্প বা দধিক্রার মস্তকে
প্রতিষ্ঠিত । দেবীর মস্তকের উপর অষ্ট-ভুজা সর্প—অষ্টমী বাক্‌—বসু-শক্তি; বাক্‌—যিনি দেবীর ব্রহ্মত্ব ঘোষণা করছেন । (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।২।৩ দ্রষ্টব্য।)
দেবীর ছয়টি হস্ত যথাক্রমে  ত্রিবৃতের তিনটি বর্ণ-সম্পন্ন*—দুইটি হস্ত লোহিত বর্ণ (ঋক্‌ বেদ) , দুইটি হস্ত শুক্ল বর্ণ (যজুর্বেদ), দুইটি হস্ত কৃষ্ণ (নীল) বর্ণ (সাম বেদ), এবং অপর দুইটি হস্ত গভীর-নীল বর্ণ (অথর্ব্ব বেদ) । (*ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য । )
সন্তান ইন্দ্র, যিনি জন্মেই মাতৃ স্তন্য দর্শন করেছিলেন এবং সোম /স্তন্য-দুগ্ধ পান করেছিলেন, তাঁর একটি হস্ত মাতৃ বক্ষে। (ঋক্‌বেদ তৃতীয় মণ্ডল ৪৮ সূক্ত দ্রষ্টব্য ।) মাতৃ-ক্রোরস্থ ইন্দ্র সম্মুখ দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন সমস্ত বিশ্বকে ডাকছেন বিশ্বজননীকে দেখবার জন্য—"শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ, শৃণ্বন্তু দেবাঃ,
মাতৃকাপূজনং অহং করিষ্যে।" 

সিন্ধুসভ্যতা এবং মিশরে মাতৃ পূজা, এবং দেবী এথিনা (আথর্ব্বণী)। 

প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌রা যে সব আবিষ্কার করেছেন, সেই সূত্রে জানা যায় যে মাতৃকার পূজা বহু প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর নানা দেশে বা সভ্যতায় প্রচলিত ছিল। 
মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ এই প্রসঙ্গে একবার যা বলেছিলেন, তা তাঁর জীবনী-গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং সেই অংশটি উদ্ধৃত করলাম—' শ্রীগুরু নিজেই একদিন শিষ্যদিগকে আপন আবির্ভাব সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আভাস দিয়া বলিয়াছিলেন,"অমৃতবাজার দিয়েছে, মহেন্‌-জো-দারোতে excavationএ তিনটি ঠাকুর বেরিয়েছে । তাতে লেখা আছে সেই ঠাকুরদের নাম —অন, অনিল, অমা । ওরা বলে পাঁচহাজার বছর আগেকার ঠাকুর; তা নয়, দশহাজার বছর আগেকার কথা* । দেখ্‌ কবেকার মা এসে হাজির হয়েছেন । আমি আমার ঠাকুরকে এবার বাংলাদেশে এনেছি । আমি সেখানে এঁকে প্রতিষ্ঠা করেছিলুম—আবার দশহাজার বছর বাদে এসেছি ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় । চেলার উপর ভার দিলে এই দুর্দ্দশা হয়—নিভে যায় সব ।সে জন্য এবার চেলার উপর ভার দিই নাই—নিজে সব করছি । একটু সংস্কার ছিল গোড়াতে, চেলার উপর ভার দেওয়া—তাই দিয়েছিলুম । এখনও দিতে পারি, হয় এক বেটাকে দিলুম উস্কে, খাটুক আমার জন্যে, কিন্তু দিলে থাকবে না । Excavationএ ঐ ঠাকুরের নাম বার করেছে কিন্তু শিষ্যের নাম যদি বার করতে পারত তাহ'লে আরও ভাল হত । তার নাম ছিল সত্যযাগ ।নাম দিয়েছিলুম ভালকরে কিন্তু হ'লে কি হবে, সব নষ্ট হয়ে গেছে।"  
(*সম্প্রতি সিন্ধু সভ্যতার বিষয়ে যেসব নূতন তথ্য আবিষ্কার হয়েছে, তার থেকে জানা যায় যে এই সভ্যতা অন্তত আট থেকে দশহাজার বছর পূর্ব্বের ।) 

এই দেবী মিশর দেশে (Egyptএ) আইসিস (Isis) ) নামে পূজিতা হয়েছিলেন। আইসিস (Isis) শব্দটি 'ঈশা' শব্দের সাথে সম্বন্ধ যুক্ত। আইসিস(Isis)-এর সন্তানের নাম ছিল 'Horus' । ইন্দ্রের যে 'হরি' নামক অশ্ব, তার থেকে Horus শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল; হরি+অশ্ব > হর্য্যশ্ব। ঋক্‌ বেদে হর্য্যশ্ব শব্দটি উক্ত হয়েছে। ইন্দ্রই Horus । 'সম্মিশ্ল' অর্থাৎ 'সম্যক-মিশ্র' এই শব্দটি এবং 'হর্য' শব্দটি, ঋক্‌ বেদের ১।৭।২ মন্ত্রে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে উক্ত হয়েছে। (ইন্দ্র ইৎ হর্যো সচা সম্মিশ্ল আ বচোযুজা । ইন্দ্রো বজ্রী হিরণ্যয়ঃ।। ঋক্‌ বেদ ১।৭।২।) সম্যক-মিশ্র বা মিশ্র থেকে মিশ্র দেশের নাম হয়েছিল। এই পূজায় মহর্ষি সোম ও কালের মিশ্রণের কথা বলেছেন ।
এই পূজাতে মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ, দেবীকে আথর্ব্বণী এবং অথর্ব্ব-আঙ্গিরস নামে বন্দনা করেছেন । এই আথর্ব্বণী গ্রীক্‌ দেশে দেবী এথিনা নামে পূজিতা হয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, গ্রীসে এবং ইতালিতে প্রাচীন কালে অন্নপূর্ণা পূজা হত ।

অন্নকূট উৎসব। 
চারদিনের এই পূজার, তৃতীয় দিনে অন্নকূট উৎসব পূজার একটি পর্ব্ব। এই পূজাকে মহর্ষি 'মহাঅন্নপূর্ণা যজ্ঞ' বলে অভিহিত করেছেন। দেবীর সম্মুখে স্থিত বেদীতে অন্নের একটি সুসজ্জিত পর্ব্বতাকার আকৃতি নির্মাণ করা হত। বিচিত্র বর্ণের বহু পুষ্পমাল্যের বেষ্টনী দিয়ে এই অন্নের স্তূপকে, এবং তার শীর্ষ বা কূটকে সুসজ্জিত করা হত; অন্ন-স্তূপের শীর্ষে, বজ্রের অনুকল্পে একটি নবনী(ননী)-পিণ্ড রাখা থাকত এবং তাতে তুলসীপাতা দিয়ে 'মা' বা 'বিশ্বমাতা' লেখা থাকত । বেদীর উপরে থাকত আকাশোপম  চন্দ্রাতপ (চাঁদোয়া), এবং তার থেকে নানা ফল, আম্র-পত্র, এবং শিশুদের নানা খেলনা, যেমন বাঁশী, ঝুমঝুমি, বল, খেলনার হাতি-ঘোড়া-পাখী ইত্যাদি ঝোলান থাকত। 
নানাপ্রকার সুরন্ধিত ভোগ্যদ্রব্য, ফল, অজস্র-মিষ্টান্ন, দধি, পায়স, অম্বল ইত্যাদি দেবীর সামনে অন্নর সাথে নিবেদন করা হত। নানাবিধ সুবর্ণ-অলংকার, সুন্দর শারী এবং নানারঙের ফুল ও ফুলের মালায় দেবীকে ভূষিত করা হত, এবং সমস্ত পূজামণ্ডপ ফুল ও ফলে সুসজ্জিত থাকত । নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকা এবং রক্তবর্ণ গোলাপের গুচ্ছ এবং স্বর্ণ-মুকুট (কিরীটী) দেবীর শিরোদেশে শোভা পেত। দেবীর কণ্ঠে দুলত জবা, বিল্বপত্র এবং অপরাজিতার মালা।
প্রকাশকের মন্তব্য।
নিম্নে যে পূজা বিবরণী পরিবেশন করা হল, তা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। যাঁরা এবিষয়ে অভিজ্ঞ নন, তাঁদের সুবিধার্থে, আমি কয়েকটি পাদটীকা (foot notes)/ 'প্রকাশকের মন্তব্য',  এবং উপরোক্ত ভূমিকাটি, মূল আলেখ্যর সাথে  সংযোজন করেছি— যা মূল পুস্তকে নেই। 
-দেবকুমার লাহিড়ী। (debkumar.lahiri@gmail.com)
--------------------------------------------------------------

শ্রী শ্রী বিশ্বমাতাপূজা। (অমা—ইন্দ্র সহ অদিতির পূজা।) আচার্য শ্রীমদ্‌ বিজয়কৃষ্ণ কৃত।
বঙ্গাব্দ ১৩৪৮, খ্রীষ্টাব্দ ১৯৪১।
সরলাদেবী চৌধুরাণী কর্ত্তৃক সংগৃহীত।
আচার্যদেবের শিষ্যগণ দ্বারা সম্পাদিত।

বঙ্গাব্দ ১৩৫৮, অগ্রাহয়ণ।
--------------------------------------------------------------




শ্রী শ্রী বিশ্বমাতাপূজা।
আচার্য শ্রীমদ্ বিজয়কৃষ্ণ কৃত।
১০ই পৌষ,১৩৪৮,২৫শে ডিসেম্বর,১৯৪১,সকাল ৯-৩৫ মিনিটে আরম্ভ।

ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ, ওঁ স্বস্তি, ওঁ স্বস্তি, ওঁ স্বস্তি।

ওঁ কর্ত্তব্যে'স্মিন্‌ শ্রীমাতৃকাপূজাকর্ম্মণি পুণ্যাহং ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু, পুণ্যাহং ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু, পুণ্যাহং ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু।
ওঁ পুণ্যাহং, ওঁ পুণ্যাহং, ওঁ পুণ্যাহং।

ওঁ কর্ত্তব্যে'স্মিন্‌ শ্রীমাতৃকাপূজাকর্ম্মণি স্বস্তি ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু, স্বস্তি ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু, স্বস্তি ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু।
ওঁ স্বস্তি, ওঁ স্বস্তি, ওঁ স্বস্তি।

ওঁ কর্ত্তব্যে'স্মিন্‌ শ্রীমাতৃকাপূজাকর্ম্মণি ঋদ্ধিং ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু, ঋদ্ধিং ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু, ঋদ্ধিং ভবন্তঃ অধিব্রুবন্তু।
ওঁ ঋদ্ধ্যতাংওঁ ঋদ্ধ্যতাং, ওঁ ঋদ্ধ্যতাং

ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং অরাতীয়তো নিদহাতি বেদঃ। স নঃ পর্ষদতি দুর্গাণি বিশ্বা নাবেব সিন্ধুং দুরিতাত্যগ্নিঃ। 

ওঁ অয়মারাম্ভঃ শুভায় ভবতু। ওঁ অয়মারাম্ভঃ শুভায় ভবতু। ওঁ অয়মারাম্ভঃ শুভায় ভবতু।

ওঁ সূর্য্যঃ সোমো যমঃ কালঃ সন্ধ্যে ভূতানি অহঃ ক্ষপা।
পবনোদিকপতির্ভূমিরাকাশং খচরামরাঃ।
ব্রাহ্মং শাসনং আস্থায় কল্পধ্বং ইহ সন্নিধিং।।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে নমো নারায়ণায়।

এতে গন্ধপুষ্পে গণেশাদি পঞ্চদেবতাভ্যো নমঃ।

এতে গন্ধপুষ্পে সূর্যাদি নবগ্রহেভ্য নমঃ।

এতে গন্ধপুষ্পে ইন্দ্রাদি দশদিকপালেভ্য নমঃ।

এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ জাতবেদসে নমঃ।

জাতবেদার* বুকে ভিন্ন, কোন দেবতার পূজা করবে না, জাতবেদার বুকে ভিন্ন কোন মন্ত্র উচ্চারণ করবে না। আর কোথাও কাকেও দেখবে না।
----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*জাতবেদা—স্বয়ং প্রকাশ চেতনা, যিনি সবার আত্মা, তিনি সর্ব্ব জ্ঞান বা বোধের আকারে প্রকাশ পাচ্ছেন। ইনি নিজেকে যে ভাবে বা যদাকারে জানেন, তৎক্ষনাৎ তাই হয়ে জাত হন। এই জানার নাম 'বেদ', এবং তাই হওয়া হলো 'জাত' হওয়া। ইনি জানতে জানতে হন এবং হতে হতে জানেন। তাই এঁর নাম জাতবেদা। আমরা এঁর জানা বা বোধের প্রকাশ। আবার আমরা যা কিছু জানছি বা অনুভব করছি, আমরা নিজের অন্তরে তদাকার হয়ে নিজেকে সেই রূপে জানছি। চেতনার ধর্ম্ম -ই এই। আবার, ইনি সব হয়েও, আবার যেমন তেমনই থাকেন। এঁর নাম জাতবেদা। 
------------------------------------------------------------

এতে গন্ধপুষ্পে ইন্দ্রাদি দশদিকপালেভ্য নমঃ
এতে গন্ধপুষ্পে নমো ব্রহ্মণে।
এতে গন্ধপুষ্পে নমো বিষ্ণবে।
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ জাতবেদসে শিবায়।
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ জাতবেদঃস্থায় শিবায়।
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ জাতবেদঃস্থেভ্যঃ সর্ব্বেভ্যো দেবেভ্যঃ।
এতে গন্ধপুষ্পে নমঃ জাতবেদঃস্থাভ্যঃ সর্ব্বাভ্যো দেবীভ্যঃ।
এতে গন্ধপুষ্পে জাতবেদঃস্থেভ্যঃ বিশ্বরূপেভ্যো নমঃ। 
ওঁ অয়মারাম্ভঃ শুভায় ভবতু। দেবি, ভগবতি, অয়মারাম্ভঃ শুভায় ভবতু । 

ওঁ তৎ সৎ,অদ্য মাতৃকামাসি মাতৃকাপক্ষে মাতৃকারাশিস্থে ভাস্করে মাতৃকায়াং তিথৌ মাতৃকাগোত্রঃ শ্রীমাতৃকাপুত্র ইন্দ্রো নাম শ্রীমাতৃকাপূজনং অহং করিষ্যে।
জাতবেদা যখন আমার মা, তখন আমার মুখ দিয়ে যে কথা উচারিত হবে, মা তাই হবেন। যদি বলি মাস, তিথি, পক্ষ, তবে মা-ই তাই হবেন। 'ইন্দ্রো
নাম'—জন্মের সাথে সাথে যে জাতবেদাকে দেখে, সে তৎক্ষণাৎ ইন্দ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। সুতরাং 'মাতৃকাপুত্র' বলাও যা, ইন্দ্র বলাও তা। 
ওঁ শৃণ্বন্তু বিশ্বেঅমৃতস্য পুত্রাঃ, শৃণ্বন্তু দেবাঃ,
মাতৃকাপূজনং অহং করিষ্যে।
ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং।
এই প্রচণ্ডা, অমোঘা, অব্যর্থা মহাশক্তিকে ধারণা করতে হবে। তোমরা 'জাতবেদা' এই মন্ত্রকে সুদৃঢ় ভাবে বুকে ধারণা কর। এত দিন ত মৃত্যুর দ্বারা সমাচ্ছন্ন হয়ে তাকে 'মা বলে ডেকেছিলে। আজ সে সাক্ষাৎ মাতৃকা মূর্ত্তি ধারণ করে দাঁড়িয়েছে শুধু এইটি দেখতে—কেমন করে তোরা মাকে ডাকিস। তোদের বহুবর্ষব্যাপী শিক্ষা আজ হাতে-কলমে দেখা।'জাতবেদা' এই মন্ত্র অতিক্রম করে তোরা একটি ফুল দিবি না, একটি পা বাড়াবি না।
'জাতবেদা' বলে তোরা চল—মৃত্যু থেকে অমৃত লাভ করবি। আজ মা স্বেচ্ছায় করাল কালিকা মূর্ত্তি ধারণ করেছে। আপনাকে অভিব্যক্ত করেছে।
দেখিয়েছে আমি ঋক্‌*, আমি আপনার আনন্দে বিপুল তেজে,বিপুল শক্তিতে চলেছি।
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*ঋক্‌--ঋ—যা গতিশীলা, ক—যা বর্ণ বিচ্ছুরণময়।
------------------------------------------------------------
যেখানে যেখানে তোরা চলেছিস, সেখানে সেখানে মাত্র ভোগ্যই দেখছিস—যেন মৌরসি পাট্টা করে বসে আছিস। আজ তোরা খালি ভোগ দেখবি না, আমার গতি দেখ—আমি চলছি, চলছি, চলছি। মায়ের এই চলা দেখে আজ তোরা পূজা আরম্ভ কর। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং। দিলুম উল্টে। জীবনের যেখানে যত গতি, তাকে উল্টে দিলাম। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং। আবার বলে দিচ্ছি, অমন করে পূজা করলে চলবে না। সমূদ্রে যেতে যেতে জাহাজ ভেঙ্গে মানুষ যদি জলে পড়ে যায়, তখন সে যেমন আপনাকে বাঁচাবার জন্য ধড়ফড় করে, তেমনি করে পূজা করতে হবে।
জয় গুরু! জয় মৃত্যুদলনকারিণী! জয় মৃত্যুভীতিনাশিনী! তোরা প্রতি পদে জাতবেদাকে দেখতে দেখতে যাবি। এ শুধু  পূজা নয়, এ তোদের জীবনগতি। তোরা চলেছিস—এটা দেখাচ্ছি; আমার সঙ্গে সঙ্গে যদি চলতে পারিস ত মৃত্যুতে গিয়েও অমৃতে পড়বি। এই করালা ঘোরার প্রাণের ইয়ত্তা কেউ করতে পারলে না। জাতবেদসে সুনবাম সোমং। 
অনয়া মহ্যা অস্যাঃ মতৃকায়াঃ মহাঅধিবাসনম্ অস্তু। [এই মন্ত্রে বরণডালায় রক্ষিত গন্ধ, শিলা, ধান্য ইত্যাদি নানা জিনিষ দ্বারা মায়ের অধিবাস হল এবং শঙ্খ, ঘণ্টা, ঢাক, ঢোলের বিপুল বাদ্য হতে লাগল।]
এই মহামন্ত্র অবলম্বন করতে না পারলে পূজাপদ্ধতির ভিতর প্রবেশ করতে পারবে না। জাতবেদাকে অবলম্বন কর। শিলা, ধাতু, জল, ফল, ফুল ইত্যাদি সমস্ত মূর্ত্তি ধারণ করে তোমাদের এই জাতবেদা দাঁড়িয়ে রয়েছেন—এই হল মায়ের অধিবাস*।
-----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*যাঁর অধিকারে সমগ্র বিশ্ব, তিনিই সর্ব্বরূপে নিজেকে সৃষ্টি করে, মূর্ত্ত 
করে, অধিষ্ঠাত্রী হয়ে বসবাস করছেন। এইটি অধিবাস। 
----------------------------------------------------------
কি দেখলে ? জাতবেদা মহী, জাতবেদা গন্ধ, জাতবেদা শিলা, জাতবেদা ধান্য, জাতবেদা স্বর্ণ, জাতবেদা রৌপ্য, জাতবেদা ফল, জাতবেদা দধি মধু, জাতবেদা বস্ত্র—এই বিশ্ব-আকারীয় বাসখানি জাতবেদার জ্বলন্ত মূর্ত্তি। প্রজ্ঞানের ফাঁকে যেন চলে যেও না, খুব হুঁসিয়ার! হাজার বছর ধরে তোমরা জ্ঞানের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে মরে এসেছ, আর না মরতে হয়।ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং। 'নবাম' করলি" ? কি করলি? এই জাতবেদাকে দেখলি? তুমি ধরণী, তুমি শিলা, তুমি তাম্র, তুমি স্বর্ণ, তুমি শস্য—এস মা , এস মা, এস! কোথায় কোন্‌ গহ্বরে মাকে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছিলি । ও ভাবে খুঁজলে পাবি না—ব্রহ্মজ্ঞান হলেও পাবি না। এ খালি দর্শনের তারতম্য। বুঝলি? ওকে যদি এখানে পাস, তবে ওখানেও পাবি। মরণের হাত থেকে বাঁচবার জন্য যেমনি ধড়ফড় করে এখানে এসেছিস , তেমনি ভাবে ওর পূজা কর।  ছিল মড়া মাটি, মড়া জল, সেই মড়া খেয়ে খেয়ে তোরা পচ্‌ছিলি। সবাই মড়া, কে কাকে বয়, কে কাকে গোভাগাড়ে নিয়ে যায় ? যাঁহাতক 'জাতবেদা' এই মন্ত্র বললি, অমনি যত মড়া ছিল, সব বেঁচে উঠল।যে মৃত্যুর বিষ খেয়েছিস, তাই হয়ে গেল অমৃত, সোমধারা। খা -খা-জাতবেদসে সুনবামং সোমং। আর, মাটি দিয়ে গড়া, কাঠ দিয়ে বাঁধা ছিল একটা পুতুলের মত মূর্ত্তি; যেমনি 'সুনবাম' করলি, সে হল সাক্ষাৎ ভগবান্‌! 
জাতবেদসে সুনবাম সোমং। চল চল চল—স্থিরা ভব, স্থিরা ভব। 
দেবেশি ভক্তিসুলভে ত্রিপাদ সুসমন্বিতে। যাবৎ ত্বাং পূজয়িষ্যামি তাবৎ ত্বং সুস্থিরা ভব।। দেবি! জাতবেদসে সুনবাম সোমং*।
ওঁ আপ্যায়ন্তু মম অঙ্গানি বাক্‌ প্রাণঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রম্‌ অথ বলম্‌ ইন্দ্রিয়াণি চ সর্ব্বাণি। সর্ব্বং ব্রহ্মোপনিষদংমস্তু।সর্ব্বং জাতবেদঃস্থং জাতবেদোপনিষদং অস্তু। আমার হাত, পা, আপাদমস্তক, চতুর্দশকরণ, আত্মময় এই শরীর সর্ব্বং জাতবেদোপনিষদমস্তু। 
কে দাঁড়াল ? জাতবেদা ? তোর হাত, তোর পা, তোর মুখ—এ নিয়ে কে দাঁড়াল ? জাতবেদা। দেবেশি, স্থিরা অত্যন্তং হি ভব, গৃহ্ন মে পূজাং। একান্ত স্থির হয়ে, আমার এই ইন্দ্রিয়রাশি, আমার এই চতুর্দশকরণ, আমার এই আত্মা, এই সব নিয়ে, এইখানে দাঁড়িয়ে পূজা নাও। স্থিরা ভব দেবেশি, স্থিরা ভব, স্থিরা ভব। কার পূজা করছ ? জাতবেদার । জাতবেদার ? আজ তার কোন মূর্ত্তির পূজা করছ ? সবই ত জাতবেদা।কখনও স্ত্রীমূর্ত্তি, কখনও পুত্রমূর্ত্তি, কখনও জাগরণমূর্ত্তি, কখনও মৃত্যুমূর্ত্তি; আজ এই মহাক্ষণে কোন মূর্ত্তির পূজা করতে বসেছ ? মাতৃমূর্ত্তির। শুধু তা বললে হবে না। সে যে সব মূর্ত্তিতেই মা হয়ে তোর সেবা করছে । তুই আজ কি চাস ? অভয়। সুতরাং মায়ের অভয়া মূর্ত্তিতে মাকে দেখ।
-----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*জাতবেদসে সুনবাম সোমং—জাতবেদার জন্য সোমকে নবীন (নব) করে, 'সু' অর্থাৎ সুত বা নিঃসৃত করছি। যে বেদন বা অনুভূতি প্রকাশের দ্বারা আমরা সজ্ঞান হয়ে রয়েছি, বা বেঁচে আছি তার নাম 
'সোম'। 'সোম' শব্দের নিরুক্তি-গত একটি অর্থ  হল 'সহ উমা'। চিন্ময় আত্মস্বরূপ মৃত্যুর ঊর্দ্ধে বা উৎ ক্ষেত্রের যে মাত্রা , বা যা  অমৃতের মাত্রা, তা মৃত্যুকে দূর করে আমাদের দেন। এতে আমরা অমৃত ভোক্তা হই। এর নাম সুনবাম সোম পান করা। যা নিত্য নবীন, তা মৃত্যুর ঊর্দ্ধে, তা অমৃত।নবমীর দুর্গা পূজায় যে বলিদান করা হয়, তার অর্থ এই সুনবাম সোমের প্রকাশ, বা এই সুনবাম সোমকে মুখ্য-প্রাণস্বরূপ দুর্গাতে নিবেদন করা। বলি মানে পশু হত্যা নয়, নিজের পাশব-বৃত্তিগুলিকে হত্যা করা। 
এই মহাপূজার শেষ দিনে মহর্ষি 'উমা' শব্দের নিরুক্তি ব্যক্ত করেছেন ।
..........................................................................
গোঁজামিল দিস না। এখন কোন মূর্ত্তিতে মায়ের কাছে কি চাস ? অভয়—অভয়ামূর্ত্তি। যাকে দেখলে তোর সব ভয় দূর হবে, শত্রু দূরে যাবে, তোর হৃদয়কুণ্ড অমৃত ধারণ করবে। বাইরে যার অসুরদলনী মৃত্যুদলনী মূর্তি,
তোর ভিতরে সে জাতবেদামূর্তি। জাতবেদামূর্তিতে মাকে যে আনতে সক্ষম হয়েছে, সে দেখে শুধু স্তন্য*। 
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*স্তন্য : স্তন্য শব্দটি স্তন্‌ ধাতু থেকে হয়েছে। স্তন্ শব্দের একটি অর্থ 'মেঘ গর্জ্জন করা'। চেতনা শব্দাকারে প্রকাশ পেয়ে যে ভাব সকল বর্ষণ করছেন, তাও স্তন্য দান করা; আবার বর্ষণ বা সোমধারা হয়ে আকাশ থেকে বর্ষিত হয়ে, আমাদেরকে প্রাণ দিচ্ছেন, তাও স্তন্য দান। আত্মস্তুতিময় 'অন' বা প্রাণ, সর্ব্বত্র অনাত্মবোধ দূর করে যে আত্মপ্রকাশ করছেন, তাও 'স্তন্‌'। এই জন্য বৃহদারণ্যক উপনিষদে ইন্দ্রকে 'স্তনয়িত্নু' বলা হয়েছে। অনাত্মবোধ যা আত্মজ্ঞানকে আবৃত করে রাখে,তা বৃত্র। আত্মস্তুতি-স্তনয়িত্নু বা বজ্রের দ্বারা ইন্দ্র বৃত্রকে হত্যা করেছিলেন। আত্মচক্ষুমান্ বা সহস্রলোচন ইন্দ্র আত্মস্তুতির দ্বারা বৃত্র রূপ অনাত্মবোধকে হত্যা করেছিলেন। ইন্দ্র জন্মেই মাতৃদুগ্ধ পান করেছিলেন—ঋক্‌ বেদ ৩য় মণ্ডল সুক্ত ৪৮ দ্রষ্টব্য। 
ছন্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৮।১২।২ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৯।৬ দ্রষ্টব্য। 
------------------------------------------------------------
ভক্তির দোহাই, যোগের দোহাই,এ-সব এখানে চলবে না। ভক্তি নিয়ে মা মা করে গড়াগড়ি দিবি, সে এখানে নয়। এখানে জাতবেদাকে দেখ—দূরং হি অস্যা মৃত্যুঃ।*
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*দূরং হি অস্যা মৃত্যুঃ—বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৩।৯ দ্রষ্টব্য ।
...........................................................................

মৃত্যুকে যে মৃত্যু দেয়, সেই মূর্তির উপাসক তুই। যতক্ষণ মরণ বলে একটা কথাও ফুটবে, ততক্ষণ মরণ বেঁচে আছে, ততক্ষণ তার হাত থেকে তুই অব্যাহতি পাবি না, ততক্ষণ মৃত্যু ছুটেছে তোর পিছু পিছু তাই এমন মূর্ত্তি চাই, সমস্ত মরণটাকে যে দেখে নিয়েছে। গুরু ভিন্ন এ কেউ দেখতে পারে না। গুরু যদি গার্হপত্য অগ্নি জ্বেলে দেয়, তবেই সে দেখে। যদি গার্হপত্য অগ্নি না জ্বালিস, দক্ষিণাগ্নি না চিনিস, আহবনীয়কে আবাহন না করতে পারিস—no compromise ।প্রথমে গার্হপত্য অগ্নি জ্বালতে হবে। কি করে জ্বালবি ? ঋক্‌ । যা কিছু আমার ইন্দ্রিয়ে প্রত্যক্ষ হয়ে রয়েছে, সে সব জাতবেদার ঋক্‌। এটা গাছ, এটা জল, এটা গুরু, এটা ভগবান্‌—এ-সব জাতবেদার ঋক্‌। ঋকের একটি মন্ত্র হল 'কালিকা', সে জ্বলেছে ? তার কি কি তনু ! পৃথিবী, অগ্নি, অন্ন, আদিত্য। আগে পৃথিবী বুঝি। 
---------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
তিন অগ্নি : স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা, যাঁর দ্বারা আমরা প্রাণময় এবং কাল-গতিময়, সেই প্রাণাগ্নির তিন প্রকার যে অভিব্যক্তি, তার নাম গৃহপতি অগ্নি, দক্ষিণাগ্নি (অন্বাহার্য -পচন অগ্নি), এবং আহবনীয় অগ্নি। 
তিন অগ্নি এবং তাঁদের তনুর বিষয়ে ছন্দোগ্য উপনিষদের চতুর্থ খণ্ডের একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ খণ্ড দ্রষ্টব্য। 
----------------------------------------------------------
জাতবেদা এই ঋক্‌ আকারে, বেদরূপিণী আকারে, প্রতি শিখা আকারে, পৃথিবী মূর্ত্তি হয়ে চলেছেন। এই ঋক্‌ যে দেখতে শিখেছে, একেও—এই কাঠ মাটি আদি দিয়ে যাকে গড়েছিস, একেও ঋক্‌ বলে দেখবে। তবেই পূজা হবে। 
----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
'একেও—এই কাঠ মাটি আদি দিয়ে যাকে গড়েছিস, একেও ঋক্‌ বলে দেখবে' : অর্থাৎ মৃন্ময় প্রতিমা জাতবেদার একটি ঋক্‌, একটি গতিময় বা প্রাণময়/বেদনময় এবং বর্ণময় দীপ্ত প্রকাশ।
------------------------------------------------------------
আর এই যে ঋক্‌, এই যে বেদগতি, এ কেমন করে উড়ে আসছে ? বাইরের জগৎ থেকে তোকে স্তন্য খাওয়াবার জন্য, মধু খাওয়াবার জন্য মধুকরের মত উড়ে উড়ে আসছে। দেখলি ? নারী, স্ত্রী, পুত্র, চন্দ্র, আকাশ—এ- সব উড়ে উড়ে আসছে ?  দেখবার এ সৌভাগ্য তোর হয়েছে ? কি করে হল? ঐ ঋক্‌ থেকে মন্ত্ররূপ মধুকর তোর বুকে ঢুকল। যে পথে ঢুকল, তার নাম যজুঃ। 
এমন করেই মা সব তৈরি করে রেখেছে যে, এ-সব এসে
পড়ছে, পড়ছে, পড়ছে। তুই নাস্তিক—তাই বলছিস এটা মাটি। "ভগবান্‌ খুঁজতে বেরিয়েছি। দূর! এখানে হবে না, বনে চল।" অমনি তুই বেরিয়ে পড়লি।
জাতবেদা অনল, বহ্নি জ্বলছে। বহতি ইতি বহ্নিঃ। মাদুর বা বিছানার মত একটা কিছু পড়ে আছে, তা নয়; মা চলেছে—চলেছে। তুই গাঁট্টাগোট্টা হয়ে বসে আছিস; ভাবছিস আর সবাই মরছে, আমি যেমন তেমনি আছি। এ শুধু বয়ে যাচ্ছে, তা নয়; বাতাস যেমন স্নিগ্ধতা খাওয়ায়, তেমনি এ তোকে খাওয়াতে খাওয়াতে চলেছে। তুই তখন বলছিস,—" আমি প্রাণবন্ত।" আর সেই বওয়াটা যেমন বন্ধ হল, অমনি " চোখে দেখতে পাচ্ছি না, হাতটা চলে না", ইত্যাদি সুরু হল। ঐ যে তোকে খাওয়াচ্ছিল, সে যেমন সেটা বন্ধ করল, অমনি তুই দেখতে শুনতে পেলি না, মরতে যাচ্ছিস। কিন্তু তোর যদি জানা থাকত, যে ও কোন রাস্তায়, কেমন করে আসছে, আর কি খেতে খেতে তুই চলেছিস, তা হলে মরণ আসত না। ওঁ জাতবেদসে সুনবামং সোমং। 'সোমং' কাকে বলে ? দাঁতটাত বার করে হেসে ত নিলি; কিন্তু সোমং বলে কি দিলি ? উমা ও শিব। এখানে, বুকেতে যে তাদের একটা জানোয়ার করে তুলেছিলি, একটা মানুষ হয়ে বসেছিলি, যেমন বললি 'সুনবাম সোমং,' অমনি ইনি হলেন চন্দ্রশেখর শিব ও মা—সোমং সুনবাম। আবার নতুন করে তোমায় ফুটিয়ে তুললুম। একেবারে শক্তিহীন, একটু একটু চোখ ইত্যাদি নিয়ে মানুষ হয়ে বসেছিলি, তাকে ফুটিয়ে তুললুম শিব ও উমা করে। আমাকে ফাঁকি দিতে পারবি না। গার্হপত্য অগ্নি জ্বালতে হবে। তারপর দক্ষিণাগ্নি—অনুশাসক অগ্নি। বাড়ীর ভিতর ঢুকতে হলে, ঠিক ঐ কবাটের মধ্য দিয়ে ঢুকতে হবে। ওর চেয়ে বড় মোট ওতে ঢুকবে না। কে কবাট হয়ে আছে নক্ষত্ররাজিবেষ্টিত চাঁদ। আমি সূর্য্যকে বেষ্টন করেই আছি, ভাল ছেলে হয়েছি, তাতে হবে না। চাঁদ যেমন সূর্য্যকে পাক দিয়ে চলেছে, তেমনি তোমাকে পাক দিয়ে দিয়ে, তোমাকে খেতে খেতে আমি চলেছি, প্রথমে এইটি দেখলে দক্ষিণাগ্নিতে ঢুকতে পারবে। আজকে চলেছি।আহবনীয় অগ্নি হয়েছে আমার আহবা মা। গার্হপত্যের সঙ্গে যেখানে আহবনীয় সংযুক্ত হয়, সেইখানে চাঁদের রস বয়ে যায়। গার্হপত্যকে যদি আহবনীয়তে সংযুক্ত করতে পার, তবে দক্ষিণাগ্নি তোমাতে সর্‌-সর্‌ করে বয়ে যাবে। প্রথমে গার্হপত্য অগ্নি এই প্রতিমায় স্থাপন করলাম। তার মানে, যে-কোনও বস্তু অবলম্বন করে তাকে ঋক্‌ বলে চেন। ওঁ জাতবেদসে সুনবামং সোমং। জয় মা!, জয় মা!, জয় মা! কেন মা বললুম ? আন্দাজে একটা মা বলে ফেললুম কি ? কোন সম্পর্ক জ্ঞান নেই, ফস্‌ করে মা বলে ফেললুম, না আমি দেখতে পাচ্ছি যে ওতে আমাতে একত্ব পেয়েছি। ধূ ধূ করে জাতবেদা জ্বলছে। জাতবেদা মানেই সাম। যেখানে জাতবেদা, যেখানটায় আপনি আপনাকে জানছি, ঐ খানটা সাম।
 --------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
সাম : যিনি সবার সাথে সমান, যিনি প্রাণ, যিনি বাক্‌ হয়ে প্রাণ-রূপ নিজেকে বহু করেন, তিনি সাম; বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ১।৩।২২ দ্রষ্টব্য।
----------------------------------------------------------
আপনি আপনাকে। এ মাকে জ্বালাব, তাতে আশ্চর্য্য কি? ঋক্‌ হলে, তবেই যজুঃ হয়ে সামে একসা হয়। জাতবেদা বলেছ কি, এখান থেকে আহবনীয়ে যাবার রাস্তায় বিচরণ করছ। তাতে কে জ্বলে উঠল ? যে তোতে ইন্দিয়াদির মূর্ত্তি ধরেছে, যে ভিন্ন কেউ মননকারী, প্রাণনকারী নেই, তাকে দেখছি যেমন প্রদীপ জ্বলে  থাকে। ঐ মধু ঋক্‌, হৃদয় দিয়ে তাতে যুক্ত হয়ে গেল। গাছ থেকে ফল পাড়তে যেও না। তোমাতে কোথায় সে আসছে, কোথায় মধু পড়ছে ? কে খাচ্ছে ? পুত্র, স্ত্রী, টাকাটা কে খাচ্ছে ? তুই ? দূর্‌ , দূর্‌ ! তুই নয়। যদি বলি টাকাটা তোমার নয়, তা বলতে দেবে ? ঋক্‌ থেকে, যজুতে গিয়ে সামে একত্ব পাচ্ছে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যা কিছু আছে, সেই বিশ্ব ঋক্‌, তোমার ভোগের জন্য এখানেই প্রবিষ্ট হচ্ছে। এই যে মধুচক্র, যাতে সব ঋক্‌ এসে পড়ছে, সে হল আদিত্যমুখী এই ভগবতী। সে পিছনে লুকিয়ে আছে, তোর ভিতরে যাতায়াত করছে।
কি রে, খেয়েছিস ? দেখা যাচ্ছে ? আজ আনন্দ-মধু চাইছি না, আজ অভয়-মধু দাও।মৃত্যু ভয়ে জর্জ্জরিত হয়েছি, শুধু বোমার* ভয়ে নয়।
--------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* বোমা : ১৯৪১ সালে ভারতবর্ষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশেষ ভাবে লিপ্ত ছিল।  
--------------------------------------------------------

চিরদিনের যে মরণ—মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে যাওয়া, এ থেকে অভয় দিতে হবে। মরণ বলে আর কোনও কথা যেন না থাকে। সেই জন্য, এই ঋকে, এই প্রতিমায়, জাতবেদাকে আবির্ভূত করছি। ঋক্‌ হল হং—অনন্তভূবনা; এ  তান্ত্রিক নাম। অনন্তভূবন মানে বাহ্যাকাশ। আর যা কিছু, সে সব তার অবলম্বনে ফুটে উঠেছে। এই যে হং, একে আমি সোমস্রাবী করব, এ থেকে সোম বার করব। কেমন করে ? ঋকে যদি জাতবেদাকে সংযুক্ত করতে পারি। এই প্রতিমা তোমার ঋক্‌। এ মূর্ত্তি কে ধরেছে ? জাতবেদা। সত্যি ? তবে কাকে দেখছিস ? যো'য়ং অস্মিন্‌ অন্তরে তেজোময়ঃ অমৃতময়ঃ পুরুষঃ, অয়মেব সঃ।*
---------------------------------------------------------- 
প্রকাশকের মন্তব্য।
*বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ দ্বিতীয় অধ্যায়, পঞ্চম ব্রাহ্মণ দ্রষ্টব্য ।
---------------------------------------------------------- 

এক কথায় বেদ একে বললেন—জাতবেদা। বহিরাকাশ থেকে এ যখন এই রূপ মূর্তিতে ফোটে, তখন নাম হয় ঋক্‌, গতিশীলা। এই যে কত বিচিত্র বর্ণ তোমাতে ধরেছে। একটা দিন চলে গেল রে। তুই যদি ওর সঙ্গে সঙ্গে যাস, তবে কি ও যেতে পারে ? চল চল চল। এই সঙ্গে সঙ্গে না চললেই মৃত্যু, গুরুর সঙ্গে যদি না চলেছ ত মৃত্যু। ঐ হল ঋক্‌—জাতবেদার দর্শন।জাতবেদার দর্শন মানে হল সোম। তাতে এবার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করি। যখন হংস বলব, তোমরা যেন হাঁস মনে করো না। মনে করো—গুরু আমার এই ঋকে জাতবেদাকে প্রতিষ্ঠা করবেন। বাঁচতে যদি চাও ত তোমরাও এখানে জাতবেদাকে জোড়। মরবার সময় যেমন করে বেরিয়ে যাবি, তেমনি করে বেরিয়ে, চলে আয়, এই মায়ের বুকে। বল্‌ মা ! মা ! [উচ্চ রোল] 
**ওঁ হংসঃ শুচিষদ্‌বসুঅন্তরীক্ষসৎ হোতা বেদিসৎ অতিথির্দুরোণসৎ নৃসৎ বরসৎ ঋতসৎ ব্যোমসৎ অব্জা গোজা ঋতজা অদ্রিজা ঋতং বৃহৎ। হং সঃ । ওঁ নমো নমঃ। বল হংসঃ শুচিষৎ [মণ্ডলী তাই বলতে থাকল।
গুরু একখানা জলচৌকির উপর উঠে, প্রতিমা জড়িয়ে ধরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে লাগলেন।] বল মা ! মা ! [উচ্চ রোল] খাঁড়া হাতে করে গুরু মণ্ডলীর দিকে ফিরলেন।] মরণভয়দলণি ! এই তোমার দ্বিধা করার খড়্গ—গৃহাণ।রক্ষ মাং। রুদ্রের ত্রিবৃতের ত্রিশূল, যা দিয়ে তুমি বিশ্ব সংহার* কর, তাই তোমার হাতে দিচ্ছি।
-------------------------------------------- 
 প্রকাশকের মন্তব্য। 
* ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ খণ্ডের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে ত্রিবৃতের বিষয়ে বলা হয়েছে ।
** "ওঁ হংসঃ শুচিষদ্‌..."— কঠোপনিষদোক্ত এই মন্ত্রের বিশদ ব্যখ্যা মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের দুর্গপূজার অষ্টমীর দিন বিশেষ ভাবে ব্যাখ্যা করেন। ঐ পূজার বিবরণ এই লিঙ্কে পাবেন : https://upanishadinbengali.blogspot.com/2024/02/durga-puja-of-1941-in-bengali-language.html
--------------------------------------------------------

দেবি, রক্ষ মাং। ত্রিশূলপাণির্ভব। চক্র—বিষ্ণুচক্র মায়াময়—এই তোমার হাতে দিলাম, দেবেশি, আমাদের চারিদিক থেকে রক্ষা কর। এই দিলাম তোমার অক্ষসূত্রএই সূত্র দিয়ে তুমি বিশ্বজাল বেঁধেছ ।এই সূত্র তোমায় দিলাম; এর দ্বারা তুমি আমাদের ভয় বিদূরিত কর। স্বর্গ থেকে, দ্যু থেকে ভূ পর্য্যন্ত যে শক্তির দ্বারা তুমি সব নিয়ন্ত্রিত করছ, সেই এই ইন্দ্রের বজ্র তোমার হাতে দিলাম, আমাদের তুমি নিয়ন্ত্রিত কর। তোমায় বরুণের পাশ দিলাম, আমাদের উদ্ধার কর। দিলাম তোমায় যমের দণ্ড; যারা তোমার পথে চলে না, এই যমদণ্ডের দ্বারা তাদের নিয়ন্ত্রিত কর। দেবেশি, মায়ের মত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, মায়ের মত আমাদের রক্ষা কর। ওঁ মণিধরি বজ্রিণি, মহা প্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ রক্ষ। শাঁখ বাজা রে ! [ বহু বহু শঙ্খের সম্মিলিত রোল ]। জাতবেদা মাকে আমরা অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত করলাম। অস্ত্ররাজি মায়ের হাতে সমর্পিত দেখলাম। মা এ-সব ধরেছেন। সপ্ত বজ্র* মায়ে অর্পিত করেছি। 
---------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*সপ্ত বজ্র—খড়্গ, ত্রিশূল, চক্র, অক্ষসূত্র, বজ্র, পাশ, যমদণ্ড।
--------------------------------------------------------

এই বার তোমরা অষ্টম* বজ্র অবলম্বন কর, করে গার্হপত্য অগ্নি স্থাপনা কর।এখনও কোন্‌ অস্ত্র দিইনি ? বাক্‌*—কৌমারী শক্তি। ক্রীং। 
---------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*  ১। বাক্‌ অষ্টমী ব্রহ্মণা সংবিদানা— বৃহদারণ্য্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।২।৩ দ্রষ্টব্য।
* ২। হিমাচল প্রদেশের অন্তর্গত কাংড়াতে অষ্ট-বজ্রেশ্বরী দেবীর মন্দির আছে। এই স্থানে মহারাজ দণ্ডীর পক্ষ নিয়ে, কৌরব এবং পাণ্ডবরা একত্রে, উর্বশীকে মহারাজ দণ্ডীর অধিকারে রাখবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ এবং দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এই স্থানে অষ্ট বজ্রের সম্মিলন হয়, এবং উর্বশী
স্বর্গে প্রত্যাগমন করেন। এই পূজাতে মহর্ষি বিশেষ ভাবে উর্বশী, অষ্টবজ্রের
সম্মিলন, এবং স্তন্য-পায়ী ইন্দ্রের কথা বলেছেন। উল্লেখযোগ্য যে এই স্থানটি একটি সতীপীঠ, এবং এখানে সতীর বাম স্তন পতিত হয়েছিল।
---------------------------------------------
এমন ভাবে চলে যাবি যে, এই মন্ত্র জাতবেদায় উচ্চারণ করবি। বীরাসনে বস মুর্খরা ! যাত্রা শুনতে এসেছিস ? খড়্গ, ত্রিশূল, চক্র, অক্ষসূত্র, বজ্র, পাশ, যমদণ্ড দিয়েছিস ? অষ্ট বজ্র একত্র সমাহিত না হলে উর্ব্বশীর উদ্ধার হয় না। যে মাকে এখন তুই শূদ্রাণী করে ভোগ করছিস, উর্ব্বশী করে, বাম উরুতে বসিয়ে, উরুদেশে মাকে জাত দেখছিস, এই মাকে অষ্টবজ্রধরা করে তুলতে  হবে। অষ্ট বজ্র হল ওর। সপ্ত পর্য্যন্ত দিয়েছিস, এইবার অষ্টম বজ্র দে। ক্রীং। জাতবেদা ক্রীং। জাতবেদসে সুনবাম সোমং।
পরপর, পরপর এই মা। আর তারই বুকে আপনি শক্তিরূপে জাত হয়েছে—পরপর, স্তরে স্তরে আপনাকে শক্তিরূপে ক্ষেপণ করেছে, তবে প্রত্যেকটিকে গড়েছে। প্রতি তৃণটি, প্রতি কীটটি এই সপ্ত বজ্রে রচিত। কুমার আমার ! তুই আর এই মর্ত্তে থাকিস না। আজ তোকে সেই মহতী শক্তি দেব; তাইতে দেখবি—তুই বিশ্বম্ভরীর ছেলে। এই সপ্ত বজ্র; কৌমারী শক্তি দিয়ে একে সম্পূর্ণ, সম্যক্‌ করে তোল, অষ্ট বজ্রের সংযোগ কর। তা ত আগেই করতে হয়েছে; কেননা, কথার দ্বারা সব করে আসছিস। এখন খালি একে জ্যান্ত করা। কেননা, এইটি মরে থাকে। অস্ত্রের পর অস্ত্র, লোকের পর লোক; মহা শক্তি মা আমার আপনাকে মোটা মাটি পর্য্যন্ত করে গড়েছে। আপনাকে সাজিয়েছে মৃত্যু, আপনি সেজেছে মৃত্যু, আপনই সেজেছে মর্ত্ত্য, মৃত্যুর দ্বারা অনুশাসিত। তাকে দেখতে হবে। এ যে আর কেউ নয়, তাই দেখতে হবে। ওঃ খড়্গধারিণী ! আর কিছু নয়, আপনাকে খট্টাঙ্গ করেছে। এইটি থেকে গৃহপতি অগ্নি জ্বালতে হবে। যদি মাটিতে খড়্গধারিণীকে না দেখ, তবে মাটি হয়ে গেল। দেখলে হয়ে গেল জাতবেদা। ওই মাটি থেকে বেরোল যমের দণ্ড, বরুণের পাশ—যারা তোমায় বেঁধেছিল। তাই তাদের তোমার গলায় মালা করে দিলুম।
তুমি ইন্দ্র—জড়ের পড় জড় সেজেছ। কিন্তু এই বৈদ্যুতী শক্তি, প্রকাণ্ড আকর্ষণী শক্তি মায়েতে এবং তোমাতে রয়েছে। তোমার কথাটা চক্‌চক্‌* করে ছুটতে লাগল। এখন তুমি ইন্দ্র হয়েছ। তোমার বাক্য আর বাক্য নয়,সে বিদ্যুৎ। কৌমারী শক্তির সাহায্যে এই ইন্দ্রত্ব তোমায় নিতে হবে। ঐ তোমার ইন্দ্রত্ব রক্ষা করবে। 
---------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*তোমার কথাটা চক্‌চক্‌* করে ছুটতে লাগল। এখন তুমি ইন্দ্র হয়েছ : .......ইন্দ্র ইৎ হর্যো সচা সম্মিশ্ল  আ বচোযুজা । ইন্দ্রো বজ্রী হিরণ্যয়ঃ।। অবশ্যই ইন্দ্র বাক্‌-রূপ অশ্বদ্বয়-যুক্ত হয়ে আসছেন; সকল কিছু যাঁতে মিশে যাচ্ছে (সেই) ইন্দ্র বজ্রধারী, হিরণ্ময়। ঋক্‌ বেদ ১।৭।২। 
---------------------------------------------
ঐ খড়্গ-ত্রিশূল-বজ্রধারিণী মায়ের সন্তান তুমি। তখনই তুমি অসুর তাড়াতে পাড়বে, যখন তোমার বাক্যের এই কৌমারীশক্তি তুমি দেখবে।এতেই মা* থেকে আমি পর্য্যন্ত সব জাত হচ্ছে। আমার কথা বলতে এখন বুঝি এক কৌমারী শক্তি। সে মা থেকে জাত হয় এবং মায়েতেই ফেরে*।
----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
* এই আত্মা নিজেই নিজের শক্তি বা স্বয়ংশক্তি।
-----------------------------------------------------------
যেমন আকাশ থেকে বজ্র বেড়িয়ে আবার আকাশে ফিরে যায়*।এই হল তোমার কথার বীর্য্য
-----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
* ছান্দোগ্য উপনিষদ মন্ত্র ৮।১২।২ দ্রষ্টব্য। 
------------------------------------------------------------
তাতে সাপ কি ব্যাঙ্‌, যা থাকবে তাই ছুটবে। যা ছুটবে, তার দাম নেই, দাম আমার এই কথার। সে দ্যুক্ষেত্র থেকে, ভগবতী থেকে এই মর্ত্তভূমি পর্য্যন্ত চড়াক্‌ করে উঠছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। 'তুই' বলে এখানে কেউ নেই, একমাত্র জাতবেদা আপনার মহতী শক্তি বিস্তার করে রয়েছে। ক্রীং অতঃ করালঃ। এই জন্য ওর নাম করাল। ক্রীং ওর মূর্ত্তি—করোতি, করোতি, করোতি। ও এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে জল খায় না, বাঁধা ঘাটেও নয়; কেবল স্রোত স্রোত—মা চলেছে। ক্রীং অতঃ করালঃ। এত দ্রুত করছে, যে সে করা দেখা যায় না; করছে অথচ ঠিক আছে, এজতি, নৈজতি, করছে সব, আবার ঠিক আছে। অতএব ঘোরা। এত নিবিড় করা যে, যে করা বলে দেখা যাচ্ছে না। ক্রীং—এই মন্ত্রে অগ্নিস্থাপনা করলি। ও কি বলতে বলতে যাচ্ছে রে ? আমি কালা শুনতে পাচ্ছি না। তোদের কাণ আছে, তোরা শুনতে পাচ্ছিস ? কি বলছে ? "আমার প্রাণ চাইছে—আমি তোদের প্রচুর দিয়ে যাই।" আমি ব্রহ্মা থেকে শিব পর্য্যন্ত এবং শিবের ঝুঁটি ধরে মাটি পর্য্যন্ত ধরে ধরে ফিরব। অনুলোম এবং বিলোমের এই খেলা চলছে। এই মাকে স্থাপনা করেছি এই প্রতিমায়। ক্রীং। ওরে খণ্ডদর্শীর দল ! তোদের ভয় পাবার দরকার নেই। মা ছুটেছে, তুই তারই বুকে আলাদা হয়ে বসে আছিস, গাড়ী যেমন তোকে বুকে করে বৃন্দাবনে নিয়ে যায়। এমন মা ছাড়া আর কিছু খাবি ? আর কিছু দেখতে গেলে যমদণ্ডে পড়বি। কৌমারী শক্তি ও যমদণ্ডের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। যে জন্মাবামাত্র মাতৃস্তন্য পান করে, সে ইন্দ্র*।
-----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*ঋক্‌ বেদ ৩। ৪৮।১,৩।৪৮।২, ৩।৪৮।৩ মন্ত্র দ্রষ্টব্য। 
-----------------------------------------------------------

জন্ম কখন হয় ? প্রতি বাকে বাকে। নিরন্তরং জায়তি ইতি নিজঃ। প্রতি কথায়—thought and thought, world and world জন্মাচ্ছে। সাপ বলেছ, ব্যাঙ্‌ বলেছ, ভিতরে তাই হয়েছে। বলেছ কি হয়ে গেছে, তাতে ভূলটি হবার যো নেই। finished। সুতরাং কৌমারী শক্তি চাই। কি বলছ ? ব্যাঙ্‌ । কাকে বললে ? মাকে ।কি বলছ ? সাপ । কাকে বললে ? ক্রীংকে। কি বলছ ? কালী, ব্রহ্মা। কাকে বললে ? ক্রীংকে। কোথায় বললে? ক্রীং— যে ছোটে ও হয় ও ভোগ করে।সোমেতে ও কালেতে একসাথে একসঙ্গে মিশ্রিত* হয়েছে, সেই গতি হল তোমাদের অগতির গতি। এর স্রোতে মিশতে না পারলে হবে না। কাকে জাতবেদা বললি—ক্রীংকে। ওটা কি শব্দ রে—যিনি পুনঃ পুনঃ আপনাকে কর্ত্তিত করছেন ? কাটবা মাত্র ত্রিশূল জন্মাচ্ছে, তা জন্মানমাত্র instantly চক্র জন্মাচ্ছে ? যে কুমার, যে ছেলে, যে ধরতে শিখেছে, সে বলে— "যাই হও মা, আমি তোমায় ধরেছি।" সেটা মদের বোতলই হক বা স্বর্গের অমৃতই হক। এই হল তোমার জাতবেদার আহবনীয় মূর্ত্তি, যাকে তোমরা আবাহন করছ। এতে কি কি তনু আছে ? প্রাণ, বিদ্যুৎ, আকাশ, দ্যু**। তার মানে ?
-------------------------------------------------------------

প্রকাশকের মন্তব্য।
* সোমেতে ও কালেতে যে মিশ্রণ, তা জাতবেদার  'জানাতে এবং হওয়াতে' যে সংমিশ্রণ—তাই : এই বিজ্ঞান মিশ্রদেশ বা মিশরে একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঋক্‌বেদ মন্ত্র ১।৭।২ : "ইন্দ্র ইৎ হর্যো সচা সম্মিশ্ল আ বচোযুজা । ইন্দ্রো বজ্রী হিরণ্যয়ঃ।।—এই মন্ত্রে ইন্দ্রকে 'সম্মিশ্ল' বা 'সংমিশ্র' বলে অভিহিত করা হয়েছে। 
**ছান্দোগ্য উপনিষদ মন্ত্র  ৪।১৩।১ দ্রষ্টব্য।
-------------------------------------------------------------
যেখানে আপনি আপনাকে হারাচ্ছে না, সেই দ্যু। 
প্রাণ—যে উঠলে দেখি, আর চালাকি করার জো নেই। তখন আমাকে মড়া বলে ফেলতে পারবে না; কেন না, আমি প্রাণকে চিনেছি। কাঠ, জল ইত্যাদি তুচ্ছ জিনিষকে 'আমার প্রাণ, আমার প্রাণ' করে কত আদর করেছি। এখন দেখছি—প্রাণ তিনি, যিনি চললেই যা কিছু আছে, সব চলে যায়। তোর ব্যাটা তখন কাছা ধরে টানছে,—"কোথা যাচ্ছ, চেকখানা রেখে যাও না।" ঐরূপ যার গতি, সর্ব্বস্ব নিয়ে যে ছোটে, সেই হল ক্রীংয়ের প্রণপাদের গতি। বিদ্যুৎ—মায়েতে আমাতে ঠিক রয়েছি, ঠিক রয়েছি*, এমনি বিদ্যুৎ, এমনি দ্যু, এমনি প্রাণ নিয়ে এবার আকাশে চল। 
-----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*মায়েতে আমাতে ঠিক রয়েছি--বিদ্যমান রয়েছি—ইতি বিদ্যুৎ ।
-------------------------------------------------------------
আকাশ মানে ? প্রজ্ঞান। anything coming out tin the form of words—যে কোনও প্রজ্ঞা।বিদ্যুৎময়, দ্যুময়, প্রাণময় । এইবার তার উপর কথার জামা পর। পুত্র বল, ধন বল, আর ব্রহ্মা বল, বিষ্ণু বল, এইখানে যে কথায় ঢুকল, সে কি আর মড়া হয়ে বেরোবে ? সে যেখানে যে দিকে যাবে, সমস্ত দুনিয়া, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্য্যন্ত তার সঙ্গে চলবে। এই দধিক্রাকে* দেখালুম। 
----------------------------------------------------------

প্রকাশকের মন্তব্য।
দধিক্রা—দধ্‌ (ধারণ করা) +ই (চলা)  + ক্র (ক্রমণ; গতি-ক্রম)- যাঁর গতিক্রম বা চলাই হল সবাইকে ধারণ করে চলা। সবাইকে নিয়ে যিনি চলেন তিনি প্রাণ। হৃদয়ের দ্বারা ধারণ করে ইনি চলেন, তাই ইনি সর্প; কেননা সাপেরা বুকে হাঁটে। তাই বেদ এঁকে 'সসর্পরি/সসর্প' বলেছেন। 
-----------------------------------------------------------

আমার 'অদ্য'ও নেই, 'কল্য'ও নেই, অদ্য কল্যকে আমি জাত করছি। আমি এক জায়গায় বসে অনন্ত দেশ ঘুরে আসি। আমার অদ্য অর্থাৎ ভোগ কিছু নেই, কল্য অর্থাৎ কলন নেই; অথচ আমি অদ্য কল্য সৃষ্টি করে চলেছি। এই আমার মা ! তোদের মাই খাওয়াতে আমার মুখ দিয়ে মা প্রকাশ হচ্ছে। 
স্নান করা। এবারকার পূজায় স্নান সামান্য, অগ্নি বেশী।
গার্হপত্য অগ্নি। ক্রীং। আমার অদ্যও নেই, কল্যও নেই; আমি অদ্য কল্য প্রসব করি। ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে। ক্রীং স্বাহা। খেতে খেতে 
যাচ্ছ ? না বসে বসে খাচ্ছ ? না খালি যাচ্ছ, খাচ্ছ না ? খাচ্ছও, যাচ্ছও। এতক্ষণ কোথায় ছিলে ? ওঁ ক্রীং। ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে। জয় মা ! জাতবেদা মা আমার ! জাতবেদা মা আমার ! দিনকে রাত করে দাঁড়িয়েছিস, এবার রাতকে দিন কর। ঐং হ্রীং ক্লীং জাতবেদায়ৈ বিচ্চে স্বাহা। [ প্রতিমার মাথায় জল ঢালা, গা মোছানো ইত্যাদি। প্রতিমার প্রতি ] বসে বসে যেমন খাচ্ছিস খা। আবার এ-সব ইচ্ছা হয়েছে কেন ? তারা ! জাতবেদা ! 
[ মাকে কাপড় পরাবার সময় হস্তস্থিত একটি অস্ত্র খোলা হইলে ] ওর অস্ত্র খুলিস না, খুলিস না রে ! বল্ তারা ! তারা ! [ ১২টা ২৫ মিনিটে প্রথম পর্ব্ব সমাপ্ত। ]

       [ ১২টা ৪০ মিনিটে দ্বিতীয় পর্ব্ব আরম্ভ। ]

ক্রীং । ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ। জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। [প্রজ্বলিত অগ্নি দেখিয়ে] ঐ হল তোমার গার্হপত্য অগ্নি। এই বেদিতে যা ভোগসম্ভার রয়েছে, সে দক্ষিণাগ্নি। আর এই প্রতিমা হল আহবনীয়াগ্নি। তুমি ঐখানে যে কথা বলবে, যে আকাশ প্রবাহিত হবে, তা যাবে ঐ মায়ে। আজ বুক চাইছে খালি অভয়, তাই কেবল অভয়াকে সেবা করতে চাইছি। ক্রীং অভায়ায়ৈ নমঃ। ভোগের ভিতর দিয়ে এস বৎস। মায়ের অভয় ভোগ করতে করতে,  অভয় ভোগ করতে করতে, এস। কেননা ঐ ঋক্‌ অগ্নি, ইনিই ঋক্‌ হয়ে ওখানে দাঁড়িয়েছেন। তাই এই ভোগের ভিতর দিয়ে এখানে চলে এস। ক্রীং। এইখানে অভয়ার আহুতি দিলে। দক্ষিণাগ্নিতে সেটা ভোগ কর। খালি 'অভয়া' বললে কি হবে; ছেলে, স্ত্রী, পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে যদি বাঁচতে চাস, তবে অভয়াকে ভোগ কর। 
একজন আগুনে আহুতি দিলেই হবে। তোরা দক্ষিণাগ্নির
ভিতর দিয়ে চলে আয়। এতৎ পাদ্যং ক্রীং অভায়ায়ৈ নমঃ। ঐ মর্ত্ত ক্ষেত্রে গার্হপত্য অগ্নি রেখেছিস। এই অন্তরীক্ষ ক্ষেত্র, আন্তর ভোগ; দেখতে চাল, কলা, নৈবেদ্য বটে, কিন্তু অভয় দিয়ে গড়া। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। তোরা ও-পাশ থেকে যে পরিমাণে আহুতি দিলি, সেই পরিমাণে এখান থেকে নেমে মা  ওখানে গেলেন। স্বর্গ থেকে মর্ত্তে, আবার মর্ত্ত থেকে স্বর্গে। ক্রীং কি ভয়ানক মন্ত্র। কি রকম বল ত ? ও মন্ত্র দধিক্রা, সর্ব্বস্ব গায়ে মেখে নিয়ে ছুটছে, কিছু ফেলে আসে না, সব নিয়ে ছুটে আসে। তোরাও মরবার সময় যেমন করে বেরিয়ে আসিস, তেমনি করে প্রতি কথায় সর্ব্বস্ব নিয়ে ছুটে আয়। এরই নকলে, আমরা যাকে যখন ভালবাসি, লজ্জ্বা সরম কিছু থাকে না; তাকে সবটা দিয়ে দিতে ছট্‌ফট্‌ করি। এই আমার মায়ের গতি। কি লাগাম বেঁধেছিস দেখ। লৌহ খণ্ড* দাঁতে চিবোতে চিবোতে চলেছে। 
-----------------------------------------------------------

প্রকাশকের মন্তব্য।
*লোহ-—যা লোহিত বা লাল; রুহ্‌ ধতু থেকে লোহ এবং লৌহ শব্দটি হয়েছে। রুহ্‌ ধতুর অর্থ  'বর্দ্ধিত হওয়া', নিজেতে নিজে আরূঢ় হয়ে নিজেকে বর্দ্ধন করা, মূর্ত্ত করা।' তাই এই ভৌতিক বিশ্ব প্রাণের লৌহ মূর্ত্তি। প্রাণরূপ দধিক্রা এই বিশ্বকে আকৃষ্ট করে নিজেতে ধারণ করে চলেছেন । এইজন্য 'লোহ- মণি' শব্দের অর্থ চুম্বক। 
-----------------------------------------------------------

ওর লাগামে সেদিন কি জুড়েছিল, ছেলে ? আজ তোরা কি জুড়েছিস ?অভয়া।ইদং অর্ঘ্যং ক্রীং অভায়ায়ৈ নমঃ।
যদি এমন করেই বাঁচাতে পারিস, তবে আবার ভয় দেখাস কেন বেটি ? ইদং আচমনীয়ং ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে, ক্রীং অভায়ায়ৈ স্বাহা। ঐ যে গার্হপত্য অগ্নি, ওর তনু  কি ? পৃথিবী, অগ্নি, অন্ন, আদিত্য। এই মা অদিতি। ও আগুন জ্বলছে আদিত্য। সর্ব্বস্ব নিয়ে তবে একটা কিছু তৈরী হয়। সেই যে নিজের গোটাত্বের একটা ভাব, সেইটি আদিত্যের ভাব; এ জাত হয়েছে অদিতি থেকে। তোমরা সব আদিত্য। পুরুষ আহুতি দিচ্ছে দধিক্রামন্ত্রযে আহুতি* দেয়, সে পুরুষ*; সে সবটা নিয়ে তাল পাকিয়ে 'আমি'* বলে। আহুতি যে বয়ে নিয়ে যায়, সে ঘোড়া, সর্ব্বস্ব নিয়ে ছোটে। আর যাতে পড়ে, সে অদিতি। কি অপূর্ব্ব যজ্ঞের সমাবেশ। জগৎটা উদ্ধার হয়ে গেল রে ! কি সমাগম ! অদিতি, তার ভিতরে রয়েছে দধিক্রা, তার ভিতরে আদিত্য। মা গো, বেঁচে গেলুম, বেঁচে গেলুম, বেঁচে গেলুম।
---------------------------------------------- --------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
* বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১।৪।১ দ্রষ্টব্য ।  
------------------------------------------------------------

ইদং আচমনীয়ং ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ  বিচ্চে, ক্রীং
অভায়ায়ৈ স্বাহা।ইদং বস্ত্রং—ওখানে কি আগুন জ্বলছে?
পুনঃ পুনঃ স্মরণ করাচ্ছি। কেন না, আমি তোদের উত্তরসাধক। বৎস ! আজ বড় ভয়ানক যজ্ঞ । মরণের হাত থেকে তোমাদের উদ্ধার করতে হবে।এটা পূজা নয়,
আত্মোদ্ধার। ঐখানে জ্বলছে গার্হপত্য, আর এখানে সাজান দক্ষিণাগ্নি, রস। রস বলে জলকে, ভোগকে—যেটা ভোগে আসছে, তাকে। চন্দ্রমা—যেটা খেলি, তার দ্বারা তোরা গঠিত হস, ও তোদের তৈরি করে। এটা শুধু
খাওয়া নয়, ভোগ নয়, গতি নয়—সঙ্গে সঙ্গে সুভূত হওয়া, গঠিত হয়ে যাওয়া। আর নক্ষত্ররাজি ? তোদের সংযমিত করছে। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট ইত্যাদি রাশি। দেখি তোর কোষ্ঠি রে ! কে তোকে চালাচ্ছে ? 
দক্ষিণাগ্নির একটি তনুর নাম রস, একটি তনুর নাম চন্দ্রমা, একটি তনুর নাম দিক্‌*। ভোগের দ্বারা দিক্‌ নির্ণয় হয়—সুখে এসে পড়লুম, দুঃখে এসে পড়লুম। এই দক্ষিণাগ্নি। আর আমার মা আহবনীয়।
ইদং বস্ত্রং ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে, এতৎ 
গার্হপত্যাগ্নয়ে, এতৎ দক্ষিণাগ্ননয়ে,এতৎ আহবনীয়াগ্নয়ে, এতৎ ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা।   
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৪।১২।১ দ্রষ্টব্য। 
-------------------------------------------------------------

আসছে ? এষঃ গন্ধঃ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে। হ্যাঁ রে, চামুণ্ডা কেন বললি রে ? তিনটি আগুন জ্বেলে তোদের দেখান হল—কেমন করে ও সব প্রকাশ করে। আপনি আপনাকে গঠন করে, আপনি আপনাকে ভোগ করে ও গতিশীল হয়, আবার যেমন তেমনি থাকে। এই খেলা হল চামুণ্ডার। তার সাধারণ নাম জাতবেদা। তোর বুকে যে কথাগুলি ফুটছে, তা তুই জানছিস ত ? তেমনি যে জানতে জানতে ফোটে, সে জাতবেদা। যে আপনাকে  জানতে জানতে আপনি ফোটে, ভোগ করে, আবার আপনাতে মিশিয়ে নেয়, সে কি মড়া,না সে জাতবেদা ?
ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে, ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। কাকে দিলি রে ? সে জ্যান্ত ? নিলে ? কি রকম করে নিলে ? জানলে ? সবটাই ? তুই হেলায় দিস, কি শ্রদ্ধায় দিস, যদি জানিস যে ওতে ঠেকেছে ত ও নিয়েছে।
দৃষ্টান্ত—latheএ একটা ঘেরা দিয়ে রাখে; তাতে যদি কাপড় লাগে ত টেনে নেয়। তেমনি যে এই তিন অগ্নি দেখেছে, সে একটা ফুলটুল যাই দিক না কেন, মা তা টেনে নেয়। ভিতরে নিজে তাই না হয়ে কোনও কথা  তোদের পেটে জন্মায় না, উচ্চারিত হয় না। সেইটার মানে in toto, মা আগে নিয়েছে। সেইখানটায় তোরা জাতবেদা বলছিস। 
ঐং হ্রীং ক্লীং  চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে, ক্রীং অভয়ায়ৈ জাতবেদায়ৈ স্বাহা। ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে গার্হপত্যাগ্নয়ে,দক্ষিণাগ্ননয়ে,আহবনীয়াগ্নয়ে স্বাহা। এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। অষ্ট বজ্রের দ্বারা বিধৃত হে ধরিত্রি, হে বায়ু, হে আকাশ ! আমার শরীর তোমাদের দ্বারা বিধৃত হয়েছে, মা অধিভূত হয়ে
দাঁড়িয়েছেন। তোমরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে, নিজের দিকে দৃষ্টিরক্ষা করে বল।এ যে না করবে, সে চূর্ণ হবে।দধিক্রা অশ্বে আরোহণ করে অসুরঘাতিনী মা আমার এসেছে। ত্রিচক্রের রথ —গার্হপত্য, দক্ষিণ, আহবনীয় এই ত্রিচক্র। সাবধান ! তোমরা মাতৃধর্ম্মকে রক্ষা কর। স্বর্গ ও মর্ত্তকে বিচ্ছিন্ন হতে দিও না, স্বর্গ ও মর্ত্তের এই সংযোগ তোমরা রক্ষা কর। অসুর দূরীভূত কর, কর, কর, ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। এষঃ ধূপঃ ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। বাজাও বাজাও, শাঁখ বাজাও। [ধূপ ও দীপ ঘূর্ণন।] বল অভয়া ! অভয়া ! বল মা। মা ! ইদং সোপকরণং দক্ষিণাগ্নিনৈবেদ্যং ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। প্রাণায় স্বাহা, অপানায় স্বাহা, সমানায় স্বাহা, ব্যানায় স্বাহা, উদানায় স্বাহা। তারিণি, তারা ! তৃপ্তা হও মা ! প্রণাম  কর। [১.১৫ মিনিটে দ্বিতীয় পর্ব্ব সমাপ্ত]
                         
                               হোম। 
                    [১.৪৫ মিনিটে আরম্ভ]
ওঁ জাতবেদসে সুনবামং সোমং অরাতীয়তো নিদহাতি বেদঃ। স নঃ পর্ষদতিদুর্গাণি বিশ্বা নাবেব সিন্ধুং দুরিতাত্যগ্নিঃ। জাতবেদসে—একেবারে এখানে প্রতিমায়, ঋকেতে দেখ, একেবারে ঋকে। জাতবেদসে সুনবামং সোমং। আয়, মাকে দেখে যা, একজন একজন করে এসে মাকে দেখে যা—দেখে যা। [একে একে সকলের উঠে উঠে দর্শন।] মা ! মা! মা! ফুল দে, ফুল দে। ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। দেখলি ? দেখলি ? মাকে  দেখলি ? জাতবেদসে সুনবামং সোমং অরাতীয়তো নিদহাতি বেদঃ। স নঃ পর্ষদতিদুর্গাণি বিশ্বা নাবেব সিন্ধুং দুরিতাত্যগ্নিঃ। যত বিষাদ থাক, সঙ্কট থাক, ভীতি থাক, দুর্দ্দশা থাক, এই মা তোকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কি অরিভীতিজনক মূর্ত্তি ! আহাহা ! কি দেখালি আজ ! কি দেখালি আজ ! দেবী, রক্ষা কর। ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে [বহু বার]। ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে, ক্রীং গার্হপত্যাগ্নয়ে স্বাহা । জ্বলে ওঠ। পৃথিবী, অগ্নি, অন্ন, আদিত্য চামুণ্ডাময় হও। ক্রীং গার্হপত্যাগ্নয়ে স্বাহা। ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে, ক্রীং 
দক্ষিণাগ্নয়ে স্বাহা। ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে।ক্রীং আহবনীয়াগ্নয়ে স্বাহা।ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে। ক্রীং ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। [বেলা ২টায় হোম সমাপ্ত।]
     
                  গুরুর হোম ও ভোগ নিবেদন। 
ভোগ সাজান হয়েছে ? দক্ষিণাগ্নি জ্বাল না। [গুরু হোম করতে লাগলেন।] খা, খা, ওঃ, উঃ ! কি করি ? মা, কি করি ? জাতবেদসে সুনবামং সোমং। ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। তোকে কোথায় খাওয়াই ? কোথায় খাওয়াই ? ওঁ গার্হপত্যাগ্নয়ে স্বাহা। ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। পৃথিবী, অগ্নি, অন্ন, আদিত্য—এই চতুস্তনুওঁ অগ্নয়ে স্বাহা। অমা, অমা, অমা, কালি ! অমা কালি ! সপ্তম্যাং গৃহাণ পূজাং অমাবস্যাস্বরূপিণি, সপ্তম্যাং গৃহাণ ভোগং অমাবস্যাস্বরূপিণি স্বাহা। মা আমার, মা আমার, জাতবেদা মা আমার ! বেদরূপিণী মা আমার!  ক্রীং অভয়ায়ৈ স্বাহা। সব খেলে, আবার কেন খাও মা ! দেবি তুমি ধন্য, দেবি তুমি ধন্য। জাতবেদসে সুনবামং সোমং স্বাহা। এষ আঙ্গিরসঃ, এষ আথর্ব্বণঃ।এষ আঙ্গিরসঃ, এষা অমা কালিকা। এমন বেদ কোথাও চলেনি, যেখানে স্বর্গ, মর্ত্ত, পাতাল ভেদ করে যায় নি। মনের ভিতর দিয়ে একটু ভেদ করে গেল, এ নয়—একেবারে অমা, ক্রীং স্বাহা। খা-খা-খা ! তারিণি, তারিণি, দেবি আমার, মা আমার, প্রাণ আমার, কালি আমার, প্রাণ আমার। দ্যুভূ-আয়তনায় স্বাহা। তোমায় প্রাণ বলে যে সম্ভাষণ করে, তাকে আর তুমি ফেলতে পার না। দধিক্রায়ৈ স্বাহা। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। অভয়া ! অভয়া ! অভয়া ! দীপ জ্বাল-দ্বীপ জাল। বাজাও। [আরতি অন্তে সকলের প্রণাম। বেলা ৩টায় প্রথম দিনের পূজা সমাপ্ত।]

                            দ্বিতীয় দিন। 
১১ই পৌষ,১৩৪৮, ২৬ শে ডিসেম্বর, ১৯৪১,শুক্রবার প্রাতে ৯-৩৫ মিনিটে আরম্ভ।

নমো নমো নমো নমো নমঃ । ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ। হুং হুং
হুং নমঃ শিবায়। ওঁ জাতবেদসে সুনবামং সোমং। হুং নমঃ শিবায়। ওঁ নমো বিষ্ণবে। ওঁ নমো ব্রহ্মণে। নমঃ অম্বিকায়ৈ। নমঃ শিবায়। ব্যোম ব্যোম ব্যোম, নমঃ শিবায়। নমঃ অম্বিকায়ৈ।নমঃ শিবায়।নমো বিষ্ণবে। নমো ব্রহ্মণে। নমঃ অনির্ব্বচনীয়ায়ৈ অমায়ৈ। নমঃ তৎপুরুষায় শিবায়। নমঃ কেশবায়। নমঃ শ্রীধরায় কেশবায়। নমঃ পদ্মযোনয়ে ব্রহ্মণে। নমঃ পদ্মযোনয়ে ব্রহ্মণে। নমঃ শ্রীধরায় কেশবায়। নমঃ শিবায় তৎপুরুষায়। নমঃ অম্বায়ৈ। জয় মা ! 
জয় মা ! জাতবেদসে সুনবামং সোমং। ওঁ নমো গার্হপ্ত্যাগ্নয়ে। নমঃ  দক্ষিণাগ্নয়ে। নমঃ  আহবনীয়াগ্নয়ে। জাতবেদসে সুনবামং সোমং [২ বার]। মাকে খাওয়াচ্ছি। মাকে কাল তোমরা অস্ত্রে শস্ত্রে সুসজ্জিত করে সাজিয়ে দিয়েছ। মাকে কাল রণযাত্রার জন্য বরণ করেছ। আজ মায়ের সেই যাত্রা শুভদ হক, অতিশুভদ হক, ফলদ হক। ক্রীং স্বাহা। নমঃ ক্রীং।আহাহা ! ক্রীং-মায়ের আমার রণযাত্রা দর্শন কর। 
ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। 

ওঁ উদ্যৎআদিত্যরাগরঞ্জিতাং যোগমায়াং মহেশ্বরীং। 
শিববিরিঞ্চিকেশবমুকুটসেবিতচরণাং, সূর্য্য-শশাঙ্কস্পন্দানন্দস্ফুরণমণ্ডিতাং, নিত্যাং স্থিরাং সিদ্ধামরবেষ্টিতাং, স্নেহকরুণাভারনম্রাং। পূত-প্রণব-রাগ-রচিত-চমৎকৃত-বিকশিত-বিন্দু-দিক্‌বাসিনীং। প্রপূজিতাং অভয়াং বরদাং বিশ্বজননীং। শিবমাতাং শিবানীঞ্চ ব্রহ্মাণীং ব্রহ্মজননীং, বৈষ্ণবী বিষ্ণুপ্রসূতিং, ত্রিপুরাং ত্রিপুরেশ্বরীং। নমামি মাতরং বিশ্বজননীং।নমামি মাতরং বিশ্বজননীং। মা ! মা !
হ্যাঁরে, তোদের মাকে ত দেখছি— কৃষ্ণা, ভয়ঙ্করা, করালী। তোরা আদিত্যরাগরঞ্জিত দেখছিস কেন ? ওর রাগই হল আদিত্য-রাগ। ও যেখানে পদক্ষেপ করে সমস্তটা নিয়ে যায়; আর আপনি যেখানে যায়, সেখানে সমস্তটা নিয়ে নেয়—এই হল আদিত্যরাগ। এই হল এর অদ্ভুত মায়া, যুক্ত করে নেওয়ার অদ্ভুত শক্তি। এই জন্য একে বলছি যোগমায়া।এর কাযই হল এই যে, যে যেখানে টুকরা হয়ে পড়ে আছে, দ্বিতীয় হয়ে পড়ে আছে, আপনাকে মা-হারা নাস্তিক করে রেখেছে, তাকে ঝপাং করে নিয়ে নেয়। এইটুকু নেব, এইটুকু নেব না, এমন হিসাব করে ও আসে না। এমনি করেই নিয়ে নেয়। অন্য দেবতাদের কথা শুনেছি,—"মামেব ভজ, শরণং গচ্ছ," এই ভাবে কত রকম কর্তব্যের গণ্ডী ধরিয়ে দেয়। এর তা নয়, এ ঝপাস করে গিলে নেয়। না হলে একে এটা ওটা সেটা দিয়ে বিদায় করা যেতে পারত; কিন্তু তা নয়। কৃষ্ণ এলেন, বিষ্ণু এলেন—আচ্ছা, আচ্ছা, খান দান যান। কিন্তু এত বড় মুস্কিলের দেবতা—এ সবটা গিলে নেয়। ভক্তি শ্রদ্ধার ধার ধারি না—ক্রীং বলেছিস কি ওতে গেছিস। যোগ, যাগ, তপস্যা কিছুর ধার ধারি না—ক্রীং বলেছিস কি তুলে নিয়েছি। " হে গুরুঠাকুর, এ আবার কোন ঠাকুরের চোখের তলায় এনে ফেললে ? ও বাবা !" ভয় পাচ্ছিস কেন ? আমি তোদের যে শিক্ষা দিয়েছি, তাতে এ কিসের বিপরীত মূর্ত্তি ? ঋকের। যিনি ও-পিঠে ক্রীং, তিনিই এ পিঠে ঋক্‌। কাল এই যে তোমরা ঋক্‌ ঋক্‌ বলে পূজা করলে, সে  একেই নামিয়ে পূজা করলে? সর্ব্বনেশে পুত্র তোমরা ! গার্হপত্যে বহির্বিশ্বরূপে একেই দেখেছিলে ? একেই ছড়িয়ে ধরিয়ে ঋক্‌ ঋক্‌ বলছিলে ? কি জানি বাবা, আমি মুখ্যু মানুষ—বুঝতে পারিনি। যা প্রকাশ হয়, তার নাম বহিঃ। সুতরাং যা প্রকাশ হয়েছে, তার নাম ঋক্‌। এই তোদের গার্হপত্য অগ্নি; যেখানে যা ফুটেছে, সে ঋক্‌। তা হলে তোরা যে ফুটেছিস, প্রতি জনে জনে তোরা ঋক্‌। ঐ ক্রীং থেকে ফুটে ঋক্‌ হয়ে বসে আছিস ? যেমন গাছের পেট থেকে মাথায় ফুল ফোটে, তেমনি এই কল্পতরু থেকে তোরা ফুটে বসে আছিস ? এতৎ বেদমধু, এই ঋক্‌ বেদের মধু।
ঋক্‌ কেমন করে যজুতে, যজু সামে, সাম অথর্ব্বে চলে যায়, সে গতি বুঝিয়ে দিয়েছি। সারা বছর ধরে তোদের খাইয়েছি; এখন বুড়ো বেটাকে যেন অবহেলা করিস না।
কিন্তু এই ঋক্‌ হয়ে ফুটতে, তোদের কত ঋণগ্রস্ত করেছে জানিস ? তোদের যা কিছু "আমার আমার," সে সবটাই ওর। তোরা জানিস না যে, তোদের ভিটে-মাটি, গায়ের কাপড়খানা পর্য্যন্ত ওর কাছে বাঁধা আছে। এখন দিব্যি গাড়ী চড়ে মজা করছিস। ঋক্‌ মানে ঋণ পাওয়া। এগুলি তোর আছে, না ওর কাছে পাচ্ছিস ? পাওনাদারকে কেমন করে ফাঁকি দিতে হয় জানিস ? তোদের সব নিলেমে বিকিয়ে যেত, যদি না গুরু থাকত।পাওনাদারকে ফাঁকি দিতে হলে তার পুষ্যিপুত্তুর হতে হয়, গায়ে হাতটাত বুলিয়ে বশ করতে হয়। সেই চেষ্টা কর্‌ না।
তিনি দিতে দিতে, জানতে জানতে নামেন, তার নাম হয় তোদের ঋণ। কাগজে কলমে সাক্ষী রেখে, ডেকে হেঁকে পাঁচজনকে জানিয়ে, সে ধার দেয়। অর্ণব—যা তোরা পাস, মন্ত্রের আকারে চারিদিকে তাই বলিস। ঋণ দেয়,
অর্ণের আকারে বর্ষিত হয়, ঋকের আকারে গতি রেখে দিতে দিতে, বলতে বলতে সে চলতে থাকে। সে ঋক্‌ হয়ে ফোটে।এই যে তোরা বসে আছিস, এতে গতি আছে ? দু বেলা টানা পোড়েন চলছে ? এক পয়সা ধার দিয়ে, অণুতে অণুতে সুদ খাটিয়ে, তাকে 'অহং ব্রহ্মাস্মি' করে তোলে। কেমন হে, পাওনাদারটি আজ কেমন ভাবে আসছে ? 'অহং ব্রহ্মাস্মি' উচ্চারণ করিয়ে তবে ছাড়ে। একটু একটু করে ধার দিয়ে সুরু করে, তার পরে লোভে পড়ে এত এত দেয়—তার পরে 'অহং ব্রহ্মাস্মি'।ওকে না দেখলেই তোমরা 'অহং অহং' কর । ঋক্‌, দিতে দিতে, বলতে বলতে—নিজে শুনতে শুনতে, বলতে বলতে, ঋক্‌ আকারে পর্য্যবসিত করে একটি মন্ত্র দেয়—সে হল 'তুমি' 'আমি'*।
-------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*তত্ত্বমসি—ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
-------------------------------------------------------------
মৌমাছি ঋক্‌ থেকে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসে* । যেখান দিয়ে মধুচক্রে মধু চলে আসে, তার নাম যজুঃ। যেখানে সঞ্চিত হয়, সেটা সাম। আর যত কিছু সংগ্রহ, সব যেখানে খেয়ে যায়, সে অমাবস্যা।
-----------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*মধুবিদ্যা—ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ তৃতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।)
--------------------------------------------------------

ও তোদের সবটা মধু খেয়ে ফেলে, চাকে আর কিছু থাকে না। তুই যদি ঋক্‌ হয়ে থাকিস, তবে কোন দিকে অনবরত ছুটছিস ? কি অবলম্বনে এবং কোন দিকে ছুটছিস? ইন্দ্রিয় অবলম্বনে, ইন্দ্রিয় পথে হুড়হুড় করে ছুটছিস। যেখানে যা কিছু ঋক্‌ আছে , তা থেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য তুই ইন্দ্রিয়পথে ছুটছিস। মধু নিয়ে ভিতর দিকের ঘরে হৃদয়ে পোরবার জন্য তুই ছুটছিস। যতক্ষণ বুকের ভিতর না পুরতে পারছি, ততক্ষণ নিস্তার আছে ? দুনিয়া, থেকে যা কিছু তুই কুড়োস সে সব নিয়ে নিজের চাকের দিকে, বুকের দিকে, বাসা অভিমুখে ছুটিস। কোন দিকে ছুটিস ? হৃদয়ের দিকে।
যতক্ষণ না সে সব তোর বলে শমিত হয়, ততক্ষণ ঠাণ্ডা হস না। বাইরের দিকে যখন কায করে, তার নাম ইন্দ্রিয়, ভিতর-দিকে যখন যায়, তার নাম হয় প্রাণ। তা হলে তুই এ পিঠে প্রাণময়, ও-পিঠে ইন্দ্রিয়ময়। তোর কোথাও বসবার ক্ষমতা নেই; ঘুমিয়েও তুই চলেছিস হৃদয়ের দিকে, সামের দিকে। যদিও দেখছিস যে, দেবী লুকিয়ে রয়েছে, তথাপি গোটা হৃদয়খানা ত ঐ দিকেই; সুতরাং গোটা মধুচক্রটা তার দিকেই ধর। সুতরাং তুই এখন ঋক্‌ থেকে সংগ্রহ করে, যজুর ভিতর দিয়ে, সামের ভিতর দিয়ে ক্রীং মাকে মধুময় করবি। যারা মধু বেচতে আসে, তারা এক টোসাও খায় না, তারা বেচে পয়সা পাবে। তুমি কি তেমনি ? না খেতে খেতে যাবে ? তোমাদের হাটবাজার করতে দেওয়া ত সর্ব্বনাশ !  তোমরা বাজার থেকে খেতে খেতে ফিরবে !  খেতে খেতে গেলে ক্ষতি নেই, ক্রীং বলে খাও, 'বিজয় চাটুয্যে' বলে নয়।কেন ? তুমি কত খাবে ? ওখানে অনন্ত অনন্ত আছে—তার একটা নমুনা মাত্র তোমায় দিয়েছি। তাতে তুমি এই মানুষটি, এই গাছটি ইত্যাদি দেখলে। তুমি শিখেছ—বাইরের জগৎ মাত্র provocation দেয়, কিন্তু তুমি দেখ জ্ঞানের জগৎ। ওটা, বহির্জ্জগৎটা খালি নাড়া দেয়, সেটার নাম ঋক্‌। তা হলে টক, ঝাল, বা কালী ইত্যাদি যা ফুটল, ও কি ঐ ভিতরে জাতবেদা ? প্রকৃত পক্ষে ইনিই। ক্রীং—ইনি ফুটে ফুটে 'বাহির' নামে  ঋক্‌ হন।এ একেবারে বেদেরই বহির্নামীয় মূর্ত্তি।সুতরাং কে এসে বহির্মূর্ত্তি ধারণ করেছেন? তুমি ঋক্‌, ক্রীংই তোমার চেহারা ধরেছেন। হে ক্রীং-দেবি, মানবনামীয় যে ঋক্‌ দেখছি, আর তা দেখতে চাই না। এখন ওখানেই ক্রীং বলছি, আমায় তুমি কি করে তুলবে ? ওখান থেকে  তুমি যা পাও, সেইটি ঋক্‌ হয়ে, naturalised  হয়ে, তোমায় দেখিয়ে দেয় যে, সেই ক্রীং গতিশীলতা নিয়ে স্থূল হচ্ছে। সুতরাং তুমি মানব দেখবে না, ক্রীং দেখবে ।
হে পুরুষ ! তুমি নিজে ঋক্‌। তোমার ইন্দ্রিয় সকল যজুঃ, হৃদয় সাম, এবং তার পিছনে ঊর্দ্ধহৃদয়ে চোরাকুঠুরিতে যিনি, তিনি হলেন ক্রীং । তা হলে এখন এই জগতের দিকে চেয়ে তুমি বল ত—কাকে দেখছ ? জল, আকাশ, মানুষ, সূর্য, চাঁদ দেখতে পারি, কিন্তু তাদের আসল নাম যখন দেখতে যাই, তখন দেখি—এই ক্রীং মা আমার মাটি, জল, আকাশ, তুই ও আমি হয়ে ফুটে রয়েছেন। তুই ও আমি, তুই ও আমি—এ কে ফুটেছে ? তুই হলি কল্য, আমি হলুম অদ্য। যার অদ্য ও কল্য নেই, সে নিজেই অদ্য ও  কল্য হয়ে সেজে উঠেছে। তুই আমার কালী, ক্রীং, চলে আয়, চলে আয় অমা দেবীতে।এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং যোগমায়ায়ৈ স্বাহা। ঐ যে ফুল ছুড়ছিস—আমি বললেই কি তুই ঘরে আগুন দিবি ? তোর হিতাহিত জ্ঞান আছে, সাবধানে দিস; ফুল ফল যা দিচ্ছিস, ও সব গিলে নেবে। নিচ্ছে ? নিচ্ছে ? [ সকলের সঘন পুষ্পক্ষেপ ]। আমি তোদের কথা ততক্ষণ বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না  দেখব যে, কালী বলতে তোদের তর সইছে না, অমনি কালী হয়ে যাচ্ছিস। তোদের সব ইন্দ্রিয়—চতুর্দ্দশ করণ, আত্মময় শরীর, সবটা নিয়ে তোরা কালী হয়ে যাচ্ছিস। ক্রীং যখন প্রচুর হয়, তখন সে  হয় করালমূর্ত্তি।তোরা এই করালমূর্ত্তি হচ্ছিস, তাই আমি দেখতে চাই। তোদের হাতে খড়্গ, ত্রিশূল, চক্র ও কৌমারী শক্তি, এই আমি দেখতে চাই।
 ওঁ উদ্যৎআদিত্যরাগরঞ্জিতাং যোগমায়াং মহেশ্বরীং। 
শিববিরিঞ্চিকেশবমুকুটসেবিতচরণাং। —কে ফুটল ? শুভ্র, অক্ষর, ক্ষরণহীন নিত্যসনাতন শিবমূর্ত্তি—কে তুমি ? হে আত্মা, হে ভূমাপুরুষ, কে তুমি ? কে আমি ? কে, কে ? " বরং বৃণু—বর গ্রহণ কর। আমি ক্রীংয়ের পুরুষমূর্ত্তি। এই যে আমার শুভ্র মূর্ত্তি, এর ভিতর ক্রীং লুকিয়ে আছে। তাই আমি মহেশ্বর, আমি ত্রিশূলধর।" 
হে শান্ত, গভীর সমূদ্রের জলরাশির ভিতর শায়িত কে তুমি ? হে কেশব কে তুমি ? এই বিপুল জলাবর্ত্তে শায়িত রয়েছ কে তুমি ? "ঐ যে ক্রীং, ঐ যে তৎপুরুষ, তস্য পুরুষ, ঐ তৎপুরুষের আমি আকার। বিশ্বকে নিবিড় জলাচ্ছন্ন করে রেখেছি।" হিরণ্যগর্ভ, হিরণ্যশরীর  কে তুমি ? "অহং ব্রহ্মাস্মি। যেমন ফোটা পদ্ম, যেমন পদ্ম ফুটেছে। আমার গর্ভে সমূদ্র লুকান রয়েছে। সে প্রাণে শিব-শক্তি সর্ব্বান্তরে বাস করছেন। সেই জন্য আমি ব্রহ্ম, মদতীত কেউ নেই। আমার দ্রষ্টা প্রসব করার জন্য আমি নিয়ন্ত্রিত হয়েছি। যে জাত হয়ে আমাকেই দেখবে, যে জন্মমাত্র মাকে দেখতে পাবে, সে ইন্দ্র, তাকে স্বর্গের রাজা করব।" তোমরা বৎসরের পর বৎসর যে যজ্ঞ সম্পাদন করছ, সে দুর্গোৎসব যে অশ্বমেধ যজ্ঞ, তা দেখিয়েছি। এখন তার ফল গ্রহণ কর। তোমার আত্মবোধ যাতে জাত হয়েছে, তাতে দেনাদার, পাওনাদার ইত্যাদি হিসাবের খাতা খোলার দরকার নেই। —এ-ই ক্রীং, এ-ই ঋক্‌, এ final statement দিয়ে দিয়েছি। এর উপর নালিশ, মকদ্দমা যা চলে চলুক। এখন একে দেখ—ইন্দ্রত্ব হবে; না দেখ,এর ওর কাপড় চুরি করবে, বিদ্যা চুরি, বই লেখা ইত্যাদি হবে। এখন তোমাদের ক্রীং ও ঋক্‌ পড়া হয়েছে। মাঝখানে কি আছে ? যজুঃ, সাম। তুমি মাকে, ক্রীং-দেবীকে দেখেছ ? কোথায় কোথায় ? এই প্রতিমায়? ওটা terminus ? ও terminusএ  ক্রীং, এ terminus এ ঋক্‌ ? কি ভয়ঙ্কর মেরু। দক্ষিণমেরুতে ঋক্‌, উত্তরমেরুতে ক্রীং ? শিবকে পেটের ভিতর খেলিয়ে বেড়াচ্ছেন। সুঋক্‌ মানে স্বর্গ।স্বর্গতত্ত্ব যে বুঝেছে, তার বাসস্থান হয়ে যায় অক্ষয়স্বর্গ, সু-ঋক্‌
সুভূতা যেমন আপনি আপনাকে তৈরি করে নেন, তেমনি স্বর্গ হল সু-ঋক্‌। এতক্ষণে তোরা ব্রাহ্মণ হয়ে মা বললি। এতদিন শূদ্রের মত খোসামদ করে মা বলতিস।
ঠিক মা বলা হলে, মাকে তীরের মত ঝুঁটি ধরে বসায়। মা তোর চোখে, নাকে, বুকে, শুধু এইটি জানা, এইটি দেখে নেওয়া হল বেদধর্ম্ম। একে বলে ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম, একে বলে বেদ, একে বলে ঋষি হওয়া। আর ক্রীং হারাবি ? বাড়ীতে বলছিল,—" কি কালো ভূতের মত মাকে দাঁড় করিয়েছ।" কি হে, সত্যি কথা না কি? ওর কোনও রূপ নেই। আমার মা কালোও নয়, সুন্দরও নয়, আবার কালো ও সুন্দর সবই।          
তা হলে যত কিছু শব্দ,গন্ধ,স্পর্শ তোদের অনুভূতিতে পাস, সে এই ক্রীং থেকেই পাস ? এই বেদগতির কথা বলছি। এইখানে, মাথায় সব আছে ? নিজে কিছু নয়, অথচ সব হয়ে ফোটে, সে এইখানে আছে, আর যত কিছু সে হচ্ছে, সব ঋক্‌। ব্যাঙ্ক থেকে যত কিছু overdraw করতে দিচ্ছে। তোর রূপ রস আদি প্রতি অনুভূতি, প্রতি অবস্থার বদল, জন্ম মৃত্যু, সব এইখান থেকে বেরোচ্ছে। তারই বাহ্য রূপকে তোরা রূপ বলে দেখতে শিখেছিস ? যা কিছু বেরোয়, সব ঐখান থেকে, ঐ অমা থেকে? তা হলে যে সবকথা শুনেছি, খড়্গ,শূল, পাশ, যমদণ্ড ইত্যাদি যে সব অস্ত্রের বর্ণনা করেছি, যে সব শক্তি অনন্ত অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত করছে, সে  সব এই মাথা থেকে বেরোবে ? ফুল নে ? ভেবে ভেবে মা বলছিস কেন ? এখনও ভাববার কথা বলছিস কেন ? কোলে করে তোদের নিয়ে যাচ্ছি, দেখছিস না ? আমার কথার স্রোতে নির্ব্বিচারে তোরা ভেসে যা, মাকে পোঁটলা বাঁধতে চেষ্টা করিস না, বুঝতে গিয়ে এর ইয়ত্তা পাবি না। বীরাসনে বস। ওঁ অমা হি তে সর্ব্বং। অমায়ৈ স্বাহা। 
এতে গন্ধপুষ্পে, ইদং সর্ব্বৌষধিমন্থং—আমি সুদ্ধ, আমার
বিশ্ব সুদ্ধ মথিত করে এই হাতের ফুল করেছি—ইদং সর্ব্বৌষধিমন্থং অমায়ৈ স্বাহা। ইদং সর্ব্বৌষধিমন্থং অমা হি তে সর্ব্বমিদং। দেবী, জননী, রমণি ! তোমায় যে দিক দিয়ে আদর করতে যাই, সর্ব্বমূর্ত্তিই বুকে বাজছে। কি করে তোমায় সম্ভাষণ করবো, হে অসম্ভাষণি ! গুরু বলছেন—'আছে' ও 'নেই' বলে যা কিছু, সব তোমাতে সমাহিত। তাই আমার সব-কিছু মথিত করে, একীভূত করে তোমাতে দিচ্ছি। ইদং সর্ব্বৌষধিমন্থং অমায়ৈ স্বাহা।
[১১টায় প্রথম পর্ব্ব সমাপ্ত।]

                [১১টা ২০ মিনিটে দ্বিটীয় পর্ব্ব আরম্ভ।]

নমঃ শিবায়। নমঃ শিবায়। নমঃ শ্রীগুরবে। নমো মৃগপরশুহস্তায় শিবায়। নমঃ শিবায়। নমঃ ত্রিশূলধরায় রুদ্রায়। মন্ত্র পড়ছিস, না কথা কইছিস ? মন্ত্র পড়ার ফল হল—যা বলি, তাই বেরিয়ে আবার আমাতে ঘুরে আসে। এই ক্রীং বললাম ত সে বেরিয়ে, আবার ঘুরে   এসে, আমার পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত দাঁড়ায়। এর নাম হয় মন্ত্র পড়া, আর এ না হলে সে হল কথা। তোরা যেমনি ক্রীং বলছিস, অমনি সর-সর করে, যে যে স্তর বলেছি, সেই সেই স্তরে ফুটে এসে, কৌমারী শক্তি দিয়ে একেবারে তোকেই ঘিরে ফেলবে। যেমন জাম খেয়ে বলিস জাম, আম খেয়ে বলিস আম, শব্দ শুনে বলিস শব্দ, তেমনি এই ক্রীং কে দেখে ক্রীং বললি ? এইটি আমি দেখতে চাই। অর্থাৎ যাঁহাতক ঋক্‌ বলেছিস, অমনি ওর গতি চড়াক করে ক্রীং হয়ে নেমে এসেছে। এমন কিছু প্রকাশ কি কোথাও হয়েছে, বা হতে পারে, যাতে ও নিজের অশ্বে নিজে আরোহী নয়। এইটি দেখতে দেখতে বললে সে হবে মন্ত্র, আর তা না হলে হবে গর্ত্ত বোঁজান। 'বুঝতে পেরেছি,' এ কথাটাকে আমরা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিই। এই বেদগতি, এই যাওয়া আসা দেখতে হবে। এটা শুনতে ভয় হয়। কিন্তু এ যে সত্যিই যাওয়া আসা, তার কোনও সন্দেহ নেই। তোর রক্ত স্রোত, স্নায়ু স্রোত তোকে বেষ্টন করে পাঁই পাঁই করে ঘুরছে, তোর ভিতর এমন একটা কুচি নেই, যা ঘুরছে না, অথচ তুই ঘুরছিস বোধ করছিস না। তোর নখ, চুল, স্নায়ু, রক্ত সবই আপাদমস্তক ঘুরছে। একটি বিন্দু ফুটতে হলে, একটি ব্রহ্মাণ্ড ঘুরতে হবে। চতুর্দ্দশ ভুবন তৈরি করে, একটি অনন্তের আবর্ত্তন নিয়ে, তবে এই নখটি তৈরি হয়েছে। তা না করে কোনও entity ফুটতে পারে না। ঐ গাছের ডগায় একটি পাতা, সে সমস্ত শিকড় থেকে একটা রসের প্রবাহ টেনেছে। তোমার যে নখ গড়া, সে সমস্ত শরীরের রস টেনে গড়ছে। কোনও বিশিষ্ট প্রকাশই সমগ্রতা না নিয়ে হয় না। নখ, চোখ, চুল, এ-সব ক্ষুদ্র এক একটি ঋক্‌। কিন্তু এরা ঘুরছে ঐ ক্রীংয়ে, অনন্ত মায়ে। পূজা কর, পূজা কর। মা আমার, মা আমার বলে কি নিচ্ছিস ? মাকে পেতে আমার কাছে এসেছিলি। আমি মাকে দেখালুম। তোরা বললি— 'বুঝেছি'। দূর ! দূর ! ঋক্‌ এমনি একটি নির্দ্দিষ্ট বর্ণনা, সেই অনন্ত বেদ প্রবাহেরই একটি মুখ। তুমি যদি 'ফুল' ব'লে খালি 'ফুল', 'মানুষ' ব'লে খালি 'মানুষ' দেখ, তবে তুমি পাপী, পাতকী হলে। এক আথর্বণী* মা রয়েছে।যার অথ বিদূরিত হয়ে গেছে, সকল প্রশ্নের মীমাংসা হয়েছে, অনন্তরং কিং, এ চেষ্টা, এ প্রশ্ন* যার থেকে যার বুক থেকে বেরিয়ে গেছে, তার নাম আথর্বণী।  
-------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* (১) প্রশ্ন উপনিষদ্‌ অথর্ব্ব বেদের অন্তর্গত। এই উপনিষদে ৬য়টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। (২)  এই  আথর্বণী, গ্রীস দেশে এথিনা দেবী নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।)
---------------------------------------------
তার ফল হল—যদি ঋক্‌ উচ্চারণ করেছিস ত সে fill করে দেবে সমস্ত বিশ্ব। blackout এর নিবিড় অন্ধকারে
গাছের তলায় দেখি—প্রকাণ্ড এক কালো মূর্ত্তি,মাথায় ঝাঁকড়া চুল ! অমনি দুর্গা মনে পড়ে গেল । যেমন তোমরা aeroplane* এর ভয়ে কাল 'অভয় অভয়' করছিলে। কি করি বাবা, দশচক্রে ভগবান্‌ ভূত। 
--------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*বোমারু বিমান।
--------------------------------------------------------

মরার আর ভয় কি ? ও যখন দাঁড়িয়েছে, তখন একটা ব্যবস্থা, হেস্তনেস্ত করবেই। কাছে গিয়ে দেখি— সে হল একটা গাছের ফাঁক। দুরন্ত অন্ধকারে 'ভূত' বলে একটা ঋক্‌ বেরিয়েছিল; তাতে চোখ, মুখ, কালো চুল, হাতে লাঠি ইত্যাদি সবই ফুটেছিল। আমাদের মন্ত্র কি এই রকম ঋক্‌ হয়ে ফুটবে না ? এক অথর্ব্ব বেদন থেকে সাম, যজু, ঋক্‌ বিভাগ হয়ে বেরিয়েছে, এ যদি জানা থাকে ত বেঁচে গেছিস। আমি এই যে হাত ঘোরাচ্ছি, একি সাম যজু ঋক্‌ বেদনের চক্র নয় ? কথা কইছি, সেকি সাম যজু ঋক্‌ বেদনের চক্র নয় ? মাকে দেখছি সে কি সাম যজু ঋক্‌ বেদনের চক্র নয় ? এই সমস্ত বেদন, ব্যথা, যার ব্যথা—ব্যথা বলেই বলছি রে! সে অথর্ব্ব বেদ। 
রোগী দেখতে গেছ; তার পায়ে বেদনা, পা টন্‌টন্‌ করছে। তুমি দেখছ— কোথায় পুঁজ, কোথায় ফোড়া, অথ কিং, কিন্তু যার 'অথ' বিগত হয়েছে, সে দেখছে ব্যথা। দেবি, কত ব্যথাই দিচ্ছ ! কত অজ্ঞানে তোমায় নাড়াচাড়া করছি, কত ব্যথাই দিচ্ছ । অথর্ব্বের লক্ষণ হল— সে বেদন নয়, not an understanding—বুঝেছি, বুঝেছি বলে গুরু গম্ভীর চালে মাষ্টার হয়ে বসা নয়। মাকে দেখতে হবে একেবারে অথর্ব্বে। যেখানে বেদের সাড়া পয়েছি, সেখানে ও বেটী বসে আছে। এটা রূপ ?
এটা শব্দ ? তবে মা বসে আছে; কেন না, রূপ, শব্দ, এ হল এক একটি বেদন। মা কোথা দিয়ে বেরিয়ে যায়, দেখতে পাচ্ছিস ? তবে কি দিন রাতই ঐ করব ? পুত্র তুই, স্বাধীন তুই, তোকে একবারও বলব না— এই কর, ঐ কর। তোরা এসেছিস আমার কাছে মাকে চিনতে তাতে তোদের সকল শাস্ত্র মুড়ে রাখতে হবে। অথর্ব্বের লক্ষণ কি হবে ? যেমনি মন্ত্র বলব, জানব—ঐ যে অমা মা, সব জায়গাতেই যার কেন্দ্র, আবার সব জায়গাতেই দধিক্রা, সব জায়গাতেই ইন্দ্রত্ব ফুটিয়ে দ্রষ্টা, সব জায়গাতেই বরুণের নাগপাশ দিয়ে এক একটি সংসার বেঁধে বসে আছেন—পরিবার টানছে, ছেলে টানছে, আমার স্ত্রী, আমার পুত্র—কেমন বেশ ! হঠাৎ দেখি যে, লাঠি হতে একটা কালো মানুষ এল। ও বাবা ! ঋক্‌ যে এই ভাবে ঘুরে ঘুরে এমনি ভাবে খেলা করছে ! আমাকে যদি চিনে থাকিস ত মাটিকে মা বলে দেখ। ও বামুন বেশ বলছে, এ দেখিস না। খবরদার ! মাকে দেখ। কে বলছে ? কার মুখে উপদেশ শুনছিস ? মা। এই মায়ের আমার অথর্ব্বমূর্ত্তি যদি এমনি করে স্বীকার করিস, তা হলে যদি বলিস—এই সমস্ত মানুষ আমার শরীর, তবে তাই-ই। গুরু এই সবগুলিকে 'আমার শরীর' বলে, তাই সে তোদের সকলের ভিতর জ্ঞান ঢোকাতে পারে। যার যতটা শরীর, তাতে ঐ Divine spirit ঢুকবে।Human spirit ঢুকবে না। 
এই হাত ক্রীং। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। আমাকে যেমন দধিক্রা করেছ, আমি তেমনি ছুটছি। তুমি আমার ঘাড়ে আছ, এইটি দেখতে দাও।তোরা এই বেদ বলে বেদীয়ান্‌।
একটা কিছু বিপদ্‌ এলে, এই বেদ বল প্রকাশ করে ঋষিরা তার প্রতিকার করত। বশিষ্ঠ হাজার হাজার সেনা তৈরি করলে। ভরদ্বাজ নগর, হাট, দোকান, ইত্যাদি করলে। ও সব কোথায় ছিল ? ঐ অথর্ব্বে। তাই তারা পারলে। কোথায় আছে ইন্দ্র, কোথায় বিশ্বকর্ম্মা ইত্যাদি; সবাই এসে সব কিছু যোগাতে লাগল। কে সে বুড়া ? অথর্ব্ব। এই জন্য এর একটি নাম আঙ্গিরস—ইনি সর্ব্বাঙ্গে বিচরণ করেন। আবার ইনিই সর্ব্বাঙ্গ রূপে ফুটে ওঠেন। কিছু একটা ফুটতে হলেই গোটাটার রস চাই। উনি অঙ্গার থেকে জাত বলে নাম অঙ্গিরা। ঐ যে কালো ভূত, অঙ্গার, ওর কোন রং নেই, চেহারা নেই; ওতে আগুনের কোন কিছু আছে ? আবার সব আগুনই ঐ থেকে বেরোচ্ছে। এতে গন্ধপুষ্পে অথর্ব্বাঙ্গিরসস্বরূপিণ্যৈ ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা।তোর সর্ব্বাঙ্গে কে বইছে, এবার বল ত। কালিকা ? নমঃ কালিকে, নমঃ কালিকে, নমঃ কালিকে। আলো জ্বলে উঠতে  তুই বেশ নেচে উঠলি, সূর্য্য উঠতে তুই বেশ প্রফুল্লিত হলি,  কিন্তু জানিস কি, অন্ধকার না থাকলে আলো জ্বলত না, রাত্রি না থাকলে, দিন হত না। দিন ওর সন্তান মাত্র, সূর্য্য আদিত্য মাত্র, অদিতির কুমারঐ কালোকোলো মায়ের পুত্র। আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠে আবার আকাশে মিলিয়ে যায়। আমি রয়েছি বলে তোদের কত অহঙ্কাকার ! কিন্তু এই তুই ঐ অন্ধকার থেকে এসেছিস, আবার ওতে যাবি। তোমাকে জাত করা হয়েছে মা-বাপের সেবা করতে, মাতৃশক্তি ও পিতৃশক্তি চিনে, তাতে লয় হবার জন্য।  তোমাকে জাত করা হয়েছে বুক ফুলিয়ে চিতিয়ে বেড়াবার জন্য নয়, ওকে চেনবার জন্য তোমায় জন্ম দেওয়া হয়েছে। আদিত্য হয়ে উদিত হবার জন্য তোমার জন্ম, জীব হয়ে নয়। আদিত্য হল ঋক্‌, দেবমধু। তোমার পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত সমাসিত সব দেবতারা হাঁ করে আছে। আমি তেত্রিশ কোটি দেবতার রূপ ধরে, তারই সমাস হয়ে, তবে একটি 'তুমি' হয়েছি। এই তেত্রিশ কোটি দেবতা হাঁ করে আছে, কত ক্ষণে তোমাদের মুখ দিয়ে ঋক্‌ বেরোবে। ঋক্‌ বেরোলে, গার্হপত্য অগ্নি জ্বললে, তারা recognised হল, দেখে শান্ত হল। তোমার মা বলার জন্য তেত্রিশ কোটি দেবতা হাঁ করে রয়েছে। বেইমান, নিমকহারাম, এখনও মা বলবে না ? মূর্খের চেয়ে শাস্ত্রধ্যেতা ভাল, তার চেয়ে শাস্ত্রের মর্ম্ম যে ধরতে পেরেছে, সে ভাল, আর তার চেয়ে শাস্ত্রের মর্ম্ম যে ব্যবহার করতে পেরেছে, সে ভাল। আজ যদি তোমরা মায়ের সাথে ব্যবহার করতে না পার, তবে কিসের উপদেশ, কিসের শিক্ষা ! ফুল নাও, বল—চতুর্ব্বেদস্বরূপিণ্যৈ অমায়ৈ স্বাহা। মা বলি বটে, কিন্তু মা বলতে ভয় করে। পাছে, সেই ছোট্ট মাকে মনে পড়ে, বেদময়ী মাকে ভুলে যাই। খালি আঁচল ধরে টাকা বার করে নেওয়া। এ, সে মা নয়, ননী খাবার মা নয়—এ সেই বেদময়ী অমা মা।ও সবাইকে মেপে মেপে ধরেছে, ওর মাপ কেউ দেখতে পায় না। একজনের একটা শৃঙ্খলিত বেদন, feeling তোমরা দেখতে পাওনি। ও nature—ভাত খেলে, শক্তি হল, গর্ভ হল, সন্তান হল। এক একটা শক্তির স্তরে এক একটা বেদন। মা ঐখানে ঐ রকম করে বোধ করছেন, তবে তুই হচ্ছিস। কত আদরে গড়া তুই ! বেদ ! বেদ ! বেদ ! বেদ ! তোরা বলিস nature, magnetism ইত্যাদি, ism ism করে বাঁদরের মত কিচির-মিচির করিস।সেগুলাকে এখন ব্যথা বেদন করে নে। বিশ্ব এমনি করে গড়া, তোরা বেদস্বরূপ। তোরা মন্ত্র, তোরা উচ্চারণ। যাঁর সর্ব্ববিশ্বে বিচরণ, তিনি চলে চলে এখানে এসেছেন। এস, এস, এস, এস ! ক্রীং ও ঋক্‌—এর মাঝের গর্ত্তটা, ভিতরকার দাঁড়িটায় ব্যথা ভর্ত্তি হয়ে রয়েছে ? ব্যথা ঝলকেছে ? ক্রীংয়ের  কাছে আশীর্ব্বাদ চাও—"তোমার ব্যথা আরও ঝঙ্কার দিয়ে উঠুক মা!" মা অমা তুমি ষোলকলায় ঝর। মা সুভূতা, সোমরূপে ষোলকলায় স্রাবিত হয়ে পূর্ণচন্দ্রের মত আমার আপাদমস্তক ভরে দাও। তোমার কাছে অমাবস্যায় দীক্ষা* গ্রহণ করেছি; তুমি পূর্ণিমায় আমার পূজা নাও। তুমি আমার সর্ব্বাঙ্গ সোমস্রাবে পূরিত কর।
----------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
*ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৫।২।৪ দ্রষ্টব্য। 
--------------------------------------------------------------
জল দাও। দেবি ! আমি খালি তোমায় দেখছি। এমন করে এখানে কেন  ছুটে এলে ? দেবি ! মা বল্‌ ! মা ! [হাতে ঘটি নিয়ে ] ক্রীং, ক্রীং, ক্রীং। এর যত বহিঃপ্রকাশ, সব ঋক্‌ ত। ক্রীং বলবামাত্র অমনি ওটা বহিঃপ্রকাশ হয়ে ঋক্‌ হয়ে গেল ! বাইরে যা কিছু জাত, সে সব ক্রীংয়ের ঘোড়ায়, ক্রীংয়ে চড়া ঋক্‌। হে আমার মা ! আমার এই শিষ্যমণ্ডলী, তোমার এই ভক্তমণ্ডলী, তোমার সোম পান করতে সক্ষম হয়েছে। কত প্রচুর সোমে ওদের বুকের ব্যথা ভরে, তোমার সোম তোমায় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। ওরা প্রচুর,বহুল সোম ঢেলেছে, সেই সোম জলস্বরূপ ঋকের দ্বারা তোমায় পান করাচ্ছি। দেবি সোমপা ! সোম পান কর । দেবি দধিক্রা ! কালি, কালি ! অভিস্নাত হও। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। বাজা রে ! [ ঢাক, ঢোল, শঙ্খ-ঘণ্টাবাদ্য]। অনেক কষ্টে জঙ্গলে, মরুভূমিতে, পর্ব্বতময় দেশে এনে আমাদের পাথর করে ফেলেছ; আমরা সেই পর্ব্বতময় দেশে পাথর পিষে পিষে তোমাকে সোম পান করাচ্ছি আমাদের অল্পপরিমাণ সোম, যেমন ক্রীং বলেছি, অমনি প্রচুর হয়ে গেল। আকাশ, পাতাল, থেঁতলে আমরা সোম এনেছি। দেবি ! তুমি অভিষিক্ত হও, অভিষিক্ত হও। প্রচুর এনেছি, প্রচুর এনেছি। যেখানে যেখানে তোমায় দেখতে পাচ্ছি, সেইখানে সেইখানে রাশি রাশি সোম বেরিয়ে আসছে। প্রচুর পেয়েছি, প্রচুর, প্রচুর পেয়েছি—তুমি স্নাতা হও, অভিষিক্তা হও। তুমি গার্হপত্যে ও আহবনীয়ে কি ভয়ঙ্কর সংযোগ শিখিয়েছ। কারও কাছে চাইতে হচ্ছে না, প্রার্থনা করতে হচ্ছে না; ক্রীং বললেই চারি দিক্‌ থেকে সোম নিঃসারিত হয়ে, নিস্যন্দিত হয়ে আসছে। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। তোদের ঘরের ভিতর জমাট হয়ে যে সব সোম জমে ছিল, সে সব বিদ্রাবিত হয়ে আসছে ? দেবি, আমার অভিস্নাতা হও। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। বলতে হবে না, তোদের বলতে হবে না। আমি নিতে এসেছি, নিতে এসেছি, তোদের সব দিতে এসেছি। তোদের বলতে হবে না, আমি কেড়ে নেব। আমি সর্ব্বস্ব দিতে এসেছি, সর্ব্বস্ব নিতে এসেছি।
                     [ ১২টা ২৫ মিনিটে দ্বিতীয় পর্ব্ব সমাপ্ত।]     
          
                       [ বেলা ১ টায় তৃতীয় পর্ব্ব আরম্ভ। ]

নমঃ শিবায়। নমঃ শিবায়। নমঃ শিবায়। [ গার্হপত্য অগ্নির দিকে মুখ করে ] দেবি ! দেবি ! মা ! মা ! মায়ের আমার অনন্ত মূর্ত্তি। এ অনন্ত মূর্ত্তির ভিতর যে মূর্ত্তি আদ্যা, সেই মূর্ত্তিতে মা যজ্ঞ সম্পাদন করছেন। গতি ঐ একই। যে মূর্ত্তিতে যেখানে মা প্রকাশ হন, গতি ঐ বেদ গতি। অগ্নি একই—গার্হপত্য, দক্ষিণ, আহবনীয়। গতি একই, ভঙ্গিমা একই; কিন্তু আজকে যে ঋক্‌ তোমরা গ্রহণ করেছ, এ ঋক্‌ হল আদ্যা। আদ্যা কে ? যে সব খেয়ে বসে আছে, সে আদ্যা। তাকে নিয়ে তোমরা আজ নাড়াচাড়া করছ।এর গতির বিশেষত্ব কি ? এর, আহবনীয়ের শরীর কি ? প্রাণ, বিদ্যুৎ, দ্যু, আকাশ। এর ঋক্‌ কি ? ক্রীং যদি হয় ঋক্‌, আর ক্রীং যদি হয় আদ্যা, তাহলে এই গার্হপত্য, এই দক্ষিণাগ্নি কার প্রকাশ ? এই আদ্যার। আদ্যা—এটি কি বেদন ? এর বিশেষত্ব কি ? সমস্ত পূর্ণতায় নিয়ে দেয়, পূর্ণতায় নেয়, এই হল এর ধর্ম্ম। এখানে ছোটখাট কিছু নিয়ে কারবার চলবে না; দিয়েছ কি সব নিয়েছে। তোমাদের বলে দিয়েছি যে, জন্মাবামাত্র, এই দেবীর বুকে সোম, দুধ দেখতে পাওয়া চাই। জন্মমাত্র, যেখানে যেখানে নিজবোধ জন্মাল, সবটা যদি দেখ, যদি দেখ যে, তুমি জন্মালে তেত্রিশকোটি দেবতা জন্মায়,  তাহলে এই আদ্যার গতিকে স্বচ্ছন্দে প্রাণ বলে নিতে পারবে। ইনি যখন যে দিকে যান, সর্ব্বস্ব নিয়ে যান, এই জন্য ইনি প্রাণস্বরূপ। তোমরা যখন মর, সর্ব্বস্ব নিয়ে মর; যখন চলে যাবে সর্ব্বস্ব নিয়ে যাবে। তা হলে তুমি আদ্যা ? এই প্রাণের গতিটি দেখতে পাচ্ছ ? একেবারে সর্ব্বস্ব নিয়ে যাওয়াটা যদি দেখতে পার, প্রাণটা যেমন সর্ব্বস্ব নিয়ে চলে যায়, কারও ধার ধারে না, সেই যদি হয় আদ্যা, তা হলে তুমি আদ্যা ? তোমার আমার মত চেহারা ধরে দেবী বসে থাকলে কি হবে, আমি দেখছি—আদ্যা বসে রয়েছেন। আমাকে, তোমাকে, সবাইকে কোলে করে ও বসে আছে। যখন বেরিয়ে যাবে, ঐরকম করে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। দেবী ! আমি তোমায় বুকে করে পূর্ণতায় ভরে গেছি; তুমি আমায় বুকে করে পূর্ণতায় ভরে গেছ। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। কত দূর গেল, কম্‌নে দিয়ে গেল ? যেমনি বললে, অমনি ঋক্‌, যজুঃ, সামে গেল ? চলেছে ? তোমাতে সোম আস্বাদন করে গেল ? গিয়ে কি চেহারা ধরছে ? আদ্যা। সোম আস্বাদন করে ভূত গড়লে, না 'আদ্যা' গড়লে ? ভাত, ডাল খাইয়ে, পয়সা খরচ করে ছেলেটিকে একটা ভূত গড়লে; বললে সবটা পণ্ডশ্রম হল। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। এমন কোন্‌ কথাটি বলেছ, যা জানতে না পেরেছ ? যে জানতে পারছে, সেই আদ্যা ? যে কথাটি তোমার প্রাণে উঠছে, যার ভাব খেলছে, তাতে কি  অন্য কাকেও বলতে হয় যে, "যা কইলি,তা শুনেছিস ?" না automatically শুনা হয় ?  তা হলে ক্রীং ঋক্‌ শুনছেন, ঋক্‌ মধু পান করছেন ?  ক্রীং এর নাম জাতবেদা। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। সোমরসকে আবার তৈরি করে নিয়েছি*। সোনা ছিল, সোনার হার ছিল, তা দিয়ে মাথার মুকুট তৈরি করলাম। সোনা ছিল, সেগুলো ভেঙ্গে মাথার মুকুট করলে, জাতবেদা করলে। এখন তুমি বাঁদর গড়বে, না জাতবেদা আদ্যা গড়বে ? 
-------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য। 
* সোমরসকে আবার তৈরি করে নিয়েছি— সুনবাম সোমং।  সুনবাম সোমং —সোমকে নবীন করে সু বা সুত করা।  
-------------------------------------------------------------
ওঁ সর্ব্বসঙ্কটহারিণ্যৈ আদ্যায়ৈ স্বাহা। জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। গুরো ! এত কথা থাকতে আপনি কেন 'সঙ্কটহারিণী' কথা আনলেন ? কোথায় কোথায় আমাদের সঙ্কট সম্পন্ন হয়েছে ? সর্ব্বত্র। বেদপ্রবাহ বইছে না। কোথাও কোথাও ময়লা জমেছে, যাতে সে বইতে পারছে না, এই হল সঙ্কট। এ থেকে আমাদের উদ্ধার কর দেবি, সর্ব্বসঙ্কটহারিণি। কেন ? গার্হপত্য থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে আহবনীয়ে যদি আমার বেদগতি ঠিক হয়, তা হলে যত কিছু ফোটা, তাতে আমার অধিকার এসেছে।যত কিছু ঋক্‌, সে সব তোমার বুকে দেখে আমি স্বর্গের দেবতা হয়েছি। এখন এমন করে সবটা বেদ খুলে দাও, যাতে সব সর্‌সর্ করে বয়ে আসে। ওঁ সর্ব্বসঙ্কটহারিণ্যৈ আদ্যায়ৈ স্বাহা। জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। কোথায় আটকাচ্ছে দেখতে পাচ্ছ ? খড়্গ চলছে না, ঐ তুমি যেমন মানুষটি, তেমনি বসে আছ। হে দেবি ! খড়্গ চালাও, আমায় খট্ট কর, তুমি মহতী হও। তবেই রুদ্র শূল ধরবে, ইন্দ্র বজ্র ধরবে, ব্রহ্মা অক্ষসূত্র এবং বিষ্ণু চক্র ধরবে। ওঁ সর্ব্বসঙ্কটহারিণ্যৈ আদ্যায়ৈ কালিকায়ৈ স্বাহা। সর্ব্বসঙ্কটহরা—বয়ে চল, বয়ে চল, বয়ে চল, চল, চল। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। পাদ্যং—এই পাদ্যটি কেমন করে বয়ে গিয়ে, মায়ের পায়ে গিয়ে পড়ল, আর শেখাতে হবে কি ? এখনও শেখাতে হবে ? কোন্‌ বিশিষ্ট ঋক্‌ নিয়েছ ? 'পাদ্য'। এটি ঋক্‌, গার্হপত্য অগ্নি।এর তনু কি ? এ পাদ্যে পৃথিবী আছে, অগ্নি আছে, অন্ন আছে, আদিত্য আছে। এ পাদ্যের দ্বারা যত শব্দ হতে পারে, সমগ্র জ্ঞানে নিয়েছ ? আদিত্যকে জ্ঞানে নিয়েছ ? আর এতে অগ্নি আছে ? সে কে ? বাক্‌। আর তার ধরিত্রী। অগ্নি, পৃথিবী, আদিত্য নিয়েছ ? যেখানে যত পাদ্য আছে, এঁকে ছেড়ে কেউ যেতে পারে না ? পাদ্যে ধরিত্রী আছে, একে সে ধরেছে ? অন্ন, অদনীয় আছে ? কার অন্ন ? দেবতার । তা হলে এটি আমার পূর্ণ পাদ্য, আদ্যাভিমুখে চলেছে। সেখানে কি আছে ? আছে বিদ্যুৎ, আছে প্রাণ, আছে দ্যু, আছে আকাশ। এখানে যাকে বলছ অগ্নি, ঐ অদিতি ক্ষেত্রে সে বিদ্যুৎ। এই অগ্নি যদি ছাড়ি, একেবারে বিদ্যুতে গিয়ে পড়বে। এখানে যাকে আদিত্য বলি, সে একেবারে দ্যুক্ষেত্রে গিয়ে পড়বে। দ্যুক্ষেত্র সেই তত্ত্ব, যিনি আপনি আপনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখছেন না, আত্মজ্ঞান যেখানে কখনও হারায় না। এই আদিত্যকে ছাড়লে তুই দ্যুক্ষেত্রে পড়বি ? এইখানে যেটা অন্ন আছে, ওখানে সেটা প্রাণ হবে ? আর এখানে যেটা পৃথবী, সেটা ওখানে আকাশ হবে ? গার্হপত্যাগ্নি আহবনীয়তে পড়তে বাধ্য। একে ছেড়ে দিলে ঠিক রাস্তায়, আহবনীয়তে পড়বে। এই জন্য এর চারিটি শরীর দেখতে পাচ্ছি। এবার ঠিক ওতে পড়বে ? পাদ্যং ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। আচ্ছা, এ কি হল ?  আমি মায়ের পা ধোয়াতে গেলুম, আমার সর্ব্বাঙ্গ ভিজে গেল, আমার স্নান হল। কেন ? কারণ, যেখানে পা, সেইখানেই মাথা। এতৎ পাদ্যং ক্রীং আদ্যায়ৈ স্বাহা। বিদ্যুৎ, প্রাণঃ, দ্যৌঃ, ব্যোম  গার্হপত্যে আবির্ভবতু স্বাহা*।
--------------------------------------------------------------------------------
 প্রকাশকের মন্তব্য।
* প্রশ্নোপ্নিষদ্‌ মন্ত্র ৪।৩ দ্রষ্টব্য।  
------------------------------------------------------------
এস এই অগ্নিতে, এই ঘৃতে, এই যজ্ঞে, এই বেদিতে, এস—নেমে এস। ইদং অর্ঘ্যং ক্রীং আদ্যায়ৈ স্বাহা। [ দেবীর দিকে চেয়ে উন্মত্তভাবে ] দাও—দাও—দাও ! দ্যু নিয়ে, প্রাণ নিয়ে, আকাশ নিয়ে, বিদ্যুৎ নিয়ে, আমার এই গার্হপত্য অগ্নিতে মূর্ত্ত হয়ে দাঁড়াও মা, মূর্ত্তি পরিগ্রহ কর। ইদং স্নায়ীয়ং ক্রীং আদ্যায়ৈ স্বাহা। বিদ্যুৎ নিয়ে, প্রাণ নিয়ে, আকাশ নিয়ে, দ্যু নিয়ে আমার এই গার্হপত্য অগ্নিতে মূর্ত্ত হও। যেমন মূর্ত্তিতে তোমার ঋক্‌ রচনা করেছি, যেমন করাল, যেমন ঘোরা, যেমন শিবের করপল্লবে পা, যেমন কোলে শিশু,  এমনি করে মূর্ত্ত হয়ে আমার এই গার্হপত্যে দাঁড়াও। এস,এস, এস। ইদং বস্ত্রং ক্রীং সর্ব্বসঙ্কটহরায়ৈ কালিকায়ৈ স্বাহা। [ বহু বার ]। আমার এই গার্হপত্য অগ্নিতে, এই যে এতে, বিদ্যুৎ, প্রাণ, আকাশ ও দ্যু নিয়ে তনুময়ী হয়ে দাঁড়াও মা। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। এতে গন্ধপুষ্পে সর্ব্বসঙ্কটহরায়ৈ কালিকায়ৈ স্বাহা। এস, এস, এস। জানি না, তোমার জন্য কবে কান্না সুরু করেছি। আমার এই সমস্ত কান্নার অবসান করে আজ তুমি এস, এস, এস। ইদং নৈবেদ্যং ক্রীং সর্ব্বসঙ্কটহরায়ৈ কালিকায়ৈ স্বাহা। বিদ্যুতে স্বাহা। আকাশায় স্বাহা। দিবে স্বাহা। প্রাণায় স্বাহা। বৈরিপ্রাণহরায়ৈ স্বাহা। মা বল্ ! মা ! [ ১টা ৪০ মিনিটে তৃতীয় পর্ব্ব সমাপ্ত। ]

                                হোম। 
                     [২টা ২০ মিনিটে আরম্ভ।]

ওঁ অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজং। হোতারং রত্নধাতমম্‌। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। এই আগুন জ্বলছে দেখতে পাচ্ছিস রে ? মা দাঁড়িয়ে, আর তোরা এতগুলি ঋক্‌ বসে আছিস ? ঐ দর্শনে খাচ্ছিস ? যিনি তোর খাওয়া দেখছেন, তোর দেখার উপর অধিষ্ঠিত হচ্ছেন, তিনি জাতবেদা মা। তিল হাতে নিয়ে আগুনে দিছিস, এত দেখছিস ত ? ঐ দেখা শুনার ভিতর যে আছে, তার নাম জাতবেদা। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। এই দেখাটা কোথা থেকে ঝরল ? ঐ আদ্যা থেকে, যে গোড়া, তা থেকে। সে তোকে খাইয়ে খাইয়ে দেখা শোনার আকারে ঝরে পড়ে। এই দেখা শোনা থেকে যা ঝরে পড়ছে, তাতেই রয়েছ ত ? কাতে ? ক্রীং । এমন কিছু কি আছে, যা ওতে নেই ? কোনও দর্শন ? কোনও স্পর্শ ? ও নিজে রূপ, শব্দ, আস্বাদন সেজে বলছে,—''দেখি, আমি কেমন রূপময়, শব্দময়, আস্বাদনময় ।''  বীর্য্য সেজে বলছে,—" দেখি, আমি কেমন বীর্য্যময়।"  ক্রীং  কালিকায়ৈ স্বাহা। তোর চোখ দিয়ে যে রূপের ঢেউ, জিহ্বা দিয়ে যে রসের ঢেউ, কাণ দিয়ে যে শব্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে, এ কে ? কালিকা। এষ মে আত্মা সর্ব্বরূপময়ঃ, সর্ব্বস্পর্শময়ঃ, সর্ব্বপ্রাণময়ঃ। এষা মে কালী। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা।ঠিক হচ্ছে ? গুরু হুং দিচ্ছে ?  বল্‌—ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং —আঃ ! প্রাণ আমার ! দেবি আমার ! কালি আমার ! —হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, হুং হুং ক্রীং ক্রীং স্বাহা । প্রাণ আমার ! বল—প্রাণ আমার, তুমি যেও না। তুমি গেলে আমাকে যেতে হবে। আমায় ছেড়ে যেও না দেবি, যেও না প্রাণ আমার ! হুং হুং, ক্রীং ক্রীং, দক্ষিণকালিকে স্বাহা। তুমি যেথায় যাবে, আমায় সঙ্গে নিও। আমাকে অপ্রাণ করে তুমি যেও না, তুমি যেথায় যাবে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেও। তুমি ভূমা—তোমার যাওয়াও অলৌকিক, থাকাও অলৌকিক। তুমি আছ ও নেই, নেই ও আছ। আহাহা ! দেবী আমি তোমার কি বর্ণনা করব ! তুমি এই প্রতিশ্রুতি দাও, তুমি যেথায় যাবে,আমাকে বুকে* করে নিয়ে যাবে। তুমি তোমার দধিক্রামূর্ত্তির* যথার্থ পরিচয় দিও। তুমি চতুর্দ্দশ ভুবন ঘুরে বেড়াও, সোমপান করে বেড়াও, আমাকে বুকে নিয়ে বেড়িও। 
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
দধিক্রা—দধ্‌ (ধারণ করা) +ই (চলা)  + ক্র (ক্রমণ; গতি-ক্রম)- যাঁর গতিক্রম বা চলাই হল সবাইকে ধারণ করে চলা। সবাইকে নিয়ে যিনি চলেন তিনি প্রাণ। হৃদয়ের দ্বারা ধারণ করে ইনি চলেন, তাই ইনি সর্প; কেননা সাপেরা বুকে হাঁটে। তাই বেদ এঁকে 'সসর্পরি/সসর্প' বলেছেন।
------------------------------------------------------------

ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং , দক্ষিণকালিকে স্বাহা। ঐ উনি ক্রীং। আত্মবোধে বললেন হুং হুং হুং। যাঁহাতক বললেন, অমনি ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তৈরি হল। মা কি অদ্ভুত দেবতা ! তোমার হেলনে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর গড়ে ওঠে। কি অপূর্ব্ব লহরী ! ত্রি-ভঙ্গিমা। গা নাড়া দিলে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর জাত হয় ! দেখতে পাচ্ছ ? গুরুর সামনে, অগ্নির সামনে, মায়ের সামনে বলছ ? ধন্য তোমরা ! ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে স্বাহা। মুখ্যু আমি; ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দাঁড়াল, এ আমাকে তোমরা দেখিয়ে দেবে ? ভিন্ন ভিন্ন স্তর ভেদ করে এই যে বেদ গতি চলেছে, এর মধ্যে হুঙ্কার দেওয়া শিব কোথায় ? প্রতি স্তরে নিজেই তাই হয়ে বসে বলছে হুং হুং। অমনি সেখান থেকে যা ঝরছে, তার নাম হল সোমপা, ইন্দ্র। তার নাম হল প্রাণ। ইদং দ্রষ্টা, সেই ইদংয়ের সোম পান করছে; 'অহং ইদং' বলে সোমপা হচ্ছে। তোমরা যখন বল 'আমি মানুষ'— তখন মানুষ-রস খাও ত ? ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে স্বাহা। ওঁ শঙ্করী শঙ্কর মাতা, ব্রহ্মাণী ব্রহ্মজননী, বৈষ্ণবী বিষ্ণুপ্রসূতিঃ সঙ্কটাৎ ত্রাহি মাং শিবে। ওঁ শিবমাতা শিবানী চ ব্রহ্মাণী ব্রহ্মজননী, বৈষ্ণবী বিষ্ণুপ্রসূতি,— এ কথাগুলি কেন বলছ ? তুমি দুই দিক্‌ দিয়ে মায়ে মোড়া রয়েছ, এইটি দেখতে হবে। তুমি সামনে চাও, ভোগ্যা হয়ে মা জড়িয়ে ধরেছে, পিছনে চাও— মা ! শিবমাতা শিবানী চ ব্রহ্মাণী ব্রহ্মজননী, বৈষ্ণবী বিষ্ণুপ্রসূতি ত্রাহি মাং সর্ব্বসঙ্কটাৎ স্বাহা। ওঁ অমানামাসি ! অমা হি তে সর্ব্বং ইতি। কাকে ডাকছ ? কাকে বলছ ? যাতে সব।  অমা হি তে সর্ব্বং ইতি, তস্মাৎ উচ্যতে অমা। যাতে তোমার খুদ-কুঁড়া, রাজত্ব ইন্দ্রত্ব, তোমার প্রাণটা যা পেতে চায়, ভোগ করতে চায়, ও থেকে সব নিতে হবে। অমা হি তে সর্ব্বং ইতি। ইদং সর্ব্বৌষধিমন্থং —এ এইটুকু ঘি মাত্র নয়, এ আমার সর্ব্বস্ব। আমি সুদ্ধ আমার যা কিছু আছে, সমস্তটাকে তাল বেঁধে হাতে ধরেছি। আমার সর্ব্বস্ব বেঁধে তোমার পায়ে দিচ্ছি। ইদং সর্ব্বৌষধিমন্থং—এদের নাম ঔষধি, উষ্মা, প্রাণ, যা নিয়ে বেঁচে আছ। ইদং সর্ব্বৌষধিমন্থং ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে স্বাহা। ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।দুর্গা শিবা ক্ষমাধাত্রী স্বাহা স্বধা নমো'স্তুতে।।
স্বাহা। [ ২ টা ৪৫ মিনিটে হোম সমাপ্ত। এর পর গুরু হোম করলেন এবং অন্ন নিবেদন করলেন। তার পর আরতি করলেন । গুরু সহ সকলের প্রণাম। ৩টা ৪০ মিনিটে দ্বিতীয় দিনের পূজা সমাপ্ত।]  

                     তৃতীয় দিন। 
১২ই পৌষ, ১৩৪৮, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১, শনিবার প্রাতে ৯-৩৫ মিনিটে আরম্ভ। 

ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ, ঐং, গুরু—আমাতে বল সঞ্চার কর; যেন আমি আজ তোমার যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারি। হে অনন্ত, হে অনন্ত দেবতা, অনন্ত দেবপ্রকাশ, আমাতে তোমরা সংযুক্ত হও, আমি যেন যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারি। জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, আদিত্য, চন্দ্রমা, ইন্দ্র, আমাতে তোমরা যুক্ত হও, বজ্রিণীর পূজায় তোমরা সকলে একত্র হও। হে জাতবেদা! অনন্ত লোকসকল সৃষ্টি স্থিতি সংহারের দ্বারা আমার আত্মস্থ হক, যজ্ঞ সম্পাদন করুক, যজ্ঞস্থ হক। করালি ! অমা ! ক্রতুময়ী তোমার নির্দ্দেশ কোমলাতিকোমল, অগ্রাহ্য। আজ তুমি গ্রাহ্য শক্তিরূপে আমায় বজ্রধর করে তোল; আমি তোমার পূজায় বহিঃক্ষেত্রে অবতরণ করি। ভগবতী অমা ! আজ তুমি মা হয়ে দাঁড়াও*। 
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* যিনি অমা, তিনি মাত্রা যুক্ত হয়ে, অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য হয়ে, মা হয়ে দাঁড়ান। 
------------------------------------------------------------
অমা ! মা হয়ে দাঁড়াও। অমা ! মা হয়ে আমায় শতক্রতু কর, যজ্ঞময় কর । দেবি ! আমার যজ্ঞ পূর্ণ হক, অন্ন বিস্তারিত হক, অপ্রাণ দূরীভূত হক, মৃত্যু চক্ষু থেকে অপসারিত হক। মা ! বজ্রিণী ! দেবি ! মহাপ্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ রক্ষ স্বাহা। দেবি, জাতবেদা, মহাপ্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ রক্ষ স্বাহা। প্রতি প্রকাশের আত্মা, প্রতি প্রকাশের প্রাণ, প্রতি প্রকাশে বজ্রধরী; আমা থেকে যা কিছু প্রকাশ হবে, এই প্রকাশে প্রকাশে তুমি আমার চক্ষু থেকে আর অন্তর্হিত হয়ো না। আমার কথায় কথায়, আমার প্রকাশে প্রকাশে তুমিই ছুটতে থাক তুমি প্রকাশিত হয়ে থাক । তুমি দিগ্‌দিগন্ত ব্যেপে, আমার প্রজ্ঞাকাশে স্থির বিদ্যুতের মত প্রজ্বলিত হতে থাক। মা ! দেবি ! পূর্ণে ! আমাতে যজ্ঞ পূর্ণ কর। ক্রীং জাতবেদায়ৈ স্বাহা। [বহু বার]। মণিধরি, বজ্রিণি, ক্রীং জাতবেদায়ৈ স্বাহা।[বহু বার]। 
কোন্‌ মণির আলোক দিগ্‌দিগন্তে বিস্তৃত হয়ে এ বিশ্ব রচনা করেছে ? যেমন সূর্য্যের আলোক দিগ্‌দিগন্তে বিস্তৃত হয়ে দিবা রচনা করে, চন্দ্রের আলো দিগ্‌দিগন্তে ছড়িয়ে জ্যোৎস্না রচনা করে, তেমনি কোন মণি ছুটে আসছে যে তুমি হয়েছে, আমি হয়েছে ? সে মণি কে , যার বিদ্যুৎ তেজে, বিদ্যুৎ বর্ণে আমরা ফুটে উঠেছি ? সেই মণি আমরা দর্শন করছি। তাই আজ স্তুতির আকারে বাক্‌ ফুটছে—যে মণি আমায় জাত করেছে, যে মণি বিশ্বকে জাত করেছে, তাকে দেখছি, তাতে দৃষ্টি স্থির করে তার উদ্গান করছি; কেননা তার আলো হল আমার মূর্দ্ধা। ওঁ মণিধরি, বজ্রিণি, জাতবেদা, ক্রীং, মাং, রক্ষ রক্ষ রক্ষ স্বাহা। ঐ মণিরূপিণী যেখানে প্রতিষ্ঠিত, সেইখানে জাত হয়েছে আমাদের শিরোদেশ, আমাদের মাথা। ঐখান দিয়ে বিদ্যুৎজ্যোতি বেরিয়ে, একটি সুশৃঙ্খল ধারায় ফুটে আসছে; তাতে গঠিত হচ্ছে তেত্রিশ কতি দেবতা। তারা স্তুতিপরায়ণ—মা, মা করে সবাই ডাকছে। আত্মবেদময় জাতবেদার গতি এমন একটা ভঙ্গিমা কোথাও নিচ্ছে না, যেখানে নিজে, নিজে, নিজে, —এই প্রজ্ঞার উদ্ভাসন হচ্ছে না। এ উদ্ভাসন কোথা নেই ? জল, বায়ু, কীট, পতঙ্গ, তুমি, আমি, সর্ব্বত্র—নিজে, নিজে, নিজে, এ আলোক, এ প্রদ্যোতন কোথায় নেই? নিদ্রিত, মৃত্যুগ্রস্ত, তবু সে-ও নিজে, নিজে, নিজে। মণিধরি, বজ্রিণি, মহাপ্রতিসরে, মাং রক্ষ। আমার এ চোখ নিবিয়ে দিয়ে তুমি কোনও দিকে ছুটো না । জাতবেদা মা, তুমি কোনও দিকে ছুটো না । এমনি করে তোমাকে আমি পেলুম মানে—নিজেকে পেলুম । নিজেকে পেলুম, মানে তোমাকে পেলুম । মণিধরি, বজ্রিণি, জাতবেদা, ক্রীং মাং রক্ষ রক্ষ  স্বাহা । তুমি বিদ্যুতের মত ছুটে চল । চলছ চল—বিদ্যুতের ভঙ্গিমায় ছোট, বিদ্যুতের মত বলীয়ান্‌ হও, দীপ্ত হও, কিন্তু আমায় ফেলে ছুট না ।আমায় ফেলে ছুটলে যজ্ঞ পশু* হবে, আমার, যজ্ঞে অসুর ঢুকবে, অপূর্ণতা এসে  যাবে 
-------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র ৩।৯।৬ দ্রষ্টব্য।
-------------------------------------------------------------
মণিধরি, বজ্রিণি, মহাপ্রতিসরে, মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা । এ যজ্ঞ তোমারই শিক্ষা, তোমারই প্রকাশ।এ যজ্ঞে তোমার নিত্য কর্ম্মপদ্ধতিরই অণুসরণ করছি।দেবি, এমনি করেই তোমার এই মণিদ্বীপ থেকে দিগ্‌দিগন্ত আলো করে তুমি ছুটতে থাক, আলো করতে থাক, সাজতে থাক অনন্ত দীপ্তি, অনন্ত শক্তিধর। আমরা শব্দাড়ম্বর করে ডাল, ভাত, রূপ, গন্ধ বলে তাদের তুলে নিই; একটা স্পর্শ পেলুম, একটা রূপ পেলুম ব'লে তাদের তুলে নিই। আমায়  ভোগ দিতে, কি বিদ্যুতের গতি ধরে, তেজময়ী হয়ে আমার বুকে তুমি দাঁড়াও ! তুমি আসছ—মণিদ্বীপে চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, এমন কিছু আসছে না, যা তুমি নও। বিদ্যুতের মত তুমি ছুটছ; মুখে তোমার হ্রেষারব— আমি গন্ধ, আমি স্পর্শ, আমি শক্তি, আমি বীর্য্য, আমি জাত হই, আমি মৃত হই। মণিদ্বীপ থেকে ছুটে ছুটে তুমি তোমার এই অশ্বমেধ যজ্ঞ আমায় দেখাচ্ছ। 
মা আজ আমার সামনে। আমায় কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না, আমায় কেউ ভয় দেখাতে পারবে না, অন্ধকারের ছায়া দিতে পারবে না*।
-------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*অসপত্ন হি ইন্দ্র.—ইন্দ্র  অপ্রতিদ্বন্দ্বী ।   বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ মন্ত্র  ১।৫।১২।)
-------------------------------------------------------------

আজ আমার এই  যজ্ঞস্থলে যদি কোন শব্দ ওঠে,—জানব তুমি ফুটে উঠেছ। আজ আমার শব্দে যদি ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ফোটে, জানব— তুমি ঐ সব মূর্ত্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছ। আজ আমার নাকে যত গন্ধ ফুটবে, যত স্পর্শে আমি আলিঙ্গিত হব, আমি জানব না —আমি জানব না আর কাউকে; আমি দেখব— তুমি, বিদ্যুৎগতিতে ছুটছ তুমি। ভগবতি ! আজ আমি যে ভোগসম্ভার দিগ্‌দিগন্ত থেকে সংগৃহীত করে তোমার নামে সমর্পণ করব, আমি দেখছি, সে সব তুমি নিজে ছুটে ছুটে হয়েছ—তোমাকে প্রতিদান দেওয়ার জন্য নিজে তাদের বুকে ধরে দাঁড়িয়েছ । বজ্রিণি, মহাপ্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা। আজ আমার যজ্ঞে মাটি, জল, আগুন, বাতাস, এ-সব দিয়ে গড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ফুল ফল, আকাশ, বাতাস, পূজা, পূজক, সব কিছু বিদ্যুৎময়। সব বিদ্যুৎময়, বিদ্যুতের প্রকাশ, বিদ্যুতে পূর্ণ দিগ্‌দিগন্ত। মণিধরি, মহাপ্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা। আজ আমি নীরব মাটি, নীরব জল, নীরব আকাশ দেখব না। আজ আমি রবহীন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আজ চেতন-অচেতন-পূরিত আমার অতীত জগৎ, সে যে  উঠে দাঁড়িয়েছে রবময়—মা,মা মা ! ফুল আজ চীৎকার* করছে,—"আমি ফুল, আমি ফুল; আমি বজ্রে গঠিত, বজ্রিণীর সন্তান আমি।"  ফল আজ চীৎকার করছে,—"আমি ফলআমি বজ্রে গঠিত, আমি বজ্রিণীর সন্তান।" কোন্‌ মুহূর্ত্তে আজ এসব ঘটল ! 
--------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।           
চীৎকার= চিৎ স্বরূপের আকার; এঁর শব্দ বা রবই মূর্ত্ত বিশ্ব। 
--------------------------------------------------------------
আমি পূর্ণাহুতি দিচ্ছি—মণিধরি, মহাপ্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা। ওরে আমার প্রাণে গড়া হৃদয়ের দুলাল ! খণ্ডে খণ্ডে নিজেকে বিদীর্ণ করে, বুকের রক্ত দিয়ে আমি তোদের প্রজ্ঞা দিয়ে আসছি। আজ এই মহাযজ্ঞে তোরা বিদ্যুৎময় হ। ওঁ মণিধরি, বজ্রিণি, মহাপ্রতিসরে, মহাযজ্ঞে মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা। এ আলো দেখতে পেয়েছি। ওগো আমার কালো মা ! এত কালো তুমি ! দেবি ভগবতি, এত শক্তি তোমার ! ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। আয় এমন ভাবে যজ্ঞ করি, যাতে পাদপ্রবাহ হয়, পরপাদে যজ্ঞকে পূর্ণ না করতে হয়। প্রতি পদক্রমই যেন পূর্ণ যজ্ঞ হয়। সে কেমন করে হবে ? যদি এই ব্যবধান না পড়ে, তবে পূর্ণতার পাদক্রম হয় । ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। ভুলিস না, ও দিকে চোখ রাখ। ঐ মণি, আর আমার নয়নমণি একসঙ্গে গাঁথা থাকবে। এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। এই মন্ত্র হল মায়ের বেদবাক্য। ক্রীং বলতে বলতে মা কালিকা হয়ে দাঁড়াল। ঐ যে মন্ত্র বললি, মা অমনি ছুটে বেরোল। ঐ মণিদ্বীপ থেকে ঐরকম চেহারায় বিদ্যুৎ চমকাল*।
তুই কোন যুগেও মন্ত্র পড়িস নি , আজও নয়। ঐ মণিদ্বীপ থেকে মা ছুটে বেরিয়েছে, তারই রবদ্যুতি—ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। যেথা থেকে যত শব্দ ফুটেছে, যত রূপ ফুটেছে, যত রস ফুটেছে, যত আলো অন্ধকার ফুটেছে, সে ঐখান থেকে ঐ মা-ই ছুটছে। ঐ ক্রীং বেরোল ! মন্ত্রময়ি, নমো'স্তু তে স্বাহা। এক মন্ত্রে তুমি ধরছ রূপ, বেরোচ্ছ চোখ দিয়ে; এক মন্ত্রে তুমি ধরছ রসমূর্ত্তি, বেরোচ্ছ জিহ্বা দিয়ে; এক মন্ত্রে তুমি ধরছ শব্দমূর্ত্তি , বেরোচ্ছ কথার আকারে; এক মন্ত্রে তুমি ধরছ স্পর্শমূর্ত্তি, বেরোচ্ছ, প্রবাহিত হচ্ছ ঐ আকারে। বিদ্যুৎময়ি ! দেখতে না দেখতে চড়াক করে তুমি আর একটা হলে। বিদ্যুতের মত মা তোকে অনবরত ঘিরে বেড়াচ্ছে*।
-------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*ঘিরে বেড়ান ---সর্পিল চক্রগতি--- spiral motion---দধিক্রার গতি।
---------------------------------------------------------------------------
ঐ মণিদ্বীপ থেকে জ্যোতির শিখা বেরোচ্ছে; মা ওতে আরোহণ করে আসছে যাচ্ছে। যেমন নারীর পেটে সন্তান জন্মে; সে এক দিকে তাকে রচনা করে এবং একদিকে তাকে স্তন্য দেয়; তেমনি মা অনবরত 'তুই' সাজছে এবং বলছে—বামনদাস, অমুক, তমুক; আর একদিকে স্তন্য দিচ্ছে—ছুটছে, ছুটছে, ছুটছে ! বিদ্যুতের মত, তড়িতের মত, তুই যে মা !  তড়িতে সন্তান গড়েছিস; আমিও সেই তড়িতে তড়িতে তোর সঙ্গে সঙ্গে ছুটব। ইন্দ্রাণীরূপিণী, শচীরুপিণী  যজ্ঞ আমায় বরণ করুক,  বরণ করুক। ওঁ মণিধরি, বজ্রিণী, মহাপ্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা। এই গতি ভুলবে না, এই মণিদ্বীপ ভুলবে না, এই জাতবেদাকে ভুলবে না।জাতবেদাকে ভুলবে না, সে জানতে জানতে আপনি জন্মাচ্ছে। সূর্য্য থকে আলো বেরোচ্ছে,তাতে মনে হয়— সূর্য্য বসে আছে। অমন মনে করতে পারবে না, মনে করবে একেবারে সূর্য্যই বেরোচ্ছে। তুই কাঁচা মাংস এখন খেতে পারবি না, তাই তোর জন্য এখন সাগু বার্লি ব্যবস্থা। মায়ের আমার এই গতি দেখাই তোর খাওয়া দেখা। সব আপনা হতেই হয়ে যাবে। এখন সাগু বার্লি খাচ্ছিস। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। তোদের বসা দেখে মনে হয় একটা ঘোড়া এনে দিই।অমন মড়ার মত মাটিতে বসা আমার বিষবৎ লাগে। উত্তিষ্ঠ ! ওঁ মণিধরি, বজ্রিণি, মহাযজ্ঞে মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা। [ ১০টা ৩০ মিনিটে প্রথম পর্ব্ব সমাপ্ত।] 

         [ ১০টা ৪৫ মিনিটে দ্বিতীয় পর্ব্ব আরম্ভ।] 

ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং। ক্রীং হুং হ্রীং। দেবি ! বীর্য্যবান্‌ পুত্র সব, বিদ্যুদ্‌বরণা মা তোদের বিদ্যুৎমূর্ত্তিতে আজ খেলা করতে নেমেছে। তবু সাবধান করে দিচ্ছি, এমন কোথাও মাকে চমকাতে দিবি না, যেখানে তুই নেই। ক্রীং হুং। বেঁচে আছ ? হুং। ক্রীং হুং। হ্রীং স্বাহা। বজ্র বিদ্যুৎ গলে, রস হয়ে, শব্দ, স্পর্শ, রূপ হয়ে জমে উঠল। সে অতীব সুকঠিন, আবার অতীব কোমল। আবার সে জমে গেল। আমি কিন্তু হুং দিতে ভুললাম না। হৃদয় সমূদ্রে সাঁতার কেটে কেটে পড়লাম গিয়ে মানুষে । জীব জন্তু যাতেই পড়ি, তাতেই হুংকার দিতে ভুললাম না, হুং হুং হুং*
------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*হুং —শিব-বীজ-মন্ত্র। সমস্ত  বোধ বা জ্ঞান ক্রিয়ার মূলে অপরিণামী  আত্মবোধ  রয়েছেন, এইটি  দেখার নাম  হুঙ্কার দেওয়া। 
----------------------------------------------------------------------------
 দেবি করালি ! আমি তোমায় ছাড়লুম না । তুমি যে ওখানে অজ্ঞাতসারে থেকে যাবে, আমি জানব না, তা হবে না। তুমি আমায় গর্ত্তে ফেলেছ, কিন্তু মহিমময়ী তোমায় আমি দেখব; কত কাঠিন্য তোমাতে আছে, মৃত্যুর মত তোমার কত রূপ, তা আমি দেখব । এ যত ক্ষণ না দেখব, ততক্ষণ তোমাকে পেলাম না । ব্রহ্মময়ী তুমি যদি না দেখাতে—আমি এই রকমে মাটি জল হই, এবং তাদের ফেলে রাখি, যদি না তারা দেখে যে আমি মণিদ্বীপে রয়েছি। সে আমার মত গতিশীল হবার জন্য আঁকপাঁক করতে থাকে, আমার গতিটা ফিরে পাবার জন্য ধড়ফড় করে, তাতে তার ঠ্যাং বেরোয়, পাখা বেরোয় । আর যে হুংকার দিতে  শিখেছে, সে বিদ্যুতের মত চলে যায় আমার বিদ্যুৎগতিতে। আজ ব্রহ্মার অক্ষসূত্র আমার হাতে এসেছে, এ হল গতাগতির চক্র। কাকে বলে বিদ্যুৎ, কাকে বলে বজ্র, তা চিনেছি। মা কি করে চক্ষুরাদি দিয়ে প্রবাহময় হচ্ছে, বেরিয়ে আসছে দেখছিস ? empirically বলিস না, গতির ক্রম অবলম্বন করে বিজ্ঞানের সঙ্গে বলতে হবে— কে বেরোচ্ছে । বিদ্যুতের মত রূপ হয়ে ফুটে বেরিয়েছে ? রূপ পেলি ? চমৎকার দেখতে ! কি করবি ? হুঙ্কার দিবি ?  ওটা হয়ে গেল জীবের অহঙ্কার । খুব রস, খুব রূপ বলে তুই বসে পড়লি; তোর মা চলে গেল । "ওরে স্বর্গের ইন্দ্র, মায়াবি ! মর্ত্তে তুই আমায় ভোগ করতে থাক, আমি বিদায় নিলুম ।" তুই যখন একটি সুন্দর গন্ধ পেয়ে বললি—"আহা, কি সুন্দর গন্ধ !" অমনি, ও পাশে দাঁড়িয়ে সে বললে,—"ওরে ইন্দ্র, তোকে পুরুরবা করেছি। তুই মানবোচিত ভোগ কর, আমি চললুম।" যে গুরু পেয়েছে , সে অমনি ডাক দিয়ে উঠবে—হুং। তুমি যদি স্বর্গে যাও ত আমি যাব । তুমি যদি মর্ত্তে আস, আমি আসব ।তুমি আমার, আমি তোমার । তুমি আমায় ইন্দ্র করেছ, চোখ, নাক, কাণ দিয়ে নিজত্ব দিয়েছ এবং তাকে মানবী ভাবে ডুবিয়ে দিয়েছ । ঐ যে চোখ দিয়ে, কাণ দিয়ে, নাক দিয়ে অনবরত গতি বিকীর্ণ  হচ্ছে, ঐগুলিই বিদ্যুৎ। তুই বিদ্যুন্ময় ? যদি দেখিস যে, মণিদ্বীপ থেকে যে বেরোচ্ছে, সে ঐখানে, তা হলে তুই বিদ্যুৎধর, বজ্রধর ইন্দ্র। আজ বজ্রধর হয়ে এই বজ্রিণীর পূজা করতে হবে। এই মাকে মা বলার জন্য তোকে বজ্রধর হতে হবে। আজ আমরা ক্রমে ক্রমে পূজা করব না ; বজ্রধর হয়ে, প্রতি পদক্ষেপে পূর্ণ পূজা করব। আমার মত ভাত খেতে, ডাল খেতে, বাতাস খেতে, আদর খেতে, প্রাণ দিয়ে প্রাণকে আলিঙ্গন করতে, এইখানে তোমাকে নামতে হবে। 
অস্য মন্ত্রস্য ইন্দ্রঃ ঋষিঃ, মাতা অদিতির্দেবতা, মাতৃযজ্ঞে বিনয়োগঃ। এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। যে ফুল দিচ্ছিস, যারা মড়ার মত বেরোচ্ছে, মণিদ্বীপে এই পূজা সম্পন্ন করলে ওরাই জ্যান্ত হয়ে বেরোবে। অস্য মন্ত্রস্য ইন্দ্রঃ ঋষিঃ, কালিকা দেবতা, মাতৃযজ্ঞে বিনয়োগঃ, মণিদ্বীপবাসিন্যৈ ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা । ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, এতস্য মন্ত্রস্য ইন্দ্রঃ ঋষিঃ, মণিদ্বীপবাসিনী আদ্যা অদিতির্দেবতা, কালিকাযজ্ঞে বিনয়োগঃ। এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং দক্ষিণকালিকে স্বাহা। [ বহু বার ] । মায়ের আমার গতি বিদ্যুতের মত। যেমনই ছন্দে মা বেরিয়ে পড়ুক না, অমনি নিজেকে সঙ্গে নেয়। যেমনি আত্মবোধের বিকাশ করে, অমনি আকাশ, জ্যোৎস্না, জল, মাটি, সব কিছু জন্মায়। তোরা এই গতিকে অবলম্বন করে চল । এই যে আমার হৃদয়-সরোবর, যাতে কত পদ্ম ফুটিয়ে রেখেছি, এ সরোবর কে ? ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে— এতস্য মন্ত্রস্য ইন্দ্রঃ ঋষিঃ, মণিদ্বীপবাসিনী কালিকা দেবতা, মাতৃযজ্ঞে বিনয়োগঃ । এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে স্বাহা।মণিদ্বীপে যে রয়েছে, আমাতেও সে-ই রয়েছে। আমার বুকের বলে যাতে যাতে আমি ছড়িয়ে যাচ্ছি, তাতে তাতে আমি ঐ হুঙ্কারময়ী কালিকাকে দেখছি। ওর হুঙ্কারের কি নিবৃত্তি আছে ? ঘোর হুঙ্কার ! সে হুঙ্কার কাণ দিয়ে শুনবার নয়, সদা-প্রত্যক্ষ স্বতঃসিদ্ধ সে হুঙ্কার 'নিজে'। এত বড় হুঙ্কার কি আর আছে ? যত কিছু, পর, সে অসুর হক, ডাকাত হক, সব পালিয়ে গেল। ওর ফুলের গন্ধটা, ওর বাগানের ফলটা, ওর বাগানের ধানটা, ইত্যাদি যত কিছু পড়ে ছিল, যখন বললুম 'নিজে', অমনি সে সব আর কারও বাগানের নয়। এত বড় হুঙ্কার কি আর আছে ? ওরে আমার সন্তান সব ! তোদের কাউকে ফেলে যাচ্ছি না ত ? ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, এতস্য মন্ত্রস্য বজ্রধরো বিদ্যুৎময় ইন্দ্রঃ ঋষিঃ, মণিদ্বীপবাসিনী জাতবেদা আদ্যা কালিকা শ্মশানবাসিনী দেবতা, মহাঅন্নপূর্ণাযজ্ঞে বিনয়োগঃ, ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, স্বাহা । এমনি করে এক এক বার আসব, এক এক বার বিদ্যুৎ জ্বালিয়ে দেব । [ ১১।১৫ মিনিটে দ্বিতীয় পর্ব্ব সমাপ্ত।]

                           [ ১১।৩০  মিনিটে তৃতীয় পর্ব্ব আরম্ভ।]
ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং স্বাহা। ঐ যে ক্রীং, ঐ যে মণিদ্বীপবাসিনীর বিদ্যুৎমেখলাময় সুদীপ্ত গতি, ঐ গতি আত্মবোধ রচনা করলে, শিবকে অক্ষর আত্মত্বে ফুটিয়ে তুললে । ফুটিয়ে যে মিথুন হল, তাতে জাত হল প্রাণ; রসের সাগর ভরে গেল । এই যে হ্রীং, এই যে প্রাণের সমুদ্র, এতে আজ উঠেছে এক বিপুল সমুদ্র; সেই সমুদ্রের নাম মা। আজ যত কিছু অন্য ঋক্‌, যত কিছু অন্য শব্দ, তাকে ঢাকা দিয়ে, এই সমুদ্র এক উত্তাল তরঙ্গে উত্তাল হয়ে উঠেছে। তার নাম মা । অমা, মা অনির্ব্বচনীয়া মা মূর্ত্তি ধরে আজ নেমে এসেছে । সে ঢেকে দিয়েছে, গ্রাস করে নিয়েছে তোর ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অহঙ্কারের আলোড়ন । মা গ্রাস করে নিয়েছে, আজ আর কোথাও কেউ ফোটে না; যে ফুটতে যাচ্ছে, সেই 'মা মা ' চীৎকার করছে । এই চীৎকার যদি শুধু এখানেই সমাপ্ত হত, তা হলে আমাদের বাসনা তৃপ্ত* হত না। কেননা, এইখানে যা ফোটে, ঐখানে তা সমাপ্ত* হয়।
------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* সমাপ্ত= সম্যক্‌ আপ্তি।
------------------------------------------------------------------------------
আমরা একটা ছোট্ট জীব, এই কথা ভেবে রাখি; কিন্তু এ ঢেউ ঐ অমা মা, দধিক্রা-অশ্বে চড়ে এখানে সে মা সেজেছে। অমা মায়ের 'অ' আছে ওখানে, 'মা' আছে এখানে; আমি পিছনে ও সামনে মায়েতে ঘিরে গেছি। ঐ যে তোরা স্বরবর্ণ বলে পণ্ডিতি করিস, ঐ গোড়ার বর্ণ 'অ'কার, আর ডগের বিন্দু অনুস্বার, ঐ হচ্ছে অমা । গুরু মশায়ের কাছে 'অ' 'আ' শিখে তোরা পূজাই করছিস। কোন হীরককে কাচখণ্ডের মত ব্যবহার করছিলি এইবার বুঝে দেখ।আমাকে জন্ম দিয়ে মা হন অদিতি । যে অদিতি মা, যে আদ্যা, সে আমাকে জন্ম দেয়। আমি ইন্দ্র, বজ্রধর ইন্দ্র, আমি স্বর্গের রাজা। আবার আমি জন্ম দিই এই অদিতিকে। আমি না জন্মালে ওকে 'মা' বলার আর কেউ নেই; আমি আছি, তাই ও মা, নয় ত ও অমাবস্যার অন্ধকার । আজ এই মহাযজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য যত সব শিষ্য সেজে মা পূজা সম্পন্ন করছেন । মা সেজেছে শিষ্য; যেমন তোর অন্তরে গন্ধ ঢোকাবা ন্য সুগন্ধময় পুষ্প সাজে, প্রাণ বওয়াবার জন্য জল সাজে । এই যে বাহ্য মূর্ত্তি, প্রবহণ, এ তোকে বইয়ে দেবার জন্য; তুই জড় হয়ে বসে না থাকিস, তাই এই জড় মূর্ত্তি ধরে তোকে বুকে ধরে থাকেন । তাই আজ মা এই জ্ঞান বইয়ে দেবার জন্য শিষ্যমণ্ডলী হয়ে জাগ্রত হয়েছে। ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, এতস্য মন্ত্রস্য ইন্দ্রঃ ঋষিঃ, অমা দেবতা, অন্নপূর্ণাযজ্ঞে বিনয়োগঃ । ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং স্বাহা। এল, ফিরে এল । মণিদ্বীপ থেকে বিদ্যুতের মত আকাশে ছড়াল, আবার ওখানে ফিরে গেল। তাই তোরা হ্রীং হ্রীং বলে এসে পড়লি,  ক্রীং ক্রীং বলে আবার 
ফিরলি । একে নিয়ে জগৎময় ছড়িয়ে পড়লি, আবার জগৎ নিয়ে তাতে  গেলি। এই হল বিদ্যুৎমেখলার গতি ।প্রতি শব্দ, কোনও রূপ রস, কোনও বিশ্ব, যা কিছু ফুটেছে বলে তোর জ্ঞান হচ্ছে, তার মানেই হল একটি কথা, একটি ঋক্‌, একটি অর্চি, একটি জ্যোতি ফুটেছে । জ্যোতি কখনও ফুটে থাকে না, যতক্ষণ না তার কেন্দ্রকে আবর্ত্তন করে । এমন কোনও জ্যোতি নেই, যা তার কেন্দ্রকে আবর্ত্তন না করছে । রূপ, রস, ইত্যাদি যা বললি, সে ঐ মা বজ্রের আকারে বেরিয়ে, তোকে মাই খাইয়ে চলে গেল । তুই তাতে মগ্ন রইলি । পুরুরবার মত তুই বললি না —" ওগো উর্ব্বশি, তুমি যাও কোথা ? তোমায় ছেড়ে আমি যে থাকতে পারি না; তুমি যদি যাও ত আমিও যাব ।" এই যজ্ঞের নাম অহঃ—দিন ।যেটা যখন ফোটে, সেইটা দিন। এখন তোরা দেখছিস, এইখানে বসে মায়ের পূজা করছি । এইটি তোদের দিবা । এ জ্বলছে বটে, জ্বলে রয়েছে বটে, কিন্তু বিদ্যুতের মত যাচ্ছে ।হুং হুং, তুমি তুমি, এই চোখ নিয়ে যে থাকে, তার কাছে আর কালপ্রকাশ হয় না, তার সূর্য্য উদয়াস্তহীন। নয় ত এই সূর্য্য দর্শন করলে, আর নিবে গেল তার নাম অহোরাত্রি । তোরা এখন  অহোরাত্রময় পুরুষ হচ্ছিস । ঠিক হুঙ্কার দিতে পারিস না, তাই একবার রাত্রি, একবার দিন হচ্ছে । যেমন হুঙ্কার দিয়ে বসলি, অমনি দিন ।এই যে অহোরাত্র হয়ে ফুটছে, এই হল যমদণ্ড, সংযমনী পুরুষ; একবার একটা শেষ হলে, তবে আর একটা হচ্ছে ।এর মধ্যে আয়ু বা বাঁচবার রাস্তা হল হুঙ্কার । কে এখানে নেমে এসেছে ? ক্রীং, অমা মা। কি বলে দিয়েছি ? এ পিঠে যিনি ক্রীং, নেমে এসে তিনি হন ঋক্‌। এক ঘর মানুষ বসে তোরা কি দেখছিস ? ক্রীং মা হুঙ্কার দিয়ে, ঋক্‌ বলে প্রতীয়মান হচ্ছেন । আর হুঙ্কার না দিলে, জল, মাটি ইত্যাদি গড্ডালিকা প্রবাহ। এই যে তুই, সেই তুই একটি ঋক্‌ । এমন করে চেহারা ধরে কে বসেছে ? ক্রীং । হুঙ্কারের ভিতর দিয়ে, হ্রীং দিয়ে তোর মত একটি বাচ্ছা বের করেছে ।এই হল দক্ষিণভূমি, ভোগভূমি; এঁকে এখন বজ্র করে তুলতে হবে; তাই দেবী এখানে দক্ষিণকালিকা। "ভয় কি বৎস ! আমি দক্ষযজ্ঞনাশিনী।" দক্ষিণকালীকে নিয়ে তুই যা খুসি খা । আর ওকে ছেড়ে, টিকি রেখে, মালা পরে, গোবর লেপে, যা খুসি কর, তাতে তুই কোথায় যাচ্ছিস ? মৃত্যুতে । তুই এত ভোগ করছিস, একটুও বিচার করবি না ? তুই কি দুর্নীতিপরায়ণ রে ! তা বটে, এ ভূমিতে তুমিই মরবে । আমার দক্ষিণঘাতিনী কালিকা আছে ।আমি ভোগে পুষ্ট হই, তাকে মা বলতে শিখি, সে আমার বিশ্বকে ভোগে ভরিয়ে দেয় । হ্রীং দক্ষিণকালিকায়ৈ স্বাহা । বল্ মা ! মা !  ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, স্বাহা । মণিদ্বীপ থেকে বিদ্যুতের রাশি ঝলমল করে বেরোচ্ছে এবং দিগ্‌দিগন্ত ভরে যাচ্ছে । আমার সহস্র বাহু, সহস্র চক্ষু হয়েছে । কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্র নয়নোজ্জ্বলে । বৃত্রপ্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমো'স্তু তে ।। যে অন্ধকার যে জড় চক্ষু আমায় ঘিরেছিল, সে অন্ধকারের অপলাপ হয়েছে, বিদ্যুতে চোখ ভরে গেছে । শুধু বিদ্যুৎ নয়, দিগ্‌দিগন্ত থেকে এক এক মূর্ত্তি ধরে, কেউ গন্ধসম্ভার, কেউ রূপসম্ভার নিয়ে আমার যজ্ঞসম্ভার হয়ে আসছে । সেই সব আমি মায়ে ফিরিয়ে দিচ্ছি । কত রসময়ী দেবী, কত রূপময়ী দেবী, কত দেবতা, ঠেলে ঠেলে এসে আমার দ্বারে সব যুগিয়ে দিচ্ছে । আমার যজ্ঞ হল শতক্রতু; সে সংখ্যা গুণে গুনে নয়, আমি উচ্চারণ করা মাত্র সেটা শতক্রতু হল। কেন ?  আমি বলনিসূদন ইন্দ্র, আমি অনন্তের সন্তান ইন্দ্র, যা বলেছি সেটা অনন্ত, recurring infinite, হয়ে গেছে । লোকে যেমন রেডিওতে কথা শোনে, তেমনি । আমার কথা যে বেরোয়, সে বিদ্যুৎ বেরোয় । ঐ কথা বিদ্যুতের মত লক্‌লক্‌ করে বেরিয়ে এল । আমি যেমনি বললুম মা, অমনি এই মণিদ্বীপ থেকে বিদ্যুতের পর বিদ্যুত ছুটছে। তোরা ওকে মা বলে বুকে তুলে নে; জল বলে, মাটি বলে পড়ে থাকতে দিস না । তোদের এই ভূমির নাম ঋক্‌, অর্চ্চি, সত্য, মন্ত্রের প্রকাশ ।এর ফল বিদ্যুৎ, ক্রীংরূপিণী কালিকা মায়ের মূর্ত্তি। বল্ এই অগ্নি ঋক্‌, এই অগ্নি অর্চ্চি, বিদ্যুৎ, এই অগ্নি মণিদ্বীপবাসিনী কালিকা । এই মূর্ত্তিতে ও-ই ফুটেছে, এ সত্যেরই সত্য প্রকাশ। এইরূপ চন্দ্র সূর্য্য আদি যেখানে যা কিছু আছে, সে আমার কালীই সেজে দাঁড়িয়েছে। বল—ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে,  ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, স্বাহা। একবার মা বল ত —মা ! 
ওঁ তৎ সৎ, অদ্য মাতৃকামাসি, মাতৃকারাশিস্থে,  ভাস্করে, মাতৃকাপক্ষে, মাতৃকায়াং তিথৌ, মাতৃকাগোত্রঃ শ্রীমাতৃকাপুত্রো'হং ইন্দ্রো নাম শ্রীমাতৃকায়া অন্নপূর্ণায়া মহাস্নানং করিষ্যে । তোমার নাম করে যে যা দেয়, তুমি তা শতগুণে তাকে ফিরিয়ে দাও । তোমার বুকে বসে যদি কেউ পাপ করে , সেই পাপকে শতগুণ পূণ্য করে, সেই শতগুণ পূণ্য তাকে তুমি ফিরিয়ে দাও। তোমার অদ্যও নেই, কল্যও নেই : তোমারই সন্তান আমারও আজও নেই, কালও নেই। আমি কিছু করছি বলে জানিনা; দেখছি তুমি সব করছ। আমি হাত তুলি; দেখছি তুমি হাত তুলছ। এখান ঠেলে ওখানে যাই; দেখছি—তুমি সব করছ । সুতরাং মণিদ্বীপবাসিনী মা আমার, তুমি আপনার স্নান আপনি করাও, আমার আজও নেই, কালও নেই। ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে স্বাহা। দেখি, দেখি মা ! কর মা, স্নান কর, কর মা ! আহাহা, স্নাত হও ! আহাহা ! আপনি আপনাকে জল করে, সেই জলে ডুব দিচ্ছ, আপনাকে নাওয়াচ্ছ, সে সোম আমায় পান করাচ্ছ । দেবি! তুমি আপনাতে আপনি তৃপ্তা । ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং স্বাহা। সোমের ধারা জলের মত চমৎকার বয়ে যাচ্ছে। তরঙ্গে তরঙ্গে মা আমার সন্তরণশীলা, তোমরা দেখতে পাচ্ছ ? মণিদ্বীপবাসিনী বহু মা হয়েছে; হয়ে সোমের সাগরে ভেসে যচ্ছে । এই ঘরে মা আমার বহু হয়েছে, তাতে সোমের সাগরে ভাসছে। আনন্দময়ী মা আমার নাচতে নাচতে, সোমের সাগর আলোড়ন করে আমাদের দিকে ছুটছে । তোদের দিকেও যাচ্ছে রে ? মা বল্ । মা ! মা স্নান করছেন ? ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং জাতবেদায়ৈ কালিকায়ৈ স্বাহা। যেখানে যত ইদং দ্রষ্টা ছিল, সবাই আমরা বজ্রসহ সপরিবারে তোমার স্নান দর্শন করতে ছুটে এসেছি, সোমসাগরে তোমার স্নান দেখতে এসেছি।দেবি ! তুমি খুব করে স্নান কর । চতুর্দ্দশ ভুবনে শান্তির সমাবেশ হোক, অসুর সকল নিরস্ত হোক । ঋষির এই যজ্ঞাগার, একে শান্তিতে রক্ষা কর দেবি ! তৃপ্তা হও, তৃপ্তা হও ।  ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং, দক্ষিণকালিকে, ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং স্বাহা।
[ ১২টা ১৫ মিনিটে তৃতীয় পর্ব্ব সমাপ্ত। ]

                      [ ১২টা ৫০ মিনিটে চতুর্থ পর্ব্ব আরম্ভ। ]

ওঁ গার্হপত্যাগ্নয়ে স্বাহা । আমি যখন কথা বলব, তার মানে হচ্ছে, বিদ্যুৎ বেরোচ্ছে । বিদ্যুৎ, প্রাণ, আকাশ ও দ্যু, এই তোমাদের প্রাপ্তব্য। যখন অগ্নি বলব, তার মানেও বিদ্যুৎ ।ওঁ গার্হপত্যাগ্নয়ে স্বাহা । 
ওঁ অগ্নির্দেবী অগ্নিঃ ঋষিঃ অগ্নিশ্চ যজ্ঞসম্ভারঃ ।
অগ্নৌ অগ্নিং—বিদ্যুতং প্রাণং দিবং আকাশং পূজয়ামি অঙ্গিরে প্রসন্না ভব ।। এহি এহি এহি আঙ্গিরস ! এহি এহি, প্রজ্বল প্রজ্বল । তৃপ্ত হও আমার অঙ্গের যত রস । ওগো আমার অঙ্গের রসরূপিণী মা, আমার চক্ষুকর্ণত্বক্‌রূপিণী মা, আমার হৃদয়, হাত পা, আপাদমস্তকময়ী মা ! ওঁ অঙ্গিরা, আঙ্গিরস ঋষির জননি, প্রসীদ প্রসীদ ।
ক্রীং গার্হপত্যাগ্নয়ে স্বাহা । এই অগ্নিমূর্ত্তিতে, বিদ্যুৎমূর্ত্তিতে তুমি আবির্ভূত হও । আলো দাও, বীর্য্য দাও, সোম পান করাও, আপনি সোম পান কর। এস, এস, অনেক অগ্নি প্রজ্বলিত করেছি, আমার সর্ব্বাঙ্গে অগ্নিদীপ্তি ফুটেছে, আমার মাটি, জল, সব অগ্নিতে পরিণত হয়েছে, এস, এস । 
ওঁ গার্হপত্যাগ্নয়ে স্বাহা । ওঁ দক্ষিণাগ্নয়ে স্বাহা । ওঁ আহবনীয়াগ্নয়ে স্বাহা । [ প্রজ্বলিত অগ্নির দিকে চেয়ে ] তুমি, তুমি—এই আমায় বুকে করে তুমি । [ প্রতিমার দিকে চেয়ে ] ঐ আমায় বুকে করে তুমি। অঙ্গিরা-কালিকায়ৈ 
স্বাহা । ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা । আপনাকে মায়ে ঢেলে দাও। ময়ের চোখে চোখ দিয়ে বল—ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। আত্মময় সোম—আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, সমাজ, দেশ, স্ত্রী, পুত্র, আপনই, আপনার সমস্তকে একীভূত করে, তোমার এই অঙ্গের যত রস, সব এই কুম্ভেতে নিয়ে, মায়ের চোখে চোখ দিয়ে, ঢেলে দাও—ওঁ জাতবেদসে [ এই সময়ে গুরুদেব না বলিতেই, মন্ত্রের পরবর্ত্তী অংশ কেহ উচ্চারণ করায় ] মারি তোর মুখে লাথি; উল্লুক, আমি না বলতেই উচ্চারণ করছে। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। আমার পরম প্রাণ বলে যে বস্তুগুলিকে আমি বুকে ধরে রেখেছি, তোমার বুকে সেইগুলিকে ধরে নবাম, নবীন করছি। এদের চক্ষু দাও, দীর্ঘ আয়ু, ধন, যশ দান কর দেবি ! ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা।
হে অঙ্গিরা মা, হে আমার অঙ্গরূপে দীপ্তিশালিনী মহাদেবি ! আমার বাক্‌, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্‌, চতুর্দশকরণ, আমার নিজত্ব দিয়ে যা কিছু আমি ধরে আছি, সেই সমস্তকে সমষ্টি আকারে, সপরিবারে আমি তোমার চরণে লুণ্ঠিত, নমিত করছি। হে মহাদেবি জাতবেদা, সুনবাম সোমং স্বাহা। ঝরুক কল্যাণ, ঝরুক আশীষ, ঝরুক বল, ঝরুক অভয়, ঝরুক আনন্দ। কালি, আনন্দময়ী কালি ! তোমার চোখের তলায় দাঁড়িয়ে, আমি নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলছি। মা, মা ! সুনবাম সোমং স্বাহা।ক্রীং ক্রীং, জাতবেদা, জাতবেদা, জাতবেদা, আমি যত রকমে জাত হচ্ছি, সে তোমার বুকে ছাড়া আমাকে আর কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। দেবি ! তোমার কলনময় গতিচক্রে আমি মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে যত মূর্ত্তি ধারণ করছি, তাতে আমি তোমাকেই দেখতে পাচ্ছি। দেবি ! আমায় ভগবান্‌ কর, ঐশ্বর্য্যবান্‌ কর, ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। আঃ ! কালী, কালী ! যে সোমলতা আমাকে বেষ্টিত করেছে, আমি তাকে পাথর দিয়ে থেঁৎলে রসের সৃজন করছি। স্বেচ্ছায় তুমি বরণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছ, স্বেচ্ছায় বরণ করতে এসেছ, আমি স্বেচ্ছায় তোমায় সোম দিয়ে বরণ করছি, তুমি এসে এই সোম পান কর। ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা। মা তোমাদের চোখে পড়ছেন ? তোমাদের চোখে মা জাগ্রত রয়েছেন । আমি যেমন করে মাকে দিচ্ছি, তোমরা আমার অনুসরণ করতে পারছ ? সামান্য ত্রুটির জন্য ভাবতে হবে না; অনুসরণ করছ কি না, তাই দেখ। এই মাহেন্দ্র সুযোগ, এই বিপ্লবের ভিতর দিয়ে মা তোদের বুকে করে দাঁড়িয়েছে । তোমরা সুযোগ গ্রহণ করছ ত ? 'যথাসাধ্য' বলছ। কালী তোমার বুকে যথা, যেমন মূর্ত্তিতে এসেছে, তাই তোমার সাধ্য; এরই নাম তোমার যথাসাধ্য । উল্টা রাস্তায় দেখো না । এতটুকু তোমার হল, অতটা ওর হল, এ ভাবে হিসাব করো না। তোমার কালী বিনা কাপড়ে এসেছে, আমার কালী গয়না পরে এসেছে; এ ভাবের হিসাব নয়। যে এসেছে, সেই যে তোমাদের সাধ্য। ওঁ নৈবেদ্যসম্ভারস্বরূপায় দক্ষিণাগ্নয়ে স্বাহা। " স্বাহা ! স্বাহা !"—অমন নয়, অমন নয় । ঐ যেখানে গিয়ে পড়ল, সেখানে যে দাঁড়িয়ে* আছে, তাকে দেখে স্বাহা* বলছিস ? 
---------------------------------------------------------------------------------
* স্বাহা — স্ব বা আত্মস্বরপেই আহুত হচ্ছে, এইটি স্বাহা।
------------------------------------------------------------- --------------------
মা তোকে দু-দিকে মুড়ে আছে, এ কথা বিশবার শেখাচ্ছি। আমি এই ফুল ধরেছি—ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। কালী দাঁড়াল, ঐখানেই ফুল পড়ল।  ক্রীং গার্হপ্ত্যাগ্নয়ে স্বাহাক্রীং দক্ষিণাগ্নয়ে স্বাহা। ক্রীং আহবনীয়াগ্নয়ে স্বাহা ইদং পাদ্যং, অর্ঘ্যং, আচমনীয়ং, গন্ধং, মাল্যং, পুষ্পং, ধূপো দীপঃ, নৈবেদ্যং ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা । এ মরবার পূজা রে জানোয়ারের দল*, এ খেলা করবার পূজা নয়। ইদং পাদ্যং, অর্ঘ্যং, আচমনীয়ং, স্নায়ীয়ং, গন্ধঃ, পুষ্পং, মাল্যং, ধূপো দীপঃ, নৈবেদ্যং ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা । 
[ ১টা ২৫ মিনিটে চতুর্থ পর্ব্ব সমাপ্ত। ]
-----------------------------------------------------------------------------------

প্রকাশকের মন্তব্য।
 * উল্লেখযোগ্য যে এর পরই বলিদান পর্ব্ব আরম্ভ। 
-----------------------------------------------------------------------------------

                   [ ১টা ৪৫ মিনিটে বলিদান পর্ব্ব আরম্ভ। ]

ক্রীং ক্রীং ক্রীং। 
ক্রীং হুং হ্রীং । ক্রীং হুং হ্রীং [বহু বার]। 
ক্রীংয়ের ভিতরে হুং, হুংয়ের ভিতরে হ্রীং। রবিমধ্যে স্থিতঃ সোমঃ সোমমধ্যে হুতাশনঃ । অদিতির মধ্যে হুং, হুংয়ের মধ্যে হ্রীং, হ্রীংয়ের মধ্যে বল। যত সোমপান করিস, তত বল লাভ করিস। সোম পান করিস— একপিঠে মরতে, একপিঠে বাঁচতে । বল মানে আনন্ত্য। ক্রীং হুং হ্রীং কালিকে ! তুমি অনন্ত, হুঙ্কার অনন্ত, হৃদয় অনন্ত। যারা সেই হৃদয় দর্শন করে, তার ভিতর যত কিছু অদন , ভোগ, কাটা, বলিদান দর্শন করে তারা আনন্ত্য লাভ করে। নতুবা শুধু খায় । একটা মরে, আর নিজের মরবার রাস্তা তুই নিজে তৈরি করিস। বলপ্রাপ্তির জন্য বলি। সুতরাং হ্রীংয়ের ভিতর বলিদান দেখ। বলিদানে তোদের প্রাণ স্ফুরিত হক, বলির যত রক্তধারা চলুক হ্রীং থেকে হুংয়ে, হুং থেকে কালিকায়।  ক্রীং হুং হ্রীং বলিং গৃহ্ন স্বাহা। ঐ মা ক্রীং, আমরা পুরোহিত হুং, আর যূপকাষ্ঠ হল হ্রীং। ক্রীং হুং হ্রীং গৃহ্ন বলিং বলায় স্বাহা। ওঁ বলায় নমঃ, বলায় নমঃ। ওঁ বলে ত্বং চণ্ডিকা অসি সাক্ষাৎ বলপ্রদা শিবা। একধা বহুধা ভূত্বা বলং দেহি নমো'স্তু তে।।ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। বলরূপায়ৈ বলিং স্বাহা। নমঃ খড়্গায়। দেব ! তব প্রসাদেন ইন্দ্রঃ স্যাৎ বহুরূপধৃক্‌ । বহুধেন্দ্রঃ প্রভবতি খড়্গ ! তব প্রসাদতঃ ।। বহুলং ব্রহ্ম ভবতি বলঞ্চ জায়তে বলং। খড়্গ ! তব প্রসাদেন দুর্ব্বলো লভতে বলং।। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। চণ্ডিকারূপিণে খড়্গায় স্বাহা । মা ! মা ! মা ! মা এই যে বহুধা হয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁরই অনুকরণের বিজ্ঞানে আমরা বলি দিচ্ছি। এ বলি ঘাতন নয়, বর্দ্ধন। যে বলির দ্বারা তুমি আপনাকে বহুধা করেছ, সেই বলির দ্বারা আমরা আমাদের বর্দ্ধিত করব। ক্রীং অগ্নয়ে স্বাহা। বলে ! দেবীপ্রসাদাত্ত্বং বলিরূপেণ আগতঃ । আত্মানং ত্বং দ্বিধা কৃত্বা বলং দেহি নমো'স্তু তে।। সর্ব্বত্র বলং প্রকাশয়, ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। জয় মা ! জয় মা ! জয় মা ! জয় মা !
[ অট্টরোলের মধ্যে বলিদান*। তার পর আরতি অন্তে সকলের ' জয় মা ' বলিয়া প্রণাম।  [২টা ১৫ মিনিটে বলিদান পর্ব্ব সমাপ্ত।]
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* যূপকাষ্ঠে প্রথিত চালকুমড়াকে বলির প্রতীক করে, খড়্গ দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করা হত ।  
------------------------------------------------------------

                   
                                       অন্নকূট।
ক্রীং ক্রীং ক্রীং, হ্রীং হ্রীং, হুং হুং, ইদং অন্নং গৃহাণ স্বাহা ।ত্বমেব ঋক্‌ । ইদং অন্নং ঋক্‌ । ইদং অন্নং অর্চ্চি, ইদং অন্নং অগ্নিঃ, ইদং অন্নং বিদ্যুৎ, ইদং অন্নং দ্যৌঃ, ইদং অন্নং প্রাণঃ, হ্রীং হ্রীং, হুং হুং, ক্রীং ক্রীং স্বাহা। গ্রহণ কর, গ্রহণ কর মা। দেবি, ভগবতি, অমা, দুর্গা, অন্নপূর্ণা, ইদং অন্নং গৃহাণ । ইদং মে হৃদয়ং, অয়ং মে প্রাণঃ ঊর্দ্ধহৃদয়ে সংযুক্তো ভবতু ভবতু স্বাহা। ইদং হৃং, ইদং হুং, ইদং ক্রীং, ইদং হৃদয়ং, ঊর্দ্ধহৃদয়ে সংযুক্তং ভবতু স্বাহা। ওঁ গার্হপ্ত্যাগ্নয়ে স্বাহা। ওঁ দক্ষিণাগ্নয়ে স্বাহা। ওঁ আহবনীয়াগ্নয়ে স্বাহা। ত্বমেব দ্যৌঃ, ত্বমেব প্রাণঃ, ত্বমেব বিদ্যুৎ, ত্বমেব আকাশঃ, ত্বমেব ইদং অন্নং পশ্য পশ্য, গৃহ্ন গৃহ্ন স্বাহা। জাতবেদা জননি ! ইদং অন্ন, এতদেব ত্বং, ত্বমেব ইদং অন্নং, ত্বমেব ঋক্‌, ত্বমেব যজুঃ, ত্বমেব সাম, ত্বমেব আথর্ব্বণী । ওঁ ইমাং ঋক্‌যজুঃসামআথর্ব্বণীং কালিকায়ৈ জুহোমি স্বাহা। ওঁ ইদং ত্বয়ি যুক্তং। ওঁ অহং যজুস্তয়ি যুক্তঃ। ওঁ ত্বং যঃ অহং, যদিদং সাম, ত্বয়ি যুক্তং।
আথর্ব্বণি ইদং অন্নং পশ্য পশ্য পশ্য, গৃহ্ন গৃহ্ন গৃহ্ন স্বাহা।প্রাণৈস্তে প্রাণায় স্বাহা। বিদ্যুন্ময় বেশে আজ তোমাদের চোখে মাকে আমার এনে দিয়েছি। বিদ্যুন্ময় বেশে মা আকাশে বিরাজ করছে, বিদ্যুন্ময় বেশে মা আজ এই মূর্ত্তি ধারণ করেছে। তুমি বিদ্যুৎ হয়ে আমাদের এই অন্ন তোমাতে যুক্ত কর। দেবি, সুতর্পিতে, পরিতৃপ্তা হও। দেবি, জাতবেদা, তৃপ্তা হও, স্বাহা । আমার প্রতি অঙ্গ চালনে, জন্মে ও মরণে, আমার প্রতি ভঙ্গিমায় তুমি তর্পিতা হচ্ছ। প্রতি ভূমিতে মায়ের পূজা চলছে । তাই এই ভূমি সত্য, জল সত্য, অগ্নি সত্য, বায়ু সত্য, আকাশ সত্য, ব্যোম সত্য, প্রাণ সত্য, পূজা সত্য, সত্য সত্য। ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। জাতবেদা মা, তৃপ্তা হও। এ
র প্রতি কথাই পূর্ণ, প্রতি অঙ্গ পূর্ণ, প্রত্যেকেই পূর্ণ। তোমার আশীর্বাদে সব পূর্ণ কর। ওঁ ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবিঃ ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতং। ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা।। বাজা। [ আরতি অন্তে ] বল মা! মা ! মা ! [ সকলের প্রণাম ] জয় মা ! যজ্ঞেন জয়ামি দুর্গাং জয়ন্তীং অসুরজয়াং, তোমাদের অভিতীদায়িনীং । 
[৪।৫ মিনিটে তৃতীয় দিনের পূজা সমাপ্ত] ।

                         চতুর্থ দিন। 
১৩ই পৌষ, ১৩৪৮, ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৪১, রবিবার প্রাতে ১০-৩৫ মিনিটে আরম্ভ। 

 মা-মা-মা ! এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে সর্ব্বেভ্যো দেবেভ্যো নমঃ। ওঁ [দশবার] । ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা । মা ! সোমে স্নাত হয়ে বিদ্যুন্ময় হয়েছ ত ? এখন বীর্য্যময় হয়ে জেগে ওঠ। তোমরা মায়ের উদয় দেখ। এ কি রত্নময় সাগর, যা বলে ডুব দিই, তাই পাই রে ! আবার ডুব দাও— জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা । আহাহা, মা আমার, মা, মা ! দেবি, আমাদের পূজারূপ সোমপান করাও। দেবি ! তিষ্ঠ, তিষ্ঠ, তিষ্ঠ । হা ভগবতী ! হা ভগবতী ! আনন্দময়ী ! নমো মণিদ্বীপবাসিন্যৈ কালিকায়ৈ নমঃ । নমঃ মণিদ্বীপবাসিন্যৈ প্রাচুর্যময্যৈ কালিকায়ৈ নমঃ । নমঃ সপ্তলোকব্যাপিন্যৈ কালিকায়ৈ নমঃ । নমঃ আপাদ-সহস্রারং বিদ্যুন্ময়ী-কালিকায়ৈ নমঃ । নমো শিরসি, নমো হস্তে, নমো হৃদয়ে । নমঃ সর্ব্বাঙ্গে বিদ্যুন্ময়ী-কালিকায়ৈ নমঃ । ওঁ আপ্যায়ন্তু মম অঙ্গানি—আমার চোখ, আমার মুখ, আমার অন্যান্য প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়, খা, খা, খা, কালিকা খা । ওঁ আদ্যায়ৈ কালিকায়ৈ নমঃ । ক্রীং, ক্রীং, ক্রীং, সাংঘাতিক মন্ত্র উচ্চারিত হল । আর শান্তভাবে বসে সোমপান করতে পারি না। খালি মন্ত্র—হ্রীং হ্রীং, হুং হুং, ক্রীং, ক্রীং স্বাহা।

আমরা বিসর্জ্জনের পূজার আয়োজন করব নাকি ? তোমাদের কি সে সামর্থ্য আছে ?  অথর্ব্ববেদকে তুলে ধরতে পারবে ? বৎস ! আমি মায়ের যে বেদমূর্ত্তি তোমাদের দেখিয়েছি, তাঁকে মর্ম্মে  মর্ম্মে  পাবার জন্য শিখিয়েছি—ত্রীণি রূপাণি সত্যং* ।
----------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌  ষষ্ঠ অধ্যায় চতুর্থ  খণ্ড দ্রষ্টব্য। 
------------------------------------------------------------------------------
এ বেদমূর্ত্তিকে তখনই পূর্ণমাত্রায় নিতে সক্ষম হয়েছ জানবে, যখন তোমার ইন্দ্রিয়ে রূপ রস আদি বলে যা কিছু গ্রাহ্য, সে সবকে পূর্ণমাত্রায় সত্য বলে ধরতে পারবে। মা ভালবাসুক আর না বাসুক, মায়ের বুকে মুখ দিয়ে যখন দুধ টানি, তখন সে মা যেমন প্রত্যক্ষ, সেইরূপ প্রত্যক্ষভাবে জাতবেদা যখন পরশ দেন, তখন জানবে জাতবেদা মাকে গ্রহণ করেছ । এই হল মায়ের আমার সাধারণ ধর্ম্ম । খাল কেটে ভগীরথের গঙ্গা আনার মত নয়, এ ধর্ম্ম প্রকাশ করতে মা আসবে বিদ্যুতের মত। জীমূতসঙ্কাশ মায়ের প্রকাশ— এই আসছে, এই আসছে, তুমি সে স্রোতের সঙ্গে বইতে পার না বলে মনে করছ, তা নয় । অথবা ঐখান দিয়ে মা বয়ে যাচ্ছে; হ্যাঁ মেনে নিলাম, এও চলবে না। কাল যে তোমাদের অপরূপ বিদ্যা দিলাম, স্বর্গের বিদ্যুৎ এনে দিলাম, সকলেই তা অল্পবিস্তর ভোগ করেছ । কিন্তু যতক্ষণ না প্রত্যক্ষবোধ হচ্ছে, ততক্ষণ পূর্ণমাত্রায় ভোগ হবে না । আবার বলি—পূর্ণ প্রত্যক্ষতার উপলব্ধিতে এই যে তোর একটি স্থূল শরীর, এ তোকে বেষ্টন করে রয়েছে  ? ঐ তোর কালী । ঐ কালী রে ! ঘুম থেকে উঠে 'আমি রয়েছি' বলে একটি বোধগঠন নিয়েছিস ত ? এ একটি বেদ গঠন ? ও জাতবেদা । যে পিঠটা ফুটে উঠেছে, তার নাম দেবতা । আর যে পিঠটা ঐটি গঠন করেছে, সে বেদ বা অনুবেদন । তবে এত কে সেজেছে ? জাতবেদা ? 'হ্যাঁ,  হ্যাঁ, জাতবেদা' । কেউটে সাপে হাত দিয়ে, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, জাতবেদা' বলা চলে ? কে জাতবেদা ? বিদ্যুৎ ! যার গতি বিদ্যুতের মত । যে, যেখানটায় যায়, প্রাণ আকারে পোটলা করে সর্ব্বস্ব বয়ে নিয়ে যায় । যে কখনও আত্মবিস্মৃত হয় না, নিজত্ব নিয়ে দ্যুক্ষেত্রে চলে, যার মূর্ত্তিটা হল বাক্য, আকাশ, প্রাণটা হল সর্ব্বস্ব কেড়ে নেওয়া, বিদ্যুৎ হল তার instantaneous গতি, আর এই গতিতে যে আপনি আপনার বাইরে কখনও যাচ্ছে না । এই কালী তুই আমার মা বসে আছিস। সুতরাং জাতবেদা কেউটে সাপের মত কি না, দেখ। সুর ধরলি, তেতলায়, চৌতালায় উঠলি, অমনি করে জাতবেদা বলবি ? ভেবে চিন্তে যাবি, না একেবারে চড়াক করে চলে যাবি ? Power houseএ সংযুক্ত আছে বলে, এ-সব হল টিপুনি দেবার রাস্তা। একটা টিপি দিলি,— নাকে চোখে মুখে, যেখানে যত আলো জ্বলবার প্রদীপ আছে, জ্বলে উঠল । এ কি কেরোসিনের ল্যাম্প হাতে নিয়ে একটু একটু করে জ্বালান । ক্রীং । ঘরে তুই যখন ইলেকট্রিক আলোগুলি জ্বেলে দিস, তখন কি দেখিয়ে 
দেয় ? তখন তারা বলতে থাকে,—" দেখ ওগো গৃহবাসী, আমি সেই বিপুল শক্তির সাথে সংযুক্ত, তাই জ্বলে উঠেছি ।"  তুই যখন ক্রীং বলবি, তখন কার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে, কোথায় তুই সুইস টিপবি ? তোর ঘরটা যখন আলো হয়ে উঠল—দেওয়াল, কড়ি বরগা, কাপড়, আলমারি, খাট, বিছানা আলো করে দিলে, তখন ওগুলি সব কিসের দেখা যাচ্ছে ? আলোর । এই যে তোদের দেখতে পাচ্ছি, কিসে দেখছি ? জাতবেদায় ।এই যে শরীর দেখতে পাচ্ছি, কিসে দেখছি ? ক্রীং । এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। তো, আমি যে instataneous গতি বলছিলাম, সে কিছু অন্যায় কথা বলেছি । Instantaneous আলো, বিদ্যুতের মত আলো, সে কিছু অন্যায় বলেছি ? ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা । দেবি আমার, মা আমার, তোমায় আমি কাল প্রচুর সোম সংগ্রহ করে প্রাচুর্য্যে খাইয়েছি, পাগল করে দিয়েছি, মত্ত করে দিয়েছি । তুমি আর আমাদের শরীরে জড়তার গতি, বৃত্রাসুরের গর্ত্ত, অন্ধকার রেখো না । বিদ্যুৎ-দীপ্তিতে জ্বলে ওঠ দেবি । তোমায় শুধু খাওয়াইনি মা, তুমি যে খেয়েছ, তা দেখেছি। শুধু খাওয়াইনি মা, তোমার বুকের কথা শুনেছি—"তোরা আমাকে যত খাওয়াচ্ছিস, আমার ইচ্ছা, তোদের এই প্রচুর দানকে অনন্ত করে দিই।" তোমাকে যা দেওয়া যায়, তা তুমি অনন্ত করে ফিরিয়ে দাও। তোমার স্বতঃসিদ্ধ ধর্ম্মই হল — ঐ বিদ্যুৎ, ঐ প্রাণ, ঐ আকাশ অনন্ত করে ছেড়ে দেবে । ওরে ব্যোমকেশ ! তুই এখানে বসে আছিস ? আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার ঐ মণিদ্বীপ থেকে সহস্র সহস্র ব্যোমকেশ বেরোচ্ছে । এখানে হাঁ করে, পুঞ্জীভূত হয়ে একটা ব্যোমকেশ মালুম হচ্ছে । জানিস ? বায়স্কোপ দেখিস, তাতে একটা ছবি দেখাতে দশহাজার ছবি আসছে । এই যে তোমরা পূজায় মত্ত, এতে কতরকম ছবি দেখাচ্ছ । কখন হাত জোড়া, কখনও প্রণাম করা, কখনও ফুল দেওয়া, এ তুমি একজনও নও, অনন্ত ব্যোমকেশের ঝাঁক এখানে । এইরূপে তোমার সবই এই অনন্তের ঝাঁকে পূর্ণ; এইখানে খালি একটা finite হয়ে দেখা যাচ্ছে । এ কথা কে বলছে ? জাতবেদা । মা কালীর কতকটা আভাস হৃদয়ে এল ? তোমায় যে দেখছে, সে তোমার এই একটা ছবি দেখে বললে,—বেশ ব্যোমকেশ দেখে এলুম । কিন্তু যতক্ষণ না দেখ— কত শক্তি, কত অনন্ত শক্তিকে একটা টিপি দিয়ে সে ফুটিয়েছে, ততক্ষণ তোমার নিস্তার নেই। ক্রীং —অনন্তে অনন্তে ব্যোমকেশ  চলেছে, চলেছে । শুধু আজ নয়, কোন্‌ জন্মে, কোথায় অব্যক্তে, মা-বাপের শরীরে, তারপর গর্ভে, তারপর এখন, এই ভাবে চলেছে । মা এখানে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করছেন ? ' ব্যোমকেশ ' —recurring infiniteএ ।এমন না  হলে মা ! এ মাকে দেখলে আর মরবি ?  চতুর্দ্দশ ভুবনে চতুর্দ্দশ সহস্র বার যদি মরি, সে মরা নয়। এই হল মায়ের পূজা, বা তোকে পূজা করান। মা তৃপ্ত হল কিনা তা নয়; এদের তৃপ্ত করার মত করে আমি  আয়োজন করেছি কিনা, মায়ের এই ভাবনা । মা ! আমি এই কয় দিন তোমায় প্রচুর সোম পান করিয়েছি; তুমি বলছ —প্রচুর খেয়েছি । তাই  আজ তৃপ্ত হয়ে,  ফুল্ল মুখে ' বরং বৃণু' ব'লে বর দিতে দাঁড়িয়েছ । কিন্তু তুমি যদি যাও ত পুরুরবার মত আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। দেবি, তৃপ্তা হও, তৃপ্তা হও ।তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না । আমাদের তুমি পর বলে ছেড়ে যেও না । যে মদ তুমি খাইয়ে দিয়েছ, তাতে শরীর তুলতে পারছি না সত্য, তবু তোমার নেশা ছাড়তে পারছি না । প্রতিদিন এমনি করে তোমায় যেন পাই, এমনি করে প্রতিদিন আমায় আদর করো ।
দেবি ! বরদা ভব ।  [১১।২৫ মিনিটে প্রথম পর্ব্ব সমাপ্ত ]।
           
                 [১১।৪০ মিনিটে দ্বিতীয় পর্ব্ব আরম্ভ ]।
ক্রীং, ক্রীং, ক্রীং । কি অপূর্ব্ব  মন্ত্র ! মণিদ্বীপবাসিনী বিদ্যুতের মত ছুটেছেন। তুমি আমি নেই, তুমি আমি ভুলে যাও; এক মণিদ্বীপবাসিনী ছুটে চলেছেন, তাঁর খেলা হচ্ছে; সেই খেলার ভিতর তুমি আমি হয়ে যাচ্ছি। তুমি অদ্য, তোমায় খাচ্ছি । যেমনি দেখছি—তুমি বসে আছ, অমনি তোমায় খেয়েছি । দেখাই হল দেবতার খাওয়া । দেবা ন অশ্নন্তি, দর্শ্ননেন তৃপ্তা ভবন্তি ।দেখার নামই খাওয়া; আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি; সুতরাং খেয়েছি । এখানে বিজয়কৃষ্ণকে দেখো না । কে কথা কইছে ? মণিদ্বীপবাসিনী । মা ! অন্নকূট প্রভৃতি ব্যাপারে তুমি আমাদের খুব খাইয়ে দিলে ।আর খেতে পারছি না ।কোমর ব্যথা হয়েছে, গা তুলতে পারছি না । দেবি, ভগবতি ! আজ যাবার সময় তুমি দুটি বর দিয়ে যাও । একটি এই যে, আমার সন্তানরা যেন আমায় না দেখে' তোমায় দেখে । আর একটি কথা । তোমার গায়ে যদি কাপড়ের খুঁটটাও লাগিয়ে দিই, তবে তুমি টেনে নেবে, এই ভয়ঙ্কর কথা ওদের শিখিয়েছি । এই বর দাও, ওরা যদি একবার তোমার নাম শুনেও থাকে, তবে শত বাধার ভিতরও ওরা তোমাতে ঢুকে যাবে । এই দুই বর দিয়ে তুমি আমাদের অভীষ্ট পূর্ণ কর । এঁর আগে আমাদের কারও আয়ু তুমি হরণ করোনা । দেবি ! জাতবেদা ! দেবি ! এ দৌর্ব্বল্য প্রকাশ করা উচিত নয়, তবু জীবক্ষেত্রে এ দৌর্ব্বল্য এসে পড়ে । 'মা ' এই শব্দের আকারে যেমনই তুমি উচ্চারিত হয়েছ, তার মানেই তার সমস্ত বিঘ্ন দূর হয়েছে । তোমার সমস্ত পূজা যেন পূর্ণতায় ভরে যায় । যত ক্ষণ আমি আমার পিতা, মাতা, পুত্র, সকলকেই দেখব , ততক্ষণ যেন দেখি —এরা যে সবাই কালী ।আমার চক্ষু তুমি খুলে দিয়েছ ।আমি এখন দেখতে পাচ্ছি — সর্ব্বত্র ইন্দ্র,  তোমার বুকে সর্ব্বত্র স্তন্যপায়ী ইন্দ্র ।এই দৃষ্টি লাভ করে, অশ্বমেধের ফলে আমরা কৃতকৃতার্থ হচ্ছি। 
নবাম সোমং—নতুন করে তোমায় ফুটিয়ে তোলা, এই হচ্ছে নবমীর পূজা। প্রথম দিনে তোমায় রণসজ্জায় সাজিয়েছি, দ্বিতীয় দিনে তোমার গতি দেখিয়েছি, নবমীতে সোম পান করিয়েছি; নবমের পর দশান্ত হয় ।সে একটা নতুন করে ভোগ । পূজায় বসার আগে কি মানুষ আমি ছিলুম, আর কি দশান্তর আমার হয়েছে । বেদময় হয়েছ ? শুধু ও কথা বললে হবে না । স্তন্যপায়ী ইন্দ্রের আভাস পেয়েছি। আমার ভিতরে একটি ইন্দ্রত্ব ফুটে উঠেছে । তুমি ইন্দ্র । ইন্দ্রিয় ধারণ করে আছ ? তুমি যখন মরবে, ইন্দ্র হয়ে, ইন্দ্রিয়ময় হয়েই বেরোবে । দেহ থেকে বেরিয়েই ছেলেদের বলবে,—"কি রে কাঁদছিস কেন ? আমি যেমন তেমনি আছি ।" ইন্দ্রিয়ময় মানে,—পঞ্চতন্মাত্রময় ভোগসমন্বিত । কত বড় করে দিয়েছি, কত বড় জ্ঞানে প্রজ্ঞান জ্বেলেছি । আমি সেই মানুষের কথা বলছি, যে মরে গেলেও বেঁচে থাকবে । এবং যার ভিতরের গতিটা ফুটে উঠল এই জামাটায়, এই হাতখানায় । ঐ যে বোধময় তুমি, ইন্দ্রিয়ময় সন্তান আমার, তোকে ইন্দ্রত্ব দেব । এই ন্যাড়া মাথা আর ভুঁড়ি,একে দেব না । তখন বলবি না ত, "শরীরের এই ধোক্‌ড়াখানা ছাড়ি কেমন করে ? " স্বর্গের সিংহাসনে এ ভাল মানাবে না ।*
----------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*ছান্দোগ্য উপনিষদ্‌ অষ্টম অধ্যায় দ্বাদশ খণ্ড দ্রষ্টব্য। )
-----------------------------------------------------------------------------------
 ইন্দ্র, বজ্রধর সন্তান, ব্রাহ্মণ তোমায় আশীর্ব্বাদ করছে,—তোমার শোক ও অভাবে জর্জ্জরিত শরীর সর্ব্বক্ষতশূন্য হক । সহস্র ক্ষত তোমাদের  সহস্র লোচন, সহস্র চক্ষু হয়ে যাক । এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ ইন্দ্রাণ্যৈ নমঃ । কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্রনয়নোজ্বলে। বৃত্র প্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমো'স্তু তে ।। তোরা বামুন পণ্ডিতের মত বসিস না, ও দেখলে আমার গা জ্বালা করে । বীরের মত বস, বীরের মত মাকে ডাকতে হবে। তোরা অবীরার কান্না কাঁদতে আসিস নি, বিধবার কান্না কাঁদিস না, বীর হতে এসেছিস, সব স্বর্গময় করতে এসেছিস । কিরীটিনি মহাবজ্রে ! কেন, কেন ? কেন আমরা   কিরীটিনী বলে ডাকছি ?  আমি দেখতে পাচ্ছি, ঐ মণিদ্বীপ দিগ্‌দিগন্ত আলো করছে, মা ওখানে জ্যোতির মুকুট পরে রয়েছেন । কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্রনয়নোজ্বলে—যত অন্ধকার, সব দূর হয়ে যাচ্ছে । বৃত্র প্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমো'স্তু তে ।। [ বহু বার ] । জাতবেদাকে ভুল না । ভোল নি ত ? আচ্ছা, আচ্ছা । স্বর্গের দ্বারে এসেছিস, রব বর্ষিত হচ্ছে । ঐ ক্রীংকে, ঐ জাতবেদাকে বলছিস ত ? যিনি ক্রীং, তিনিই জাতবেদা । তিনি আপনাকে দ্রষ্টা, দৃশ্য, দর্শন করে সাজেন* ? ক্রীং আপনাকে ভোক্তা, ভোগ্য, প্রেরয়িতা করেন ?এ দেখতে পেয়েছিস, তাতে কোন সন্দেহ, সংশয় আছে ? 
------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*বৃহদারণ্যক  উপনিষদ্‌ ৪।২।২ মন্ত্রে  ইন্দ্র কে  'ইন্ধ' নামে  উল্লেখ করা হয়েছে। ইন্ধ অর্থে যিনি প্রজ্জ্বলিত হন , বা স্বয়ংপ্রকাশ। ইনি  ইন্ধ  হয়ে রূপ প্রকাশ করেন  এবং ইন্দ্র হয়ে সেই রূপের দ্রষ্টা বা ভোক্তা হন। এই স্বয়ং প্রকাশ, স্বয়ংশক্তি আত্মা স্বয়ংই  দ্রষ্টা, দৃশ্য  এবং দর্শন শক্তি। 
-------------------------------------------------------------
ও যখন ইন্দ্রিয়রাশির উপর বজ্রের টোপর পড়ে ফুটে থাকে, তখন ওকেই ইন্দ্রাণী বলছিলি ? ইন্দ্রকে দেখাও যা, স্বর্গে গিয়ে উপনীত হওয়াও তাই। ইন্দ্রকে দেখা হয়েছে ? পুষ্পাঞ্জলি দে । কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্রনয়নোজ্বলে। বৃত্র প্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমো'স্তু তে ।।
[ ১২।৫ মিনিটে দ্বিতীয় পর্ব্ব সমাপ্ত । ১২।১০ মিনিটে গুরু ডাকলেন,—কালীকান্ত, তারাকান্ত ! চুপ করে বসে থেকো না । ইন্দ্রত্ব কি অমনি পাবে ? ঠাণ্ডা হতে দিও না । জানি, ওখানেও মন্ত্র ধ্বনিত হচ্ছে; তবু পূজা কর, তবু পূজা কর হে !" ] 
ওঁ হংসযুক্তবিমানস্থে ব্রহ্মাণীরূপধারিণী । কৌশাম্ভঃ-ক্ষরিকে দেবি নারায়ণি নমোস্তু’তে।। ওঁ ত্রিশূলচন্দ্রাহিধরে মহাবৃষভবাহিনি। মাহেশ্বরীস্বরূপেণ নারায়ণি নমোস্তু’তে।। ওঁ ময়ূরকুক্কুটবৃতে মহাশক্তিধরে’নঘে। কৌমারীরূপসংস্থানে নারায়ণি নমোস্তু’তে।। ওঁ শঙ্খচক্রগদাশার্ঙ্গগৃহীতপরমায়ুধে। প্রসীদ বৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমোস্তু’তে।। গৃহীতোগ্রমহাচক্রে দংষ্টোদ্ধৃতবসুন্ধরে।বরাহীরূপিণি শিবে নারায়ণি নমোস্তু’তে।। নৃসিংহরূপেণোগ্রেণ হন্তুং দৈত্যান্‌ কৃতোদ্যমে। ত্রৈলোক্যত্রাণসহিতে নারায়ণি নমোস্তু’তে।। কিরীটিনী মহাবজ্রে সহস্রোনয়নোজ্বলে। বৃত্রপ্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমোস্তু’তে।। শিবদূতীস্বরূপেণ হতদৈত্যমহাবলে । ঘোররূপে মহারাবে নারায়ণি নমোস্তু’তে।। দংষ্ট্রাকরালবদনে শিরোমালাবিভূষণে। চামুণ্ডে মুণ্ডমথনে নারায়ণি নমোস্তু’তে।। ওঁ সর্ব্বস্বরূপে সর্ব্বেশে সর্ব্বশক্তিসমন্বিতে। ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি নারায়ণি নমোস্তু’তে।।
এই যে সমস্ত মহাশক্তির পরিচয় বললে, এ কি ঐ জাতবেদা মায়ের ? তাঁর খুব ছোট একটি মূর্ত্তি কি ? প্রত্যেক কথাটি তিনি । প্রতি কথাটি, বাক্‌ মাত্রই ঐ মা*—complete in herself ফুটে আসছেন, প্রতি কথায় বেরিয়ে আসছেন ।
-------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
* যঃ কশ্চ শব্দো বাগেব সা —যা কিছু শব্দ তা বাক্‌। বৃহদারণ্যক উপনিষদ মন্ত্র  ১।৫।৩। )
-------------------------------------------------------------

আর তুমি যদি চতুর সাধক হও ত প্রতি কথায় তাঁকে ধরে থাকবে । সাধকের চাতুরী হল এই । প্রতি শব্দে আর কেউ বেরোচ্ছে না, ঐ অং । যখন ওম্‌ বলি, তখন প্রকাশ আর যে প্রকাশ হচ্ছে, সবটা নিয়ে বলি। আমরা এখন মাঝের 'উ' —কারটি ছেড়ে অমা মাকে দেখতে চাইছি । উকার বাদ দিলে অনির্ব্বচনীয় তত্ত্ব হল । অ-উ-ম—'উ' হল মানে বেদনের যত গতি সব ধরল, অহং ব্রহ্মাস্মি ফুটল । আরম্ভ ও শেষ, উভয়কে জুড়ে আছে, তাই দেখাচ্ছি । তো, প্রতি কথায় জাতবেদা মা আমার , ন্যাংটা মা আমার ধরা পড়ে যাচ্ছে । তাই তোমাদের শিখিয়ে ছিলাম, স্বর্গ থেকে অমৃতপ্রবাহ বইছিল, গন্ধর্ব্বেরা  তা খেয়ে ফেললে, দেবতারা আর পায় না । তখন দেবতারা পরামর্শ করে, গন্ধর্ব্বদের নিকট বাক্‌দেবীকে পাঠাল । গন্ধর্ব্বরা নারীপ্রিয় ।বাক্‌দেবী গিয়ে গন্ধর্ব্বদের ভুলিয়ে অমৃত নিয়ে এলেন। এই যে তোরা মন্ত্র পড়ছিস, এ জাতবেদা, ন্যাংটা মা । অম্‌ আসছে, অমা মা আসছে । যে ভাব বুকখানা খেয়ে বসেছিল, ন্যাংটা মা তাকে চোখে, নাকে, কাণে নামিয়ে আনছে । রাশি রাশি অব্যক্ত ভাব বুকে লুকিয়ে আছে ।যেমন ফুল বললুম ।  ফুল বলতেই সে রসটা দেখলুম । তখন চোখ বললে—"আহা, কি রঙ," জিভ বললে —"আহা, কি রস,"  গন্ধর্ব্বরা  যা খেয়ে ফেলেছিল,  ন্যাংটা মা তা বার করে নিয়ে এল । 'ফুল' এই কথাটি বললে, আর কি কিছু ঢাকঢোক আছে ? যার সম্বন্ধে কথা কইতে পার, তার মানেই—সেটা তোমার কাছে ন্যাংটা । না জানলে সেটা কি বেরোয় । ফুল, ফল, এ সব একেবারে ন্যাংটা হয়ে এল ? মোহিত ডাক্তার সকালে এসে একেবারে ন্যাংটা হয়ে প্রণাম করলে । জাতবেদা মোহিতকে ঘাড়ে করে নিয়ে এল ? ওদের বাড়ীর ছোট ছেলে সৌরেন এসে প্রণাম করলে,  অমনি সে যে ন্যাংটা সৌরেন, তা  চোখে এল । এটা allegory নয়, রূপক নয়; বজ্রের বিদ্যুতের অমোঘ গতির এই হল 
বিজ্ঞান । এই বিজ্ঞানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর জাত হন;  জগৎ গঠিত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে এই বিজ্ঞানে । এই বিজ্ঞানেই আমরা ভাত চিবিয়ে খাচ্ছি । ঐ দিগ্‌দিগন্তব্যাপী জাতবেদা অগ্নি । গঙ্গাতীরবাসী মানুষ বাসন মাজতে, কাপড় কাচতে যেমন গঙ্গা জলই নিচ্ছে, আবার পূজাও তাতেই করছে,  তেমনি তোরাও যে জল নিয়ে ঘর- সংসার করছিস, সেই জলই ঐ গঙ্গা, ঐ বিদ্যুৎ । ও এখন এই চেহারায় দাসীগিরি করছে; ওকে বরণ কর; তখন ওর রাজরাজেশ্বরী মূর্ত্তি দেখবি । সাধে কি আমি বলেছি যে তোদের আজ ভাগ্যের উদয় হয়েছে । আমি এই একেই বজ্রিণী বলে চিনেছি । এই ইন্দ্রত্ব দেয়, এই মায়ের মত কোলে করে থাকে, এর কাছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু আদি মাথা হেঁট করে থাকে । ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি  ভয়াত্তপতি সূর্য্যঃ । ভয়াৎ ইন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ* ।। 
----------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*কঠোপনিষদ্‌ মন্ত্র ২।২।৩ দ্রষ্টব্য। 
-----------------------------------------------------------------------------------
এখানে সবায়ের মাথা হেঁট । তোদের মন্ত্র, তোদের আহবনীয়কে বজ্র করার জন্য বিশেষ করে এই বজ্রিণীর মূর্ত্তিতে একে পূজা করলাম । শালপাতার আগুন যেমন সাময়িক জ্বলে উঠে নিভে যায়, এই পূজা পাছে সেইরূপ না হয়ে যায়, সেই জন্য বজ্রিণীমন্ত্রে পূজা করালাম । বজ্রকে যদি লোহার ভিতর চালিয়ে দেওয়া যায়, তবে লোহাটাও বজ্র হয়ে যায় ত ? তেমনি বজ্র হওয়ার জন্য আমি একে তোদের ভিতর চালিয়ে দিচ্ছি । " আজ্ঞে আমরা ত লোহা নেই ।  লোহা নস্‌ ? তুমি 'একজন' বলে রয়েছ, এই তুমি লোহা* । তোমার ভিতর দিয়ে বজ্র চলবে । যখন 'একজন' বলে পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছ, তখন তোমার ভিতর দিয়ে বজ্র চলবে । শুধু ঠেকে থাকলেই এটা হবে ।
-----------------------------------------------------------------------------------
প্রকাশকের মন্তব্য।
*লোহ ,লৌহ  শব্দ দুইটি  —রুহ্‌ ধাতু  থেকে হয়েছে। রুহ্‌  অর্থে  আরোহিত হওয়া। নিজেতে নিজেকে  আরোহিত করে, ইনি এই রুপময় , ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য' বিশ্ব হয়েছেন। তাই অস্তিত্বময়  প্রতিটি  সত্ত্বাই লৌহ।
---------------------------------------------------------------------------------
যে আহবনীয়, দক্ষিণ ও গার্হপত্য অগ্নি বুঝে নিয়েছে, সে বলবে—নিশ্চয় হবে । "আপনি যে ধরিয়ে দিয়েছেন,—যে গার্হপত্য অগ্নি, সেই সোমরসের ভিতর দিয়ে দক্ষিণাগ্নি, আর সে-ই বজ্রধারিণী আহবনীয়া আমার মা ।" যা রান্নাঘরে একটুখানি আগুন ছিল, তাই-ই এই সব ? কি নিয়ে তোরা ঘর করছিস ? বুঝেছিস ? সুতরাং এবার যখন ক্রীং বলব, তখন শুধু 'ক'য়ে 'র'-ফলা দীর্ঘ ঈ মাথায় আসবে না ; মনে আসবে— আহবনীয়, দক্ষিণ ও গার্হপত্য অগ্নি । জগন্নাথের মন্দিরে ঢুকে কোন পাগল ছাড়া কেউ বলবে না যে, জগন্নাথের মন্দিরে আসিনি । তেমনি ক্রীং বললেই তোর মনে পড়ে যাবে— গার্হপত্য, দক্ষিণ ও আহবনীয় অগ্নি । কেননা, এইটি হল বেদগতি । কেটে কেটে, চালিয়ে চালিয়ে সে বয়ে যায় । কে চলেছে ? জাতবেদা ? গঙ্গাস্নানে গিয়ে কি কেউ হিসাব করে যে, গঙ্গা দিয়ে মড়া ভেসে যাচ্ছে, এ ভেসে যাচ্ছে, তা ভেসে যাচ্ছে ?
গঙ্গা গঙ্গা' যে করে সে 'গঙ্গা' বোধে করে । সেই জন্য ক্রীং জাতবেদা টকাস্‌ করে খেয়ে ফেলে । কারণ, নরকে যদি পড়ি, ত আগে জানি জাতবেদাই নরক; অমনি একেবারে উদ্ধার হয়েছি । আচ্ছা, এই বার গার্হপত্য অগ্নি  জ্বাল । ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং স্বাহা । কেন এমন করে 'সোম, সোম' বলছি ? শরীরী তুই যেটা পান করে বসে আছিস; তোর নিজবোধ মহেশ্বর, আর উমা সেজেছে তোর শরীর । তোর এই অবস্থাকে ঐ আগুনে ফেলছিস । কেন না, ওকে আহবনীয় করে নিতে হবে । সেই জন্য আহবনীয়কে আবির্ভূত করার জন্য সোম আহুতি দিচ্ছি । 'আমি' জ্ঞান নিয়েই বসে থাকলে কালী গড়বি কি দিয়ে ? ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা। এই নিজবোধটা হল কালীর নিজবোধ, আর এই হাত পা হল কালীর হাত পা । দাও এতে । ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং—ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা । বেশ বুঝতে পেরেছিস ? ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং, ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা ।
" কেন আমায় ডাকছিস ? কেন ? কেন আজ আমায়
আবার নতুন করে ডাকছিস ? আমি তোদের 
দশান্তর 
দিয়েছি । এই দশা তোরা ভোগ কর । দশান্তর হলেই আমায় চলে যেতে হয় । আমি যাব ।" দেবি ! তুমি যাবে ? যদি যাবে ত 'পুনরাগমনায়' বলে যাও । আবার আসবে বলে যাও । এতৎ পাদ্যং ওঁ জাতবেদসে সুনবাম সোমং—ক্রীং কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । দেবি,  তোমার পুনরাগমনের জন্য মন্ত্র উচ্চারণ করব; কিন্তু সে  পুনরাগমনে যেন একটা সাধারণ বর্ষ অতিক্রান্ত না হয় একটি বাক্যের পরিবর্ত্তনেই যেন একটি বর্ষ হয়। একটি বাক্যে আত্মাকে পরিবর্ত্তন করলেই একটি বর্ষ হয় । একটি বাক্যের আকারে উদিত হয়ে যখন তুমি চলে যাবে, তখনই স্মরণ করব —ওহো একটা বর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে; এইবার মা আসবে, মা আসবে । তাই তোমায় পাদ্য দিচ্ছি । ওঁ এতৎ পাদ্যং ক্রীং কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । ইদং অর্ঘ্যং ক্রীং কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । ইদং আচমনীয়ং ক্রীং কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । ইদং স্নানীয়ং ক্রীং কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । এতে গন্ধপুষ্পে ক্রীং জাতবেদায়ৈ কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । দাও, তোমাদের যা কিছু আছে দাও । বর্ষে বর্ষে এস মা ! প্রতি কথার প্রকাশে তোমার সোমবর্ষণ, তাতে তুমি আমাদের সোমপান করিয়ে যাও । তাই প্রতি কথায় যে বর্ষ সম্পন্ন হয়, সেই কথায় কথায় তুমি এসো । এতৎ মাল্যং  ক্রীং জাতবেদায়ৈ কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । এতৎ পুষ্পং ক্রীং কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । এষ পুষ্পাঞ্জলিঃ ক্রীং জাতবেদায়ৈ কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । এতৎ সোপকরণং নৈবেদ্যং ক্রীং জাতবেদায়ৈ কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । জয় মা ! জয় মা ! ওঁ সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমো’স্তু তে।।
ওঁ শরণাগতদীণার্ত্তপরিত্রাণপরায়ণে। সর্ব্বস্যার্ত্তিহরে দেবি নারায়ণি নমো’স্তু তে। পুনরাগমনায় ত্বাং নমামি । ওঁ সর্ব্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্ব্বার্থসাধিকে ।শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমো’স্তু তে।। পুনরাগমনায় ত্বাং নমামি ।[ ১।৫ মিনিটে প্রথম পর্ব্ব সমাপ্ত ।]

                      [ ১।৩০ মিনিটে নিরঞ্জন পর্ব্ব আরম্ভ ।]
ক্রীং । এষ পুষ্পাঞ্জলিঃ ক্রীং কালিকায়ৈ স্বাহা । জাতবেদা ! জাতবেদা ! জাতবেদা ! জাতবেদা ! আমায় তুমি যে জাত করেছ, সে শুধু তোমায় জড়িয়ে ধরবার জন্য মা ! আমার জন্মই তোমায় জড়াবার জন্য । আমি যেন আর তোমায় ভুলি না । ভগবতি ! এই ত আমি বলছিলাম, বিরাটে তোমার যে আদিত্য মূর্ত্তি, তা থেকে চন্দ্রমারূপে, প্রত্যাবর্ত্তন করে, তুমি যে আবির্ভূত হচ্ছ, কেবল সেই আগমন আমার প্রার্থিত নয় । আমার বাক্‌ই পৃথিবী । বাক্‌ই অগ্নি, তাই বাক্‌ই পৃথিবী । তোমার বাক্‌রূপ পৃথিবী আমার বাক্‌রূপ পৃথিবীকে চাঁদের মত বেষ্টন করে পরিবর্ত্তন করছে । যেমন আদিত্যকে বেষ্টন করে চাঁদ জ্যোৎস্না বর্ষণ করে, তোমার জ্যোৎস্না তেমনি তোমার বাক্যকে পরিবেষ্টন করে করে ঘুরছে । তোমার এই কৌমুদীতে স্নাত হচ্ছি । কিন্তু এ যে কলঙ্কময় কৌমুদী । এতে কলন হচ্ছে; বাল্য, যৌবন, কৌমার, শৈশব, বার্দ্ধক্য, এইরূপে কলন চলছে । এ কলঙ্কময় চাঁদের বেষ্টনে আমি আর ঘেরা থাকতে চাই না। তুমি নিষ্কলঙ্ক চাঁদ হয়ে আমায় বেষ্টন কর । ভোগ হতে থাকবে, ফল হতে থাকবে না, এমনি নিষ্কলঙ্ক চাঁদ দিয়ে আমায় ঘিরে নিয়ে চল । এমনি যে বর্ষ হয়, সেই বর্ষে বর্ষে তুমি ফিরে এস । জাতবেদা ! কি সোম দেখালে মা ! আমার এই সন্তানদের এই সোম খাওয়াও মা ! ঐ কলনের নাম কলঙ্ক, ফলের কলঙ্ক; ভোগের দ্বারা ফল, সেই কলঙ্ক । কিন্তু আমার অমাবস্যার নিষ্কলঙ্ক চাঁদ আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরুক, আমার বর্ষ রচনা করুক, আমি বারবার তোমায় ফিরে পাই । তোরা এই নিষ্কলঙ্ক চাঁদ চাস ? ওগো, তোমায় জড়িয়েই ত ধরেছি । আর ত এই জড়ান ছাড়ান যায় না । আমি যে দিকে ফিরতে যাই, নিষ্কলঙ্ক চাঁদ আমায় জড়িয়ে থাকে । দেবি আমার, এমনি করে তুমি আমায় জড়িয়ে থাক, ধরে থাক । ক্রীং অমায়ৈ স্বাহা । আমি হাসব, আনন্দে লম্ফ দেব, না কাঁদব, তা বুঝতে পারছি না । দেবি আমার ! তুমি আমায় চেপে ধর । ক্রীং কালিকায়ৈ পুনরাগমনায় স্বাহা । মা ! মা ! মা ! শাঁখ বাজাও । [ ধূপ-দীপাদি দ্বারা আরতি ]। এই মাত্র তোদের বলছিলাম,— আমি হাসব, কি কাঁদব, কি আনন্দে নৃত্য করব, তা ঠিক করতে পারছি না । মা বললে—" আমি যে দ্বীপ থেকে এসেছি, সে দ্বীপ যে তোর বুকে বাঁধা । আমি যে তোর বুক থেকে বেরিয়ে এই যজ্ঞমূর্ত্তি হয়ে সেজেছি ।" সুতরাং আমরা এই মাকে মাথায় করে নিয়ে বিজয় যাত্রায় যাব । এই সব নিয়েই যাব । নিরঞ্জনের বাজনা বাজাও । [নিরঞ্জন ক্রিয়া]।
দুর্গাং যজ্ঞেন জয়ামি জয়ন্তী অসুরজয়াং । দুর্গাং জয়ামি যজ্ঞেন জয়ন্তী অসুরজয়াং । 
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাশিষ্যতে।। ওঁ পূর্ণমস্তু ওঁ পূর্ণমস্তু ওঁ পূর্ণমস্তু ।

                    [বিশ্বমাতা পূজা সমাপ্ত।]

---------------------------------------------
১৯৪১ সালের পূজার সময়ে বৃত্র-সংহন্ত্রী ইন্দ্রাণীর উদ্দেশ্যে মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণের উক্তি। 
(https://upanishadinbengali.blogspot.com/2024/02/durga-puja-of-1941-in-bengali-language.html

যেমন তুমি কিরীটিনীরূপে দেখা দিলে, তেমনি কিরীটিনী হয়ে সর্ব্বতঃ আমাদের রক্ষা করতে থাক। ঐ অস্ত্র শস্ত্র ধরে, বেদময়ী হয়ে পাহারা দিতে থাক, যেন বৃত্র তার ভিতর
অন্ধকার তৈরি করতে না পারে। বৃত্রসংহন্ত্রি ! শুনেছি, দধিচীর অস্থি দিয়ে তোমার বজ্র তৈরি হয়েছিল। আমিও দধীচি হয়েছি। যখন দেখছি, আমিই শুধু ঐ চন্দ্র, সূর্য্য, বায়ু, ইত্যাদি দেখছি না, ওরাও আমার দিকে চেয়ে আছে, তখন আমিও দধীচি হয়েছি। আমি দেখছি, চেতন অচেতন, সবাই জাগ্রত হয়ে আমায় দেখছে। এতে আমার বেদন খুলে গেছে —নয় তো কি হয় ? তুমি আমার দিকে চেয়ে থাক, আমি তোমার দিকে চেয়ে
থাকি, তবেই একটা ব্যথা খেলে।
তুমি দেখিয়েছ— ইয়ং পৃথিবী সর্ব্বেষাং ভূতানাং মধু, অস্যৈ পৃথিব্যৈ সর্ব্বাণি ভূতানি মধু। ওগো মাটি, তুমি আমার যেমন আদরের, আমিও তোমার তেমনি আদরের। এই যে আদান প্রদান তুমি আমাকে ইন্দ্রাণী হয়ে দেখিয়ে দিয়েছ, এই আদান প্রদানের চোখ যার খুলেছে, তার নাম দধীচি। দধ্যঙ্‌——সে যেখান দিয়ে চলে—কি গো মাটি, কিগো অগ্নি ভাল আছ ? কি গো আকাশ, আমি যাচ্ছি পথ দাও’----এই রকম কথা বলতে বলতে চলে। তার হাড় না হলে বজ্র হয় না। শিষ্যদের কাছে আমি বলেছি——যা কিছু তোরা দেখছিস ও সব বেদন; একজন বেদিত হয়ে আমি মাটি বলছে, যেমন তুই এখন যে ভাব ও ভঙ্গিমা নিয়ে বসে আছিস, তা দেখলেই বলব---- মানুষ বসে আছিস, তেমনি একজন ঐ মাটির ভঙ্গিমা নিয়ে বসে আছে।এ সত্যি ঋক্‌ ; তোরাও যেমন ওরাও তেমনি সত্যি ব্রহ্মার্চি। ভিখারি যেমন মিছিমিছি বলে ‘তুমি রাজা’, সে রকম নয়।এই যে জানে, সে দধীচি।এ কোথাও চলে না, এর গা থেকে হড় হড় করে দধি, প্রাণের স্রোত চলে। এই রকমে ততটাই বৃত্র বধ হয়, ততটাই বজ্র নির্ম্মিত হয়, যতটা এইরকম প্রাণে প্রাণে খেলা করতে পারি।ওঁ কিরীটিনী মহাবজ্রে সহস্রোনয়নোজ্বলে। বৃত্রপ্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমোস্তু’তে।। তাই বলছিলাম, আবার যদি আমাকে ঘুম পাড়াও, তবে তো ঘুমাতেই হবে, কিন্তু আমি আর ঐ অসুরের মত ঘুমাব না; এই আলোয় ঘুমাব। তুমি আমায় কোলে করে আছ, এই আমার আলো। যেমন তুমি কিরীটিনীরূপে দেখা দিলে, তেমনি কিরীটিনী হয়ে সর্ব্বতঃ আমাদের রক্ষা করতে থাক। ঐ অস্ত্র শস্ত্র ধরে, বেদময়ী হয়ে পাহারা দিতে থাক, যেন বৃত্র তার ভিতর অন্ধকার তৈরি করতে না পারে। বৃত্রসংহন্ত্রি ! শুনেছি, দধিচীর অস্থি দিয়ে তোমার বজ্র তৈরি হয়েছিল। আমিও দধীচি হয়েছি। যখন দেখছি, আমিই শুধু ঐ চন্দ্র, সূর্য্য, বায়ু, ইত্যাদি দেখছি না, ওরাও আমার দিকে চেয়ে আছে, তখন আমিও দধীচি হয়েছি। আমি দেখছি, চেতন অচেতন, সবাই জাগ্রত হয়ে আমায় দেখছে। এতে আমার বেদন খুলে গেছে——নয় তো কি হয় ? তুমি আমার দিকে চেয়ে থাক, আমি তোমার দিকে চেয়ে থাকি, তবেই একটা ব্যথা খেলে। তুমি দেখিয়েছ—— ইয়ং পৃথিবী সর্ব্বেষাং ভূতানাং মধু, অস্যৈ পৃথিব্যৈ সর্ব্বাণি ভূতানি মধু। ওগো মাটি, তুমি আমার যেমন আদরের, আমিও তোমার তেমনি আদরের। এই যে আদান প্রদান তুমি আমাকে ইন্দ্রাণী হয়ে দেখিয়ে দিয়েছ, এই আদান প্রদানের চোখ যার খুলেছে, তার নাম দধীচি। দধ্যঙ্‌——সে যেখান দিয়ে চলে——‘ কি গো মাটি, কিগো অগ্নি ভাল আছ ? কি গো আকাশ, আমি যাচ্ছি পথ দাও’----এই রকম কথা বলতে বলতে চলে। তার হাড় না হলে বজ্র হয় না। শিষ্যদের কাছে আমি বলেছি——যা কিছু তোরা দেখছিস ও সব বেদন; একজন বেদিত হয়ে আমি মাটি বলছে, যেমন তুই এখন যে ভাব ও ভঙ্গিমা নিয়ে বসে আছিস, তা দেখলেই বলব---- মানুষ বসে আছিস, তেমনি একজন ঐ মাটির ভঙ্গিমা নিয়ে বসে আছে।এ সত্যি ঋক্‌ ; তোরাও যেমন ওরাও তেমনি সত্যি ব্রহ্মার্চি। ভিখারি যেমন মিছিমিছি বলে ‘তুমি রাজা’, সে রকম নয়।এই যে জানে, সে দধীচি।এ কোথাও চলে না, এর গা থেকে হড় হড় করে দধি, প্রাণের স্রোত চলে। এই রকমে ততটাই বৃত্র বধ হয়, ততটাই বজ্র নির্ম্মিত হয়, যতটা এইরকম প্রাণে প্রাণে খেলা করতে পারি।ওঁ কিরীটিনী মহাবজ্রে সহস্রোনয়নোজ্বলে। বৃত্রপ্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমোস্তু’তে।। তাই বলছিলাম, আবার যদি আমাকে ঘুম পাড়াও, তবে তো ঘুমাতেই হবে, কিন্তু আমি আর ঐ
অসুরের মত ঘুমাব না; এই আলোয় ঘুমাব। তুমি আমায় কোলে করে আছ, এই আমার আলো।
-----------------------------------------------------------------------------------




























































































































































































































































































































































   
  
  


 

      











 

    




  
                      

 
 
 
      


Comments

Popular posts from this blog

দধীচি উক্ত মধুবিদ্যা। বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ দ্বিতীয় অধ্যায় পঞ্চম ব্রাহ্মণ। (Brihadaranyaka Upanishad Second Chapter Fifth Brahmin in Bengali language. Madhuvidyaa as told by the sage Dadhiichi in Bengali language.)

ঈশোপনিষদ্‌ (ঈশ উপনিষদ্‌) --মূল মন্ত্র, অর্থ, নিরুক্ত এবং ব্যাখ্যা সহ। (Ishopanishad --Isha Upanishad in Bengali language with original texts, annotaions, meanings, etymolgies and explanation.)