বৃহদারণ্যক উপনিষদ।গায়ত্রী বিদ্যা।পঞ্চম অধ্যায়, চতুর্দশ ব্রাহ্মণ।(Brihadaranyaka Upanishad in Bengali--Chapter on Gayatri)
বৃহদারণ্যক উপনিষদ। গায়ত্রী বিদ্যা। পঞ্চম অধ্যায়, চতুর্দশ ব্রাহ্মণ।
(Brihadaranyaka Upanishad in Bengali--Chapter on Gayatri)
(মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৪৫) এবং তাঁর প্রধান শিষ্য মহর্ষি ত্রিদিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯২৩-১৯৯৪) উপদেশ অনুসরণ করে এই উপনিষদের অর্থ এবং নিরুক্ত লিখিত হল।----দেবকুমার লাহিড়ী--debkumar.lahiri@gmail.com)
৫। ১৪। ১
ভূমিরন্তরিক্ষং দ্যৌরিত্যষ্টাবক্ষরাণ্যষ্টাক্ষরং হ বা একং গায়ত্র্যৈ পদমেতদুহৈবাস্যা এতৎ স যাবদেষু ত্রিষু লোকেষু তাবদ্ধ জয়তি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদ।
অন্বয়।
ভূমি (ভূমি) অন্তরিক্ষং (অন্তরীক্ষ) দ্যৌঃ (দ্যৌ / দ্যু) ইতি (এই তিনটি) অষ্টৌ (অষ্ট) অক্ষরাণি (অক্ষর)। অষ্ট (অষ্ট) অক্ষরম্ (অক্ষর) বা (ই) একং(একটি) গায়ত্রৈ (গায়ত্রীর) পদম্ (পদ)। এতৎ (এই--এই এক পদ)) উ হ এব অস্যা: (এনার- এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই- এই তিন লোক) ।
সঃ (সে- যিনি এইটি জানেন) যাবৎ (যে পর্যন্ত) এষু (এই) ত্রিষু (তিন) লোকেষু (লোকে), তাবৎ (সেই পর্যন্ত) হ জয়তি (অবশ্যই জয় করেন), যঃ (যিনি) অস্যা (এনার) এতৎ (এই) এবম্ (এই প্রকার) পদম্ (পদকে) বেদ (জানেন)।
অর্থ।
ভূমি, অন্তরীক্ষ, দ্যৌ এই তিনটি অষ্ট অক্ষর। এই অষ্ট অক্ষরই একটি গায়ত্রীর পদ। এই--এই এক পদ গায়ত্রীর এই- এই তিন লোক।
সে- (যিনি এইটি জানেন), যে পর্যন্ত এই তিন লোকে যা কিছু আছে সেই পর্যন্ত ( সকল কিছু )অবশ্যই জয় করেন যিনি এনার এই প্রকার পদকে জানেন।
নিরুক্ত।
ভূমি--ভূ -- সৃষ্টি হওয়া, অস্তিত্বময় হওয়া; মি--মিতি---মাপ।
ভূমি--যেখানে সকল কিছু সৃষ্ট হয় পরিমাপ যোগ্য হয়ে; ভূমি হল সেই লোক যেখানে সকল কিছুকে মাপা যায়, সকল কিছু পরিমিত বা সীমিত। সুতরাং এখানে একটি অস্তিত্ব অন্যটির থেকে আলাদা, প্রত্যেকে সীমিত। এই জন্য ভূমির অন্য নাম পৃথিবী অর্থাৎ যেখানে সবাই পৃথক পৃথক স্থিতি নিয়ে বর্ত্তমান।
অন্তরীক্ষ--- অন্ত (অন্তর) +ঈক্ষ (দর্শন , অনুভূতি)।
অন্তরীক্ষ---যেখানে সকল কিছু নিজের অন্তরে দৃষ্ট বা অনুভূত হয়। এখানে সকল কিছু নিজের সাথে যুক্ত বলে অনুভূত হয়। ভূমিতে যা পৃথক পৃথক ভাবে অনুভূত হয় , এখানে তা নিজেতে যুক্ত বলে বিজ্ঞাত হয়।
দ্যৌ-- যা দ্যুতিমান বা নিজেই নিজেকে এবং সকল কিছুকে প্রকাশ করে।
অন্তরীক্ষে নিজের ভিতরে অনুভূত হলেও, ভোক্তা (যে অনুভব করছে) এবং ভোগ্য (যাকে অনুভব করছে) আলাদা। দ্যুলোকে নিজেই নিজেকে ভোগ করছে। শব্দ, স্পর্শ ইত্যাদি সেখানে নিজেরই প্রকাশ।
দোহন অর্থাৎ নিজেকে দোহন করে ইনি (স্বয়ং প্রকাশ চেতনা) সবাইকে প্রকাশ করেছেন বলে ইনি দ্যু, দিব্, দ্যৌ।
বেদ এঁকে দোগ্ধ্রী বলে অভিহিত করয়েছেন। ইনি বাক্ এবং বেদ এঁর চারটি স্তনের কথা উল্লেখ করয়েছেন যার দ্বারা ইনি দেবগণ, পিতৃগণ এবং মনুষ্যগণকে পালন করেন।
অষ্ট---উপনিষদে বাক্কে অষ্টমী বলা হয়েছে। সকল কিছু চেতনা বা বাকের আয়তন বা 'বাক্য'। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)। সকল কিছু এঁর কথা, মনন বা মন্ত্র থেক সৃষ্ট হয়েছে।
বাক্কে ছান্দোগ্য উপনিষদে 'বৃহতী' বলা হয়েছে; যিনি বৃহৎ হচ্ছেন বা নিজেকে বর্দ্ধন করছেন।
সব কিছু এই মহা চৈতন্যে সমূহিত হয়ে রয়েছে, এইটি সপ্ত সংখ্যা বা চেতনার সপ্ত নামক সংখ্যাতি।সব কিছু যা নানা দিকে, নানা দেশে স্থিত, তাদের সবাইকে এই নিজেতে বা আত্মস্বরূপ চেতনায় পাওয়া গেল। এইটি চেতনার সপ্তমী নামক মহিমা বা তিথি।
আর সব কিছুর আকারে চেতনা নিজেকে বর্দ্ধন করেছেন, সব কিছুতে একই আত্মস্বরূপ চেতনা, এইটি 'অষ্টম' বা 'অশতম' স্বরূপ। নিজেকে অনন্তে অনন্তে বিস্তার করেছেন বা বৃহৎ হচ্ছেন, তাই সৃষ্টির প্রতি অণুতে এই এক আত্মস্বরূপই নিজেকে তদাকারে সৃষ্ট করে বিরাজ করছেন।দিক্ দিগন্তে যা কিছু ছড়িয়ে আছে, সেখানে নিজেকে বা এই আত্মাকেই পাওয়া গেল, এইটি অষ্টমী নামক চেতনার মহিমা বা তিথি।
যেখানে যা কিছু আছে তা এই ভূমি (২), অন্তরীক্ষ (৪) এবং দ্যৌ / দি +উ / দ + য়ৌ (২), সব কিছু এই তিনের অন্তর্গত; তাই এঁরা অষ্ট বা পরম আত্মস্বরূপের অষ্ট নামীয় মহিমাকে বিজ্ঞাপন করছেন।
এঁরা অক্ষর বা ক্ষয় বিহীন। এই যে অষ্ট অক্ষর ( ভূমি, অন্তরীক্ষ, দ্যৌ) এঁরা গায়ত্রীর একটি পদ। পদ অর্থে যাতে সব প্রতিষ্ঠিত থাকে। যে অবয়ব আমাদের প্রতিষ্ঠাকে স্থূল ভাবে সাধন করছে , তার নাম পাদ বা পা। পায়ের দ্বারাই আমরা দাঁড়িয়ে থাকি।
(অষ্ট বসুগণ বা বসু নামক গণ দেবতারা যাঁরা সবাইকে বসবাস করান, তাঁরাও অষ্ট। এই অষ্ট বসুদের নাম , বৃহদারণ্যক উপনিষদ অনুসারে হল----অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরীক্ষ, আদিত্য, দ্যৌ, চন্দ্রমা, নক্ষত্র সকল। )
যিনি এইটি (এই পদকে) জানেন, তিনি এই তিনলোকে যা আছে তাকে জয় করেন। জয় করা অর্থে 'নিজেতে পাওয়া'। চেতনা বা বোধ ক্ষেত্রে কিছু জানা মানেই তৎ সারূপ্য প্রাপ্ত হওয়া। সেই রকম, গায়ত্রীকে যিনি জানেন, গায়ত্রীর যা মহিমা তা সেই বিজ্ঞাতারও মহিমা।
৫। ১৪। ২
ঋচো যজূংষি সামানীত্যষ্টাবক্ষরাণ্যষ্টাক্ষরং হ বা একং গায়ত্র্যৈ পদমেতদুহৈবাস্যা এতৎ স যাবতীয়ং ত্রয়ী বিদ্যা তাবদ্ধ জয়তি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদ।
অন্বয়।
ঋচো (ঋক্ সকল), যজূংষি ( যজুঃ সকল) সামানি (সাম সকল) ইতি (এঁরা/ এই তিনটি) অষ্টৌ (অষ্ট) অক্ষরাণি(অক্ষর), অষ্ট অক্ষরম্ (অষ্ট অক্ষর) হ বা একম্ (অব্যশ্যই একটি) ) গায়ত্রৈ (গায়ত্রীর) পদম্ (পদ); এতৎ (এই--এই এক পদ)) উ হ এব অস্যা: (এনার- এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই- এই তিন বিদ্যা) )। সঃ (সে- যিনি এইটি জানেন) যাবতী (যে পর্যন্ত) ইয়ম্ (এই) ত্রয়ী (তিন) বিদ্যা(বিদ্যা) তাবৎ (সেই পর্যন্ত) হ জয়তি (অবশ্যই জয় করেন), যঃ (যিনি) অস্যা: (এনার) এতৎ (এই) এবম্ (এই প্রকার) পদম্ (পদকে) বেদ (জানেন)।
অর্থ।
ঋক্ সকল, যজুঃ সকল, সাম সকল , এঁরা/ এই তিনটি যা অষ্ট অক্ষর; অষ্ট অক্ষর অব্যশ্যই গায়ত্রীর একটি পদ; এই এক পদ এনার (এই গায়ত্রীর) এই তিন বিদ্যা। সে (যিনি এইটি জানেন), যে পর্যন্ত এই তিন বিদ্যা সেই পর্যন্ত অবশ্যই জয় করেন), যিনি) এনার এই প্রকার পদকে জানেন।
(ঋচো--২; যজূংষি--৩; সামানি--৩; ২+৩=+৩=৮।)
নিরুক্ত।
ঋক্, যজুঃ এবং সাম, এই তিন বেদ বা আত্ম বেদনের তিনটি মাত্রা, যারা চেতনার প্রকাশ বা মন্ত্র সকল ( যাদেরকে বেদ মধুকর বলে বর্ণনা করেছেন ), সেই বেদনই আমাদের আশ্রয় হয়ে, তিন লোক হয়ে , ভূমি, অন্তরীক্ষ ও দ্যৌ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এই তিন বিদ্যা, যাঁদের দ্বারা আমরা বিদ্যমান, তাঁরাও অক্ষয় বা অক্ষর। তাঁরাও অষ্ট, তাঁরাও প্রতি অণুতে অণুতে বিদ্যমান, সর্ব্বত্র বেদনময়; সবাইকে প্রাণময় করে রেখেছেন।
যা তন্ত্র শাস্ত্রে 'শক্তি', তাই বেদে 'বিদ্যা'। বিদ্যা মানে যাঁর দ্বারা আমরা 'বিদ্যমান' বা বেদনময়, সোম বা অনুভূতিময়। আবার, যে সকল বেদন বা প্রজ্ঞার দ্বারা আমরা 'মুক্তির' দিকে বা মৃত্যুর দাসত্ব থেকে পরিত্রাণের পথে চালিত হই, তা 'বিদ্যা' বলে অভিহিত হয়।
চেতনার 'ঋক্' বলে যে বেদন বা প্রাণময়তা, যার থেকে রূপময়, সংজ্ঞাময় , আয়তন যুক্ত, দৃশ্যমান এই বিশ্ব প্রকাশ পেয়েছে, তার আধার হল ভূমি। ' ঋ মানে 'চলা, গতি'। আর সেই গতি থেকে 'ক' বা ব্যঞ্জনা বা বর্ণ সকল প্রকাশ পায়। ঋক্ মানে চেতনার, আত্মস্বরূপের সেই বেদন যা থেকে যা কিছু 'দৃশ্য', যা কিছু 'চাক্ষুষ' তা প্রকাশ পায়। তাই ঋক্ বেদের প্রথম মন্ত্রে অগ্নি যিনি প্রকাশবান্ , যিনি সব প্রকাশের 'অগ্রে', যিনি 'নেতা' (নি> নী ), তাঁর বন্দনা করা হয়েছে।
চেতনার 'যজুঃ' বলে যে বেদন বা প্রাণময়তা, যার দ্বারা এই আত্মস্বরূপ চেতনার সাথে আমরা সর্ব্বদা যুক্ত, যার দ্বারা আমরা ইন্দ্রিয়ময় হয়েছি এবং ইন্দ্রিয়দের দ্বারা বহির্বিশ্বের সাথে যুক্ত রয়েছি , তার নাম যজুর্বেদ বা যজুর্বেদন।
মহাপ্রাণের এই বেদনময়তা বা ক্রিয়ার দ্বারা আমরা সবাই সবার সাথে যুক্ত। তাই উপনিষদ, যিনি মহাপ্রাণ, তাঁর প্রবহমানতাকে লক্ষ করে তাঁকে বায়ু বলে অভিহিত করেছেন এবং তাঁর যুক্ততার ক্রিয়া (বা যজন / যোজন) কে লক্ষ করে তাঁকে 'সূত্র' বা 'সূত্রাত্মা' বলে অভিহিত করেছেন। তাই যজুর্বেদের প্রথম মন্ত্রে, বায়ুকে বন্দনা করা হয়েছে।
অন্তর থেকে বাহিরে আর বাহির থেকে অন্তরে এই যাতায়াত বা গতাগতি যে পথে আমরা করি এবং যাদের দ্বারা করি, তারা ইন্দ্রিয়। তাই এই ইন্দ্রিয়রা যজুর্বেদের অন্তর্গত। এই ইন্দ্রিয়দের যে দৈব স্বরূপ তা হল একাদশ রুদ্র। মন, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয়, এই নিয়ে একাদশ রুদ্র।
সবার সাথে সবার যুক্ততা যে লোকের বৈশিষ্ট্য তা হল অন্তরীক্ষ। এখানে অন্তরেই ঈক্ষণ বা দর্শন চলছে। সবাইকে নিজের ভিতরেই দেখা যাচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে। আর প্রাণের যে ক্রিয়া বা বেদনের দ্বারা এই যুক্ততা বা যোগসূত্র সাধিত হচ্ছে তার নাম যজুর্বেদ বা যজুর্বেদন।
যে পরম আত্মস্বরূপের ঋক্ বেদন থেকে বিশ্বভূবন প্রকাশ পেয়েছে আর যাঁর যজুর্বেদনের দ্বারা সবাই তাঁর সাথে যুক্ত এবং সবাই সবার সাথে যুক্ত, তাঁর যে 'নিজ' বা আত্মবেদন , তাই সাম। এই একই আত্মস্বরূপের আত্মত্বই আমাদের মধ্যে 'নিজ বোধ' বা 'আত্ম বোধ', যা আমাদের সব বোধ, অনুভূতি এবং অস্তিত্বর মূলে।
এই আত্মাই সাম, এঁতে সবাই সমান বা সাম। ইনিই প্রাণ এবং বাক্ হয়ে সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। প্রতি সৃষ্টির মূলে এই প্রাণ এবং বাকের মিথুন রয়েছে। প্রতি সৃষ্টিতে, প্রাণ হয়েছেন আধেয় আর বাক্ হয়েছেন আধার। নিজেকে, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী ইত্যাদির আকারে বেষ্টন করেছেন বা তদাকারে সৃষ্টি করেছেন। এই যে নিজেকে নানা নামে, নানা সংজ্ঞায় ,নানা বাক্যে আলিঙ্গিত করেছেন, আত্মার এই মহিমা বা শক্তির নাম বাক্। আর যা হয়েছেন, যা সৃষ্ট হয়েছে, তাই প্রাণ বা প্রাণি। ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি প্রাণ কে 'অম' এবং বাক্কে 'সা' বলেছেন।
সবাই বাক্ আর প্রাণের মিথুন বা সাম। নিজেকে নিজে দোহন করে , এই স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা সব হয়েছেন, তাই এঁর (বাকের ) নাম দোগ্ধ্রী আর তাঁর লোকের নাম 'দ্যু' বা দ্যৌ'।
ছান্দোগ্য উপনিষদে আদিত্যকে, দেবগণের মধু বলা হয়েছে, আর দ্যু হল 'তিরশ্চীন বংশ' বা তেরছা বা বাঁকা বংশ দণ্ড বা বক্র শাখা প্রশাখা যাতে মধুচক্র সকল অবস্থিত।
আদিত্য হল সেই কেন্দ্র যেখানে সব দ্বিতীয়তা অদ্বতীয়তায় বা সামে বিধৃত। আদিত্য , অদিতির সন্তান; যাঁতে কোন দ্বিতীয় ভাব নেই তিনি 'অদিতি। এই আদিত্য 'অদন' বা ভোজনের কেন্দ্র। 'অদন অর্থে খাওয়া। ইনি কাল গতিতে সবাইকে খাচ্ছেন, সবাইকে নিজের সাথে একসা করছেন। কাল গতিতে আমাদের অভ্যুদয় হচ্ছে; আমরা ক্রমশঃ এই আত্মাকে বা নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি। এই আদিত্যকে দ্বাদশ বলা হয়েছে; দ্বাদশ মাসে বা দ্বাদশ সমাসে ইনি আমাদের সমাসিত করছেন; আবর্ত্তন যখন সম্পূর্ণ হয়, দ্বাদশ মাসের অন্তে আমরা নিজেদের ঐ অদিতির সন্তান বলে জানতে পারব।
এই তিন বিদ্যা বা বেদ হলেন অক্ষর বা অক্ষয় এবং অষ্ট, অর্থাৎ সর্ব্বত্র বিদ্যমান।
বেদের ব্যক্তিত্ব হল 'দেব' বা 'দেবতা', একদিকে বেদ বা বেদন আর তার ব্যক্তিত্ব বা ব্যবহারময়তা নিয়ে দেব বা দেবতা।
ভূমি হল 'লোক', ঋক, তার বেদ এবং অষ্ট বসু তার দেবতা।
অন্তরীক্ষ হল লোক , যজুঃ তার বেদ এবং একাদশ রুদ্র তার দেবতা।
দ্যু বা দ্যৌ হল লোক, সাম তার বেদ, দ্বাদশ আদিত্য তার দেবতা।
৫। ১৪। ৩
প্রাণঃ অপানো ব্যান ইত্যষ্টাবক্ষরাণ্যষ্টাক্ষরং হ বা একং গায়ত্র্যৈ পদমেতদুহৈবাস্যা এতৎ স যাবদিদং প্রাণি তাবদ্ধ জয়তি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদাথাস্যা এতদেব তুরীয়ং দর্শতং পদং পরোরজা য এষ তপতি যদ্বৈ চতুর্থং তত্তুরীয়ং দর্শতং পদমিতি দদৃশ ইব হ্যেষ পরোরজা ইতি সর্ব্বমুহ্যে বৈষ রজ উপর্যুপরি তপত্যেবং হৈব শ্রিয়া যশসা তপতি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদ।
অন্বয়।
প্রাণঃ (প্রাণ) অপান: (অপান) ব্যান:(ব্যান) ইতি (এই তিন) অষ্টৌ (অষ্ট) অক্ষরাণি (অক্ষর); অষ্ট অক্ষরম্ (অষ্ট অক্ষর) হ বা একম্ (অব্যশ্যই একটি) ) গায়ত্রৈ (গায়ত্রীর) পদম্ (পদ); এতৎ (এই--এই এক পদ)) উ হ এব অস্যা: (এনার- এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই- এই তিন বিদ্যা) ); স: (সে) যাবৎ (যে পর্যন্ত) ইদম্(এই) প্রাণি (প্রাণীরা) তাবৎ (সেই পর্যন্ত) হ (অবশ্যই) জয়তি (জয় করেন) যঃ (যিনি) অস্যাঃ (এনার--এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই) এবম্ পদম্ (এই রকম পদকে) বেদ (জানেন)। অথ (আর) অস্যা (এনার--এই গায়ত্রীর) এতৎ এব (ইহাই) তুরীয়ম্ (তুরীয়) দর্শতম্ (দৃশ্যমান) পদম্ (পদ) পরঃ (শ্রেষ্ঠ; পরপারে বা ঊর্দ্ধে) রজাঃ (রজ সকলের); যঃ (যিনি) এষঃ (এই ভাবে) তপতি ( তাপ বিকিরণ করছেন) । যৎ বৈ চতুর্থম্ (যা ঐ চতুর্থ), তৎ (তা) তুরীয়ম্ (তুরীয়)। দর্শতম্ (দর্শনীয়) পদম্ (পদ) ---ইতি দদৃশ (দর্শনীয়) ইব (যেন) হি (অবশ্যই) এষ: (এই) পরঃ রজাঃ (রজের ঊর্দ্ধে) ইতি। সর্ব্বম্ (সবাইকে) উ হি এব (অবশ্যই) এষ: রজঃ (এই যা রজ) উপরি উপরি (তার উপরে, তার ঊর্দ্ধে) তপতি (তপ্ত করছেন)। এবম্ হ এব (এই রকম ভাবেই) শ্রিয়া (শ্রীর দ্বারা) যশসা(যশের দ্বারা) তপতি (তপ্ত করেন) যঃ (যিনি) অস্যাঃ (এনার---এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই) এবং(এই প্রকার) পদং (পদকে) বেদ বিজ্ঞাত হন বা জানেন)।
অর্থ।
প্রাণ, অপান ব্যান এই তিন অষ্ট অক্ষর; অষ্ট অক্ষর অব্যশ্যই গায়ত্রীর একটি পদ ; এই গায়ত্রীর এই এক পদ, এই তিন বিদ্যা ; তিনি, যে পর্যন্ত এই প্রাণীরা, সেই পর্যন্ত অবশ্যই জয় করেন, যিনি এই গায়ত্রীর এই রকম পদকে জানেন। আর এই গায়ত্রীর ইহাই তুরীয় দৃশ্যমান পদ যা রজ সকলের পরপারে (বা ঊর্দ্ধে), যিনি এই ভাবে তাপ বিকিরণ করছেন। যা ঐ চতুর্থ তা তুরীয়। দর্শনীয় পদ ----- যেন দর্শনীয়, অবশ্যই এই রজের ঊর্দ্ধে । সবাইকে অবশ্যই, এই যা রজ তার উপরে, তার ঊর্দ্ধে তাপ বিকিরণ করছেন। এই রকম ভাবেই শ্রীর দ্বারা, যশের দ্বারা তিনি তপ্ত করেন, যিনি এই গায়ত্রীর এই প্রকার পদকে বিজ্ঞাত হন বা জানেন।
(প্রাণ=২, অপান= ৩, ব্যান-বিয়ান--৩; ২+৩+৩=৮।)
নিরুক্ত।
ঋক্, যজুঃ এবং সাম এই তিন বেদন বা প্রাণময়তা যাঁর স্বভাব আর সেই বেদত্রয় যে তিন রকম আলো (আলোক) বা লোককে সৃষ্টি করেছে, সেই বেদ আর সেই লোকেরই অধীন হয়ে, এই পরম আত্মস্বরূপ বা যিনি মহাপ্রাণ, তিনি নিজেকে অনন্তরকম প্রাণির আকারে সৃষ্টি করে সেই বেদসকল এবং লোক সকলকে ভোগ করছেন।
প্রতি সত্তায়, ইনিই প্রথম; ইনি আছেন বলে সেই সত্তাটি আছে। যিনি থাকলে সবাই থাকে এবং যিনি চলে গেলে বা উৎক্রমণ করলে তাঁর সাথে সবাই চলে যায় , তিনি প্রাণ।
এই প্রাণই, ঊর্ধ্বে দ্যুলোক; ইনিই অধে পৃথিবী বা বসুধা এবং এঁর নাম 'অপান'। ইনিই বায়ু , অন্তরীক্ষ বা ব্যান, যিনি এই দ্যুঃ (দ্যুলোক) আর ভূঃ (ভূমি বা মর্ত্ত), এই দুইকেই স্পর্শ করে আছেন, এই দুইএর যোজক। তাই বায়ু 'যজুঃ' এবং এঁর অন্য নাম 'ভূবঃ'।
যেখানে যা কিছু আছে বা 'অস্তি' বলে প্রতিভাত হচ্ছে, তা প্রাণই, তারা সবাই চিন্ময়, প্রাণময়। কোথাও বা এই প্রাণের (বা কালের) ধারা অতি মন্দীভূত বলে , তারা জড় বলে প্রতিভাত হচ্ছে; কোথাও আমাদের সীমিত চেতনায় প্রাণের ধারা ধরা পরছে না; কোথাও বা সৃষ্টি জীবন্ত, প্রাণময়। যিনি এই গায়ত্রীকে জানেন, তিনি সর্ব্বত্র এই মহাপ্রাণের প্রাণময়তা কে দর্শন করেন আর প্রাণের যতরকম প্রকাশ, যত কিছু প্রাণি বিশ্ব ভুবনে আছে, তারা তাঁর অনুগত হয়।
তাই এই তিন প্রাণ অষ্ট অক্ষর, সর্ব্বত্র বিস্তৃত, সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত।
প্রাণ ----প্র (প্রথম) +অন্ (গতি বা কম্পন) --চেতনার প্রথম প্রকাশ বা সক্রিয়তা।
অপান---অপ্ +অন্---অন্ বা প্রাণের যে আপ্তি। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রাণেরই আপ্তি, ইনি নিজেকেই 'তদাকারে' বা 'সৃষ্টির' আকারে প্রাপ্ত হয়েছেন বা পেয়েছেন। সমস্ত সৃষ্টিকে নিজের প্রাপ্তি বা 'আত্ম তৃপ্তির' আকারে যেখানে ইনি জানছেন, সেইটি ' অপ্ ' বা ' জল ', যিনি সর্ব্ব তৃষ্ণা হরণ করেন। আর সেই অপ্ বা জল যাতে সবাই 'আপ্তি' হয়ে আছে, তারা যখন 'কাঠিন্য' নিয়ে, স্থূল হয়ে প্রকাশ পায় , তার নাম 'স্থূল বা মূর্ত্ত বিশ্ব' বা 'পৃথিবী'। এই অপানই পৃথিবীর 'আকর্ষণ' বলে অনুভূত হয়। প্রশ্নোপনিষদে বলা হয়েছে যে ' এই অপানের দ্বারাই আমরা আমাদের শরীরে বিধৃত হয়ে রয়েছি। বৃহদারণ্যক উপনিষদে 'অপ্' থেকে 'পৃথিবী' সৃষ্টি হবার কথা বলা হয়েছে।
ব্যান--বি (বিভিন্ন দিকে) + আ (আতত বা প্রসারিত) + অন্ (প্রাণ) ---যিনি প্রাণময় হয়ে সর্ব্বত্র প্রসারিত , সবাইকে প্রাণ রূপ সূত্রের দ্বারা যুক্ত করে রেখেছেন, তিনি ব্যান, বায়ু বা সূত্রাত্মা।
"এই গায়ত্রীর) এতৎ এব (ইহাই) তুরীয়ম্
(তুরীয়) দর্শতম্ (দৃশ্যমান) পদম্ (পদ) পরঃ (শ্রেষ্ঠ; পরপারে বা ঊর্দ্ধে) রজাঃ (রজ সকলের); যঃ (যিনি) এষঃ (এই ভাবে) তপতি ( তাপ বিকিরণ করছেন)" -----এই যে মহাপ্রাণ গায়ত্রী ইনি পরোরজা।
রজ--রজ অর্থে ' র বা রব' যেখান থেকে 'জাত' হচ্ছে। আকাশ হল তত্ত্ব এবং আকাশের তন্মাত্রা হলো 'শব্দ'। সমস্ত কিছু বা সকল 'শব্দ' যেখানে 'শববৎ দমিত ' হয়ে থাকে, আবার সেই শব সকল যেখান থেকে 'বিদ্যুৎ-ময় হয়ে শবত্বকে বিদীর্ণ করে প্রকাশ পায়, অব্যক্ত থেক ব্যক্ত হয়, তার নাম 'আকাশ'। তাই এই আকাশ ঘন কৃষ্ণ বর্ণ আবার তেজ বিকীর্ণময়। তাই আকাশের নাম 'রজ' আর এই গায়ত্রী পরোরজা বা 'রজের' পর পারে, রজের ঊর্ধ্বে।
এই আকাশ কে ইনি প্রাণময় করে, অভিতপ্ত করে আত্মবিকিরণ করছেন বা প্রাণ দান করছেন।
এই আকাশ থেকে যে তেজ বা আলো প্রকাশ পেয়ে সবাইকে শব্দময় বর্ণময় বা নানা রঙে রঞ্জিত করছে, তা 'রজ'। আর ইনি সকল কে রাঙিয়ে, নিজে নিরঞ্জন, তাই 'পরোরজা'।
এই যে প্রাণ রূপ উষ্ণতা দিয়ে গায়ত্রী আমাদের অভিতপ্ত করছেন, এইটি এঁর 'তুরীয়' পদ এবং 'দৃশ্যমান' । এই পদই বেদোক্ত বিষ্ণু বা প্রাণের পরম পদ যা দ্যুলোকের মত এবং সর্ব্বত্র বিস্তারিত চক্ষুর মত। আকাশ মানে যেখানে 'দর্শন, আলোক, ঈক্ষণ বা কাল প্রকাশ পাচ্ছে। ঈক্ষণ মানে 'দৃষ্টি এবং কাল বা ক্ষণ প্রকাশ'। প্রাণ মানেই 'যিনি দেখছেন'। এই দৃষ্টি সবাইকে বিদ্ধ করে চলেছে। ইনি 'তুরীয়', এই দৃষ্টি 'অতীব ক্ষিপ্র'। ইনি প্রাণ, ইনি প্রাণাগ্নি বা অগ্নি, যিনি সবার 'অগ্রে'(অগ্) চলেন (নী)। ইনি 'নেতা' , সবাইকে নিয়ে চলেন এবং 'অগ্রে' থাকেন। তাই ইনি 'নয়ন' বা দর্শনময়। 'তুর্' অর্থে 'ক্ষিপ্র', যিনি সবার 'অগ্রে'। এতই 'ক্ষিপ্র' যে 'সব হয়েই আছে'।
"যৎ বৈ চতুর্থং (যা ঐ চতুর্থ) তৎ (তা) তুরীয়ং (তুরীয়)" ----যা চতুর্থ, তাই তুরীয়। যেখানে 'তিনটি বেদ' এক হয়ে গেছে, যাঁর থেকে , ঋক্, যজু; এবং সাম এই বেদত্রয় প্রকাশ পাচ্ছে, তিনি 'চতুর্থ'। এখানে তিনটি বেদ, একটি বেদে বা 'আত্মস্বরূপে'' এক হয়ে গেছে। এখানে তিনটি লোক এক হয়ে গেছে। তাই 'উপনিষদ' বলেছেন , 'ইনি নিজেই নিজের লোক'।
এবং হ এব (এই রকম ভাবেই) শ্রিয়া (শ্রীর দ্বারা) যশসা(যশের দ্বারা) তপতি (তপ্ত করেন) যঃ (যিনি) অস্যা(এনার---এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই) এবং(এই প্রকার) পদং (পদকে) বেদ বিজ্ঞাত হন বা জানেন) ----যিনি এই চতুর্থ পদকে জানেন, তিনি এই গায়ত্রীর মতো সবাইকে শ্রী এবং যশের দ্বারা অভীতপ্ত করেন। চেতনাতে জানা মানেই তাই হওয়া। তাই গায়ত্রীকে যিনি জানেন , গায়ত্রীর যা ধর্ম্ম তা তাঁর মধ্যে প্রকাশ পায়।
শ্রী- গায়ত্রীকে ' আশ্রয় ' করলে বা তাঁতে ' শ্রদ্ধা ' যুক্ত হলে যে গুণ বা বিশিষ্টতা প্রকাশ পায়, তার নাম "শ্রী'।
যশ---য = যমিত বা সংযমিত; শ--শক্তি। শক্তির যে সংযমিত অবস্থা তা যশ। শক্রিময় যিনি বা শক্তি যাঁতে সংযমিত হয়ে আছে তিনি যশস্বী।
এই গায়ত্রীকে যিনি জানেন তিনি তাঁর শ্রী এবং যশের দ্বারা সবাইকে অভিতপ্ত করেন।
৫। ১৪। ৪
সৈষা গায়ত্র্যেতস্মিংস্তুরীয়ে দর্শতে পদে পরোরজসি প্রতিষ্ঠিতা তদ্বৈ তৎসত্যে প্রতিষ্ঠিতং চক্ষুর্বৈ সত্যং চক্ষুর্হি বৈ সত্যং তস্মাদ্যদিদানীং দ্বৌ বিবদমানাবেয়াতামহমদর্শমহমশ্রৌষমিতি য এবং ব্রুয়াদহমদর্শমিতি তস্মা এব শ্রদ্দধ্যাম তদ্বৈ তৎ সত্যং বলে প্রতিষ্ঠিতং প্রাণো বৈ বলং তৎ প্রাণে প্রতিষ্ঠিতং তস্মাদাহুর্বলং সত্যাদোগীয় ইত্যেবংবেষা গায়ত্র্যধ্যাত্মং প্রতিষ্ঠিতা সা হৈষা গয়াংস্তত্রে প্রাণা বৈ গয়াস্তৎ প্রাণাংস্তত্রে তদ্ যদ্ গয়াং স্তত্রে তস্মাদ্ গায়ত্রী নাম স যামেবামূং সাবিত্রীমন্বাহৈষৈব সা স যস্মা অন্বাহ তস্য প্রাণাংস্ত্রায়তে।।
অন্বয়।
সা (সেই) এষা(এই) গায়ত্রী (গায়ত্রী) এতস্মিন্ (এই) তুরীয়ে (তুরীয়) দর্শতে (দর্শনীয়) পদে (পদে) পরো রজসি (রজের পর পারে) প্রতিষ্ঠিতা (প্রতিষ্ঠিত)। তৎ বৈ (তাহাই) তৎ(সেই) সত্যে (সত্যে) প্রতিষ্ঠিতম্ (প্রতিষ্ঠিত) । চক্ষু: বৈ (চক্ষুই) সত্যম্ (সত্য); চক্ষু: হি বৈ (চক্ষু নিশ্চয়ই) সত্যম্ (সত্য) । তস্মাৎ (সেই জন্য) যৎ ইদানীম্ (যখন এখনও) দ্বৌ(দুই জন) বিবদমানৌ(যারা বিবাদ করছে) এয়াতাম্ (আগমন করে) --- অহম্ (আমি) অদর্শম্ (দেখেছি), অহম্ (আমি) অশ্রৌষম্ (শুনেছি) ইতি-- যঃ (যে) এবম্ (এই রকম) ব্রুয়াৎ (বলে) অহম্(আমি_ অদর্শম্ (দেখেছি) ইতি তস্মা এব (তার প্রতিই) শ্রদ্ দধ্যাম (শ্রদ্ধাময় হয় বা তাকে বিশ্বাস করে)। তৎ বৈ (সেই যা চক্ষু), তৎ সত্যম্ (সেই সত্য) বলে (বলে) প্রতিষ্ঠিতম্ (প্রতিষ্ঠিত)। প্রাণঃ বৈ (প্রাণই ) বলম্ (বল) , তৎ (সেই সত্য) প্রাণে (প্রাণে) প্রতিষ্ঠিতম্ (প্রতিষ্ঠিত)। তস্মাৎ (সেই জন্য) আহুঃ(বলে) বলম্ (বল) সত্যাৎ (সত্যের থেকে) ওগীয়ঃ (উগ্র / ওজস্-তেজোময়) ইতি। এবম্ উ (এই ভাবেই) এষা (এই) গায়ত্রী(গায়ত্রী) অধ্যাত্মং (অধ্যাত্মে ) প্রতিষ্ঠিতা (প্রতিষ্ঠিত)। সা হ এষা (সেই এই) গয়ান্ (গয়দের) তত্রে (ত্রাণ করেন) । প্রাণা: (প্রাণ সকল বা ইন্দ্রিয় সকল) বৈ (ই) গয়াঃ (গয়) । তৎ (তাই) প্রাণান্ (প্রাণ সকলকে) তত্রে(ত্রাণ করেন) । তৎ (তাই) যৎ (যে) গয়াং (গয়দের) তত্রে (ত্রাণ করেন) , তস্মাদ্ (সেই জন্য) গায়ত্রী (গায়ত্রী) নাম (নাম) । স: (তিনি/ আচার্য) যাম্ (যাকে) এব(এই) অমূম্ (সেই) সাবিত্রীম্ (সাবিত্রী) অনু (অনুসারে) আহ (বলেন), এষা এব (ইনিই, এই গায়ত্রীই) সা (সেই সাবিত্রী)। সঃ (তিনি/ আচার্য) যস্মা (যাকে) অনু(অনুগ্রহ করে) আহ (বলেন) তস্য (তার) প্রাণান্ (প্রাণ সকল) ত্রায়তে (ত্রাণ লাভ করে বা মৃত্যুর থেকে উত্তীর্ণ হয়)।
অর্থ।
সেই এই গায়ত্রী এই তুরীয় দর্শনীয় পদ যা রজের পর পারে বা ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত। তাহাই সেই সত্যে প্রতিষ্ঠিত। চক্ষুই সত্য; চক্ষু নিশ্চয়ই সত্য। সেই জন্য যখন এখনও দুই জন যারা বিবাদ (তর্ক) করছে, (তারা) আগমন করে (বলে) --- আমি দেখেছি, আমি শুনেছি -- যে এই রকম বলে আমি-- দেখেছি তার প্রতিই শ্রদ্ধাময় হয় ( তাকে বিশ্বাস করে)। সেই (সত্য) যা চক্ষু, সেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত। প্রাণই বল , সেই সত্য প্রাণে প্রতিষ্ঠিত। সেই জন্য বলা হয়, বল সত্যের থেকে উগ্র (তেজোময়)। এই ভাবেই এই গায়ত্রী অধ্যাত্মে প্রতিষ্ঠিত)। সেই এই (গায়ত্রী) গয়দের ত্রাণ করেন)। প্রাণ সকল (ইন্দ্রিয় সকল) গয়) । তাই প্রাণ সকলকে ত্রাণ করেন । তাই যে গয়দের ত্রাণ করেন , সেই জন্য গায়ত্রী নাম । তিনি (আচার্য) (যাকে) এই সেই সাবিত্রী অনুসারে (সাবিত্রীকে অনুসরণ করে) বলেন (উপদেশ দেন) ), ইনিই (এই গায়ত্রীই) সেই সাবিত্রী। তিনি (আচার্য) যাকে) অনুগ্রহ করে বলেন তার) প্রাণসকল ত্রাণ লাভ করে বা মৃত্যুর থেকে উত্তীর্ণ হয়)।
নিরুক্ত।
চক্ষু এবং সত্য---- আত্মস্বরূপ চেতনার যে কেন্দ্র থেকে বা যে জ্ঞান বা বোধক্রিয়া থেকে নামরূপময় বিশ্ব বা নির্দিষ্ট সংজ্ঞাময় এবং আকার আয়তনময় জগৎ প্রকাশ পায়, তার নাম 'চক্ষু'। বাইরের আকাশের সূর্য, চেতনার ঐ চক্ষুরই একটি প্রকাশ বা কেন্দ্র। যা কিছু এই চেতনার দৃষ্টির থেকে প্রকাশ পেয়েছে, আর যা কিছু আমাদের চক্ষুতে প্রতিভাত হচ্ছে তা 'সত্য'। তাই চক্ষুই সত্য।
(ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি আমার সত্যরূপ প্রথম করেছ সৃষ্টি-----শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর----<https://www.youtube.com/watch?v=vAAnq3xg7Bg> )
তৎ এতৎ অমৃতম্ সত্ত্যেন চ্ছন্নং। (সেই এই অমৃত সত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন। )
প্রাণো বা অমৃতং। (প্রাণই অমৃত।)
নামরূপে সত্যং। (নাম ও রূপ সত্য।)
তাভ্যাময়ং প্রাণশ্ছন্ন:। (তাদের দ্বারা ---নাম ও রূপের দ্বারা, প্রাণ আচ্ছাদিত।)
নাম রূপময় যা কিছু তা সত্য, আর সেই নামরূপময় সৃষ্টির আবরণে প্রাণ আচ্ছাদিত। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ---১। ৬। ৩।)
চক্ষু এবং শ্রদ্ধা----যাঁকে আশ্রয় করা যায় তাঁর প্রতি আমরা 'শ্রদ্ধাময়' হই। এই পরম চেতনাই স্থূল হয়ে, নামরূপময় বিশ্ব হয়ে , আমাদের আশ্রয় হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
চক্ষু, সত্য এবং বল।
চেতনা যে শক্তি বা আত্মমহিমার দ্বারা নিজেকে নামরূপময় করে প্রকাশ করেছেন, তার নাম 'বল'।
আত্মস্বরপ চেতনা, জ্ঞান বা বোধক্রিয়ার দ্বারাই নিজেকে দ্বিতীয় করে, নাম রূপময় করে প্রকাশ করেন। এর নাম সৃষ্টি এবং ইহাই সত্য। এতে দুইটি ক্রিয়া আছে--- একটি হওয়া (বল) আর একটি যা হলেন সেইটিকে তদাকারে বোধ বা অনুভব করছেন বা জানছেন , এইটি 'জানা'। উপনিষদে এই 'জ্ঞান এবং বল ক্রিয়ার' কথা বলা হয়েছে। এই জন্য সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত।
প্রাণ ও বল।
আত্মস্বরূপ চেতনা একদিকে শান্ত , নিষ্ক্রিয়, স্থির এবং অন্যদিকে সক্রিয়, নিয়ন্ত্রণময়। এই সক্রিয়, নিয়ন্ত্রণময় চেতনাই 'প্রাণ'। তাই 'বল' , প্রাণে প্রতি'ষ্ঠিত।
বল, সত্য, উগ্র----বলের দ্বারাই সত্য প্রকাশিত। তাই সত্যের যে তেজ তা বলেরই তেজ। তাই বল সত্যের থেকে তেজোময় বা উগ্র।
গায়ত্রী এবং গয়।
যাদের দ্বারা আমরা গতাগতি করি, আমরা সক্রিয়, তারা 'গয়'। গয় অর্থে ইন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয়দের দ্বারাই আমরা সক্রিয়, অনুভূতিময়। কিন্তু এখন আমাদের দর্শন , শ্রবণ, স্পর্শ ইত্যাদি সীমিত এবং ক্ষয়শীল। এই 'গয়' দের ত্রাণ করে যিনি এদেরকে ক্ষয় বা মৃত্যুর পরপারে নিয়ে যান এবং সীমিত ইন্দ্রিয়শক্তিকে অসীম করে দেন, তিনি গায়ত্রী।
গয়, গো (গরু),গম্ (গমন করা) এই শ'ব্দ সকল সম্বন্ধযুক্ত। উপনিষদ বা বেদে যে 'গো' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে, তার প্রকৃত অর্থ 'ইন্দ্রিয়" বা 'প্রাণ শক্তি'। গো এবং অশ্ব এই দুই শব্দের দ্বারা বেদে (উপনিষদে) ইন্দ্রিয় এবং প্রাণগতি কে অভিহিত করা হয়েছে।
গয়দের ত্রাণ করা অর্থে, আমরা মৃত্যুর থেকে মাহাপ্রাণে , মৃত্যুহীন প্রাণে স্থিত হই।
তাই যিনি ইন্দ্রিয়দের অর্থাৎ আমাদের, মৃত্যুর পরপারে নিয়ে যান, বেদে বা উপনিষদে তাঁকে মুখ্যপ্রাণ বা দুর্গা বলে বন্দনা করা হয়েছে। মৃত্যুর পরপারে গিয়ে যা ছিল অদৃষ্ট তা দৃষ্ট হয়, যা ছিল অশ্রুত তা শ্রুত হয়, যা অবিজ্ঞাত তা জ্ঞাত হয় এবং এই ভাবে সমস্ত শক্তি অনন্ত হয়ে যায়।
গায়ত্রী এবং সাবিত্রী।
যিনি গয়দের, ইন্দ্রিয়দের বা প্রতি সত্তাকে মৃত্যুর পরপারে এবং সীমার থেকে অসীমে নিয়ে যান, তিনি গায়ত্রী।
এই গায়ত্রীই সাবিত্রী। সাবিত্রী অর্থে যিনি আমাদের সবনের উপর অধিষ্ঠাত্রী। সবন = সু (প্রবাহ) + অন্ (প্রাণ)--প্রাণ প্রবাহ বা জীবন। আদ্য, মধ্য এবং অন্ত, এই তিনটি প্রধান ভাগে আমাদের জীবন বিভক্ত। এই তিনটি সবনের উপর যিনি অধিষ্ঠান করছেন, তিনি সাবিত্রী, সবনত্রয়ের অধিষ্ঠাত্রী।
তাই আচার্য যে সাবিত্রীর উপদেশ দেন, সেই উপদেশের দ্বারা উপদিষ্টের প্রাণ সকল বা ইন্দ্রিয় সকল বা উপদিষ্ট মৃত্যুর থেকে ত্রাণ পান।
৫। ১৪। ৫
তাং হৈতামেকে সাবিত্রীমনুষ্টুভমন্বাহুর্বাগনুষ্টুবেতদ্বাচমনুব্রুম ইতি ন তথা কুর্যাদ্ গায়ত্রীমেব সাবিত্রীমনুব্রুয়াদ্যদি হ বা অপ্যেবংবিদ্বহ্বিব প্রতিগৃহ্ণাতি ন হৈব তদ্গায়ত্র্যা একং চ ন পদং প্রতি।
অন্বয়।
তাম্ হ এতাম্ (সেই এঁকে বা সাবিত্রীকে) একে (কেহ কেহ) সাবিত্রীম্ অনুষ্টুভম্ (সাবিত্রী অনুষ্টুপ্) অনু(অনুসারে) আহ (বলেন; উপদেশ দেন)। বাক্ (বাক্ ই ) অনুষ্টুপ্ (অনুষ্টুপ্) ; এতৎ (এই) বাচম্ (বাক্ এরই) অনুব্রুমঃ (উপদেশ দিই) ইতি। ন (না) তথা (এরকম) কুর্যাৎ (কোরো)। গায়ত্রীম্ এব (গায়ত্রীকেই) সাবিত্রীম্ (সাবিত্রীরূপে) অনুব্রুয়াৎ (উপদেশ দিও)। যদি হ বা অপি (যদি এইরকমও হয়) এবম্ (এই) বিৎ(বিজ্ঞাতা) বহু ইব (বহু) প্রতিগৃহ্ণাতি (প্রতিগ্রহণ করেন) ন হ এব (তাহা অবশ্যই হয় না) তৎ (সেই) গায়ত্র্যাঃ (গায়ত্রীর) একম্ চন পদং (একটি পদেরও) প্রতি (সমান) ।
অর্থ।
সেই এঁকে বা সাবিত্রীকে কেহ কেহ 'সাবিত্রী অনুষ্টুপ্' অনুসারে উপদেশ দেন। "বাক্ ই অনুষ্টুপ্- এই বাক্, এঁরই উপদেশ দিই "। এরকম কোরো না। গায়ত্রীকেই সাবিত্রীরূপে উপদেশ দিও। যদি এইরকমও হয় যে এই বিজ্ঞাতা (যিনি গায়ত্রীকে জানেন) বহু প্রতিগ্রহণ করেন, তাহা (সেই ধন বা বিভূতি) অবশ্যই সেই গায়ত্রীর একটি পদেরও সমান হয় না।
নিরুক্ত।
অনুষ্টুপ্ (অনুষ্টুভ্)---অনুভূতির যে ছন্দ তা অনুষ্টুপ্। এই চেতনাই বিশ্বভুবন হয়েছেন। নিজেকে নিজে বিশ্বের আকারে প্রকাশ করেছেন। ইনি যা বোধ করেন বা জানেন, তাই হন। এর নাম সম্ভূতি।আর এই সম্ভূতি থেকে যে বিশ্ব প্রকাশ পেয়েছে, সেই সম্ভূতি অনুসারে আমরা তাকে (বিশ্বকে) বোধ করছি বা অনুভব করছি; এইটি অনুভূতি। মহা চেতনার বোধক্রিয়া স্থূল, মূর্ত্ত বিশ্ব হয়েছে। আমাদের চেতনা বা অনুভূতিগুলি আমাদের মন অব্দিই থাকে, তার বাইরে আলাদা একটা সত্তা হয়ে প্রকাশ পায় না। বাইরে, বাহিরাকাশে, এই চেতনা ফুল হয়েছেন; চেতনার 'ফুল' জ্ঞান থেকে ফুলটি হয়েছে।এইটি সম্ভূতি। আর সেই 'ফুল' থেকে বা তদনুসারে, আমার অন্তরে ফুলের বোধ ফুটছে, এইটি অনুভূতি। এই অনুভূতি হওয়ার যে ধারা বা ছন্দ তা 'অনুষ্টুপ্'। আর এই যে চেতনা দুনিয়া সেজেছেন, সেই সাজার যে ছন্দ তার নাম 'জগতী'। উপনিষদে অনুভূতিকে 'বিনাশ' বলা হয়েছ, যেহেতু আমাদের অনুভূতিগুলি ক্ষণস্থায়ী।
বাক্ ই অনুষ্টুপ্-- যা কিছু আমরা বোধ বা অনুভব করি, তা আমাদের মধ্যে একটি শব্দ বা বাক্য রচনা করে। চেতনার আয়তন বা মূর্ত্তিই 'বাক্য'। সবকিছুই 'শব্দাত্মক'। এই স্থূল বিশ্ব চেতনারই বাঙময় প্রকাশ। আত্মশক্তি স্বয়ংপ্রকাশ এবং এঁর নাম 'বাক্'। ইনি যখন মূর্ত্ত হন , তার নাম 'বাক্য' আর তাতে যে প্রাণ বা বেদনের ধারা প্রকাশ পায় তাই ঋক্, যজুঃ আর সাম। ইনি নিজেকে দ্বিতীয় করে যা কিছু প্রকাশ করেন, তাকে আবার নিজেতেই ফিরিয়ে নেন, এর নাম 'গয় দের ত্রাণ করা' আর তাই এঁর নাম গায়ত্রী। (ছান্দোগ্য উপনিষদে গায়ত্রী কে 'বাক্' বলা হয়েছে (ছান্দোগ্য উপনিষদ তৃতীয় অধ্যায়, দ্বাদশ খণ্ড---(<https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_19.html> )
এই চিৎ শক্তি বাক্ বাইরে সম্ভূতির আকারে নিজেকে প্রকাশ করে, আমাদের অন্তরে অনুভূতির আকারে প্রকাশ পাচ্ছেন এবং আমাদের চেতায়িত করে রেখেছেন। তাই বাক্ 'অনুষ্টুপ্'।
বাক্ (বাক্ ই ) অনুষ্টুপ্ (অনুষ্টুপ্) ; এতৎ (এই) বাচম্ (বাক্ এরই) অনুব্রুমঃ (উপদেশ দিই) ইতি। ন (না) তথা (এরকম) কুর্যাৎ (কোরো)। গায়ত্রীম্ এব (গায়ত্রীকেই) সাবিত্রীম্ (সাবিত্রীরূপে) অনুব্রুয়াৎ (উপদেশ দিও)----চেতনা শুধু অনুভূতির আকারে নিজেতে প্রকাশ পাচ্ছেন, মাত্র এইটুকু জানলে হবে না। ইনি নিয়ন্ত্রিণী বা ঈশ্বর এবং এই ঈশিত্বের দ্বারা ইনি আমাদের মৃত্যুর পরপারে নিয়ে গিয়ে অমৃত এবং অসীম করছেন। তাই সাবিত্রীকে গায়ত্রীরূপে উপদেশ দিতে বলা হল। প্রতি অনুভূতিতে ইনি আমাদের পরিবর্ত্তন করে আমাদের অভ্যূদয় সাধন করছেন, 'গয় দের ত্রাণ করছেন'।
মাত্র বিনাশ বা অনুভূতি অবলম্বনে আত্মার বা নিজের অবিনশ্বরতা জানা যায়। যতক্ষণ সম্ভূতিকে না জানা হয়, ততক্ষণ জগৎ বা দুনিয়াটা, নিজের থেকে আলাদা হয়েই থাকে। এক আত্মা যে সবার আত্মা এটা জানা হয় না। এই জন্য বলা হল, 'মাত্র অনুষ্টুপ্ বাকের উপদেশ দিও না। এই জন্য ঈষোপোনিষদে বলা হয়েছে--
"সম্ভূতিঞ্চ বিনাশঞ্চ যস্তদ্বেদো ভয়ং সহ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা সম্ভূত্যাঃ অমৃত্মনশ্নুতে।। (ঈষোপোনিষদ ১৪শ মন্ত্র।)
সম্ভূতি এবং বিনাশ (অনুভূতি) এই দুইকে যিনি একত্রে জানেন, তিনি বিনাশ বা অনুভূতির দ্বারা মৃত্যুর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে , সম্ভূতির দ্বারা অমৃত লাভ করেন।
অমৃত লাভ করার অর্থই দেবময় বিশ্ব বা আত্মার আনন্ত্যকে জানা। এর নাম সম্ভূতিকে জানা এবং আত্মাই যে ঈশ্বর তা বিদিত হওয়া। স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার প্রকাশ, যে সব ক্ষেত্র বা ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়ে বিশ্ব ভূবনকে পরিচালনা করছে বা নিয়ন্ত্রণ করছে, তা দেবলোক বা তাঁরা দেবতারা। তাই এই গায়ত্রী দেবমাতা এবং বেদমাতা। তাই বলা হল, শুধু অনুষ্টুপ্ ছন্দে বাক্ রূপ সাবিত্রীকে উপদেশ দিও না; গায়ত্রীই সাবিত্রী--এই উপদেশ দিও।
৫। ১৪। ৬
স য ইমাংস্ত্রীল্লোঁকান্ পূর্ণান্ প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ সঃ অস্যা এতৎ প্রথমং পদমাপ্নুয়াদথ যাবতীয়ং ত্রয়ী বিদ্যা যস্তাবৎ প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ সঃ অস্যা এতদ্ দ্বিতীয়ং পদমাপ্নুয়াদথ যাবদিদং প্রাণি যস্তাবং প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ সঃ অস্যা এতৎ তৃতীয়ং পদমাপ্নুয়াদথাস্যা এতদেব তুরীয়ং দর্শতং পদং পরোরজা য এষ তপতি নৈব কেনচনাপ্যং কুত উ এতাবৎ প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ ।।
অন্বয়।
স (কেহ) যঃ(যদি) ইমাম্ (এই) ত্রীন্ (তিন) লোকান্ (লোককে) পূর্ণান্ (পূর্ণতায়) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রতিগ্রহণ করেন) সঃ (তা) অস্যা: (এনার) এতৎ (এই) প্রথমম্ পদম্ (প্রথম পদকে) আপ্নুয়াৎ (প্রাপ্ত হন)। অথ (অনন্তর)
যাবতী ইয়ম্ (এই যাবতীয় বা যত পর্যন্ত) ত্রয়ী বিদ্যা (তিন বিদ্যা), যঃ তাবৎ (যদি সেই পর্যন্ত) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রতিগ্রহণ করেন) , সঃ (তা) অস্যা: (এনার) এতৎ (এই) দ্বিতীয়ম্ পদম্ (দ্বিতীয় পদকে) আপ্নুয়াৎ (প্রাপ্ত হন)। অথ (অনন্তর) যাবৎ (যে পর্যন্ত) ইদম্ (এই) প্রাণি (প্রাণময়তা বা প্রাণময় বিশ্ব), যঃ তাবৎ (যদি সেই পর্যন্ত) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রাপ্ত হন)(প্রতিগ্রহণ করেন) , সঃ (তা) অস্যাঃ (এনার) এতৎ (এই) তৃতীয়ম্ পদম্ (তৃতীয় পদকে) আপ্নুয়াৎ (প্রাপ্ত হন) । অথ (আর) অস্যাঃ (এনার) এতৎ এব (এই প্রকার) তুরীয়ম্ (তুরীয়) দর্শতম্ (দর্শনীয়) পদম্ (পদ) পরঃ রজা (রজের ঊর্দ্বে); য: (যে) এষঃ (এ) তপতি (তাপ দিচ্ছেন), ন (না) এব (অবশ্যই) কেনচন (কেহই) আপ্যম্ (আপ্তব্য বা প্রাপ্য)--- কুতঃ উ (কোথা হতেই বা) এতাবৎ (এই পর্যন্ত) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রতিগ্রহণ করবে)?
অর্থ।
কেহ যদি এই তিন লোককে পূর্ণতায় (পরিপূর্ণ ভাবে) প্রতিগ্রহণ করেন তাহলে এনার এই প্রথম পদকে প্রাপ্ত হন। অনন্তর, এই তিন বিদ্যা যত পর্যন্ত, যদি সেই পর্যন্ত প্রতিগ্রহণ করেন, তাহলে এনার এই দ্বিতীয় পদকে প্রাপ্ত হন। অনন্তর যে পর্যন্ত এই প্রাণি (প্রাণময়তা বা প্রাণময় বিশ্ব), যদি সেই পর্যন্ত প্রাপ্ত হন (প্রতিগ্রহণ করেন) , তাহলে এনার এই তৃতীয় পদকে প্রাপ্ত হন । আর এনার এই প্রকার তুরীয় দর্শনীয় পদ রজের ঊর্দ্বে; এই যিনি তাপ দিচ্ছেন ইনি অবশ্যই কারোরই প্রাপ্য নন--- কোথা হতেই বা এই পর্যন্ত প্রতিগ্রহণ করবে (যিনি প্রাপ্তির ঊর্ধ্বে তাঁকে কি ভাবে প্রাপ্ত হবে?)
নিরুক্ত।
চেতনার ধর্ম্মই হল জানা এবং তাই হওয়া। যা জানা হয় বা যে বিষয়ে বোধক্রিয়া হয়, আমরা অন্তরে তাই হয়ে তাই বোধ করি। এই জন্য যে অনুভূতি নিয়ে আমরা কর্ম্ম করি আমাদের পরিণতি সেই অনুসারে হয়। তাই যিনি গায়ত্রীকে জানেন, তিনি গায়ত্রীর সাথে অভিন্ন হয়ে সেই গায়ত্রীর যা মহিমা সেই মহিমা সম্পন্ন হন।
তিন লোক, তিন বিদ্যা, প্রাণত্রয় (প্রাণ, অপান, ব্যান) এঁদের জানলে, সেই চতুর্থ পদ, যার দ্বারা পদবিহীনা গায়ত্রী অদৃষ্ট হয়েও যেন দৃষ্ট (দর্শত) হন, তাঁতে সেই উপাসকের গতি হয়। সেখানে কে কার থেকে কি গ্রহণ করবে, কি প্রাপ্ত হবে?
৫। ১৪। ৭
তস্যা উপস্থানং গায়ত্র্যস্যেকপদী দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদ্যপদসি নহি পদ্যসে। নমস্তে তুরীয়ায় দর্শতায় পদায় পরোরজসেঃ অসাবদো মা প্রাপাদিতি যং দ্বিষ্যাদসাবস্মৈ কামো মা সমৃদ্ধীতি বা ন হৈবাস্মৈ সকামঃ সমৃধ্যতে যস্মা এবমুপতিষ্ঠতেঃ অহমদঃ প্রাপমিতি বা।
অন্বয়।
তস্যাঃ (তাঁর) উপস্থানং(উপস্থান----গায়ত্রীর উপ বা নিকটে স্থিত হলে যে স্তুতি প্রকাশ পায় )---- গায়ত্রি! অসি (গায়ত্রী তুমি হও) একপদী (একপদী), দ্বিপদী (দ্বিপদী), ত্রিপদী ( ত্রিপদী ), চতুষ্পদী (চতুষ্পদী), অপদসি (তোমার কোন পদ নেই, তুমি সকল পদের ঊর্ধ্বে), নহি পদ্যসে (তুমি পদের দ্বারা নির্দিষ্ট হও না, পদবিহীনা)। নমঃ (নমস্কার) তে তুরীয়ায় (তোমার তুরীয়) দর্শতায় (দর্শনীয়) পদায় (পদকে) পরঃ রজসেঃ (যা পরোরজা বা রজের ঊর্দ্বে; নিরঞ্জন।
অসৌ (ঐ / ও ) অদঃ (তাকে--সেই কাম্যকে) মা (না) প্রাপৎ (প্রাপ্ত হয়) ইতি যম্ (যাকে) দ্বিষ্যাৎ (দ্বেষ করেন); অসৌ এব (ঐ সে) অস্মৈ কাম: (এই কাম্য) মা (না) সমৃদ্ধী (সমৃদ্ধ হয়) ইতি বা --- ন হ এব (অবশ্যই না) অস্মৈ (এই) সঃ (তার) কামঃ (কাম বা কাম্য) সম্ ঋধ্যতে (সম্যক রূপে বর্ধিত হয়) যস্মা (যার / যার প্রতি) এবম্ (এই প্রকার) উপতিষ্ঠতেঃ (উপাসনা করা হয়)। অহম্ (আমি) অদঃ (উহা) প্রাপম্ (প্রাপ্ত হই) ইতি বা।
অর্থ।
তার উপস্থান----গায়ত্রীর উপ বা নিকটে স্থিত হলে যে স্তুতি প্রকাশ পায় ---- গায়ত্রী তুমি একপদী, দ্বিপদী, ত্রিপদী, চতুষ্পদী,অপদসি (তোমার কোন পদ নেই, তুমি সকল পদের ঊর্ধ্বে); পদের দ্বারা নির্দিষ্ট হও না--- পদবিহীনা। (তুমি পদের অর্থ হয়ে বা পদার্থ হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেও, অপ্রকাশই থাকো। নমস্কার তোমার দর্শনীয় পদকে যা পরোরজা বা রঞ্জনার ঊর্দ্বে।
ঐ ব্যক্তি বা জীব সেই কাম্যকে প্রাপ্ত হয় না যাকে ইনি (দেবী গায়ত্রী বা গায়ত্রীকে যিনি জানেন) দ্বেষ করেন (দ্বিতীয় জ্ঞানের দ্বারা বিদ্ধ করে রাখেন); ঐ সে, এই কাম্যকে প্রাপ্ত হয় না, যাকে ইনি দ্বেষ করেন(দ্বিতীয় জ্ঞানের দ্বারা বিদ্ধ করে রাখেন ---- অবশ্যই এই তার কাম বা কাম্য সমৃদ্ধ হয় না যার প্রতি এই প্রকার উপাসনা করা হয় (বা এই রকম উপস্থাপনা করা হয়। আমি উহা প্রাপ্ত হই।
নিরুক্ত।
একপদী-- যাঁর একটিই পদ, বা যিনি সবার আত্মা বা এক আত্মস্বরূপ।
দ্বিপদী---যাঁর পদচারণ বা পদক্ষেপ থেকে 'দ্বিতীয়তা' সৃষ্টি হয় বা এক আত্মাই বহু হন।
ত্রিপদী---- যাঁর পদচারণ বা পদক্ষেপ থেকে বাক্ , প্রাণ ও মন এই তিন প্রধান দেবতা বা আত্মস্বরূপের তিন প্রধান ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। এই বাক্, প্রাণ এবং মনের সমাসে সমস্ত সৃষ্টি রচিত। (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ষষ্ঠ অধ্যায়।)
চতুষ্পদী ---বাক্, প্রাণ, মন এবং নিজের আত্মত্ব দিয়ে বা নিজেকে দিয়েই ইনি সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। প্রতি জীবে , প্রতি সৃষ্টিতে ইনি নিজেই সেই সৃষ্টি হয়েছেন এবং তাতে ইনি নিজেই বাঙ্ময়, প্রাণময়, মনোময়।
অপদসি--তুমি (গায়ত্রী) অপদী বা পদ বিহীনা----ইনি সব হয়েও কিছু হননি, যেমন তেমনই আছেন, তাই ইনি পদবিহীনা, তাই ইনি অনন্ত।
এই গায়ত্রীবিৎ সকল কিছু প্রাপ্ত হন; ইনি আপ্তকাম। নিজের বাহিরে,আত্মবহির্ভূত কিছু আর থাকে না।
ইনি যদি কারোর কাম্যের বিরোধিতা করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি কাম্যকে পায় না বা তা সমৃদ্ধ হয় না। ইনি যদি কাউকে কাম্য প্রাপ্ত করাতে চান , তবে সে অবশ্যই কাম্যকে লাভ করে। আত্মার যে ঈশিত্ব তা এই গায়ত্রীবিদের মধ্যে প্রকাশ পায়। এই জন্য মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে, কেউ যদি 'ভূতিকাম হও বা সম্পদ অভিলাষী হও , তাহলে যিনি আত্মজ্ঞ, তাঁর উপাসনা কোরো।
যতক্ষণ আমরা দ্বিতীয় জ্ঞানের বা দ্বিতীয়তার অধিকারে থাকি (দ্বেষ বা দ্বিতীয়তার দ্বারা বিদ্ধ হয়ে থাকি), ততক্ষণ আমাদের কাম সমৃদ্ধ হয় না। এই দেবক্ষেত্র, যা পরম আত্মশ্বরূপের প্রকাশময় ব্যক্তিত্ব তা আলাদা হয়ে থাকে।
আত্মজ্ঞান (আত্মার অবিনশ্বরত্ব) এবং আত্মার যে আনন্ত্য বা দেবময়তা এবং ঈশিত্ব, এই দুই (অনুভূতি এবং সম্ভূতি) জ্ঞানের দ্বারা বিজ্ঞাতা আপ্তকাম হন, তাঁর প্রাপ্তির আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
৫.১৪.৮।
এতদ্ধ বৈ তজ্জনকো বৈদেহো বুড়িলমাশ্বতরাশ্বিমুবাচ যন্নু হো তদ্গায়ত্রীবিদব্রুথা অথ কথং হস্তীভূতো বহসীতি মুখং হ্যস্যাঃ সম্রাণ্ ন বিদাংচকারোতি হোবাচ তস্যা অগ্নিরেব মুখং যদি হ
বা অপি বহ্বিবাগ্নাবভ্যাদধতি সর্ব্বমেব তৎ সংদহত্যেবং হৈবৈবংবিদ্যদ্যপি বহ্বিব পাপং কুরুতে সর্ব্বমেব তৎ সংপ্সায় শুদ্ধঃ পূতঃ অজরঃ অমৃতঃ সংভবতি।
অন্বয়।
এতৎ হ বৈ তৎ (ইহাই তা), জ্নকঃ বৈদেহঃ (বৈদেহ জনক) বুড়িলম্ আশ্বতরাশ্বিম্ (বুড়িল আশ্বতরাশ্বিকে) উবাচ (বলেছিলেন) --- যৎ নু হো তৎ (তুমি যে সেই) গায়ত্রীবিৎ (গায়ত্রীবিৎ) অব্রুথাঃ ( বলেছিলে ), অথ(তাহলে) কথম্ (কেন) হস্তীভূতঃ (হস্তী হয়ে) বহসি (বহন করছ) ? ইতি মুখম্ (মুখ)) হি অস্যাঃ(এনার) সম্রাণ্ (সম্রাট) ন(না) বিদাঞ্চকার (বিদিত হয়েছি) ইতি হ উবাচ (বললেন)। তস্যাঃ (তাঁর) অগ্নিঃ এব (অগ্নিই) মুখম্ (মুখ)। যদি হ
বা অপি(যদি বা) বহু ইব (বহু) অগ্নৌ (অগ্নিতে) অভি (অভিমুখে) আ দধতি (ধারণ করেন বা অগ্নিতে আহুতি দেন) সর্ব্বম্ এব তৎ (সে সবকেই) সম্দহতি ( সম্যক ভাবে দহন করেন); এবম্ হ এব (এই রকমই) এবম্ বিৎ (এই প্রকার বিজ্ঞাতা) যদি অপি বহু ইব(যদি বহু) পাপম্ (পাপ) কুরুতে (করেন) সর্ব্বম্ এব তৎ (সেই সব পাপ) সংপ্সায়(সম্যক রূপে অপসরণ করে বা বিনাশ করে) শুদ্ধঃ (শুদ্ধ) পূতঃ (পবিত্র) অজরঃ((অজর বা জরা বিহীন) অমৃতঃ (অমৃত) সম্ভবতি (হন) ।
অর্থ।
ইহাই তা যা বৈদেহ জনক বুড়িল আশ্বতরাশ্বিকে বলেছিলেন --- "তুমি যে (নিজেকে) গায়ত্রীবিৎ বলেছিলে, তাহলে কেন হস্তী হয়ে বহন করছ) ?"
"সম্রাট! এনার মুখকে বিদিত হই নি (জানতে পারিনি)"--- ইহাই (বুড়িল আশ্বতরাশ্বি ) বললেন।
(জনক বললেন)-- "অগ্নিই তাঁর মুখ--- যদি বা বহু (আহুতি) অগ্নিতে, (অগ্নির) অভিমুখে (কেহ) ধারণ করেন (বা অগ্নিতে আহুতি দেন), সে সবকেই সম্যক ভাবে (অগ্নি) দহন করেন; এই রকমই এই প্রকার বিজ্ঞাতা যদি বহু পাপ করেন, সেই সব পাপকে সম্যক রূপে অপসরণ করে (বিনাশ করে) শুদ্ধ, পবিত্র, অজর ( জরা বিহীন) অমৃত হন।
নিরুক্ত।
বৈদেহ জনক----বিদেহ= বি (দেহ বিহীন) জনক (জন্মদাতা)-----বাক্ বা চেতনার থেকে সব কিছু জাত হচ্ছে এবং সকল কিছু চেতনারই আয়তন, আকার--- এই জ্ঞানসম্পন্ন যিনি।
বুড়িল----বুড়িল শব্দটি বুড্ শব্দ থেকে হয়েছে। সংস্কৃত 'বুড্' শব্দ এবং ইংরাজি (English) 'bud' (বাড্) শব্দের অর্থ একই । এর অর্থ 'কলি' বা 'যা সবে ফুটে উঠছে বা ওঠার মত হয়েছে'।
'আশ্বতরাশ্বি'---আশ্ব অর্থে যা 'প্রাণ' বা 'অশ্ব' থেকে উৎপন্ন বা যা প্রাণ বা অশ্বের সাথে যুক্ত।
'অশ্ব' অর্থে যিনি 'শ্ব' বা কালের আকারে প্রকাশ পাচ্ছেন। প্রাণের গতিই কাল, যার দ্বারা আমরা শৈশব, বাল্য,কৈশোর ইত্যাদি অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছি। এই প্রাণ বা কালের দ্বারাই দিবা রাত্রি ইত্যাদি হচ্ছে।প্রাণই সবাইকে বহন করে নিয়ে চলেছেন এবং এর নাম 'অভ্যুদয়'। বেদে ইহা 'বিষ্ণুর সংক্রমণ'। এই গতি এবং বাহক বা বহনের ধর্ম্ম যে পশুর মধ্যে প্রকট তার নামও 'অশ্ব'।
সুতরাং 'বুডিল / বুড়িল আশ্বতরাশ্বি' নামের অর্থ এইকম ---যিনি মহাপ্রাণ (বা অশ্বকে) অবলম্বন করে অভ্যুদয়ের পথে চলা শুরু করেছেন।
"তুমি যে (নিজেকে) গায়ত্রীবিৎ বলেছিলে, তাহলে কেন হস্তী হয়ে বহন করছ ?"----এর অর্থ " গায়ত্রীর উপাসক হয়েও তুমি কেন হস্তীর মত হয়েছ? যা স্থূল, যা মর্ত্ত বা যা শরীর তার অধীন হয়ে রয়েছ কেন?"
যিনি বৈদেহ জনক অর্থাৎ যিনি দেহ বা শরীরে ঊর্দ্বে যে প্রাণ, যিনি মুখ্য প্রাণ এবং সবার জনক, সেই প্রাণকে জানতেন, তিনি বুড়িল আশ্বতরাশ্বি, যিনি মর্ত্ত বা শরীরের অধীন হয়েও নিজেকে 'গায়ত্রীবিৎ' বলেছিলেন, তাঁকে ঐ প্রশ্ন করেছিলেন।
"সম্রাট! এনার মুখকে বিদিত হই নি (জানতে পারিনি)"--- ইহাই (বুড়িল আশ্বতরাশ্বি ) বললেন।
(জনক বললেন)-- "অগ্নিই তাঁর মুখ ---------অগ্নিই গায়ত্রীর মুখ। সমস্ত প্রাণ(পঞ্চ প্রাণ) এবং ইন্দ্রিয়রা যেখানে প্রতিষ্ঠিত তার নাম মুখ। ইনি মুখ্য প্রাণ (প্রাণাগ্নি) এবং উপনিষদ (ছান্দোগ্য ১। ২। ১২।) এঁকে 'আয়াস্য প্রাণ' বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন ইনি 'আয়াস্য' যেহেতু 'আস্যাৎ যৎ অয়তে', অর্থাৎ যেহেতু ইনি আস্য বা মুখের থেকে 'অয়' বা গতিময় হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন। প্রতি কথা, প্রতি বাক্য এই চেতনারই আয়তন, এই মহাপ্রাণই ছোট হয়ে, আমাদের মুখের কথা হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন; একান্ত অনুগত হয়ে, কণা বা ক্ষুদ্র হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন। এই জন্য এঁর নাম 'কন্যা'----যিনি দীপ্ত এবং কণায় কণায় প্রকাশ পাচ্ছেন।
এই নিজেকে কণায় কণায়, খণ্ড খণ্ড করে প্রকাশ করার যে শক্তি তার নাম 'বাক্' আর যা প্রকাশ পায় তার নাম 'বাক্য'। এই বিশ্ব ভুবন, এই দুনিয়া, এই মহাপ্রাণের বাক্যরাশি।
বাক্ই অগ্নি। উপনিষদে বাক্ই অগ্নি এ কথা বার বার বলা হয়েছে। আবার বালা হয়েছে, বাক্ আর প্রাণের মিথুনে সবাই জাত। প্রাণ মানেই অগ্নি, যিনি প্রকাশময়, উষ্ম, সবাইকে অগ্রে নিয়ে (নী--নি) চলেন।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, " তস্যৈ বাচঃ পৃথিবী শরীরং জ্যোতীরূপম্ অয়ম্ অগ্নিঃ। তৎ যাবতী এব বাক্, তাবতী পৃথিবী, তাবান্ অয়ম্ অগ্নিঃ"---- সেই বাকের শরীর হল পৃথিবী (বা যা কিছু মূর্ত্ত), আর জ্যোতীরূপ (আয়তন ব মূর্ত্তি প্রকাশময় যে স্বরূপ) তা এই অগ্নি। তাই যত পর্যন্ত এই বাক্, তত পর্যন্ত এই পৃথিবী(বা মর্ত্ত) এবং তত পর্যন্তই এই অগ্নি।
এই চেতনাই মূর্ত্ত হয়েছেন, সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম থেকে একেবারে পৃথিবী হয়েছেন, শরীর হয়েছেন, যা কিছু মূর্ত্ত তাই হয়েছেন, স্থূল হয়েছেন। এই জ্ঞান যাঁর লব্ধ হয়েছে তিনি গায়ত্রীর যে মুখ, যা বাক্, যিনি অগ্নি, যিনি পৃথিবী তাকে জেনে বৈদেহ জনক হয়েছিলেন। তাই এই বাক্ এঁর কন্যা, বিদেহ নগরের রাজকন্যা যিনি বৈদেহী সীতা।
------------------------------------------------------------------------------
বাংলায় অন্যান্য কয়েকটি উপনিষদ নিম্ন লিখিত সূত্র বা লিঙ্কে (web link) পাওয়া যাবে :
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_19.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_23.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_24.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_2.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_64.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_64.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_39.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_20.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_3.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/brihadaranyaka-upanishad-in-bengali.html
(Brihadaranyaka Upanishad in Bengali--Chapter on Gayatri)
(মহর্ষি বিজয়কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৫-১৯৪৫) এবং তাঁর প্রধান শিষ্য মহর্ষি ত্রিদিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯২৩-১৯৯৪) উপদেশ অনুসরণ করে এই উপনিষদের অর্থ এবং নিরুক্ত লিখিত হল।----দেবকুমার লাহিড়ী--debkumar.lahiri@gmail.com)
৫। ১৪। ১
ভূমিরন্তরিক্ষং দ্যৌরিত্যষ্টাবক্ষরাণ্যষ্টাক্ষরং হ বা একং গায়ত্র্যৈ পদমেতদুহৈবাস্যা এতৎ স যাবদেষু ত্রিষু লোকেষু তাবদ্ধ জয়তি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদ।
অন্বয়।
ভূমি (ভূমি) অন্তরিক্ষং (অন্তরীক্ষ) দ্যৌঃ (দ্যৌ / দ্যু) ইতি (এই তিনটি) অষ্টৌ (অষ্ট) অক্ষরাণি (অক্ষর)। অষ্ট (অষ্ট) অক্ষরম্ (অক্ষর) বা (ই) একং(একটি) গায়ত্রৈ (গায়ত্রীর) পদম্ (পদ)। এতৎ (এই--এই এক পদ)) উ হ এব অস্যা: (এনার- এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই- এই তিন লোক) ।
সঃ (সে- যিনি এইটি জানেন) যাবৎ (যে পর্যন্ত) এষু (এই) ত্রিষু (তিন) লোকেষু (লোকে), তাবৎ (সেই পর্যন্ত) হ জয়তি (অবশ্যই জয় করেন), যঃ (যিনি) অস্যা (এনার) এতৎ (এই) এবম্ (এই প্রকার) পদম্ (পদকে) বেদ (জানেন)।
অর্থ।
ভূমি, অন্তরীক্ষ, দ্যৌ এই তিনটি অষ্ট অক্ষর। এই অষ্ট অক্ষরই একটি গায়ত্রীর পদ। এই--এই এক পদ গায়ত্রীর এই- এই তিন লোক।
সে- (যিনি এইটি জানেন), যে পর্যন্ত এই তিন লোকে যা কিছু আছে সেই পর্যন্ত ( সকল কিছু )অবশ্যই জয় করেন যিনি এনার এই প্রকার পদকে জানেন।
নিরুক্ত।
ভূমি--ভূ -- সৃষ্টি হওয়া, অস্তিত্বময় হওয়া; মি--মিতি---মাপ।
ভূমি--যেখানে সকল কিছু সৃষ্ট হয় পরিমাপ যোগ্য হয়ে; ভূমি হল সেই লোক যেখানে সকল কিছুকে মাপা যায়, সকল কিছু পরিমিত বা সীমিত। সুতরাং এখানে একটি অস্তিত্ব অন্যটির থেকে আলাদা, প্রত্যেকে সীমিত। এই জন্য ভূমির অন্য নাম পৃথিবী অর্থাৎ যেখানে সবাই পৃথক পৃথক স্থিতি নিয়ে বর্ত্তমান।
অন্তরীক্ষ--- অন্ত (অন্তর) +ঈক্ষ (দর্শন , অনুভূতি)।
অন্তরীক্ষ---যেখানে সকল কিছু নিজের অন্তরে দৃষ্ট বা অনুভূত হয়। এখানে সকল কিছু নিজের সাথে যুক্ত বলে অনুভূত হয়। ভূমিতে যা পৃথক পৃথক ভাবে অনুভূত হয় , এখানে তা নিজেতে যুক্ত বলে বিজ্ঞাত হয়।
দ্যৌ-- যা দ্যুতিমান বা নিজেই নিজেকে এবং সকল কিছুকে প্রকাশ করে।
অন্তরীক্ষে নিজের ভিতরে অনুভূত হলেও, ভোক্তা (যে অনুভব করছে) এবং ভোগ্য (যাকে অনুভব করছে) আলাদা। দ্যুলোকে নিজেই নিজেকে ভোগ করছে। শব্দ, স্পর্শ ইত্যাদি সেখানে নিজেরই প্রকাশ।
দোহন অর্থাৎ নিজেকে দোহন করে ইনি (স্বয়ং প্রকাশ চেতনা) সবাইকে প্রকাশ করেছেন বলে ইনি দ্যু, দিব্, দ্যৌ।
বেদ এঁকে দোগ্ধ্রী বলে অভিহিত করয়েছেন। ইনি বাক্ এবং বেদ এঁর চারটি স্তনের কথা উল্লেখ করয়েছেন যার দ্বারা ইনি দেবগণ, পিতৃগণ এবং মনুষ্যগণকে পালন করেন।
অষ্ট---উপনিষদে বাক্কে অষ্টমী বলা হয়েছে। সকল কিছু চেতনা বা বাকের আয়তন বা 'বাক্য'। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)। সকল কিছু এঁর কথা, মনন বা মন্ত্র থেক সৃষ্ট হয়েছে।
বাক্কে ছান্দোগ্য উপনিষদে 'বৃহতী' বলা হয়েছে; যিনি বৃহৎ হচ্ছেন বা নিজেকে বর্দ্ধন করছেন।
সব কিছু এই মহা চৈতন্যে সমূহিত হয়ে রয়েছে, এইটি সপ্ত সংখ্যা বা চেতনার সপ্ত নামক সংখ্যাতি।সব কিছু যা নানা দিকে, নানা দেশে স্থিত, তাদের সবাইকে এই নিজেতে বা আত্মস্বরূপ চেতনায় পাওয়া গেল। এইটি চেতনার সপ্তমী নামক মহিমা বা তিথি।
আর সব কিছুর আকারে চেতনা নিজেকে বর্দ্ধন করেছেন, সব কিছুতে একই আত্মস্বরূপ চেতনা, এইটি 'অষ্টম' বা 'অশতম' স্বরূপ। নিজেকে অনন্তে অনন্তে বিস্তার করেছেন বা বৃহৎ হচ্ছেন, তাই সৃষ্টির প্রতি অণুতে এই এক আত্মস্বরূপই নিজেকে তদাকারে সৃষ্ট করে বিরাজ করছেন।দিক্ দিগন্তে যা কিছু ছড়িয়ে আছে, সেখানে নিজেকে বা এই আত্মাকেই পাওয়া গেল, এইটি অষ্টমী নামক চেতনার মহিমা বা তিথি।
যেখানে যা কিছু আছে তা এই ভূমি (২), অন্তরীক্ষ (৪) এবং দ্যৌ / দি +উ / দ + য়ৌ (২), সব কিছু এই তিনের অন্তর্গত; তাই এঁরা অষ্ট বা পরম আত্মস্বরূপের অষ্ট নামীয় মহিমাকে বিজ্ঞাপন করছেন।
এঁরা অক্ষর বা ক্ষয় বিহীন। এই যে অষ্ট অক্ষর ( ভূমি, অন্তরীক্ষ, দ্যৌ) এঁরা গায়ত্রীর একটি পদ। পদ অর্থে যাতে সব প্রতিষ্ঠিত থাকে। যে অবয়ব আমাদের প্রতিষ্ঠাকে স্থূল ভাবে সাধন করছে , তার নাম পাদ বা পা। পায়ের দ্বারাই আমরা দাঁড়িয়ে থাকি।
(অষ্ট বসুগণ বা বসু নামক গণ দেবতারা যাঁরা সবাইকে বসবাস করান, তাঁরাও অষ্ট। এই অষ্ট বসুদের নাম , বৃহদারণ্যক উপনিষদ অনুসারে হল----অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরীক্ষ, আদিত্য, দ্যৌ, চন্দ্রমা, নক্ষত্র সকল। )
যিনি এইটি (এই পদকে) জানেন, তিনি এই তিনলোকে যা আছে তাকে জয় করেন। জয় করা অর্থে 'নিজেতে পাওয়া'। চেতনা বা বোধ ক্ষেত্রে কিছু জানা মানেই তৎ সারূপ্য প্রাপ্ত হওয়া। সেই রকম, গায়ত্রীকে যিনি জানেন, গায়ত্রীর যা মহিমা তা সেই বিজ্ঞাতারও মহিমা।
৫। ১৪। ২
ঋচো যজূংষি সামানীত্যষ্টাবক্ষরাণ্যষ্টাক্ষরং হ বা একং গায়ত্র্যৈ পদমেতদুহৈবাস্যা এতৎ স যাবতীয়ং ত্রয়ী বিদ্যা তাবদ্ধ জয়তি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদ।
অন্বয়।
ঋচো (ঋক্ সকল), যজূংষি ( যজুঃ সকল) সামানি (সাম সকল) ইতি (এঁরা/ এই তিনটি) অষ্টৌ (অষ্ট) অক্ষরাণি(অক্ষর), অষ্ট অক্ষরম্ (অষ্ট অক্ষর) হ বা একম্ (অব্যশ্যই একটি) ) গায়ত্রৈ (গায়ত্রীর) পদম্ (পদ); এতৎ (এই--এই এক পদ)) উ হ এব অস্যা: (এনার- এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই- এই তিন বিদ্যা) )। সঃ (সে- যিনি এইটি জানেন) যাবতী (যে পর্যন্ত) ইয়ম্ (এই) ত্রয়ী (তিন) বিদ্যা(বিদ্যা) তাবৎ (সেই পর্যন্ত) হ জয়তি (অবশ্যই জয় করেন), যঃ (যিনি) অস্যা: (এনার) এতৎ (এই) এবম্ (এই প্রকার) পদম্ (পদকে) বেদ (জানেন)।
অর্থ।
ঋক্ সকল, যজুঃ সকল, সাম সকল , এঁরা/ এই তিনটি যা অষ্ট অক্ষর; অষ্ট অক্ষর অব্যশ্যই গায়ত্রীর একটি পদ; এই এক পদ এনার (এই গায়ত্রীর) এই তিন বিদ্যা। সে (যিনি এইটি জানেন), যে পর্যন্ত এই তিন বিদ্যা সেই পর্যন্ত অবশ্যই জয় করেন), যিনি) এনার এই প্রকার পদকে জানেন।
(ঋচো--২; যজূংষি--৩; সামানি--৩; ২+৩=+৩=৮।)
নিরুক্ত।
ঋক্, যজুঃ এবং সাম, এই তিন বেদ বা আত্ম বেদনের তিনটি মাত্রা, যারা চেতনার প্রকাশ বা মন্ত্র সকল ( যাদেরকে বেদ মধুকর বলে বর্ণনা করেছেন ), সেই বেদনই আমাদের আশ্রয় হয়ে, তিন লোক হয়ে , ভূমি, অন্তরীক্ষ ও দ্যৌ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এই তিন বিদ্যা, যাঁদের দ্বারা আমরা বিদ্যমান, তাঁরাও অক্ষয় বা অক্ষর। তাঁরাও অষ্ট, তাঁরাও প্রতি অণুতে অণুতে বিদ্যমান, সর্ব্বত্র বেদনময়; সবাইকে প্রাণময় করে রেখেছেন।
যা তন্ত্র শাস্ত্রে 'শক্তি', তাই বেদে 'বিদ্যা'। বিদ্যা মানে যাঁর দ্বারা আমরা 'বিদ্যমান' বা বেদনময়, সোম বা অনুভূতিময়। আবার, যে সকল বেদন বা প্রজ্ঞার দ্বারা আমরা 'মুক্তির' দিকে বা মৃত্যুর দাসত্ব থেকে পরিত্রাণের পথে চালিত হই, তা 'বিদ্যা' বলে অভিহিত হয়।
চেতনার 'ঋক্' বলে যে বেদন বা প্রাণময়তা, যার থেকে রূপময়, সংজ্ঞাময় , আয়তন যুক্ত, দৃশ্যমান এই বিশ্ব প্রকাশ পেয়েছে, তার আধার হল ভূমি। ' ঋ মানে 'চলা, গতি'। আর সেই গতি থেকে 'ক' বা ব্যঞ্জনা বা বর্ণ সকল প্রকাশ পায়। ঋক্ মানে চেতনার, আত্মস্বরূপের সেই বেদন যা থেকে যা কিছু 'দৃশ্য', যা কিছু 'চাক্ষুষ' তা প্রকাশ পায়। তাই ঋক্ বেদের প্রথম মন্ত্রে অগ্নি যিনি প্রকাশবান্ , যিনি সব প্রকাশের 'অগ্রে', যিনি 'নেতা' (নি> নী ), তাঁর বন্দনা করা হয়েছে।
চেতনার 'যজুঃ' বলে যে বেদন বা প্রাণময়তা, যার দ্বারা এই আত্মস্বরূপ চেতনার সাথে আমরা সর্ব্বদা যুক্ত, যার দ্বারা আমরা ইন্দ্রিয়ময় হয়েছি এবং ইন্দ্রিয়দের দ্বারা বহির্বিশ্বের সাথে যুক্ত রয়েছি , তার নাম যজুর্বেদ বা যজুর্বেদন।
মহাপ্রাণের এই বেদনময়তা বা ক্রিয়ার দ্বারা আমরা সবাই সবার সাথে যুক্ত। তাই উপনিষদ, যিনি মহাপ্রাণ, তাঁর প্রবহমানতাকে লক্ষ করে তাঁকে বায়ু বলে অভিহিত করেছেন এবং তাঁর যুক্ততার ক্রিয়া (বা যজন / যোজন) কে লক্ষ করে তাঁকে 'সূত্র' বা 'সূত্রাত্মা' বলে অভিহিত করেছেন। তাই যজুর্বেদের প্রথম মন্ত্রে, বায়ুকে বন্দনা করা হয়েছে।
অন্তর থেকে বাহিরে আর বাহির থেকে অন্তরে এই যাতায়াত বা গতাগতি যে পথে আমরা করি এবং যাদের দ্বারা করি, তারা ইন্দ্রিয়। তাই এই ইন্দ্রিয়রা যজুর্বেদের অন্তর্গত। এই ইন্দ্রিয়দের যে দৈব স্বরূপ তা হল একাদশ রুদ্র। মন, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয়, এই নিয়ে একাদশ রুদ্র।
সবার সাথে সবার যুক্ততা যে লোকের বৈশিষ্ট্য তা হল অন্তরীক্ষ। এখানে অন্তরেই ঈক্ষণ বা দর্শন চলছে। সবাইকে নিজের ভিতরেই দেখা যাচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে। আর প্রাণের যে ক্রিয়া বা বেদনের দ্বারা এই যুক্ততা বা যোগসূত্র সাধিত হচ্ছে তার নাম যজুর্বেদ বা যজুর্বেদন।
যে পরম আত্মস্বরূপের ঋক্ বেদন থেকে বিশ্বভূবন প্রকাশ পেয়েছে আর যাঁর যজুর্বেদনের দ্বারা সবাই তাঁর সাথে যুক্ত এবং সবাই সবার সাথে যুক্ত, তাঁর যে 'নিজ' বা আত্মবেদন , তাই সাম। এই একই আত্মস্বরূপের আত্মত্বই আমাদের মধ্যে 'নিজ বোধ' বা 'আত্ম বোধ', যা আমাদের সব বোধ, অনুভূতি এবং অস্তিত্বর মূলে।
এই আত্মাই সাম, এঁতে সবাই সমান বা সাম। ইনিই প্রাণ এবং বাক্ হয়ে সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। প্রতি সৃষ্টির মূলে এই প্রাণ এবং বাকের মিথুন রয়েছে। প্রতি সৃষ্টিতে, প্রাণ হয়েছেন আধেয় আর বাক্ হয়েছেন আধার। নিজেকে, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী ইত্যাদির আকারে বেষ্টন করেছেন বা তদাকারে সৃষ্টি করেছেন। এই যে নিজেকে নানা নামে, নানা সংজ্ঞায় ,নানা বাক্যে আলিঙ্গিত করেছেন, আত্মার এই মহিমা বা শক্তির নাম বাক্। আর যা হয়েছেন, যা সৃষ্ট হয়েছে, তাই প্রাণ বা প্রাণি। ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি প্রাণ কে 'অম' এবং বাক্কে 'সা' বলেছেন।
সবাই বাক্ আর প্রাণের মিথুন বা সাম। নিজেকে নিজে দোহন করে , এই স্বয়ংপ্রকাশ আত্মা সব হয়েছেন, তাই এঁর (বাকের ) নাম দোগ্ধ্রী আর তাঁর লোকের নাম 'দ্যু' বা দ্যৌ'।
ছান্দোগ্য উপনিষদে আদিত্যকে, দেবগণের মধু বলা হয়েছে, আর দ্যু হল 'তিরশ্চীন বংশ' বা তেরছা বা বাঁকা বংশ দণ্ড বা বক্র শাখা প্রশাখা যাতে মধুচক্র সকল অবস্থিত।
আদিত্য হল সেই কেন্দ্র যেখানে সব দ্বিতীয়তা অদ্বতীয়তায় বা সামে বিধৃত। আদিত্য , অদিতির সন্তান; যাঁতে কোন দ্বিতীয় ভাব নেই তিনি 'অদিতি। এই আদিত্য 'অদন' বা ভোজনের কেন্দ্র। 'অদন অর্থে খাওয়া। ইনি কাল গতিতে সবাইকে খাচ্ছেন, সবাইকে নিজের সাথে একসা করছেন। কাল গতিতে আমাদের অভ্যুদয় হচ্ছে; আমরা ক্রমশঃ এই আত্মাকে বা নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি। এই আদিত্যকে দ্বাদশ বলা হয়েছে; দ্বাদশ মাসে বা দ্বাদশ সমাসে ইনি আমাদের সমাসিত করছেন; আবর্ত্তন যখন সম্পূর্ণ হয়, দ্বাদশ মাসের অন্তে আমরা নিজেদের ঐ অদিতির সন্তান বলে জানতে পারব।
এই তিন বিদ্যা বা বেদ হলেন অক্ষর বা অক্ষয় এবং অষ্ট, অর্থাৎ সর্ব্বত্র বিদ্যমান।
বেদের ব্যক্তিত্ব হল 'দেব' বা 'দেবতা', একদিকে বেদ বা বেদন আর তার ব্যক্তিত্ব বা ব্যবহারময়তা নিয়ে দেব বা দেবতা।
ভূমি হল 'লোক', ঋক, তার বেদ এবং অষ্ট বসু তার দেবতা।
অন্তরীক্ষ হল লোক , যজুঃ তার বেদ এবং একাদশ রুদ্র তার দেবতা।
দ্যু বা দ্যৌ হল লোক, সাম তার বেদ, দ্বাদশ আদিত্য তার দেবতা।
৫। ১৪। ৩
প্রাণঃ অপানো ব্যান ইত্যষ্টাবক্ষরাণ্যষ্টাক্ষরং হ বা একং গায়ত্র্যৈ পদমেতদুহৈবাস্যা এতৎ স যাবদিদং প্রাণি তাবদ্ধ জয়তি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদাথাস্যা এতদেব তুরীয়ং দর্শতং পদং পরোরজা য এষ তপতি যদ্বৈ চতুর্থং তত্তুরীয়ং দর্শতং পদমিতি দদৃশ ইব হ্যেষ পরোরজা ইতি সর্ব্বমুহ্যে বৈষ রজ উপর্যুপরি তপত্যেবং হৈব শ্রিয়া যশসা তপতি যঃ অস্যা এতদেবং পদং বেদ।
অন্বয়।
প্রাণঃ (প্রাণ) অপান: (অপান) ব্যান:(ব্যান) ইতি (এই তিন) অষ্টৌ (অষ্ট) অক্ষরাণি (অক্ষর); অষ্ট অক্ষরম্ (অষ্ট অক্ষর) হ বা একম্ (অব্যশ্যই একটি) ) গায়ত্রৈ (গায়ত্রীর) পদম্ (পদ); এতৎ (এই--এই এক পদ)) উ হ এব অস্যা: (এনার- এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই- এই তিন বিদ্যা) ); স: (সে) যাবৎ (যে পর্যন্ত) ইদম্(এই) প্রাণি (প্রাণীরা) তাবৎ (সেই পর্যন্ত) হ (অবশ্যই) জয়তি (জয় করেন) যঃ (যিনি) অস্যাঃ (এনার--এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই) এবম্ পদম্ (এই রকম পদকে) বেদ (জানেন)। অথ (আর) অস্যা (এনার--এই গায়ত্রীর) এতৎ এব (ইহাই) তুরীয়ম্ (তুরীয়) দর্শতম্ (দৃশ্যমান) পদম্ (পদ) পরঃ (শ্রেষ্ঠ; পরপারে বা ঊর্দ্ধে) রজাঃ (রজ সকলের); যঃ (যিনি) এষঃ (এই ভাবে) তপতি ( তাপ বিকিরণ করছেন) । যৎ বৈ চতুর্থম্ (যা ঐ চতুর্থ), তৎ (তা) তুরীয়ম্ (তুরীয়)। দর্শতম্ (দর্শনীয়) পদম্ (পদ) ---ইতি দদৃশ (দর্শনীয়) ইব (যেন) হি (অবশ্যই) এষ: (এই) পরঃ রজাঃ (রজের ঊর্দ্ধে) ইতি। সর্ব্বম্ (সবাইকে) উ হি এব (অবশ্যই) এষ: রজঃ (এই যা রজ) উপরি উপরি (তার উপরে, তার ঊর্দ্ধে) তপতি (তপ্ত করছেন)। এবম্ হ এব (এই রকম ভাবেই) শ্রিয়া (শ্রীর দ্বারা) যশসা(যশের দ্বারা) তপতি (তপ্ত করেন) যঃ (যিনি) অস্যাঃ (এনার---এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই) এবং(এই প্রকার) পদং (পদকে) বেদ বিজ্ঞাত হন বা জানেন)।
অর্থ।
প্রাণ, অপান ব্যান এই তিন অষ্ট অক্ষর; অষ্ট অক্ষর অব্যশ্যই গায়ত্রীর একটি পদ ; এই গায়ত্রীর এই এক পদ, এই তিন বিদ্যা ; তিনি, যে পর্যন্ত এই প্রাণীরা, সেই পর্যন্ত অবশ্যই জয় করেন, যিনি এই গায়ত্রীর এই রকম পদকে জানেন। আর এই গায়ত্রীর ইহাই তুরীয় দৃশ্যমান পদ যা রজ সকলের পরপারে (বা ঊর্দ্ধে), যিনি এই ভাবে তাপ বিকিরণ করছেন। যা ঐ চতুর্থ তা তুরীয়। দর্শনীয় পদ ----- যেন দর্শনীয়, অবশ্যই এই রজের ঊর্দ্ধে । সবাইকে অবশ্যই, এই যা রজ তার উপরে, তার ঊর্দ্ধে তাপ বিকিরণ করছেন। এই রকম ভাবেই শ্রীর দ্বারা, যশের দ্বারা তিনি তপ্ত করেন, যিনি এই গায়ত্রীর এই প্রকার পদকে বিজ্ঞাত হন বা জানেন।
(প্রাণ=২, অপান= ৩, ব্যান-বিয়ান--৩; ২+৩+৩=৮।)
নিরুক্ত।
ঋক্, যজুঃ এবং সাম এই তিন বেদন বা প্রাণময়তা যাঁর স্বভাব আর সেই বেদত্রয় যে তিন রকম আলো (আলোক) বা লোককে সৃষ্টি করেছে, সেই বেদ আর সেই লোকেরই অধীন হয়ে, এই পরম আত্মস্বরূপ বা যিনি মহাপ্রাণ, তিনি নিজেকে অনন্তরকম প্রাণির আকারে সৃষ্টি করে সেই বেদসকল এবং লোক সকলকে ভোগ করছেন।
প্রতি সত্তায়, ইনিই প্রথম; ইনি আছেন বলে সেই সত্তাটি আছে। যিনি থাকলে সবাই থাকে এবং যিনি চলে গেলে বা উৎক্রমণ করলে তাঁর সাথে সবাই চলে যায় , তিনি প্রাণ।
এই প্রাণই, ঊর্ধ্বে দ্যুলোক; ইনিই অধে পৃথিবী বা বসুধা এবং এঁর নাম 'অপান'। ইনিই বায়ু , অন্তরীক্ষ বা ব্যান, যিনি এই দ্যুঃ (দ্যুলোক) আর ভূঃ (ভূমি বা মর্ত্ত), এই দুইকেই স্পর্শ করে আছেন, এই দুইএর যোজক। তাই বায়ু 'যজুঃ' এবং এঁর অন্য নাম 'ভূবঃ'।
যেখানে যা কিছু আছে বা 'অস্তি' বলে প্রতিভাত হচ্ছে, তা প্রাণই, তারা সবাই চিন্ময়, প্রাণময়। কোথাও বা এই প্রাণের (বা কালের) ধারা অতি মন্দীভূত বলে , তারা জড় বলে প্রতিভাত হচ্ছে; কোথাও আমাদের সীমিত চেতনায় প্রাণের ধারা ধরা পরছে না; কোথাও বা সৃষ্টি জীবন্ত, প্রাণময়। যিনি এই গায়ত্রীকে জানেন, তিনি সর্ব্বত্র এই মহাপ্রাণের প্রাণময়তা কে দর্শন করেন আর প্রাণের যতরকম প্রকাশ, যত কিছু প্রাণি বিশ্ব ভুবনে আছে, তারা তাঁর অনুগত হয়।
তাই এই তিন প্রাণ অষ্ট অক্ষর, সর্ব্বত্র বিস্তৃত, সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত।
প্রাণ ----প্র (প্রথম) +অন্ (গতি বা কম্পন) --চেতনার প্রথম প্রকাশ বা সক্রিয়তা।
অপান---অপ্ +অন্---অন্ বা প্রাণের যে আপ্তি। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রাণেরই আপ্তি, ইনি নিজেকেই 'তদাকারে' বা 'সৃষ্টির' আকারে প্রাপ্ত হয়েছেন বা পেয়েছেন। সমস্ত সৃষ্টিকে নিজের প্রাপ্তি বা 'আত্ম তৃপ্তির' আকারে যেখানে ইনি জানছেন, সেইটি ' অপ্ ' বা ' জল ', যিনি সর্ব্ব তৃষ্ণা হরণ করেন। আর সেই অপ্ বা জল যাতে সবাই 'আপ্তি' হয়ে আছে, তারা যখন 'কাঠিন্য' নিয়ে, স্থূল হয়ে প্রকাশ পায় , তার নাম 'স্থূল বা মূর্ত্ত বিশ্ব' বা 'পৃথিবী'। এই অপানই পৃথিবীর 'আকর্ষণ' বলে অনুভূত হয়। প্রশ্নোপনিষদে বলা হয়েছে যে ' এই অপানের দ্বারাই আমরা আমাদের শরীরে বিধৃত হয়ে রয়েছি। বৃহদারণ্যক উপনিষদে 'অপ্' থেকে 'পৃথিবী' সৃষ্টি হবার কথা বলা হয়েছে।
ব্যান--বি (বিভিন্ন দিকে) + আ (আতত বা প্রসারিত) + অন্ (প্রাণ) ---যিনি প্রাণময় হয়ে সর্ব্বত্র প্রসারিত , সবাইকে প্রাণ রূপ সূত্রের দ্বারা যুক্ত করে রেখেছেন, তিনি ব্যান, বায়ু বা সূত্রাত্মা।
"এই গায়ত্রীর) এতৎ এব (ইহাই) তুরীয়ম্
(তুরীয়) দর্শতম্ (দৃশ্যমান) পদম্ (পদ) পরঃ (শ্রেষ্ঠ; পরপারে বা ঊর্দ্ধে) রজাঃ (রজ সকলের); যঃ (যিনি) এষঃ (এই ভাবে) তপতি ( তাপ বিকিরণ করছেন)" -----এই যে মহাপ্রাণ গায়ত্রী ইনি পরোরজা।
রজ--রজ অর্থে ' র বা রব' যেখান থেকে 'জাত' হচ্ছে। আকাশ হল তত্ত্ব এবং আকাশের তন্মাত্রা হলো 'শব্দ'। সমস্ত কিছু বা সকল 'শব্দ' যেখানে 'শববৎ দমিত ' হয়ে থাকে, আবার সেই শব সকল যেখান থেকে 'বিদ্যুৎ-ময় হয়ে শবত্বকে বিদীর্ণ করে প্রকাশ পায়, অব্যক্ত থেক ব্যক্ত হয়, তার নাম 'আকাশ'। তাই এই আকাশ ঘন কৃষ্ণ বর্ণ আবার তেজ বিকীর্ণময়। তাই আকাশের নাম 'রজ' আর এই গায়ত্রী পরোরজা বা 'রজের' পর পারে, রজের ঊর্ধ্বে।
এই আকাশ কে ইনি প্রাণময় করে, অভিতপ্ত করে আত্মবিকিরণ করছেন বা প্রাণ দান করছেন।
এই আকাশ থেকে যে তেজ বা আলো প্রকাশ পেয়ে সবাইকে শব্দময় বর্ণময় বা নানা রঙে রঞ্জিত করছে, তা 'রজ'। আর ইনি সকল কে রাঙিয়ে, নিজে নিরঞ্জন, তাই 'পরোরজা'।
এই যে প্রাণ রূপ উষ্ণতা দিয়ে গায়ত্রী আমাদের অভিতপ্ত করছেন, এইটি এঁর 'তুরীয়' পদ এবং 'দৃশ্যমান' । এই পদই বেদোক্ত বিষ্ণু বা প্রাণের পরম পদ যা দ্যুলোকের মত এবং সর্ব্বত্র বিস্তারিত চক্ষুর মত। আকাশ মানে যেখানে 'দর্শন, আলোক, ঈক্ষণ বা কাল প্রকাশ পাচ্ছে। ঈক্ষণ মানে 'দৃষ্টি এবং কাল বা ক্ষণ প্রকাশ'। প্রাণ মানেই 'যিনি দেখছেন'। এই দৃষ্টি সবাইকে বিদ্ধ করে চলেছে। ইনি 'তুরীয়', এই দৃষ্টি 'অতীব ক্ষিপ্র'। ইনি প্রাণ, ইনি প্রাণাগ্নি বা অগ্নি, যিনি সবার 'অগ্রে'(অগ্) চলেন (নী)। ইনি 'নেতা' , সবাইকে নিয়ে চলেন এবং 'অগ্রে' থাকেন। তাই ইনি 'নয়ন' বা দর্শনময়। 'তুর্' অর্থে 'ক্ষিপ্র', যিনি সবার 'অগ্রে'। এতই 'ক্ষিপ্র' যে 'সব হয়েই আছে'।
"যৎ বৈ চতুর্থং (যা ঐ চতুর্থ) তৎ (তা) তুরীয়ং (তুরীয়)" ----যা চতুর্থ, তাই তুরীয়। যেখানে 'তিনটি বেদ' এক হয়ে গেছে, যাঁর থেকে , ঋক্, যজু; এবং সাম এই বেদত্রয় প্রকাশ পাচ্ছে, তিনি 'চতুর্থ'। এখানে তিনটি বেদ, একটি বেদে বা 'আত্মস্বরূপে'' এক হয়ে গেছে। এখানে তিনটি লোক এক হয়ে গেছে। তাই 'উপনিষদ' বলেছেন , 'ইনি নিজেই নিজের লোক'।
এবং হ এব (এই রকম ভাবেই) শ্রিয়া (শ্রীর দ্বারা) যশসা(যশের দ্বারা) তপতি (তপ্ত করেন) যঃ (যিনি) অস্যা(এনার---এই গায়ত্রীর) এতৎ (এই) এবং(এই প্রকার) পদং (পদকে) বেদ বিজ্ঞাত হন বা জানেন) ----যিনি এই চতুর্থ পদকে জানেন, তিনি এই গায়ত্রীর মতো সবাইকে শ্রী এবং যশের দ্বারা অভীতপ্ত করেন। চেতনাতে জানা মানেই তাই হওয়া। তাই গায়ত্রীকে যিনি জানেন , গায়ত্রীর যা ধর্ম্ম তা তাঁর মধ্যে প্রকাশ পায়।
শ্রী- গায়ত্রীকে ' আশ্রয় ' করলে বা তাঁতে ' শ্রদ্ধা ' যুক্ত হলে যে গুণ বা বিশিষ্টতা প্রকাশ পায়, তার নাম "শ্রী'।
যশ---য = যমিত বা সংযমিত; শ--শক্তি। শক্তির যে সংযমিত অবস্থা তা যশ। শক্রিময় যিনি বা শক্তি যাঁতে সংযমিত হয়ে আছে তিনি যশস্বী।
এই গায়ত্রীকে যিনি জানেন তিনি তাঁর শ্রী এবং যশের দ্বারা সবাইকে অভিতপ্ত করেন।
৫। ১৪। ৪
সৈষা গায়ত্র্যেতস্মিংস্তুরীয়ে দর্শতে পদে পরোরজসি প্রতিষ্ঠিতা তদ্বৈ তৎসত্যে প্রতিষ্ঠিতং চক্ষুর্বৈ সত্যং চক্ষুর্হি বৈ সত্যং তস্মাদ্যদিদানীং দ্বৌ বিবদমানাবেয়াতামহমদর্শমহমশ্রৌষমিতি য এবং ব্রুয়াদহমদর্শমিতি তস্মা এব শ্রদ্দধ্যাম তদ্বৈ তৎ সত্যং বলে প্রতিষ্ঠিতং প্রাণো বৈ বলং তৎ প্রাণে প্রতিষ্ঠিতং তস্মাদাহুর্বলং সত্যাদোগীয় ইত্যেবংবেষা গায়ত্র্যধ্যাত্মং প্রতিষ্ঠিতা সা হৈষা গয়াংস্তত্রে প্রাণা বৈ গয়াস্তৎ প্রাণাংস্তত্রে তদ্ যদ্ গয়াং স্তত্রে তস্মাদ্ গায়ত্রী নাম স যামেবামূং সাবিত্রীমন্বাহৈষৈব সা স যস্মা অন্বাহ তস্য প্রাণাংস্ত্রায়তে।।
অন্বয়।
সা (সেই) এষা(এই) গায়ত্রী (গায়ত্রী) এতস্মিন্ (এই) তুরীয়ে (তুরীয়) দর্শতে (দর্শনীয়) পদে (পদে) পরো রজসি (রজের পর পারে) প্রতিষ্ঠিতা (প্রতিষ্ঠিত)। তৎ বৈ (তাহাই) তৎ(সেই) সত্যে (সত্যে) প্রতিষ্ঠিতম্ (প্রতিষ্ঠিত) । চক্ষু: বৈ (চক্ষুই) সত্যম্ (সত্য); চক্ষু: হি বৈ (চক্ষু নিশ্চয়ই) সত্যম্ (সত্য) । তস্মাৎ (সেই জন্য) যৎ ইদানীম্ (যখন এখনও) দ্বৌ(দুই জন) বিবদমানৌ(যারা বিবাদ করছে) এয়াতাম্ (আগমন করে) --- অহম্ (আমি) অদর্শম্ (দেখেছি), অহম্ (আমি) অশ্রৌষম্ (শুনেছি) ইতি-- যঃ (যে) এবম্ (এই রকম) ব্রুয়াৎ (বলে) অহম্(আমি_ অদর্শম্ (দেখেছি) ইতি তস্মা এব (তার প্রতিই) শ্রদ্ দধ্যাম (শ্রদ্ধাময় হয় বা তাকে বিশ্বাস করে)। তৎ বৈ (সেই যা চক্ষু), তৎ সত্যম্ (সেই সত্য) বলে (বলে) প্রতিষ্ঠিতম্ (প্রতিষ্ঠিত)। প্রাণঃ বৈ (প্রাণই ) বলম্ (বল) , তৎ (সেই সত্য) প্রাণে (প্রাণে) প্রতিষ্ঠিতম্ (প্রতিষ্ঠিত)। তস্মাৎ (সেই জন্য) আহুঃ(বলে) বলম্ (বল) সত্যাৎ (সত্যের থেকে) ওগীয়ঃ (উগ্র / ওজস্-তেজোময়) ইতি। এবম্ উ (এই ভাবেই) এষা (এই) গায়ত্রী(গায়ত্রী) অধ্যাত্মং (অধ্যাত্মে ) প্রতিষ্ঠিতা (প্রতিষ্ঠিত)। সা হ এষা (সেই এই) গয়ান্ (গয়দের) তত্রে (ত্রাণ করেন) । প্রাণা: (প্রাণ সকল বা ইন্দ্রিয় সকল) বৈ (ই) গয়াঃ (গয়) । তৎ (তাই) প্রাণান্ (প্রাণ সকলকে) তত্রে(ত্রাণ করেন) । তৎ (তাই) যৎ (যে) গয়াং (গয়দের) তত্রে (ত্রাণ করেন) , তস্মাদ্ (সেই জন্য) গায়ত্রী (গায়ত্রী) নাম (নাম) । স: (তিনি/ আচার্য) যাম্ (যাকে) এব(এই) অমূম্ (সেই) সাবিত্রীম্ (সাবিত্রী) অনু (অনুসারে) আহ (বলেন), এষা এব (ইনিই, এই গায়ত্রীই) সা (সেই সাবিত্রী)। সঃ (তিনি/ আচার্য) যস্মা (যাকে) অনু(অনুগ্রহ করে) আহ (বলেন) তস্য (তার) প্রাণান্ (প্রাণ সকল) ত্রায়তে (ত্রাণ লাভ করে বা মৃত্যুর থেকে উত্তীর্ণ হয়)।
অর্থ।
সেই এই গায়ত্রী এই তুরীয় দর্শনীয় পদ যা রজের পর পারে বা ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত। তাহাই সেই সত্যে প্রতিষ্ঠিত। চক্ষুই সত্য; চক্ষু নিশ্চয়ই সত্য। সেই জন্য যখন এখনও দুই জন যারা বিবাদ (তর্ক) করছে, (তারা) আগমন করে (বলে) --- আমি দেখেছি, আমি শুনেছি -- যে এই রকম বলে আমি-- দেখেছি তার প্রতিই শ্রদ্ধাময় হয় ( তাকে বিশ্বাস করে)। সেই (সত্য) যা চক্ষু, সেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত। প্রাণই বল , সেই সত্য প্রাণে প্রতিষ্ঠিত। সেই জন্য বলা হয়, বল সত্যের থেকে উগ্র (তেজোময়)। এই ভাবেই এই গায়ত্রী অধ্যাত্মে প্রতিষ্ঠিত)। সেই এই (গায়ত্রী) গয়দের ত্রাণ করেন)। প্রাণ সকল (ইন্দ্রিয় সকল) গয়) । তাই প্রাণ সকলকে ত্রাণ করেন । তাই যে গয়দের ত্রাণ করেন , সেই জন্য গায়ত্রী নাম । তিনি (আচার্য) (যাকে) এই সেই সাবিত্রী অনুসারে (সাবিত্রীকে অনুসরণ করে) বলেন (উপদেশ দেন) ), ইনিই (এই গায়ত্রীই) সেই সাবিত্রী। তিনি (আচার্য) যাকে) অনুগ্রহ করে বলেন তার) প্রাণসকল ত্রাণ লাভ করে বা মৃত্যুর থেকে উত্তীর্ণ হয়)।
নিরুক্ত।
চক্ষু এবং সত্য---- আত্মস্বরূপ চেতনার যে কেন্দ্র থেকে বা যে জ্ঞান বা বোধক্রিয়া থেকে নামরূপময় বিশ্ব বা নির্দিষ্ট সংজ্ঞাময় এবং আকার আয়তনময় জগৎ প্রকাশ পায়, তার নাম 'চক্ষু'। বাইরের আকাশের সূর্য, চেতনার ঐ চক্ষুরই একটি প্রকাশ বা কেন্দ্র। যা কিছু এই চেতনার দৃষ্টির থেকে প্রকাশ পেয়েছে, আর যা কিছু আমাদের চক্ষুতে প্রতিভাত হচ্ছে তা 'সত্য'। তাই চক্ষুই সত্য।
(ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি আমার সত্যরূপ প্রথম করেছ সৃষ্টি-----শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর----<https://www.youtube.com/watch?v=vAAnq3xg7Bg> )
তৎ এতৎ অমৃতম্ সত্ত্যেন চ্ছন্নং। (সেই এই অমৃত সত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন। )
প্রাণো বা অমৃতং। (প্রাণই অমৃত।)
নামরূপে সত্যং। (নাম ও রূপ সত্য।)
তাভ্যাময়ং প্রাণশ্ছন্ন:। (তাদের দ্বারা ---নাম ও রূপের দ্বারা, প্রাণ আচ্ছাদিত।)
নাম রূপময় যা কিছু তা সত্য, আর সেই নামরূপময় সৃষ্টির আবরণে প্রাণ আচ্ছাদিত। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ---১। ৬। ৩।)
চক্ষু এবং শ্রদ্ধা----যাঁকে আশ্রয় করা যায় তাঁর প্রতি আমরা 'শ্রদ্ধাময়' হই। এই পরম চেতনাই স্থূল হয়ে, নামরূপময় বিশ্ব হয়ে , আমাদের আশ্রয় হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
চক্ষু, সত্য এবং বল।
চেতনা যে শক্তি বা আত্মমহিমার দ্বারা নিজেকে নামরূপময় করে প্রকাশ করেছেন, তার নাম 'বল'।
আত্মস্বরপ চেতনা, জ্ঞান বা বোধক্রিয়ার দ্বারাই নিজেকে দ্বিতীয় করে, নাম রূপময় করে প্রকাশ করেন। এর নাম সৃষ্টি এবং ইহাই সত্য। এতে দুইটি ক্রিয়া আছে--- একটি হওয়া (বল) আর একটি যা হলেন সেইটিকে তদাকারে বোধ বা অনুভব করছেন বা জানছেন , এইটি 'জানা'। উপনিষদে এই 'জ্ঞান এবং বল ক্রিয়ার' কথা বলা হয়েছে। এই জন্য সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত।
প্রাণ ও বল।
আত্মস্বরূপ চেতনা একদিকে শান্ত , নিষ্ক্রিয়, স্থির এবং অন্যদিকে সক্রিয়, নিয়ন্ত্রণময়। এই সক্রিয়, নিয়ন্ত্রণময় চেতনাই 'প্রাণ'। তাই 'বল' , প্রাণে প্রতি'ষ্ঠিত।
বল, সত্য, উগ্র----বলের দ্বারাই সত্য প্রকাশিত। তাই সত্যের যে তেজ তা বলেরই তেজ। তাই বল সত্যের থেকে তেজোময় বা উগ্র।
গায়ত্রী এবং গয়।
যাদের দ্বারা আমরা গতাগতি করি, আমরা সক্রিয়, তারা 'গয়'। গয় অর্থে ইন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয়দের দ্বারাই আমরা সক্রিয়, অনুভূতিময়। কিন্তু এখন আমাদের দর্শন , শ্রবণ, স্পর্শ ইত্যাদি সীমিত এবং ক্ষয়শীল। এই 'গয়' দের ত্রাণ করে যিনি এদেরকে ক্ষয় বা মৃত্যুর পরপারে নিয়ে যান এবং সীমিত ইন্দ্রিয়শক্তিকে অসীম করে দেন, তিনি গায়ত্রী।
গয়, গো (গরু),গম্ (গমন করা) এই শ'ব্দ সকল সম্বন্ধযুক্ত। উপনিষদ বা বেদে যে 'গো' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে, তার প্রকৃত অর্থ 'ইন্দ্রিয়" বা 'প্রাণ শক্তি'। গো এবং অশ্ব এই দুই শব্দের দ্বারা বেদে (উপনিষদে) ইন্দ্রিয় এবং প্রাণগতি কে অভিহিত করা হয়েছে।
গয়দের ত্রাণ করা অর্থে, আমরা মৃত্যুর থেকে মাহাপ্রাণে , মৃত্যুহীন প্রাণে স্থিত হই।
তাই যিনি ইন্দ্রিয়দের অর্থাৎ আমাদের, মৃত্যুর পরপারে নিয়ে যান, বেদে বা উপনিষদে তাঁকে মুখ্যপ্রাণ বা দুর্গা বলে বন্দনা করা হয়েছে। মৃত্যুর পরপারে গিয়ে যা ছিল অদৃষ্ট তা দৃষ্ট হয়, যা ছিল অশ্রুত তা শ্রুত হয়, যা অবিজ্ঞাত তা জ্ঞাত হয় এবং এই ভাবে সমস্ত শক্তি অনন্ত হয়ে যায়।
গায়ত্রী এবং সাবিত্রী।
যিনি গয়দের, ইন্দ্রিয়দের বা প্রতি সত্তাকে মৃত্যুর পরপারে এবং সীমার থেকে অসীমে নিয়ে যান, তিনি গায়ত্রী।
এই গায়ত্রীই সাবিত্রী। সাবিত্রী অর্থে যিনি আমাদের সবনের উপর অধিষ্ঠাত্রী। সবন = সু (প্রবাহ) + অন্ (প্রাণ)--প্রাণ প্রবাহ বা জীবন। আদ্য, মধ্য এবং অন্ত, এই তিনটি প্রধান ভাগে আমাদের জীবন বিভক্ত। এই তিনটি সবনের উপর যিনি অধিষ্ঠান করছেন, তিনি সাবিত্রী, সবনত্রয়ের অধিষ্ঠাত্রী।
তাই আচার্য যে সাবিত্রীর উপদেশ দেন, সেই উপদেশের দ্বারা উপদিষ্টের প্রাণ সকল বা ইন্দ্রিয় সকল বা উপদিষ্ট মৃত্যুর থেকে ত্রাণ পান।
৫। ১৪। ৫
তাং হৈতামেকে সাবিত্রীমনুষ্টুভমন্বাহুর্বাগনুষ্টুবেতদ্বাচমনুব্রুম ইতি ন তথা কুর্যাদ্ গায়ত্রীমেব সাবিত্রীমনুব্রুয়াদ্যদি হ বা অপ্যেবংবিদ্বহ্বিব প্রতিগৃহ্ণাতি ন হৈব তদ্গায়ত্র্যা একং চ ন পদং প্রতি।
অন্বয়।
তাম্ হ এতাম্ (সেই এঁকে বা সাবিত্রীকে) একে (কেহ কেহ) সাবিত্রীম্ অনুষ্টুভম্ (সাবিত্রী অনুষ্টুপ্) অনু(অনুসারে) আহ (বলেন; উপদেশ দেন)। বাক্ (বাক্ ই ) অনুষ্টুপ্ (অনুষ্টুপ্) ; এতৎ (এই) বাচম্ (বাক্ এরই) অনুব্রুমঃ (উপদেশ দিই) ইতি। ন (না) তথা (এরকম) কুর্যাৎ (কোরো)। গায়ত্রীম্ এব (গায়ত্রীকেই) সাবিত্রীম্ (সাবিত্রীরূপে) অনুব্রুয়াৎ (উপদেশ দিও)। যদি হ বা অপি (যদি এইরকমও হয়) এবম্ (এই) বিৎ(বিজ্ঞাতা) বহু ইব (বহু) প্রতিগৃহ্ণাতি (প্রতিগ্রহণ করেন) ন হ এব (তাহা অবশ্যই হয় না) তৎ (সেই) গায়ত্র্যাঃ (গায়ত্রীর) একম্ চন পদং (একটি পদেরও) প্রতি (সমান) ।
অর্থ।
সেই এঁকে বা সাবিত্রীকে কেহ কেহ 'সাবিত্রী অনুষ্টুপ্' অনুসারে উপদেশ দেন। "বাক্ ই অনুষ্টুপ্- এই বাক্, এঁরই উপদেশ দিই "। এরকম কোরো না। গায়ত্রীকেই সাবিত্রীরূপে উপদেশ দিও। যদি এইরকমও হয় যে এই বিজ্ঞাতা (যিনি গায়ত্রীকে জানেন) বহু প্রতিগ্রহণ করেন, তাহা (সেই ধন বা বিভূতি) অবশ্যই সেই গায়ত্রীর একটি পদেরও সমান হয় না।
নিরুক্ত।
অনুষ্টুপ্ (অনুষ্টুভ্)---অনুভূতির যে ছন্দ তা অনুষ্টুপ্। এই চেতনাই বিশ্বভুবন হয়েছেন। নিজেকে নিজে বিশ্বের আকারে প্রকাশ করেছেন। ইনি যা বোধ করেন বা জানেন, তাই হন। এর নাম সম্ভূতি।আর এই সম্ভূতি থেকে যে বিশ্ব প্রকাশ পেয়েছে, সেই সম্ভূতি অনুসারে আমরা তাকে (বিশ্বকে) বোধ করছি বা অনুভব করছি; এইটি অনুভূতি। মহা চেতনার বোধক্রিয়া স্থূল, মূর্ত্ত বিশ্ব হয়েছে। আমাদের চেতনা বা অনুভূতিগুলি আমাদের মন অব্দিই থাকে, তার বাইরে আলাদা একটা সত্তা হয়ে প্রকাশ পায় না। বাইরে, বাহিরাকাশে, এই চেতনা ফুল হয়েছেন; চেতনার 'ফুল' জ্ঞান থেকে ফুলটি হয়েছে।এইটি সম্ভূতি। আর সেই 'ফুল' থেকে বা তদনুসারে, আমার অন্তরে ফুলের বোধ ফুটছে, এইটি অনুভূতি। এই অনুভূতি হওয়ার যে ধারা বা ছন্দ তা 'অনুষ্টুপ্'। আর এই যে চেতনা দুনিয়া সেজেছেন, সেই সাজার যে ছন্দ তার নাম 'জগতী'। উপনিষদে অনুভূতিকে 'বিনাশ' বলা হয়েছ, যেহেতু আমাদের অনুভূতিগুলি ক্ষণস্থায়ী।
বাক্ ই অনুষ্টুপ্-- যা কিছু আমরা বোধ বা অনুভব করি, তা আমাদের মধ্যে একটি শব্দ বা বাক্য রচনা করে। চেতনার আয়তন বা মূর্ত্তিই 'বাক্য'। সবকিছুই 'শব্দাত্মক'। এই স্থূল বিশ্ব চেতনারই বাঙময় প্রকাশ। আত্মশক্তি স্বয়ংপ্রকাশ এবং এঁর নাম 'বাক্'। ইনি যখন মূর্ত্ত হন , তার নাম 'বাক্য' আর তাতে যে প্রাণ বা বেদনের ধারা প্রকাশ পায় তাই ঋক্, যজুঃ আর সাম। ইনি নিজেকে দ্বিতীয় করে যা কিছু প্রকাশ করেন, তাকে আবার নিজেতেই ফিরিয়ে নেন, এর নাম 'গয় দের ত্রাণ করা' আর তাই এঁর নাম গায়ত্রী। (ছান্দোগ্য উপনিষদে গায়ত্রী কে 'বাক্' বলা হয়েছে (ছান্দোগ্য উপনিষদ তৃতীয় অধ্যায়, দ্বাদশ খণ্ড---(<https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_19.html> )
এই চিৎ শক্তি বাক্ বাইরে সম্ভূতির আকারে নিজেকে প্রকাশ করে, আমাদের অন্তরে অনুভূতির আকারে প্রকাশ পাচ্ছেন এবং আমাদের চেতায়িত করে রেখেছেন। তাই বাক্ 'অনুষ্টুপ্'।
বাক্ (বাক্ ই ) অনুষ্টুপ্ (অনুষ্টুপ্) ; এতৎ (এই) বাচম্ (বাক্ এরই) অনুব্রুমঃ (উপদেশ দিই) ইতি। ন (না) তথা (এরকম) কুর্যাৎ (কোরো)। গায়ত্রীম্ এব (গায়ত্রীকেই) সাবিত্রীম্ (সাবিত্রীরূপে) অনুব্রুয়াৎ (উপদেশ দিও)----চেতনা শুধু অনুভূতির আকারে নিজেতে প্রকাশ পাচ্ছেন, মাত্র এইটুকু জানলে হবে না। ইনি নিয়ন্ত্রিণী বা ঈশ্বর এবং এই ঈশিত্বের দ্বারা ইনি আমাদের মৃত্যুর পরপারে নিয়ে গিয়ে অমৃত এবং অসীম করছেন। তাই সাবিত্রীকে গায়ত্রীরূপে উপদেশ দিতে বলা হল। প্রতি অনুভূতিতে ইনি আমাদের পরিবর্ত্তন করে আমাদের অভ্যূদয় সাধন করছেন, 'গয় দের ত্রাণ করছেন'।
মাত্র বিনাশ বা অনুভূতি অবলম্বনে আত্মার বা নিজের অবিনশ্বরতা জানা যায়। যতক্ষণ সম্ভূতিকে না জানা হয়, ততক্ষণ জগৎ বা দুনিয়াটা, নিজের থেকে আলাদা হয়েই থাকে। এক আত্মা যে সবার আত্মা এটা জানা হয় না। এই জন্য বলা হল, 'মাত্র অনুষ্টুপ্ বাকের উপদেশ দিও না। এই জন্য ঈষোপোনিষদে বলা হয়েছে--
"সম্ভূতিঞ্চ বিনাশঞ্চ যস্তদ্বেদো ভয়ং সহ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা সম্ভূত্যাঃ অমৃত্মনশ্নুতে।। (ঈষোপোনিষদ ১৪শ মন্ত্র।)
সম্ভূতি এবং বিনাশ (অনুভূতি) এই দুইকে যিনি একত্রে জানেন, তিনি বিনাশ বা অনুভূতির দ্বারা মৃত্যুর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে , সম্ভূতির দ্বারা অমৃত লাভ করেন।
অমৃত লাভ করার অর্থই দেবময় বিশ্ব বা আত্মার আনন্ত্যকে জানা। এর নাম সম্ভূতিকে জানা এবং আত্মাই যে ঈশ্বর তা বিদিত হওয়া। স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার প্রকাশ, যে সব ক্ষেত্র বা ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়ে বিশ্ব ভূবনকে পরিচালনা করছে বা নিয়ন্ত্রণ করছে, তা দেবলোক বা তাঁরা দেবতারা। তাই এই গায়ত্রী দেবমাতা এবং বেদমাতা। তাই বলা হল, শুধু অনুষ্টুপ্ ছন্দে বাক্ রূপ সাবিত্রীকে উপদেশ দিও না; গায়ত্রীই সাবিত্রী--এই উপদেশ দিও।
৫। ১৪। ৬
স য ইমাংস্ত্রীল্লোঁকান্ পূর্ণান্ প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ সঃ অস্যা এতৎ প্রথমং পদমাপ্নুয়াদথ যাবতীয়ং ত্রয়ী বিদ্যা যস্তাবৎ প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ সঃ অস্যা এতদ্ দ্বিতীয়ং পদমাপ্নুয়াদথ যাবদিদং প্রাণি যস্তাবং প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ সঃ অস্যা এতৎ তৃতীয়ং পদমাপ্নুয়াদথাস্যা এতদেব তুরীয়ং দর্শতং পদং পরোরজা য এষ তপতি নৈব কেনচনাপ্যং কুত উ এতাবৎ প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ ।।
অন্বয়।
স (কেহ) যঃ(যদি) ইমাম্ (এই) ত্রীন্ (তিন) লোকান্ (লোককে) পূর্ণান্ (পূর্ণতায়) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রতিগ্রহণ করেন) সঃ (তা) অস্যা: (এনার) এতৎ (এই) প্রথমম্ পদম্ (প্রথম পদকে) আপ্নুয়াৎ (প্রাপ্ত হন)। অথ (অনন্তর)
যাবতী ইয়ম্ (এই যাবতীয় বা যত পর্যন্ত) ত্রয়ী বিদ্যা (তিন বিদ্যা), যঃ তাবৎ (যদি সেই পর্যন্ত) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রতিগ্রহণ করেন) , সঃ (তা) অস্যা: (এনার) এতৎ (এই) দ্বিতীয়ম্ পদম্ (দ্বিতীয় পদকে) আপ্নুয়াৎ (প্রাপ্ত হন)। অথ (অনন্তর) যাবৎ (যে পর্যন্ত) ইদম্ (এই) প্রাণি (প্রাণময়তা বা প্রাণময় বিশ্ব), যঃ তাবৎ (যদি সেই পর্যন্ত) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রাপ্ত হন)(প্রতিগ্রহণ করেন) , সঃ (তা) অস্যাঃ (এনার) এতৎ (এই) তৃতীয়ম্ পদম্ (তৃতীয় পদকে) আপ্নুয়াৎ (প্রাপ্ত হন) । অথ (আর) অস্যাঃ (এনার) এতৎ এব (এই প্রকার) তুরীয়ম্ (তুরীয়) দর্শতম্ (দর্শনীয়) পদম্ (পদ) পরঃ রজা (রজের ঊর্দ্বে); য: (যে) এষঃ (এ) তপতি (তাপ দিচ্ছেন), ন (না) এব (অবশ্যই) কেনচন (কেহই) আপ্যম্ (আপ্তব্য বা প্রাপ্য)--- কুতঃ উ (কোথা হতেই বা) এতাবৎ (এই পর্যন্ত) প্রতিগৃহ্ণীয়াৎ (প্রতিগ্রহণ করবে)?
অর্থ।
কেহ যদি এই তিন লোককে পূর্ণতায় (পরিপূর্ণ ভাবে) প্রতিগ্রহণ করেন তাহলে এনার এই প্রথম পদকে প্রাপ্ত হন। অনন্তর, এই তিন বিদ্যা যত পর্যন্ত, যদি সেই পর্যন্ত প্রতিগ্রহণ করেন, তাহলে এনার এই দ্বিতীয় পদকে প্রাপ্ত হন। অনন্তর যে পর্যন্ত এই প্রাণি (প্রাণময়তা বা প্রাণময় বিশ্ব), যদি সেই পর্যন্ত প্রাপ্ত হন (প্রতিগ্রহণ করেন) , তাহলে এনার এই তৃতীয় পদকে প্রাপ্ত হন । আর এনার এই প্রকার তুরীয় দর্শনীয় পদ রজের ঊর্দ্বে; এই যিনি তাপ দিচ্ছেন ইনি অবশ্যই কারোরই প্রাপ্য নন--- কোথা হতেই বা এই পর্যন্ত প্রতিগ্রহণ করবে (যিনি প্রাপ্তির ঊর্ধ্বে তাঁকে কি ভাবে প্রাপ্ত হবে?)
নিরুক্ত।
চেতনার ধর্ম্মই হল জানা এবং তাই হওয়া। যা জানা হয় বা যে বিষয়ে বোধক্রিয়া হয়, আমরা অন্তরে তাই হয়ে তাই বোধ করি। এই জন্য যে অনুভূতি নিয়ে আমরা কর্ম্ম করি আমাদের পরিণতি সেই অনুসারে হয়। তাই যিনি গায়ত্রীকে জানেন, তিনি গায়ত্রীর সাথে অভিন্ন হয়ে সেই গায়ত্রীর যা মহিমা সেই মহিমা সম্পন্ন হন।
তিন লোক, তিন বিদ্যা, প্রাণত্রয় (প্রাণ, অপান, ব্যান) এঁদের জানলে, সেই চতুর্থ পদ, যার দ্বারা পদবিহীনা গায়ত্রী অদৃষ্ট হয়েও যেন দৃষ্ট (দর্শত) হন, তাঁতে সেই উপাসকের গতি হয়। সেখানে কে কার থেকে কি গ্রহণ করবে, কি প্রাপ্ত হবে?
৫। ১৪। ৭
তস্যা উপস্থানং গায়ত্র্যস্যেকপদী দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদ্যপদসি নহি পদ্যসে। নমস্তে তুরীয়ায় দর্শতায় পদায় পরোরজসেঃ অসাবদো মা প্রাপাদিতি যং দ্বিষ্যাদসাবস্মৈ কামো মা সমৃদ্ধীতি বা ন হৈবাস্মৈ সকামঃ সমৃধ্যতে যস্মা এবমুপতিষ্ঠতেঃ অহমদঃ প্রাপমিতি বা।
অন্বয়।
তস্যাঃ (তাঁর) উপস্থানং(উপস্থান----গায়ত্রীর উপ বা নিকটে স্থিত হলে যে স্তুতি প্রকাশ পায় )---- গায়ত্রি! অসি (গায়ত্রী তুমি হও) একপদী (একপদী), দ্বিপদী (দ্বিপদী), ত্রিপদী ( ত্রিপদী ), চতুষ্পদী (চতুষ্পদী), অপদসি (তোমার কোন পদ নেই, তুমি সকল পদের ঊর্ধ্বে), নহি পদ্যসে (তুমি পদের দ্বারা নির্দিষ্ট হও না, পদবিহীনা)। নমঃ (নমস্কার) তে তুরীয়ায় (তোমার তুরীয়) দর্শতায় (দর্শনীয়) পদায় (পদকে) পরঃ রজসেঃ (যা পরোরজা বা রজের ঊর্দ্বে; নিরঞ্জন।
অসৌ (ঐ / ও ) অদঃ (তাকে--সেই কাম্যকে) মা (না) প্রাপৎ (প্রাপ্ত হয়) ইতি যম্ (যাকে) দ্বিষ্যাৎ (দ্বেষ করেন); অসৌ এব (ঐ সে) অস্মৈ কাম: (এই কাম্য) মা (না) সমৃদ্ধী (সমৃদ্ধ হয়) ইতি বা --- ন হ এব (অবশ্যই না) অস্মৈ (এই) সঃ (তার) কামঃ (কাম বা কাম্য) সম্ ঋধ্যতে (সম্যক রূপে বর্ধিত হয়) যস্মা (যার / যার প্রতি) এবম্ (এই প্রকার) উপতিষ্ঠতেঃ (উপাসনা করা হয়)। অহম্ (আমি) অদঃ (উহা) প্রাপম্ (প্রাপ্ত হই) ইতি বা।
অর্থ।
তার উপস্থান----গায়ত্রীর উপ বা নিকটে স্থিত হলে যে স্তুতি প্রকাশ পায় ---- গায়ত্রী তুমি একপদী, দ্বিপদী, ত্রিপদী, চতুষ্পদী,অপদসি (তোমার কোন পদ নেই, তুমি সকল পদের ঊর্ধ্বে); পদের দ্বারা নির্দিষ্ট হও না--- পদবিহীনা। (তুমি পদের অর্থ হয়ে বা পদার্থ হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেও, অপ্রকাশই থাকো। নমস্কার তোমার দর্শনীয় পদকে যা পরোরজা বা রঞ্জনার ঊর্দ্বে।
ঐ ব্যক্তি বা জীব সেই কাম্যকে প্রাপ্ত হয় না যাকে ইনি (দেবী গায়ত্রী বা গায়ত্রীকে যিনি জানেন) দ্বেষ করেন (দ্বিতীয় জ্ঞানের দ্বারা বিদ্ধ করে রাখেন); ঐ সে, এই কাম্যকে প্রাপ্ত হয় না, যাকে ইনি দ্বেষ করেন(দ্বিতীয় জ্ঞানের দ্বারা বিদ্ধ করে রাখেন ---- অবশ্যই এই তার কাম বা কাম্য সমৃদ্ধ হয় না যার প্রতি এই প্রকার উপাসনা করা হয় (বা এই রকম উপস্থাপনা করা হয়। আমি উহা প্রাপ্ত হই।
নিরুক্ত।
একপদী-- যাঁর একটিই পদ, বা যিনি সবার আত্মা বা এক আত্মস্বরূপ।
দ্বিপদী---যাঁর পদচারণ বা পদক্ষেপ থেকে 'দ্বিতীয়তা' সৃষ্টি হয় বা এক আত্মাই বহু হন।
ত্রিপদী---- যাঁর পদচারণ বা পদক্ষেপ থেকে বাক্ , প্রাণ ও মন এই তিন প্রধান দেবতা বা আত্মস্বরূপের তিন প্রধান ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। এই বাক্, প্রাণ এবং মনের সমাসে সমস্ত সৃষ্টি রচিত। (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ষষ্ঠ অধ্যায়।)
চতুষ্পদী ---বাক্, প্রাণ, মন এবং নিজের আত্মত্ব দিয়ে বা নিজেকে দিয়েই ইনি সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। প্রতি জীবে , প্রতি সৃষ্টিতে ইনি নিজেই সেই সৃষ্টি হয়েছেন এবং তাতে ইনি নিজেই বাঙ্ময়, প্রাণময়, মনোময়।
অপদসি--তুমি (গায়ত্রী) অপদী বা পদ বিহীনা----ইনি সব হয়েও কিছু হননি, যেমন তেমনই আছেন, তাই ইনি পদবিহীনা, তাই ইনি অনন্ত।
এই গায়ত্রীবিৎ সকল কিছু প্রাপ্ত হন; ইনি আপ্তকাম। নিজের বাহিরে,আত্মবহির্ভূত কিছু আর থাকে না।
ইনি যদি কারোর কাম্যের বিরোধিতা করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি কাম্যকে পায় না বা তা সমৃদ্ধ হয় না। ইনি যদি কাউকে কাম্য প্রাপ্ত করাতে চান , তবে সে অবশ্যই কাম্যকে লাভ করে। আত্মার যে ঈশিত্ব তা এই গায়ত্রীবিদের মধ্যে প্রকাশ পায়। এই জন্য মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে, কেউ যদি 'ভূতিকাম হও বা সম্পদ অভিলাষী হও , তাহলে যিনি আত্মজ্ঞ, তাঁর উপাসনা কোরো।
যতক্ষণ আমরা দ্বিতীয় জ্ঞানের বা দ্বিতীয়তার অধিকারে থাকি (দ্বেষ বা দ্বিতীয়তার দ্বারা বিদ্ধ হয়ে থাকি), ততক্ষণ আমাদের কাম সমৃদ্ধ হয় না। এই দেবক্ষেত্র, যা পরম আত্মশ্বরূপের প্রকাশময় ব্যক্তিত্ব তা আলাদা হয়ে থাকে।
আত্মজ্ঞান (আত্মার অবিনশ্বরত্ব) এবং আত্মার যে আনন্ত্য বা দেবময়তা এবং ঈশিত্ব, এই দুই (অনুভূতি এবং সম্ভূতি) জ্ঞানের দ্বারা বিজ্ঞাতা আপ্তকাম হন, তাঁর প্রাপ্তির আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
৫.১৪.৮।
এতদ্ধ বৈ তজ্জনকো বৈদেহো বুড়িলমাশ্বতরাশ্বিমুবাচ যন্নু হো তদ্গায়ত্রীবিদব্রুথা অথ কথং হস্তীভূতো বহসীতি মুখং হ্যস্যাঃ সম্রাণ্ ন বিদাংচকারোতি হোবাচ তস্যা অগ্নিরেব মুখং যদি হ
বা অপি বহ্বিবাগ্নাবভ্যাদধতি সর্ব্বমেব তৎ সংদহত্যেবং হৈবৈবংবিদ্যদ্যপি বহ্বিব পাপং কুরুতে সর্ব্বমেব তৎ সংপ্সায় শুদ্ধঃ পূতঃ অজরঃ অমৃতঃ সংভবতি।
অন্বয়।
এতৎ হ বৈ তৎ (ইহাই তা), জ্নকঃ বৈদেহঃ (বৈদেহ জনক) বুড়িলম্ আশ্বতরাশ্বিম্ (বুড়িল আশ্বতরাশ্বিকে) উবাচ (বলেছিলেন) --- যৎ নু হো তৎ (তুমি যে সেই) গায়ত্রীবিৎ (গায়ত্রীবিৎ) অব্রুথাঃ ( বলেছিলে ), অথ(তাহলে) কথম্ (কেন) হস্তীভূতঃ (হস্তী হয়ে) বহসি (বহন করছ) ? ইতি মুখম্ (মুখ)) হি অস্যাঃ(এনার) সম্রাণ্ (সম্রাট) ন(না) বিদাঞ্চকার (বিদিত হয়েছি) ইতি হ উবাচ (বললেন)। তস্যাঃ (তাঁর) অগ্নিঃ এব (অগ্নিই) মুখম্ (মুখ)। যদি হ
বা অপি(যদি বা) বহু ইব (বহু) অগ্নৌ (অগ্নিতে) অভি (অভিমুখে) আ দধতি (ধারণ করেন বা অগ্নিতে আহুতি দেন) সর্ব্বম্ এব তৎ (সে সবকেই) সম্দহতি ( সম্যক ভাবে দহন করেন); এবম্ হ এব (এই রকমই) এবম্ বিৎ (এই প্রকার বিজ্ঞাতা) যদি অপি বহু ইব(যদি বহু) পাপম্ (পাপ) কুরুতে (করেন) সর্ব্বম্ এব তৎ (সেই সব পাপ) সংপ্সায়(সম্যক রূপে অপসরণ করে বা বিনাশ করে) শুদ্ধঃ (শুদ্ধ) পূতঃ (পবিত্র) অজরঃ((অজর বা জরা বিহীন) অমৃতঃ (অমৃত) সম্ভবতি (হন) ।
অর্থ।
ইহাই তা যা বৈদেহ জনক বুড়িল আশ্বতরাশ্বিকে বলেছিলেন --- "তুমি যে (নিজেকে) গায়ত্রীবিৎ বলেছিলে, তাহলে কেন হস্তী হয়ে বহন করছ) ?"
"সম্রাট! এনার মুখকে বিদিত হই নি (জানতে পারিনি)"--- ইহাই (বুড়িল আশ্বতরাশ্বি ) বললেন।
(জনক বললেন)-- "অগ্নিই তাঁর মুখ--- যদি বা বহু (আহুতি) অগ্নিতে, (অগ্নির) অভিমুখে (কেহ) ধারণ করেন (বা অগ্নিতে আহুতি দেন), সে সবকেই সম্যক ভাবে (অগ্নি) দহন করেন; এই রকমই এই প্রকার বিজ্ঞাতা যদি বহু পাপ করেন, সেই সব পাপকে সম্যক রূপে অপসরণ করে (বিনাশ করে) শুদ্ধ, পবিত্র, অজর ( জরা বিহীন) অমৃত হন।
নিরুক্ত।
বৈদেহ জনক----বিদেহ= বি (দেহ বিহীন) জনক (জন্মদাতা)-----বাক্ বা চেতনার থেকে সব কিছু জাত হচ্ছে এবং সকল কিছু চেতনারই আয়তন, আকার--- এই জ্ঞানসম্পন্ন যিনি।
বুড়িল----বুড়িল শব্দটি বুড্ শব্দ থেকে হয়েছে। সংস্কৃত 'বুড্' শব্দ এবং ইংরাজি (English) 'bud' (বাড্) শব্দের অর্থ একই । এর অর্থ 'কলি' বা 'যা সবে ফুটে উঠছে বা ওঠার মত হয়েছে'।
'আশ্বতরাশ্বি'---আশ্ব অর্থে যা 'প্রাণ' বা 'অশ্ব' থেকে উৎপন্ন বা যা প্রাণ বা অশ্বের সাথে যুক্ত।
'অশ্ব' অর্থে যিনি 'শ্ব' বা কালের আকারে প্রকাশ পাচ্ছেন। প্রাণের গতিই কাল, যার দ্বারা আমরা শৈশব, বাল্য,কৈশোর ইত্যাদি অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছি। এই প্রাণ বা কালের দ্বারাই দিবা রাত্রি ইত্যাদি হচ্ছে।প্রাণই সবাইকে বহন করে নিয়ে চলেছেন এবং এর নাম 'অভ্যুদয়'। বেদে ইহা 'বিষ্ণুর সংক্রমণ'। এই গতি এবং বাহক বা বহনের ধর্ম্ম যে পশুর মধ্যে প্রকট তার নামও 'অশ্ব'।
সুতরাং 'বুডিল / বুড়িল আশ্বতরাশ্বি' নামের অর্থ এইকম ---যিনি মহাপ্রাণ (বা অশ্বকে) অবলম্বন করে অভ্যুদয়ের পথে চলা শুরু করেছেন।
"তুমি যে (নিজেকে) গায়ত্রীবিৎ বলেছিলে, তাহলে কেন হস্তী হয়ে বহন করছ ?"----এর অর্থ " গায়ত্রীর উপাসক হয়েও তুমি কেন হস্তীর মত হয়েছ? যা স্থূল, যা মর্ত্ত বা যা শরীর তার অধীন হয়ে রয়েছ কেন?"
যিনি বৈদেহ জনক অর্থাৎ যিনি দেহ বা শরীরে ঊর্দ্বে যে প্রাণ, যিনি মুখ্য প্রাণ এবং সবার জনক, সেই প্রাণকে জানতেন, তিনি বুড়িল আশ্বতরাশ্বি, যিনি মর্ত্ত বা শরীরের অধীন হয়েও নিজেকে 'গায়ত্রীবিৎ' বলেছিলেন, তাঁকে ঐ প্রশ্ন করেছিলেন।
"সম্রাট! এনার মুখকে বিদিত হই নি (জানতে পারিনি)"--- ইহাই (বুড়িল আশ্বতরাশ্বি ) বললেন।
(জনক বললেন)-- "অগ্নিই তাঁর মুখ ---------অগ্নিই গায়ত্রীর মুখ। সমস্ত প্রাণ(পঞ্চ প্রাণ) এবং ইন্দ্রিয়রা যেখানে প্রতিষ্ঠিত তার নাম মুখ। ইনি মুখ্য প্রাণ (প্রাণাগ্নি) এবং উপনিষদ (ছান্দোগ্য ১। ২। ১২।) এঁকে 'আয়াস্য প্রাণ' বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন ইনি 'আয়াস্য' যেহেতু 'আস্যাৎ যৎ অয়তে', অর্থাৎ যেহেতু ইনি আস্য বা মুখের থেকে 'অয়' বা গতিময় হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন। প্রতি কথা, প্রতি বাক্য এই চেতনারই আয়তন, এই মহাপ্রাণই ছোট হয়ে, আমাদের মুখের কথা হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন; একান্ত অনুগত হয়ে, কণা বা ক্ষুদ্র হয়ে প্রকাশ পাচ্ছেন। এই জন্য এঁর নাম 'কন্যা'----যিনি দীপ্ত এবং কণায় কণায় প্রকাশ পাচ্ছেন।
এই নিজেকে কণায় কণায়, খণ্ড খণ্ড করে প্রকাশ করার যে শক্তি তার নাম 'বাক্' আর যা প্রকাশ পায় তার নাম 'বাক্য'। এই বিশ্ব ভুবন, এই দুনিয়া, এই মহাপ্রাণের বাক্যরাশি।
বাক্ই অগ্নি। উপনিষদে বাক্ই অগ্নি এ কথা বার বার বলা হয়েছে। আবার বালা হয়েছে, বাক্ আর প্রাণের মিথুনে সবাই জাত। প্রাণ মানেই অগ্নি, যিনি প্রকাশময়, উষ্ম, সবাইকে অগ্রে নিয়ে (নী--নি) চলেন।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, " তস্যৈ বাচঃ পৃথিবী শরীরং জ্যোতীরূপম্ অয়ম্ অগ্নিঃ। তৎ যাবতী এব বাক্, তাবতী পৃথিবী, তাবান্ অয়ম্ অগ্নিঃ"---- সেই বাকের শরীর হল পৃথিবী (বা যা কিছু মূর্ত্ত), আর জ্যোতীরূপ (আয়তন ব মূর্ত্তি প্রকাশময় যে স্বরূপ) তা এই অগ্নি। তাই যত পর্যন্ত এই বাক্, তত পর্যন্ত এই পৃথিবী(বা মর্ত্ত) এবং তত পর্যন্তই এই অগ্নি।
এই চেতনাই মূর্ত্ত হয়েছেন, সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম থেকে একেবারে পৃথিবী হয়েছেন, শরীর হয়েছেন, যা কিছু মূর্ত্ত তাই হয়েছেন, স্থূল হয়েছেন। এই জ্ঞান যাঁর লব্ধ হয়েছে তিনি গায়ত্রীর যে মুখ, যা বাক্, যিনি অগ্নি, যিনি পৃথিবী তাকে জেনে বৈদেহ জনক হয়েছিলেন। তাই এই বাক্ এঁর কন্যা, বিদেহ নগরের রাজকন্যা যিনি বৈদেহী সীতা।
------------------------------------------------------------------------------
বাংলায় অন্যান্য কয়েকটি উপনিষদ নিম্ন লিখিত সূত্র বা লিঙ্কে (web link) পাওয়া যাবে :
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_19.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_23.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/blog-post_24.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_2.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_64.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_64.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_39.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_20.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/12/blog-post_3.html
https://upanishadinbengali.blogspot.com/2019/11/brihadaranyaka-upanishad-in-bengali.html
Comments
Post a Comment